প্রণয়ের বিরহ পর্ব ১৬

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ১৬
তাসনিয়া রহমান স্নিগ্ধা

হাঁটাহাঁটি করছি কিন্তু সময় যেন এগুচ্ছে না। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করে শাশুড়ি মা সহ আর বাকি সবাই একসাথে বসে গল্প করছেন, ওখানে গেলাম।
‘ কি ব্যাপার,নাত বউ?তোর বোনকে নিয়ে তূর্য এখনও আসছে না কেন বলতো, কোনো সমস্যা হলো না তো?’(দাদী)
‘ বুঝতে পারছি না। সমস্যা হলে ফোন করতো তো। চলে আসবে, তুমি চিন্তা করো না।'(আমি)
মুখে দাদী কে চিন্তা করতে মানা করলাম ঠিকই কিন্তু আমার মন কু গাইছে। বারবার মনে হচ্ছে ওদের কোন একটা সমস্যা হয়েছে নিশ্চয়ই, এতক্ষণ দেরি হওয়ার কথা নয়।

‘ এই টেক্সি সিটি হাসপাতালে যাবেন?মামা দুটো ছেলে মেয়ের এ’ক্সি’ডে’ন্ট হয়েছে, ওদের তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিতে হবে নাহলে একটা ও বাঁচবে না।’
মেইন রোডের উপর একটা বাইক পড়ে আছে, এখনও স্লো মোশনে চাকা ঘুরছে আধা ভাঙাচোরা বাইকটার । একটু দূরে ছিটকে পড়ে আছে একটা ছেলে, আর তার থেকে কয়েক ফুট দূরত্বে একটা মেয়ে। তূর্য আর তাহমিমা!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ফুল স্পীডে বাইক চালানোর সময় উল্টোদিক থেকে একটা মালবাহী ট্রাক এগিয়ে ধেয়ে আসছিল ওদের দিকে কিন্তু তূর্য উত্তেজনায় খেয়াল করেনি। ফলাফল, একেবারে সামনাসামনি চলে আসার পর হুঁশ ফিরল যখন তখন সব শেষ হয়ে গেছে।এক ধাক্কায় বাইকটা কে ফেলে দিয়ে চলে গেল ট্রাকটি। তখন কয়েকজন ছেলে ওই রাস্তা দিয়েই নিজেদের হোস্টেলে ফিরছিল।স্পট এক্সি’ডে’ন্ট দেখে ওরা কি করবে বুঝে উঠতে পারলো না।ভাগ্য ওদের উপর সহায় ছিল বোধ হয়, একটা টেক্সি আসছিল উল্টো পথ থেকে। ওটাকেই থামালো ছেলেদের মধ্যে একজন।

‘এই টেক্সি সিটি হাসপাতালে যাবেন?মামা দুটো ছেলে মেয়ের এ’ক্সি’ডে’ন্ট হয়েছে, ওদের তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিতে হবে নাহলে একটা ও বাঁচবে না।’

টেক্সি ড্রাইভার ইশারায় তাড়াতাড়ি উঠাতে বললো রোগীকে।ছেলেরা ধরাধরি করে তূর্য আর তাহমিমা কে টেক্সি তে তুললো। মাথার একপাশে থেঁতলে গেছে তাহমিমার,তূর্যের অবস্থাও বেশি একটা ভালো না। ছেলেগুলো তাড়া দিল ড্রাইভার কে দ্রুত গাড়ি চালানোর জন্য।তাহমিমার মাথা তূর্যের কোলে , তূর্য কে আধ বসা করে রেখে ধরে রেখেছে ছেলেগুলো।জ্ঞান নেই দুজনের মধ্যে কারোরই, ছেলেগুলোর মুখে এক চাপা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বাঁচবে তো এই ছেলে মেয়ে দুটো? যেভাবে এক্সি’ডে’ন্ট হয়েছে, বাঁচার হার থার্টি পার্সেন্ট।

আধ ঘন্টার মধ্যে সিটি হসপিটালের সামনে টেক্সি থামলো। হসপিটালে দৌড়ে গেল ওদের মধ্যে দু’জন, গিয়ে সিস্টার আর বেঞ্চ নিয়ে এলো দুটো। বেঞ্চে করে দুজনকে ভিতরে নিয়ে গেল সিস্টার রা, এমার্জেন্সি তে একজন ডাক্তার ছিলেন তখন হসপিটালে,ওনাকে ই ডাকলো ওরা।

হসপিটালের বাইরে ছেলেগুলো দাঁড়িয়ে আছে, ভিতরে যায়নি আর। চুপচাপ খবর আসার অপেক্ষা করতে লাগলো, পিনপতন নীরবতা ভেঙে ওদের মধ্যে রায়হান বলে উঠলো,,

‘ দোস্ত, ওদের একজনের ফোন রাস্তায় পড়ে ছিল, আমি তুলে নিয়েছি। আচ্ছা এটা থেকে তো ওদের বাড়ির কারোর ফোন নাম্বার পাওয়া যেতে পারে। আমরা ওদের বাড়িতে খবরটা দেই, নাহলে পরে আমরা কেইস খেয়ে যাবো।'(রায়হান)
‘ হ্যা, তুই একদম ঠিক বলেছিস। তুই দেখ বাড়ির কারোর নাম্বার ফোনে পাওয়া যায় কিনা, আমি ওদিকে ড্রাইভার মামাকে আটকাই, উনি যদি পালিয়ে যায় তাহলে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে আমাদের।'(ওদের মধ্যে আরেকজন সাহিল,ও বলল)

রায়হান পকেট থেকে তাহমিমার ফোন টা বের করলো।বাইক থেকে পড়ে যাওয়ার সময় তাহমিমার , হাত থেকে ফোনটা দূরে ছিটকে পড়েছিল তাই খুব বেশি ক্ষতি হয়নি ফোনটার। ফোন হাতে নিয়ে নাম্বার খুঁজতে লাগল, কোনো লক দেওয়া নেই ফোনে তাই রায়হানের ফোন খুলতে অসুবিধা হলো না। খুঁজতে খুঁজতে কল লিস্টে আপু নামে সেভ করা একটা নাম্বার দেখলো।ওটা ওর বাড়ির নাম্বার হতে পারে ভেবে রায়হান ওই নাম্বারেই ডায়াল করলো,,,,

বারোটা পঁচিশ বাজছে কিন্তু ওদের আসার কোনো নাম গন্ধ নেই। টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে আমার। একটা কল করবো তারও উপায় নেই, পূর্ব সবাইকে কড়া হুকুম করেছেন কেউ যেন ওদের দুজনের মধ্যে কাউকেই কল না করে। একটা কান্ড জ্ঞান থাকা উচিত ছিল ওদের, বারোটার দিকে সারপ্রাইজ দেওয়ার কথা অথচ বারোটা পেরিয়ে গেছে কখনই কিন্তু ওদের পাত্তা নেই।

রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে হাঁটাহাঁটি করছেন কেক টেবিল টার সামনে, বারবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছেন সময় কত পেরুলো। আমি মুখটা কালো করে একটা বেঞ্চে বসে আছি হঠাৎ করে আমার ফোনটা বেজে উঠলো। ফোন বাজার শব্দ পেয়ে সবাই আমার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো,কে কল করেছে? আমি ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তাহমিমা কল করেছে । ওফফফফ, একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কলটা রিসিভ করলাম কিন্তু কথা বলার আগেই পূর্ব আমার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে কানে ধরে বললেন,,,

‘ এইসব কি শুরু করেছো তোমরা দুজনে? কয়টার দিকে আসার কথা ছিল তোমাদের আর কয়টা বাজে এখন সেটা খেয়াল আছে তোমাদের?আর ওই শ’য়’তা’ন টা কোথায়,ও কি ভয়ে কল করতে পারছে না। ওর কাছে ফোনটা দাও, আমি দেখি ওকে একটু।'(বেশ চড়া গলায় বললেন পূর্ব)

‘ আ’ম সরি টু সেই ভাইয়া আপনি যাকে ভাবছেন আমি সে না। আমি রায়হান, সিটি হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে আছি বর্তমানে আর এই ফোনটা যার তার এক্সি’ডে’ন্ট হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। একটা ছেলে আর মেয়ে ছিল বাইকে, মেয়েটার অবস্থা খুব খারাপ। আপনি কি ওদের বাড়ির কেউ, তাহলে তাড়াতাড়ি সিটি হাসপাতালে চলে আসুন।'(রায়হান)

ফোনটা পূর্বের হাত থেকে মাটিতে পড়ে গেল।কানের কাছে হাতটা এখনও উঠানো আছে কিন্তু হাত থেকে আলগা হয়ে ফোন পড়ে গেছে। ওদিকে রায়হান ‘হ্যালো স্যার, শুনতে পাচ্ছেন,হ্যালো হ্যালো ‘ করেই চলেছে। আমি উঠে এলাম উনার কাছে, উনি একদৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন কিছু বলছেন না। মনে হচ্ছে কেউ উনাকে এখানে দাবিয়ে রেখে দিয়েছে, এতোটাই চুপ হয়ে গেছেন! আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম উনার এমন আচরণে,কি হয়েছে উনার?কলে উনাকে কি বলেছে তাহমিমা? কাঁধে হাত রাখলাম উনার। শান্ত কন্ঠে শুধালাম,

‘ তাহমিমা আর তূর্য কি আসবে না বললো? ওরা কোথায় এখন, আপনাকে কি মেজাজ দেখিয়েছে ওভাবে বলেছেন বলে?'(আমি)
পূর্ব তখনও সামনের দিকে তাকিয়ে। উনার মুখের দিকে তাকালাম আমি। শাশুড়ি মা সহ সবাই পূর্বের কাছে এলেন, আমার বাবা মা ও চলে এসেছিলেন এর মধ্যে। শাশুড়ি মা পূর্ব কে জিজ্ঞেস করলেন ‘কি হয়েছে পূর্ব, তুই কিছু বলছিস না যে?ওরা কখন আসবে,দেরি হয়ে গেল তো অনেক।’ পূর্বের চোখের কোনে পানি জমে উঠছে, আমার বুকটা কেঁপে উঠলো উনার চোখে পানি দেখে। তাহমিমা তূর্যের আবার কোন বিপদ হয়নি তো? উনার হাতে ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,,

‘ কি হলো বলুন , ওরা ফোনে কি বলেছে ওরা কোথায়?’
‘ ওদের ওদের এক্সি’ডে’ন্ট হয়েছে স্নিগ্ধা,ওরা সিটি হসপিটালে এখন।’
থেমে থেমে বললেন পূর্ব। আমি মনে হলো কানে কিছু ভুল শুনলাম যেন, না এটা কখনো হতেই পারে না।আজ আমার বোনের জন্মদিন,আর আজ এইরকম কিছু কখনই না।

‘ কি যা তা বলছেন আপনি? ওদের এক্সি’ডে’ন্ট হবে কেন, আপনি মজা করছেন তাই না, বলুন?'(আমি)
‘ না স্নিগ্ধা। আমি মজা করছি না, ওদের সত্যিই!!চলো আমাদের সিটি হসপিটালে যেতে হবে এক্ষুনি।’

পূর্ব আমার হাত টা ধরে টেনে নিয়ে চললেন গাড়ির দিকে। গাড়িতে আমাকে বসিয়ে দিয়ে নিজে ড্রাইভিং এর সিটে বসে নিজেই ড্রাইভ করতে শুরু করলেন। ফার্স্ট ড্রাইভ করছেন পূর্ব, আর আমি পাশেই পাথরের মুর্তির মতো চুপ করে বসে আছি।কি শুনলাম এসব, কিছুই মাথায় ঢুকছে না।আ’ম ড্যাম শিওর পূর্ব আমার সাথে মজা করছেন, হয়তো ওরাই কোনো সারপ্রাইজ প্লান করেছে আমাদের জন্য আর তাই আমাদের ওদের কাছে ডেকেছে।

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ১৫

আমি যদি না যাই সেজন্য পূর্ব আমাকে মিথ্যে এক্সি’ডে’ন্ট এর গল্প ফাঁদছেন,হ্যা এটাই হবে। পূর্বের দিকে তাকালাম, উনার মুখটা অমাবস্যা রাতের মতোই নিকষ কালো হয়ে গেছে, বারবার হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে নিচ্ছেন। খানিকটা খটকা লাগলো আমার, উনি আমার সাথে মজা করলে এভাবে কাঁদবেন কেন, সত্যিই ওদের এক্সি’ডে’ন্ট হয়নি তো!!!!!!

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ১৭