প্রণয়ের বিরহ পর্ব ১৫

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ১৫
তাসনিয়া রহমান স্নিগ্ধা

‘নাতবউ, দাঁড়িয়ে আছিস কেন?বসে পড়।’
চেয়ার টেনে বসলাম আমি আর কেয়া।দাদী হাসি হাসি মুখ করে সবার প্লেটে খাবার দিচ্ছেন। খাবার দিতে দিতে বললেন,,
‘ আমার নাতির চোখ ভালো বুঝেছিস আশরাফ? নাহলে কি এমন সোনার টুকরো নাতবউ খুঁজে নিয়ে আসে আমাদের জন্য,কি বলিস তুই?'(দাদী)

‘ হ্যা মা। তোমার নাতির পছন্দ আছে ভালোই।’
আমার দিকে তাকিয়ে বললেন চাচা শশুর আশরাফ চৌধুরী।চাচী তখন মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন,’ এই মেয়ের প্রশংসা করবে নাকি খাবার ও খাবে!’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

চুপচাপ খাবার খাওয়ায় মনোযোগ দিলো সবাই। আমি খেয়ে উঠে চলে এলাম নিজের রুমে,কেয়ার খাওয়া হয়নি বলে ও এলো না। রুমে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালাম।এক তলায় পূর্বের রুম হওয়ায় এখানের জানালা আর মাটি প্রায় সমান সমান ই।বেশ বড় জানালা এই রুমের ডানদিকে। তখন পূর্ব স্যার কে ওভাবে ঘোল খাইয়ে দিতে বেশ ভালোই লেগেছে আমার।

মজা পেয়েছি ব্যাপারটায়।রাত তিনটার দিকে তাহমিমার সাথে দেখা করে আসার সময় গেটের ভিতরে ঢুকে পড়েছি কোনোরকমে খালেক চাচার চোখের আড়ালে কিন্তু বাড়ির ভিতরে ঢুকা হলো মুশকিল। বাড়ির দরজার সামনে চেয়ারে শশুর বাবা কে নিয়ে শাশুড়ি মা বসে আছেন দেখে বেশ অবাক হয়ে গেছিলাম।

এতো রাতে উনারা না ঘুমিয়ে এইভাবে জেগে আছেন দেখে কিছুটা সন্দেহ হলেও সেটাকে পাত্তা না দিয়ে বাড়ির পিছন দিকে চলে এলাম। পেছনের দিকে বেলকনিতে দরজা বন্ধ, জানালা সব কটা বন্ধ করে রাখা।অগ্যতা সকাল হওয়ার অপেক্ষা করতে হলো, সকালে স্যার ঘুম থেকে উঠে যখন আমাকে খোঁজাখুঁজি করছিলেন তখন এক ফাঁকে জানালা খুলে দেখেছিলেন বাইরে টা।

ব্যাস কাজ শেষ আমার,স্যার চলে যাওয়ার পর পরই জানালা দিয়ে রুমে ঢুকে সোজা ওয়াশ রুমে চলে গেলাম।
বাগানের পুরো দৃশ্যটা জানালায় দাঁড়িয়ে দেখা যায়। খোঁপা করে রাখা চুল গুলো ছেড়ে দিয়ে বাগানের দিকে তাকিয়ে রইলাম।কি সুন্দর গোলাপ ফুল ফুটেছে সেখানে। গোলাপের প্রতি আমার বরাবরই একটু বেশি দুর্বলতা আছে,সেই গোলাপ হাতে পাওয়ার লোভ হলো খুব।

জানালা দিয়ে বের হওয়ার জন্য রেডি হয়ে নিলাম,এদিক দিয়ে গিয়ে ফুল গুলো তুলে আনলেই হবে।কেউ কিছু দেখতেও পাবে না আর জানতেও পারবে না।জানালা দিয়ে এক পা বের করেছি কি করিনি তখনই কে যেন পিছন থেকে আমার হাত টা টেনে ধরলো,টাল সামলাতে না পেরে পিছনের দিকে উল্টে পড়লাম।

আনোয়ার চৌধুরী আর আশরাফ চৌধুরীর আজ মায়ের সাথে আবার গোল টেবিল বৈঠক বসেছে। বৈঠকের বিষয় একটাই, এই সম্পত্তির সমান সমান মালিকানা চাই সবারই। মহুয়া চৌধুরী একবার বড় ছেলের দিকে তাকালেন আরেকবার ছোট ছেলের দিকে।ছেলে বউ রা মহুয়া চৌধুরীর পাশে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে,মেয়েরা ও তাই। কিছুক্ষণ নিরবতা চলার পর মুখ খুললেন মহুয়া চৌধুরী।

‘ আশরাফ,এতো দিন তো তোর সম্পত্তি নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তাহলে হঠাৎ করে আজ সম্পত্তির চিন্তা এতো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে কেন?'(মহুয়া চৌধুরী)
‘ এতো দিন পূর্বের বিয়ে হয়নি মা। আমি চেয়েছিলাম ভাইয়ের ছেলে পূর্বের সাথে সিয়ার বিয়ে দিয়ে আমাদের সবকিছু আমাদের হাতের মুঠোয় রাখতে। কিন্তু ভাই সেটা মেনেছে কি,ও কোথা থেকে একটা বাইরের মেয়েকে ওর ছেলের বউ করে এনেছে।

এখন আমার মেয়ের যদি পূর্বের সাথে বিয়ে নাই হলো তাহলে আর এইসব ঝামেলা পুষিয়ে রেখে লাভ কি। এখন সব সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা হোক, আমি আমার সবকিছু সুদে আসলে ফেরত চাই।'(কঠিন মুখে বললেন আশরাফ চৌধুরী)
আনোয়ার চৌধুরী এই দিকের আলোচনায় কোনো খেয়াল দিতে পারছেন না। উনার কপালে ভাঁজ পড়েছে চিন্তার,কি করে এখন সবকিছু ম্যানেজ করবেন সেটাই বুঝে উঠতে পারছেন না।

শুকনো ঢোক গিললেন তিনি।কাল রাতে হঠাৎ করে চোখে পড়েছে সম্পত্তির সব দলিল হারিয়ে গেছে,যেই ড্রয়ারে সব দলিল রাখা হয়েছিল সেই ড্রয়ার হঠাৎ খোলা দেখে কিছুটা সন্দেহ হয় উনার। আশঙ্কা নিয়ে ড্রয়ার ভালো করে খুলতেই দেখেন কাগজ পত্র সব উধাও, একটা কাগজের টুকরো পর্যন্ত ড্রয়ারে নেই। পূর্বের দায়িত্বে উনার এতো বড়ো কোম্পানি, তার সব কাগজপত্র ও এখানে ছিল। পূর্ব কে এবার কি জবাব দিবেন তিনি এটার চিন্তায় হার্ট অ্যাটাক করতে বসেছিলেন কাল রাত্রিরে।বড় ছেলে কে বারবার কপালের ঘাম মুছতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন মহুয়া চৌধুরী।

‘ কি হয়েছে আনোয়ার? তুই কি কিছু নিয়ে চিন্তিত?'(মহুয়া চৌধুরী)
‘ না মা।তোমরা কি বলেছিলে বলো,,,,'(আনোয়ার চৌধুরী)
‘ মা শোনো, আমি কোনো ঝামেলায় পড়তে চাই না আর। আমার যেই সম্পত্তি পাওয়ার অধিকার আছে সেটুকু তুমি আমাকে বুঝিয়ে দাও। আমি আমার মেয়েকে শান্তিতে বিয়ে দিতে পারবো অন্য কোথাও।'(আশরাফ চৌধুরী)

‘ এতো তাড়াহুড়ো করার কি আছে? আমি তো বেঁচে আছি এখনও পর্যন্ত। তুই যেটুকু পাওয়ার সেটুকু ই পাবি আর আনোয়ার তুই, তুই ও ঠিক ততটাই পাবি যতটা আশরাফ পাবে। আমি আমার সব সন্তান কেই সমান মালিকানা করে দিয়ে তারপর ম’র’বো। এতো চিন্তা করিস না তোরা।’

মহুয়া চৌধুরী বিরস মুখে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে উনার। এতো সুন্দর একটা সাজানো সংসার কিনা এখন তার ছেলেরা ভেঙে ফেলতে চাইছে। চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেলেন তিনি। আশরাফ চৌধুরী ও উঠে চলে গেল।একে একে বসার রুমটা ফাঁকা হয়ে গেল। আফসানা চৌধুরী তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, সবাই যাওয়ার পর আনোয়ার চৌধুরীর পাশে বসে উনার কাঁধে হাত রাখলেন।

‘ এত চিন্তা করো না তুমি।সব ঠিক হয়ে যাবে।’ (আফসানা চৌধুরী)
আনোয়ার চৌধুরী কিছু বললেন না। শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন, নিশ্চয়ই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। পূর্ব যেনো এইসব কিছু না জানে শুধু এইটুকুই চাওয়া উনাদের দুজনের, পরিবারের এই ইতিহাস এই ঠুনকো সম্পদের ঝামেলায় একমাত্র ছেলে যেন না জড়ায়।

বেডের ঠিক মাঝখানে বসে আছি আর আমার সামনে পূর্ব বসা। কঠিন মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন উনি, চাহনি দেখে মনে হচ্ছে যেন আমাকে খেয়ে ফেলার মতো ইচ্ছে হয়েছে উনার।পায়ে হাত বুলাতে লাগলাম আমি।ফ্লোরে পড়ে গিয়ে কোমর পা দুটো ই গেছে। পূর্বের ও লেগেছে বেশ ভালোই।

‘ কি খাও তুমি? শরীরে এতটুকু ও শক্তি নেই তোমার।দেখে তো বেশ পাতলা মনে হচ্ছে কিন্তু এতো ওজন বাপরে, একটা আলুর বস্তা আমার উপরে পড়েছিল মনে হচ্ছে।'(বেশ রাগী গলায় বললেন উনি)
চোখ পাকিয়ে উনার দিকে তাকালাম আমি। কি বললো আমাকে? আমি আলুর বস্তা হ্যা? পায়ে হাত বুলানো বাদ দিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘ আপনি কি বললেন আমি আলুর বস্তা?এই শোনেন মশাই, আমার না এতোটা ও ওজন নয় যেটা তে আমাকে আলুর বস্তা মনে হতে পারে। মাত্র পঁয়তাল্লিশ কেজি ওজন আমার।'(কোমরে হাত দিয়ে বললাম আমি)

‘ ইশশ্ কি স’র্ব’না’শ! পঁয়তাল্লিশ কেজি তারপরও এটাকে মাত্র বলছো তুমি। এতো ওজন তো একটা কি বলবো আর, না বলি। তুমি তোমার লো ব্রেইন নিয়ে ওসব কিছু বুঝবে ই নাকি আবার।বাই দা ওয়ে আমার পায়ে ব্যথা করছে খুব, সাথে হাত দুটোও। তোমার জন্য ফ্লোরে পড়ে গিয়ে কোমর ও ব্যথা হয়ে গেছে। এখন লক্ষী মেয়ের মতো আমার পা দুটো টিপে দাও তো,ব্যথা করছে খুব।'(আয়েশ করে বসে বললেন পূর্ব)

‘ বয়েই গেছে আমার আপনার পা টিপে দিতে।কে বলেছিল আপনাকে আমাকে ওইভাবে পিছন থেকে টেনে ধরতে। ওভাবে হেঁচকা টান দিলে টাল সামলানো যায় নাকি হ্যা,সে সেজন্যই তো আমি পড়ে গেলাম আর আমার পা আর কোমর গেল। ওফফফফ মা গো,কি ব্যথা।'(আমি)

একটু ব্যথা ছিল কাতর স্বরে আরেকটু ব্যথা বাড়িয়ে দিলাম। পূর্ব আমার দিকে কেমন ভাবে যেন তাকিয়ে আছেন,ককানো শুরু করেছিলাম মাত্র ই কিন্তু উনার দৃষ্টি দেখে ব্যথা সব হাওয়া। সুবিধাজনক ঠেকছে না উনার নজর। কষ্ট করে একটু হাসি আনলাম মুখে। উনি আমার থেকে একটু দূরে বসেছিলেন, উনার একেবারে কাছে এসে বসলাম।পা মেলে বসে আছেন উনি, তাড়াতাড়ি করে পা টিপে দিতে লাগলাম।

ব্যথা পেয়েছি আমি আর পা টিপে দিতে হচ্ছে উনার।যত কপাল আমার। পূর্ব মনে মনে হাসছে, জোরে হাসতে গিয়েও পারছে না। ঠোঁট টিপে হাসতে লাগলো, একটু শুধু অন্য নজর দেখেই আমার যা অবস্থা। বহুত কষ্টে হাসি চেপে রেখে কঠিন গলায় বলল,,

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ১৪

‘ কিভাবে পা টিপছো?টেরই তো পাচ্ছি না, ভালো করে কাজ করো। মনে রেখো তোমার এই হ্যাভি ওয়েটের জন্যই কিন্তু আমার পায়ে ব্যথা।'(পূর্ব)
‘ কি বললেন আপনি????????'(আমি একটা চিৎকার দিলাম উনার দিকে তাকিয়ে)

প্রণয়ের বিরহ পর্ব ১৬