অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ৩

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ৩
তাশরিন মোহেরা

রান্নাঘরের টুংটাং ধ্বনি চারিদিক মাতিয়ে তুলছে। সাথে পো’ড়া ঘ্রাণটা আরও গাঢ়ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। মুগ্ধের লেখার এক ফাঁকে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘আমি যে ঘ্রা’ণটা পাচ্ছি তুমিও কি তাই পাচ্ছো, মুগ্ধ? আগের চাইতে বেশি?’
মুগ্ধ খাতার দিকে চোখ রেখেই বললো,

‘এই পো’ড়া গ’ন্ধে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি, ম্যাম। প্রতিদিনই ভাইয়া কিছু না কিছু পু’ড়ে ফেলে।’
মুগ্ধ আর মুখরের জন্য বড্ড মায়া হলো আমার। আহা! কি কষ্টেই না নিজেদের দিন পার করছে দুই ভাই। ইদানীং মানুষের প্রতি প্রীতি-মায়া আমার একটু বেশিই যেন বাড়ছে। মুখরের উপর দুঃখ করে মন মাঝারে বললাম, ‘আহারে মুখর সাহেব! আপনার প্রতি মায়া হচ্ছে। তবে আপনি পারবেন, অবশ্যই পারবেন সব সামলাতে!’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আমার উৎসাহটা মুখরের কানে পৌঁছালো না ঠিকই তবে মনে মনে এমন করে সবাইকে উৎসাহিত করতে আমার বেশ লাগে! সেকেন্ড খানেক পর আমি পড়ানো শেষ করে উঠতে যাবো এমন সময় মুগ্ধের ডাক পড়লো। আমিও সায় দিলাম যেতে। দেখি সে নাস্তা নিয়ে এসেছে আমার জন্য। তবে আজ অন্যদিনের মতো বিস্কিট কিংবা পাউরুটি নাস্তায় নেই। আছে ভিন্ন কিছু। ভাবলাম,’আহা!

এই প্রথম কোনো ছেলের হাতে বানানো নাস্তা খেতে যাচ্ছি। বাহ! কি সৌভাগ্য আমার।’
খাবারটা ঠিক আমার সামনেই রাখলো মুগ্ধ। বরাবরের মতোই খাবার দাবারের প্রতি আমার তেমন একটা আগ্রহ নেই। কিন্তু আজ নাস্তায় ভিন্ন কিছু দেখে খাবারের প্রতি আগ্রহটা আরও কমে গেছে। হ্যাঁ! ঠিকই দেখছেন। আগ্রহ বাড়ার বদলে কমে গেছে। কারণ নাস্তায় আজ এসেছে পো’ড়া কালো দুটো রুটি আর আধসেদ্ধ আলুভাজি। এটুকু দেখেই ভাবলাম আমার সৌভাগ্য ক্রমেই দু’র্ভা’গ্যে নেমে এসেছে! বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকতে গিয়েও বোধহয় আমার এতোটা বেগ পো’হা’তে হয়নি যতটা রুটিটুকুর আকার বুঝতে পো’হা’তে হচ্ছে!

নাস্তা দিয়েই মুগ্ধ আমার দিকে উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে। যেন আমি একজন মাস্টারশেফ আর তার মুখর ভাই একজন প্রতিযোগী! আমিও তার দিকে জোরপূর্বক একটা হাসি দিয়ে রুটিটা মুখে পুরলাম। যত যাই হোক, বাইরে তো ভদ্রতা দেখাতেই হবে। তবে ভদ্রতার খাতিরেও মুখের খাবারটা আর গ’লা’ধঃ’ক’র’ণ করা গেল না আমার পক্ষে। রুটিতে তো কোনো লবণ নেই-ই বরং আলুভাজিতে একদলা লবণের সমাহার আর মসলায় ভরপুর। আমি মুখশ্রী বিকৃত করে মুখের খাবারটা ফেলে দিলাম। এতে হেসে কুটি কুটি মুগ্ধ। হাসতে হাসতে সে বললো,

‘আমি জানতাম, ম্যাম! খাবারটা আপনার পেট পর্যন্ত যেতে পারবে না। এটা হলো আমার মুখর ভাইয়ের স্পেশাল টেলেন্ট। এমন খাবার বানায় যা কেউই গি’ল’তে পারে না।’
এটুকু বলে সে আবারো হো হো করে হাসতে লাগলো। আমি এক চুমুক পানি খেয়ে মুগ্ধকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘তোমরা কি রোজ এগুলোই খাও?’
সে মুখটা তখনি মলিন করে বললো,
‘হুম!’

হঠাৎ ফোনের রিংটোনে চমকে উঠলাম। আজ কিছু বন্ধুদের সাথে সাক্ষাৎ করার কথা ছিল আমার। আমি এদিক সেদিক একবার তাকিয়ে দেখি কোথাও মুখর সাহেব আছে কিনা! নাহ! সে আশেপাশে কোথাও নেই। আমি ব্যাগ থেকে তক্ষুণি একটা আয়না আর লিপস্টিক বের করলাম। আয়না খুলে লিপস্টিক ঠোঁটে দেওয়ার মাঝপথে দেখি মুগ্ধ থুতনিতে দুইহাত রেখে খুব মনোযোগ দিয়ে আমার কান্ড দেখছে। আমি লিপস্টিকটা পুনরায় ব্যাগে রেখে বললাম,

‘কি দেখছেন মুগ্ধ সাহেব?’
মুগ্ধ হালকা হেসে বললো,
‘এই লিপস্টিকে আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে ম্যাম!’
আমি মুচকি হেসে তার মাথায় একটা চাপড় মারি। এটা আমার বহু পুরোনো অভ্যাস। খুব বেশি লজ্জা পেলে আমি পাশের জনকে চাপড় মারি। এরপরপরই তাড়া দিয়ে মুগ্ধকে বিদায় দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

আজ কালি পুজোয় ভার্সিটি বন্ধ থাকায় খুব রয়েসয়ে মুগ্ধের বাসায় এলাম। এসে দেখি মুগ্ধ এখনো ঘুম থেকে উঠেনি। আজ ছুটি বলে দেরিতে উঠছে। মুগ্ধের জন্য পড়ার রুমে অপেক্ষা করছি। তখনি আমার চোখ যায় ঠিক সামনের জানালায়। সাথে সাথে চোখ সরিয়ে ফেলি। তা দেখেও না দেখার ভান করছি। কিন্তু তাতেও কিছু হলো না! চোখটা বারবার সেদিকে যাওয়ার তাড়া দিচ্ছে মনকে। শেষমেশ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠে পড়ি। রুম থেকেই ডাকতে থাকি,

‘মুখর সাহেব! আছেন? মুখর সাহেব?’
মুখর শার্টের হাতা গুটিয়ে সেই চেনা পরিচিত বিরক্তিমাখা চাহনি দিয়ে সামনে এলো। ভ্রু কুঁচকে বললো,
‘কি হলো, মিস.তিথিয়া? কোনো সমস্যা?’
আমি তড়িৎ রুম থেকে বেরিয়ে তার ঠিক সামনে এসেই বললাম,

‘ঐযে! ওদিকে একজন আমাকে অনেকক্ষণ হলো ডিস্টার্ব করছে!’
আমার চোখে একঝাঁক ভয় দেখে মুখরও বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সে আমার তাক করা আঙুল অনুসরণ করে সেদিকে তাকালো। ব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
‘কে ডিস্টার্ব করছে? ব্যাটাকে এখনই শায়েস্তা করছি।’
আমি মুখরের কথায় কিছুটা সাহস পেলাম। বললাম,
‘আপনি আমাকে প্রমিস করুন, তাকে একদম ধরে দূরে ফেলে দিয়ে আসবেন! প্রমিস করুন!’
মুখর এবার ভ্রুজোড়া আবারো কিঞ্চিৎ কুঁচকে বললো,

‘মানে?’
আমি তাকে তাড়া দিয়ে বললাম,
‘প্লিজ মুখর সাহেব। আপনি আগে আমাকে প্রমিস করুন, প্লিজ!’
মুখর কিছু বুঝতে না পেরেও দুবার মাথা দুলালো। দ্বিধায় পড়ে বললো,
‘হ্যাঁ, ঠিক আছে। প্রমিস করছি!’
এবার আমাকে নিয়ে সে জানালার কাছে যায়। জানালার বাইরে উঁকি দিয়ে বলে,

‘কে ডিস্টার্ব করছে আপনাকে? বলুন আমাকে? কে আমাদের বাড়ির শিক্ষিকাকে ইভটিজিং করার সাহস পায়?’
আমি মুখরের পেছন হতে জানালার পাশের দেয়ালে আঙুল তাক করলাম। সেখানে একটি মাকড়সা বসে আছে। অন্য কোনো পোকামাকড় আমি তেমন ভয় না পেলেও মাকড়সাকে আমি যমের মতো ভয় পায়। ভীতসন্ত্রস্ত কণ্ঠে মুখরকে বললাম,

‘এই যে, এই মাকড়সাটা আমাকে ডিস্টার্ব করছিলো।’
মুখর কিছুক্ষণ মাকড়সাটার দিকে তাকিয়ে পুনরায় আমার দিকে ফিরলো। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে বললো,
‘আপনি আমার সাথে মজা করছেন, মিস.তিথিয়া?’
আমি প্রত্যুত্তরে বললাম,

‘আশ্চর্য তো! আমি আপনার সাথে কেন মজা করতে যাবো? আমি এখানে আসার পর থেকে সে আমাকে ইভটিজিং করে যাচ্ছে! দেখুন, দেখুন। এখনো কেমন চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে!’
মুখর কোমড়ে দু’হাত গুঁজে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। নিজের রাগটুকু সামলালো যেন। আমি তাকে তাড়া দিয়ে বললাম,
‘কি হলো, মুখর সাহেব! মাকড়সাটাকে ধরে দূরে ফেলে আসুন। আপনি কিন্তু প্রমিস করেছেন।’

সেই মুহুর্তেই পড়ার রুমে আগমন ঘটে মুগ্ধের। সে সোজা মাকড়সাটার দিকে এগিয়ে তাকে ধরে ছুড়ে মারে জানালার বাইরে। এরপর আমার দিকে ফিরে শাহরুখ খানের মতো দু’বাহু প্রসারিত করে বলে,
‘মে হু না!’

আমি ফিক করে হেসে উঠলাম তার আচরণে। মুখর সাহেবকে কিছুটা উপহাস করে বললাম,
‘আমার স্টুডেন্ট দেখি আপনার থেকেও বেশি সাহসী, মুখর সাহেব।’
মুখর আমার দিকে বিরক্তিতে চেয়ে বললো,
‘সাহসী না ছাঁই! শিক্ষিকা – ছাত্র দুইটাই পাগল।’

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ২

এই বলে হনহনিয়ে চলে যায় মুখর। আমি তার দিকে তাকিয়েই ঠোঁট বের করে উপহাস করলাম আরও একবার। এরপর মুগ্ধকে বললাম,
‘দেখেছো, তোমার ভাইয়া কেমন জ্বলছে তোমায় নিয়ে! হুহ!’

অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব ৪