অনুভবে তুই পর্ব ১৮

অনুভবে তুই পর্ব ১৮
লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া

তপ্ত অলস দুপুরের সোনালি সূর্যের ঘন আলোয় উদ্ভাসিত পৃথিবী। গ্রামীণ পরিবেশের মুগ্ধতা ছড়িয়ে আছে চর্তুদিকে। অদ্ভুত নীরবতার মাঝে রেইনট্রি গাছের ঝিঁঝিঁ পোকার কর্কশ আওয়াজ ত্যক্ত করে তুলেছিল দুপুরটাকে। সিমেন্টের মেঝে উত্তপ্ত হয়ে পা পুড়িয়ে দিচ্ছিলো রোজার। ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সে। বাড়ির পেছনের ঘন জঙ্গল, ঝোপঝাড় থেকে দৈবাৎ হাওয়া এসে ওড়িয়ে দিচ্ছিলো ওর ঘন কেশ। চুলগুলো হালকা করে ঠেলে পেছনে সরিয়ে হাতখোঁপা বেঁধে কাঠের চেয়ারে বসে পড়লো সে। ছাদের অর্ধেকটা জুড়ে রয়েছে কাঁঠাল গাছের একাংশ। রেলিঙের ওপর বসে পাতা ছিঁড়তে ছিঁড়তে উৎস তীব্র কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘ফুপি যে তোকে এসব কথা বলেছে আমাকে জানাস নি কেন তুই?’

রোজা তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল, ‘এসব তোমাকে কে বললো?’
‘যেখান থেকে হোক শুনেছি। তুই আগে আমাকে সত্যিটা বল। আমাদের বাড়ি ছেড়ে আসার পেছনে ওই একটা কারণই কি আছে?’
রোজা থমকে গেল, ‘মানে?’
‘তুই কি ছোট বাচ্চা রোজানু? আমি তোর কাছে পুরো ঘটনাটা শুনতে চাইছি। ফুপি তোকে কেন এত অপমানজনক কথা বললো?’
রোজা বিরক্ত হলো। এসব কথা উৎস জানলো কীভাবে? সে শক্ত কন্ঠে বলল, ‘এসবই তোমার প্রয়োজনীয় কথা? এজন্যই ছাদে ডেকেছিলে?’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘হুম। কিন্তু তুই কথা এড়িয়ে যাচ্ছিস। হুট করে এত বড় হয়ে গেলি তুই? আমাকে নিজের ভাই মনে করিস না? তাহলে এত ভনিতা কেন তোর?’
রোজা বোঝানোর চেষ্টা করল, ‘ভাইয়া তুমি ভুল বুঝছো আমাকে। হ্যাঁ, এটা সত্যি। আমি তোমার ফুফুর বলা তিক্ত কথাগুলোর ভার সইতে না পেরে চলে এসেছি। কিন্তু তোমাকে আমি নিজের আপন লোক মনে করি।’
উৎস রাগী স্বরে বলল, ‘আমাকে একবারও জানালি না কেন? ফুপিকে বুঝিয়ে দিতাম তুই আসলে কে!’
রোজা হতাশ হয়ে বলল, ‘ঝামেলা তো আমার সাথে হয়েছে। তোমার সাথে না। শুধু শুধু তোমাদের জড়িয়ে লাভ কী? তাছাড়া ওনি যা বলেছেন সবগুলো সত্যি না হলেও কিছু কথা নির্মম সত্য।’

উৎস জিজ্ঞেস করল, ‘কোনটা সত্যি রোজানু? ভাই যে তোকে পছন্দ করে এটা নাকি তুই লোভী ওটা?’
রোজা আঁৎকে ওঠলো। মুখ রক্তশূণ্য হয়ে গেল। ফ্যাকাসে মুখখানা তীব্র গরমে ঘেমে একাকার হয়ে গেলো। আমতা-আমতা করে বলল, ‘কী বলছো তুমি?’
‘ভাবিস না আমি কিছু জানি না৷ তোকে সেদিন ফুপি কী কী বলেছিল সেসব আমার মস্তিষ্কে খুব সুন্দর করে গেঁথে আছে। তাই সত্যটা বললে আমি খুশি হবো।’
রোজা ওড়নার একাংশ মুঠো করে রেখেছিল হাতের তালুতে। চোখদুটো মুদিত করে নিঃশ্বাস বন্ধ করে নিজের আবেগ, অনুভূতি লুকানোর কঠোর প্রচেষ্টা চালিয়ে শুকনো একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘সবসময় সত্য স্বীকার করা যায় না ভাইয়া। কিছু কিছু সত্য মিথ্যের আড়ালে চাপা থাকাই ভালো।’

উৎস কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, ‘তাহলে কি ধরে নেব তুইও ভাইয়ার জন্য কিছু অনুভব করিস?’
রোজা জানে না বা স্বীকার কর‍তে চায় না সত্যটা। নিজের কাছে নিজেই পরিষ্কার নয় ব্যাপারটা নিয়ে, উৎসকে সে কি বলবে। রোজা ঢোক গিলে ব্যগ্র কন্ঠে বলল, ‘একদম না। ঝামেলাটা তোমার ভাই শুরু করেছে। ওনিই তোমার ফুফুর কাছে আমার নামে বদনাম করেছেন বলেই আমার বিশ্বাস।’
উৎস চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কেন এমন মনে হলো তোর?’

‘কেননা, ওনি সেই প্রথম থেকে আমার পিছু লেগে আছেন। যদিও কোনোদিন অসভ্যতামি বা খারাপ কিছু নজরে পড়েনি তথাপি আমি বারবার ওনাকে এড়িয়ে চলছিলাম। কারণ পড়াশোনা করতে গিয়ে কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে চাই নি। বলতে বাঁধা নেই, ওনাকে খুবই বিবেকবোধ সম্পন্ন মানুষ বলে মনে হয়েছিল আমার। ওনার আমার প্রতি এত কেয়ারিং থাকাটা আমি কোনোদিন কারো সাথেই আলোচনা করিনি বা কাউকে জানাইনি। বিষয়টা নিজের মনের মধ্যে রেখে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে এটা বলো, যেখানে কেউওই এ সম্বন্ধে ঘূর্ণাক্ষরেও কিছু ভাবে নি; তোমার ফুফু জানলো কীভাবে? তার মানে কী এটাই নয় তোমার ভাই-ই ওনাকে বলেছে? যেহেতু ফুফুর সাথে তার খুব ভালো সম্পর্ক!’

উৎস রোজার প্রতিটি কথা মনোযোগ সহকারে শুনলো। বোনের মুখের কথা আর চোখ দুটো যেন ভিন্ন ভিন্ন কথা বলছে। সূঁচালো চক্ষু মেলে একপলক রোজাকে দেখলো। অতঃপর বিদ্রুপের সুরে বলল, ‘আচ্ছা রোজা, এই বিশ্রি ঘটনাটাকে দূরে সরিয়ে, নিজের মনকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখ তো ; ভাইয়ের জন্য তুই কিছু ফিল করিস কি-না। আই মিন, ভাইকে তুই ভালোবাসিস কিনা? ড্যাম শিওর আমার ভাই কারো কাছে তোর নামে বদনাম করেনি।’
রোজা চিবুকে হাত রেখে পূর্ণদৃষ্টিতে ভাইকে দেখলো। উৎস জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আছে। রোজা থতমত খেলো। বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারলো না উৎসের প্রশ্ন তীরে বিদ্ধ হওয়ার ভয়ে। দ্রুত নেমে পড়লো ছাদ থেকে।

আষাঢ়ের চতুর্থ দিবস। শুভ্র-কৃষ্ণ মেঘে পরিপূর্ণ আকাশ, জলে থইথই জলধার। আকাশের কান্না থামানোর কোনো অবকাশ নেই। গত দু’দিন যাবৎ একনাগাড়ে কেঁদেই চলেছে সে। ঘনকালো তুলোর পসরা সাজিয়ে সিক্ত করে তুলেছে প্রতিটি ক্ষণ। এরইমধ্যে দু’টি দিন পেরিয়ে গেছে। আদ্রিশের প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে উৎকন্ঠার সহিত। অপেক্ষা করছে কখন সুহানা শেখের কাছে এ বিষয়ে কৈফিয়ত চাইবে সে। কিন্তু রোজা যেদিন চলে গেল সেদিনই সুহানা নিজের বাড়ি ফিরে গেছেন ইশাকে নিয়ে, যারজন্য কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ পায় নি আদ্রিশ। প্রথমে মাতৃতুল্য ফুফুর বিরুদ্ধে এমন কুৎসিত অভিযোগ মানতে না পারলেও বাড়ির কাজের মহিলাটাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে আদ্রিশ। একদিকে রোজাকে না দেখার যন্ত্রণা ওকে কুঁড়েকুঁড়ে খাচ্ছে। আর অন্যদিকে উৎসটাও খালার বাড়িতে গিয়ে আয়েশ করে দিন কাটাচ্ছে। ওর আসার নামগন্ধই নেই। ত্যক্তবিরক্ত আদ্রিশ নিজের রাগ কমাতে সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজলো।

সেদিন রোজাকে নিয়ে হরষপুর গ্রামে এসে আটকে পড়েছে উৎস। মাঝেমধ্যে নেটওয়ার্ক-ও ডিসকানেকটেড হয়ে যায়। এরকম বাজে অবস্থায় বেশিরভাগ সময়ই বাড়ির কারো সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না উৎসের। নেহাকে ফোন করে সুহানা শেখের বিষয়টি গোপন করে খালার বাড়িতে আটকে পড়ার ঘটনাটি জানিয়ে দিয়েছিল সে; যার জন্য ওদের বাড়ির প্রতিটি লোকজন নিশ্চিন্ত হয়েছে। বৃষ্টির কারণে গ্রামের পথঘাট হাঁটু সমান জলে ডুবে গেছে। রোজাদের বাড়ির উঠোন অবধি ওঠে এসেছে পানি। তারমধ্য আবহাওয়া অত্যধিক ঠান্ডা থাকায় উৎসের জ্বর ওঠে, গলা বসে গেছে। সেজন্য রোজার মা সুলতানা বেগম বোনপো’কে কিছুতেই শহরে দূর বাড়ির চৌকাঠ-ই পেরুতেই দিলেন না। কম্বলের ভেতর গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় হঠাৎ উৎসের ফোনটির উচ্চস্বরে থরথর করে কেঁপে ওঠলো। লাফিয়ে ওঠে ফোন রিসিভ করে দ্রুতগতিতে জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যালো কে?’

‘তুই কী সারাজীবন বোনকে পাহারা দেওয়ার জন্য ওই গ্রামেই থেকে যাবি?’
‘ভাই তুমি? এখানে নেটওয়ার্কের যা ছিরি ফোন আসাটাই আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো। ওফ..’
আদ্রিশ তিক্ত কন্ঠে বলল, ‘কেন? অন্য কাউকে আশা করেছিলি নাকি?’
‘নাহ। আসসালামু আলাইকুম ভাই।’
আদ্রিশ শান্ত কন্ঠে জবাব দিল, ‘ওয়ালাইকুমুস সালাম।’
‘কেমন আছো?’
আদ্রিশ রোষগ্নি কন্ঠে ধমক দিল, ‘মজা করছিস তুই?’

কম্বলের ভেতর ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ওর ধমকে উৎস কেঁপে ওঠলো। মুখখানা চুপসে গেল। এই আরামদায়ক বিছানা ছাড়তে কিছুতেই ইচ্ছা করছে না ওর। আর বাড়ি ফিরে গেলেই অশান্তির সম্মুখীন হতে হবে, যা মোটেও ওর পছন্দ নয়। কিন্তু আদ্রিশের রাগ সম্বন্ধে ধারণা করতে পেরে উৎস নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, ‘আজই ফিরবো। চিন্তা করো না।’
আদ্রিশ হুমকি দেওয়া গলায় বলল, ‘সন্ধ্যের মধ্যে যেন তোকে বাড়িতে দেখি। ফুপি আজ ইশাকে নিয়ে বাসায় আসবে। আমি আজই এর একটা বিহিত করতে চাই। সেখানে তোর থাকাটা দরকার। যদিও তোর অহংকারী বোনটাকে বেশি প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তিনি তো মহারাণী। ওনার পদধূলি যত্ন করে রাখার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছি আমরা, তাইনা! যাইহোক, যা বলেছি তার সামান্য হেরফের করলে সারাজীবন অহংকারী বোনের বাড়িতেই কেটে যাবে তোর। মনে রাখিস!’

ড্রইংরুমে নেহার বিয়ের শপিং নিয়ে আলোচনা চলছে। সুহানা শেখ খুব উৎসাহ নিয়ে খাতা-কলম নিয়ে খরচাপাতির হিসাব কষছেন। ইশা মায়ের পাশে বসে তাঁকে সাহায্য করছে। ইনায়েত ও ইমতিয়াজ সাহেব অফিস থেকে ফিরেছেন খানিক আগে। চা-নাস্তার আয়োজন পর্ব চলছে এখন। এরইমধ্যে হন্তদন্ত পায়ে ঢুকলো উৎস। এইমাত্র হরষপুর থেকে ফিরছে সে। সবার মনোযোগ এবং দৃষ্টি চলে গেল ওর দিকে। ওকে দেখতে পেয়েই নিশিতা ছুটে এলেন৷ জিজ্ঞেস করলেন, ‘ফিরলি তবে! আমার মেয়েটা কেমন আছে?’
উৎস ক্লান্ত শরীর নিয়ে ধপ করে সোফায় বসে পড়লো। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে সে বলল, ‘আমাকে জিজ্ঞেস না করে ফুপিকে জিজ্ঞেস করো কি পরিমাণ কথা শুনিয়ে বাড়ি থেকে চলে যেতে বাধ্য করেছে আমাদের রোজানুটাকে। এ অবস্থায় আমার বোনটা কীভাবে ভালো থাকে বলো?’

অনুভবে তুই পর্ব ১৭

উপস্থিত সবাই সচকিত দৃষ্টিতে তাকালো উৎসের দিকে। তাঁরা কিছুই বুঝতে পারলো না। এদিকে সুহানা শেখের চেহারা বেলুনের মতো চুপসে গেল। আর কেউ বুঝতে না পারলেও তিনি ঠিকই বুঝতে পারলেন ভাইয়ের ছেলে কোন বিষয়টিকে ইঙ্গিত করেছে। রোজা মেয়েটা তো আসলেই একটা চিজ। সব কথা কেমন ভাইকে বলে দিয়েছে! ইনায়েত, ইমতিয়াজ সাহেব জানতে পারলে তো আর ক্ষমা-ই করবে না তাকে। অত্যাধিক শীতল আবহাওয়া থাকা স্বত্তেও সুহানা শেখ কুলকুল করে ঘামতে শুরু করলেন।

অনুভবে তুই পর্ব ১৯