অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব ৭৮

অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব ৭৮
তেজস্মিতা মুর্তজা

একটি বিস্তৃত জনমানবহীন মরু প্রান্তর। হঠাৎ-ই তা নিশীথের অন্ধকারে অবরুদ্ধ হয়ে উঠল। জয় সেখানে একা দাঁড়িয়ে। অনেকটা দূরে আবছা দেখা যায়–ছোট্ট জয় আমির তার দিকে চেয়ে তাচ্ছিল্য করে হাসছে। তখনই একটি শুকনো-লম্বা হাত জয়ের হাতটা শক্ত করে ধরে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে লাগল। নিশীথের অন্ধকার তখনও বেহায়ার মতো তাদের পিছু পিছু ভেসে আসছে। চলতে চলতে কিছুদূর পেরিয়ে সেই হাতের মালিক বলিষ্ঠ, শ্যামরঙা এক দানব-মানব হয়ে উঠল। জয় আরও অনেকটা পথ নিশ্চিন্তে হাঁটে সেই পুরুষটির হাত ধরে।

কিন্তু হঠাৎ-ই আকাশ ফুঁড়ে এক টুকরো বিদ্যুতের ঝললকানি জমিনের ওপর পড়লে সামান্য একটু আলোকিত হলো অন্ধকার মরুপ্রান্তর। চিরসঙ্গীর হাত ছেড়ে জয় বড় আগ্রহে এগিয়ে যায় নিভু নিভু আগুনের টুকরোর দিকে।
নিভু আগুন জয়কে ইষৎ হেসে শুধায়, “আপনাকে ফেরানোর দায় আমার ছিল না। তবু দু-একবার চেষ্টা করিনি বললে মিথ্যা হবে। কিন্তু আপনি রাজী নন। আপনার পথ রুখার সাধ্যি তো আমার নেই, আমি তাই আপনার পায়েই শিকল পরাবো, আজ যারা শিকলে বন্দি, তাদেরকে আমি মুক্ত আকাশের নিচে দাঁড় করাবো।ʼʼ
জয় হাসল, “এতে আপনি জিতে যাবেন, উকিল ম্যাডাম?ʼʼ

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-“আবার হার-জিতের প্রশ্ন কেন, জয় আমির? আপনি সমাজের জন্য দাবানলের মতো বিপজ্জনক। আপনার তান্ডব চলতে দিলে বনের পর বন ছারখার হয়ে আমার মতো অন্তূরা জন্মাবে। তা আর না হতে হলে আপনাদেরকে এখানেই থামতে হবে।ʼʼ
-“আমরা থেমে গেলে তোমাদের সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে তো?ʼʼ
-“মানুষ চিরকাল বাঁচবে না জেনেও চায় অন্তত আর ক’টাদিন বাঁচতে। সমাজের সকল কীট-পতঙ্গ নাশের সাধ্যি আমার কই, হাতের নাগালে যা আছে তারাই অন্তত সই? এটাকে নিজের পরাজয় ধরলে ধরুন, বাঁধা দেবার ইচ্ছে নেই।ʼʼ
জয় হেসে বিরবির করে আওড়ায়,

-‘পরাজয় আমার হলো বৈকি, জেনেবুঝে সব ছাড়ি,
বিজয়ের কৌশল রপ্ত আমার, তোমার তরে হারি!’
নিভু আগুন আপত্তি কোরে মৃদু হেসে মাথা দোলায়,
-‘জেনেবুঝে ছাড়ে, কারও তরে হারে, যে বা যেই জন,
পরাজয় ছিল একক পরিণাম—জেনেছে আগে তার মন।’
জয় ভ্রু কুঁচকায়। সে নিজের পরাজয় সুনিশ্চিত জানার পর হার মেনেছে? এ কেমন কথা? সে চাইল, বড়ঘরের বন্দিদেরকে রক্তে চুবিয়ে এলো। আবার এখন চাইলেই আরমিণের পরিবারসহ আরমিণকে জীবিত দাফন করে ফেলতে পারে…তারপর ক্ষমতার চূড়ায় দাঁড়িয়ে মুক্ত পাপী রাজা হিসেবে নিজেকে ঘোষনা করতে পারে, অতঃপর বিজয় উল্লাসের নামে আরও শ খানেক নরবলী সে দিতেই পারে। তাহলে পরাজয় কোনটা?
নিভু আগুন তার কানে ফিসফিস করে যায়, “আপনি চাইলেই জিততে পারেন–কিন্তু আপনি চেয়েও চাইছেন না; এই না চাওয়াটার চাইতে বড় পরাজয় আর কই?ʼʼ

জয়ের মস্তিষ্ক এ পর্যায়ে শরীরে মরণ-যন্ত্রণা টের পেল। এই ব্যথা তার পরিচিত। দেহে বিঁধে থাকা বুলেট বের করার ব্যথা এটা। মরুপ্রান্তরের অন্ধকারটা গাঢ় হলো, বলিষ্ঠ হাতখানা এখন বহুদূর পেছনে দাঁড়িয়ে, নিভু আগুনে রক্তের ছিটা পড়ছে, তাই তা আরও নিভু নিভু হচ্ছে। জয় খুব অস্থির হয়ে উঠল–তার পরাজয়টা কী?
মরুপ্রান্তরে ধ্বনি উঠল, “বরং তুই বল দেখি বিজয় কোনটা? সীমাহীন পাপ করার ক্ষমতা থাকাটা যদি বিজয় হয়… তুই বিজয়ী এক পাপের সম্রাট। কিন্তু একখানা সংসার, একটা জীবন–মানুষের মতো জীবন, নিজের ঠিকানা-পরিচয়, তোর আকাঙ্ক্ষিত সঙ্গিনী, নিজের বংশধর….কিছুই তোর হবার নয়। …..তবু তুই দাবী করিস জিতে যাবার! বিজয়ের মর্ম না বোঝা নির্বোধ পাপীষ্ঠ! তোর পরাজয় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে তোর অপেক্ষায়।ʼʼ
জয় দেখে, নিভু নিভু আগুন নিভে যাবার শেষক্ষণেও হাসছে। অন্ধকার জয়কে পরম যত্নে আগলে নিচ্ছে ধীরে ধীরে। ব্যথার অনুভূতি ফুরিয়ে আসছে। বিজ্ঞানকে শুধালে বিজ্ঞান এটাকে মানব মস্তিষ্কের চেতনাহীনতা বলবে। ভদ্রলোকেরা বলবে, মস্তিষ্কের মৃত্যু।

সকালে কাস্টডি রুমে বসে থেকে জয়ের খুব খিদে পাচ্ছিল। তার খিদে পেলে অমানুষিক সব হিংস্রতা ও ভাবনা আসে। যেমন কাস্টডি রুমের চেয়ার-টেবিলগুলো দেখে তার মনে হলো, এগুলোকে ডুবোতেলে মচমচে করে ভেজে খেলে খুবই টেস্টি লাগবে।
খানিকবাদে দুজন কনস্টেবল ধরাধরি করে পরাগকে নিয়ে এলো সেখানে। চেনা যাচ্ছে না চেহারাখানা। নিজে দাঁড়ানো অথবা হাঁটার শক্তি নেই। যেন অনেকদিন পর কবর থেকে একটি মরদেহ তুলে আনা হয়েছে, অর্ধেকের বেশি মাংস ঝরে গেছে শরীর থেকে, সামান্য কিছু কঙ্কালের সাথে ছিঁড়ে ছিঁড়ে ঝুলছে।
জয় পরাগকে দেখেই নাক চেপে ধরল, “সকাল সকাল মুড নষ্ট! দরকার পড়লে আমার নামে আরও পনেরো-বিশটা মামলা ঠুকে দ্যান, তবু এই ধরণের চামবাদুরের মুখোমুখি বসায়ে রাখবেন না, স্যার। আমার খুবই বমি আসতাছে।ʼʼ
পরাগ টেবিলের ওপর মাথা রেখে নিস্তেজ গলায় আলতো হেসে বলল, “তাইলে তুই মনেহয় পোয়াতি, জয়। এতে আমার দোষ নাই।ʼʼ

আজ পলাশ ও রাজন বেঁচে থাকলে পুলিশদের সাহস হতো না পরাগকে এভাবে টর্চার করার। থাকলে এতক্ষণে পুলিশদের পরিবারের কমপক্ষে চার-পাঁচটা মেয়েলোক পলাশের জন্য ডিলেশিয়্যস ডিনার হতো…
রউফ কায়সারকে দেখে জয় কপালে হাত তুলে সালাম ঠুকল। পরাগের কানে কানে বলল, “ দেখতে তো একদম ঝিংকু হয়েছিস রে, ফ্রগ! যাকগে, তো শ্বশুরবাড়ির মেহমানদারি কেমন উপভোগ করলে, দোস্তো?ʼʼ
পরাগ হাসল, “তুই টেস্ট করারই পথে, নিজেই টেস্ট করে বুঝে নিবি।ʼʼ
-“আমার এত সৌভাগ্য কই রে পাগলা?ʼʼ
পরাগ হাসে, “তোর ভাগ্য খুলে দিয়েছি আমি।ʼʼ
-“হু?ʼʼ
-“পলাশ আজগরকে তুই মেরেছিস।ʼʼ
-“তাই নাকি? কই আমার তো মনে নেই! কিন্তু স্বীকার যখন করবিই, এতদিন ভাউ খাইলি ক্যান? দে শালা মাওরাচো%দা, আমার কৃতজ্ঞতা ফিরায়ে দে।ʼʼ

-“কৃতজ্ঞ হয়ে তুমি আমার বালডা ফালাইছো, হুমুন্দির পুত! তোর জন্য জান তো দিতে পারি না।ʼʼ
তার সঙ্গে জয়ের সম্পর্ক আগে-পরেই প্যাঁচ খাওয়া। তবু সে কেন শুরুতেই জয়ের নাম নেয়নি, এটা ভাবনার বিষয়।পরাগকে জিজ্ঞেস করলে সে বলবে, সে জানে না। কিন্তু কারণ একটা আছে, অদ্ভুত কারণ।
পরাগ তখন ছদ্মবেশী প্রশাসন কর্মকর্তা। একদিন তার মিছেমিছি কার্যালয়ে এক নারী এলো। তার চোখে চিকচিক করছিল ন্যায়ের তেজ, আচরণে বিচক্ষণতা। পরাগের বুকে ধাক্কা লাগল—তার মনে হলো, নারীটির বিশ্বাস অনুযায়ী সে আজ কেন সত্যিই মুস্তাকিন মহান নয়? সে কেন পারছে না নারীটির চাহিদামতোন ধর্ষিতা মেয়েটিকে ইনসাফ দিতে? আবার কিনা সে সেই পলাশের অনুগত জারজ ভাই, যে এসবের পেছনে কাঠি নাড়ছে।

এ পর্যন্ত পরাগ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল কষে। কিন্তু যেদিন সেই নারীটিকেই আবার আরেকজন মুমতাহিণা হবার জন্য পলাশের ডেরায় পাঠাতে হলো, সেই বিশ্বাসঘাতকতার অনুশোচনা কি আজও গেছে পরাগের ভেতর থেকে? সে কেন সেদিন নারীটির সরল বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারেনি? কোন সুঁতোয় তার হাত বাঁধা ছিল? সেই সুঁতোর নাম যদি পাপ হয় তো সেদিন কী করে সেই সুতো ছিঁড়ে তার সম্মুখে জিতে গেল জয় আমির? যেখানে জয় আমিরের পাপের সুঁতো যে তার চেয়ে হাজারগুণ শক্ত, পরিপোক্ত!? এমন তো কথা ছিল না! নারীটির কাছে জয় আমির মৃত্যুর মতো ঘৃণ্য, জয় আমিরের কাছে নারীটি কেবল একটি শিকার–অথচ সেইরাতে সম্মান বাঁচিয়ে এনে নারীটিকে জয় আমির বিশ্বাসঘাতক পরাগের হাতে তুলে দিয়ে এক টুকরো বিদ্রুপমাখা হাসি হেসে চলে গেছিল। এই স্ব-ধিক্কার কি পরাগ ভুলতে পেরেছে আজও?

সে জয় আমিরের কাছে বিশ্বাস ও ভরসার মামলায় হেরে যাওয়া আনাড়ি। পরাগের বুকে নারীটির জন্য অগাধ টান। সেই টানে পাপ নেই, এটুকু নিরেট। তবে সেই টান অদ্ভুত, একজন কাপুরুষ বিশ্বাসঘাতকের কলিজার টান কিনা! তাই ততদিন সেই নারীর ভরসাস্থল–জয় আমিরকে কেঁড়ে নিতে পরাগের সাহস হয়নি যতদিন না রূপকথার মামলা এসেছে। পলাশ আজগরের খুনী হিসেবে সন্দেহের তীর রূপকথার ওপর স্থির হয়ে যাচ্ছিল। তদন্তে উঠে এসেছিল—রূপকথা ছিল পলাশের কাছে অমানুষিক অত্যাচারের শিকার। রূপকথার কাছে যথেষ্টর চেয়েও বেশি কারণ ছিল অসুস্থ পলাশকে খুন করে নিজেকে বাঁচিয়ে নেবার।

পরাগের সাথে রূপকথার সম্পর্ক আরও জটিল। সৎ ভাই-বোন, প্রতিদ্বন্দী। কিন্তু পরাগের না বলা আরও একখানা কথা আছে—পরাগ রূপকথাকে বোনের চেয়েও বেশি ভালোবেসেছে সেই ল্যাংটা-কাল থেকে। সেই নারীটির জয় আমির আছে! রূপকথার আজ এক পরাগ ছাড়া কেউ নেই। পরাগ বলে দিয়েছে পলাশের খুনীর নাম।
জয় বলল, “তুই এমনিতেও বাঁচবি না। তোর খয়রাতে আমি বোয়াল মাছ দিয়ে আলু ঘাটার অনুষ্ঠান করব।ʼʼ
পরাগ মাথা নাড়ল, “ওইজন্যই বলে দিছি। তোর মরার ব্যবস্থা না করে মরলে নরকবাস হবে।ʼʼ
-“নয়ত তুই কি জান্নাতুল ফেরদাউসে যাইতি? তোর মতো শাউয়ার নাতিরে নরকে দিলেও তোর জায়গা হবে নরকের হাগাখানায়।ʼʼ
পরাগ টেবিলের নিচ দিয়ে জয়ের পায়ের ওপর দুম করে একটা লাত্থি মারল। রউফ এসে বসল দুজনের সামনে। জয় বলল, “স্যার, এই উগ্রবাদী পাঠাটার এখনও ফাঁসি হয় নাই ক্যান? আমি আপনাকে খুব ন্যায়পরায়ণ অফিসার বলেই জানি।ʼʼ

-“আজই আমার সঙ্গে আপনার প্রথম দেখা।ʼʼ
-“দেখা তো আমাদের আজরাইলের সাথেও জীবনে প্রথমবার আর একবারই হয়, তাই বলে কি মরার আগে আমরা জানি না তাকে?ʼʼ
-“আমাকে আপনি নিজের আজরাইল বলছেন?ʼʼ
জয় মুচকি হাসল, “হতেই পারেন! সুযোগ দিয়েছি তো!ʼʼ
-“না, জয় আমির। আপনি নিজেকে খুব বেশি শক্তিধর ভাবলে আমি তার প্রতিবাদ করব।ʼʼ
জয় ঠোঁট বাঁকাল, “কোচের ছুরি কোচ কাটলে স্যার, আপনার মতো প্রতিবাদীরা একটু-আধটু প্রতিবাদ করলেও মেনে নিতে হয়। ও সঁয়ে যাবে।ʼʼ
খুব গভীর চোখে এবার দেখল রউফ জয় আমিরকে। রসিক-গম্ভীর চেহারা। ক্লান্ত-পরিশ্রান্ততায় কাতর, কিন্তু উদ্বেগ নেই একটুও। সেও কি জানে তার স্ত্রী তাকে ধ্বংসের কত কঠোর ফর্দ তৈরি করেছে? জানে বৈকি! ওই গভীর বাজ পাখির মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে গভীর সতর্কতা আর বিচক্ষণতা।

-“যখন কামরুজ্জামান ঝন্টু সাহেবের মার্ডার হয়, তখন আপনি কোথায় ছিলেন?ʼʼ
-“সামনেই।ʼʼ
রউস হেসে উপর-নিচ মাথা নাড়ল, “যাহোক, পেছনে থেকেও খুন করা যায়।ʼʼ
-“পেছন থেকে কুত্তা দাবরায়, স্যার। আমি ধরলে সামনে থেকেই…বাই দ্য ওয়ে আপনি দু চারটে করেছেন নাকি খুন…পেছন থেকে?ʼʼ
একটু অবাক অবশ্যই হলো রউফ কায়সার জয়ের অকপট স্বীকারক্তিতে। খানিক চুপ থেকে আচমকা জিজ্ঞেস করল, -“রাজন আজগরকে কেন মেরেছেন?ʼʼ
রউফের উদ্দেশ্য ছিল হঠাৎ-ই এমন প্রশ্নে ভড়কে যাবে জয়, কাচুমাচু হবে। কিন্তু অবাক হয়ে তড়াক করে মাথা তুলল পরাগ। জয় শুধু সামান্য ঠোঁট উল্টায়, “একটুও ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু জানেন দুনিয়া কক্ষনোই চায় নাই আমি পাপ কম করি।ʼʼ

আরমিণ যেদিন প্রথমবার বড়ঘরে পা রাখল তখন জয় রাজধানীতে। সেখানকার একটি চেম্বারে রাজন আজগরের ব্যবসার মাল–মদ, অস্ত্র ও মেয়েলোক দেখে ফেলেছিল আরমিণ। খবরটা জয় জেনে যখন আশপাশে পাহারা বাড়িয়ে দিলো, সেই পাহারাদারদের মাঝে বেশ কয়েকটা পলাশের ছেলে ছিল অবশ্যই। তারা রাজন আজগরকে কল করে জয় আমিরের স্ত্রীর স্পর্ধার কথা বলে দিলো।
সেবার দিয়ে রাজন আজগর তিনবার শুনলেন জয় আমিরের স্ত্রীর দুঃসাহসিকতার গল্প। আগেও বহুবার হাতে চেয়েও পাননি, কিন্তু এবার আর না দেখলে চলছিলই না সেই মেয়েটিকে। জয়কে সেই সকালেই তিনি কল করে আবদার করলেন—
-“তোর বউডারে তো লাগতো, আব্বা। পাঠায়ে দে। পলাশের কাছে বহুত শুনছি তার ব্যাপারে। সচক্ষে দেখতে না পাইলে কলজে তড়পাচ্ছে।ʼʼ

আরমিণ তখন বড়ঘরের লোহায় পা কেটে, জ্বর এসে অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় শুয়ে। জয় একবার আরমিণকে দেখে হেসে বলল, “কলজে তড়পানো কোনো বিশেষ ঘটনা না, কাকা। কলিজা তড়পাচ্ছে মানে হইলো আপনি জিন্দা আছেন। নয়ত এতক্ষণে হরি বোল..ʼʼ
-“না না, জয়। নাহ্। এই তড়পানি অন্যরকম রে। নিয়ে চলে আয়। ও জিনিস তো কবেই আমাগোর সম্পত্তি হইছে, তুই খালি বারবার কাইড়া নিছোস। আমি তরে স্নেহ করি, আমি আবার উল্টা কাইড়া নিলে কেমন দেখায় না? তুই নিয়ে চলে আয় আমার ফ্ল্যাটে। বুঝলি?ʼʼ
জয় দীর্ঘ এক শ্বাস টেনে বলল, “আচ্ছাহ্! অপেক্ষা করেন তাইলে। আসতেছি। আজই আসি, নাকি কাকা? পলাশ ভাইরে আগেই কিছু জানায়েন না। কাউরেই জানায়েন না। পলাশ ভাইয়ের জন্য খুব ডিমান্ডেবল ব্যাপার আমার বউ, বুঝলেন? তারে সারপ্রাইজ দেব। আপনে কইলাম বইলেন না আগেই।ʼʼ
জয় আবার সেদিনই দুপুরে রওনা দিলো রাজধানীর উদ্দেশ্যে। হামজাকেও জানালো না। রাত এগারোটায় ঢাকা পৌঁছে একটু ড্রিংক করে, শহর ঘুরে রাজন আজগরের ফ্ল্যাটে ঢুকল রাত দেড়টার পর। একুশ তলা ভবন। রাজন আজগর থাকেন চৌদ্দ তলার লেফ্ট-ইউনিটে।
রাজন বললেন, “কই রে? সেই মহিয়সী কই? বাপরে, দম বন্ধ করে দেয় মাঝেমধ্যে। কোত্থেকে পাইলি বাপ এরম কড়া মাল? কই সে?ʼʼ

জয় ঠোঁট গোল করে খুব ধৈর্যশীলের মতো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আনিনি, কাকা।ʼʼ
রাজন আজগর রসিকতা ভেবে হাসতে চাইলেন, কিন্তু তিনি জানেন জয়কে। বিভ্রান্ত হলেন, ধীরে ধীরে হিংস্রতা চাপতে লাগল ভেতরে।
জয় খুব হতাশ কণ্ঠে বলল, “যখন একটা সাধারণ মেয়ে ছিল, আমার চোখের বিষ ছিল, তখনই দেই নাই আমি। আইজ তো সে আমির পরিবারের বউ–কোয়েশ্চেন অফ ফ্যামিলি অউনার, কাকা। আপনি কি ঠিক করছেন আমির পরিবারের বউকে এইরকম সস্তাভাবে চেয়ে বসে?
যেইগুলারে আপনি বেচাকেনা করেন, সে কি সেইরকম কিছু? শ্যাহ্! আপনি ওরে চাইলেন সেইটা সমস্যা না, সমস্যা হইলো আপনে আমার পরিচয়ের ওপর হাত মারছেন।ʼʼ
জয় উঠে দাঁড়ায় এ পর্যায়ে, “আমি কে?ʼʼ
রাজন আজগর বুঝতে পারছিলেন না পরিস্থিতি। জয় কী চায়?

জয় রাজন আজগরকে খুব একটা শাস্তি দিয়ে মারল না। ভুলবশত বয়স্ক একজন মানুষ একটু বেয়াদবী করে বসেছে, এই আর কী! রাজন আজগরের বুকের ওপর উঠে বসে চোয়ালের একপাশ দিয়ে একটি মাঝারি আকৃতির ড্যাগার গেঁথে দিলো। একপাশ দিয়ে ঢুকে অপরপাশের চোয়াল ভেদ করে বেরিয়ে গেল তা।
জয় বলল, “আমি, জয় আমির। সি’জ মাই লেডি, মাই বেটার হাফ, নাও দ্য হেরিটেজ অফ মাহ্ ফ্যামিলি! কারবারের খাতিরে সব মাফ, কিন্তু ঘরের সম্মানে নজর রাখা মহাপাপ। কোনো লোটির বাচ্চা তোর মতো এমন সাহস করলেই একদম জবাই করে ফেলব। আমি এখনও বেঁচে আছি।ʼʼ
জয় করলও তাই। ড্যাগার দিয়েই রাজন আজগরের গলাটা ঘষে ঘষে কেটে ফেলল। ভোঁতভোঁত আওয়াজ হয়ে কণ্ঠনালি দু’ভাগ হলো, ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এসে জয়ের মুখ-বুক, শার্ট ও হাতে ভরে গেল। ঘাঁড়ের কাছে অল্প একটু চামড়ার সঙ্গে বাঁধিয়ে রাখল মাথাটা। যাতে তদন্ত ও দাফনের কাজে একটু সুবিধা হয়।

পরাগ মাথাটা চেপে ধরে বসে ছিল। তার কষ্ট লাগছে এমন নয়, কিন্তু অস্বস্তি হচ্ছে এক প্রকার, আবার সাথে অদ্ভুত এক প্রশান্তি। তার মনে হলো এটাই কি পার্থক্য নয় তার আর জয়ের মাঝে? জয় তার ঘাতকিনীকে নিজে লাঞ্ছনা ও যন্ত্রণা দিয়ে আবার পদে পদে নিজের ঐতিহ্যে লালন-পালন করেছে বরাবর। কিন্তু সে সেই নারীটির ওপর দূর্বলতা অনুভব করার পর জয় আমিরের মতো এই পাগলাটে দুষ্কৃতির আশপাশেও যেতে পারেনি। এটাই কি কারণ নয় যে জয় আমির সেই নারীটিকে লাভ করেছে আর পরাগ কেবল নীরব এক প্রতারক!
রউফ কায়সার কিছুক্ষণ চুপচাপ দেখল জয় আমিরকে। তবু এই লোকের স্ত্রীর এত নিরাসক্তি এই লোকের ওপর? কেন? গল্পটা কি কোনোদিন শোনা দরকার না সেই নারীটির কাছে?

পরাগ দূর্বল গলায় আস্তে কোরে জিজ্ঞেস করল, “তোর প্রতিদ্বন্দীর খাতিরে বারবার এতকিছু করেছিস, তুই!?ʼʼ
জয় হাসল, “এক হেলেনের জন্য গ্রিকরা দশ বছর যুদ্ধ করেছিল, ফ্রগ! সেই হেলেন কিন্তু চরিত্রহীনা এক ঘাতকিনী নারী ছিল। যার জন্য গ্রীক বীরদের রক্তে ধুয়ে উঠেছিল ট্রয় নগরী। কারণ সে ছিল রাণী, গ্রীকদের সম্মান।ʼʼ
পরাগ হেসে উঠল, “তোর অবাধ্য রাণী!ʼʼ
জয় ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে হাসল, “রাণী কখনোই রাজার প্রতি ততটা অনুগত হয় না যতটা রাজ্যের প্রজারা। তবেই সে রাণী। আর রাণী ছাড়া রাজ্য ও রাজা দুটোই চাবিহীন তালার মতো। হয় অবরুদ্ধ নয় চূর্ণ-বিচূর্ণ, অথবা অকেজো-অসম্পূর্ণ!ʼʼ
পরাগ অদ্ভুতভাবে হেস মাথা দোলায়, “সব রাখ। তবে হেলেনের খাতিরে তুই যদি অ্যাকিলিস হতে যাস, তোর তাহলে মৃত্যু সুনিশ্চিত, তোর সাম্রাজ্যের ধ্বংসও–জেনে রাখ।ʼʼ
-“কোন শালা চিরকাল বাঁচতে জন্মাইছে রে?ʼʼ

একটা বুলেট জয়ের ডান হাঁটু থেকে বেশ কিছুটা উপরে বিঁধে ছিল, আরেকটা অন্ধকারের বদৌলতে বুকে না লেগে হাতের বাহু ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে।
কবীরের দেহের বিভিন্ন স্থানে তখনও থকথকে ঘা। তার ওপর জয়ের রক্ত শুকিয়ে লেপ্টে আছে। দূর্ঘটনার সময়টা অসময় ছিল। সেই অসময়ে বাঁশেরহাট মোড় থেকে আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজে জয়ের দেহ পৌঁছানো কবীরের জন্য দুঃসাধ্যই হয়ে উঠেছিল বটে। কবীরের হঠাৎ-ই মনে হলো–বড়ঘরে জয় যা করেছে, ঠিক করেছে। এই জয়ের আছে কে এবং কী হামজা ছাড়া? আজ হামজা থাকলে দিনাজপুর সদর এলাকায় কাঁপন ধরে যেত এই শেষরাতে। সেই হামজার ওপর হামলা করা লোকদের সাথে জয়ের ওই ব্যবহার একদম ঠিক।
কবীরের শরীরটা থরথর করে কাঁপছিল। জয়ের রক্তের দানা এত ভারী কেন? হাসপাতালে গিয়েও কবীর হামজার দাপটের কমতি অনুভব করল। তার কথায় কেউ তোড়জোর করে জয়কে এই অসময়ে অপারেশন রুমে শিফ্ট করছে না। হামজা এসে দাঁড়ালে হাসপাতালের জড় বেডগুলোও সচল হয়ে উঠতো।
ডাক্তার বললেন, “রক্তক্ষরণের মাত্রা অতিরিক্ত। এ অবস্থায় অপারেশন ঝুঁকিপূর্ণ। অপারেশন শেষে সেন্স না ফিরলে আমাদের কিছু করার থাকবে না।ʼʼ

কবীর হাতের কব্জি এগিয়ে দিলো, “ওই ডাক্তাল কী মনে হয় আপনার, আমার শরীলে কি রক্ত নাই? নেন নেন। এই যে রক্ত, নেন। কতখানি লাগবে, কয় ব্যাগ কয় ব্যাগ?ʼʼ
কবীরের পাগলামিকে অগ্রাহ্য করে ডাক্তার বললেন, “রোগীর রক্তের গ্রুপ ও-নেগেটিভ। রেয়ার এনিহোয়ার। দ্রুত জোগাড় না করতে পারলে রোগীর কোমায় যাবার সম্ভাবনা রয়েছে, সেন্স ফেরার নিশ্চয়তা দিতে পারছি না। যা করার দ্রুত করুন।ʼʼ
কবীর কী করবে এবার? সে অনেকক্ষণ হাপাতালের মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে রইল। ও-নেগেটিভ রক্ত দুনিয়ায় বিরল। এই রক্ত নেই দুনিয়ার মানুষের। পরে তার মনে পড়ল জয়ও তো নেই দুনিয়ায় অহরহ! আরও মজার ব্যাপার হলো ও-নেগেটিভ রক্তওয়ালা সবাইকে রক্ত দিতে পারলেও সে নিজে শুধু ও-নেগেটিভ রক্ত নিতে পারবে, আর কারওটা না। এটাও কি জয়ের ভালোবাসার মতো?
কিন্তু জয়কে হামজা ভালোবেসেছে, ভালোবাসতে পেরেছে, পাগলের মতো। তার রক্তের গ্রুপও ও-নেগেটিভ– কারণটা বোধহয় এটাই!
ছেলেদেরকে বিকেল পর্যন্ত থামিয়ে রাখল কবীর এই খবর হামজাকে দেয়া থেকে। হামজা উন্মাদ হয়ে উঠবে এই খবরে, যেখানে সে নিজেও জখম। কিন্তু বুলেট অপসারণ করে জয়কে বেডে দেবার কয়েক ঘন্টা পরেও সে চোখ খুলে তাকিয়ে হেসে উঠল না।

দিনাজপুরের পুলহাট পুলিশ ফাঁড়ি থেকে রাত একটায় দুজন বেরোলো। জয়ের ডানহাতে হ্যান্ডকাফ ঝুলছে তখনও। কেবল বাম হাতটাকে মুক্ত হয়ে দেয়া হয়েছে।
পাশের চায়ে দোকানে ঢুকে দোকানির কাছে এক প্যাকেট সিগারেট চাইল। দোকানি সিগারেট দিলে হুরহুর করে বেরিয়ে আসছিল। খুপরি থেকে। পেছন থেকে ডাকে দোকানি, “আমার ট্যাহা দিবা না?ʼʼ
-“বাকি খাইলাম। পরে-টরে দেব। ট্যাহা নাই আমার কাছে। ওহ্, মনেই নাই। শ’দুয়েক টাকা ধার দেন তো। গাড়ির ভাড়া নাই আমার কাছে।ʼʼ
দোকানি চোখ গোল্লা করে বলল, “অ্যাহ্!ʼʼ সে বুঝল না, এই ছ্যাঁড়া কী কয়! একে তো বাকি সিগারেট, তার উপর টাকা ধার!
জয় এগিয়ে গিয়ে দোকানির কানের কাছে বলল, “আপনের দুকানে কোনোদিন চাঁদা তুলতে আইছে আমার চ্যাংরারা?ʼʼ

দোকানি নিজের ভালো বোঝে। এসেছে বললে বিপদ হতে পারে বুঝে ঘাঁড় নাড়ল, “নাহ্, আহে নাই।ʼʼ সে মূলত জানে না জয়ের ছেলেরা তার কাছে চাদা খেয়েছে কিনা।
জয় বলল, “ব্যাস, শোধ-বোধ। যদি ধরেন টপকে-মপকে যাই, এই ট্যাকার দায় আবার বাঁধায়ে রাইখেন না। মাফ করে দিয়েন।ʼʼ
রাস্তায় চলার সময় সিগারেট টানতে টানতে গান ধরল,
আই অম এ ডিস্কো ড্যান্সার
বিড়ি খাইলে হয় ক্যান্সার…

পথে ডাবে ভরপুর নারকেল গাছের দেখা মিলল। মাস ছয়েক কোনো নারকেল গাছে হামলা দেয়া হয় না। শুধু চেহেলগাজী ইউনিয়ন না, দিনাজপুর সদরের প্রায় সব গাছের নারকেল তাদের পেটে যায়। গাছওয়ালা সন্ধ্যায় নারকেল গুণে রাখে, সকালে গাছ পরিস্কার। পেঁপে, পেয়ারা, আমের ক্ষেত্রেও ঘটনা এক।
পরস্পরের সাথে চোখাচোখি করে হাসে দুজন। হুট করে জীবনটা গম্ভীর হয়ে গেছে। আগে জটিল ছিল, কিন্তু ছিল ছন্নছাড়া। এখন ভারী হয়ে গেছে।

বাড়ির রাস্তা তুলনামূলক বেশি গুমোট লাগল। যেন কিছু ঘটেছে ঘটেছে বা ঘটবে নিশ্চয়ই। সে যে আশঙ্কা করে বাড়িতে ঢুকল, তার সূক্ষ্ণ চিহ্ন ছিটে আছে স্থানে স্থানে। গতরাতে তাকে নিয়ে যাবার পর পরই উন্মত্ত দল রাজধানীর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে। বাড়ির পাহারায় যে দু’একজন রয়ে গেছিল, তাদেরকে পেল বাহির বাড়ির খোলা বারান্দার এক কোণে। ভয়ানক জখম তারা। হামজার নির্দেশে সবসময় পরিপাটি পাটোয়ারী বাড়ির আঙিনায় লন্ডভন্ড হাল জয় অন্ধকারেও টের পেল–অনেকগুলো পায়ের বিক্ষিপ্ত পদচারণা চলেছে বারবার।
এমপির দুটো ছেলে দৌড়ে এলো কোত্থেকে যেন জয়কে দেখে। জয়কে ঘুরে ঘুরে সব দেখাল। বড়ঘরের বাইরের লোহার দরজা হাতরালো। পুরোনো বিশাল তালাখানা ভেঙে নিচে পড়ে আছে, আর শাবলটাও। সিটকিনিতে নতুন তালা লাগানো। জয় হাসল একচোট। অসুস্থ কবীর বোঝার চেষ্টা করছিল সবকিছু।

-“ভাই, এইসব কারা করতে পারে?ʼʼ
-“মুরসালীনের শুভাকাঙ্ক্ষীরা।ʼʼ
-“জঙ্গির দল?ʼʼ
জয়ের আন্দাজ বাস্তবের চেয়ে শক্তিশালী। সে মাথা নেড়ে হাসল বলল, “হ, আনসারী মোল্লা মনেহয়, কবীর। মজার ব্যাপার কী জানিস? আমার ঘরওয়ালির আয়োজন এইসব।ʼʼ
কবীর চমকে উঠল, “ভাবী?ʼʼ
জয় সেই শাবল দিয়েই দোতলার সদর দরজা খুলে বাড়িতে ঢুকল। রিমি চাবি কোথায় রেখে গেছে, জানা নেই। রুমে ঢুকে লুঙ্গি পরতে পরতে কবীরকে বলল, “বড়সাহেবের রুমে যা। বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ারে চাবি আছে। দেখ আবার সেখানে আছে নাকি মুরসুর শুভাকাঙ্ক্ষীরা সঙ্গে নিয়ে গেছে।ʼʼ
-“আমি?ʼʼ ইতস্তত করে কবীর
-“যা, শালা। ভাবী নাই এখন, যা।ʼʼ

সে তো সেই আমির নিবাসেই আন্দাজ করেছিল অন্তূ ভয়ানক কিছু ঘটিয়েছে, কিন্তু সেটা এতকিছু, তা ভাবার ফুরসত পায়নি। হেসে ফেলল সে। ঘরে সে আসলেই এক ঘাতকিনীকে পালছে। এত নিখুঁত পরিকল্পনাকারী তার স্ত্রী, এটা ভেবে গর্বে বুক ফুলাতে গিয়ে আবারও হেসে ফেলল। যোগ্য স্বামী থুক্কু যোগ্য আসামীর যোগ্য বউ। নাহ্ আইনজীবী।
বড়ঘরে ঢুকল জয় তিন চারখানা মদের বোতল সঙ্গে নিয়ে। তার গ্লাসে ঢেলে পানি অথবা মদ কোনটাই পান করার অভ্যাস নেই। পানি জগ ধরে, মদ বোতল ধরে। সিঁড়ির তালা বাইরে থেকে ঠিকঠাকই বন্ধ। সিঁড়ি পেরিয়ে প্রথম ইউনিটে পা রাখতেই খচ করে পায়ে কিছু গেঁথে গেল।

জয় কবীরকে ধাক্কা দিয়ে সামনে সরিয়ে বলল, “সাবধান। শালারা মনে হয় কালাজাদুটাদু করে রেখে গেছে। লাইট-মাইট সব ভেঙে অন্ধকার করে কালাজাদু করছে, বুঝলি?ʼʼ
আন্দাজমতো বড়ঘরের স্পট লাইটখানাও ভাঙা পেয়ে ভেতরে আরও আত্মবিশ্বাস টের পেল জয়। বহুদিন পর অসুস্থ শরীরে বড়ঘরে ঢুকে কবীর অস্বস্তিতে গুটিয়ে যাচ্ছিল। আচমকা দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠলে চমকে উঠল।
জয় মদের বোতলের মুখে দিয়াশলাই মেরেছে। নীল আগুন জ্বলে ওঠার সাথে সাথে মুখে “হু হুউউ হুহ্!ʼʼ রকমের আওয়াজ করে ছুঁড়ে মারল সামনের দিকে। উন্মাদের মতো কাজ। সামান্য আলোয় দৃশ্যমান মেঝেতে লুটিয়ে থাকা কয়েকটি দেগুলোর পশম ছুঁয়ে ছুটে গেল বোধহয় বোতলটা, বিকট আওয়াজে ভেঙে কাচগুলো ছিটিয়ে গেল চারদিকে। জয় খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠল। সবগুলো হাতছাড়া হলে সে নিজেকে সামলাতে পারতো না। আজ তার রক্ত চাই-ই-চাই।

দ্রুত চার্জার লাইট জ্বালায় কবীর। জয় খুঁড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে মুরসালীনের সামনে বসে। কবীর আঁৎকে উঠল। পায়ের তালুতে তিন ইঞ্চিমতো ফেঁড়ে গেছে, এক টুকরো কাচ বিঁধে আছে। জয় এক টানে তা তুলে ফেলল, রক্ত ছিটে এলো খানিকটা। সেই ক্ষততে গবগব করে খানিকটা মদ ঢাললো। অ্যালকোহল ভালো জীবাণুনাশকের কাজ করে।
মুরসালীনসহ চারজন যুবক ও আব্দুল আহাদ এবং তার সমবয়সী তিনজন কিশোর এখন বড়ঘরের বাসিন্দা। তারা বিগত দু’দিন পানি ও খাবারবিহীন। এ বাড়িতে তাদের একজন মমতাময়ী ছিল, সে আমির নিবাসে বন্দিনী। পিপাসায় কাতর প্রাণগুলোর শক্তি নেই সামান্য মাছিকেও প্রতিহত করে হাত নেড়ে। যুবক চারজন অচেতন। ওদের শরীরের ক্ষততে ইনফ্রাকশন ধরে গেছে, সেখানে মাছি উড়ে বদরক্ত ও পুঁজের গন্ধ শুঁকছে। জয়ের সামনেই মুরসালীন বমি করে ফেলল আবার। শুধু পিচ্ছিল মিউকাসের থকথকে রক্ত উঠে এলো।

জয় জিজ্ঞেস করে, “তুই যাসনি ক্যা, মুরসালীন? আমার টানে রয়ে গেছিস?ʼʼ
মুরসালীন কথা বলতে পারল না। জয় বোতল খুলে বসল। একেবারে ঢকঢক করে এক বোতল শেষ করে ছেলে দুটোকে ডেকে বলল, “এই চারটাকে পাশের ঘরে নিয়ে যা।ʼʼ
জয় পিছে পিছে গিয়ে কুকুরগুলোর সামনে পরিবেশন করে এলো দেহগুলো। কুকুরগুলো মাংস খেয়ে অভ্যস্ত–পিট বুল। নামকরা মাংসাশী জাত। তারা জয়ের কাছে আসার পর থেকে প্রায় সময়ই ক্ষুধার্ত থেকেছে। আজ চারটে রক্তাক্ত আধমরা মানবদেহ পেয়ে খুবই সন্তুষ্ট হলো জয়ের ওপর। ছেলেদুটো কক্ষের দরজা বাইরে থেকে আঁটকে দিলো। কবীর দাঁতের মাড়ি শক্ত করে চোখ বুজে রইল। জয়ের অনেক কর্মকান্ড আছে যা তাকে ভীত ও অপ্রস্তুত করে তোলে।

পাশের ঘর থেকে রক্ত ঠান্ডা করা আওয়াজ আসছিল। তাজা রক্ত-মাংস ছিঁড়েছুটে আসাও চারটে ক্ষুধার্ত কুকুরদের মাঝে টানা-হেঁচড়ার আওয়াজ মিশে একটা অসুস্থ পরিবেশ তৈরি হলো। মুরসালীন তবু অনড় বসে রইল দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে। সে শুধু আন্দাজ করার চেষ্টা করল–আজ আনসারীর কথায় সেও যদি যেত ওদের সঙ্গে, জয় ঠিক খুঁজে বের করতো ওদেরকে, তাহলে জয়ের ব্যবহার কেমন হতো?
একসময় ওপাশের ঘরের আওয়াজ কমে এলো। জয় আর দেখলও না কুকুরগুলো তৃপ্তি পেয়েছে কিনা, তাদের ক্ষুধা মিটেছে কিনা অথবা শিকারগুলোর শরীরে আর কী পরিমাণ মাংস অবশিষ্ট আছে, আর কয় বেলা তারা নিজেদের ক্ষুধা নিবারণ করতে পারবে দেহগুলো থেকে।
সে আরাম করে বসে আরও খানিকটা মদ পান করল।

এরপর মুরসালীনকে জিজ্ঞেস করল, “মরার আগে একটা প্রশ্নের জবাব দে, জিন্নাহর সাথে কী হয়েছিল? হামজা ভাইয়ের কাছে জিজ্ঞেস করার সুযোগ এখনও হয়নি, তুই বল।ʼʼ
মুরসালীন কাশল বেশ কয়েকবার। হাতদুটো মাথার নিচে দিয়ে আস্তে কোরে শুয়ে পড়ল মেঝের ওপর কাত হয়ে। নাক দিয়ে রক্ত আসছে। শরীরটা, বিশেষত হাতদুটো থরথর করে কাঁপছে তার। সেই হাতে সে নিঃশব্দে জয়ের দিকে এক টুকরো কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলল, “আম্মাকে দিবি এটা।ʼʼ
জয় উত্তর পেল না। মুরসালীন আরাম করে পড়ে রইল নিজের বিদ্ধস্ত দেহখানা নিয়ে। চোখ বুজলে একটা সুন্দর মৃত্যু তাকে ডাকছে। সেখানে হাহাকার নেই, বন্দিত্ব নেই, নেই রক্ত, শরীরের চিৎকার, নেই নিপীড়ন, ক্ষমতার তুলনা…
মুরসালীনের কানে এখন আর এমদাদ, তৌফিক, নাঈমদের আর্তনাদ ও কুকুরদের ভোজের আওয়াজ বাজছে না। ওরা এখন মুরসালীনের চেয়ে সুখী। মুরসালীনের দুর্ভাগ্যের ওপর নিশ্চয়ই হাসছে!

কেননা মুরসালীন এখন চোখের সামনে তিন কিশোরের মৃত্যু দেখার সম্ভাবনা নিয়ে বসে। এই ভার থেকে তারা মুক্ত হয়েছে। তওফীক, আব্দুল আহাদ ও হাবিবুল্লাহ্কে কোনোক্রমেই নিয়ে যাওয়া যায়নি। তারা মুরসালীন ভাইকে রেখে যাবে না। ওদের বোকামির ওপর মুরসালীন হাসল। ওরা কি জানে না মুরসালীন ভাইয়ের সাধ্যি নেই ওদেরকে রক্ষা করার! মুরসালীন একটা পাপ করল। সে নিজের মৃত্যু আগে চাইল। এটা মহাপাপ কিনা জানে না মুরসালীন। কিন্তু চোখের সামনে ছোট ছোট কিশোর প্রাণগুলোর ঝরে যাওয়া দেখার সাহস মুরসালীনের নেই। কিন্তু দেখতে হলো।
জয় চারটে গুলি খরচা করল তওফিক ও হাবিবুল্লাহর খাতিরে।

আব্দুল আহাদের চোখদুটো জ্বলজ্বল করে জ্বলছিল তখনও। কিন্তু কখন যে তা জলে টসটসে হয়ে উঠল। তার আব্বা নেই। মায়ের আরেক ঘরে বিয়ে হয়েছে। নানীর বড় সাধ ছিল আব্দুল আহাদ হাফেজ হবে। বিশাল বড় ধার্মিক হবে। নানীর হাঁপানি আছে। সে শেষবার নানীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মাদ্রাসায় আসার পথে নানীকে বলেছিল, ‘এবার আসার রমজানের ছুটিতে বাড়ি আসার সময় মুরসালীন ভাইয়ের কাছ থেকে শ’তিনেক টাকা নিয়ে তোর জন্য একখানা নতুন ইনহেলার কিনে আনব। সারাদিন হুক্কুর হুক্কুর করে কাশিস।ʼ

কেনা হলো না। নানীকে তার দেখা হয় না কতগুলো মাস। আচ্ছা, নানী কি আর তাকে… মরা আহাদকেই, দেখতে পাবে কী? সে মুরসালীনের সামনে গিয়ে বসে বুক পেতে দেবার মতো করে তাকিয়ে রইল। তার একবার ওই আপাটির কথা মনে পড়ল। তার মনে হলো ওই আপাটি এখন থাকলে নিশ্চয়ই এই জয়কেই গুলি করে মেরে ফেলতো, তবু আব্দুল আহাদ আর মুরসালীন ভাইয়ের কিছু হতে দিতো না।
জয় খুব আন্তরিক ভঙ্গিতে হেসে আব্দুল আহাদকে টেনে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরল। তার লম্বা দেহের তুলনায় আব্দুল আহাদ জয়ের বুক পর্যন্ত লেপ্টে রইল। এক হাত দিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে রেখে পিঠের ঠিক বামভাগে, যেখানটায় সামনের দিকে হৃদযন্ত্র থাকে সেইখানে মুজেল ঠেকিয়ে ট্রিগার চাপল।

অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব ৭৭ (২)

আব্দুল আহাদের হৃদপিন্ড ফুঁড়ে এসে সবটুকু রক্তই জয়ের বুক, লুঙ্গি, মুখ, হাতে ভরে গেল। জয় চোখদুটো বুজে তার অটোসেমি বেরেট-92FS পিস্তলের আরও চারখানা গুলি বড় তৃপ্তির সাথে আব্দুল আহাদের দেহকে সামান্য আলগা করে বুকে বিঁধাল। তার ঘরওয়ালি তার সাথে যে বিরোধিতার আয়োজন করেছে, তাতে আব্দুল আহাদের ওপর ঘরওয়ালির স্নেহের ভাগ অনেকটা। এদেরকে মুক্ত করার জন্যই এত আয়োজন। তাই জয় সেই আব্দুল আহাদের দেহটাকে তৃপ্তিমতো ঝাঝরা করল।
অন্তূ জানলে নিশ্চয়ই বলতো, জয় আমির মানসিক ভাবে অসুস্থ। পলাশকে পাগল বলা জয় আমির নিজেও স্যাডিস্ট।

অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব ৭৯