অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব ৮০

অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব ৮০
তেজস্মিতা মুর্তজা

রাতের বেলা ঘরে ফিরে ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ল হামজা। ঘুম আসার সম্ভাবনা নেই। রিমি কোনোভাবেই জয়কে আবার দেখতে যেতে দেয়নি। পা দুটো ঝিমঝিম করছিল, যেন রক্ত ও স্নায়ু নেই।
রিমি পা টিপতে টিপতে লাগল। হামজা রিমিকে চোখ ভরে দেখতে লাগল। শাড়ির আঁচলটা প্রায় নেমে আছে বুক থেকে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে খোঁপা থেকে বেরিয়ে ছড়িয়ে আছে মুখ, কপাল ও গলার দিকে। সে কি দিনদিন পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে কিনা জানা নেই। তার বয়সটাও রিমির চেয়ে অনেকটাই বেশি। এই ছোট্ট মেয়েটা আজকাল অবাধ্য হতে লেগেছে। এসব কার করা ক্ষতি? হামজার ভেতরের চাহিদায় অসুস্থতার চাপ পড়ল।
কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি ও দৃষ্টিতে ওঠা কথা রিমি বোঝে। হামজাকে দমাতেই নাকি জানা নেই, রিমি বলে উঠল, “জয় ভাইয়া আর দু’দিনের মধ্যেই বাড়ি ফিরে আসবে। কোনোরকম উঠে দাঁড়াতে পারলেই তাকে বেঁধেও আর হাসপাতালে রাখা যাবে না। সেই ফাঁকে তাকে এদিকের দেখভালে রেখে আপনি যাবেন ট্রিটমেন্টের জন্য। নিজের ভালো পাগলও বোঝে।ʼʼ

হামজা বড় বাধ্যর মতো মাথা নাড়ল। কিছুক্ষণ চুপচাপ নিষ্পলক রিমিকে দেখে জিজ্ঞেস করল, “আরমিণ কোথায়? বাড়িতে নেই কেন?ʼʼ
রিমির শরীরটা ঝাঁকি খেল একটা। কিন্তু কী যে তার হলো, সে চট কোরে বলে ফেলল, “সেটা নিয়েই তো হয়রান আমি। সারাদিন ভাবছি সে কোথায় গেছে? আমরা যেদিন আপনার কাছে গেলাম, ওকে তো বাড়িতে রেখে গেছিলাম।ʼʼ
হামজা একটু চুপ থেকে বলল, “সে বাড়িতেই ছিল, যখন তোমরা যাও?ʼʼ
হামজার সামনে মিথ্যা বলা দুঃসাধ্য। রিমির গলা কাঁপছিল, তবু সে বলল, “হ্যাঁ। আর কোথায় থাকবে? কিন্তু আমার মনে হয় আপনি তো এমনিতে ও বাড়িতে যাবার অনুমতি দেন না, ফাঁকা পেয়ে ওখানেই গেছে।ʼʼ

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

হামজা বিশ্বাস করেছে কিনা তা দেখার জন্য তাকাতেও সংকোচ হলো রিমির। কিন্তু সে কোনভাবেই বলবে না আরমিণ কোথায়। সে হামজাকে দূর্ভাগ্যবশত ভালোবাসতে পারে, কিন্তু বিশ্বাস করে না। সারাটাদিন তার যে কলিজা পুড়ছে, সেটাও সে এই পুরুষটাকে বুঝতে দেয়নি। সেই জ্বলুনিতে এক পশলা ঠান্ডা পানির মতো সংবাদ—আরমিণ গর্ভবতী। রিমি গোসলে গিয়ে পাগলের মতো কেঁদেছে। সে তার দুটো সন্তানের ভ্রুণকে নিজ হাতে হত্যা করেছে। আরমিণ কেন সামলে রেখেছে তাহলে?
সন্দেহ তো রিমির আগেই হয়েছিল। সেদিনও রান্নাঘরে এই কথাটা বড় ধূর্ততার সাথে এড়িয়ে গেছে আরমিণ। রিমি আরমিণের মতো চালাক হলে সেদিনই ধরে ফেলতো। কিন্তু জেনেশুনে আরমিণ জয় আমির সন্তান গর্ভে ধারণ করেছে কেন? কী উদ্দেশ্যে?

সকালটা হামজার চরম ব্যস্ত কাটল। অসুস্থতা পাত্তাই পেল না। সে সকাল সকাল দল নিয়ে পুলিশফাঁড়ি, ক্লাব ও পার্টিঅফিস ঘুরল। এই কদিনের সব তথ্য পকেটে ভরলো। আরমিণের বাপের বাড়ি থেকে খোঁজ এলো, সেখানে আরমিণ নেই। রিমি বলতেও পারছিল না, এত খোঁজ করছেন কেন? বাড়ির বউ নিখোঁজ, খোঁজ তো করতেই হবে।
হামজা হেসে জিজ্ঞেস করল, “তুমি যখন ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরোলে, তখন আরমিণ সত্যিই বাড়িতে ছিল?ʼʼ
-“কেন জিজ্ঞেস করছেন বারবার একই কথা?ʼʼ
রিমির দুই গালে পরম আবেশে দুই হাত রেখে ঠান্ডা গলায় বলল হামজা, “রিমি, আমার আর জয়ের মাঝে যে-ই আসুক, যা-ই আসুক তাকে আমার তোপে ছাই হতে হবে। মুরসালীন বড়ঘরে থেকে আমার অনেক ক্ষতিই করেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ক্ষতি– জয়কে ভুলভাল অনেককিছু বুঝিয়েছে। জয়ের আমার প্রতি দ্বিধাভরা আচরণের কারণ ছিল সে। আমি কীভাবে সহ্য করেছি কয়টাদিন, আন্দাজ করতে পারো? আমার আন্দাজ সঠিক হলে সে জয়কে এটাও বলে দিয়েছে আমি জিন্নাহকে মেরে ফেলেছি।ʼʼ

রিমি আঁৎকে উঠল। এই জিন্নাহর খোঁজে বছরের পর বছর পাগল হয়ে ছুটতে দেখেছে সে জয়কে।
-“কেন মেরেছি জানো? জিন্নাহ্ থাকলে জয় আমার দেয়া ঠিকানা ও পরিচয় ভুলে যেত। একসময় হয়ত আমার সঙ্গও ছেড়ে দিতো। আমি সহ্য করতে পারতাম না, রিমি। তাই জিন্নাহ্টাকেই সরিয়ে নিয়েছি জগৎ থেকে। জয় শুধু খুঁজবে, আমি সঙ্গ দেব তাকে খুঁজতে, কিন্তু তাতে পাবার সম্ভাবনা থাকবে না। একথা জয় জানলে যদি আমায় ঘেন্না করে আমি ওর পা ধরে ক্ষমা চাইব। ওকে বলব, তুই মেরে ফেল আমায়। তবু তোর চোখ দিয়ে আমায় ঘৃণার নজরে দেখিস না। আমার সয় না। পাগল হয়ে যাব আমি। ওকে আমি এই দেখো, আমার এই দুই হাতে, এই হাতের ওপর মানুষ করেছি। ও আমার জান, আমার ছেলে। আমার এই হাত ও ছাড়তে পারে না কোনো শর্তেই। সেই শর্তকেই আমি দুনিয়ায় রাখব না।ʼʼ

রিমির ভেতরে এক নিগূঢ় ভয় কাজ করতে লাগল হামজার জন্য। হামজার কঠিন স্বভাবের মুখখানায় এখন নিদারুণ আবেগ খেলছে। কিন্তু রিমি দেখল এই আবেগ যেন ধারালো শূলের চাইতেও বর্বর আর ভয়াবহ।
-“সেই একই কাজ আরও সূক্ষ্ণ আর গভীরভাবে আরমিণ করেছে। আমি বলেছিলাম না তোমায় ও আমার বিশাল ক্ষতি করছে! তুমি জানো না রিমি, ও জয়কে চিরতরে নিজের সীমানায় বন্দি করার বন্দোবস্ত করে ফেলেছে। কী ভয়ানক, রিমি। ভাবতে পারো? ওকে আমি ভয় পাই। হ্যাঁ, ঠিক ছিলে তুমি। খুব ভয় পাই আমি। কারণ ও ভয় পায় না। না হারাতে না মরতে।ʼʼ
রিমি দম আঁটকে আসছিল এতক্ষণ, এবার সে কেমন অপ্রকৃতস্থর মতোন প্রতিবাদ কোরে উঠল, “আমি থাকতে আপনি ওর কোনো ক্ষতি করতে পারবেন না। তার আগে আমাকে মারতে হবে।ʼʼ
হামজা হেসে ফেলল, “খুব নিম্নমানের ভাবনা তোমার, গিন্নি। তুমি আমার সঙ্গে বিরোধ রচনা করছো। তুমি আজও ফেইল। পারলে না আমার অর্ধাঙ্গিনী হতে।ʼʼ

-“এ আমার সৌভাগ্য, গর্বের কথা।ʼʼ
-“খুব বাজে কথা, রিমি।ʼʼ
-“আপনি এত নোংরা কেন? নিজের ভেতরে যে এত এত পাপ পুষছেন, তারা কখনও ধিক্কার দিয়ে ওঠে না আপনাকে?ʼʼ
-“মানবজীবনে ক্ষুধা, চাহিদা, প্রবৃত্তি জলন্ত নক্ষত্রের মতো। নক্ষত্র বেশি সক্রিয় হলে তা মারা যায়। আর নক্ষত্রের মৃত্যু মানে বোঝো তো, রিমি? কালগহ্বরের সৃষ্টি। যা এতটাই অসীম যে তার ভেতর আলোকরশ্মি প্রবেশ করলে তাও আর মুক্তি পায় না, বিলীন হয়ে যায়। তাতে তুমি কত কী দেবে? কত ক্ষমতা, কত ঐশ্বর্য, কত শক্তি! সব তলিয়ে যাবে অসীম বিবরে।
আমি সেরকম এক মৃত নক্ষত্র। ন্যায়-নীতিও সব তলিয়ে যায় আমার গর্ভে। পুস্তকগত জ্ঞানে আমি মানুষের সংজ্ঞা জানি। সে হিসেবে আমি মানুষ নই, রিমি। আমি হলাম ধাঙর। আমি এতটাই ক্ষুধার্ত যে দুনিয়ার সমস্ত আবর্জনাসহ পাপ-পূণ্যকেও গ্রাস করে বসে আছি। মেনে নাও, সুখে থাকবে।ʼʼ

-“এটা সুখ নয়, নরকবাস।ʼʼ
-“নারী কোথায় সুখী তা আমার জানা নেই, তাই বলতে পারছি না। তবে যদি এটা নরকবাস হয়, হলো। তবু আমার সঙ্গ ছাড়ার সুযোগ নেই তোমার কাছে। তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী, রিমি।ʼʼ
রিমির চোখদুটো লাল হয়ে ছলছল করতে লাগল। হামজা বলল, “আরমিণ কি আমির নিবাসে, রিমি?ʼʼ
রিমি জবাব দেয় না, কেবল চোখেই ভষ্ম করে দিতে চাইল যেন।
-“আমার বিরোধিতা কোরো না, রিমি। আমি বিরোধীকে জিইয়ে রাখি না। আজ তোমার আচরণে যদি একবারের জন্যও আমার মনে হয় তুমি আমার কাজে বাঁধা হতে চাও, আমি তোমাকে মেরে ফেলব। কেননা এবার আমি যা করব, তা আমার অস্তিত্বের প্রশ্ন।ʼʼ

রিমি তবু ঠিক হামজার পথ আঁটকে দাঁড়িয়ে বলল, “এতদিন যা করেছেন, আমি কোনোদিন সরাসরি বাঁধা দিতে পারিনি আপনাকে। কিন্তু আজ এমন হবে না যে আমি এখানে বসে থাকব চুপচাপ, আপনি ওদিকে যা নয় তাই করবেন।ʼʼ
হামজা খুব সাবলীলভাবে রিমিকে সরাতে চাইল, কিন্তু সে অবাক হয়ে গেল, রিমি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে, “আজ সব সীমা, সম্মান, মনুষত্বের ঊর্ধ্বে চলে গেছেন, আপনি। আমাকেও যেতে দিন।ʼʼ

হামজার চোখদুটো জ্বলে উঠল যেন। রিমি এরকম হামজার সম্মুখীন হলো প্রথমবার। সত্যিই হামজা রিমির চুলগুলো মুঠো কোরে চেপে ধরে কোনো এক বিড়ালছানার মতো ছুঁড়ে ফেলল মেঝের ওপর রিমিকে। মরমর করে উঠল রিমির হাড়গুলো। কপাল ও থুতনি ফাটল। তবু রিমি উঠে এসে হামজাকে কষে এক ধাক্কা মারে। হামজা টাল সামলে রিমির গলা চেপে ধরে ছেচড়ে রুমের ভেতরে নিয়ে গিয়ে ধপাস করে ফেলে দিলো বিছানার ওপর। প্রায় বুকের চড়ে গলাটা চেপে ধরে রাখল কতক্ষণ। রিমির চোখে রক্ত উঠে এলো, তখন ছেড়ে দিয়ে বলল—
-“তুই নিজে আমার সন্তানের খুন করে ওই খানকি মাগীর বাচ্চা নিয়ে পূণ্যবতীর পরিচয় দিতে চাচ্ছিস? তোর কথা অনুযায়ী আমার মতো পাপীর সন্তান থাকতে নেই, তো জয় কি ফেরেশতা রে? আমার আর জয়ের পথ এখনও অনেক লম্বা। তোদের মতো দুই চারি শ খানেক বেইমান মাগী খুন হতে পারে যদি বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। জয়ের জীবনে আমি কোনো পিছুটান রাখব না। তুই তা বদলাতে পারবি না।ʼʼ

তুলি এসে হামজাকে ধাক্কা মেরে সরালো, “পাগল হয়ে গেছিস তুই? মানুষ মারতে মারতে হাত এত লম্বা হয়ে গেছে, ঘরে যে আদর্শের মুখোশ পড়ে থাকতি, সেটাও খসে গেছে? সরে যা জানোয়ার!ʼʼ
হামজা বেরিয়ে গেল। কাশতে কাশতে দম আঁটকে এলো রিমির। তবু সে কাঁকুতি করে ওঠে তুলির কাছে, “আপু, ওকে থামান। ও আজ সর্বনাশ করতে যাচ্ছে।ʼʼ
হামজা তুলিকে টেনে বের করে দিয়ে রিমিকে বিছানার ওপর ফেলে রেখে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে রেখে বেরোলো। বলে গেল এ বাড়ির সীমানা একটা পাখিও যেন না পেরোতে পারে।

জয় আমির গুলিবিদ্ধ হবার শেষরাত থেকে হাসপাতালের বাইরে মোতায়েন ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সেদিন দুপুরের পর পরই রউফ কায়সারের পক্ষ থেকে জয়ের কেবিনের সামনে জড়ো হয়ে পড়ল। ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল জয় আমির আইনের নজরদারীতে বন্দি হয়ে পড়ল। আইনের পক্ষ থেকে তার জন্য এখন কেবল জীবন বাঁচিয়ে নেবার মতো চিকিৎসা গ্রহণের অনুমতি রয়েছে। সামান্য সুস্থ হলেই কারাগারে স্থানান্তর করা হবে, এরপর আদালত।
হাসপাতালে যাবার পর হামজা অবাক হলো পুলিশদের আগ্রাসী ভূমিকা দেখে। সে সকালে উপরমহলে কথা বলে এসেছে, লাখ কয়েক টাকা প্রাথমিক পর্যায়ে গুণে ছড়িয়ে দিয়ে এসেছে। দুজনের আউটডোর ভিসা রি-নিউ হচ্ছে ওদিকে। এর মধ্যে এত দুঃসাহস দেখানোর কারণ কী! থানা পুলিশ হামজাকে দেখে একটু নড়েচড়ে উঠল বটে। একটু গাইগুই করল। কেউ বা বলল, ‘পুলিশফাঁড়ি থেকে ভেগে এসে ঠিক করেনি জয় আমির। নয়ত আমরা সামান্য কনসিডার করতে পারতাম হামজা সাহেব। এখন আর সেই জায়গা নেই।ʼ

তাহলে কি এমপিও তাই চেয়েছিল? যে যদি তার প্রচেষ্টায় জয় আমিরের কৈ মাছের জান না-ও বেরোয়, তো ভয়ানক এক মামলায় তাকে দীর্ঘভাবে ফাঁসতে তো হবেই।
জয় হামজাকে দেখে কেবল তাকিয়ে রইল। তার ভেতরে অতিরিক্ত প্রশ্ন জমে সে বোবা হয়ে গেছে যেন। এখনও রিজার্ভ ব্যাগের খানিকটা রক্ত খুব ধীরে শরীরে যাচ্ছে তার। সাডেটিভের প্রভাবে চোখ বুজে এলো।
হামজা হাত ধরে বসে রইল। দুপুর পেরিয়ে গেল। তখন দুপুরের ইঞ্জেকশন দেবার পর জয় আবার ঘুমিয়েছে। হামজার ওঠার সময় হলো। সে জয়ের মাথায় হাত নেড়ে উঠে এলো। জয়ের দিকে একবার কোরে তাকালেই সে টের পাচ্ছে আরমিণের কাছে যাওয়া তার জন্য ফরজ হয়ে গেছে। তার এখন আরও অনেক ধ্বংসতান্ডব চালানোর ছিল। কিন্তু তা এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বোকামি হবে। দিন তো ফুরিয়ে গেল না। এখন আপাতত কোনোরকম জয়কে বর্তমানের বিষাক্ত পিছুটানটুকু ছাড়িয়ে দেশের বাইরে পা রাখতে পারলেই ব্যাস।

রাত হলো হামজার আমির নিবাসে পৌঁছাতে। অনেকদিন পর এলো এখানে, বহুদিন পর। তার বুকে একটা ব্যথা কাজ করে এই বাড়ির কথা খেয়ালে এলেও। হুমায়িরা ফুপুর মুখখানা আবছাভাবে মনে পড়লে হামজার মন চায় আরেকবার মৃত্যুর খেলা খেলতে। আজও মনে পড়ল–শীর্ণদেহী লম্বাটে হামজা চাল-সবজি, পকেটে হুমায়িরার দেয়া ক’টা টাকা নিয়ে আমির নিবাসের ফটক পেরিয়ে বেরোচ্ছে। দারোয়ার পিঠ চাপড়ে বলছে, “ফুবুডারে ভালো পাইয়া চুইষা খাইতাছো, মিয়া? বড়লোক দেইখা বিয়া দিয়ার এই তো ফায়দা, অ্যাহ্!ʼʼ

হামজার যে কী লজ্জা করতো! ইচ্ছে করতো দাফন হয়ে যেতে। তবু সে মাথাটা নত কোরে বেরিয়ে যেত। শাহানা বসে আছে, রান্না হবে সে বাজারগুলো নিয়ে গেলে। আজ হামজার বাড়িতে বাজার আসে ভ্যান ভরে। সেই বাজার টেনে দোতলায় তুলতে দুজন লোক হাঁপিয়ে ওঠে। কিন্তু হুমায়িরা ফুপু আর নেই ঋণ ফিরিয়ে নেবার জন্য, অথবা সমাজের বিশিষ্ট মানুষ হয়ে ওঠা হামজাকে দেখার জন্য।
সদরদরজায় ধাক্কাধাক্কি করে ভেঙে ফেলার জোগাড় হলো, তবু ভেতর থেকে দরজা খুলল না আরমিণ। গালি দিলো হামজা, “শেয়ানা মাগী!ʼʼ

হামজা কথা না বললে দরজা খুলবে না, আর হামজার কণ্ঠ শুনলে তো মোটেই না। যে চালাক চেংরি! জঙ্গলের পার্শ্বে পিছন দিকের আধভাঙা জানালা-দরজা পাওয়া গেল। এত বছর পড়ে আছে বাড়ি, চোর ও নেশাখোরদের কাছে ভূতের কোনো কদর নেই। এ বাড়ির দামি সরঞ্জামগুলো খুলে নিয়ে বিক্রির চেষ্টা থেকে জয়নাল আমিরের ভূতও ঠেকাতে পারেনি তাদেরকে।
তা হামজার কাজে লাগল বাংলা ঘরের পেছনের লোহার দরজা খুলে নিয়ে গিয়ে কে কোথায় বিক্রি কোরে খেয়েছে। সামনের কাঠের দুয়ার ঘুণে ধরা। কয়েকজন জোয়ানের আঘাতে তা ভেঙে পথ তৈরি হলো। সেদিক দিয়ে ঢুকলেই উঠান, তারপর বড় বারান্দা পেরোলেই অন্দরমহল। খুব সহজে সে এসে অন্তূর পেছনে হলরুমের মাঝখানে দাঁড়াল। অন্তূ তখন ভীত-সতন্ত্র চোখে দরজায় কান বাঁধিয়ে বসা।
-“আর শব্দ আসছে না, আরমিণ? লোকগুলো বোধহয় চলে গেছে। জানে তুমি সতর্ক মেয়েলোক, খুলবে না কখনোই।ʼʼ

অন্তূর শরীরটা থরথর কোরে কেঁপে উঠল। হামজা মদের বোতলে চুমুক দিতে দিতে টলতে টলতে এসে দাঁড়াল অন্তূর খুব কাছে। ভয়ংকর দৃশ্য।
অন্তূকে পরখ করে দেখে হামজা চোখ বুজে হাসল। সপ্তাহখানেক আগে দেখেও বোঝার একরত্তি উপায় ছিল না, সে গর্ভবতী। এত শেয়ানা মেয়েলোকের দেখা আগে পায়নি হামজা। কিন্তু আজ এই অন্ধ কুঠিরে একাকি না খাওয়াসহ বিভিন্ন চাপ ঠিক সেই মেয়েলি অসুস্থতা টেনে বের কোরে এনেছে। তবু সুন্দরী! যদিও হামজার কোনো আগ্রহ নেই অন্তূর মেয়েলি শরীরে। জয় আজ অন্তূকে দেখলে এক মুহুর্তে ধরে ফেলতো, তার বীর্য তার ঘরওয়ালির শরীরে বাড়ন্ত।

হামজা অন্তূর কাছ ঘেষে বসে পড়ল। হা কোরে শ্বাস ফেলল কয়েকটা। দুজন বিরোধীতার চূড়ান্ত ঘোষনা জানাল যেন পাশাপাশি বসে। উৎকট গন্ধ হলরুম জুড়ে। শব্দ কোরে মদের বোতল খুলে একটি ছোট্ট শিশি থেকে কী একটা তরল ঢালল তাতে হামজা। ঝাঁঝালো গন্ধ সেই তরলের। অন্তূ জানে না ওটা ফরমালডিহাইড লিক্যুইড। অ্যালকোহলের সাথে মিশলে ফরমালিন জাতীয় বিষ তৈরি হয়। এ অবস্থায় তা অন্তূর জন্য মরণসম ও ভ্রুণের জন্য অবধারিত মরণ।
হামজা অন্তূর মুখের খুব কাছে মুখ নিয়ে ঘাঁড় কাত করে বলল, “তুমি আমার এত ক্ষতি কেন করলে, আরমিণ?ʼʼ
অন্তূ শক্ত ঢোক গিলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এটা উপযুক্ত সময় নয় জবাব দেবার। শান্তভাবে মোকাবেলা করার চেষ্টা করা উচিত।

-“তুমি আমার জয়কে ঠিক কীভাবে ধ্বংস করতে চাও? আর কত ক্ষতি করে থামবে?ʼʼ
অন্তূ হেসেই ফেলল, “জয় আমিরের ক্ষতি? সেটা চাইলেও কেউ আপনার চেয়ে বেশি করতে পারবে? সম্ভব?ʼʼ
-“আমি? আমি ক্ষতি করব জয়ের?ʼʼ
-“আর করার জায়গা নেই। সে ইতোমধ্যে আপনার সহচর্যে পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত।ʼʼ
হামজা অন্তূর মুখের ওপর শ্বাস ফেলে অবাক হবার মতো বলল, “আজও এই পরিস্থিতিতেও তুমি এভাবে কথা বলবে আমার সঙ্গে?ʼʼ
অন্তূ জবাব দেবার প্রয়োজন মনে করল না। হামজা খুব সুন্দর কোরে হাসল, “আমাকে ধ্বংস করা তোমার স্বপ্ন। তোমার স্বপ্ন দেখার অধিকার তো আমি কেড়ে নিতে পারি না। কিন্তু এছাড়াও আরও অনেক কিছুই রয়েছে যা আমি কেড়ে নিতে পারি। যা তোমার মতো ছলনাময়ী, কুচক্রী সর্পিনীর কাছ থেকে তার বিষদাঁত ভেঙে নেবে।ʼʼ
-“আর নেই কিছু আমার।ʼʼ

গলা আরও শ্লথ করল হামজা, অন্তূর মুখে দৃষ্টি চালিয়ে বলল, “উহুউম! এই ছলনা জয়ের ওপর খাটে। আমি তোমার কাছে তেমন কিছু পাইনি যা আমাকে আচ্ছন্ন করে তুলবে আর তোমার এই খেলায় গুটি হবো আমি।ʼʼ
নোংরা ইঙ্গিতে অন্তূর শরীর ভার হয়ে এলো। খুবই কাছে বসে আছে হামজা। হামজা এবার অন্তূর চুল মুঠো কোরে নরম ঠোঁটের ওপর গ্লাস চেপে ধরল অদ্ভুতভাবে, “নাও পান করো এটা।ʼʼ
অন্তূ মুখ সরিয়ে নিলো। তাকে সর্বোচ্চ ভয় যে তার সম্মান হরণ ও তাকে স্পর্শের মাধ্যমে পাইয়ে দেয়া যায় একথা যেন সবার জানা। অন্তূর মনে হলো–এই দূর্বলতার কাছে সে বারবার হেরেছে। আজও বুক কাঁপছে। শরীর অবশ হচ্ছে।
চুল মুঠ করে ধরে অন্তূ ওপরভাগে চড়ে বসার মতো করে অন্তূর মুখের ওপর মুখ রেখে হামজা বলল, “তুমি গর্ভবতী, হুহ্?ʼʼ
অন্তূ শারীরিক উদ্দীপনা থমকে রইল। বুকে ঢিপঢিপ শব্দ উঠে গেল। তার নীরবতা যেন হামজাকে জবাব দিয়ে দিলো।

-“জয় জানে না!ʼʼ হাসল হামজা।
মাসখানেক আগে অন্তূ টের পেল তার শরীরে গর্ভাবস্থার লক্ষণ স্পষ্ট। ঘৃণ্য পাপী, ও তার এক জীবনের আসামীর রক্ত-বীর্য নিজের শরীরে; তার কেমন লেগেছিল সে নিজেও বোঝেনি। সেই অদ্ভুত অনুভূতি কেবল অদ্ভুত, বর্ণনা করা যায় না, তা ছিল মিশ্র।

কিন্তু অন্তূর কাছে বিবাহিত জীবন বলতে একটা সংসার ও এক পুরুষই বোঝায়। যে পাপী হলেও অন্তূ তার ছোঁয়ায় সিক্ত। তা মোছার উপায় নেই। অন্তূর একটা ভবিষ্যত অবলম্বণ চাই, যা পেচিয়ে ধরে সে তার অনিশ্চিত ভবিষ্যত পাড়ি দিতে পারে। একটা সন্তান, নিজের গর্ভজাত আপন। এটা কতটা মূখ্য ছিল জানা নেই। মূখ্য বিষয়টা ভয়াবহ বটে। জয় আমিরের একটা পরিবারের নেশা রয়েছে, আমির পরিবারের উত্তধাধিকারী পাবার পাগলামি আছে।

এর চেয়ে বড় শাস্তি তার জন্য হতে পারে না যে সে জানল তার সন্তান রয়েছে, কিন্তু তাকে চোখে দেখার বা ছোঁয়ার সাধ্যি ও অধিকার তার রইল না। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রাপ্ত আসামীর এক জীবন ফুরিয়ে যায় বন্দিত্বেই। যে নিজের পরিবারকে হারিয়ে আরও অসংখ্য পরিবার একইভাবে উজাড় করেছে, তার নতুন করে পরিবার ও সন্তান হতে নেই। অন্তূর সন্তানের ওপর কেবল অন্তূর অধিকার থাকবে। অন্তূর জীবনের খুঁটি। তাতে জয় আমিরের ভাগ নেই। শেষ জীবনে জয় আমির মুক্ত হবে মৃত হয়ে। ওই বেঁচে থাকা মৃত্যুর ঊর্ধ্বে।
সে এই খবর ততদিন পর্যন্ত দুনিয়া থেকে গোপন রাখতে চেয়েছিল যতদিন না জয় ও হামজার পাপে কারাবদ্ধতা আসছে। হয়নি তা।
হামজা অন্তূর শরীরের ওপর উবু হয়ে ঝুঁকে তরল ভর্তি গ্লাসটা এগিয়ে দিলো, “নাও, ড্রিংক ইট।ʼʼ

-“আমি অ্যালকোহলে অভ্যস্ত নই।ʼʼ
-“কোনো ব্যাপার না। ট্রাই করে দেখো।ʼʼ
তীব্র ঝাঁঝাল ও বিষাক্ত গন্ধে অন্তূর বুক অবধি জ্বলে উঠল।
-“কী মিশিয়ে পান করতে দিচ্ছেন আমায়?ʼʼ
-“টেস্ট করে দেখো।ʼʼ
-“মরে গেলেও না।ʼʼ
হামজা মাথা দোলায়, “মরবে না তুমি। মারব না আমি তোমায়। আমি সহজে মারি না কাউকে।ʼʼ
-“আপনি কী চাইছেন বুঝতে পারছি না।ʼʼ
-“বুঝতে পারছো। তুমি বোকা নও। তুমি কুচক্রী, ঘাতকিনী।ʼʼ
-“আমার বাচ্চা আপনার কোনো ক্ষতি করেনি।ʼʼ
-“করবে। জয়কে আমার কাছ থেকে কেড়ে নেবে, ওকে পথভ্রষ্ট করবে, মায়ায় বাঁধবে, পিছুটান তৈরি হবে। তা হতে দিতে নেই।ʼʼ

খানিক চুপ থেকে তাচ্ছিল্যে স্বগোতোক্তি করল, “যেভাবে তুমি ছোট্ট এক দানা বালুকণা থেকে আমার জন্য মহাদেশ হয়ে উঠেছ!ʼʼ
অন্তূ দেখল ঘৃণাভরে হামজাকে। হামজা কিছু বলবে, গুরুত্বর কিছু। জানা নেই আর কী শোনার আছে—
২০১১ এর মাঝামাঝিতে একদিন হামজার কাছে কুষ্টিয়া থেকে বার্তা এলো ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক জঙ্গির অনুসারী পাওয়া গেছে। সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো সে হামজার অঞ্চলের ছেলে। অন্তিক প্রামাণিক। স্কুল মাস্টার আমজাদ আলী প্রামাণিকের ছেলে।

সমস্যাটা অন্তিকের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই। সে যখন হলে উঠবে, লীগের বড় ভাইয়েরা বলল, গণরুমে থাকবি। কিন্তু গণরুমে থাকার একটা সুবিধা হলো—বড়ভাইয়েরা যখন-তখন মিছিলসহ রাজনৈতিক কর্মে যোগদান, দলে নাম দেয়া, মদ পান, আড্ডা, নারীবাজি, চাঁদাবাজি ইত্যাদির ডাক দেন। তার ফলে পড়ালেখা ছেড়ে উঠে যাবার সুযোগ রয়েছে, পড়ার খাটুনি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
কিন্তু অন্তিক এসবে আগ্রহী না। সে আপত্তি জানিয়েছে বেশ কয়েকবার। তারপর তাকে নজরে রাখা হচ্ছিল, সে জানেই না। ২০১১ এর শেষের দিকে দেশের পরিস্থিতি গরম। মুক্তিযুদ্ধে কে বিরুদ্ধাচারণ করেছে, কে পাকিস্তানের চর ছিল এই নিয়ে দুই প্রধান দল কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করছে। বছরের শেষের দিকে একটা অভ্যুত্থান হতে হতে হলো না। অভ্যুত্থানটা ছিল ইসলামপন্থি কিছু সংগঠনের পক্ষ থেকে। ভারত এর পুতুল হয়ে থাকা চলবে না, এই উদ্দেশ্যে। কিছু গ্রেফতার-ট্রেফতার চলার পর তা থামল।

এর মাঝে অন্তিক একজন মোটামুটি পর্যায়ের সভ্য পুরুষ। সে ইসলামী অনুষদের দাওয়াহ্ বিভাগে অনার্স করছিল। সর্বনাশের মূল-অংশ এখান থেকেই এলো বোধহয়। দাওয়াহ্কে ইসলামি অনুশাসনমূলক রাজনৈতিক ক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
পরে অন্তিক আসন পেয়েছিল বঙ্গবন্ধু হলে। একদিন রাতে সে পড়ছে। হঠাৎ-ই তার ডাক পড়ল। সে বের হতেই একদল তাড়া করল তাকে। তাদের হাতে চাপাতি, ছুরি, স্টিক। অন্তিক না বুঝেই দৌঁড়াতে শুরু করল। হল চত্বর পেরিয়ে রাস্তায় প্রাণপনে অনেকটা ছুটে সে মণ্ডলপাড়া মসজিদ অবধি পেরিয়ে এলো। তখনও পেছনে কমপক্ষে আট-দশজন ধাওয়া করছে তাকে। সে মসজিদের অদূরে ভাঙা টিনের এক গেইট প্রায় আরেকটু চ্যাপ্টা করে ভেঙে মাঝরাতে ঢুকে পড়ল অচেনা কারও বাড়িতে।
শব্দে বাড়ির কর্তার আগে টিনের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো যুবতী মেয়ে। অন্তিক অনুরোধ করে, “আমাকে একটু লুকোনোর জায়গা দিন।ʼʼ

ঝাঁঝাল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে যুবতী, “কে আপনি? কেন লুকানোর জায়গা দেব?ʼʼ
-“আমি অন্তিক। ভার্সিটির ছাত্র।ʼʼ
গলা শুকিয়ে কাঠ, শরীর থরথর কাঁপছে তখন অন্তিকের। আর কিছু বলতে পারল না সে। মেয়েটা অন্তিককে ঘরের ভেতর দিয়ে নিয়ে গিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে আমবাগানের ওদিকে বের করে দিলো। বলল, “ওই ঝোঁপের ওদিকে যদ্দূর পারেন পালান।ʼʼ
কণ্ঠটা তখনও ঝাঁঝাল। মেয়েটার নাম মার্জিয়া। বয়স কত হবে? ঊনিশ-বিশ?
তার বিশ মিনিটের মাঝে মার্জিয়াদের বাড়ির টিনের প্রাচীরে ঘেরা উঠোন ভরে গেল ছাত্র দ্বারা। ওরা কাউকে খুঁজতে এসেছে। এদিকেই পালিয়েছে কোথাও। এ বাড়িতেই বোধহয় ঢুকেছে। এবার বাড়ির সবাই বেরোলো। তারা কেউ কিচ্ছু জানে না–কে এসেছে, পালিয়েছে। পুরো বাড়িতে ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডব চলল। ঘরের একেকটা কাপড়চোপড় রাখার র‌্যাক অবধি ছাড় পেল না। যেন অন্তিক কাপড়ের ভাজে বসে আছে মার্জিয়াদের ঘরে। মার্জিয়ার মা কাঁদতে লাগলেন।

পুরো পাড়াই কমবেশি জেগে উঠল। কিন্তু কেউ বাড়ির ভেতরে এলো না, যতক্ষণ না ওরা বেরিয়ে গেল। এদের সামনে আসতে নেই। তারা সচেতন জনগণ। কিন্তু ওরা দেখেছে অন্তিক এদিকেই ঢুকেছে। তবু না পেয়ে ক্ষিপ্রতা বাড়াই তো স্বাভাবিক। মার্জিয়ার দাদির ঘরের দরজা দুই লাত্থিতে চুরমার হয়ে ভেঙে পড়ল। মাঝরাতে বাড়িটা এক টুকরো পাগলা ঝড়ো হাওয়ায় বাড়ি খেলো। মার্জিয়ার আব্বা মাঝবয়সী মানুষ। তাতে কী? তিনি মার খেলেন। হুমকিও পেলেন, যদি ওই ছেলেকে লুকিয়েছে বলে জানা যায় জ^বাই করে রেখে যাওয়া হবে।
কিন্তু ঘটনার মূল কালপ্রিট মার্জিয়া যথাসম্ভব চুপচাপ আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল। যুবতী মেয়েদের এদের সামনে আসতে নেই। সেদিন সারারাত বাড়ির সামনে একগাদা ভারী পায়ের বিচরণ শোনা গেল। অথচ মার্জিয়া সকালে বাড়ির পেছনের ডোবার ধারে ঝোঁপে অন্তিককে খুঁজতে গেল। কাহিনি শোনার চেষ্টা করল। বাড়ির সাথে বাড়ি লাগানো। পাশের বাড়ির মহিলারা না দেখবে কেন?

মার্জিয়ার বদনাম হলো। বাড়িতে মার্জিয়া মার খেল। ছোটচাচা ও মা মিলে মারল মার্জিয়াকে। আব্বা ঘেন্নায় কথা বন্ধ করে দিলো। বাড়িতে মার্জিয়া ভুল বোঝাবুঝিতে ঘৃণিত হয়ে উঠল। সবাই নিশ্চিত অন্তিকের সাথে বহুদিনের সম্পর্ক। তাই তো তাড়া খেয়ে এসে প্রেমিকাকে জাগিয়ে আশ্রয় নিয়েছে ছ্যাঁড়া। আবার এতকিছু হলো তবু লাংয়ের খোঁজ দিলো না মেয়ে।

দু’দিন ওভাবেই পলাতক থাকার পর অন্তিক জানতে পারল সে মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত। বঙ্গমাতা হলের এক ছাত্রীর সাথে কয়জন কী করেছে, সেটার দায় অন্তিকের। এবার ছাত্র উপষদসহ হলের প্রধানরাও অন্তিকের বিরুদ্ধে। এবং এটার কারণ হিসেবে বলা যায়–অন্তিক কোন সাহসে বড়ভাইদের আহ্বান ঠুকরায়। তার পথ কোনটা? অন্তিকের এই পরিণতি জুনিয়রদের জন্য শিক্ষা হয়ে থাকবে। পরে জানা গেল, এটার চেয়ে বড় কারণ অন্তিক যে গোপনে টুকটুক করে ইসলামী সংগঠন ও দাওয়াহ্ সম্বলিত কার্যক্রমে সমর্থন ও অনুসরণ রাখে, এটা জানাজানি হয়েছে।
অন্তিক বুঝল–তার ভার্সিটি জীবনের অবসান এখানেই। সকল স্বপ্ন, ক্যারিয়ার, আব্বুর সম্মান সব গেছে। ভার্সিটিতে পড়তে গেলে মেধা ও সুযোগ নয় লাগে বড়ভাইদের অনুমোদন, তা অন্তিক হারিয়ে ফেলেছে। এবার কোনো একদিন টুকুস করে তাকে মেরে ফেলা হতেই পারে। অন্তিক একরাতে এক জীবন বদলকারী সিদ্ধান্ত নিলো। মার্জিয়ার বাবার কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা ও মার্জিয়ার হাত চাইল। দিলেন উনারা। বদনাম যার নামে হয়েছে, তার কাছেই দিয়ে দিলেন। অন্তিকের বাবার খোঁজ করলে অন্তিক বলল, আব্বু এসব জানলে হার্ট ফেইলিউর হয়ে যাবে উনার। আমি কুষ্টিয়া আর থাকতে পারব না। আমার জানের ঝুঁকি রয়েছে।

মার্জিয়ার বাড়ির লোক অদ্ভুতভাবে এই এক রাতে মুসিবত হয়ে আসা অন্তিকের জন্য একের পর খুব বেশিই ত্যাগ তারা করেছেন। এই এক ত্যাগ, যা আজব। তারপর অন্তিকের ব্যবসার জন্য একগাদা গহনা মার্জিয়ার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তারপর সেই অন্তিক যখন মরল, মার্জিয়াসহ অন্তিকের সন্তান ও জন্মদাত্রীর পালনটাও তাদেরই করতে হলো। কিন্তু এসব দুই গোঁয়ার কোনোদিন কারও কাছে বলেনি।
অন্তিক একটু পাগল হয়ে গেছিল। সে এত কঠিন এক মানসিক আঘাতের পর দিনাজপুর ফিরে আব্বুর কাছে ভুল বোঝার শিকার হলো। যেখানে তার নিজেরই বেশি পাগলামি ছিল আব্বুর আদর্শ ধরে রাখার। মার্জিয়া ও অন্তিক তারপর বোধহয় দুজন একসাথে পাগল হলো। এই এত বড় ঘটনাটা দুজন রোজ গিলতে গিলতে বাড়ির বাকি তিনটে মানুষ থেকে তারা আলোকবর্ষ দূরে চলে গেল। মার্জিয়া অন্তিককে পাগলের মতো ভালোবেসে ফেলেছে হঠাৎ-ই, এটা সত্যি। কিন্তু অন্তিক মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।

কিন্তু সে কখনও জানেনি কুষ্টিয়া থেকে ফিরে সে নজরমুক্ত হয়নি। হামজার লোক তার অবস্থা বহুদিন ধরে পর্যবেক্ষণ ও জানাশোনায় রেখে লোক মারফতে তাকে নিয়ে ফেলল পলাশের ডেরায়। এটাকে বলে ধান্দা ও এক ঢিলে দুই পাখি। অন্তিককে দমন ও পলাশের ধান্দায় বাড়তি মুনাফার ব্যবস্থা হয়ে গেল।
২০১২ তে অন্তূ হাজি মোহাম্মদ দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়ে এডমিশন নিলো সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। সেও জানল না ভার্সিটির ছাত্র পরিষদ তাকে খুব চেনে, অন্তিকের বোন হিসেবে চেনে। জয় তখন ঢাকাতে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাস্টার্স করছে। সে ফিরল বছর দুই কাটিয়ে ২০১৪ তে, হামজার নির্বাচনের আগ আগ দিয়ে। এছাড়া তখন মুমতাহিণাকে অপহরণ করা হয়েছে, মুরসালীন হাতের মুঠোয় আসবে আসবে ভাব।
সেরকম একদিন অন্তিকের বোনের সামনে হাজির হবার শখ জাগল জয়ের। সে কখনও দেখেছিল না। কিন্তু সে দেখল অন্তিকের বোন অন্তিকের মতো মনোবল খুব সহজে হারায় না। সিগারেটের সাথে সাথে গোটা জয়কেই পায়ে পিষে চলে যাবার দূর্বার সাহস জয়কে খুব ডিস্টার্বড করে তুলল।

এরপর মুমতাহিণাকে নিয়ে কৌতূহলবশে সে গভীরে হাঁটাহাঁটি শুরু করল। পরাগও এক প্রকার দূর্বল হলো মেয়েটার জন্য। কথা ছিল অন্তূর মতো একটা সামান্য মেয়েকে দমাতে একরাত ক্লাব অথবা কোনো হলের রুমে একটু খাতির করলেই ব্যাস। কিন্তু এর মাঝে জয় একটা অঘটন ঘটালো। সেটাও ভালোই। কমের ওপর দিয়ে বেইজ্জত ঠিকঠাকই হয়েছিল অন্তূর। কিন্তু শেষক্ষণে সেই অন্তূটা যে বাড়ির বউ হয়ে যাবে, এটা সব ঘেঁটে দিলো। যদিও ঘাঁটার কথা ছিল না, যদি না মেয়েটা অন্তূর মতো বিচক্ষণ, জেদি আর কূশলী আগুন হতো।
অন্তূ দম আঁটকে হামজার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। তার জীবনে কোনো ঘটনাই তাহলে কাঁকতালীয় ঘটেনি। আর না ঘটেছে সেদিন সিগারেট পায়ে পিষার ফলে। এসবের সূত্রপাত তখন যখন অন্তূ কলেজ পড়ুয়া বেখবর কিশোরী। এসব হবার ছিল বলেই হয়েছে। অন্তূর চোখ দিয়ে টসটস করে কয়েক দানা জল নিথর মুখখানা বেয়ে পড়ল। অন্তিক আজ নেই। জয় আমির ও হামজারা অবশেষে তাকে গাড়ির তলে থেতলে ঠিকই মেরে দিয়েছে।
-“নাও এটা পান করো।ʼʼ

অন্তূ অদ্ভুত স্বরে বলে, “বিশ্বাস করুন, জয় আমির আপনাকে জীবিত দাফন করবে….ও জানলে…ʼʼ
হামজা হতবাক হবে নাকি ক্ষুব্ধ; সে ভুলে গেল। তার জয়ের ওপর ঘাতকিনী এই নারীর এতটা অধিকারবোধ ও ভরসা জেগেছে! হামজার পাগল পাগল লাগল নিজেকে। কিন্তু পরমুহুর্তে সে হেসে ফেলল অসীম শীতলতার সাথে। অন্তূর গলার কাছে থুতনি ঘেষে বলল—
-“কে বলবে জয়কে? তুমি? উহু। তুমি তো আর থাকবে না জয়ের সামনে উপস্থিত হবার জন্য! তাহলে কে বলবে? এই দেয়াল, আসবাবপত্র?ʼʼ
অন্তূ একবার দেখল এই নিথর দেয়াল ও আসবাবপত্র। শিকারী একেকটা ইট এই বাড়ির! অবরুদ্ধ নিশীথ আবারও নেমেছে প্রকৃতিতে। আজ কি অন্তূর গ্রাস হবার পালা?

অন্তূর পেটের ওপর হাইবুট দিয়ে এক লাত্থি মারল হামজা, চেপে ধরে রইল পা’টা। অন্তূ নিদারুণ আর্তনাদ করে ওঠে, “আব্বু!ʼʼ ঠোঁট কামড়ে ধরে কেঁদে উঠল মেয়েটা।
হামজা আরেক পা দিয়ে অন্তূর বাঁ পায়ের উরু চেপে ধরে হাত দিয়ে অন্তূর হাতজোড়া বন্দি করে প্রায় গোটা শরীরটা নিয়েই ঝুঁকে পড়ল অন্তূর ওপর। ঠোঁটে চেপে ধরল তরল, “ড্রিংক ইট, মাই ডেভিয়াস লেডি ! আই ওন্ট সাজেস্ট এনিমোর।ʼʼ

অন্তূ ছলছল চোখে অসহায় বদনে চায় হামজার দিকে। হামজা চোখ বুজে প্রশান্তির শ্বাস ফেলল। এই কাতরতা এই নারীটির চোখে দেখবার জন্য হামজা অস্থির হয়ে পড়েছিল। কিন্তু হতাশা একটু রইল, তবু অন্তূর চোখে দ্রোহের আগুন ছলকাচ্ছে, “আপনাকে আজ শত্রু হিসেবে একটা পরামর্শ দেই–যা করতে চাইছেন না করুন। আমও যাবে ছালাও যাবে। যে আফসোসে পড়বেন আপনি তার কোনো অন্ত থাকবে না ইহকালে।ʼʼ
হামজা এক টুকরো হাসল, “এভাবে হামজা ভড়কে না।ʼʼ

অন্তূ কাতর স্বরে কেমন পাগলের মতো করে বলে, “আমায় ছেড়ে দিন। আমার কিচ্ছু নেই। আমার বাপ নেই, মা থেকেও কাছে নেই। সব নিয়েছেন। এইটুকু আমার থাকুক। এইটুকু আমার দাবী, আমার নিজের। আমার সন্তান…আমি ওকে নিয়ে বহুদূর চলে যাব। কোনোদিন আর আসব না এ পথে। আপনার জয়কে আমার কখনোই চাই না। আপনি রাখুন তাকে। সে আমার কাম্য নয়। না পেল কখনোই সে তার সন্তানের ভাগ। আমার থাকুক এটুকু। সে আমায় এইটুকু দিয়ে দেবে আমি চাইলে অনায়াসে। আপনি তাকে বলবেন, তার প্রাণভোমরা নিয়ে আমি চলে গেছি। এটা তার জানা দরকার। আমি দূরে গেলেই তার জানা দরকার।ʼʼ

হামজা অবাক হবার ভান করে, “হু? সন্তানটা কার? তোমার? নাহ। মেয়েলোকের কোনো সন্তান থাকে না। ও তো কেবল পুরুষের দান। আচ্ছা! এটা কার সন্তান? জয়ের? তো ব্যাস এতে আমার ষোলো আনা হক আছে। আমার চাওয়া মোতাবেক তার ভাগ্য নির্ধারণ হবে। তবে যদি এটা জয়ের সন্তান না হয় তো বলো, ছেড়ে দেব। জয়কে বলে দেব, ও এমনিতেও আর তাকাবে না। কিন্তু ওর হলে ছাড়া যাচ্ছে না যে!ʼʼ
অন্তূ চোখ বুজে ফেলল। বুকটা থরথর করে কাঁপছে। তলপেটে মরণের ব্যথা। বুকের ব্যথা নেই। অন্তূর ব্যথারা অসাড় আজ।

তবু অন্তূ আকুতি করে, “আমাকে যেতে দিন। আজ আমি আমার ঘাড়ে নিলাম সমস্ত দায়। আপনাদের বিরুদ্ধাচারণ, অন্তিকের বোন হওয়া, এক অসহায় স্কুল মাস্টারের মেয়ে হওয়া, সমাজের সাধারণ শক্তিহীন মানুষ হবার এই সব পাপ আমার। এর বিনিময়ে আমি আজ পথান্তরী হবো। তার শাস্তি এক নিষ্প্রাণ শিশুর পেতে আছে, বলুন তো? ও আমায় কত ভরসা করে। ও জানে আমার গর্ভ ওর জন্য নিরাপদ। বাইরে যা-ই হোক, আমি ওর গায়ে তার এক টুকরো আঁচড় লাগতে দেব না। এমনটাই চুক্তি আমার ওর সাথে, যেদিন ও আমার কাছে এসেছে। ওর কাছে আমি দোষী হয়ে যাব আজ। এই লাঞ্ছনা মা হয়ে সওয়া যায় না। আপনি বুঝতে পারছেন? ও আমার আমানত। আমার নারীত্বে দাগ পড়ে যাবে। আপনার দেয়া সব কলঙ্ক কবুল, কিন্তু মাতৃত্বের কলঙ্ক….আমি পায়ে পড়ছি আপনার..জয় আমির…ও… ওর বাপ…সে..ওকে মারবেন না। আর জায়গা নেই আমার ভেতরে। আমি আর পারব না। মেয়ে হয়ে বাপ হারিয়েছি, সয়েছি। ভাই ও পরিবার হারিয়েও মেনে নিয়েছি। ইজ্জতের দাবী ছেড়েছি। মাতৃত্বে সেই সুযোগ নেই বোধহয়।আমি পারবোই না, আমি বুঝেছি…আমায় যেতে দিন।ʼʼ

অন্তূর কান্নায় ভিজে ছিটকে আসা আকুতি অবরুদ্ধ হলরুমের প্রতিটি দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হলো। কিন্তু এই হলরুম এ ধরণের আর্তনাদে বরাবর অভ্যস্ত। এখানে একটুও অস্বাভাবিক নয় এই অসহায়ত্ব ও আঁকুতির স্বর।
হামজা বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হলো। নারীত্ব ও মাতৃত্ব যে নারীটির মাঝে এত তীব্র সে কী করে এতটা ধ্বংসাত্বক হতে পারে? অন্তূ তাকে হতবিহ্বল করে তুলল। হামজা ভাবতে পারছিল না, বুঝতে পারছিল না নারীটিকে। এত রূপ ও অনুভূতির স্বত্ত্বাধিকারিণী! রিমি পারেনি। তার ভেতরে অন্তৃর তুলনায় একরত্তি বিদ্রোহ না থাকার পরেও সে কী করেছে! হামজার মনে হলো আরমিণের ওপর জয়ের পতন জায়েজ।
সে শুধু বলল, “কোথায় যেতে দেব? জয় যে প্রশ্ন করবে আমায়! কী জবাব দেব, কোথায় গেছে তার সর্পিনী? মাথা নাড়ল হামজা, লাশ দেখিয়ে বলতে হবে এমপির ছেলেটা ঘ্যাচাং করে দিয়েছে।ʼʼ
হামজা ক্ষ্রান্তি দিলো। গ্লাস সরিয়ে নিয়ে বোতল ধরে নিজে পান করতে করতে ডাকল, “ওরে আছিস রে তোরা? সিস্টারদেরকে পাঠা রে!ʼʼ

চারজন সহকারী নার্স ও ডাক্তার এলো, হাতে কীসব সরঞ্জামের বাক্স। অন্তূ মেঝের ওপর ছেচড়ে কিছুটা পিছিয়ে যায়। অনবরত মাথা নাড়ে, “নাহ্, না না না। হামজা, হামজা সাহেব, না।ʼʼ
হামজা বলল, “কাজ শুরু করুন। রাত অনেক হলো।ʼʼ
রোগীকে দেখে ডাক্তারের নারী ও মানবীমনে দোলা দেয়া স্বাভাবিক। ইতস্তত করে তারা ডাকে, “স্যার!ʼʼ
হামজা জবাব দেয়, “উঁহ্! কী? আবেগে টান পড়ছে?ʼʼ
পিস্তল বের করে হাতে ঘুরালো দু-চারবার। এভাবেই নিয়েও আসা হয়েছে তাদেরকে। একজন গর্ভবতীর এবোর্শন করাতে হবে। তার শরীরের কন্ডিশন খারাপ। আনা হলো এখানে। শুকনো ফুলের মতো বিদ্ধস্ত সুন্দরী, চোখের দিকে তাকালে আর অস্ত্র চালানো সম্ভব হতে চাইবে না। কী করবে তারা?

অন্তূ উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক পা দ্রুত সরে যেতে নেয়। হামজা বলল, “ছেলেদেরকে ডাকব তোমায় ধরার জন্য? তোমার পর্দার খেলাপি হবে না তো? ওরা ছোঁবেও, দেখবেও। তোমার আপত্তি না থাকলে ডাকব।ʼʼ
অন্তূর শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। মাটিতে বসে পড়ল মেয়েটা। হামজার সামনে হাটু গেড়ে বসে হু হু করে কেঁদে উঠল। জীবন তাকে কোথায় এনে ফেলেছে! সে আজ প্রথমবার জীবনকে জিজ্ঞেস করল, ‘আমার অপরাধ কী? বল আমার অপরাধ কী? আমি কেন এত অসহায়, একা? এত দূর্গতি কোন পাপের বিনিময় হিসেবে দেয়া হলো আমায়?ʼ

অন্তূ টের পায় পাশে আব্বু বসে অন্তূর কান্না দেখছে। অন্তূ আত্মহারা স্বরে ডাকে, “আব্বু? কোথায় তুমি?ʼʼ
-“সামনে রেখে কেউ এই প্রশ্ন করে, অন্তূ?ʼʼ
-“আজ আমায় রক্ষা করতে পারো, আব্বু?ʼʼ
-“না, অন্তূ। সেদিনই পারিনি যেদিন তোকে এই জীবন দিয়েছি আমি, আজ কেন আশা করছিস বোকার মতো?ʼʼ
চট কোরে অন্তূর বিচক্ষণ মস্তিষ্কে হিসেব খেলে যায়। আব্বু কি সেদিন চলতি পথে অতটা সময় অন্তিকের সাথে কাটিয়ে এই ঘটনাগুলো শুনেছিল? সেজন্যই কি জেনেবুঝে চুপচাপ অন্তূকে বিয়ে দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে? নয়ত কেন সেদিন কোনো প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মানুষটা কেবল অন্তূকে মেনে নিতে বলেছিলেন? কেন সেদিন বলেছিলেন, অন্তূকে তিনি মেরে ফেললেন? আর তারপর ব্রেইন স্ট্রোক। এসব কতটা চাপে হয়েছিল?

অন্তূ দেখে আব্বু আর নেই। সে ছটফটিয়ে ওঠে। হামজা হলরুমের কেন্দ্রিয় আসনটিতে বসেছে পায়ে পা তুলে। অন্তূর চোখের সামনে জয় আমির ভেসে ওঠে। কোথায় সেই লোক? তার সন্তানকে রক্ষা করার কর্তব্য নেই তার? আসবে না সে? অন্তূর জন্য না, নিজের সন্তানের জন্য আসা দরকার তার। অন্তূ এদিক-সেদিক তাকায়। কোথাও নেই জয় আমির। কোথাও কেউ নেই অন্তূর। সে এতিম, সে একেলা।
অন্তূর চার হাত-পা বাঁধা হলো মোটা নাইলনের দড়ি দিয়ে। আজ আকাশে চাঁদ নেই। অমাবস্যার নিশীথ। আমির নিবাসের অভিশপ্ত অবরুদ্ধতা। হামজার নির্দেশ সম্পূর্ণ চেতন অবস্থায় অস্ত্রপচারের মাধ্যমে গর্ভপাত হবে আরমিণের। যদি অসহনীয় ব্যথা ও রক্তপাতে এখানেই মরে যায় তো গেল, নয়ত মানুষ মারা কঠিন ঘটনা নয়।
অন্তূর গর্ভাবস্থা তিন মাসের। সুতরাং তার স্যাকশন অ্যাসপিরেশন করা হলো। সহকারী তিনজন ও যে নারী ডাক্তারটি এসেছেন, উনারা অবধি কেঁপে উঠলেন। একবার তাদের মনে হলো হামজার গুলিতে মরে যাওয়াই ভালো তবু এমন নৃশংস ধরণের পাপ ও পাগলামি তারা করতে পারে না।

অন্তূর দেহের নিম্নাংশ যখন অনাবৃত করা হচ্ছিল, হামজা এক সময় চোখ ফিরিয়ে নিলো। সে শুদ্ধ পুরুষ নয়। কিন্তু তার মোটেই আগ্রহ নেই এই নারীটির শরীরের ওপর। সে সুন্দরী হলেও কেবল ঘৃণ্য। চাইলে সে আজ অনেককিছুই করতে পারতো। কিন্তু রুচি নেই। অথবা কীসের এক দ্বিধা ও আড়ষ্ঠতা! ভাইয়ের স্ত্রী যে!
প্রকৃতিতে মাঝরাত। চারদিকে পাথরের প্রাচীর, তার মাঝে দাঁড়ানো আমির নিবাসের অন্তঃপুরীতে অভিশাপ রচিত হলো সে রাতে। অন্তূর হৃদৎবিদারী চিৎকার ও নারীত্বের হাহাকারে আমির নিবাসের দেয়ালেও বুঝি থরথরিয়েছিল। অন্তূর যোনীদ্বার ফুঁড়ে ধাতব-ডাইলেটর প্রবেশ করল গর্ভাশয় অবধি। আমির নিবাসেই আমির নিবাসের শেষ ভ্রুণ-পিণ্ডটুকু গর্ভথলি থেকে অপসারিত হলো।

পনেরো মিনিটের ব্যবধানে অন্তূর শরীর ও মেঝে রক্তে স্নাত হলো। অন্তূ লুটিয়ে পড়ল অন্ধকারের কোলে। রক্তপিণ্ডের মতো দেখতে রক্তে ভেজা এক দলা ভ্রুণ পড়ে রইল মেঝের ওপর। জয় আমিরের রক্ত ও বীর্য শরীর থেকে বয়ে যাবার পর অন্তূর শরীরটা হালকা হয়ে এলো। কোথাও একটুও ব্যথা নেই, মায়া নেই। শুধু কলকল ধ্বনি তুলে অন্তূর নারীত্ব রক্তের সাথে বয়ে যাচ্ছে নিম্নদেশ বেয়ে। তা একটু একটু গড়িয়ে গিয়ে হামজার পায়ের তলায়ও তো ঠেকল।

অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব ৭৯

হামজা বুকটা মুচড়ে ওঠে। জয়ের রক্ত মিশে আছে এতে? হামজা রক্ত তুলে হাতে মাখে। লাল টকটকে গরম তরল, একটু গন্ধ। হামজার ভেতরে ঘৃণার উদ্রেক হলো। এটা জয়ের রক্ত নয়। এটা নোংরা নারীটির বদ-দেহরস।

অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব ৮১