অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ১০

অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ১০
নুসাইবা ইভানা

নয়না চুপচাপ বসে আছে। বুঝতে পারছে না তার কী করা উচিত। এভাবে তো থাকাও যাবে না।
থলামুয়ানা নিজের ঘরে দৌড়ে এলেন। নয়নাকে বললেন, “আমার সাথে এখনই চলো, তোমাকে পালাতে হবে।”
নয়না অবাক হয়ে বলল, “কিন্তু কেন?”
“এখন কোনো যদি-কিন্তুর সময় নেই। আগে চলো, নিরাপদ স্থানে পৌঁছে তারপর বলব।”
পাহাড়ের দুর্গম উঁচু-নিচু পথ পেরিয়ে, রাতের অন্ধকারে জঙ্গলের ভেতর গাছের ওপরে একটি বাঁশের ঘরে এসে পৌঁছাল দু’জনে। রাত তখন আনুমানিক ক’টা বাজে, বোঝা মুশকিল। জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে পশু-পাখি ও হিংস্র প্রাণীর আওয়াজ। ভয়ে কেঁপে উঠছে নয়না।

গা-ছমছমে পরিবেশ। জীবন তাকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে! বাবার রাজকন্যা ছিল সে। জন্মের পর থেকে প্রিন্সেসের মতো বড় হয়েছে। অথচ ভাগ্য আজ তাকে কোথায় নিয়ে এসেছে! জীবন বড়ই বৈচিত্র্যময়। কখন কী ঘটে, তা বোঝা মুশকিল। মানুষের জীবন যেন নাটকের চেয়েও নাটকীয়।
নয়না প্রথমবারের মতো থলামুয়ানাকে ভয় পাচ্ছে। এই জঙ্গলে চিৎকার করে মরে গেলেও কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে না। আতঙ্কিত চেহারায় জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে থলামুয়ানার দিকে।
থলামুয়ানা বললেন, “আমাদের সম্প্রদায়ে বিয়ে ছাড়া ছেলে-মেয়ে একে অপরকে স্পর্শ করতে পারে না। লুসাই সম্প্রদায়ে এটা ঘোরতর অপরাধ। তোমাদের দু’জনের ওপর কয়েকদিন ধরে সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ নজর রাখছিল। কাল সন্ধ্যার আগে তোমরা কী করেছিলে মাচায় বসে?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নয়না বলল, “কথা বলছিলাম। কথা বলার এক পর্যায়ে ডাক্তার ঈশান আমার হাত ধরে ফেলেছিল, ব্যস, এতটুকুই।”
থলামুয়ানা বললেন, “আমি তোমাকে এখানে আর নিরাপত্তা দিতে পারব না। ওরা তোমাকে পেলে কী শাস্তি দেবে, জানা নেই। ওদের শাস্তি কঠোর। তুমি ডাক্তার সাহেবের সাথে চলে যাও শহরে। আমি তোমার বাবার মতো। আমি বলছি, ডাক্তার সাহেবকে বিশ্বাস করতে পারো। তিনি কখনো তোমার ক্ষতি করবেন না, ক্ষতি হতেও দেবেন না। জানি না কী হয়েছে তোমার সাথে, কেনই বা তোমার এইটুকু জীবনে এত বিপদ। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, তিনি তোমার জীবন সহজ করুন।”

নয়না বলল, “আমি কি আত্মহত্যা করতে পারি না? কিছু কিছু সময় বেঁচে থাকা কঠিন, মরে যাওয়ার চেয়ে।”
থলামুয়ানা বললেন, “তুমি ভুলের মধ্যে বাস করছ। জীবন হচ্ছে ঈশ্বরের সবচেয়ে বড় দান। এই পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর সৃষ্টি মানুষ। ধরো, তুমি মরে গেলে তাতে কার কী এসে যাবে? তোমার মা ছাড়া কেউ তোমার কথা মনে রাখবে না সময়ের চক্রে। যতদিন বেঁচে আছ, সেটাই সবচেয়ে সুন্দর ও উপভোগ্য। এই যে এই রাতে, এই পাহাড়ের চূড়ায়, জঙ্গলের মধ্যে বাঁশের ঝুপড়িতে বসে আছ—এটাও ঈশ্বরের নিয়ামত। তিনি যখন তোমাকে বাঁচার সুযোগ দিচ্ছেন, তুমি কে? সেই জীবন শেষ করে দেওয়ার? বরং যারা তোমার সাথে অন্যায় করেছে, যারা তোমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছে, বেঁচে থেকে তাদের দেখিয়ে দাও। ঈশ্বরের মর্জির ওপরে আর কারো মর্জি চলে না।”
নয়না বলল, “আমি বাসায় গিয়ে কীভাবে সবার মুখোমুখি হব? কীভাবে সবাইকে বলব যাকে পাগলের মতো ভালোবেসেছিলাম, অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছিলাম, সেই মানুষটা আমাকে সত্যি সত্যি পাগল আর অন্ধ প্রমাণ করেছে?”

থলামুয়ানা বললেন, “সত্য যতই কঠিন হোক, সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। সত্য থেকে পালানো যায় না। যারা পালায়, তারাই জীবনকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে ফেলে।”
নয়না থলামুয়ানার হাত ধরে বলল, “বাবা।”
থলামুয়ানার চোখের কোণে জল জমে উঠল নয়নার মুখ থেকে ‘বাবা’ ডাক শুনে।
নয়না আবার ডাকল, “বাবা…”
থলামুয়ানা বললেন, “তুমি আমাকে আর ঋণী করে দিও না, মেয়ে। এ জীবনে ‘বাবা’ ডাক শোনার ঋণ কোনো বাবা-ই পরিশোধ করতে পারে না। শুধু এই ‘বাবা’ ডাকের ঋণেই পৃথিবীর সমস্ত বাবারা তাদের সন্তানের খুশির জন্য নিজের জীবন বিলীন করে দেয়। নিজের সব শখ, সব কষ্ট বিসর্জন দিয়ে দেয় সন্তানের সুখের জন্য। তা কেবল দিন শেষে এই ‘বাবা’ ডাক শোনার জন্য।”

নয়না বলল, “আমি সারাজীবন আপনার কথা মনে রাখব, বাবা। আমার আজ থেকে দু’টো বাবা। একজন যিনি আমাকে জন্ম দিয়েছেন, আর একজন যিনি আমাকে জীবনের বাস্তবতার পাঠ শিখিয়েছেন।”
থলামুয়ানা বললেন, “আমরা শেষ রাতের দিকে বের হব। ওই পুঁটলির ভেতর শুকনো চিড়ে আর গুড় আছে, খেয়ে নাও। কাঠের পাত্রে পানি আছে, তার পাশেই বাঁশের একটা মগ।”
নয়নার এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, আসলেই এটা তার জীবনে একটা অ্যাডভেঞ্চার। জানালার ঝাঁপ তুলে বাইরে দৃষ্টি দিল। রাতের অন্ধকার যত গাঢ় হয়, বাইরের প্রকৃতি ততটাই স্পষ্ট দেখা যায়। রাতের অন্ধকারেও এক ধরনের আলো থাকে। তার ওপর বিশাল একটা চাঁদ ঠিক তার মাথার ওপরে। মনে হচ্ছে হাত বাড়িয়ে জোছনা ছুঁয়ে দেওয়া যাবে। কী অদ্ভুত ভালো লাগছে তার! মনে হচ্ছে নতুন করে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে জোছনার মতো।

জাহিন আর জিয়ানকে রাখা হলো এক সেলে। দু’জনে চুপচাপ বসে আছে।
জাহিন জিয়ানের সামনে এসে বলল, “কী দরকার ছিল আমার বিপক্ষে যাওয়ার? আমার প্রতি তোমার বিশ্বাস নেই, ভাইয়া?”
জিয়ান বলল, “বিশ্বাস? তাও তোর প্রতি? বিশ্বাস এই কথা শুনে লজ্জা-য় এতক্ষণে আত্মহত্যা করেছে। কোথায় রেখেছিস নয়নাকে? একটা মেয়ের জন্য নিজের ভাইয়ের বিপক্ষে চলে গেলি! আমাকে একবার বলতে তো পারতি?”
জাহিন বলল, “আর তুমি! প্রেম করলে আরেকজনের সাথে, বিয়ে করলে ভাইয়ের প্রেমিকাকে!”
জিয়ান বলল, “তুই ভুল ভাবছিস। সুনয়না তোকে কখনো ভালোবাসেনি। ইনফ্যাক্ট, ও তোকে সহ্য করতে পারত না। আমাকে অনেকবার বলেছে, তোর ব্যবহার ওর পছন্দ না।”
জাহিন বলল, “ওহ, রিয়েলি! আমাকে তোমার বলদ মনে হয়?”
জিয়ান বলল, “তুই স্বার্থপর। স্বার্থপর মানুষ বলদ হয় না, ধ্বংসকারী হয়। তারা নিজের স্বার্থের জন্য সব ধ্বংস করে দেয়।”

জাহিন বলল, “তুমি আর অন্তর কাজটা ভালো করোনি। আমি জাহিন চৌধুরী, আমাকে থামানোর ক্ষমতা কারো নেই। তোমার ধারণাও নেই আমার ক্ষমতা সম্পর্কে।”
জিয়ান বলল, “তোর অপকর্মের শাস্তি তুই নিশ্চিত পাবি। ভাবতেও ঘৃণা লাগছে, তুই আমার ভাই?”
জাহিন বলল, “তো মরে যা। কেন বেঁচে থাকার জন্য আমার পরিচয় টানছিস? আমার পরিচয় আমার নামকে ঘৃণা করিস না?”
জিয়ান বলল, “আমাকে বাঁচতে হবে। তোর পাপকে ধ্বংস করতে বাঁচতে হবে। আমার অর্ধাঙ্গিনীর জন্য বাঁচতে হবে। তোর মতো কুলাঙ্গারের জন্য মরব কেন?”
জাহিন বলল, “কার জন্য বাঁচবি? তোকে অন্তর পুরো সত্যিটা বলেনি?” বলেই অট্টহাসি দিতে লাগল জাহিন।
জিয়ান বলল, “কোন সত্যির কথা বলছিস তুই? আমি তোর কোনো ফাঁদে পা দেব না। বিশ্বাস করি না তোর মতো পশুকে।”

জাহিন বলল, “মিস্টার পাইলট জিয়ান রেজা চৌধুরী, কান খুলে শোন। আপনার প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনীকে আমি নিজের হাতে হত্যা করেছি। এই হাত দিয়ে সাজেকের পাহাড় থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছি, আরো ছয় মাস আগে। আপনার অর্ধাঙ্গিনীর মৃত্যুর সাত মাস চলছে। ওপস! পাঁচ মাস পর তার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করার জন্য আপনি বেঁচে থাকবেন তো!”
জিয়ানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল, চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। উঠে দাঁড়িয়ে সজোরে লাথি মারল জাহিনের কোমরের নিচে। আচমকা আক্রমণে জাহিন ছিটকে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফ্লোরে পড়ে গেল। মাথা কেটে ফিনকি দিয়ে গলগল করে বের হতে লাগল টকটকে লাল রক্ত।

জাহিন মাথায় হাত দিয়ে রক্ত স্পর্শ করে বলল, “আমি মারলে এখানেই স্পট ডেথ হবে তোমার। কিন্তু আমি তো এত সহজে তোমাকে মরতে দেব না। কষ্ট পেয়ে পেয়ে, তিলে তিলে ধুঁকে ধুঁকে মরবি জেলে বসে।”
জিয়ান উঠে এসে জাহিনের গলা চেপে ধরল, “তোমকে আমি মেরেই ফেলব। আমার নয়নার কিছু হলে তোকে আমি ছাড়ব না। ভুলে যাব তুই আমার ভাই। তোর সাথে কোনোকালে রক্তের সম্পর্ক ছিল।”
ততক্ষণে পুলিশ এসে দু’জনকে ছাড়িয়ে নিল। জাহিনকে সাময়িক চিকিৎসার জন্য জেলখানার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গেল। জিয়ানকে আলাদা সেলে বন্দি করে রাখা হল।

“আপনার কি লজ্জা নেই?”
“নাহ, নেই। বউয়ের কাছে কিসের লজ্জা?”
“কেসের কী হল? এই দেশে কি সুষ্ঠু বিচার কখনো সম্ভব না? একজন নিরপরাধ মানুষ শাস্তি পাবে?”
অনিকেত বলল, “জিয়ানের ফাঁসির আদেশ এসেছে। তবে শেষ মুহূর্তে জাহিনের বন্ধু অন্তর কেসটাই পাল্টে দিয়েছে।”

অনিকেত সবটা খুলে বলল সায়নাকে। সব শুনে সায়না স্তব্ধ। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমার মনে হয় জাহিন ভাইয়া, জিয়ান ভাইয়াকে বাঁচানোর জন্য এরকম একটা প্ল্যান করেছে।”
অনিকেত বলল, “বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে। তবে যাই হোক, আমি চাই জিয়ান আবার ফিরে আসুক আমাদের মাঝে। নয়না মেয়েটার সাথে কী হল? কোথায় গায়েব হয়ে গেল! মেয়েটা যেখানেই থাকুক, ভালো থাকুক।”
সায়না বলল, “বড্ড দরদ উথলে পড়ছে বন্ধুর বউয়ের জন্য? এত দরদী আপনি, আগে তো জানা ছিল না।”
অনিকেত বলল, “কী উল্টোপাল্টা বলছ! মেয়েটা আমার বোনের মতো। তুমি ছাড়া পৃথিবীতে সব মেয়ে আমার বোন।”

অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ৯

সায়না বলল, “এসব কথা ছাড়ুন, আসল কথা বলুন।”
অনিকেত বলল, “আসল কথাটা বড্ড তেতো। তুমি কি তা সহ্য করতে পারবে?”
সায়না বলল, “যতই তেতো হোক, আমি জানতে চাই।”

অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ১১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here