আপনাতেই আমি সিজন ২ পর্ব ৬৪
ইশিকা ইসলাম ইশা
অতীত,
দিয়া আর রাইফা ছোট বেলা থেকেই বন্ধু। রাইফারা তিন ভাই বোন।বড় ভাই রোনাক রেজা,ছোট ভাই রোশান রেজা।রোনাক পড়াশোনা শেষ করে বিদেশেই সেটেল হয়েছিল।মাঝে মাঝে আসত গ্রামে বেড়াতে।
আর রোশান ঢাকায় পড়াশোনা করেছে।রোশান তখন সবেই শহর থেকে গ্রামে ফিরেছে। গ্রামের কৃষকদের উন্নতির জন্য সে কৃষি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেছে।শহুরে চাকরির সুযোগ থাকলেও গ্রামে কিছু করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল তার।তাই আর চাকরিমুখো হয়নি। রোশানের বাবা সেই গ্রামের চেয়ারম্যান ছিলেন।বাবার সাথে টুকিটাকি চক্কর দিতেন মাঝে মাঝে!গ্রামের মানুষদের সাথে আলাপ জমাতেনও বেশ।
সেদিন ছিল শুক্রবার। রোশান অনেকদিন ধরেই গ্রামের সব কিছু পর্যবেক্ষণ করে বুঝল।গ্রামে শিক্ষার হার কম।যারা উচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেছে তারা গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হয়েছে।গ্রামে স্কুল তো আছে তবে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়ে পড়ানোর মতো তেমন কোন ব্যবস্থা নেই।টিউটর থাকলেও বেশ দূরে হওয়ায় কেউ যেতে চাই না।নইলে গ্রামের ছেলেমেয়েগুলো আরো এগিয়ে যেতে পারবে ভালো রেজাল্ট করতে পারবে।সেই ভেবেই সিদ্ধান্ত নেয় সে গ্রামের ছেলেমেয়েদের টিউটর হিসেবে পড়াবে।তাই বাবার সাথে আলোচনা করে।ছেলের কথায় রফিক রেজা আপত্তি করেন নি।সম্মতি দিয়েছে।এই নিয়েই শুক্রবার এ মিটিং বসেছে। গ্রামের সবাই সম্মতি দিয়েছে তাদের বাচ্চাদের পড়তে পাঠাবে।আর পড়ানোর জায়গা ঠিক করা হয় রেজা ভিলার পুরানো আমলের বাড়িতে।যা আপাতত খালি পড়ে আছে। পাশেই আধুনিক ভাবে দোতলা বাড়ি সেখানেই সবাই থাকে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তীব্র গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন। বিকেলের দিকে রোদের মাএা কমে কিছুক্ষণ আগে থেকে হুট করেই মুষুলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বিকাল ৫ টা থেকে ৯ম শ্রেণীর ব্যাচ শুরু হয়েছে।আর প্রথম দিনেই ১৫ মিনিট লেট করে বৃষ্টিতে ভিজে এসে দরজার কড়া নাড়ল দিয়া।
মাস্টারমশাই আসতে পারি!!
রিনরিনে চিকন কন্ঠে মাস্টারমশাই ডাকটা শুনে অবাক হয়েই দরজার দিকে তাকালো রোশান।আটপেরে শাড়ি পড়ে কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন ১৫ বছর বয়সী কিশোরি কন্যা। শ্যামল বদনে ছাই রাঙা শাড়ি।ডাগর ডাগর চোখ গুলো যেন গভীর সমুদ্র।চোখে মুখে উপচে পড়া মায়া।রোশান দিয়াকে দেখে অবাক হয়েই তাকিয়ে রইল তার দিকে!
মাস্টারমশাই!!ভেতরে আসতে পারি!!
রোশান এবার খুক খুক করে কেশে উঠে আড়চোখে সবার দিকে তাকিয়ে বলল ,
আসুন!!
দিয়া রুমে প্রবেশ করতেই রাইফা হাত দিয়ে কিছু একটা বোঝাল। কিন্তু দিয়া বুঝার আগেই রোশান বলল,
আপনার নাম??
দিয়া রোশানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
জি আমার নাম ডালিয়া বিনতে দিয়া।
রোশান বিরবির করে নামটা উচ্চারিত করে বলল,
লেট কেন??
দিয়া আমতা আমতা করে বলল,
মাস্টারমশাই সত্যি বলব নাকি মিথ্যা!!
রোশান দিয়ার এমন কথায় হচকচিয়ে তাকালো!তাকে বলে কি সত্যি বলবে নাকি মিথ্যা!
সত্যি বলেন!
আসলে আমি বুড়ির গাছের পেয়ারা চুরি গিয়ে ধরা পড়ে গেছিলাম।তাই আসতে লেট হয়ছে!
রোশান হতভম্ব হয়ে বলল,
চুরি!!
দিয়ার সহজ সিকারক্তি,
জি!! বুড়ির গাছে চুরি!
রোশান কিছুটা কড়া গলায় বলল,
এতো বড় হয়েছো অথচ চুরি করছ!!তা চুরি করার কি দরকার ছিল?
দিয়ার সহজ সরল উওর,
আসলে কাল স্কুল থেকে আম্মুর কাছে কল এসেছিল আমি ক্লাসে ঘুমিয়ে পড়ি,পড়াশোনায় মনোযোগ দিই না।তাই আম্মু আমার রাতের খাওয়া বাদ দিয়েছে। বুঝেছেন মানে রাতে খেতে দেয়নি। পড়াশোনা না করলে আমাকে রিকসা আলা দেখে বিয়ে দিবে এটাই বলেছে।আবার সকাল সকাল হুমকি দিয়েছে স্কুল থেকে ফিরে সোজা যদি টিউশন পড়তে ঠিক সময়ে না আসি তবে আজ রাতেও আমাকে খেতে দিবে না।আর কোনো কানা খুরা দেখে আজকেই আমার বিয়ে দিয়ে দেবে।
তো আজকে টিউশন পড়তেই আসছিলাম পরে আমি ভাবলাম আবার কোন না কোন নালিশ আসে আর আমার রাতের খাওয়া বন্ধ হয়ে যায় তার আগেই বুড়ির গাছ থেকে পেয়ারা চুরি করে নিয়ে আসি।যে ভাবা সেই কাজ। কিন্তু এবার চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছি আর শাস্তি হিসেবে বুড়ি আমাকে দিয়ে সব কাজ করিয়ে নিয়েছে।মানে ঘর ঝাড়ু দিয়েছি, থালাবাটি মেজেছি,আর বাগান ঝাড়ু দিয়েছি।ব্যাস……তাই আসতে আসতে দেরি হয়ে গেছে।
রিদির একদমে বলা কথায় ক্লাসের সবাই মুখ টিপে হাসছে।কেউ কেউ ফিসফিস করে কথা বলছে।রোশানের নিজের অবাক হল হাসি পেল তবে মুখাবয় গম্ভীর করে রাখল।কি সহজ সরল স্বীকারোক্তি মেয়েটার।
ফিসফিস না করে সবাই নিজেদের পড়া করুন।আর আপনি…….
মাস্টারমশাই আপনি আমাকে নাম ধরে ডাকবেন!আমার নাম তো জানেন এখুনি বললাম দিয়া।
এই দিয়া তুইই কি আদিম কালে ফিরে গেলি নাকি। মাস্টার মশাই না বলে ভাইয়া বল বা স্যার বল।ওনি রাইফার ভাই সে হিসেবে ভাইয়া আর আমাদের টিচার তাই স্যার।
প্রিয়া!! তাদের ক্লাসমেটের কথায় রিদি মুচকি হেসে সরল উওরে বলল,
আমার তো ওনাকে মাস্টারমশাই ডাকতেই ইচ্ছে করে!!আর রাফু!!তুই তো বলিসনি তোর ভাই……
অনেক হয়েছে।আপনারা সবাই নিজেদের পড়া করুন।আর আপনি মানে তুমি দিয়া রাইফার সাথে যাও!রাইফা ওর ড্রেস ভিজে গেছে তুই ওকে সাথে করে নিয়ে যা।
রাইফা চট করে উঠে বলল,
জি ভাই!!
রাইফা চরম বিরক্তি নিয়ে হাতের গামছা দিয়ার হাতে দিয়ে বলল,
তুই রোজ রোজ বুড়ির গাছের আম চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়িস কেন বলতো??
কারন বুড়ি মহিলা খুব জটিল ভাইরাস বুঝলি।
মানে??
মানে বুড়ির একটা ব্যাটা আছে।শহরে থাকে।আসে মাঝে মাঝে কিন্তু বৌয়ের জন্য তাকে সাথে নিয়ে যেতে পারে না।আর বুড়িও নাকি প্যারাদায়ক মহিলা বুঝলি সে ঐ মুখপুড়ি বৌমার সাথে থাকবে না। আমি রোজ ঐ বুড়িটাকে দেখতে যায়। কিন্তু বুড়ি বেটি ঐ যে বললাম জটিল মহিলা।আমাকে দেখলেই খালি খেদায়।কাউরে নাকি ওর সহ্য হয় না।তাই ভাবলাম চুরি করে ধরা পড়ে একদিন দেখি কি করে এই বুড়ি।সেই ভাবনা সেই কাজ।ধরা পড়ে বুড়ি আমাকে দিয়ে ওর কাজ করাই নেই।জানিস !!
বুড়ির কি তেজ রে মাইরি।দেখলে মনে হয় কাল পরশু পটল তুলবে। কিন্তু নিজের কাজ নিজে করে।আবার চুলায় দেহি ভাত ও বসাই।তাই আমি ভাবলাম চুরির আইডিয়া মন্দ না।আমার পেয়ারাও খাওয়া হবে বুড়ির কাজ ও হবে।কি বলিস!!
রাইফা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
তো তুই জিলাপির পেঁচ এঁকে এটাই বুঝাতে চাইছিস তুই ঐ বুড়ির হেল্প করতে যাস।
রাইফা চুল মুছে কাপড় নিয়ে ওয়াসরুমে যেতে যেতে বলল,
তোর মাথায় যে বুদ্ধি আছে ভেবে খুশি হলাম।
তুই কি আমাকে বুদ্ধিহীন ভাবিস!!
শুনেছি।অতি সুন্দরী মেয়েদের বুদ্ধি হাটু অবদি থাকে।
দিয়ার বাচ্চা!
দিয়া দৌড়ে ওয়াসরুমে ঢুকে খিলখিলিয়ে হেসে বলল,
আমার বাচ্চা হয়নি!হলেও তোকে দাওয়াত দিব না।শোন আমার পেয়ারা আবার খাস না কিন্তু!রাতের খাবার ঐটাই আমার।আজ তোর ভাই নালিশ করলে রাতে আমাকে ঐটাই খেতে হবে।
রাইফা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।এই মেয়ে পারেও বটে।তবে বুড়ির গাছের পেয়ারা সে তো খাবেই ভেবেই মুচকি হেসে ঘুরে দাড়াতেই দেখে রোশান দু হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে।রাইফা ভাইকে দেখে হচকচিয়ে বলল,
ভাইয়া তুমি??
রোশান মুচকি হেসে বলল,
তবে এটাই তোর বেস্ট ফ্রেন্ড!
হ্যাঁ!বলেছিলাম ভাইয়া ও একটু দুষ্টু কিন্তু খুব ভালো।আজ……
শুনেছি!!
এসব ছাড়।ওকে নিয়ে ক্লাসে আয়।
ক্লাস শেষ হতে হতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে।রোশান সবাই কে ১৫ মিনিট আগে ছাড়লেও দিয়া কে ছাড়ল ১৫ মিনিট লেট করে।এতেই দিয়া রেগে রোশানের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করেছে ইতিমধ্যে।রোশান দিয়ার রাগি রাগি চেহেরা দেখে আড়ালে মুচকি হাসল।রাইফাও ভাইয়ের প্রতি বিরক্ত কারন বেস্ট ফ্রেন্ড বলে বলে তাকেও এখনো ছুটি দেয় নি রোশান।
কিছুক্ষণ যেতেই বাইরে থেকে হাক ছাড়লেন দিয়ার বাবা আতাউর রহমান।দিয়ার নাম কয়েকবার ডাকতেই দিয়া বই খাতা তুলেই ছুটল বাইরে।গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।রোশান ও বাইরে এসে আতাউর রহমানকে দেখে সালাম দিলেন।আতাউর রহমান সালামের উত্তর দিয়ে বলল,
বাবা ও পড়ছে কেমন? দুষ্টুমি করেছে নাকি??
রোশান আড়চোখে একবার দিয়ার দিকে তাকালো।দিয়া ব্যাগের পেয়ারা গুনছে।তার ধারনা রোশান এখন ১৫ মিনিট লেট করে আসা আর চুরির ঘটনা দুটোই উল্লেখ করে ধরিয়ে দিবেন।আর তাতে আতাউর রহমান কিছু না বললেও তার মাতা নিশ্চিত ব্যাপারটা বুঝে তাকে শাস্তি দিবেন।তবে পেয়ারা দুটো কম দেখে রাগি লুকে রাইফার দিকে তাকাতেই রাইফা দাঁত কেলিয়ে হাসল।দিয়া মনে মনে বলল,”তোক পড়ে দেখব রাফুর বাচ্চা”।রোশান দুইজনের অভিব্যাক্তি বুঝে আলতো হেসে আতাউর রহমানের উদ্দেশ্য বলল,
না চাচা কোনো দুষ্টুমি করে নি। পড়ালেখাতেও বেশ ভালো।
দিয়া টিভি সিরিয়ালের নায়কাদের এর মতো তিনবার চমকে তাকালো রোশানের দিকে। লম্বা,ফর্সা, সুন্দর দেখতে পুরুষটি।চোখে চমশা,মুখে হালকা চাপদাড়ি । সুন্দর!!রোশান দিয়ার তাকানো দেখে মুচকি হাসল।
আতাউর রহমান এক গাল হেসে বললেন,
প্রথমবার মেয়ের নালিশ পেলাম না।সেলিব্রেট করা উচিত নয় কি?
রোশান এবার বিস্তর হাসল।দিয়া ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে দেখল সেই হাসি। আতাউর রহমান রোশানের থেকে বিদায় নিয়ে মেয়েকে একটা ছাতা খুলে দিল।দিয়া ছাতার নিচে এসে আরও একবার রোশানের দিকে তাকিয়ে বাবার সাথে চলে গেল।রোশান দিয়ার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল।যতদূর দেখা যায় তাকিয়ে দেখল শুধু।
রোশান কে এভাবে তাকাতে দেখে রাইফা কিছু একটা ভেবে মুচকি হাসল।
এটাই ছিল তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎকার। এরপর ধীরে ধীরে রোশান দিয়া কে বুঝতে শুরু করল।মেয়েটা দারুন! হাস্যোজ্জ্বল, দুষ্টু, মিষ্টি। রোশান ধীরে ধীরে যেন দিয়ার দুষ্টুমির প্রেমে পড়ল।মায়া মায়া শ্যামরাঙা মুখটার প্রতি ধীরে ধীরে জন্ম নিল অফুরন্ত ভালোবাসা। রোশানকে দিয়াও পছন্দ করত রোশান ও ধীরে ধীরে হয়ে উঠল তার “প্রিয় মাস্টারমশাই”।
আপনাতেই আমি সিজন ২ পর্ব ৬৩
তাঁদের প্রেম ছিল চোখে চোখে। তাঁদের কথাও হতো চোখে চোখে।কেউ কাউকে ভালবাসার কথা না বললেও তাঁদের মধ্যে ছিল অসীম ভালবাসা।মাঝে মাঝে “প্রিয় মাস্টারমশাই” কে চিঠি লিখত তবে দেওয়া হয়নি কখনো।ব্যাস এইটুকুই ছিল তাঁদের সীমাবদ্ধতা।