আমার অবেলায় তুমি গল্পের লিংক || সানজিদা বিনতে সফি(সাথী)

আমার অবেলায় তুমি পর্ব ১
সানজিদা বিনতে সফি(সাথী)

সে তোকে ছেড়ে গেছে মাহতাব, তুই না।তাই এভাবে হাত পা ছড়িয়ে বসে থাকার কিছু হয়নি।
আচ্ছা বিয়ে করতে সমস্যা টা কোথায়? বয়স টা তো আর কম হচ্ছে না। এসব পাগলামির কোন মানে আছে মাহতাব!
বড় আপার কথায় রাগ আর হতাশা দুটোই স্পষ্ট। নির্বাক মাহতাব নিজ মনে চা খেয়ে অফিসের জন্য বেড়িয়ে গেলো৷ এসব কথা সে মোটেও পাত্তা দেয়না। মাহতাব ইব্রাহিম। বয়স চল্লিশের কোঠায় পৌছালেও ত্রিশের যুবক ভেবে সবাই ভুল করে বসে।

সৌন্দর্যের কোন দিক থেকে কমতি নেই তার। অত্যন্ত অল্পভাষী মাহতাব তার প্রথম ভালবাসাকে হারিয়ে এখনো বিয়ের কথা ভাবে নি৷ এ নিয়ে পরিবারের সবাই খুব রুষ্ট। সবচেয়ে রুষ্ট মাহতাবের বড় বোন আর তার মা। ছোট ভাই তার বউ বাচ্চা নিয়ে আলাদা থাকে।তার এসব নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই। ভাইয়ের সিদ্ধান্তকে সম্মান করে সে। ছোট ভাই মেহরাবের বউ লামিয়া অসম্ভব ভালো একটা মেয়ে। বরের চাকরির জন্য বাড়ির বাইরে থাকতে হয় তাকে। শ্বাশুড়ি একটু খিটখিটে টাইপের হলেও ননাস তাকে খুব ভালোবাসে। শ্বাশুড়িও ভালোবাসে তবে তা খুব একটা প্রকাশ করে না।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মাহতাব যেতেই ময়না বেগম হতাশ মুখে বসে রইলেন। ভাইয়ের মাথা থেকে কোন ভাবেই ওই মেয়েকে নামানো যাচ্ছে না। এ কেমন জীবন বেছে নিলো মাহতাব! ভাইয়ের বিরস জীবন দেখে হতাশার শ্বাস ফেললো ময়না বেগম। বিধবা হওয়ার পর থেকে এক ছেলে কে নিয়ে ভাইয়ের সাথেই থাকে সে। কখনো বিন্দুমাত্র অবহেলা পায় নি। ছেলেটাও অস্ট্রেলিয়া থেকে পড়াশোনা করছে। মা মেয়ে সারাদিন বাড়িতে একা। মাহতাবের মা কুলসুম বেগম খুব একটা হাটাচলা করতে পারে না। বেশিরভাগ সময় রুমেই কাটে তাঁর। ময়না বেগমের সারাদিন কাটে ঘুমিয়ে অথবা বই পড়ে। সুফিয়া বানু বাড়ির পুরোনো কাজের লোক। মাঝে মাঝে তার,সাথে গল্প করে সময় কাটায়। কাজের জন্য সেও বেশি সময় দিতে পারে না। বাকি গুলো সব ফাকিবাজ। ফাক পেলেই টিভি দেখতে বসে যায়। তাদের ধমকে ধমকে কাজ করানোর জন্যে সুফিয়া খালা তাদের পিছনে লেগে থাকে।মাহতাব তাকে বেশি কাজ করতে নিষেধ করেছে। শুধু দুপুরের রান্না টা সে সুফিয়া খালাকে করতে বলেছে। সকাল আর রাত হালকা পাতলা খেলেই চলে।

ময়না বেগম টেবিল ছেড়ে মায়ের রুমে চলে গেলো। গতকাল একটা মেয়ের ছবি দিখিয়েছে ঘটক। মেয়েটা সুন্দর।বয়স যদিও একটু কম।মাহতাবের তুলনায় বেশ ছোট। তবুও সম্ভন্ধটা হাত ছাড়া করতে চাইছে না সে। মায়ের সাথে একবার কথা বলা দরকার।

অফিসে এসেই কাজে ডুবে গেছে মাহতাব। বোনের কথা আমলে নেয়নি এমন না। একজনের মায়ায় পরে জীবনে আর কাউকে জড়াতে ইচ্ছে করেনি তার। তাকে ভেবে ভেবেই বয়স টা আর ঠিক জায়গায় নেই। এখন খুব অনুভব হয়,একজন জীবনে থাকলে ভালো হতো। মাঝে মাঝে একাকিত্ব জেকে ধরে। তখন খুব করে একজনের প্রয়োজন অনুভব হয়। কিন্তু এই বয়সে এসবের কোন মানেই নেই। তার মতো একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর এসব মানায় না।ভালোবাসার মানুষটার প্রতি মায়া কেটে গেছে এমনটাও নয়৷ সে তার মতো ভালো আছে।সুখে সংসার করছে। স্বামী সন্তান নিয়ে ভরা সংসার তার। শুধু সে ই একা।

আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে , আমি চাই
কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক,
শুধু ঘরের ভেতর থেকে দরোজা খুলে দেবার জন্য ।
বাইরে থেকে দরোজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত ।
আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ আমাকে খেতে দিক । আমি হাতপাখা নিয়ে
কাউকে আমার পাশে বসে থাকতে বলছি না,
আমি জানি, এই ইলেকট্রিকের যুগ
নারীকে মুক্তি দিয়েছে স্বামী -সেবার দায় থেকে ।
আমি চাই কেউ একজন জিজ্ঞেস করুক :
আমার জল লাগবে কি না, নুন লাগবে কি না,
পাটশাক ভাজার সঙ্গে আরও একটা
তেলে ভাজা শুকনো মরিচ লাগবে কি না ।
এঁটো বাসন, গেঞ্জি-রুমাল আমি নিজেই ধুতে পারি ।
আমি বলছি না ভলোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ একজন ভিতর থেকে আমার ঘরের দরোজা
খুলে দিক । কেউ আমাকে কিছু খেতে বলুক ।
কাম-বাসনার সঙ্গী না হোক, কেউ অন্তত আমাকে
জিজ্ঞেস করুক : ‘তোমার চোখ এতো লাল কেন ?’

নির্মলেন্দু গুণের কবিতা আওরে ক্লান্ত শরীর টা চেয়ারে এলিয়ে দিলো মাহতাব। ক্লান্ত চোখে গ্লাসের বাইরে দীপ্তমান আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এই বয়সে বিয়ে করে লোক হাসানোর কোন মানেই হয় না। বড় আপাকে ভালো ভাবে বুঝিয়ে বলতে হবে। তার আম্মার কানে একবার তুলে দিলে আর বাচার রাস্তা নেই।
অফিস থেকে লাঞ্চে বাসায় এসে মহা ঝামেলায় পরেছে মাহতাব। বাসায় রান্না হলেও খাওয়ার জন্য কেউ টেবিলে নেই। ময়না বেগম আর কুলসুম বেগম খাবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। ক্লান্তি আর খুদা থাকা সত্বেও মাহতাব টেবিলে তাদের অপেক্ষায় বসে আছে। একটু পর পর আম্মার রুমের দিকে তাকিয়ে দেখছে কেউ আসছে কিনা। কিন্তু কারোর আসার নাম গন্ধ নেই।

মাহতাব উঠে কুলসুম বেগমের রুমের দিকে পা বাড়ালো। রুমে ঢুকে সালাম দিয়ে মায়ের দিকে এগিয়ে তার হাতে চুমু খেলো মাহতাব। মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে বাচ্চাদের মতো আদর করে দিলো। মায়ের পাশে বসে ধীর গলায় বলল,
— খেতে চলুন আম্মা। ঠিক সময়ে না খেলে অসুস্থ হয়ে পরবেব তো। আপনি অসুস্থ হলে আমি সহ্য করতে পারি না। আপনার কষ্ট আমার সহ্য হয়না আম্মা। আসুন আমার সাথে।
কুলসুম বেগমের চোখ ভরে এলো ছেলের আদুরে গলা শুনে। তবুও শক্ত হয়ে বসে রইলেন। কোন কথা না বলে তসবিহ পড়ায় মন দিলেন। ময়না বেগমও মায়ের দেখাদেখি মুখ ঘুরিয়ে নিলেন ভাইয়ের থেকে। মাহতাব শান্ত গলায় ময়না বেগম কে ডাকলো,

— আপা, প্লিজ খেতে আসো।
— তুই ই খা। আমাদের কথা তোর ভাবতে লাগবে না। দূর হ সামনে থেকে। একটা মেয়ের জন্য আমাদের এতো দিন অবজ্ঞা করেছিস। বুড়ো বয়সে যখন দুটো কথা বলার জন্যও মানুষ খুজে পাবি না তখন এই আমার কথা মনে করবি আর কপাল চাপড়াবি। এদিকে আয়,দুটো থা*প্পড় দেই। তখন হয়তো কবরে থাকবো। মন হাসফাস করলেও দিতে পারবো না। আগে ভাগেই দিয়ে রাখা ভালো। তোর মতো ভুল আমি করবো না।
মাহতাব মাথা নিচু করে চুপ করে রইলো। ময়না বেগম কথা শেষ করে আবার মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে।
কুলসুম বেগম চোখ খুলে তসবিহ তে চুমু খেয়ে সোজা হয়ে বসলেন। চোখের চশমা ঠিক করে ছেলের নিচু করে রাখা মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

— আমরা কিন্তু সাহিদাকে মেনে নিয়েছিলাম বাবু। বলেছিলাম তাদের বাসায় প্রস্তাব পাঠাবো। কিন্তু সে মানা করে দিলো। তার বড়লোক বর চাই। তোমার বাবার মতো সামান্য ইঞ্জিনিয়ারের ছেলে কি তার চাহিদা পুরন করতে পারতো? তুমিও প্রতিষ্ঠিত ছিলেনা। প্রেমিক ভবপঘুরে হলেও চলবে।কিন্তু বর প্রতিষ্ঠিত হওয়া চাই। এখন তুমি প্রতিষ্ঠিত। পত্রিকায় তোমার বড় বড় ছবি ছাপা হয়। সে তোমাকে নিজ স্বার্থে ছেড়েছিল বাবু। তুমিও নাহয় নিজ স্বার্থেই নিজেকে একটা সুযোগ দিলে। লোকে কি বলবে ভেবো না। লোকের কাজ ই বলা।বলবে আবার নিজে থেকেই চুপ হয়ে যাবে। তাই সে ভাবনা বাদ দাও। আমি আমার ছেলেকে এভাবে দেখতে চাই না বাবু।মায়ের এই কথা টা রাখো। একবার হাত বাড়িয়ে দেখো।সুখ তোমার অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে।

মাহতাব নিঃশব্দে মাথা নাড়লো। নিরব সম্মতি পেয়ে ছেলের মাথায় চুমু খেলো কুলসুম বেগম। ময়না বেগম তড়িঘড়ি করে খাট থেকে নেমে যেতে যেতে বলল,
— চল চল।এতক্ষণ না খেয়ে থাকা যায় নাকি! পেটে পিত্তি পরে গেল।
মাহতাব কুলসুম বেগম কে হাত ধরে নামালো।তাকে ধরে ধরে টেবিলে নিয়ে বসিয়ে দিল।
— আজ বিকেলেই মেয়ে দেখতে যাবো। আজ আর অফিসে যাস না। মেহরাব কেও আসতে বলেছি। হসপিটাল থেকে সরাসরি এখানেই আসবে।
মাহতাব কিছু বললো না। মায়ের মুখে নিঃশব্দে খাবার তুলে দিচ্ছে সে। প্রতিদিন নিজ হাতে মাকে খায়িয়ে দিতেই সে দুপুরে বাসায় আসে৷

ময়না বেগম ঘটক কে ফোন করে জানিয়ে দিলো তারা আজই যাবে মেয়ে দেখতে। পছন্দ হলে একেবারে বিয়ে করিয়ে বউ নিয়ে বাসায় ফিরবে। বলা তো যায় না ভাইয়ের মন কখন ঘুরে যায়।
মাহতাব থম মেরে বসে রইলো। শান্ত চোখে মায়ের দিকে তাকাতেই কুলসুম বেগম চোখ দিয়ে আস্বস্ত করলেন।
মেয়ে দেখতে এসে মাহতাবের চোখ কপালে উঠে গেলো। তুমুল অস্বস্তি তে ঝিমিয়ে এল শরীর।

আমার অবেলায় তুমি পর্ব ২

1 COMMENT

Comments are closed.