আমার অবেলায় তুমি পর্ব ১৫

আমার অবেলায় তুমি পর্ব ১৫
সানজিদা বিনতে সফি(সাথী)

লামিয়ার সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে মেহরাব। লামিয়ার বান্ধবী মনি কিচেনে মেহরাবের জন্য চা নাশতার ব্যবস্থা করছে। মেহরাবদের শুকনো মুখ ই বলে দিচ্ছে সকাল থেকে তার পেটে কিছু পরে নি৷ মেহরাব আসার পর থেকেই চুপ করে আছে। লামিয়ার প্রতি অভিমান তার মুখ থেকে কথা বের করতে দিচ্ছে না। মাহতাব এসেই লামিয়া কে কড়া ধমক দিয়েছে৷

–এরকম বোকামি কেউ করে? আমরা কি সবাই ম*রে গিয়েছিলাম? আমাদের বলা যেতো না? তুমি কাজটা ঠিক করোনি লামিয়া। অন্তত মেহরাবের সাথে বসে সব ডাউট ক্লিয়ার করতে পারতে। সম্পর্কে বিশ্বাস আর ভরসা থাকতে হয়। ভালোবাসাহীন সম্পর্ক তুমি বয়ে বেড়াতে পারবে। কারণ একসাথে থাকতে গেলে ভালোবাসা না হলেও একটা মানুষের প্রতি মায়া জন্মে যায়। আর ভালোবাসার চেয়ে মায়া প্রখর। কিন্তু বিশ্বাস আর ভরসা না থাকলে ভালোবাসার সম্পর্ক ও ভাঙ্গতে সময় লাগে না। আশা করি এমন বোকামি আর কখনো করবে না।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

লামিয়া নিরবে অশ্রু ঝাড়াচ্ছে। তার ভুল টা কোথায়? সে তো মেহরাবের ভালোর জন্যই তাকে ছেড়ে এসেছে। মাহতাব সংক্ষেপে সব কিছু খুলে বললো লামিয়া কে। লামিয়া অপরাধবোধে মেহরাবের দিকে তাকাতে পারছে না। মেহরাব আসার পর থেকে একবার ও তার দিকে তাকায়নি। এতেই লামিয়ার কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। সে কি অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে মেহরাব কে!
মনি টেবিলে নাশতা দিয়ে লামিয়া কে ডেকে বলল,

— ভাইয়াদের নিয়ে টেবিলে আয়। আগে খাওয়া দাওয়া। তারপর বাকি কথা বলা যাবে। সকাল থেকে যে পেটে কিছু পরে নি সেই খেয়াল আছে? বড় ভাইয়া আসুন। দুলাভাই আপনিও আসুন।
— আমরা কিছু খাবো না মনি। এতো কষ্ট করার জন্য ধন্যবাদ। বাসার সবাই চিন্তায় আছে। আমাদের তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। আমার বোনটাকে দেখে রাখার জন্য ধন্যবাদ। তুমি বরং আমাকে এক কাপ চা দাও। তাহলেই হবে।
মাহতাবের কথায় মনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মাহতাব যে এখানে খাবে না তা সে ভালো করেই জানতো। তবুও সে নিজের মতো আয়োজন করেছে। টেনশনে বাড়ির কেরোর পেটে যে দানা পানি পরেনি তা সে জানে। তাদের অভুক্ত রেখে মাহতাব ম*রে গেলেও খাবে না।

মনি দুজনকেই চা দিল।মেহরাব দুই চুমুক দিয়ে আর খেলো না। মাহতাব নিজের চা শেষ করে লামিয়া কে বলল,
— এবার যাওয়া যাক লামিয়া? তোমরা এসো। আমি নিচে যাচ্ছি।
— আমিও আসছি ভাই।
মাহতাব ছোট ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বললো না। মেহরাব ও মাহতাবের সাথে বেড়িয়ে গেল। যাওয়ার আগে মনি কে ধন্যবাদ দিতে ভুললো না। লামিয়া নিজের প্রতি এই অবহেলা মেনে নিতে পারছে না। শব্দ করে কেদে যাচ্ছে। মনি বিরক্ত হয়ে মুখ কুচকে বলল,

— এহন কান্দস ক্যা? জামাই রে ফালায় আহনের সময় মনে আছিল না? বেদ্দপ বেডি। তুমি কি মনে করসিলা তোমারে আইয়া কোলে নিয়া বইয়া থাকবো?এইবার যাও,জামাইর রাগ ভাঙ্গাও। ভাই আরেকটা বিয়া করলে একদম ঠিক হইতো। বেশি ভালোবাসে তো তাই হুস নাই। যেমনে মন চায় অবহেলা করো। এহন বুঝো মজা। সর সামনে থেইক্কা। আর দরজা ওই দিকে। তারাতাড়ি বাইর হ। তাড়ছিড়া বেডি।
লামিয়ার কান্না থেমে গেলো। মনির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
— তুই বেদ্দপ।তোর চোদ্দগুষ্টি তারছিড়া।তোর বাসায় না থাকলে কি হইবো। আমর কি বাড়িঘর নাই? গেলাম আমি। অসভ্য মাইয়া।

লামিয়া হনহন করে বেড়িয়ে গেল। মনি সেদিকে তাকিয়ে হালকা হেসে চা খাওয়ায় মন দিলো। সকাল থেকে তার পেটেও কিছু পরে নি।
মেহরাব ভাইয়ের দিকে কপাল কুচকে তাকিয়ে রাগী গলায় বলল,
— তুমি ওকে বকা দিলে না কেন? জোরে ধমক ও দাও নি।
— দিয়েছি।
— এটা কে ধমক বলে! আরো কিছু বলা দরকার ছিল। আসলে ভালো করে বকে দিবে। নাহলে আবারও এমন করবে।
— পারবো না। তুই দিস।

মাহতাবের সোজা জবাবে মেহরাব বলার মতো আর কিছু খুজে পেল না। সে কিভাবে বকবে! আজ পর্যন্ত তো কখনো একটা ধমক ও দেয়নি। সে তো শুধু ভালোবেসেছে। এখন মনে হচ্ছে ধমক দেয়া দরকার ছিল। মাঝে মাঝে বকাঝকা করলে প্র‍্যাকটিস থাকতো। তাহলে এখন তা কাজে লাগাতে পারতো। কি এক ঝামেলা। মেহরাব আবার মুখ কুচকে রইলো। এবার লামিয়ার সাথে সে টানা তিন দিন চার ঘন্টা কথা বলবে না। এটা লামিয়ার শাস্তি।
লামিয়া এসে কাচুমাচু করে দাড়ালো। মেহরাব অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। মাহতাব ভাইয়ের বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে রাখা দেখে মনে মনে হাসলো। লামিয়া কে গাড়িতে উঠতে বলে নিজে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে পরলো। মেহরাব হন্তদন্ত হয়ে বলল,

— তুমি ওখানে বসলে কেন? আমি চালাচ্ছি।
— পিছনে বস।
ভাইয়ের গম্ভীর গলা শুনে মেহরাব আর কিছু বলল না। চুপচাপ লামিয়ার পাশে গিয়ে বসে পরলো। তবে লামিয়ার দিকে ফিরেও তাকালো না।
— আমি ও বাড়ি যাবো ভাইয়া।
— কিন্তু মেহরাব ফ্ল্যাটে যেতে চাইছে।
লামিয়া মেহরাবের দিকে একবার আড় চোখে তাকিয়ে মিনমিনে গলায় বলল,
— আমার ওখানে একা একা থাকতে ভালো লাগে না। বাড়িতে নিয়ে চলুন না।
মাহতাব মেহরাবের দিকে একবার তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
— ঠিক আছে।

মেহরাব ও আর কিছু বললো না। সবার প্রতিই তার ভালোবাসা আছে। শুধু তার বেলায়ই অবিচার।
বাসায় পৌঁছাতেই সবাই লামিয়া কে ঘিরে ধরলো। ময়না বেগম কতক্ষণ বকাঝকা করে আবার নিজেই জড়িয়ে ধরে বসে আছে। মধু ও একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে আছে লামিয়া কে। সবার এতো ভালোবাসা দেখে লামিয়ার চোখ আবার ভরে উঠলো। কুলসুম বেগম ও এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গেছে। এমন যেন আর কখনো না করে তাও বুঝিয়ে বলেছে।
মাহতাব ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো মধু টেবিল সাজিয়ে ফেলেছে। মাহতাব কুলসুম বেগম কে একহাতে ধরে টেবিলের দিকে নিয়ে যেতে যেতে সবাইকে খেতে যেতে বলল,

— রহিমা,,মেহরাব কে ডেকে নিয়ে আয়।
— আইচ্ছা ভাইজান।
মেহরাব নিজের রুমে ঘাপটি মেরে বসে আছে। বাইরে বের হতে ইচ্ছে করছে না। মাহতাবের ডাক সে শুনেছে। তাই রহিমা আসার আগেই সে বেরিয়ে গেলো। টেবিলে গিয়েও সে লামিয়ার দিকে তাকালো না। সবাই মেহরাবের রাগ আর অভিমান বুঝলেও কিছু বললো না। তবে মধুর কাছে ব্যপারটি খুব ভালো লাগলো। ভালোবাসার মানুষদের অভিমান ও খুব সুন্দর। এই যে মেহরাব আড় চোখে দেখছে লামিয়া ঠিকঠাক ভাবে খাচ্ছে কিনা। তার দিকে তাকিয়েছে কি না। এসব দেখেও তো ভালো লাগে।

খাওয়া শেষে সবাই যে যার রুমে চলে গেলো। মাহতাব এখন অফিসে যাবে। আজ ঝামেলায় অনেকটা দেড়ি হয়ে গেছে। ঘড়ির কাঁটায় এখন প্রায় বারোটা বাজতে চললো।
মাহতাব কে রেডি হতে দেখে মধু ধীর গলায় বলল,
— আপনি কি অফিসে যাচ্ছেন?
— হুম। (আয়নায় মধুর দিকে তাকিয়ে)
— কাল রাতে তো ঘুমাতে পারেননি। এখন একটু ঘুমিয়ে বিকেলে গেলে হয়না?
মাহতাবের হাত থেমে গেলো। টাই বাধা রেখে সে মধুর দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,

— হয়।
— তাহলে রেস্ট নিন।
— আচ্ছা।
— তাহলে আমি যাই। আপনি ঘুমান।
— না।
— না মানে?
মাহতাব মধুর সামনে এসে দাড়ালো। পকেটে হাত গুজে মধুর দ্বিধান্বিত মুখের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,
— নাক ডাকা না শুনলে ঘুম আসে না।
মধুর মুখটা কালো হয়ে গেলো। অসহায় চোখে মাহতাবের দিকে তাকালো সে।

— তুমিও আমার সাথে ঘুমাবে এসো।
— আমার ঘুম আসছে না।(অসহায় গলায়)
— তোমার চোখ লাল হয়ে আছে। তুমিও কাল থেকে ঠিক করে ঘুমাও নি।
মধু আর কিছু বললো না। এভাবে দিনের বেলায় ঘুমিয়ে থাকলে মানুষ কি বলবে? সবাই খারাপ ভাববে হয়তো। তার সত্যিই খুব ঘুম আসছে।
— কেউ কিছু বলবে না। চুপচাপ শুয়ে পরো। আমি চেঞ্জ করে আসছি৷
— হুম।
মাহতাব চেঞ্জ করে এসে দেখে মধু আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে।
— ঘুমাও নি কেন?
— হ হ্যাঁ হ্যাঁ। ঘুমাচ্ছি।

মধু কাচুমাচু করে গিয়ে একপাশে সুয়ে পড়ল৷ মাহতাব জানলার পর্দা গুলো টেনে দিয়ে নিজেও মধুর গা ঘেঁষে শুয়ে পরলো৷ একটু ঘুমিয়ে নেয়া দরকার।
— দূরে কেন?আমার কাছে এসে ঘুমাও।
মধুর মুখটা শুকিয়ে গেলো। মাহতাবের কাছাকাছি শুতে তার ভয় করে। যদি হাত পা লেগে যায়! এমনিতেই তার নাক ডাকার জন্য বেচারা ঘুমাতে পারে না।
— আমি শক্ত করে ধরে রাখবো তোমায়। হাত পা ছুড়তে পারবে না। এসো।

আমার অবেলায় তুমি পর্ব ১৪

মধু বোকা বনে গেলো। মনের কথা বুঝলো কি করে? সে কি জোরে জোরে বলে ফেলেছে।
মধুকে ভাবতে দেখে মাহতাব তাকে কাছে টেনে নিলো। নিজের বুকের সাথে মাথাটা চেপে ধরে মন্থর গলায় বলল,
— এবার ঘুমাও। বুড়ো বলে আমাকে বেরসিক ভাবার কারণ নেই। তোমার বর যথেষ্ট রোমান্টিক। দেখবে?
মধু দ্রুত মাথা নাড়িয়ে না বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু মাহতাবের বুকে আটকে থাকায় বলতে পারলো না। মাহতাব মধুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মধুর কপালে চুমু খেয়ে ধীর গলায় বলল,
— ভালোবাসা নম্বর বত্রিশ। দেখেছো তোমার বর কতো রোমান্টিক?

আমার অবেলায় তুমি পর্ব ১৬