আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ২৬
সালমা খাতুন
বর্তমান….
বিরাটের হাতের আঙ্গুল অনুসরণ করে তাকিয়ে আরমান বিরবির করে উঠলো— “মায়াই…মাইশা। আমার পিচ্চি মায়াবতী।
তৎক্ষণাৎ আবারও বিরাট হাতের আঙ্গুল তুলে আরমানের ভুল শুধরিয়ে বলে উঠলো— “নাহ স্যার। আপনার বুঝতে ভুল হচ্ছে….মায়ার পাশে মায়াকে আগলে ধরে বসে থাকা মেয়েটি হচ্ছে মাইশা…মাইশা তালুকদার। মায়ার চাচাতো বোন.. যাকে আপনি এতো বছর ধরে খুঁজছেন।”
এটা শুনে আরমান একবার বোকা চোখে বিরাটের মুখের দিকে তাকিয়ে হাতের আঙুল অনুসরণ করে আবার তাকালো মায়ার পাশে থাকা মেয়েটির দিকে। চোখে ধাক্কা মারল সেই দৃশ্য।
পাথরের মত নির্জীব হয়ে বসে থাকা মায়া তার পিচ্চি মায়াবতী নয়, বরং তার পাশে বসে থাকা অন্য এক মেয়ে—যে মায়াকে জড়িয়ে ধরে চোখে অশ্রু নিয়ে বসে আছে..সে ওর পিচ্চি মায়াবতী। আবারও একবার আরমানের পায়ের নিচের মাটিটা দুলে উঠল—মায়া মাইশা নয় এটা জেনে।
বিরাটের বলা কথাটা আবারও কানে বাজলো— “মায়ার পাশে মায়াকে আগলে ধরে বসে থাকা মেয়েটি হচ্ছে মাইশা…মাইশা তালুকদার। মায়ার চাচাতো বোন.. যাকে আপনি এতো বছর ধরে খুঁজছেন।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মাইশা! যার নাম সে হৃদয়ে বয়ে বেড়িয়েছে বছরের পর বছর— যার জন্য সে নিজে থেকে মায়াকে না জেনে, না ভালোভাবেই দেখেই ডিভোর্স দিয়েছে, যেই নামটি ছিল ওর হৃদয়ের এক অংশ…এই কি সেই মেয়ে?
কোই চোখে চোখ পড়তেই তো কিছু ভাঙল না? কাঁপল না তার হৃদয়? কোই একবারও তো মনে হচ্ছে না যে ওই মাইশা নামের মেয়েটি ওর পিচ্চি মায়াবতী? ওর যে আগে অনুভূতি হতো, যে ওর পিচ্চি মায়াবতীকে খুঁজে পেলে এক ছুটে গিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরবে, তবে কোই এখন তো সেই ইচ্ছা হচ্ছে না…মাইশা নামের মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরতে।
বরং একটা ফাঁকা অনুভূতি… যেন এই মাইশা নামের মেয়ের মধ্যে কোথাও নেই সেই পিচ্চি মায়াবতী, সেই অনুভূতি, সেই চোখ।
ওর তো এই সময় ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে মায়াকে জড়িয়ে ধরতে, সান্তনা দিতে, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতে যে, তোমার বাবা চলে যাচ্ছে তো কি হয়েছে? আমি তো আছি। সারা জীবন আগলে রাখবো তোমায়।
কিন্তু না.. ও পারছে না। ওর যে এই অধিকার নেই। এই অধিকার ও নিজেই হারিয়েছে। কিন্তু মাইশা.. মাইশা কি আদেও সেই মেয়ে যে ওর জান বাঁচিয়েছিল। সেই পিচ্চি মায়াবতী। কোই তার সাথে তো কোনো মিল পাচ্ছে না ও।
আরমান স্থিরভাবে তাকিয়ে রইল মেয়েটার দিকে।
চেহারায় বিষণ্নতা, শোক, ক্লান্তি—সবই আছে।
কিন্তু তবুও… কোথাও যেন কিছু নেই।
“এই মেয়েটি কীভাবে হতে পারে সেই পিচ্চি মায়াবতী?”
মন বলছে, না।
হৃদয় আরও জোরে বলে উঠল—না।
কিন্তু যুক্তি? নাম, বয়স, পরিচয়, আর সেই নেম প্লেট—সব মিলিয়ে বলে দেয়, এ-ই সেই মাইশা। তবুও… তবুও মন মানতে চায় না।
একটু দূরে বসে থাকা মায়ার দিকে এক ঝলকে তাকাতেই বুকের ভিতর কেঁপে উঠল কিছুটা।
আশ্চর্য! এই চোখ… মুখের গঠন…এত চেনা…
একদম সেই দিনের মতো, যেদিন এক ছোট্ট হাত তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় গাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে ছিল।
তখনো ওর বুকের গভীরে এমন কাঁপন উঠেছিল,
যেমনটা এখন হচ্ছে… মায়ার দিকে তাকিয়ে।
আরমান নিজের মনে চমকে উঠল।
“কি ভাবছি আমি? মায়া কি…”
নিজের চিন্তা নিজেই তাড়িয়ে দিতে চাইল।
কিন্তু তা যেন একবার ঢুকে গেলে আর যায় না।
ভিতরে ভিতরে আরমান একটা অদ্ভুত দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ল। তবে এটা জানে—এই মেয়েটির সামনে দাঁড়ালে তার বুকের ভিতরে একরকম অদ্ভুত ঢেউ ওঠে, ঠিক যেমনটা ওঠে সেই মায়াবতীর কথা মনে পড়লে। কোই সেই ঢেউ তো মাইশাকে দেখে উঠছে না….
বিরাটের কণ্ঠে ঘোর কাটলো আরমানের
“স্যার, আমি এবার যাই। আমার কাজ শেষ। পৌঁছে দিয়েছি আপনাকে আপনার মাইশার কাছে। এখন আমাকে যেতে হবে।”
আরমান দ্বিধান্বিত গলায় কিছুটা আমতা আমতা করে বলল— “আচ্ছা বিরাটা তুমি সিউর তো যে এটাই মাইশা? না মানে, ওই নেম প্লেট এর অধিকারী মাইশা আর এই মাইশা এক তো?”
বিরাট— “হ্যাঁ স্যার! আমি একশো পার্সেন্ট সিউর। আর সিউর এর কথা আসছে কোথা থেকে? আমি সব ভালো ভাবে খোঁজ লাগিয়েছি, আর আমার কাছে সব প্রমাণও আছে যে ওই নেম প্লেট এর মাইশাই এই মাইশা। আমার এই কেসের পুরো ফাইল প্রমাণ সহ রেডি আছে, আমি আপনাকে পাঠিয়ে দেবো। এখন আমাকে যেতে হবে স্যার। আমার আরো অন্য কেস আছে। আর হ্যাঁ দরকার হলে আপনি একবার মিস মাইশার সাথে কথা বলে নিন। এখন আমি যাই।”
আরমান ঠিক আছে বলে বিরাটকে বিদায় দিলো। কিন্তু ও তখনো বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে ওর সাথে। মাথার ভিতর সব কিছু যেনো গুলিয়ে যাচ্ছে। এলোমেলো লাগছে সবকিছু। আজ যেনো ওর পিচ্চি মায়াবতীকে পেয়েও পেলো না। অথচ সেই মেয়েটা ওর সমানেই আছে, কিন্তু তাকে মানতে পারছে না ও কিছুতেই। আরমান দুই হাতে নিজের মাথার চুল খামচে ধরলো। ঠিক তখনি ওর কাঁধে কেউ একজন হাত রাখলো। পিছন ফিরে দেখলো আবির দাঁড়িয়ে আছে।
আবির আরমানকে এতোটা বিচলিত, বিদ্ধস্ত দেখে ওর কাঁধে হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো— “কি হয়েছে তোর? ঠিক আছিস? আর এখানে কখন এলি?”
আরমান নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল— “ঠিক আছি আমি। এই একটু আগেই এসেছি। কিভাবে হলো এসব?”
আবির একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, “কাল রাতে পার্টি চলাকালীন হসপিটাল থেকে কল করা হয়েছিল মায়াকে। ওর বাবার অবস্থা হঠাৎ করেই ভীষণ খারাপ হয়ে যাই। মায়া প্রথমে পার্টিতে ব্যস্ত থাকায় কল এসেছিল সেটা হয়তো খেয়াল করেনি। পরে হসপিটাল থেকে ওকে ম্যাসেজ দেওয়া হয়েছিল, ‘ওর বাবার অবস্থা খারাপ তাই যেন যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব ও হসপিটালে পৌঁছায়।’ মায়া ওই ম্যাসেজ দেখেই পার্টি থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে আসি। ওকে ওভাবে যেতে দেখে আমিও ওর সাথে বেরিয়ে আসি। আইসিইউতে নেওয়া হয়েছিল উনাকে। সারারাত মৃত্যুর সাথে লড়াই করে ভোরের দিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন উনি।”
আরমান কী বলবে, বুঝে উঠতে পারল না। বুকের ভেতরটা কেমন জ্বলে যাচ্ছে—মায়ার কথা মনে পড়তেই। এতো কষ্ট, এতো যুদ্ধ করেও বাবাকে শেষরক্ষা করতে পারল না মেয়েটা। একবার তাকালো মায়ার দিকে। বাবার মাথার পাশে পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে বসে আছে সে। মুখটা নিঃশব্দ, চোখ দুটি শূন্য দৃষ্টিতে বাবার মুখের উপর স্থির। গাল বেয়ে শুকিয়ে যাওয়া জলরেখার দাগ এখনো স্পষ্ট। চোখদুটো ফুলে লাল হয়ে উঠেছে, ঘুমহীন দীর্ঘ রাতের মতো ক্লান্ত আর বিষাদে ভরা। চুলগুলো এলোমেলো, অবিন্যস্ত—যেন নিজের খেয়ালই নেই। মাথায় সেই লাল গোলাপের ক্লিপটা আর দেখা যাচ্ছে না। হয়তো কোথাও পড়ে গেছে, কিংবা নিজের হাতে খুলে ফেলে রেখেছে… কে জানে!
হঠাৎ বাইরে থেকে ভেসে এলো চেঁচামিচির আওয়াজ। আরমান ও আবির চমকে তাকাল সদর দরজার দিকে। গার্ডরা একজোট হয়ে মিডিয়ার লোকদের আটকে রাখার চেষ্টা করছে। রিপোর্টাররা জেনে গেছে, আরমান শাহরিয়ার এসেছেন এখানে। একটা সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের একজনের মৃত্যুতে দেশের শীর্ষস্থানীয় একজন ব্যবসায়ীর উপস্থিতি—সেটা তাদের কাছে বড়ো খবর।
আরমান খেয়াল করলো, ওর বাবা… উনিও এখানে উপস্থিত। একপাশে নিঃশব্দ দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, মুখে একরকম বিক্ষিপ্ত ক্লান্তি, চোখে চাপা বিস্ময় আর ভার। এই দৃশ্য দেখে আরমান নিজেই কিছুটা অবাক হয়ে গেল। ধীর কণ্ঠে আবিরকে জিজ্ঞেস করলো,
— “ড্যাড এখানে কখন এসেছে?”
আবির ধীরে বললো, “আংকেল ভোরের দিকেই হসপিটালে পৌঁছে গিয়েছিলেন। শুনেছি, অনেকদিন ধরেই উনি হসপিটালের কিছু মানুষকে বলে রেখেছিলেন—মায়ার বাবার অবস্থা সম্পর্কে সব খবর যেন উনাকে জানানো হয়। তুই তো জানিস, তোর দাদু আর মায়ার দাদু এক সময়কার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। সেই সূত্রে তোর ড্যাড আর মায়ার বাবার মাঝেও ছিল এক গভীর বন্ধুত্ব। তুই তো বেশিরভাগ সময় বিদেশে ছিলিস, এসব জানার সুযোগই হয়নি তোর।”
একটু থেমে নিঃশ্বাস নিলো আবির, তারপর আবার বললো, “তুই মায়াকে ডিভোর্স দেওয়ার পর থেকে মায়ার বাবার ভীষণ অভিমান হয় আংকেলের উপর। যোগাযোগ পুরো বন্ধ করে দেন। আর আংকেলও… লজ্জায় মুখ দেখাতে পারেননি ওনাকে।
কিন্তু আজ, ভোরের দিকে যখন শেষ নিঃশ্বাস ফেলেন মায়ার বাবা, তার আগেই ভেঙে যায় দুই পুরনো বন্ধুর মান-অভিমান। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে উনিও বুঝে নেন—তোর ড্যাডের কোনো দোষ ছিল না তোর আর মায়ার সম্পর্কের ভাঙনে। সবটা তো তুই-ই ঠিক করেছিলি। তবু… শেষ সময়ে, নিজের মেয়েকে আর একা রেখে যেতে চাননি তিনি। আর পাশে ছিল না কোনো আপনজনও। সেই মুহূর্তে নিজের জীবনের একমাত্র বন্ধুকে পাশে পেয়ে, তোর ড্যাডকেই তিনি নিজের সবচেয়ে বড়ো দায়িত্ব দিয়ে যান। বলেন, ‘মায়াকে যেনো তিনি দেখে রাখেন।’”
এই কথাগুলো শোনার সময় আরমানের চোখ স্থির হয়ে থাকে এক বিন্দুতে, মন পড়ে থাকে অনেক দূরে—অতীতের এক ধুলোঝরা কোণে।
এদিকে, বাড়ির ভেতরে থাকা মানুষজন হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলো, আরমান শাহরিয়ার এখানে উপস্থিত। এখনো পর্যন্ত কেউ খেয়াল করেনি তাকে, কিন্তু মিডিয়ার চেঁচামিচি ও গার্ডদের ব্যস্ততায় এক ধরনের অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। সবার দৃষ্টি ধীরে ধীরে গিয়ে স্থির হয় আরমানের ওপর। কে যেন কানে কানে কিছু বলে, কেউ ফিসফিস করে—কৌতূহল, বিস্ময় আর সন্দেহ মেশানো এক অদ্ভুত দৃষ্টি ঘিরে ফেলে পুরো ঘরটাকে।
এ দেশের নামকরা একজন শিল্পপতি, সেই মানুষটা হঠাৎ এমন এক সাধারণ পরিবারের শোকবাড়িতে? কী সম্পর্ক তার মায়াদের সঙ্গে?
আর ওর বাবাও তো এসেছেন! যদিও শুরুতে কেউ বিশেষ খেয়াল করেনি উনাকে।
মিডিয়ার হট্টগোল সামাল দিতে কোনোভাবে রিপোর্টারদের বুঝিয়ে আরমানের বাবা তাদের নিয়ে বেরিয়ে গেলেন রাস্তায়, কারণ এমনিতেই মায়া দের বাড়িটা ছোটো। বারান্দাতেই শুইয়ে রাখা হয়েছে মায়ার বাবার নিথর দেহ। উঠোনে জড়ো হতে শুরু করেছে আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা। কেউ কেউ চুপচাপ দাঁড়িয়ে, কেউ বা চোখ মুছে দেখছে আর চলে যাচ্ছে।
“দেশের টপ বিজনেস ম্যান আরমান শাহরিয়ার… আপনি এখানে? আমি তো ভাবতেই পারছি না!”
একটা মেয়েলি উচ্ছ্বাসে ভরা কণ্ঠস্বর কানে আসতেই আরমান আর আবির একসাথে ঘুরে তাকালো। আরমান মুহূর্তেই থমকে গেল—চোখের সামনে দাঁড়িয়ে মাইশা তালুকদার। সেই মাইশা, বিরাট ভাষায় তার “পিচ্চি মায়াবতী”। অথচ মন এখনো মানতে নারাজ—এই মেয়েটিই কি সত্যিই সেই মেয়ে?
আবারও ভেসে এলো সেই উচ্ছ্বসিত স্বর,
“আমি আপনার অনেক বড়ো ফ্যান! কতবার ভেবেছি সামনে থেকে একবার আপনাকে দেখবো। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে, এমনভাবে আপনাকে দেখতে পাবো—স্বপ্নেও ভাবিনি!”
আরমান কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলো মাইশার দিকে। কীভাবে সম্ভব! এইমাত্র যে মেয়েটিকে সে দেখেছে মায়ার পাশে বসে, গাল ভেজানো চোখে কান্নায় ভেঙে পড়তে—তার মুখে এখন যেন আলো ফুটে উঠেছে। চোখের কোণে এখনো অশ্রুর রেখা, কিন্তু তাতে কোনো বিষাদের রঙ নেই—বরং যেন বিজয়ের এক অদ্ভুত দীপ্তি। মুখে ফুটে আছে একরকম উচ্ছ্বাস, যা ভেতর থেকে আলো ছড়াচ্ছে।
আরমান বুঝে উঠতে পারছিল না, এই পরিবর্তন কীভাবে এত দ্রুত সম্ভব হলো। মেয়েটি যেন কিছু পেয়ে গেছে—অনেক দিনের কাঙ্ক্ষিত, স্বপ্নের মতো কিছু। এমন এক মুহূর্তে, যখন চারপাশে শোকের ছায়া, মাইশার মুখে এই খুশির ঝলক তাকে গভীরভাবে বিস্মিত করলো।
মাইশা কিছুটা অনুরোধের সুরে বলল, “প্লিজ স্যার আমি কি আপনার সাথে একটু আলাদা ভাবে কথা বলতে পারি।”
আরমান এখনো অবাক, ও এই কথার উত্তরে কি বলবে বুঝতে পারলো না। এই কথার উত্তর আবির দিলো, “মিস এটা একটা শোকের পরিবেশ। তাই এই পরিস্থিতির গুরুত্ব টা একটু বোঝার চেষ্টা করুন। উনি এখানে কোনো মেয়েদের সাথে আলাদা কথা বলতে আসেননি।”
মাইশা আবিরের এই কথায় কিছুটা অপমানিত বোধ করলো। মুখটা ছোটো হয়ে গেলো ওর। আরমান মাইশার দিকে তাকিয়ে মাইশার মধ্যে সেই পিচ্চি মায়াবতীকে খোঁজার চেষ্টা করছে।
মায়ার বাবাকে খাটিয়ায় শুইয়ে ধীরে ধীরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে উঠোন পেরিয়ে। মায়ার বুক ফাটা কান্না বাতাস কাঁপিয়ে তুলছে—”পাপা! আমার পাপা!” আরমানের ছোটো আম্মু তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন, কিন্তু সে বাঁধন ছিঁড়ে ছুটে যেতে চাইছে বাবার দিকে। সামিরা একপাশ থেকে ধরে আছে তাকে, নরম করে শান্ত করতে চাইছে, কিন্তু সে যেন কিছু শুনতে পাচ্ছে না। সেই কান্নার শব্দে, সেই আহাজারিতে, বাড়ির উঠোনজুড়ে নেমে এসেছে নীরব অথচ ভারী এক অশ্রুপ্রবাহ। একে একে অনেকের চোখেই জল।
খাটিয়ার একপাশ ধরে আছে আরমান, তার পাশে আবির। আরেক পাশে আরমানের বাবা এবং মায়ার চাচা মোশারফ তালুকদার—যিনি সকালেই খবর পেয়ে স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছেন। তাঁর চোখেও যেন জমে উঠেছে না বলা অনেক কথা, আর তার মাঝখান থেকে গড়িয়ে পড়ছে নীরব অশ্রু। আরও দুজন প্রতিবেশী সহায়তা করছেন খাটিয়া ধরে।
আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ২৫
চলন্ত অবস্থায় হঠাৎ মায়ার কান্নার তীব্রতা বুক চিরে পৌঁছে গেল আরমানের হৃদয়ে। সে একবার চোখ বন্ধ করে ফেলল, যেন নিজেকে সামলাতে চাইছে। কিন্তু পরক্ষণেই টের পেল—এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়েছে তার চোখ বেয়ে। শক্ত কাঠখোট্টা মুখের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মানুষটাকে যেন নিজেই চিনতে পারল না সে। নিজের অজান্তে ভেঙে পড়ার এই মুহূর্তে, নিজেকেই অবাক করে দিল আরমান।