আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ২৮

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ২৮
সালমা খাতুন

হাসপাতালের কেবিনে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা।
মৃদু আলোয় ধূসর হয়ে আছে চারপাশ। মায়া এখনো ঘুমিয়ে আছে… চোখদুটো বন্ধ, ওর নিস্তরঙ্গ মুখে ছায়া পড়েছে ক্লান্তির, অথচ কী শান্ত, কী কোমল… যেন একটা হারিয়ে যাওয়া বিকেলের ছবি।
আরমান আস্তে করে কেবিনের দরজাটা বন্ধ করে দিলো। তারপরে এক নিঃশ্বাসে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ মায়ার দিকে। বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়ে গেল। মনের ভেতরটা হঠাৎ করেই খুব কাঁপতে শুরু করলো ওর।
আজকে সারাদিন কত কিছু ঘটে গেছে…

কত অস্থিরতা, দৌড়ঝাঁপ, টানাপোড়েন—সব মিলিয়ে শরীরটাও ক্লান্ত, কিন্তু মনটা?
মনে যেন বয়ে যাচ্ছে এক অস্থির স্রোত… এক অনুচ্চারিত হাহাকার।
আরমান চুপ করে একটা চেয়ার টেনে বসে গেলো বিছানার পাশে।
হাতটা বাড়িয়ে রাখলো খুব ধীরে… খুব নরম করে ছুঁয়ে রাখলো মায়ার হাতের পাশে। তবে ছোঁয়া নয়… কেবল অনুভব। ওর হাতে স্যালাইনের সুই গাঁথা, তাই সাহস হয়নি পুরোপুরি ধরার।
মাঝে মাঝে ওর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে ওঠে, বুকটা ধীরে ধীরে উঠানামা করে। কপালে এলোমেলো কিছু চুল পড়ে আছে, যেন ক্লান্ত মুখটার প্রশান্তিকে নষ্ট করে দিচ্ছে। আরমান আস্তে করে হাত বাড়িয়ে একটিমাত্র আঙুল দিয়ে সরিয়ে দিলো চুলগুলো, যেন মায়ার মুখটা আরও স্পষ্টভাবে দেখতে পায়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কিন্তু ওর সেই মৃদু ছোঁয়াতেই মায়া হঠাৎ ঘুমের ঘোরেই ভয় পেয়ে শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো।
আরমান কেঁপে উঠলো ওর এমন প্রতিক্রিয়ায়। তাড়াতাড়ি করে কপাল থেকে হাতটা সরিয়ে নিলো, যেন অপরাধ করে ফেলেছে এমন ভঙ্গিতে। তবে মায়ার হাতে রাখা ওর হাতটা ঠিকই কিছুটা চেপে ধরে রাখলো, যেন আশ্বস্ত করতে চায় তাকে। এরপর আস্তে ঝুঁকে মায়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো—
“আমি এখানে আছি তো… তোমার পাশে… তবে ভয় পাচ্ছো কেন, মায়াবতী?”
শব্দগুলো যেন বাতাসে মিশে গেলো। মায়ার তরফ থেকে কোনো সাড়া এলো না। কিন্তু সেই মুহূর্তে নিজেরই বলা কথায় থমকে গেলো আরমান। ‘মায়াবতী’…!

সে তো শুধু মাত্র, সেই ছোট্ট পিচ্চি‌ মেয়েটাকে এই নামে ডাকতো—পিচ্চি মায়াবতী। ওর নাম তো শুধু হৃদয়ে ছিল, মুখে কখনো আর আসেনি কাউকে দেখে। অথচ আজ… নিজের অজান্তেই, মায়াকে উদ্দেশ্য করে সেই নামটাই বেরিয়ে এলো!
এমনকি মাইশাকে তো কতবার দেখেছে, কথা বলেছে… একটিবারও তো মন থেকে সেই নামটা আসেনি! তবে আজ? আজ কেন এই ডাক?

হয়তো মায়ার মুখেই লুকিয়ে আছে সেই একই ‘মায়া’। ওর মুখের দিকে তাকালেই একটা গভীর মায়া এসে চেপে ধরে। এই মায়া হয়তো সেই পিচ্চির মায়াবতীর মতোই স্নিগ্ধ, সরল, তাই হয়তো এই ডাক। এই কথাগুলো ভেবে আরমান আবারও আনমনে ফিসফিস করে বলে উঠলো — “তোমার চোখে আমি যা দেখি, সেটা আমি আমার পিচ্চি মায়াবতীর চোখে দেখেছিলাম। অনেক বছর আগে…আর তাই হয়তো মন থেকে এই ডাক বেরিয়ে এলো।”
আরমান নিজের‌ সাথে কি হচ্ছে বুঝতে পারছে না। মায়ার মুখের দিকেই তাকিয়ে থাকতে মন চাইছে। যেনো কোনো ক্লান্তি আসবে না এই মুখের দিকে সর্বক্ষণ তাকিয়ে থাকলে। কেন এমন অনুভূতি হচ্ছে তা আরমান বুঝতে পারছে না।
আজ কনফারেন্স রুমে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলছিল। ফোন ভাইব্রেট করা ছিল। সামিরা কল করছে দেখেও প্রথমে রিসিভ করেনি। ইগনোর করেছিল ও। তারপর বার বার কল করতে দেখে, রিসিভ করে ।

যখন সামিরা মায়ার অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ার বিষয়ে জানালো, তখন যেনো আরমানের হৃদয় থমকে গেলো। পুরো শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো। আর কোনো কথা বের হচ্ছিল না ওর মুখ দিয়ে এদিকে সামিরা, ‘হ্যালো! হ্যালো!’ করে যাচ্ছিল। অনেক কষ্টে তখন আরমান নিজের মুখ দিয়ে কাঁপা গলায় বের করেছিল, “আ..আসছি আমি।”
এরপর আর কোনো কিছু না ভেবে, কনফারেন্স রুম থেকে ছুটে বেরিয়ে এসেছিল ও। অবাক হয়ে দেখেছিল সবাই আরমানকে এইভাবে কোনো কিছু না বলে ছুটে বেরিয়ে আসতে দেখে।‌ এরপর আবিরও নিজের ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখে সামিরার অনেক গুলো মিসডকল আর ম্যাসেজ। এরপর আবির অফিসের সবকিছু কোনোমতে সামাল দিয়ে নিজেও বেরিয়ে আসে।

আরমান মায়ার মুখের কাছে খানিকটা ঝুঁকে মায়ার মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় মায়ার। ধূসর আলো আর স্যালাইনের ফোঁটার শব্দের ফাঁকে চোখ মেলে দেখে—আরমান। ওর মুখের ওপর ঝুঁকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মুখে অদ্ভুত এক প্রশান্ত ভাব, যেন বহুদিন পর কোনো কিছুতে স্থির হতে পেরেছে।
মায়া চমকে ওঠে না। তবে ভেতরে কোথাও একটা আলতো কাঁপুনি বয়ে যায়—
স্মৃতি, দুঃখ আর দুর্বলতার ফাঁকে দাঁড়িয়ে থাকা এই মানুষটা, এত কাছে কেন?
ওর ঠোঁট কাঁপে… খুব নিচু দূর্বল গলায় ফিসফিস করে উচ্চারণ, “এভাবে… তাকিয়ে আছেন কেন?”
কণ্ঠে কিছুটা দূর্বলতা, একটুখানি ভাঙা ভাঙা বিস্ময়, যেন ঘোরের মধ্যে কথা বলছে ও।
আরমান মায়ার চোখ খোলা দেখতে পেয়েই সে যেন খানিকটা থতমত খেয়ে গেল। মুখের কাছ থেকে একটু সরে এসে সোজা হয়ে বসল। মুহূর্তেই নিজের স্বভাবজাত গম্ভীরতা ফিরিয়ে আনল সে। ঠোঁট কঠিন রেখায় বদ্ধ করে ফোনটা হাতে তুলে নিল, যেন ফোনে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ করছে এখন।

মায়া ধীরে ধীরে চোখ ঘুরিয়ে তাকাল চারপাশে, তারপর আরমানের দিকে। ক্লান্ত ও দুর্বল গলায় সে প্রশ্ন করল, “এটা… কোথায়? কোথায় নিয়ে এসেছেন আমায়?”
আরমান ফোন থেকে চোখ তুলে তাকাল মায়ার দিকে। গলার স্বর শান্ত, “হাসপাতালে। দুপুরের দিকে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলে তুমি। তাই নিয়ে আসা হয়েছে এখানে।”
মায়া:- “ওহ।”
তারপর খানিক চুপ থেকে, যেন হঠাৎ কিছু মনে পড়ে গেল তার। কণ্ঠে অসহায়তার আভাস, চোখে মেঘ জমার ইঙ্গিত, সে আবার প্রশ্ন করল—
“বাড়িটা? আমার পাপার বাড়ি… সত্যিই কি ওনারা নিয়ে নেবে? কোনো উপায় নেই… আমার পাপার শেষ স্মৃতিটুকু বাঁচানোর?”

আরমান মায়ার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল। দৃষ্টিটা ছিল শীতল, অনুভূতিহীন, যেন দীর্ঘদিনের ক্লান্ত এক পুরুষ যে সমস্ত আবেগকে অন্তরের গহীন কক্ষে তালাবদ্ধ করে রেখেছে। সেখান থেকেই যেন নিঃসৃত হলো তার উত্তর—
“না, কোনো উপায় নেই। কোম্পানির দেওয়া সময় শেষ হয়ে গেছে। তোমার বাবা নিজে হাতে দলিল আর কন্ট্রাক্ট পেপারে সই করেছিলেন। এখন আইনের চোখে ওই বাড়ি আর তোমার নয়।”
আরমানের এমন নিষ্ঠুর কথায় মায়ার চোখে বৃষ্টি নেমে এলো। আরমান তখনো তাকিয়ে আছে মায়ার মুখের দিকে। কি যেনো গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যাস্ত ও। আর মায়া দুঃখ, কষ্টে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
তখনি রুমে একজন নার্স প্রবেশ করলো। হাতে মেডিসিন ও খাবারের থালা। খাবারের থালা বেডের পাশের টেবিলে রেখে বলল, “এই যে উনার খাবার, আর এখন একটা ইনজেকশন আছে উনার।”
মায়া নার্সকে আসতে দেখে ফুঁপানো থামিয়ে দিয়েছে, তবে চোখ থেকে তখনও নিঃশব্দে পানি পড়ছে। আরমান তখনো মায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে।

নার্স প্রথমে মায়াকে শোয়া থেকে উঠে বসালো ধীরে সুস্থে। তারপর ধীরে ধীরে ইনজেকশনের সিরিঞ্জটা প্রস্তুত করে, মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “আচ্ছা ম্যাডাম, একটু কষ্ট হবে, সহ্য করুন।”
মায়া নিঃশব্দে চোখ বন্ধ করল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ওর সারা শরীর যেন কেঁপে উঠল। এখনো বুকের ভেতর কান্নার ঢেউ দোলা দিচ্ছে। নার্স ইনজেকশন পুশ করতেই, চুপচাপ ওর পাশে বসে থাকা আরমানের বাহু হঠাৎ করে বাঁহাত বাড়িয়ে শক্ত করে ধরে ফেলল। ওর আঙুলের নোখ গুলো গেঁথে গেলো শার্টের উপড় দিয়েই।
আরমান নির্বাক ভঙ্গিতে তাকালো মায়ার সেই হাতের দিকে। ওর চোখে ধরা পড়ল মায়ার চোখের ভেতর জমে থাকা আতঙ্কের ছায়া। ঠোঁটদুটো কেঁপে কেঁপে উঠছে মায়ার।

নিজের হাতের উপর আর একটা হাতের অস্তিত্ব পেতেই ধীরে চোখ খুলল মায়া। তারপর দৃষ্টি রাখলো আরমানের চোখের দিকে।
আরমান ওর হাতটা ছাড়িয়ে নিল না। বরং নিজের ডান হাতটা বাড়িয়ে ওর হাতের ওপর রাখল আস্তে করে। চোখে একটা নিশ্চিন্ত আশ্বাসের দৃষ্টি, যেনো বলতে চাইছে—“আমি তো আছি, ভয় কিসের?”
মায়া তাকিয়ে রইল আরমানের চোখের দিকে আরমানের দৃষ্টি তখন নিজের আরেক হাতে থাকা ফোনে। কিন্তু তবুও যেনো মায়া ভরসা পেলো আরমানের থেকে, তাই ওর আঙুলের চেপে ধরা শক্তিটা আস্তে আস্তে কমে এলো।
নার্স ইনজেকশন দিয়ে বলল, “হয়ে গেছে। এই ইনজেকশনটা ঘুম আনবে… তবে তার আগে কিছু খেয়ে নেবেন। অনেকক্ষণ কিছু খাননি তো।”

নার্স এর কথায় ঘোর কাটলো মায়ার। কিভাবে যে ইনজেকশন দিলো নার্স কি জানি? ও তো কিছু বুঝতেই পারলো না যেনো। ধীরে আরমানের বাহু থেকে হাত সরিয়ে আনলো মায়া। নার্স খাবারের থালাটা বিছানার পাশে রেখে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।
আরমান ওর মোবাইল টা পাশের টেবিলে রেখে চোখ মেলে তাকাল থালার দিকে। তারপর আবার মায়ার মুখের দিকে। মায়া মাথা নিচু করে নিজের কোলের দিকে দৃষ্টি রেখেছ। যেন শূন্য দৃষ্টিতে কী এক অতল কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে। চোখের কোনায় জমে থাকা অশ্রু তখনও শুকিয়ে যায়নি।
আরমান ধীরে ধীরে খাবারের থালাটা টেনে কাছে আনল। থালার মধ্যে একটা মাঝারি সাইজের বাটিতে স্যুপ রাখা। আরমান চামচে কিছুটা স্যুপ তুলে, মুখে কিছু না বলে চামচ টা মায়ার মুখের কাছে ধরলো।
মায়া মুখ তুলে চাইলো আরমানের দিকে। তারপর বলল, “আমি নিজে খেয়ে নেব।”
আরমান বিরক্ত না হয়ে গম্ভীর গলায় বলল—

“ডান হাতে স্যালাইন চলছে। বাঁ হাত দিয়ে চামচ ঠিক মতো ধরতে পারবে না। তাই বেশি না বকে, চুপচাপ খেয়ে নাও।”
মায়া দু’চোখে অভিমান আর ক্লান্তির মিশ্র ছায়া। যেন কাঁদতেও ক্লান্ত, বিরোধও করতে ইচ্ছে করছে না। তবুও বলল, “এখন এতিম হয়ে গেছি বলে দয়া দেখাচ্ছেন?”
আরমান চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইল একটুখানি। তারপর মুখটা গম্ভীরের থেকে গম্ভীর করে বলল— “ভেবে নাও তাই। আমার সময়ের একটা দাম আছে। তাই ফালতু বকবক না করে আমার সময় নষ্ট করবে না।”
মায়া ছলছল চোখে বলে উঠলো— “হ্যাঁ! আপনার তো সময়ের অনেক দাম। তাহলে এখানে এসেছেন কেন? আর এতোক্ষণ ছিলেনই বা কেন?”

আরমান এতোক্ষণে চামচ টা আবারও বাটিতে নামিয়ে নিয়েছে। মুখ তখনও গম্ভীর। গম্ভীর গলাতেই বললো— “মনে রাখবে, এই আরমান শাহরিয়ার কখনো কোনো কাজ নিজের স্বার্থ ছাড়া করে না।”
মায়া— “আমার খেয়াল রাখার পেছনে আপনার কি স্বার্থ আছে, মিস্টার আরমান শাহরিয়ার?”
আরমান এবার ধমকে উঠলো মায়াকে— “just stop it, Maya. আমি তোমার সব কথার উত্তর দিতে বাধ্য নয়। চুপচাপ খেয়ে নাও।”

আরমানের ধমকে ভয় পেয়ে চমকে উঠলো মায়া, থমকে রইল খানিকটা। আরমান নিজের কথা শেষ করে আবার চামচে খাবার তুলে নিয়ে মায়ার মুখের সামনে ধরেছে। মায়া একবার চামচের দিকে তাকাল, তারপর আরমানের চোখে। সেই চোখে কোনো মায়া নেই, কোনো অনুরোধও নেই—কিন্তু অদ্ভুত এক নিঃশব্দ জোর, অধিকার রয়েছে। যেনো মায়া বাধ্য আরমানের কাছে। একরকম অনিচ্ছাসত্ত্বেও মায়া আস্তে করে মুখ খুলল।
দুজনেই চুপ। কেবিনে তখন শুধু স্যালাইনের ফোঁটার শব্দ, ঘড়ির টিকটিকি, আর এক অজানা আবেগের নিঃশব্দ স্রোত।
আরমান যত্ন করে একে একে মায়াকে খাইয়ে দিতে লাগল। কোনো কথা নেই, তাড়া নেই—শুধু নিঃশব্দে এক মনোযোগে খাবার তুলে দিচ্ছে। যেন সেই মুহূর্তে এই কাজটাই পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
মায়া ওর মুখের ভেতর খাবার গিলে নিতে নিতে মনে মনে ভাবছিল—এই মানুষটা কি শুধুই নিজের স্বার্থে জন্য ওর এতোটা যত্ন করছে? এই সব কিছু কি শুধুই দয়া? নাকি… অন্য কোনো কিছু আছে, যেটা ও বুঝতে পারছে না?
কিছু প্রশ্ন কখনো, চাইলেও মুখে আনা যাই না, হৃদয়েই ঘুরপাক খায়।

মায়ার খাওয়া শেষ। আরমান তার হাতে কিছু না লাগার সত্ত্বেও ওয়াশরুম থেকে হাত ধুয়ে আসলো। মায়া চোখ মুখ কুঁচকে বলল— “আপনার হাতে তো কিছুই লাগেনি তাও হাত ধুলেন যে?”
আরমান মায়ার এই কথার কোনো উত্তর দিলো না। চুপচাপ কেবিনে থাকা সোফাটায় বসলো। যা দেখে মায়া মুখ বাঁকালো। আরমান তা আরচোখে দেখলেও কিছু বলল না। মায়া মিনমিন করে বলল— “নার্স কে একবার ডেকে দিন না।”
আরমান গম্ভীর গলায় বলল, “কেন?”
মায়া আবারও মিনমিন করেই উত্তর দিলো, “ওয়াশরুমে যাবো একবার।”

আরমান ঝট করে উঠে দাঁড়াল। তারপর কোনো কিছু না ভেবেই বলল— “তো চলো আমি দিয়ে আসছি ওয়াশরুমে।”
মায়া অবাক হয়ে গেলো, চোখ গোল গোল করে বলল, — “কিহ?? আপনি আমার সাথে যাবেন মানে??”
আরমান কোনো কিছু না বুঝতে পেরে, ভ্রু কুঁচকে বলল— “হ্যাঁ আমি তো বলেছি ‘দিয়ে আসবো ওয়াশরুমে’ এতে এতো অবাক হওয়ার কি আছে?”
মায়া এবার কিছুটা লজ্জা পেলো। মাথা নিচু করে নিলো ও। তারপর আমতা আমতা করে বলল— “তা তো ঠিক… কিন্তু শুধু দিয়ে আসলে তো হবে না। দাঁড়িয়েও থাকতে হবে… কারণ এই স্যালাইনের বোতলটাও নিয়ে যেতে হবে। আমার এক হাতে স্যালাইনের সুঁচ গাঁথা…আরো অন্য হেল্প লাগবে আমার।”

আরমান এতোক্ষণে বুঝতে পারলো সবকিছু। আর এতে নিজেই বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেলো ও। ও তো ভেবেছিল মায়া হয়তো একটু মুখে হাতে পানি দেবে। অন্য কিছু ভেবে দেখেনি ও। আরমান কিছুটা আমতা আমতা করে বলল— “মানে… দাঁড়িয়ে থেকে… স্যালাইনের বোতল ধরে… আর তুমি… মানে… আমি… তোমার…”
মায়া চোখ তুলে একঝলক তাকাল। এবার আরমান যেন পাথর। মুখ গম্ভীর রাখার চেষ্টা করলেও ভেতরে ঝটকা খেয়েছে বুঝাই যাচ্ছে। সে এক ঝটকায় বলে উঠল— “আমি নার্সকে ডেকে দিচ্ছি।”

আরমান কথাটা বলেই যেন নিঃশ্বাস ফেলার ফুরসত না পেয়ে তাড়াহুড়ো করে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে গেল। যেন মুহূর্তে হারিয়ে যেতে চায় এই বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে, যেটা ওর চিরচেনা গাম্ভীর্যের দেয়ালে একটা সরু ফাটল ধরিয়ে দিয়েছে। আরমান চলে যেতেই কেবিনে ফিরে এলো নিস্তব্ধতা। সেই নিরবতার ভেতর মায়ার ঠোঁটে এক অচেনা হাসির রেখা—যেটা তার সমস্ত কষ্ট, ক্লান্তি, শোকের গহ্বর পেরিয়ে এক অনাবিল কোমলতায় ঝিকিমিকি করে উঠলো। কাঠখোট্টা, গম্ভীর মানুষটার ভেতর যে এতখানি অবুঝ মানুষের স্পর্শ লুকিয়ে আছে, তা বুঝতে পেরে যেন একটুখানি আলো ছুঁয়ে গেল তার ভেতরের মেঘলা আকাশে।
কিছুক্ষণ পরেই কেবিনে প্রবেশ করলো একজন নার্স। কণ্ঠে পেশাগত সৌজন্য, মুখে একগাল হাসি।

“কি হেল্প লাগবে, ম্যাম?”
মায়া চোখ তুলে তাকিয়ে ধীরে স্বরে জানালো, “ওয়াশরুমে যেতে চাই।”
নার্স সহানুভূতির ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে নরম হাতে বেড থেকে নামতে সাহায্য করলো তাকে। স্যালাইনের পাইপ সামলে, ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো মায়া। কিন্তু ঠিক তখনই নিজের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে তার বুকের ভেতর হঠাৎ করেই শূন্যতার এক হালকা ঢেউ খেললো।

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ২৭

পরনে হাসপাতালের নরম আকাশি রঙের পোশাক—গলার কাছে খোলা, বুক জুড়ে ফাঁকা, কোথাও নেই চেনা ওড়নার আড়াল। মুহূর্তেই তার মুখে ছায়া ফেললো রক্তিমতা, লজ্জায় টকটকে হয়ে উঠলো দুই গাল। ভাবতেই কেমন হোঁচট খেল তার মন—এই বেশেই কি সে এতক্ষণ ছিল আরমানের সামনে?
চোখ নামিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো সে। মনের গভীরে অদ্ভুত এক অনুভূতির ঢেউ বয়ে গেলো—লজ্জা, অস্বস্তি, আবার যেন কোথাও একটা অচেনা স্পর্শে নরম হয়ে আসা হৃদয়ের পরত।

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ২৯