আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৩৬

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৩৬
সালমা খাতুন

কিছুদিন ধরেই অদ্ভুত এক অস্থিরতা গ্রাস করছে মায়াকে। হঠাৎ হঠাৎ মাথা ভার হয়ে আসে, যন্ত্রণায় চোখের পাতা ঝাঁপসা হয়ে যায়। মনটা যেন সর্বদা কোথাও হারিয়ে থাকে, চারপাশের কোনো কিছুর সাথেই আর সংযোগ স্থাপন করতে পারে না। মাঝে মাঝে এমন কিছু কথাও ভুলে যায়, যা মুহূর্ত খানেক আগেই বলেছিল বা শুনেছিল। নিজের ভেতরেই এক অচেনা শূন্যতা অনুভব করছে ও—সবকিছু যেন ধোঁয়াশা, অগোছালো, আর অবুঝ। নিজেকে যেন একটা পাগল, বেপরোয়া সত্ত্বা বলে মনে হয় তার। এমনিতেই কোনো কিছুই ভালো লাগছে না, তার উপর আবার এসব অদ্ভুত অনুভূতি যেন মনের মধ্যে বিষ ছড়াচ্ছে ধীরে ধীরে।

হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রেখেছে একটা ছোট্ট চিরকুট। পাতাটির স্পর্শেই যেন কোনো এক অজানা সংবেদন জেগে ওঠে মায়ার মনে। কোমরে বাঁধা কোমর বন্ধনীটা হঠাৎই ভারী মনে হচ্ছে, যেন কে একজন নিঃশব্দে এসে ওর শরীর জড়িয়ে ধরেছে—ঠান্ডা অথচ ব্যাকুল এক স্পর্শ যেন ছড়িয়ে পড়ছে ওর সারা সত্ত্বায়।
হঠাৎ করেই কানের খুব কাছ থেকে ভেসে এল এক স্বর, “কি ব্যাপার মায়া পরি? শপিং মলে এসেও শপিং না করে মুখ লটকে দাঁড়িয়ে আছো যে?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ভয়ে চমকে উঠল মায়া। দু’পা পিছিয়ে গিয়ে এক ঝটকায় ঘুরে তাকাল পিছনে। চেনা মুখ—আসিফ।
আসিফ বলল, “হেই, রিল্যাক্স! এমন করে চমকে উঠলে কেনো? মনটা কোথায় ছিল তোমার?”
মাথা নিচু করে ভগ্ন কণ্ঠে মায়া উত্তর দিল, “ওহ… কিছু না ভাইয়া, মানে… আমি খেয়াল করিনি, হঠাৎ এত কাছে থেকে বললেন, ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
আসিফ খানিকটা নাটকীয় ভঙ্গিতে মুখ বাঁকিয়ে বলল, “আহ! ‘ভাইয়া’ বলে তো মনটাই ভেঙে দিলে!”
লোকটার আচরণে কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেল মায়া। সকালেও সে খুবই গম্ভীর ভঙ্গিতে ‘আপনি’ সম্বোধনে কথা বলছিল, আর এখন যেন এক লাফে অনেকটা কাছে চলে এসেছে। এতটা দ্রুত ব্যবধান কমিয়ে ফেলার চেষ্টা, তাও আবার ওর মতো একজনের সঙ্গে—অস্বস্তিতে গুটিয়ে গেল মায়া।
প্রথমবার দেখা মাত্রই লোকটার ব্যক্তিত্বে একধরনের সম্মোহন অনুভব করেছিল মায়া। স্নায়ুর মতো টানটান গম্ভীর এক রূপে দেখা দিয়েছিল সে, কিন্তু এই মুহূর্তে তার আচরণে কোথাও যেন একটা খামখেয়ালিপনা, একধরনের অবাঞ্ছিত স্পর্শের গন্ধ।

মায়া হঠাৎ অনুভব করল, কেউ যেন ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চুপিচুপি অনুসরণ করছে, কিংবা দূর থেকে অনুভব করিয়ে দিচ্ছে নিজের উপস্থিতি। চারপাশে চোখ ঘোরালো ও। এই অস্থিরতা বুঝে ফেলে আসিফ জিজ্ঞেস করল, “কি হলো মায়া রানি? কাউকে খুঁজছো বুঝি?”
মায়া সোজাসুজি বলল, “কাউকে না। আর দয়া করে আমাকে এই নামে ডাকবেন না। খুব অস্বস্তি লাগে।”
আসিফ হেসে উঠল, “আরে, এতে আবার অস্বস্তি লাগার কী আছে—”
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই একটি মেয়ে কর্মচারী এগিয়ে এসে বলল, “ম্যাম, আপনাকে সামিরা ম্যাম ডেকেছেন, ওইদিকে।”

মেয়েটির কথায় যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল মায়া। মনে হলো, এখান থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারলে বাঁচে। মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, “হ্যাঁ, চলুন। আমার আপনার সাথেও একটু কথা আছে।”
মায়া দ্রুত পা ফেলল সেদিকে। সঙ্গে সেই মেয়েটিই, যে আগেও এসে ডেকে নিয়েছিল ওকে। এবং তারপরই ঘটেছিল সেই অদ্ভুত ঘটনাটা।
চলতে চলতে মায়া প্রশ্ন করল, “আচ্ছা আপু, তখনও তো আপনি বলেছিলেন সামিরা ম্যাম ডেকেছেন। কিন্তু আমি তো কোথাও ওদের দেখতে পেলাম না?”
মেয়েটি তখন থেকেই কেমন যেন কাঁচুমাচু করছিল। ওর মুখের অস্বস্তি মায়ার চোখ এড়াল না।
মেয়েটি বলল, “হ্যাঁ ম্যাম, তখন সামিরা ম্যাম আপনাকে উপরের ফ্লোরে ডেকেছিলেন। এই ফ্লোরে একটু বিদ্যুৎ সমস্যা হয়েছিল। কিছুক্ষণের জন্য আলো ছিল না। মানুষজনও ছিল না প্রায়। ওই যে সামিরা ম্যাম… আমি এখন যাই, আমার একটু কাজ আছে।”

এই কথা বলে তাড়াহুড়ো করে চলে গেল মেয়েটি। মায়া স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল ওর পিছুপানে। মনে হলো, কিছু একটা লুকোচ্ছে সে। আবার সেই চেনা ঝিমঝিমে অনুভূতি, মাথার ভেতর যেন দপদপ করে কিছু পুড়ে যাচ্ছে। সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। মায়া চোখ মুদে মাথাটা দুহাতে চেপে ধরল—প্রতিদিনই যেন নিজের সঙ্গে এক নতুন যুদ্ধ শুরু হয় ওর ভেতরে।
সামিরা— “আপু কি হয়েছেন তোমার? শরীর খারাপ লাগছে?”
সামিরা মায়াকে ধরে জিজ্ঞাসা করলো।
মায়া নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বলল, “না আমি ঠিক আছি। তুমি ডেকেছিলে আমায়?”
সামিরা— “হ্যাঁ আপু। তুমি তো কিছুই সপিং করলে না। এই দেখো এটা বড়ো ভাইয়া…না মানে আবির ভাইয়া আর আমি পছন্দ করে নিয়েছি তোমার জন্য।”

মায়া নিজের ধ্যানে থাকায় ভালো করে খেয়াল করলো না সামিরার কথাটা। খেয়াল করলে হয়তো বুঝতে পারতো, সামিরা আবিরকে বড়ো ভাইয়া বলে ডাকে না।
মায়া— “আরে এটার কি দরকার ছিল বলো তো।”
সামিরা— “কি বলো আপু? সপিংএ এসেছো আর সপিং না করেই ফিরে যাবে? ধরো তো এটা।‌ সবার সপিং শেষ। এখন কিছু খাওয়া দাওয়া করে বাড়ি ফিরবো।”
কথাটা বলেই সামিরা একটা বড়ো সপিং ব্যাগ ধরিয়ে দিলো মায়ার হাতে।
এরপর সবার সপিং শেষ হলে ওরা গেলো এই সপিং মলেই থাকা রেস্টুরেন্টে। দুপুর হয়ে গেছে, খুব জোড় খিদে পেয়েছে সবার। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে একেবারে খাওয়া দাওয়া করে তারপরই বাড়ি ফিরবে।

বিয়ের দিন… সন্ধ্যা বেলা…
আজ মাইশা ও আরমানের বিয়ে। রেজিস্ট্রি ম্যারেজ তাই, অনুষ্ঠানটি রাতেই হবে। দিনটিকে ঘিরে যেন এক অদ্ভুত উত্তেজনা, অজানা কাঁপন ছড়িয়ে রয়েছে চারপাশে। কাল সপিং এ নিজের ও আরমানের জন্য কাপল ড্রেস নিয়েছিল মাইশা—দুটি মেরুন রঙা পোশাক, লেহেঙ্গা আর তার সাথে একে সেট করে বানানো স্টাইলিশ কুর্তা। চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য মিশে আছে প্রতিটি সেলাইয়ে, প্রতিটি ডিজাইনে।

মাইশার লেহেঙ্গাটি ছিল দুর্লভ সৌন্দর্যের এক নিদর্শন। ভারী কাজ করা, চকচকে পাথরের ছটায় যেন জ্যোৎস্নার ছায়া পড়েছে কাপড়ের গায়ে। এমন পোশাক শুধু গায়ে দেওয়া নয়—মনে একরাশ রাজরানীর অনুভূতি এনে দেয়। বিখ্যাত মেকআপ আর্টিস্টকে আনা হয়েছে ওকে সাজিয়ে তোলার জন্য—একেবারে নিখুঁত, অপার্থিব রূপে।
প্রথমে সিদ্ধান্ত ছিল, বিয়েটা হবে নিরালায়, খুব গোপনে—শুধু ঘনিষ্ঠ কিছু মানুষকে নিয়ে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সব পাল্টে গেল। হঠাৎ করেই আরমান বদলে ফেলল তার সিদ্ধান্ত। বড়জোর কয়েকটা অতিথি নয়, বরং সমগ্র দুনিয়াকে জানিয়ে দিল তার এই বিশেষ দিনের কথা। দেশের-বিদেশের সব বড় ক্লায়েন্ট আর ব্যবসায়িক পার্টনারদের ইনভাইট করল সে। এমনকি মিডিয়াকেও প্রবেশাধিকার দিয়ে দিল নিজ হাতে।

যে বিয়ে একান্তই ব্যক্তিগত রাখতে চেয়েছিল ও নিজেই, সে বিয়েই যেন রাতারাতি রূপ নিল এক জাঁকজমকপূর্ণ রাজকীয় আয়োজনে। নিজ বাড়িতেই জানিয়ে দিল আরমান—আর কোনো গোপনীয়তা নয়। এবার সকলে জানবে, দেখবে, চিনে নেবে—আরমান শাহরিয়ার-এর অর্ধাঙ্গিনীকে। চোখের সামনে উপস্থিত হবে সেই নারী, যাকে সে এই জীবনের সবচেয়ে বড় পরিচয় দিতে চলেছে—‘মিসেস আরমান শাহরিয়ার’।”

এদিকে মায়া যেন ভেঙে পড়েছে ভীষণভাবে। মনে হচ্ছে, শরীরের প্রতিটি রক্তকণায় কান্না জমে আছে, অজানা এক যন্ত্রণায় ছটফট করছে ওর বুকের ভেতরটা। সত্যিই কি এই কষ্ট অজানা? নাকি নিজেই জানে সব, তবু না জানার ভান করে চলেছে বারবার? সকাল থেকে কতবার যে চোখের পানি ঝরেছে, তার কোনো হিসেব নেই। মনকে বারবার বুঝিয়েছে, এই কান্না ওর বাবার জন্য। পিতৃহীন হবার যন্ত্রণায় বুকটা ভার হয়ে আছে, এটাই যেন বিশ্বাস করাতে চাইছে নিজেকে। কিন্তু ওর মন জানে—এই যন্ত্রণার উৎস অন্য কোথাও।
এই ক’দিনে মায়া নিজেকেই চিনতে পারছে না। ভিতরটা কেমন অচেনা লাগছে—অজানা, ভীতিকর। কিছু একটা পরিবর্তন হচ্ছে ভিতরে, কিন্তু ঠিক কী—তা কি সত্যিই বুঝতে পারছে না ও?

“একি আপু! তুমি এখনো রেডি হওনি? আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তো সবাই বেরিয়ে পড়বে ইভেন্ট হলের উদ্দেশ্যে!”
সামিরার কণ্ঠস্বর ওর মন থেকে ছিটকে পড়া চিন্তাগুলোকে ছিন্নভিন্ন করে দিল।
মায়া তখন জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল—শূন্য দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে। চোখে তখনো অশ্রুর রেখা। শব্দ শুনে তড়িঘড়ি করে চোখ মুছে নিল দু’হাতের আড়ালে। তারপর পিছন ফিরে সামিরার দিকে তাকিয়ে এক কৃত্রিম হাসিতে মুখ ঢাকল—“তোমরা যাও সামিরা। আমি যাবো না।”

সামিরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মায়ার দিকে। এতোটা বিধ্বস্ত, এতোটা ভেঙে পড়া চেহারা শেষ কবে দেখেছিল ও? হ্যাঁ, তখন… যেদিন মায়ার বাবা মারা গেলেন, সেদিনও ঠিক এমনই দেখেছিল তাকে। চোখ ফোলা, মুখ থেমে থাকা, এলোমেলো চুল, যেন নিজের ভেতরে নিজেই লড়ছে কেউ একজন।
সামিরা মনে মনে বলে উঠল, “জানি আপু, খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার। তুমি এখনো ভাইয়াকে ভালোবাসো। নিজের চোখের সামনে নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে অন্য কারো হতে দেখাটা সহজ নয় কারো পক্ষেই। কিন্তু চিন্তা কোরো না। আবির ভাইয়া কথা দিয়েছে—এই বিয়ে হতে দেবে না কিছুতেই।”
এইটুকু ভেবে সে এগিয়ে এল মায়ার দিকে। “একি আপু! তুমি কাঁদছো কেন?”
নিজেকে অনেক বুঝিয়েও আজ যেন আর পারছে না মায়া। বুকের ভিতরটা জ্বলছে, এক আগুন লেগে আছে সেখানে, “ও কিছু না সামিরা। পাপার কথা মনে পড়ছে খুব। তাই চোখের পানি ধরে রাখতে পারছি না।”
কণ্ঠস্বরটি কেমন নিস্তেজ, তবু কঠিন আবরণে মোড়া।
সামিরা মায়াকে জড়িয়ে ধরে বলল,

“আপু, কষ্ট পেয়ো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আজকের অনুষ্ঠানে তোমাকে যেতেই হবে। না গেলে সবাই ভাববে তুমি কষ্ট পাচ্ছ ওদের বিয়ের জন্য। মানুষ ভুল ব্যাখ্যা দেবে—এটুকু বোঝার চেষ্টা করো।”
মায়া একরাশ ক্লান্তির সঙ্গে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “কে কেমন ভাববে তাতে কিছু যায় আসে না সামিরা। আমি কারো কাছে এতোটাও গুরুত্বপূর্ণ না যে কেউ আমাকে মনে রাখবে।”
সামিরা গাল ফুলিয়ে বলল, “তা হলে আমিও যাচ্ছি না। তোমাকে একা রেখে যাবো না। তুমি না গেলে আমিও যাবো না।”

বলেই ধপ করে খাটের উপর বসে পড়ল সে। মায়া পাশে বসে ওর মাথায় হাত রেখে বলল, “এটা ঠিক না সামিরা। তুমি তোমার ভাইয়ার একমাত্র আদরের বোন। তুমি না গেলে চলবে? আর তোমাকে তো আমি খেয়ালই করিনি এতক্ষণ, কী সুন্দর লাগছে তোমাকে। মাশাআল্লাহ, একেবারে পরির মতো লাগছে। লেহেঙ্গাটা খুবই সুন্দর।”
সামিরা মুখ ফিরিয়ে বলল, “হয়েছে! এত পাম দিতে হবে না। আমি বলেই দিয়েছি, তুমি না গেলে আমিও যাবো না। এবার বলো, রেডি হবে? না হলে আমি কিন্তু আমার সাজই নষ্ট করে ফেলব।”

মায়া কোনো উত্তর খুঁজে পেল না। কেবল এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। যেন সমস্ত দুনিয়া ওর কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে এক বিশাল ভার। কেউ বুঝতে চায় না তাকে, কেউ শুনতে চায় না তার হৃদয়ের গোপন বেদনার শব্দ।
ওয়াশরুমে ঢুকে গেল মায়া। এদিকে সামিরা আলমারির দিকে এগিয়ে গিয়ে বের করল কালকের সেই শপিং ব্যাগ। সেখানে রাখা ছিল একটি অনিন্দ্যসুন্দর সবুজ জামদানি শাড়ি, যার উপর সূক্ষ্ম গোল্ডেন সূতোর কাজ। সাথে ছিল মানানসই নানা জুয়েলারি।

কিন্তু জুয়েলারিগুলো দেখে সামিরা যেন এক মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল। প্রতিটি গয়না নিখাদ ডায়মন্ডের। চোখ কপালে ওঠার মতো দামি। কাল সে ব্যাগটা খুলেও দেখেনি—আর এই ব্যাগটিই তো আরমান ওকে দিয়েছিল, বলেছিল মায়াকে যেন নিজের নাম করে এগুলো দিয়ে দেয়, কারণ মায়া কিছুই নেয়নি।
মাথা যেন চক্কর দিয়ে উঠল সামিরার। আবার সেই অদ্ভুত প্রশ্ন—আরমান যদি সত্যিই মাইশাকে ভালোবাসে, তবে মায়ার জন্য এই অসামান্য উপহার কেন? দিনের পর দিন ও দেখেছে, মাইশার প্রতি কোনো মোহ নেই তার। কিন্তু ওর ভালোবাসা, ওর পিচ্চি মায়াবতী তো মাইশা।
সব গুলিয়ে যাচ্ছে। ভাবল, এবিষয়ে আবিরকে জানাবে। কিন্তু ঠিক তখনই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো মায়া। আর ওর ভাবনার স্রোত ছিন্ন হয়ে গেল।

সময় খুব বেশি নেই। আবির ভাইয়া স্পষ্ট করে বলেছে—আজ যেভাবেই হোক মায়াকে অনুষ্ঠানে পৌঁছাতেই হবে। তাই আর কিছু না ভেবে, সামিরা এগিয়ে এল মায়াকে সাজাতে।
মায়া তখনো যেন অচেতন ভাবনায় ডুবে। ওর দৃষ্টি নেই, রঙ নেই, জ্যোতি নেই—শুধু একটি নির্বাক অস্তিত্ব। চোখ ধাঁধানো শাড়িতে, মাথা ঘোরানো ডায়মন্ডের জুয়েলারিতে সেজেও সে যেন কেবল এক প্রাণহীন পুতুল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে থাকলো নিশ্চলভাবে। সামিরা এক এক করে সাজিয়ে দিতে লাগল ওকে।
আর ঠিক তখনই আয়নার প্রতিফলনে যদি একবার তাকাত মায়া—দেখতে পেত নিজেকে, দেখতে পেত এক অপার সৌন্দর্যের ছায়া। কিন্তু না—ওর সমস্ত অনুভূতি আটকে আছে ভিতরের এক জটিল, অভেদ্য যন্ত্রণায়।

বাড়ির সকল আত্মীয়স্বজন এবং পরিবারের সদস্যরা একে একে রওনা হয়ে গেছেন ইভেন্ট হলের উদ্দেশ্যে। শুধু থেকে গেছে পাঁচজন—মাইশা, আরমান, আবির, সামিরা এবং আয়ান। মাইশা জানিয়ে দিয়েছিল, সে আরমানের সাথেই যাবে। আর আরমানও সেই কথাতেই সায় দিয়ে বলেছিল, সে নিজেই মাইশাকে নিয়ে যাবে, বাকিরা যেনো আগেই বেরিয়ে পড়ে।
অনেকক্ষণ ধরেই মাইশা গাড়ির পেছনের সিটে বসে আছে। নীরব, অপেক্ষারত। কিছুক্ষণ পর সামিরা এসে বসলো ওর পাশে। এরপর গাড়ির ড্রাইভিং সিটে এসে বসল আবির, আর তার পাশে—শান্ত মুখে, সানগ্লাস পরা অবস্থায় বসে পড়ল আয়ান।
মাইশা হঠাৎ থমকে গেল। চমকে উঠে অবাক গলায় বলল,

“একি! তোমরা এই গাড়িতে কেনো? আর আরমান কোথায়?”
সামিরা হালকা সুরে বলল,
“ভাইয়া তো অনেক আগেই বেরিয়ে গেছে, আপু।”
মাইশার চোখে ক্ষণিকের হতাশা, কণ্ঠে ভেজা ভাঙা শব্দ—
“কিন্তু… আমার তো ওর সাথেই যাওয়ার কথা ছিল।”
আবির হালকা হাসিতে বলল, “আরমানের হঠাৎ একটা জরুরি কাজ এসে পড়েছে। জানোই তো, কতটা ব্যস্ত মানুষ ও।”
মাইশা ছোট্ট করে বলল,

“ওহ… আচ্ছা।”
শব্দগুলোর মধ্যে ছিল অনুচ্চারিত অপমান, চাপা অভিমান।
চোখের কোণে একবার তাকালো আয়ানের দিকে। গাঢ় রঙের শেরওয়ানিতে, চোখে সানগ্লাস আর হাতে ম্যাচিং ঘড়ি পরে দাঁড়িয়ে থাকা আয়ান যেন অন্য কেউ—অপরিচিত এক অভিজাত পুরুষ। মুখে অচেনা গম্ভীরতা, চোখে চাপা অভিমান।
ব্রেকআপের পর থেকে এই নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে সে—আর আশ্চর্যজনকভাবে, এই পরিবর্তিত আয়ানকে ভীষণ মানাচ্ছে। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে মাইশার, অথচ বুকের মধ্যে কী এক চাপা অস্বস্তি।

এদিকে মায়া—নিঃশব্দে বসে আছে গাড়ির অন্য প্রান্তে, আরমানের পাশে। সামিরা এই গাড়িতেই ওকে বসিয়ে গিয়েছিল। কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আরমান এসে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়েছিল। স্রেফ ইঞ্জিন চালিয়ে সামনে তাকিয়ে রইল—নিঃশব্দ, নির্লিপ্ত।
মায়াও আজ আর কিছু বলেনি। এমনিতেই ভিতরে কিছুই ভালো লাগছে না। অকারণেই বিরক্ত লাগছে। নিজের মনকে প্রশ্ন করে লাভ নেই, কারণ সে নিজেই জানে না—কেন এই মানুষের সঙ্গেই আজ ওর পথ এক হয়েছে, যে মানুষটা আজ অন্য কাউকে নিয়ে ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনছে। এত ভাবনায় মাথার যন্ত্রণা বাড়ছে কেবল।
চোখ সরিয়ে নিল বাইরের দিকে, চলমান জানালার ধারে তাকিয়ে রইল শূন্য দৃষ্টিতে।
হঠাৎই এক শান্ত কণ্ঠে বলে উঠল,

“শেষবারের মতো একটা জিনিস চাইবো… দিবেন আমায়?”
আরমান গম্ভীর গলায় বলল,
“হুম। বলো।”
মায়ার কণ্ঠে ছিল নিঃস্ব, নিঃশেষ হওয়া এক নারীস্বর—
“মুক্তি। আপনার কাছ থেকে মুক্তি চাইছি। জানি, এখনো পুরো এক মাস যায়নি। চুক্তির কিছুদিন বাকি। কিন্তু আমি আর এক মুহূর্তও চাই না। আজ, এই মুহূর্ত থেকে… আমি মুক্তি চাই। দিবেন আমায়?”
আরমান নিঃসাড় মুখে, একটুকরো নির্লিপ্ততা মিশিয়ে বলল,
“হুম। আজকের পর থেকেই তুমি মুক্তি পাবে। সেই চুক্তি আর তোমাকে মানতে হবে না। কারণ আজ আমার জীবনে আমার অর্ধাঙ্গিনীর প্রবেশ ঘটবে। তাই আমার আর কোনো পার্সোনাল মেইডের প্রয়োজন পড়বে না।”
মায়া একটিবারের জন্যও তাকালো না ওর দিকে। শুধু ঠোঁটের কোণে নিস্তরঙ্গ এক শব্দ—

“ধন্যবাদ।”
তারপর নেমে এল নিঃশব্দতা। গাড়ির ভিতর নিঃসাড় নিস্তব্ধতা যেন ওদের মনের ভিতরের স্তব্ধ কান্নার প্রতিচ্ছবি। দুই পাশে বসা দুটি প্রাণ—একজন এগিয়ে চলেছে নতুন এক জীবনের পথে, আর আরেকজন বিদায় নিচ্ছে সেই জীবনের সবটুকু স্বপ্ন ছুঁয়ে।
মায়া এক গভীর শ্বাস টানল। জানালার পাশে বসে থাকা সেই মানুষের শরীর থেকে আসা পরিচিত গন্ধটা শেষবারের মতো বুক ভরে নিতে চাইল। শেষবারের মতো… যেন হৃদয়ে জমা রাখতে চায়—একটি জীবনের অনুপস্থিত সঙ্গীস্মৃতি।
আরমানের গাড়ি এসে থামল ইভেন্ট হলের একটি নিরিবিলি দরজার সামনে। সেখানে গার্ড ছাড়া আর কোনো মানুষের চিহ্ন নেই। বিপরীতে, মেইন গেটের কাছে চলছে তীব্র কোলাহল—অনেক মানুষের আনাগোনা, গাড়ি থামার শব্দ, ফটোগ্রাফারদের হাঁকডাক।

গাড়ি থেকে নেমে এলো মায়া। এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল দরজার দিকে। আরমানও নামল, তারপর পকেট থেকে ফোন বের করে দ্রুত কাকে যেনো একটি মেসেজ পাঠিয়ে দিল। মায়া কিছু না ভেবে, না কিছু জিজ্ঞেস করে, নির্ভার পায়ে এগিয়ে গেল সেই দরজার দিকে।
দরজা পেরিয়েই মুহূর্তে চারদিক যেন আলোর ঝলক জ্বলে উঠল।
সাথে সাথেই শুরু হয়ে গেল বেলুন ও ফুলের বর্ষন। উপর থেকে ঝরে পড়ছে লাল গোলাপের পাঁপড়ি ও রঙিন লাভ-শেপ বেলুন। মেঝেতে ধোঁয়ার আস্তরণ গড়িয়ে যাচ্ছে ধীর গতিতে, আর তার ওপরে সাজানো রয়েছে অপূর্ব কার্পেট, কার্পেটের ওপর বিছানো ফুলের পাঁপড়ি—একটি নিখুঁত স্বপ্নময় পথ।
মায়ার পাশে এসে দাঁড়াল আরমান। সেই মুহূর্তেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল কনফেটি ফাটার শব্দ, এক মুহূর্তে আকাশ রঙিন কাগজের ঝলকে ঢেকে গেল। মায়ার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে চিকচিক করা রঙিন কাগজের কণা, ঝিলিক দিচ্ছে আলোর ঝলকে।

মিডিয়ার ক্যামেরাগুলোর ফ্ল্যাশ একসঙ্গে জ্বলে উঠল। চারদিক থেকে ভেসে আসছে ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক আওয়াজ। চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে এতসব ঝলমলে আলো আর ভিড়ের মধ্যে। যেন পুরো ভুবন তাকিয়ে আছে একজন নারীর দিকে—যার আগমন আজকের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত দৃশ্য।
আর ঠিক তখনই—মায়া হতবাক। একেবারে নিঃশব্দে, নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে। কী হচ্ছে তার সঙ্গে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল চারপাশে।
এমন সময় হঠাৎ কারও ধাক্কায় টলে উঠল মায়ার শরীর। ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যেতে যাচ্ছিল সে, ঠিক তখনই শক্ত অথচ স্নিগ্ধ এক হস্তে কোমর ধরে ওকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো আরমান। কেঁপে উঠলো মায়া।

মুহূর্তের মধ্যে মায়া ফিরে তাকাল সামনের দিকে—মাইশা দাঁড়িয়ে আছে রাগে ফুসতে থাকা চোখে। সেই দৃষ্টি ঠিক যেন ওর বুকের ভেতরে আগুন ছুঁড়ে দিচ্ছে।
তারপর ধীরে তাকালো পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরমানের দিকে। গম্ভীর মুখ, নিঃশব্দ চোখ—তবুও সেই চোখের ভাষা স্পষ্ট। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাইশার দিকেই।

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৩৫

মায়ার মাথাটা হঠাৎ কেমন যেন ঘুরে উঠল। পা থেকে শরীর আলগা হয়ে এলো, চোখে অন্ধকার। চারদিকের কোলাহল যেন থেমে গেল এক নিমিষে। শরীরটা ঢলে পড়ল, আর ঠিক তখনই আরমান দুই হাতে জড়িয়ে ধরল তাকে। আগলে রাখল পরম যত্নে, যেন তার সবচেয়ে প্রিয় কিছু হারিয়ে যেতে বসেছে।
আরমানের মুখে ফুটে উঠল এক তীব্র উদ্বেগ। বুকের ভিতর তোলপাড় করে উঠল—মায়ার নিঃশব্দ জ্ঞান হারানো যেন তার ভিতরটাকে ছিন্ন করে দিয়ে গেল।

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৩৭