আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৩৯

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৩৯
সালমা খাতুন

মায়ার রেখে যাওয়া চিঠি….
প্রিয় গম্ভীর সাহেব..
গম্ভীর সাহেব বলছি বলে আবার রাগ করবেন না যেনো। এই নামটা একেবারে আপনার স্বভাবের সাথে যাই, এই ডাকটা আমার খুব প্রিয়।‌ কিন্তু আফসোস কখনো ডাকা হয়নি, সেই সুযোগই পাইনি কখনো। জানেন সেই প্রথম যখন আপনাকে দেখেছিলাম মানে, আমাদের বিয়ের দিন, তখন প্রথম দেখায় আপনার মুখের গম্ভীর ভাব দেখে এই ডাকটাই প্রথম আমার মনে এসেছিল। কিন্তু আফসোস কখনো সামনাসামনি ডাকা হয়নি, আপনি তো সে সুযোগ টাই কখনো দেননি আমায়। তবে আজ, যখন চিরতরে চলে যাচ্ছি, আর ফেরার কোনো সম্ভাবনা নেই—নিজের এই ক্ষুদ্র ইচ্ছে টা আপনাকে লেখা এই চিঠিতে মিটিয়ে নিচ্ছি। মুখে না হোক, কলমে তো অন্তত বলতে পারলাম, “গম্ভীর সাহেব…”

আচ্ছা যেটা বলার জন্য এই চিঠি লেখা, সেটা আগে বলি। চলে যাচ্ছি আমি। চলে যাচ্ছি আপনাদের জীবন থেকে। অনেক দূরে। আর হয়তো কোনোদিনও দেখা হবে না। আর আপনাকে এই বিরক্তিকর মেয়েটির মুখ দেখতে হবে না। হুম কিছুটা ঋণ থেকে গেলো আপনার কাছে, শোধ করা হলো না সেটা। চুক্তির এক মাস শেষ হতে এখনো কিছুদিন বাকি আছে। এটার জন্য আবার বিশ্বাস ঘাতক ভাববেন না প্লিজ। সন্ধ্যায় গাড়িতে আসার সময় এই বিষয়ে বলেছি আপনাকে, মুক্তি চেয়েছিলাম এই চুক্তি থেকে, আপনিও কিন্তু মুক্তি দিয়েছেন আমায়। আপনি তো বলেই দিলেন, আজ থেকে আপনার জীবনে আপনার অর্ধাঙ্গিনী থাকবে। তাই আজ থেকে আমি মুক্তি পেলাম আপনার কাছে। আমাকে এই মুক্তি দেওয়ার জন্য, আমি অনেক অনেক কৃতজ্ঞ থাকব আপনার কাছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এই মুক্তি টা যে আমার ভীষণ দরকার ছিল গম্ভীর সাহেব। ভীষণ ভীষণ দরকার ছিল।‌ আমি যে আর সহ্য করতে পারছিলাম না। সহ্য করতে পারছিলাম না নিজের স্বামীকে অন্য কারো হতে দেখতে। তবে এটাকে আবার বড়ো বোনের প্রতি হিংসা ভাববেন না। মনে রাখবেন, আপনি আমার বড়ো বোনের হওয়ার আগে, আপনি আমার ছিলেন। আর নিজের স্বামী বললাম কারণ— হ্যাঁ আমি আপনাকে এখনো নিজের স্বামী বলেই মানি।‌ সেই বিয়ের প্রথম দিন থেকেই। এখনো আপনাকে ভালোবাসি গম্ভীর সাহেব, এখনো ভালোবাসি আপনাকে। এই বিরক্তকর মেয়েটা আপনাকে ভালোবাসে। চলেই তো যাচ্ছি আপনার জীবন থেকে, তাই ভাবলাম মনের কথা আপনাকে জানিয়েই যায়। এতে আমার হৃদয়ের ভাড় কিছুটা হালকা হবে।

জানেন গম্ভীর সাহেব! অনেক চেষ্টা করেছি আপনাকে ভুলে যাওয়ার, কিন্তু পারিনি। অনেক ভেবেছি আপনাকে ভুলে নিজের জীবনে এগিয়ে যাবো। কিন্তু পারিনি। আপনাতেই থমকে গেছিল আমার জীবন। হয়তো আপনার চোখে বা এই দুনিয়ায় চোখের আমার এই ভালোবাসা অন্যায় কারণ, আমাদের যে কাগজে কলমে ডিভোর্স হয়ে গেছে। তবে আমার চোখে আমার এই ভালোবাসা এখনো বৈধ, অন্যায় নয়। কারণ আমরা যে ইসলাম ধর্মের নীতি মেনে, কালেমা পড়ে, আল্লাহ কে সাক্ষী রেখে তিন কবুল বলেছিলাম। ইসলামিক শরিয়াহ মতে, কেবল তালাকনামায় স্বাক্ষর করলেই তালাক কার্যকর হয় না, যদি না এর সঙ্গে নিয়ত ও স্পষ্ট উচ্চারণ থাকে। তাই এখনো আমি আপনাকে নিজের স্বামী বলে মানি। ভালোবাসি আপনাকেই গম্ভীর সাহেব। আপনার অনেক অবহেলার পরও আপনার জন্য আমার হৃদয়ে থাকা ভালোবাসা মুছে ফেলতে পারিনি, হয়তো তিন কবুলের জোড়েই।

জানেন গম্ভীর সাহেব, যেদিন আপনি আমাদের বাড়িতে ডিভোর্স পেপার পাঠালেন, বলে বোঝাতে পারবো না সেদিন কতটা কষ্ট হয়েছিল। তবুও সাইন করে দিয়েছিলাম আপনার কথা ভেবে। এতে যদি আপনি খুশি থাকেন তাহলে তাই সয়। জানেন গম্ভীর সাহেব, যখন আমি সাইন গুলো করছিলাম তখন মনে হচ্ছিল, আমার হৃদয় টা কেউ হাত দিয়ে টেনে ছিঁড়ে বাইরে বের করে নিচ্ছে। তবুও সাইন করেছিলাম, আপনার ভালো থাকার কথা ভেবে।

আমি চাইলেই কিন্তু ডিভোর্স এর আগে, আমাদের বিয়ের কথা ফাঁস করে দিতে পারতাম। গোটা দুনিয়া বাসীকে জানিয়ে দিতাম পারতাম। আর এতে আপনি আমাকে আপনার স্ত্রীর অধিকার দিতে বাধ্য হতেন।‌ কিন্তু আমি তো আপনার কাছে ভালোবাসা চেয়েছি। চেয়েছি ভালোবেসে আমাকে স্ত্রীর অধিকার দিন, ভালোবাসে আপন করে নিন। আপনাকে বাধ্য করতে চাইনি। আবির ভাইয়া বলেছিল আমাকে এমন করতে, আবির ভাইয়া আমাকে সব রকমের সাহায্য করতে চেয়েছিল এই বিষয়ে। কিন্তু আমি রাজি হয়নি। এতে যে আপনার ক্ষতি হবে গম্ভীর সাহেব। এতে যে আপনার সম্মানহানি হবে।

আর যাকে ভালোবাসি তার এতো বড়ো ক্ষতি কিভাবে করতে পারি? তার থেকে বরং ভালো থাক ভালবাসার মানুষটি। সে যেভাবে ভালো থাকতে চাই ভালো থাক। ভালোবাসা মানেই তো নিজের কষ্ট হলেও, ভালোবাসার মানুষটিকে ভালো রাখা। তাই আমার কষ্ট হলেও সাইন করেছিলাম আপনার পাঠানো ডিভোর্স পেপারে।
তারপর অনেক চেষ্টা করেছি আপনাকে ভুলে এগিয়ে যাবো নিজের জীবনে, কিন্তু পারিনি। কারণ ওই যে— হৃদয়ে ছিল তিন কবুল এর বাস। এরপর হঠাৎই অপ্রত্যাশিত ভাবে আবারও দেখা হয়ে গেলো আপনার সাথে।‌ আপনাকে এমন জায়গায় দেখবো কখনো কল্পনাও করিনি। রাগের মাথায় অনেক কিছু বলেছিলাম। রাগের মাথায় নিজেকেও অনেকটা ছোটো করেছিলাম আপনার সামনে।‌ যাক গে, সে সব কথা থাক। তবে আমি সত্যিই ভীষণ ভাবে কৃতজ্ঞ‌ আপনার কাছে গম্ভীর সাহেব, আমাকে ওই নোংরা জায়গা থেকে বের করে আনার জন্য। হাজার ধন্যবাদ দিলেও কম হয়ে যাবে। ওই ঋণ আমি কোনো দিনও শোধ করতে পারবো না। সেই রাতে নিজের কুমারিত্ব হারিয়ে ছিলাম, তবে আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া যে মানুষটি আমার স্বামী ছিল।

এরপর শুরু হয় আপনার কাছাকাছি থাকা।‌ এতে আমার হৃদয়ে চাপা পড়া ভালোবাসা, আসক্তি আবারও জেগে ওঠে। আপনার হাজার অপমান, কটুক্তিও পারেনি আপনার জন্য আমার হৃদয়ে ঘৃণা সৃষ্টি করতে। কারণ আপনার দেওয়া কষ্ট গুলোর গভীরতার চেয়ে আমার হৃদয়ে থাকা ভালোবাসার গভীরতা বেশি ছিল। তবে ভাববেন না যে আমার ভালোবাসা জাহির করে আপনার থেকে সহানুভুতি পেতে চাইছি। এইধরনের মেয়ে আমি নয়। শুধু হৃদয়ের ভাড় কমানোর জন্য কথা গুলো আপনাকে জানিয়ে রাখলাম গম্ভীর সাহেব। আমি জানি এই চিঠি যখন আপনার হাতে পড়বে তখন আপনি হয়তো আমার বড়ো বোনের হয়ে যাবেন।
থাক অনেক কিছু বলে ফেলেছি।‌ শেষে একটাই চাওয়া, মাঝে মাঝে হয়তো আমিও আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি রাগের মাথায়।‌ তার জন্য মন থেকে সরি। শেষ বারের মত ক্ষমা করে দেবেন, এই বিরক্তিকর মেয়েটাকে।
ভালোবাসি গম্ভীর সাহেব।‌ কোনোদিন আসবো না, আমার এই ভালোবাসার দাবী নিয়ে। ভালো থাকা ভালোবাসা…..
ইতি…
আপনার অপ্রিয়
(আপনার ভাষায়) প্রাক্তন স্ত্রী..

আবির চিঠিটা পড়ে শেই করতেই চারিদিকে নীরবতা ছড়িয়ে পড়লো। সবাই মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। দুজনেই ভালোবেসেছে একে অপরকে, তবে তা খুব গোপনে। একজন গোপন রেখেছে অভিমানে, আর একজন গোপন রেখেছে নিজের অনুভূতিতে নিজেই বিভ্রান্ত হয়ে। হ্যাঁ আরমান কষ্ট দিয়েছে মায়াকে, তবে ওর দেওয়া প্রতিটি আঘাতের পিছনে কোনো না কোনো কারণ ছিল। আচ্ছা ও কি খুব বেশি আঘাত দিয়ে ফেলল মায়াকে? ও তো ভেবেছিল ওর করা ভুল গুলোর জন্য সকলের সামনে ক্ষমা চেয়ে মায়াকে আপন করে নেবে। কোনো কিছুর পরোয়া না করা আরমান তো কোই আজ নিজের ব্যাক্তিত্বর কথা ভাবেনি। পুরো দুনিয়া বাসীর সামনে মায়াকে পাওয়ার জন্য মায়ার সামনে মাথা নত করতে রাজি ছিল ও। কিন্তু এমনটা কেনো করলো মায়া? ভুলে বুঝে কেনো এইভাবে দূরে সরে গেলো ও?

নাহ এখন এই সব ভাবার সময় নেই। খুব বেশি দেরি হওয়ার আগে খুঁজে বের করতে হবে মায়াকে। এতো অল্প সময়ের মধ্যে খুব বেশি দূরে হয়তো মায়া যেতে‌ পারবে না। এই ভেবে আরমান হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়ালো, ছুটে গেলো যেই ঘরে মায়াকে রাখা ছিল সেই ঘরে। হ্যাঁ রুবির কথা মতো বিছানায় রক্তের দাগ। সাথে ফ্লোরেও কিছুটা রক্ত।
থমকে গেলো আরমানের হৃদয়। মায়া ঠিক আছে তো? এই রক্ত কিসের রক্ত? অজনা আশঙ্কায় বুকের ভিতর টা কেঁপে উঠলো‌ আরমানের।

রাত ১:৩৫
আরমানের হৃদয়ে সাথে যেনো পৃথিবীর বুকেও ঝড় উঠেছে। আকাশে বজ্রপাতের শব্দ এত বিকট যে, মানুষের বুকের ভেতর কাঁপতেও বাধ্য। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাতাসের গতি। আর সেই বাতাসের গতির সাথে যেনো নিরব যুদ্ধ চলছে আরামানের। কিন্তু প্রকৃতির এই তান্ডবের সাথে পাল্লা দেওয়া কি এতোই সহজ? গাছ গুলো এমন ভাবে দুলছে যেনো এখনি ভেঙে পড়বে আরমানের গাড়ির উপর।

হ্যাঁ! সকলের বাধা উপেক্ষা করে এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে এসেছে আরমান। সিসিটিভি ফুটেজ এ দেখেছে মায়াকে বিদ্ধস্ত অবস্থায় ইভেন্ট হল থেকে বেরিয়ে আসতে। কেমন যেনো টলমল করছিল মায়ার শরীর টা।
শুধু ও একা নয়, সমস্ত গার্ড দেরও আদেশ করেছে মায়াকে খুঁজে বের করার। এই ঝড় বৃষ্টি মধ্যেও গার্ডরা তার বসের আদেশ অমান্য করেনি। ওরাও খোঁজ চালাচ্ছে শহরের প্রতিটি অলিগলিতে। আরমান ওর সমস্ত সোর্স কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। যেভাবেই হোক ওর মায়াকে ফেরত চাই। কিছুতেই হারাতে পারবে না ও ওর পিচ্চি মায়াবতীকে।
আবিরও বসে নেই। ও নিজেও বেরিয়েছে মায়াকে খুঁজতে। আবিরও নিজের বোনের মতো ভালোবাসে ওকে।

আরমান গাড়ির চলন্ত অবস্থাতেই, এদিকে ওদিকে তাকাতে ব্যাস্ত, একটি বার সেই চেনা মুখটির দেখা পাওয়ার আশায়। তখনো আকাশের বুক চিড়ে নেমে আসছে বজ্রপাত। থেকে থেকেই বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই আলোয় অনেকটা দূরে দেখা গেলো আবছা এক নারী মুর্তি। আরমান সতর্ক হলো। তীক্ষ্ণ চোখে চাইলো সেই দিকে। হ্যাঁ একটা মেয়ে, এলোমেলো পায়ে ঝড় বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে, এগিয়ে যাচ্ছে সামনে দিকে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় তা দেখতো পেলো আরমান। মনে হল, মেয়টির পরনে ওর দেওয়া সেই সবুজ শাড়ী। আরমানের শুষ্ক হৃদয় যেনো পানি পেলো। মুখে ফুটে উঠলো এক চিলতে হাসি। ওর পিচ্চি মায়াবতীকে ফিরে পাওয়ার আশায়।

কিন্তু আরমানের মুখের সেই হাসি বেশিক্ষন স্থায়ী হলো না। হঠাৎই এক বিকট আওয়াজে বজ্রপাত পড়লো আরমানের গাড়ির কিছুটা সামনে একটা গাছের উপর। সাথে সাথে গাছটি দুই ভাগ হয়ে পড়ে গেলো রাস্তার উপর। আরমান খুব জোড়ে ব্রেক কষে, গাড়ি থামিয়ে দিলো। পুরো রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। হঠাৎ যেনো ওর আর মায়ার মাঝে, এই বিশাল বড়ো গাছটা দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। আর এই দেওয়াল এর জন্যই ওর মায়াকে দেখতে পাচ্ছে না আর। প্রকৃতিও যেনো চাইছে না আরমান আর মায়া এক হোক। এই প্রকৃতিকেও আরমানের নিজের শত্রু মনে হচ্ছে এখন। আরমান তাড়াহুড়ো করে নেমে পড়লো গাড়ি থেকে। সাথে সাথে বৃষ্টির ফোঁটা গুলো ভিজাতে শুরু করলো আরমানের শরীর টাকে।

আরমান এসবের উপেক্ষা করে, গাছের ডাল পালা আর পাতার ফাঁক ফোকর দিয়ে বেরিয়ে গেলো প্রকৃতির সৃষ্টি করা দেওয়াল মধ্যে দিয়ে। এরপরই সামনের দৃশ্য দেখে আরমানের হৃদয় কেঁপে উঠলো। ঠান্ডা হয়ে গেলো বুকের ভিতর টা। এই বৃষ্টির মধ্যেও আরমান দেখতে পেলো, একটা বিশাল বড়ো লরি এগিয়ে আসছে মায়ার দিকে। আর মায়া ঠিক রাস্তার মাঝখানে লরিটার সোজাসুজি দাঁড়িয়ে আছে, মাথা চেপে ধরে। মায়া যেনো এই দুনিয়াতে নেই।
এই দৃশ্য দেখে আরমানের মাথার ভিতর টা ফাঁকা হয়ে গেলো যেনো। চিৎকার করে উঠল ও—

“মায়াআআআআ!!!!”
না মায়ার কোনো হেলদোল নেই ও এক ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আরমান আর কিছু ভাবতে পারলো না, প্রাণ পনে ছুট লাগালো ও।
এদিকে লরিটাও তীব্র গতিতে ছুটে আসছে মায়ার দিকে। আরমান মুখে উচ্চারণ করতে করতে ছুটছে— “মায়া! প্লিজ সরো ওখান থেকে!! প্লিজ সরো। মায়াআআ!!”
নাহ! আরমানের এতো ডাক হয়তো মায়ার কানে গেলো না। মায়া তখনো এক ভাবে মাথা চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আরমানের এই ছোটার মাঝে বাতাসের গতি আর পায়ের নিচে পানি, কতোবার যে হোঁচট খেয়ে পড়লো তার হিসাব নেই। কিন্তু এই সবকিছুর উপেক্ষা করে আরমান আবারও দাঁড়িয়ে ছুটে চলেছে।

হ্যাঁ! সম্ভব হলো। লরি টির আগেই আরামান পৌঁছে গেলো মায়ার কাছে। দুই হাতে বুকে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো। কপালে দিলো ঠোঁটের পরশ। তারপর মায়াকে দুই হাতে জোড়ে ধাক্কা দিলো। মায়া ছিটকে পড়লো রাস্তা থেকে কিছুটা দুরে। আরমানের মুখে প্রাপ্তির হাসি।‌ ও পেরেছে মায়াকে বাঁচাতে। ওর পিচ্চি মায়াবতীকে বাঁচাতে পেরেছে। ঠিক তখনি সাথে সাথে দুম করে আওয়াজ হলো। আরমান তার পিচ্চি মায়াবতীকে রক্ষা করতে পারলেও নিজেকে রক্ষা করতে পারলো না। লরিটি এসে খুব জোড়ে ধাক্কা দিলো আরমানকে। আরমান ছিটকে গিয়ে পড়লো রাস্তার আরেক পাশে। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো লরিটা এতোকিছুর পরও থামলো না। তীব্র গতিতে বেরিয়ে গেলো লরিটি।

মায়া এই দৃশ্য আবছা চোখে দেখলো। মুখে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো, “গম্ভীর সাহেব”।
আরামানের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে পিচের রাস্তা টা। আরমানও রাস্তার ওপার থেকে নিভু নিভু চোখে দেখছে, তার পিচ্চি মায়াবতীকে। পুরো শরীর যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে, তবুও ঠোঁটের কোনে লেগে রয়েছে এক ফোঁটা হাসি। প্রতিটি বৃষ্টির ফোঁটা যেনো বৃষ্টির ফোঁটা নয়, একেক টা আকাশের বুকে চিড়ে বেরিয়ে আসা কাঁচের টুকরো। ঠিক এমনটাই অনুভব হচ্ছে আরমানের শরীরে।
আরমান বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় দেখলো মায়া তার একটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে আরমানের দিকে। আরমানের মনে সন্দেহের বাসা বাঁধলো, ওর মায়াবতী ঠিক আছে তো? এখনো এইভাবে পড়ে আছে কেনো? মায়ারও কি আঘাত লেগেছে কোথাও?

মায়ার চোখও নিভু নিভু করছে। আরমানের ধাক্কা দেওয়ার ফলে মায়ার মাথা বাড়ি খেয়েছে রাস্তার পাশে থাকা ছোটো পুলে। কপাল বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। আর সেই রক্ত মিশে যাচ্ছে বৃষ্টির পানিতে। মায়া স্পষ্ট দেখলো আরমানের লরির সাথে ধাক্কা খাওয়ার নির্মম দৃশ্য। মায়ার চোখের পানি বৃষ্টির পানির সাথে মিশে যাচ্ছে। ওর শরীরে এক ফোঁটাও শক্তি নেই উঠে দাঁড়ানোর। হঠাৎই পেটের ভিতর টা যেনো তীব্র যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয়, মায়া নিভু নিভু চোখে দেখতে পাচ্ছে রাস্তার ওপাশে পড়ে থাকা আরমান নিথর শরীর টা।
আরমান অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না, মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো পিচ ঢালা রাস্তায়। আরো কিছুটা আঘাত পেলো ও। বাঁ পা টা হয়তো ভেঙে গেছে। তীব্র যন্ত্রণায় চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো আরমান। রাস্তায় পড়ে থেকেই চেষ্টা করলো মায়াকে দেখার। শরীরে এক ফোঁটাও শক্তি নেই ওর। পুরো শরীরে আঘাতে ভর্তি। রাস্তায় পড়ে থেকেই শরীর টাকে কোনো রকমে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো এপার থেকে ওপারে। কিন্তু কষ্ট হচ্ছে খুব। অল্প চেষ্টাতেই হাঁপিয়ে উঠছে। পুরো শরীর ব্যাথায় বিষিয়ে উঠছে। আকাশ থেকে পড়া বৃষ্টির ফোঁটা গুলো, আঘাত পাওয়া স্থানে লাগতেই চিড়বিড় করে জ্বলে উঠছে।

নাহ! ওকে হার মানলে হবে না। কষ্ট হলেও যেতে হবে ওকে ওর মায়াবতীর কাছে। ওর মায়াবতী ঠিক আছে কিনা ওকে দেখতে হবে। ওর মায়াবতী যে এখনো ওর দিকে হাত বাড়িয়ে আছে। ওর মায়াবতীও হয়তো কষ্ট পাচ্ছে। ওকে পৌঁছাতেই হবে মায়াবতীর কাছে।
আরমান নিজের শরীরের কষ্টকে উপেক্ষা করে, নিজের শরীর টাকে রাস্তায় পড়ে থাকা অবস্থাতেই টেনে টেনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে শরীরটা রাস্তায় ঘেঁষোর লেগে আঘাত পাওয়া জায়গাগুলো তে আরো আঘাত পাচ্ছে। দ্বিগুন হারে বাড়ছে কষ্ট।

এদিকে মায়াও আরমানকে এভাবে এগিয়ে আসতে দেখে নিজেও নিজের শরীর টাকে টেনে টেনে নিয়ে আসছে রাস্তা আঁকড়ে ধরে। কেনো জানি ওর শরীরেও এক ফোঁটা শক্তি নেই উঠে দাঁড়ানোর। দুজনেই দুজনের দিকে হাত বাড়িয়ে আছে। অনেক কষ্টের পর একে অপরের হাত ধরতে পারলো। আরমান মায়ার হাতটা শক্ত করে ধরে একটা শান্তির নিশ্বাস ছেড়ে শরীরের ভর ছেড়ে দিলো। রাস্তায় পানিতেই মাথা নামিয়ে দিলো।

তারপর আবারও কি যেনো ভেবে মায়ার দিকে তাকালো। দেখলো মায়ার মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠলো ওর। আবারও নিজের শরীর টাকে টেনে নিয়ে গেলো মায়ার কাছাকাছি। মায়ার শরীর টাকে টেনে নিলো দুইহাত দিয়ে। জড়িয়ে ধরলো বুকের মাঝে শক্ত করে। চোখে মুখে অজস্র চুমু আঁকলো। মায়া নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে আছে আরমানের দিকে। আরমান চেয়েও যেনো মুখ দিয়ে আওয়াজ বের করতে পারছে না। তবুও কোনো রকমে মুখ থেকে বের করলো, “আ..আমি কি তো..তোমায় পেয়েও হা..হারালাম মায়াবতী? কেনো বু..বুঝলে না আমাকে একটু? আর একটু কেনো অপেক্ষা করলে না তু..তুমি?? আমাকে কি আর এ..একটা সুযোগ দেওয়া যে..যেতো না?? কথা বলতে ক..কষ্ট হচ্ছে খুব, মা.. মায়াবতী। অনেক কথা রয়ে গেলো..বলা হলো না তোমায়। শুধু একটাই রি.. রিকোয়েস্ট করছি তোমায়। শু.. শুধু একবার তোমার মুখ থেকে ‘গম্ভীর সাহেব’ ডাকটা শু..শুনতে চাই, একবার।”

মায়া ফিসফিস করে উচ্চারণ করলো অনেক কষ্টে, “গম্ভীর সাহেব।”
এতো কষ্টের মাঝেও আরমানের মুখে ফুটে উঠলো এক চিলতে হাসি। মায়াকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে।
“ভালোবাসি তোমাকে, আমার পিচ্চি মায়াবতী… অন্তরের গভীর থেকে ভালোবাসি। কত কথা জমে ছিল হৃদয়ে, বলা হয়নি… আর বলা হবে কি? আজ, যখন সবকিছু ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে… তখন তোমাকে জানাতে এসেছি—তোমার জন্যই ছিল আমার প্রতিটা নিঃশ্বাস, তুমি-ই ছিলে আমার গল্পের শুরু। তবে কি শেষটাও তোমার নামেই হবে? বলো মায়াবতী, আমাদের গল্পটা কি সত্যিই এখানেই শেষ?”

না কোনো উত্তর এলো না মায়ার তরফ থেকে। কিভাবে আসবে? মায়া যে আরমানের বুকেই জ্ঞান হারিয়েছে। আরমানও পারলো না আর চোখ খুলে রাখতে। ধীরে ধীরে সে ও চোখ বন্ধ করলো, প্রেয়সীকে বুকে নিয়ে। বিকট আওয়াজে বজ্রপাত হলো কাছে কোথাও। বৃষ্টির বেগ বাড়তেই থাকলো। আর এই বৃষ্টির পানিতেই রাস্তায় পড়ে থাকলো দুটো জ্ঞানহীন নিথর দেহ।

শাহরিয়ার পরিবার টা যেনো একেবারে ভেঙে পড়ছে। আর ভাঙ্গবেই নাই বা কেনো। বাড়ির প্রধান খুঁটিটাই যে নড়ে উঠেছে। হাসপাতালের উপর নীচ দুই ওটিতে চিকিৎসা চলছে মায়া আর আরমানের। মায়া আছে নিচের তলায়, আর ঠিক তার উপর তলার ওটিতে আছে আরমান। মায়ার বাঁচার গ্যারান্টি দিতে পারলেও আরমানের বাঁচার চান্স ১০০% এর মধ্যে ১০%। অনেক টা দেরি করে ফেলেছে পেসেন্ট কে হাসপাতালে আনতে, যার ফলে অনেক টা রক্ত বেরিয়ে গেছে শরীর থেকে। অনেক আঘাত পেয়েছে আরমান।

আর মায়া? মায়ার শরীরে নাকি এক ভয়ঙ্কর ড্রাগস পাওয়া গেছে। আরো অবাক করা বিষয় হলো মায়া নাকি প্রেগন্যান্ট ছিল, কিন্তু ড্রাগস এর প্রভাবে মিসক্যারেজ হয়েছে। এই খবর এক মাত্র আবির আর ছোটো আম্মু ছাড়া কেউ জানে না। এক মাত্র এই দুজনই মায়ার ওটির সামনে বসে আছে। আবির ছোট আম্মু কে বারণ করেছে এখন বাকি সবাইকে এই বিষয়টা জানাতে। ওরাও ভীষণ রকমের অবাক হয়েছে। কিন্তু এখন কোনো কিছু ভাবার পরিস্থিতি নেই।

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৩৮

ওরাও একবার করে ঘুরে আসছে উপর তলা থেকে। বাকিরাও একবার করে এসে খোঁজ নিচ্ছে মায়ার, বাকিরা বলতে সামিরা, আরমানের বাবা, চাচা, আয়ান এরাই। বাড়ির সবাই ভীষণ ভাবে ভেঙে পড়েছে। আরমানের মা তো বারে বারে সেন্সলেস হয়ে যাচ্ছে, ছেলের এমন অবস্থা দেখে।

আমার নিষ্ঠুর ভালবাসা পর্ব ৪০