আমার ভাঙা ক্যানভাসে গল্পের লিংক || তানজিলা খাতুন তানু

আমার ভাঙা ক্যানভাসে পর্ব ১
তানজিলা খাতুন তানু

“তুই আমার ফ্রেন্ড, ফ্রেন্ডের মতোই থাক আমি কার সাথে প্রেম করবো, কাকে ভালোবাসব সবটাই আমার পার্সোনাল বিষয়। এইসব বিষয়ে তুই একদম নাক গলাস না।” (তীক্ষ্ণ স্বরে)
– ‘জয় তুই একবার আমার পুরো কথাটা শোন।’
– ‘এইসব বিষয়ে কিছু বললে আমি ভুলে যাবো তুই আমার বেস্টফ্রেন্ড।’ (ক্ষিপ্ত হয়ে)
রুহির চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। জয়ের এই পরির্বতন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। যে ছেলেটা রুহিকে ছাড়া কিছুই বুঝত না, আজকে সেই রুহিকে এতটা কঠিন স্বরে নয় দিচ্ছে। সত্যি মানুষ কতটা বদলে যায়! রুহি নিজের চোখের পানিটা মুছে নিয়ে বলল,

– ‘ঠিক আছে তোর যেটা ইচ্ছা সেটাই করিস। তবে মনে রাখিস এই দিনটার জন্য তুই একদিন অনেক আফসোস করবি।’
রুহি কাঁদতে কাঁদতে চলে যায়। জয়ের জন্য নিজের মনে একটু একটু করে ভালোবাসার বীজ বপন করছিল, কত কত আশা বুনেছিল আর আজকে সেই জয় নিজের প্রেমিকার জন্য এতবছরের বন্ধুত্বকে শেষ করে দিতে দুইবার ভাবল না।
রুহিকে আঘাত দিয়ে জয় নিজেও সুখে নেই, কিন্তু কিছু কিছু সময়ে আমরা সঠিকটা দেখেও দেখতে পাইনা। ঠিক ভুল কিছুই বুঝতে পারিনা, মনে হয় যেটা করছি সেটাই ঠিক। রুহি দরজা বন্ধ করে কাঁদতে থাকে, চোখের সামনে ভেসে উঠে পুরানো দিনগুলো। ইশ কতই না সুন্দর ছিল সবগুলো অথচ আজকে!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সেইদিনের পর বদলে যায় সমস্ত সম্পর্কের সমীকরন।‌ রুহি আর জয়ের বন্ধুত্বের ইতি ঘটে, রুহি পড়াশোনা করার জন্য মামার বাড়িতে চলে যায় তারপর আর দূজনের কোনোপ্রকার যোগাযোগ হয়নি।

রুহি অনেকগুলো বছর পর নিজের বাড়িতে ফিরছে। যদিও বা আসার কোনো উদ্দেশ্যে ছিল না, কিন্তু হঠাৎ করেই দাদু অসুস্থ হয়ে পড়াতে ফিরতে হচ্ছে। গাড়িটা বাড়ির সামনে দাঁড়াতেই পরিবারের মানুষদের ভীড় লেগে গেল, রুহিদের অনেক বড়ো‌ পরিবার যদিও বা সকলেই আলাদা। কিন্তু যেকোন অনুষ্ঠান কিংবা বিপদে গোটা পরিবার একসাথে হয়ে পড়ে। যেমনটা ঠিক আজকে হয়েছে।

রুহিকে জড়িয়ে ধরে ওর মা কান্না শুরু করলেন। সেই যে মেয়েটা গেল আর ফিরল না, শত চেষ্টা করেও বাড়ি ফেরাতে পারেননি। অবশেষে দাদুর অসুস্থতার কারণে বাড়ি ফিরল। কখনো কখনো অসুস্থতাও কিছু সুখ বহন করে আনে, যেটা আজকে রুহির পরিবারের সাথে হয়েছে।
মাকে এইভাবে কাঁদতে দেখে রুহি বলল,

– ‘মা দ্যাখো আমি ফিরে এসেছি। প্রমিস আর কোথাও যাবো না।’
– ‘সত্যি।’
– ‘হুমম।’
রুহি হাসি মুখে পরিবারের সকলের সাথে কুশল বিনিময় করল। এতগুলো দিন রুহিকে পেয়ে সকলে প্রচন্ড খুশি বিশেষ করে বাড়ির ছোট সদস্যরা। তাদের তো আনন্দে মাটিতে পা পড়ছে না, যদি পারে রুহিকে কোলে তুলে নাচানাচি করে।
রুহির কাকাতো বোন তুলি বলল,

– ‘রুহিপু তুমি এসেছ, আমরা কিন্তু অনেক মজা করব আর তোমাকে যেতে দেব না।’
– ‘আচ্ছা পিচ্চি। এখন তো ঘরে যেতে দে।’
– ‘চলো।’
বাড়িটা নিমিষেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল। মনেই হচ্ছে না এটা তো অসুস্থতার বাড়ি। রুহির উপস্থিত সকলকে প্রান ফিরিয়ে দিয়েছে। রুহি ফ্রেশ হয়ে এসে দাদুর ঘরে গেল। অনেকটা বয়স হবার কারনে দিনকে দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, শরীরের আনাচে কানাচেও বেঁধেছে নানান রোগ।

– ‘দাদু কেমন আছো।’
– ‘রুহি দিদিভাই তুই এসেছিস।’
– ‘হুমম। এখন কেমন আছো বলো।’
– ‘আছি ওইরকম। তাই এতদিনে এই বুড়োর কথা মনে পড়ল।’
– ‘তোমাকে তো আমার সবসময়েই মনে পড়ে। তুমি তো আমার ইয়াং ম্যান।’
দাদু হেসে বলল,

– ‘দিদিভাই তোমার দাদু আর ইয়াং ম্যান নেই, এইবার যে চলে যাবার সময় ঘনিয়ে আসছে।’
– ‘দাদু খবরদার এইসব কথা বলবে না।’
– ‘না বললেও কি সত্যিটা বদলে যাবে। তুই যে সেই চলে গেলি আর এলি না, মাঝে কতগুলো বছর কেটে গেছে। তোকে দেখার বড্ড সাধ জাগছিল,সেটা পূর্ণ হলো এইবার নিশ্চিতে মরতে পারব।’
– ‘দাদু এইটা কিন্তু ঠিক নয়। আমি তোমার কারনে ফিরলাম আর তুমি!’
রুহি বাচ্চাদের মতো গাল ফোলালো, দাদু নাতনীর কান্ড দেখে ফিক করে হেসে বললেন,
– ‘এত বড়ো হয়েছিস তবুও বাচ্চামো গুলো গেল না।’
– ‘আমি তো তোমাদের কাছে এখনো বাচ্চাই।’
– ‘পাগলি আমার।

জয় অফিস থেকে ফেরার পথে রুহিদের বাড়িতে শোরগোল শুনতে পেল। যেটা বেশ কয়েকবছর পরে শুনতে পেয়েছে, আগে রুহি দেশে থাকাকালীন সময়ে বাড়িটা সবসময়েই হাসি ঠাট্টাতে মেতে থাকত কিন্তু রুহি চলে যাবার পর বাড়িটা কিরকম একটা নিস্প্রা’ন হয়ে গেছে। পরিবারটাও ভেঙে গেছে, কর্মসূত্রে সকলেই আলাদা থাকতে শুরু করেছে। বর্তমানে রুহির বাবা মা আর ওর ছোট কাকুর পরিবার আর দাদু ছাড়া এই বাড়িতে কেউই থাকে না।

কয়েকদিন যাবত দাদুর শরীর খারাপ হওয়াতে পরিবারের সকলে একসাথে হয়েছে ঠিকই কিন্তু এতটা শোরগোল তো আগে শোনা যায়নি। আসল ঘটনা কি?
জয় আর রুহি প্রতিবেশী। ছোট থেকে একসাথে বড়ো হয়েছে, ওদের পরিবারের সমস্ত কিছুই জয়ের জানা। ওই বাড়িতে অবাধ যাতায়াত ছিল ওর কিন্তু রুহি চলে যাবার পর যাতায়াত কমিয়ে দেয়। আর এখন অফিস সেরে যাওয়াই হয়ে উঠে না।
জয় বাড়ি ফিরতেই ওর মা একগ্লাস পানি ধরিয়ে দিয়ে গজগজ করতে লাগলেন।

– ‘কতবার বলেছি একটা বিয়ে কর, বিয়ে কর। আমি আর কতদিক একা সামলাব বল তো‌!’
জয় মায়ের কথাকে পাত্তা না দিয়ে বলল,
– ‘মা আসার পথে দেখলাম রুহিদের বাড়ি থেকে শোরগোল আসছে, কিছু হয়েছে নাকি?’
– ‘আরে রুহি এসেছে তো। কেন তুই জানিস না?’
জয় থমকে গেল। রুহি বাড়ি ছাড়ার পর ওর সাথে কোনোরকমের যোগাযোগ রাখেনি, জয় অনেকবার চেষ্টা করেছিল কিন্তু ব্যর্থ হয় শেষে গিয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছিল।

– ‘কখন আসলো?’
– ‘সে বেলার দিকে এসেছে। জানিস রুহিকে দেখলাম কত বড়ো হয়ে গেছে, আর আগের থেকে অনেক সুন্দরী হয়ে গেছে।’
জয়ের মা রুহির গুনগান করতে বসলেন। জয় নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারল না। রুহিকে একপলক দেখার জন্য মনটা আকুল হয়ে উঠেছে, কিন্তু রুহি কি ওর সাথে দেখা বা কথা বলবে?

কি হবে রুহি আর জয়ের জীবনে? এই মাঝের চারবছরেই বা জয়ের সাথে ঠিক কি হয়েছে?

আমার ভাঙা ক্যানভাসে পর্ব ২