বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৪
জাওয়াদ জামী

তাহমিদের মনে সারাটা পথ সেই শ্যামাকন্যার মুখটাই থেকে থেকে উঁকি দিয়েছে। বাসায় এসেও সেই একই অবস্থা। ও কিছুতেই মেয়েটাকে ভুলতে পারছেনা।
ওর কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে। অনেকবার পানি পান করা স্বত্বেও ওর পিপাসা পাচ্ছে। যেন বুকটা কিছুতেই ভিজছেনা। শুকিয়ে কাঠকাঠ হয়ে আছে। কোন পানিতে এ তৃষ্ণা মিটবে, তার সন্ধান এখনও পায়নি তাহমিদ।
মাঝরাত, চারপাশে সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন।

শুধু ঘুম নেই তাহমিদের চোখে। ওর মস্তিষ্কে চিন্তার ঝড় বইছে। কিভাবে সেই শ্যামাকন্যার দেখা পাওয়া যায়? একবার ভাবে শনিবারই যাবে মির্জাপুর। কিন্তু পরক্ষণেই সেই চিন্তা বাতিল করে দেয়। যে মেয়ে শুক্রবার ব্যাগ ভর্তি বাজার করে নিয়ে গেছে, সেই মেয়ে নিশ্চয়ই শনিবার আবার বাজার করতে আসবেনা। অনেক ভেবেচিন্তে তাহমিদ সিদ্ধান্ত নেয়, আগামী শুক্রবার সে মির্জাপুর যাবে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সেই কাঁচা বাজারের কোন একটা স্থানে, মেয়েটার জন্য অপেক্ষা করবে। আর একবার তাকে দেখতে পেলেই তার নাম, ঠিকানা সব জেনে নিবে। যদিওবা কাজটা কঠিন, তবে নিজের মানসিক শান্তির জন্য একটুকু কষ্ট করাই যায়।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ফজরের আজান শুনে তাহমিদের হুঁশ হয়। সে সারাটা রাত জেগে আছে! মাথাটা বড্ড ধরেছে। বিছানায় পিঠ ঠেকাতেই ইচ্ছে করছেনা। এই মুহুর্তে ওর শুদ্ধ বায়ুর ভিষণ প্রয়োজন। নিরেট বায়ু। যে বায়ুতে কোন ধুলি কনা নেই, নেই রোদের আঁচ কিংবা যে বায়ুতে মিশে নেই হাজারো কোলাহল।
দরজা খুলে বেরিয়ে আসে তাহমিদ। ওর গন্তব্য ছাদ।
অনেকদিন পর ছাদে এসে মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে যায়। ভোরের ভেজা ভেজা মৃদুমন্দ বাতাস বেশ লাগছে। বাতাসের প্রতিটি শীতল স্পর্শে
শরীরের শিরা-উপশিরা আন্দোলিত হচ্ছে।

আজ এই ক্ষণে সেই শ্যামলাবরণ কন্যে থাকলে মন্দ হতনা। শীতল হাওয়ার স্পর্শে তাহমিদের শরীর অবসন্ন হয়ে আসে। ও ছাদের এককোনায় থাকা ট্যাপ থেকে অজু করে দক্ষিণ দিকে থাকা ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে নামাজ করে। এরপর সেখানেই সটান হয়ে শুয়ে পরে। ঝিরিঝিরি শীতল হাওয়া তখনও তার স্পর্শ দিয়ে যায় তাহমিদের শরীরে। কখন যে ওর চোখ লেগে যায় বুঝতেই পারলনা।
কুহু ফজরের নামাজ আদায় করে রান্নাঘরে এসে খাবার তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে যায়। একটু পর দৃষ্টিও সেখানে এসে হাজির হয়। সেই ছোটবেলা থেকেই প্রতিদিন ভোরে কুহুকে জাগতে দেখেই দৃষ্টিরও ঘুম ভেঙে যায়। ভোরে ঘুম থেকে জাগা ওর জন্য ডাল-ভাত।

” আপু, কি রান্না করবে আজ? আমি তোমাকে সাহায্য করব আজ। বল কি করতে হবে? ”
” তোর কিছুই করতে হবেনা। তুই গিয়ে পড়তে বস। পড়া ফাঁকি দিয়ে আসছে কাজ করতে। ”
” আমি কোথাও যাচ্ছিনা। প্রতিদিন সকালে চেটেপুটে খেয়ে, হেলেদুলে স্কুলে যাই। এটাই আমার প্রাত্যহিক রুটিন। আর তুমি সব কাজ সেরেই তবে অফিসে যাও। সংসারের কর্ত্রী হিসেবে যেই কাজ আমার আম্মুর করতে হত, সেই কাজ করছ তুমি। আম্মু চোখ বন্ধ করে থাকলেও আমি থাকতে পারিনা। তাই আমি এই মুহুর্তে কোথাও যাচ্ছিনা। কি করতে হবে বল। ”

কুহু বুঝতে পারছে দৃষ্টি আজ আর রান্নাঘর থেকে নড়বেনা। তাই ও বাধ্য হয়ে দৃষ্টিকে রুটি বানাতে বলে, নিজে ভাজার জন্য আলু কাটতে থাকে। আজ সকালে রুটি আর আলু ভাজি। দুপুরের জন্য ডাঁটা দিয়ে তেলাপিয়া মাছের ঝোল করবে সে।
রান্না, খাওয়া শেষ করে তৈরি হয়ে, বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অফিসে উদ্দেশ্যে রওনা দেয় কুহু।
গলির শেষ মাথায় তাকাতেই ওর আত্না শুকিয়ে গেছে। কাউন্সিলরের ছেলে সবুজ কুতকুতে চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। তার ঠোঁটে অশ্লীল আহ্বান।

কুহু মাথা নিচু করে কোনরকমে গলির পথটুকু পাড়ি দিতে থাকে।
অতি সন্তর্পনে সবুজকে পাশ কাটাতে গেলেই, সবুজ ওর হাত ধরে ফেলে। ভয়ে কুহুর অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়। ও আঁড়চোখে এদিকওদিক তাকিয়ে দেখে। কিন্তু আশেপাশে কাউকে দেখেনা। মনে মনে আল্লাহকে ডাকছে কুহু।
” এই যে শ্যামাসুন্দরী, এত সকালে কোথায় যাও? অফিসে যাচ্ছ বুঝি? তা শ্যামাসুন্দরী প্রতিদিন যে এভাবে এত রাস্তা হেঁটে অফিস কর, তোমার বুঝি পায়ে খুব ব্যথা করে? তুমি চাইলে প্রতিদিন রাতে আমাকে ডাকতে পার। আমি তোমার হাত-পা, পুরো শরীর ম্যাসেজ করে দিব। তোমার খুব ভালো লাগবে। ”

সবুজের কথা শুনে ঘৃণায় কুহুর মুখের ভেতরটা তেঁতো হয়ে যায়। একটা মানুষ কতটা জঘন্য হলে এভাবে বলতে পারে! কুহুর খুব ইচ্ছে করছে জা’নো’য়া’র’টা’কে কঠিন কিছু কথা শোনাতে। কিন্তু আশেপাশে পরিচিত কাউকে না দেখে আপাতত সেই ইচ্ছে প্রশমিত হয়। হুট করেই ও হ্যাঁচকা টানে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয় সবুজের থেকে। এরপর এক দৌড়ে বেরিয়ে যায় গলি থেকে। সামনে একটা অটো আসতে দেখে তাতে উঠে বসে। আজকে ও হাঁটার মত অবস্থায় নেই।
অন্যদিকে সবুজ কুহুর এমন কাজে একটু অবাকই হয়। মেয়েটাকে যতটা বোকা ও ভেবেছিল, ততটা বোকা সে নয়। নিজের খসখসে দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বিশ্রী ভঙ্গিতে হেঁসে উঠে সবুজ।

” কই যাবে, সুন্দরী! তুমি দুনিয়ায় থাকলেও আমার, আবার পাতালে গেলেও আমারই থাকবে। প্রতি রাত জেগে জেগে তোমাকে নিয়ে কত মধুর স্বপ্ন দেখছি আমি। আমার সেই স্বপ্নটাকে সত্যি করতে তোমাকেই আমার লাগবে। ”
সকালে কাজের মেয়ে মনি ছাদে এসে তাহমিদকে শুয়ে থাকতে দেখে হুড়মুড়িয়ে নিচে যেয়ে সবাইকে খবর দেয়। মনির কথা শুনে সবাই হতবাক হয়ে গেছে। যে ছেলে বছরের একদিনও ছাদে যায়না, সেই ছেলে হঠাৎই ছাদে ঘুমাচ্ছে! তাহমিনা আক্তার ভিষন চিন্তায় পরে যান। কারও দিকে না তাকিয়ে তিনি দ্রুত পায়ে ছাদে আসেন।

ছাদে এসেই ছাউনির নিচে তাহমিদকে শুয়ে থাকতে দেখে কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেন।
ততক্ষণে আফরোজা নাজনীন আর সিক্তা, সুপ্তিও ছাদে এসেছে। ওরাও এভাবে তাহমিদকে দেখে অভ্যস্ত নয়।
সবাই তাহমিদের পাশে দাঁড়িয়ে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।
হঠাৎই সিক্তা হাঁটু গেড়ে বসে তাহমিদের পাশে। আলতো করে হাত রাখে ভাইয়ের কপালে।
বরাবরই তাহমিদের ঘুম পাতলা। কপালে কারও স্পর্শ পেয়েই চোখ মেলে তাকায়।

ওর চারপাশে বাসার সবাইকে উদ্ভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়। বোঝার চেষ্টা করে কোথায় আছে। কয়েক সেকেন্ড পরেই যখন মনে পরে ভোরে ছাদেই শুয়েছিল, তখন স্বাভাবিক হয়। হাঁই তুলে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে।
” মা, বড়মা, তোমরা সবাই এখানে কেন? কিছু হয়েছে? ”
” সেই কথা তোকে জিজ্ঞেস করব আমরা। তুই এই সময় ছাদে কি করছিস? মেঝেতে এভাবে শুয়ে ছিলি কেন? তোর শরীর ঠিক আছে, বাবু? ” তাহমিনা আক্তারের গলায় উদ্বেগ ঢেউ খেলে যায়। তিনিও ছেলের কাছে বসে, ছেলের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়েছেন।

” বাপ, তোর কি হয়েছে? তুই কখনও, কোনদিন এভাবে ছাদে থাকবি এটা সবার চিন্তার বাইরে। হঠাৎ তুই এমন করলি কেন? ” আফরোজা নাজনীনও বসেছেন তাহমিনার পাশে।
” আমার কিছুই হয়নি, বড়মা। অনেকদিন থেকেই ছাদে আসা হয়না, তাই আজ খুব ভোরেই ছাদে এসেছিলাম। এখানেই ফজরের নামাজ আদায় করেছি। চোখটা একটু লেগে গিয়েছিল, তাই শুয়েছিলাম। ” তাহমিদ ইচ্ছে করই ঘুম না বিষয়ে বলেনা। সে অযথা সবাইকে চিন্তায় ফেলতে চায়না।
সেদিন মেডিকেলে যাবার পর তাহমিদ জানতে পারল আগামীকাল রাতে ওকে একটা সেমিনারের জন্য সিঙ্গাপুর যেতে হবে। পুরো একটা মেডিকেল টিম থাকবে, সেই টিমের প্রধান তাহমিদ। ওদের আগামী একমাস সিঙ্গাপুর কাটাতে হবে। সেমিনার শেষে মেডিকেল ক্যাম্প হবে সেখানে।

সংবাদটা শুনেই মন খারাপ হয়ে গেছে তাহমিদের। অথচ ওরই সবচেয়ে বেশি খুশি হওয়ার কথা ছিল। এই সেমিনার সব সময়ই ওর কাছে বহু আকাঙ্খিত ছিল। কিন্তু আজ এই সুখবর ওকে মোটেও আন্দোলিত করলনা। ও ভেবেছিল, আগামী শুক্রবার আবার মির্জাপুর যাবে। কিন্তু তা আর হলোনা৷

বিরস বদনে সন্ধ্যায় বাসায় এসে গোছগাছ শুরু করে তাহমিদ। ওর বিরস বদন দেখে মা, বড়মা জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে? তাহমিদ তাদের সেমিনারের কথা জানাল। আফরোজা নাজনীন আর তাহমিনা আক্তার খবরটা শুনে ভিষণ খুশি হন।
বিষন্ন মনে পরদিন সন্ধ্যায় সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় তাহমিদ। ও শুধু শরীরটাকেই সিঙ্গাপুর নিয়ে যাচ্ছে। ওর মনটা পরে রয়েছে, সেই শ্যামলাবরণ সাধারণ চেহারার মেয়েটার কাছে।
তাহমিদ যাবার একদিন পর হঠাৎই সানাউল রাশেদিন আফরোজা নাজনীনের বোনদের নিজ বাসায় জরুরি ভিত্তিতে ডেকে পাঠালেন। তারাও সানাউল রাশেদিনের তলব পেয়ে দেরি করেননি। পরদিনই চলে এসেছেন। যদিও আফরোজা নাজনীনের ছোট বোন শাহনাজ সুলতানা ঢাকাতেই থাকেন। কিন্তু আফরোজা নাজনীনের মেজ বোন নাজমা পারভিন চিটাগং থাকেন। তারা দুই বোন আলোচনা করে পরদিনই একসাথে এসেছেন।

সকাল দশটার মধ্যেই দুই বোন আফরোজা নাজনীনের বাসায় প্রবেশ করলেন।
দুই বোনকে অসময়ে নিজের বাড়িতে দেখে চমকালেন আফরোজা নাজনীন। তিনি জানতেননা আজ তার বোনেরা আসবে।
সানাউল রাশেদিন আজ বাসায়ই আছেন। তিনি নিজেও তার স্ত্রীকে জানাননি আজ তার দুই শালিকা আসবে। আবার শালিকাদেরও তাদের বড় বোনকে বলতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন।

আফরোজা নাজনীন অনেকবার জিজ্ঞেস করেও স্বামীর মুখ থেকে কোন কথা বের করতে পারেননি।
প্রায় ঘন্টা খানেক পর তাড়া লাগালেন সানাউল রাশেদিন। তিনি তার স্ত্রীকে তৈরি হতে বলছেন।
কোথায় যেতে হবে, জিজ্ঞেস করলেন আফরোজা নাজনীন। কিন্তু সানাউল রাশেদিন নিরুত্তর রইলেন।
আফরোজা নাজনীন দুই বোনকে সাথে নিয়ে অন্ধের ন্যায় অজানা কোন স্থানের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।
গাড়িতে ওঠার আগে শুধু সানাউল রাশেদিন স্ত্রীকে বলে দিলেন, কোনও একটা বাড়িতে তাদের যেতে হবে। তিনি বললেন, ড্রাইভারকে সব বুঝিয়ে দিয়েছেন।

নির্দিষ্ট সময়ে আফরোজা নাজনীন পৌছলেন তাদের গন্তব্যে। মেইন রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে ড্রাইভার তাদেরকে নিয়ে ঢুকলেন একটা লম্বা গলিতে। গলি পেরিয়ে আবার একটা সাইড রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে পাঁচ মিনিট হাঁটতেই একটা পাঁচিলে ঘেরা বাড়ি দৃশ্যমান হল। বহুদিনের পাঁচিলের ইটের গায়ে শ্যাওলা ধরেছে। অশীতিপর বৃদ্ধের ন্যায় কোনরকম দাঁড়িয়ে আছে। পাঁচিলের ভেতরে টিনশেড বাড়ি। সেই বাড়িও কালের বিবর্তনে নিজস্ব রং হারিয়েছে। কত কালের রোদ,বৃষ্টি, ঝড়, বাদল যেন বাড়িটার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। ড্রাইভার জানায়, তাদের এই বাড়িতেই যেতে হবে।

আফরোজা নাজনীন ইতস্ততভাবে টিনের দরজায় কড়া নাড়েন। কিছুক্ষণ পর কারও পায়ের আওয়াজ শোনা যায়। একটা ফর্সা মহিলা দরজা খুলে দাঁড়ায়। মহিলাটি এককালে যে সুন্দরী ছিল তা তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তার পরনে মলিন কাপড়। চেহারায়ও দারিদ্র্যের ছাপ।
” কারে চান আপনারা? আপনাগো তো আগে কুনদিন দেখিনাই। ” মহিলাটি সামনে দাঁড়ানো তিন অভিজাত রমনীকে দেখে ভরকে গেছে।
আফরোজা নাজনীন কি জবাব দেবেন ভেবে পাননা।

” আমাদের একটু পানি খাওয়াতে পারবেন? এই রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলাম। হঠাৎই পিপাসা পেয়ে গেল। ” বড় বোনকে ইতস্তত করতে দেখে ঝটপট করে বললেন নাজমা পারভিন।
মহিলাটি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সে হয়ত ভাবছে, এত অভিজাত মানুষদের কাছে খাওয়ার মত পানি নেই! এদের কি কোন বদ মতলব আছে?

বেশ কিছুক্ষণ চিল চক্ষু নিয়ে তিনজনকে পরখ করে দরজা থেকে সরে দাঁড়ায় শিউলি। ভেতরে ঢুকতে দেয় তিনজনকে।
তিন বোন ভেতরে ঢুকলে দরজা লাগিয়ে বাড়ির মুল দরজার সামনে এসে তাদের ভেতরে আসতে বলে।
আফরোজা নাজনীন বোনদের নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে।
শিউলি তাদের নিয়ে আসে রান্নাঘরের সামনে ফাঁকা জায়গায়। এরপর তিনটা আধ পুরোনো চেয়ার এনে তাদের বসতে দেয়।

আফরোজা নাজনীন একটু হেসে বসলেন। এরপর ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশ দেখতে থাকেন।
তিনি ভেবে পাচ্ছেননা, তার স্বামী তাদের কেন এখানে আসতে বললেন!
” আপনারা কয়জন থাকেন এখানে? ” প্রথমবার মুখ খোলেন আফরোজা নাজনীন।
” আমরা পাঁচজন থাকি। ” শিউলির চোখেমুখে সন্দেহ।
এরপর শিউলি রান্নাঘরে ঢুকে জগে করে পানি আর তিনটা গ্লাস নিয়ে আসে।
কায়েস ঘরে শুয়ে ছিল। আজকাল তার শরীর ভালো যাচ্ছেনা। মেয়েটা তার সাধ্যমত চিকিৎসা করছে। তবু্ও দিনদিন বুকের ব্যথা বেড়েই চলেছে।

বাইরে কারও কথার আওয়াজ পেয়ে বিছানা থেকে নেমে আসে কায়েস। এই সময় আবার কে আসল! শিউলি যে মানুষ, কেউ আসলেই তার কাছে কুহুর নামে দুর্নাম করতে বসে যায়। কায়েস সেই ভয়েই তারাতারি বাইরে আসে। সে তার মেয়ের দুর্নাম শুনতে চায়না।
” কে এসেছে, শিউলি? কার সাথে কথা বলছে? ” ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলে কায়েস।
কায়েস সামনে বসা তিনজন মহিলার পেছন দিক দেখতে পাচ্ছে।
পেছন থেকে কারোর গলা শুনে ধক করে ওঠে আফরোজা নাজনীনের বুক। এ যে অতি পরিচিত কন্ঠস্বর!
নাজমা পারভিন আর শাহনাজ সুলতানার অবস্থাও তাই। পেছনের কন্ঠস্বর শুনে তাদেরও বুকে খিল ধরে।
একসাথে তিন বোন পেছনে তাকায়।

সাথে সাথে তাদের হৃদপিণ্ড কেঁপে ওঠে। এ কাকে দেখছে তারা!
কায়েসও এত বছর পর বোনদের দেখে থমকে গেছে।
আফরোজা নাজনীন দৌড়ে এসে ভাইকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। ততক্ষণে তার দুই বোনও উঠে এসেছে।

শিউলি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। বিয়ের এত বছর পরও সে কায়েসের কাছ থেকে তার বাড়ির খবর জানতে পারেনি। কিন্তু আজ এ কি দেখছ সে! তার ননদরা কত ধনী বাড়ির বউ, সে তাদের দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
এদিকে তারা তিন বোন শিউলিকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেছেন। শিউলি যদি কায়েসের বউ হয়, তবে আইরিন কোথায়! যার জন্য কায়েস একদি সবাইকে ছেড়েছিল।
নাজমা পারভিন আর চুপ থাকতে পারলেননা। তিনি আইরিনের কথা জিজ্ঞেস করেই ফেললেন।

” কায়েস, আইরিন কোথায়? তুই যে বলছিস এটা তোর বউ! কিন্তু তুই তো আইরিনকে বিয়ে করেছিলি? ”
” আইরিনকে আমি অনেক বছর আগেই হারিয়ে ফেলেছি, মেজ আপা। সে আঠারো বছর আগে আমার সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। যার জন্য এত আয়োজন করে সবাইকে ছেড়েছিলাম, সে-ই আমাকে ফাঁকি দিয়েছে। সেই সাথে কেড়ে নিয়ে গেছে আমার সকল সুখ। ” কায়েস কাঁদছে। আইরিনের কথা মনে হলেই সে কেঁদে বুক ভাসায়।
আফরোজা নাজনীন ফ্যালফেলিয়ে চেয়ে থাকেন ভাইয়ের দিকে। শাহনাজ সুলতানার চোখে পানি। আর নাজমা পারভীর কি বলবেন ভেবে পাননা।

এদিকে শিউলি আইরিনের নাম শোনা মাত্রই ফুঁসে ওঠে। সে কায়েসের মুখে আইরিনের নাম শুনতে পারেনা। সে মনে করে, কায়েসের সকল ভালোবাসা শুধুই আইরিনের জন্য। এত বছরেও সে কায়েসের ভালোবাসা পায়নি। যতটুকু পেয়েছে তা শিউলি জোর করে আদায় করেছে।
” সে কোথায়? তাকে দেখছিনা যে? ” কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন আফরোজা নাজনীন।
কথাটা কায়েসের বুঝতে একটু সময় লাগে। যখন বুঝল, তখন জবাব দিল,

” সে এই সংসারের হাল ধরেছে। আমার মা হয়ে সে এসেছে। আমি বাবা হয়ে যা করতে পারিনি, সে মেয়ে হয়ে তাই করছে। ”
আফরোজা নাজনীন বুঝে গেলেন, আইরিনের মেয়ে হয়েছিল। টুপ করে একফোঁটা পানি তাল গাল বেয়ে পরল।
” কি নাম তার? ”
” কুহু। ত্বাকওয়া হাসান কুহু।”
” সে বুঝি আমাদের কোকিল পাখি! ” চোখে পানি নিয়ে বললেন নাজমা পারভিন।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৩

বিঃদ্রঃ আপনারা অনেকেই ইনবক্সে অনুরোধ করেছেন প্রতিদিন গল্প দিতে। কিন্তু আমি সত্যিই নিরুপায়। প্রতিদিন লিখতে গেলে সংসারের কাজ সামলে ছেলের দিকে নজর দিতে পারিনা। আমি কাছে না বসলে ছেলে পড়তে চায়না। এছাড়াও আল্লাহর রহমতে আমার বাসায় মাসের দশ দিন মেহমান থাকে। তাই তাদের আপ্যায়ন করে লিখার সময় করে উঠতে পারিনা। এত অসুবিধার মাঝেও আপনারা আমাকে যে ভালোবাসা দিয়েছেন আপনাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আমার অফুরান ভালোবাসা রইল আপনাদের প্রতি।

বিন্দু থেকে বৃত্ত সিজন ২ পর্ব ৫