আমার মেয়ে পর্ব ৭ || Khadija Akter

আমার মেয়ে পর্ব ৭
Khadija Akter

আর পারলাম না,একসময় হাতটা ছুটে গেল। আর সাথে সাথেই একটা পুরুষালি হাত আমার ছুটে যাওয়া হাতটাকে তৎপরতা সাথে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে টেনে উপরে তুলে আনলো।আমি ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে তাকালাম।
রাশেল!রাশেল এই পথ দিয়েই দোকান থেকে বাড়িতে ফিরছিল দুপুরের ভাত খেতে।হঠাৎই আওয়াজ শুনতে পেয়ে এইদিকটায় এসে আমাকে এই অবস্থায় দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি ধরে উঠায়।
চোখ খুলতেই দেখলাম,রাশেল ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে।চোখে চোখ রেখেই গলার স্বর যথেষ্ট কঠিন করে বললো,

–সাবধানে চলাফেরা করতে পারো না?কে বলেছে এই ভরদুপুরে তোমাকে এখানে আসতে?গোসল করতে পুকুরেই আসতে হবে কেন?যদি কিছু একটা হয়ে যেত….!
কোথাও লেগেছে?ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে?
আমি এতোক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছি কিছুটা।তবে এখনো হাত-পা কাঁপছে অনেকটা।রাশেল দুইহাত দিয়ে শক্ত করে আমার বাহু ধরে রেখেছে।আমি ওর হাত ছাড়াতে চেষ্টা করতেই ও আরও শক্ত করে চাপ দিয়ে ধরলো।

–উফফ,ছাড়ো তো।
আর আমি ঠিক আছি এখন কিন্তু তুমি আরেকটু দেরী করে এলেই কি যে হতো……!
তবে আমার বা আমার বাচ্চার কিছু হলে তাতে তোমার কি?তুমি তো আরও খুশি।তুমি তো আমাকে ডিভোর্স দিয়ে নতুন বউ ঘরে আনার জন্য তৈরি।
–চুপ,একদম চুপ।
রাশেল আমাকে আচমকা কোলে তোলে বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলো।
–আরেহ্ আরে করছো কি!নামাও রাশেল,সবাই দেখবে তো।
রাশেলের মধ্যে কোনোরকম ভাবান্তর দেখা গেল না।
আমাকে কোলে নিয়েই ঢুকে গেল ভিতর বাড়িতে….

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আমার শাশুড়ী উঠানে দাঁড়িয়ে মুরগীকে খাবার দিচ্ছিলেন।কারো আসার শব্দে পিছন ফিরে তাকিয়েই রাশেলে কোলে আমাকে দেখে যেনো ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন।
তিনি হয়তো কল্পনাও করতে পারেননি উনার আর আমার সম্পর্কের এই টানাপোড়েন এর মাঝে উনার ছেলে উনারই সামনে আমার প্রতি এমন দরদ দেখাচ্ছে।
তবে মনের ভাব মুখে প্রকাশ করলেন না তিনি।কিছুটা চিন্তিত হওয়ার ভাণ করে প্রশ্ন করলেন,
–কিরে,ছোড বউমার কি হইছে?
–কি আর হবে,অসাবধান থাকলে যা হয় আর কি।পড়ে গেছিল পা পিছলে..!
রাশেল আমাকে ঘরে এনে শুইয়ে দিতেই আমি ওর হাতটা ধরে বললাম,
–রাশেল,আম্মা কিন্তু উঠানেই ছিল।আমি কত করে জোরে জোরে ডেকেছি কিন্তু একজনও আসলো না।আম্মার তো শোনার কথা ছিল…

–বলতে কি চাও তুমি,সোজা বললেই তো পারো?
তুমি বলতে চাইছো,তোমার ডাক শুনেও মা যায়নি তোমাকে ধরতে?এটাই বলতে চাও?
–ঠিক এরকম বুঝাতে চাইছি না রাশেল।কিন্তু…
–তো কিরকম?শুনো,আমার মা’র আর তোমার সম্পর্ক প্রথম থেকেই ভালো না তা আমি জানি।কিন্তু তাই বলে,যখন যা খুশি নিজের মনগড়া কথা বানায় বলতে হবে না।
তুমি যেমন বেকায়দায় পড়তে যাচ্ছিলে,ঐভাবে পড়লে তোমার বাচ্চা তো কি তোমার জীবনও রিস্কে পড়ে যেত।আর তুমি বলতে চাইছো মা সব দেখেও ইচ্ছে করেই তোমাকে বাঁচাতে আসেনি?
আমার মাকে ভালো না লাগলে তুমি দূরে থাকো,কিন্তু প্লিজ উল্টাপাল্টা বলে আমার কান ভারী করতে এসো না।এতে তোমার প্রতি আমার যে সম্মানবোধ আছে,ঐটাও চলে যাবে।

রাশেল দ্রুত পায়ে বের হয়ে গেল ঘর থেকে।
ধুর আমারই উচিত হয়নি এইসময় এই কথা বলা।একে তো ও মায়ের প্রতি অনেক দূর্বল আবার হচ্ছে মাত্রই বাহিরে থেকে এসেছে।
ধ্যাৎ দিলাম তো রাগিয়ে….।
রাশেল ভাত না খেয়েই চলে গেল আবার দোকানে।রাশেল চলে যেতেই বড় জা তড়িঘড়ি করে আমার ঘরে ঢুকলেন। এসে জিজ্ঞেস করলেন,
–কি হয়েছে?রাশেল গলা শুনলাম মনে হলো?না খেয়েই চলে গেল নাকি?
আমি বড় জা’কে খুলে বললাম সমস্ত ঘটনা।

বড় জা ও বললো,”কাজটা তুমি ঠিক করো নাই রাকা।আসতে না আসতেই নালিশ কইরা ফেলেছো।”
বড় জা আমার ঘর থেকে যাওয়ার আগে বেশ কয়েকবার করে জিজ্ঞেস করলেন,”আমি ঠিক আছি কিনা।”
উনার মুখে কেমন একটা অপরাধী অপরাধী ভাব দেখতে পেলাম আমি।কারণ বুঝলাম না কিছুই,কিন্তু নিশ্চিত করে দিলাম যে আল্লাহর রহমতে ঠিকই আছি।
রাশেল সাধারণত এতো দেরী করে না কখনো,কিন্তু আজ রাতে ফিরতে অনেক সময় লাগাচ্ছে কেন বুঝলাম না।আমি ভেবে রেখেছি,রাশেল আসলে যে করেই হোক ওর মনের ক্ষোভ দূর করবো।যা হওয়ার তো হইছেই,মনে যত রাগ থাকবে সম্পর্কে তত দূরত্ব সৃষ্টি হবে।
অনেক রাত পর্যন্ত রাশেলের জন্য অপেক্ষা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে গিয়েছি খেয়াল নেই।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি রাশেল নতুন প্যান্ট শার্ট পরে কোথাও যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে।
আমি আশ্চর্য হয়ে ঘুম জড়ানো কন্ঠে প্রশ্ন করলাম,
–কোথাও যাবে নাকি?
রাশেল আমার দিকে না তাকিয়েই নির্লিপ্তভাবে ছোট্ট করে জবাব দিল,
–হুম কাজ আছে।
–ওহ্,রাতে কখন এসেছিলে?অনেক রাত করে ফিরেছো নিশ্চয়ই?
–হুম কাজ ছিল।
–তুমি কি আমার উপর রেগে আছো?
–না তো।
–তাহলে আমার দিকে একবারও তাকাচ্ছো না কেন?পুরাতন হয়ে গেছি নাকি?
রাশেল কোনো জবাব দিল না।আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে, বিছানার কোণা থেকে মানিব্যাগটা পকেটে পুরে দরজার দিকে পা বাড়ালো।
সকাল সকাল মনটাই খারাপ হয়ে গেল।রাশেলও আজকাল আমার সাথে ভালোভাবে কথা বলতে চাইছে না!আমি কি এতোই খারাপ!
আবার শুয়ে পড়লাম,একদম উঠতে ইচ্ছে করছে না।

বিকালে আমার শাশুড়ী দেখি নতুন কাপড় পড়ে বেশ তৈরি হয়ে কোথাও যাচ্ছেন।সাথে আমার বড় জা’য়ের ছোট ছেলেটাও যাচ্ছে,ওর দুহাত ভর্তি মিষ্টির প্যাকেট ।
শাশুড়ী বাড়ির বাহিরে চলে যেতে আমি সেজো জা’কে জিজ্ঞেস করলাম,
–আম্মা,কোথায় গেল ভাবী?
সেজো জা কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল।আমার দিকে চেয়ে কেমন ইতস্তত করতে লাগলো।
–কি হলো?আম্মা কোথায় যাচ্ছে জানেন না?
–জানি তো।
–তো বলেন না কেন?

‌–পাশের এলাকাতেই যাইতাছে,রাশেলের বিয়ার পাকা কথা কইতে।সকালে গিয়া মাইয়া পছন্দ কইরা আসছেন।আর এখন গিয়া ডেট ফাইনাল কইরা আসবেন।
কথাগুলো ঝটপট বলে মেঝো জা দ্রুত নিজের ঘরে চলে গিয়ে যেনো পালিয়ে বাঁচলেন।
আর আমি কাঠ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানেই।আমি ভেবেছিলাম তালাক আটকে যাওয়া পর্যন্তই ঘটনার সমাপ্তি হয়তো।
কিন্তু আমার শাশুড়ী তো হার মানার পাত্রী নয়,তালাক দেওয়াতে পারেনি তাতে কি!ছেলের ২য় বিয়ে তো করাতে পারবে।
এক্ষেত্রে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি পর্যন্ত নেওয়ার প্রয়োজন নেই তাদের!
রাশেল কি জানে এইকথা?
হঠাৎই মনে হলো,সকালেই তো দেখলাম রাশেল বেশ তৈরি হয়েই বেরিয়ে গেল।তারমানে কি রাশেলও গিয়েছিল নিজের বিয়ের পাত্রী দেখতে!

আমি দুচোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম।কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে গলার কাছে জড়ো হচ্ছে।হয়তো আমি টাল সামলাতে না পেরে সেখানেই পড়ে যাচ্ছিলাম।বড় জা দেখতে পেয়ে দৌঁড়ে এসে আমাকে ধরে ঘরে এনে শুইয়ে দিলেন।
আমি প্রচুর কান্না করলাম,বড় জা’কে জড়িয়ে ধরে।
তিনি আমাকে অনেকভাবে শান্ত করতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু আমার কানে তখন কোনো কথাই ঢুকছিল না।
সারাটা বিকাল কান্না করে করে সন্ধ্যার দিকে একটু তন্দ্রার মতো চলে আসছিল।
শাশুড়ীর উচ্চস্বরের কথাবার্তা শুনে জেগে উঠে বসলাম।জানালাটা অল্প একটু ফাঁক করে উঠানে তাকাতেই দেখলাম,আমার শাশুড়ী পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে খুশিতে বিগলিত কন্ঠে আমার জা’য়েদের সাথে মেয়ে বাড়িতে তাদের কতটা আদর আপ্যায়ন করেছে,তা নিয়ে গল্প করছেন।
আমি জানালাটা লাগিয়ে দিলাম।

আমার আবারও চাপা কষ্টে বুক ঠেলে কান্না পেতে লাগলো।রাশেল কি করে পারলো আমাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করার কথা ভাবতে,ছিঃ! রাশেলের প্রতি অভিমান জমতে জমতে বুকের ভিতরটা একদম ভারী হয়ে উঠলো,নিঃশ্বাস নিতেও যেনো কষ্ট হচ্ছে।
বালিশে মুখ গুজে কাঁদতে কাঁদতেই আবার ঘুমিয়ে গেলাম।
খুব বেশি ঘুমিয়েছি বলে মনে হলো না।
ঠাস করে দরজা খোলার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল।
রাশেল এসেছে ঘর্মাক্ত হয়ে।শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে সে ফ্যানের নিচে এসে বসে।
একটু স্থির হয়ে আমার দিকে তাকাতেই রাশ চমকে উঠলো।
–রাকা!কি হয়েছে তোমার?এ কি অবস্থা করেছো নিজের?কি হইছে বলো?

লাল টকটকে চোখ,ফোলা নাক-মুখ,এলোমেলো চুল,উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টির এই রাকাকে আগে কখনো দেখেনি হয়তো রাশেল।রাশেল সহানুভূতি হাত বাড়িয়ে আমাকে ছুতে আসতেই আমি হিংস্র বাঘিনীর মতো ক্ষ্যাপে উঠলাম।
এক ধাক্কা দিয়ে রাশেল অনেকটা দূরে সরিয়ে দিলাম।রাশেল কোনোরকমে চেয়ারটা আঁকড়ে ধরে নিজেকে সামলালো।রাশেলের দু’চোখ ভর্তি বিস্ময়!
–রাকা এমন করছো কেন?কি হয়েছে বলবা তো?না বললে আমি কি করে বুঝবো?মা’র সাথে আবার ঝগড়া করছো নিশ্চয়ই?
–চুপ।একদম ন্যাকামি করতে আসবেন না আপনি।সকাল সকাল এমন তৈরি হয়ে কোথায় গেছিলেন হা?ভাবছেন আপনি বলবেন না,তাই আমিও জানতে পারবো না।

লজ্জা করে ন? ভালোবেসে যে মেয়েকে বিয়ে করলেন ৩ বছরেই সেই মানুষটাকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়ে এখন নতুন মেয়ে নিয়ে আসতে?মেয়ের বয়স তো শুনছি মাত্র ১৫! বাহ্, রুচি আপনার এতো নিচে নেমে গেছে।
কিসে কমতি রেখেছিলাম আমি আপনার?দোষ শুধু একটাই, আপনার মায়ের অন্যায় আবদার মেনে নেইনি তাইতো?আপনার মায়ের সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলে তবেই আমি ভালো;নয়তো না!এতোই যদি মায়ের কথায় উঠবস করবেন তাহলে বিয়ে করলেন কেন তখন?কেন?…
হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলাম,আর কোনো কথা বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে আমার।হাত-পা কাঁপছে থরথর করে রাগে।রাশেল এগিয়ে এলো আমার দিকে,

–শান্ত হও,শান্ত হও প্লিজ রাকা।আমি তোমার কথা কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।বাড়িতে কি নতুন করে কিছু হয়েছে?আমি তো কিছুই জানি না,মাত্রই ফিরলাম ঢাকা থেকে।আর সকালে তো ঢাকা যাওয়ার জন্যই তৈরি হলাম।আজ কি বার বলোতো?আজ তো দোকানের মাল আনতে গিয়েছিলাম ঢাকা।
–মিথ্যা কথা আর বলতে হবে না।সরেন,যান এখান থেকে যান।
একবিন্দুও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করলো না রাশেলের কথা আমার।ধাক্কাতে ধাক্কাতে ওকে ঘর থেকে বের করে দরজায় ছিটকিনি দিয়ে দিলাম ভিতর থেকে।তারপর বসে বসে কাঁদতে লাগলাম।
হঠাৎ জানালার দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম,আমার বড় জা আমার ঘরের পূর্ব পাশের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন।আমার চোখে চোখ পড়তেই উনি সরে গেলেন।

তারমানে এতোক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বড় জা আমাদের সব কথা শুনছিলেন।
“অন্যের ঘরের ঝগড়া দেখতে বেশ ভালোই লাগে বোধহয়” চরম মেজাজ নিয়ে আমি উঠে জানালা বন্ধ করতে গিয়ে, জানালা দিয়ে দেখলাম বড় ভাবী রাশেলকে উঠানে দাঁড় করিয়ে কিছু একটা বলছেন।
রাতে খেতে না যাওয়াতে আমার বড় জা আসলেন আমাকে নিতে।আমি উনার সাথেও উল্টাপাল্টা ব্যবহার করলাম।
আমার মানসিক অবস্থাটা বুঝতে পেরেই হয়তো উনি আমার কোনো কথা গায়ে মাখলেন না।আমাকে জোর করে উঠিয়ে,মুখ হাত ধোয়ালেন।

তারপর খাওয়ার ঘরে নিয়ে সবার সামনে খেতে বসালেন।
রাশেলও ছিল সেখানে।চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে,আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছে শুধু।
খাওয়ার সময় আমার শাশুড়ীই উঠালেন বিয়ের কথা।রাশেলকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
–রাশেল তোর জন্যি মাইয়া দেইখা আসলাম আইজ।কি যে সুন্দর একদম পরীর মতোন।মাইয়ার বাপের পইসাও আছে।ঠিকানা কইলে তুই চিনতেও পারোস। ঐ যে ঐ গ্রামের জমির আলির মাইয়াটা।
রাশেল বেশ বিস্ময় নিয়ে মায়ের দিকে তাকি আছে।আমি তার চেয়েও বেশি বিস্ময় নিয়ে রাশেলকে দেখছি।
মানে কি!রাশেল কি তাহলে জানে না বিয়ের কথা!আমি যে ওকে এতোগুলো কথা বলে ফেললাম একটু আগেই…..
আমার চিন্তার মাঝপথেই রাশেল তার মাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

–কি বলছো মা?আমি বিয়ে করবো মানে?বিয়ে করবো কেন?বিয়ে কয়বার করবো।
–তোর কোনো মত আমি শুনবার চাই নাই রাশেল।তোরে কওয়ার দরকার আছিল,তাই কইলাম।বিয়া আগামী পরশুদিন।ঘরোয়া কইরাই বিয়া পড়াইয়া মাইয়া নিয়া আসমু।
–মানে কি মা?তুমি আমাকে না জানিয়েই বিয়ের ডেইট পর্যন্ত ফাইনাল করে আসছো?একবার আমাকে কিছু বলারও প্রয়োজন মনে করো নাই।বিয়ে কি ছেলে খেলা নাকি,যখন-তখন যাকে-তাকে বিয়ে করে ফেলবো।আমি তো আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি!
রাশেলের কথা শুনে আমার শাশুড়ী চিৎকার করে বললেন,

–তোরে জিগাইয়া তোর বিয়া ঠিক করা লাগবো আমার?তোর থেইকা কি আমি কম বুঝি রে?কি পাইছোস তুই এই মাইয়ার মধ্যে। তোরে কি জাদু কইরা রাখছে হা?
পছন্দ কইরা বিয়া কইরা এই মাইয়াডারে তুই আনছোস।কিন্তু এই বেদ্দপ মাইয়াডা আমার কোনো কথা শুনবার চায় না,চ্যাটাং চ্যাটাং মুখের উপরে উত্তর দিয়া দেয়।আমার সংসারের সব সুখ কাইড়া নিছে….
শাশুড়ীর মুখের কথা ছো মেরে একপ্রকার কেঁড়ে নিল রাশেল,
–তোমার সংসারের সব সুখই ও নষ্ট করে দিছে! আর তোমরা কি করছো?তোমরা কোন দিক থেকে ওরে সুখ দিছো সেটা বলবা?
৩টা বছর ধরে এই সংসারে এসে পেয়েছেটা কি এই মেয়েটা?

এই মেয়েটা যতটা পারছে,যেভাবে পারছে সবসময় তোমাদের মন জোগাতে চেষ্টা করে গেছে।বিনিময়ে কি পাইছে ও?তুমি ওরে মন থেকে গ্রহণ করে নিবা তো দূরের কথা,ওর মৃত্যু কামনা করতে পর্যন্ত তোমার বাঁধে না মা!
–এ এ বাজান,তুই এইগুলা কি কইতাছোস?তোর মাথা ঠিক আছে তো?নাকি আউলাই গেছে!আমার সাথে এমনে কথা কইবার সাহস কই পাইছোস।আর আমি কহন তোর বউয়ের মৃত্যু চাইলাম।
–কেনো, কাল যে রাকা পুকুরপাড়ে পড়ে গিয়ে চেচিয়ে তোমাদের ডাকছে,শুনতে পাওনি তুমি?শুনতে পেয়েও গেছিলা একবার ওরে সেইভ করতে?ও যদি সেখান থেকে পিছলে পড়তো ওর কি হাল হতো খুব ভালো করেই জানতা তুমি মা।
–কি কস এইগুলা?কহন ডাকলো আমারে?আমি তো শুনবার পাই নাই।

–মা সব ভালো লাগে,কিন্তু মিথ্যা কথা ভালো লাগে না।মিথ্যা কথা বলে,আমার যে সম্মানবোধটুকু তোমার জন্য আছে,ঐটা কখনো নষ্ট হতে দিও না প্লিজ।
আমি জানি তুমি রাকার ডাক শুনছো।গিয়ে একবার উঁকি দিয়ে রাকার অবস্থাটাও তুমি দেখে আসছো!তবুও তুমি নিজে তো এগিয়ে যাওনি উদ্ধার করতে,উল্টো বড় ভাবীকেও যাইতে বাঁধা দিছো!
মা,আমি তোমার কাছ থেকে এটা একদম আশা করি নাই ।
রাকা আমাকে বলছিল কাল,”রাকার ডাক তুমি শুনতে পাইছো।” কিন্তু আমি রাকাকে উল্টো ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছিলাম।

আমার মেয়ে পর্ব ৬

কারণ আমার মা’র প্রতি আমার এইটুকু বিশ্বাস ছিল,আর যাই হোক শত্রুও যদি বিপদে পড়ে তাহলেও আমার মা এগিয়ে যাবে বিপদ থেকে তাকে রক্ষা করতে।আর এটা তো তোমার ছেলের বউ ছিল মা,তোমার ছেলের সন্তানের মা ছিল।
কিন্তু আজ বড় ভাবীর কাছ থেকে ওই কথাটা শুনে বুঝতে পারলাম,আমার মা আর সেই মা নাই।আমার মা কেমন যেনো পরিবর্তন হয়ে গেছে…।
রাশেলের গলা কেঁপে উঠে, সে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয় কান্না লুকাতে।ঘরের প্রত্যেকটি মানুষ স্তব্ধ হয়ে আছে।আমি নিজেও থ হয়ে গেছি আজ রাশেলের কথা শুনে।এর আগে কখনো দেখিনি এভাবে মুখ ফুটে কথা বলতে ওকে।
এদিকে শাশুড়ী আমার বড় জা’য়ের দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছেন যেনো পারলে এখনি চিবিয়ে খান।কিছুক্ষণ নীরব থেকে উনি ক্রোধে ফেটে পড়লেন,

–ফকিন্নির জী,তুই আমার নামে আমার পোলার লগে লাগাস,তোরেও আমি দেইখা ছাড়মু।আগে ছোডটার ব্যবস্থা করি।
শাশুড়ীর আগুন ঝড়ানো দৃষ্টির সামনে আমার বড় জা ভয়ে একদম মিহিয়ে গেল।
উনি তাহলে উঠানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাশেলকে এই ব্যাপারেই বলছিলেন।
আচমকাই আমার শাশুড়ী হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন।কাঁদতে কাঁদতে উঠে গিয়ে রাশেলের হাতটা নিজের মাথার উপর রেখে বললেন,
–তোরে আমার কছম দিলাম রাশেল,বিয়াটা তুই করবি।আমি কথা দিয়া ফালাইছি।আর যদি বিয়া না করোস,তাইলে আমার মরা মুখ দেখবি।

আমার মেয়ে শেষ পর্ব