আমার মেয়ে শেষ পর্ব || Khadija Akter

আমার মেয়ে শেষ পর্ব 
Khadija Akter

–তোরে আমার কছম দিলাম রাশেল,বিয়াটা তুই করবি।আমি কথা দিয়া ফালাইছি।আর যদি বিয়া না করোস,তাইলে আমার মরা মুখ দেখবি।
শাশুড়ী কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলেন।শাশুড়ী যাওয়ার সাথে সাথে রাশেলও উদ্ভ্রান্তের মতো বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
এদিকে শাশুড়ীর কথা শুনে আমার বুকটা ধড়াস করে উঠলো।আজ পর্যন্ত আমার শাশুড়ি কিছু বলেছে আর রাসেল সেই কথা শুনে নি এরকমটা কখনো হয়নি।
তবে কি রাশেল…!
না আমি আর ভাবতে পারছিনা!
রাসেল সেই যে তখন ঘর থেকে বের হল,সারা রাতে আর বাড়ি ফিরলো না।
আমি আরও একটিনির্ঘুম আরেকটি রাত কাটিয়ে দিলাম।

পরদিন সকাল হতেই বাড়িতে বিশাল আয়োজনের তোরজোর শুরু হয়ে গেল।
বিয়ে আগামীকাল হওয়ার কথা থাকলেও, আমার শাশুড়ী কোনো এক কারণে আজ রাতেই বিয়েটা সম্পন্ন করে ফেলতে চাইছেন।
আমি ঘরে বসে নীরব দর্শক হয়ে জানালা দিয়ে শুধু দেখতে লাগলাম।আহ্,কত মানুষ, কত আনন্দ,পাড়াপ্রতিবেশির হৈ-হুল্লোড়! বিয়ে বাড়ি বলে কথা!
আমার চোখদুটো তখন শুধু রাশেলকে খুঁজছে।কিন্তু আশেপাশে কোথাও রাশেলকে দেখতে পেলাম না।
একটু পর রাশেল কোথা থেকে যেনো হন্তদন্ত করে ঘরে আসলো।
এসেই বিছানায় শুয়ে পড়লো,ওর দৃষ্টি উপরের কারবাসে দিকে নিবদ্ধ।
পাশে যে একটা জলজ্যান্ত মানুষ হিসেবে আমি বসে আছি,সেইদিকে ও একবার ফিরেও তাকালো না।
কি জানি,হয়তো চোখে চোখ মিলাতে পারবে না বলেই তাকাচ্ছে না।
বিষন্ন দেখাচ্ছে রাসেলকে ভীষণ ;দেখেই বোঝা যাচ্ছে বিশাল ঝড় বয়ে যাচ্ছে ওর মনের ভিতর দিয়ে।একদিকে মা অন্যদিকে বউ!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

হঠাৎ করেই আমার কি হলো জানি না,প্রচন্ড মায়া অনুভব করতে লাগলাম এই মানুষটার প্রতি।
ওর বুকের কাছে জড়ো করে রাখা হাতগুলো থেকে ডানহাতটা আমি তুলে নিলাম আমার হাতে।
ও কিছুটা চমকে গিয়ে এতক্ষণে আমার দিকে তাকালো।
–তোমাকে দো’টানায় থাকতে হবে না রাশেল!তুমি তোমার মায়ের কথা মেনে নাও।বিয়েটা করে নাও তুমি….
–রাকা……!
–হুম,আমার কোনো আপত্তি নেই।
রাশেল,একটা কথা কি জানো?যাকে ভালোবাসা যায় তাকে অশান্তিতে দেখা যায় না!বিশ্বাস করো,তোমার মনে যে অশান্তি চলছে,এটা আমি আর নিতে পারছি না।আমি তোমাকে মুক্তি দিলাম।
আর আমি আজই আমাদের বাড়িতে চলে যাব,সমস্যা নেই।তোমার নতুন বউয়ের কোনো প্রকার কষ্ট হবে না এখানে আমার কারণে।
আমাকে কখনো দেখতে ইচ্ছে হলে আমার বাবার বাড়িতে এসে দেখে যেও।
রাশেল উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলো।আমার কোনো কথা ও শুনতে পাচ্ছে কিংবা বুঝতে পারছে বলে মনে হলো না।

আমার দু’চোখ দিয়ে তখন টপটপ করে পানি পড়ছে শুধু। কিন্তু আমার চোখের পানি দেখিয়ে আমি রাশেলকে দুর্বল করতে চাইনা।
আমি অনেক করে চাইছি কান্না থামাতে,কিন্তু আমার চোখ চাইছে না।
কিছুক্ষণ পর আমার জা’য়েদের ছোট ছোট ছেলেরা ও পাড়াপ্রতিবেশি ছোট ছেলে-মেয়েরা হাতে করে একগাদা ফুল নিয়ে আমার ঘরে ঢুকে গেল হুড়মুড় করে।
–চাচা,চাচি আন্নেরা একটু বাইরে যান, আমরা বাসর ঘর সাজামু।
আমার বুকে যেনো কেউ তীর ছুড়ে মারলো!এভাবে করে আমার শ্বাসটা হঠাৎই আটকে গেল এই কথা শুনে।
আমার ঘর,আমারই বিছানা,আমার স্বামী;আর সব আয়োজন অন্য একটা মেয়ের জন্য।
আমি তড়িঘড়ি করে বের হয়ে এক দৌঁড়ে সেজো জা’য়ের ঘরে চলে গেলাম।
আমি চাইনা ঘরভর্তি ছোট ছোট ছেলেপিলে আমার চোখের পানি দেখুক!পাড়াপ্রতিবেশিরা আমাকে নিয়ে উপহাস করুক!

সারাটা বিকাল জা’য়ের ঘরে কাটিয়ে, সন্ধ্যার দিকে অনিচ্ছা স্বত্তেও আমার ঘরে ফিরে আসলাম।
ব্যাগ গুছাতে হবে,এখনি চলে যাব বাবার বাড়িতে।নিজের চোখে নিজের স্বামীর বিয়ে কোন নারীই বা দেখতে পারে!
বউ নিয়ে যখন আসবে,তখন ঠিক এই ঘরেই তো তুলবে!আর আমাকে ছুড়ে ফেলা দেওয়া হবে পরিত্যক্ত কোনো ঘরে যেভাবে করে ময়লা আবর্জনা ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়।
আমার স্বামী আস্তে আস্তে নতুন বউয়ের দিকে ঝুঁকে যাবে……..নাহ্ আর ভাবতে পারছি না।
আমার ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে বাচ্চারা।আমার কপালে তো এতো আয়োজন জুটেনি,হয়তো আমার ভাগ্যেই ছিল না।

কিন্তু আমার স্বামীর ভাগ্যে ছিল!
খাটের উপর রাশেলের জন্য শেরেওয়ানি রাখা।সে এখন কোথায় তা জানি না,তবে একটু পরে এই জামাটা পরেই তৈরি হয়ে যাবে দ্বিতীয় বিয়ের আসরে!
আমি আলতো করে শেরেওয়ানিটা ছুঁয়ে দিলাম।
আমার শাশুড়ীর নাকি অনেক শখ ছিল,ছোট ছেলের বিয়ে ধুমধাম করে দিবেন!প্রথম বিয়ের ক্ষেত্রে না হলেও,দ্বিতীয় বিয়েতে উনার শখ নিশ্চয়ই পূরণ হচ্ছে।
ভালো থাকুক সকলেই…..

দ্রুত হাতে আমি আমার নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রগুলো আমার ব্যাগে ভরতে লাগলাম।আমার কোনো জিনিস এই ঘরে থাকুক,তা আমি চাইনা।এখানে তো শোভা পাবে নতুন বউয়ের নতুন সব জিনিস!আমার পুরোনো জিনিসগুলো তো জঞ্জাল ছাড়া কিছুই না।
মাগরিবের আজান হয়ে গেছে অনেক আগেই।চারদিকে ইতিমধ্যে অন্ধকার নেমে গেছে।
যে যার ঘরে নিজেকে সুসজ্জিত করতে ব্যস্ত,বিয়েতে যাবে বলে কথা।
আমার গুছানো প্রায় শেষ। রাতের অন্ধকারেই কাউকে কিছু না জানিয়ে বের হয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আমার।অন্ধকারটা আরেকটু গাঢ় হওয়ার অপেক্ষা করছি।

হঠাৎ করেই রাশেল আসলো ঘরে।এতক্ষণ নিজেকে তবুও শক্ত রাখতে পেরেছি।কিন্তু শেষবেলায় রাশেলকে দেখে আমার বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল।ইশশ কেন আমি অপেক্ষা করতে গেলাম,আরেকটু আগে কেন বের হলাম না!তবেই তো আর ওর মুখোমুখি হতে হতো না।
রাশেল বেদনার্ত চোখে তাকিয়ে দেখছে ভেঙে যাওয়া রাকাকে।আস্তে করে বললো,
–চলে যাচ্ছো?
–হুম।
দীর্ঘ নীরবতার পর রাশেল বললো,
–আমাকে মাফ করে দিও রাকা।
–তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই।চিরকালই তুমি হয়তো আমার ভাগ্যে ছিলে না…..
আমার পক্ষে আর কান্না আটকে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।মুখে আঁচল চেপে ধরে ব্যাগটা হাতে নিয়ে রাশেলের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলাম চিরদিনের জন্য এই ঘর থেকে।
আগামীকাল সকালে নিশ্চয়ই আমার শাশুড়ী বিজয়ের হাসি হাসবেন।অবশেষে যে উনি পেরেছেন রাকার দম্ভ ভাঙতে!রাকাকে এই বাড়ি থেকে বিদায় করতে!

শ্বশুর বাড়িটা যতই পেছনে রেখে সামনের দিকের পথ অতিক্রম করছি, ততই যেনো বুকের হাহাকারটা বেড়েই চলছে।আমার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদটাই যে আমি ঐ বাড়তে রেখে এসেছি!
অনেকটা দূর চলে এসেছি,আর কিছুটা গেলেই আমাদের বাড়ি!
বাড়িতে গিয়ে আবার মা’র কোন রুপ দেখতে হয় সেটা নিয়েও চিন্তা করছি।
তাড়াতাড়ি পৌঁছানোর জন্যই লোকালয় ছেড়ে বনের রাস্তা ধরে ছিলাম।এদিক বেশ নির্জন এলাকা।ভয়টা আমার বরাবরই কম।কিন্তু এই মুহুর্তে এই নিরিবিলি পরিবেশে অন্ধকারে বনের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে গা টা কেমন ছমছম করে উঠলো।

হঠাৎই মনে হলো,ঝোপঝাড় ভেঙে খচখচ শব্দ করতে করতে এলোপাতাড়ি কেউ ছুটে আসছে এদিকে।আমি থেমে গেলাম,কান পেতে ভালো করে শব্দটা শুনলাম।এদিক সেদিক তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেলাম না।
মনে হলো,এতো রাতে আমার শরীরের এই অবস্থায় একদম উচিত হয়নি এই রাস্তায় আসা।যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে…..
আমি আরও দ্রুত পায়ে হাঁটা শুরু করলাম।
আরও কিছুদূর এগুতেই কেউ যেন প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়লো আমার উপর।আমি তাৎক্ষণিকভাবে ভাবে বেশ ভয় পেয়ে গেলেও, পরিচিত একটা গায়ের গন্ধ নাকে আসতেই অন্ধকারেও নিশ্চিত হলাম মানুষটা ঠিক কে।
দুচোখ ভর্তি বিস্ময় নিয়ে অন্ধকারে ছায়ামূর্তিটার দিকে চেয়ে আছি আমি।

মানুষটা হাঁটুতে ভর দিয়ে ঝুঁকে আছে নিচের দিকে।ভীষণ হাঁপাচ্ছে সে।পরনে বিয়ের শেরেওয়ানি!
একটু জিরিয়ে নিয়েই গা থেকে একটানে শেরেওয়ানিটা খুলে পাশের ঝোপে ফেলে দিল।তারপর হাতে থাকা ব্যাগের এলোমেলো কয়েকটা জামা প্যান্ট হাতড়ে একটা টি-শার্ট বের করে গায়ে দিয়ে নিল।
আমি শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে মানুষটার কর্মকাণ্ড দেখছি।যার এখন বিয়ের আসরে থাকার কথা দ্বিতীয় বউয়ের সাথে,সে এখন এই রাত্রিরে বনের মাঝখানে প্রথম বউয়ের কাছে কি করছে!

নাকি এই ছায়ামূর্তিটা শুধুই আমার ভ্রম!একটু পরেই দেখবো সে নেই,সে উধাও!
এটা যে আমার কল্পনা নয়,এটা নিশ্চিত হলাম রাশেলের হাপিয়ে উঠা পুরুষালি কণ্ঠে,
–রাকা,রাকা তোমাকে ছেড়ে থাকা আমার পক্ষে একদম অসম্ভব! আমি পারবো না তোমার জায়গাটা অন্য কাউকে দিতে।
আমি ঘুম ভেঙেই পরিচিত তোমার মুখটার বদলে অন্য কারো মুখ দেখতে পারবো না।
তোমার গায়ের গন্ধ না পেলে আমি ঐ ঘরটাতে ঘুমাতেও তো পারবো না।
কাজ থেকে ঘর্মাক্ত হয়ে যখন ফিরবো,তোমার হাসি মাখা মুখটার বদলে অন্য কাউকে দেখলে তো আমার ক্লান্তি কাটবে না রাকা।

ক্লান্ত থাকতে থাকতে আমি একসময় একদম নির্জীব হয়ে যাব।তুমি এটা চাও?ছেড়ে কেন যাচ্ছ আমায় অন্য কোনো মেয়ের হাতে তুলে দিয়ে?এতো সহজেই হার মানলে তুমি?
ভালোবাসি তোমায় রাকা!
–মা-মানে?
–মানে টানে কিছু না।চলো আমার সাথে..!
–কিন্তু কোথায়?
–ঢাকায়।
–ঢাকায়!
–পালাবো তোমায় নিয়ে।বেশি রাত হয়ে গেলে বাস পাবো না।আর জলদি এই এলাকা ছাড়তে হবে।আসো আমার সাথে।
আমি হাত ধরে থামিয়ে দেই রাশেলকে।অনেক অনেক প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরছে।রাশেল ওর মায়ের কথা রাখবে না তাহলে!

–কিন্তু রাশেল,আমার কিছু কথা বলার আছে…
–আচ্ছা,যা বলার জলদি বলো।দেরী করলেই ঝামেলা হয়ে যেতে পারে।
–তুমি যে এখন তোমার মায়ের আদেশ অমান্য করে পালিয়ে এসেছো সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে এখানে।
কিছুদিন পরেই যদি তোমার মনে হয় যে তোমার এই সিদ্ধান্তটা ভুল!আবেগের বশে নিয়েছো এটা!তখন আমার কি হবে?
রাশেল এক মুহুর্ত কিছু একটা চিন্তা করলো।তারপর বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে বললো,
–হুম……।আমি বুঝতে পারছি তোমার মনের শঙ্কার কারণটা।
রাকা শুনো,

আমি তোমাকে শর্টকাটে কিছু কথা বলি।তাহলে তুমি নিজেই বুঝতে পারবে আমি বিবেক দিয়ে চিন্তা করে এখানে এসেছি, নাকি তোমার প্রতি ক্ষনিকের মোহ আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।
আমি অনেক আগে থেকেই দেখে আসছিলাম আমার মা,আমার ভাবীদের মেয়ে বাচ্চা নষ্ট করে দেয়।কেন উনি এটা করেন,সেটা তো তুমি এর মধ্যে জেনেও গেছো।
যদিও আমরা সবাই জানতাম,মায়ের এই কাজটা ঘোর অন্যায়।কিন্তু অনেক বুঝানোর পরেও আমরা উনাকে টলাতে পারিনি।একসময় আমরা হাল ছেড়ে দেই,মাকে কষ্ট দিতে চাইনি আমরা কেউই।মাকে মায়ের মতো মায়ের চিন্তাভাবনা নিয়ে থাকতে দেই।

মেয়ে সন্তান নষ্ট করে দেওয়ায় ভাবীরা প্রথম প্রথম কাঁদতো,একসময় তারাও অভ্যস্ত হয়ে যায়।তারাও মেনে নিতে শিখে যায়,মেয়ে বাচ্চা মানেই পাপ!মেয়ে বাচ্চা জন্মানোর আগেই মেরে ফেলতে হবে!এটা আমাদের পরিবারের একটা রীতি হয়ে গিয়েছিল বলতে পারো।
কিন্তু যখন তোমার পালা আসলো,আমার মধ্যে অদ্ভুত এই অজানা অনুভূতির সৃষ্টি হলো জানো?
সবাই যখন জানতে পারলো তুমি প্রেগন্যান্ট। মা আমাকে ডেকে নিয়ে বললো,”যত দ্রুত সম্ভব বাচ্চা নষ্ট করতে হবে।তোর বউকে বোঝা এটা।”
আমি ঝোকের বশে মা’র কথাটা মেনে নেই,তোমাকে ফোর্স করতে থাকি বাচ্চাটা নষ্ট করার জন্য।
কিন্তু আমার বোধদয় হয় তখন,যখন বেবিটা মারার জন্য তোমাকে জোর করে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলাম আমি আর মা।

“প্রথমবারের মতো বাবা হওয়ার অনুভূতিটা থেকে আমি বঞ্চিত হবো ঠিক একটু পরেই” ভাবতেই আমার কেমন একটা লাগছিল।
আমার কাছে তখন ছেলে বা মেয়ে সন্তান কোনো ম্যাটার করছিল না।আমার শুধু মনে হচ্ছি, আমার সন্তানকে আমি মেরে ফেলতে যাচ্ছি।বাবা হতে গিয়েও বাবা হতে পারলাম না!
চরম অস্বস্তিতে পরে গেছিলাম আমি সেদিন।কিন্তু মায়ের মুখের উপর কথা বলার সাহসও ছিল না।শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলাম,কোনোভাবে এই বাচ্চাটা বেঁচে থাক।

হাসপাতালে ওয়াশরুমের নাম করে তুমি ওয়েটিং রুম থেকে যখন উঠে গেলে,তুমি হয়তো খেয়াল করোনি তোমার পিছু পিছু আমিও উঠে এসেছিলাম তোমার সেইফটির জন্য।
একসময় আমি দেখতে পেলাম তুমি ওয়াশরুমের জন্য সিঁড়ির ডানদিকে না গিয়ে সোজা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছো।নিচে নেমে একটা রিকশা নিয়ে নিলে…..।
আমি দেখেও না দেখার ভান করে কিছুক্ষণ পর মাকে গিয়ে বলেছি,”রাকা মনে হয় বাড়ি চলে গেছে, মা।কখন গেল দেখতেই পেলাম না!”

পরদিন গেলাম তোমাকে ফিরিয়ে আনতে,তুমি আসলে না।
একদিন চলে গেল,দুইদিন চলে গেল,তবুও তুমি আসলে না।তুমি না আসাতে আমি খুশিই হয়েছিলাম জানো? আসলেই কি হতো? মা তো আবার তোমার পিছু লাগতো!
কিন্তু তুমি না আসাতে মা যেনো অস্থির হয়ে যাচ্ছিলেন।আমি জানতাম কোনো না কোনোভাবে মা তোমায় নিয়ে আসবেই।আর বাচ্চাটাও রাখতে দিবেন না তোমাকে।
কিন্তু আমি চাইছিলাম আমার বাচ্চাটা অত্যন্ত বেঁচে থাকুক,নিরাপদে থাকুক।
অনেক ভেবেচিন্তে আমিই মায়ের কাছে প্রস্তাব নিয়ে যাই,
“মা,রাকাকে ফিরিয়ে আনো।মা, এখন তো অনেক দেরী হয়ে গেছে।বাচ্চাটা তো পৃথিবীতে আসার সময় হয়ে গেছে,এইসময় ওকে মেরে ফেললে অনেক বেশিই পাপ হবে আমাদের।আমরা বরং জন্মের পর বাচ্চাটাকে পালক দিয়ে দিব।”

অনেক বুঝানোর পর মা রাজী হলেন।মায়ের চিন্তা ছিল,উনি বড় একটা পাপকাজ থেকে বেঁচে যাবেন।
আর আমার চিন্তা ছিল,আমার সন্তানটা অত্যন্ত বেঁচে থাকবে এই পৃথিবীতে।
তালাকের ব্যাপারে যদি বলতে যাই তবে আমি নিশ্চিত ছিলাম,রাকা তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে।কোনো না কোনোভাবে তুমি এটা আটকাবে।বিশেষ করে কাবিনের টাকাটার কথা তোমার মাথায় আসারই কথা।
কিন্তু সেদিন রাতে উকিলের সাথে মায়ের কথাবার্তা শুনে আমিও মনে মনে বেশ বিচলিত হয়ে উঠেছিলাম।তুমি তালাকটা আটকাতে পারবে কি না ভেবে!অবশেষে তুমি পেরেছিলে।
আজ পর্যন্ত এই তিন বছরে তোমার উপর দিয়ে যা যা দুর্যোগ গেছে,সব কিছুতেই আমি তোমার সাপোর্টে ছিলাম কিন্তু সেটা মনে মনে।আমার সরাসরি সাপোর্ট কখনোই তোমার দরকার হয়নি।আমার সাহায্য ছাড়াই তুমি প্রত্যেকটি সমস্যার সমাধান করেছো।

হ্যাঁ আমি যদি তোমাকে সাহায্য করতাম,তাহলে হয়তো তোমার কাছে ব্যাপারটা অনেক সহজ হতো। কিন্তু রাকা ঐ যে, আমি আমার মায়ের মুখের উপর কথা বলতে পারি না।এটাই আমার একমাত্র দূর্বলতা।
তবে এই দূর্বলতাটাকেও অনেকটা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে আমার অনাগত মেয়ে!
সেদিন তুমি পুকুর পাড়ে পড়ে যাওয়ার পর “আমার মা ইচ্ছে করেই তোমাকে তুলতে আসেনি,ভাবীকেও আসতে দেয়নি” কথাটা শোনার পর সেদিন আর মুখ বুঝে থাকতে পারিনি রাকা।আমার মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিল রাগে।যদি এখানে আমার মা না হয়ে অন্য কেউ হতো, তবে যে কি করতাম আমি…….!
একবার শুধু চোখ বন্ধ করে ভেবেছি যদি আমি ঠিক সময়ে না আসতাম সেদিন,তোমার বা আমার সন্তানের ঠিক কি অবস্থা হতো!

সন্তানের প্রতি অসম্ভব চুম্বকীয় সেই টান ,আমাকে মা’র সামনে প্রথমবারের মতো উঁচু গলায় কথা বলতে বাধ্য করেছিল।
রাকা,একের পর এক সমস্যা তুমি সমাধান করে গেছ ঠিকই।কিন্তু শেষমেষ যখন আমার দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপার আসলো।তুমি হাল ছেড়ে দিলে,এবার আর পারলে না এই সমস্যার সমাধান করতে।
এটা এমন একটা সমস্যা যেটা তোমাকে ভিতর থেকে একদম গুড়িয়ে দিয়েছিল।তুমি আর পারলে না…হেরে গেল।যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে চলে আসলে।

এখনো যদি আমি তোমার কিছু করার অপেক্ষাতেই থাকি,তাহলে তো চিরদিনের জন্যই তোমাকে হারিয়ে ফেলবো রাকা।
এবার বলো,আমার এখানে আসা কি তোমার কাছে আবেগের বশে নেওয়া সিদ্ধান্ত মনে হচ্ছে?
একটানা কথাগুলো বলে আমার উত্তরের কোনো অপেক্ষা করলো না রাশেল,এক হাত দিয়ে শক্ত করে আমার হাতটা ধরে অন্যহাতে ব্যাগ দুইটা নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো সামনের দিকে।
আমি বিভোর হয়ে শুনছিলাম রাশেলের কথা এতোক্ষণ ।ওর কথাগুলো শুনতে শুনতে আমার শরীরে অদ্ভুত এক ভালো লাগার শিহরণ খেলে যাচ্ছিল বারবার।

এই মানুষটার মুখ দেখে কখনো বুঝতে পারতাম না তার ভিতরে কি চলে।আজ তার ভিতরকার সব অনুভূতিগুলোই যেনো আমি আমার নিজ চোখে দেখতে পাচ্ছি!
–রাশেল,একটু দাঁড়াও।
রাশেল দাঁড়াতেই আমি ওর সামনে এসে শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলই।
–ধুর পাগলী।
রাশেল আমার মুখটা তুলে চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে আলতো করে একটা চুমু খায়।তারপর নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরে রাখে আমায় কিছুক্ষন।
–এবার তো যেতে হবে রাকা।
আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে রাশেলের হাতটা আরও শক্ত করে চেপে ধরলাম।এই ভরসার হাতটা চেপে ধরেই হেঁটে চললাম অচেনা একটা শহরের গন্তব্যে।

আজ থেকে প্রায় আঠারো বছর আগে ডায়েরীতে নিজের লেখা কথাগুলো পড়ে নিজের অজান্তেই কেঁদে ফেললাম।
সেইসময়ের প্রতিটা দিন,প্রতিটা মুহুর্ত চোখের সামনে ভেসে উঠলো।কত কঠিন সময় পার করে এসেছি।কতটা সংগ্রাম করে একটা পরিবারের রীতি ভেঙে দিয়ে অবশেষে আমার মেয়ে তুলিকে জন্ম দিয়েছি আমি।
হ্যাঁ আমার মেয়ের নাম তুলি।কিছুদিন পরেই ওর আঠারো বছর পূর্ণ হবে।কিন্তু এতো অল্প বয়সেই আমার মেয়েটা আমাদের ৪জনেএ সংসারটা চালাচ্ছে ভাবা যায়!
এখানে আসার কিছুদিন পরেই তুলির জন্ম হয়।
ঢাকায় আসার প্রথম দিনগুলো আমাদের খুব একটা ভালো যায়নি তা ঠিক। কিন্তু স্ট্রাগল করতে করতে একসময় এসে ঠিকই সফলতার মুখ দেখতে পেয়েছিলাম আমরা।
প্রথমদিকে আমি বাসায় বসে টিউশন করাতাম কয়েকটা।আর রাশেল তার জমানো মূলধন দিয়ে প্রথমে ছোট করে একটা ব্যাবসা শুরু করেছিল।

আগে থেকেই অভিজ্ঞতা থাকায় অল্পদিনেই বেশ সফলতা পেয়ে বড় ব্যাবসায়ী হিসেবে খ্যাতি লাভ করে রাশেল।
কিন্তু একটা বাস দূর্ঘটনায় বছর তিনেক আগে রাশেল জীবনে অন্ধকার নেমে আসে।
পঙ্গু হয়ে সে এখন হুইল চেয়ারে বসা।আশার কথা হলো,সে এখন অল্প অল্প করে হাঁটতে পারে।ডাক্তার বলেছে খুব শীঘ্রই রাশেল আবার নিজ পায়ে চলতে পারবে কোনোরকম সাহায্য ছাড়াই।
রাশেলের এক্সিডেন্টের পর আমি যখন ঘোর হতাশায় ডুবে যাচ্ছিলাম,কিভাবে কি করবো!বাসায় বসে স্বামীর সেবাই করবো নাকি বাহিরে গিয়ে ব্যাবসা দেখবো।
এই বিপদ থেকে উদ্ধার করে আমার ছোট্ট মেয়েটি।মাত্র ১৫ বছর বয়সে সে তার বাবার ব্যবসায়ের সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল।

ছোটবেলা থেকেই বাবার সাথে ব্যবসায়ীক ছোট ছোট কাজে সাহায্য করতে করতে হাতেখড়ি তারও হয়ে গেছিল।
কিন্তু একা এতবড় কারবার সামলাতে হিমশিমও খেয়েছিল অনেক মেয়েটা।একই সাথে পড়াশোনা আর ব্যাবসা চালিয়ে নেওয়ার জার্নিটা কষ্টেরই ছিল তার জন্য।
তবে এখন এই তিন বছরে আমার মেয়েটা বাবার মতোই পাকা ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছে দেখতে দেখতে।বড় কোনো সমস্যা আসলে তবেই শুধু বাবার সাহায্য নেয়।
যাইহোক,মজার বিষয় হলো আমার শাশুড়ীও এখন আমাদের সাথে থাকছেন!এই বৃদ্ধা বয়সে উনার সেবা শুশ্রূষা আমি আর আর আমার মেয়েই করছি।
আঠারো বছর আগে অনেক স্ট্রাগল করে একটা মেয়ে জন্ম দিয়ে আমি রাশেলের পরিবারটিতে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছিলাম।

আমি চলে আসার পর আমার জা’য়েরাও সোচ্চার হয়ে উঠেছিল শাশুড়ীর এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তারাও তাদের মেয়ে সন্তান আর নষ্ট করতে দেয়নি।
ফলে এক কথায়,দুই কথায় একসময় ছেলে ও ছেলের বউদের সাথে আমার শাশুড়ীর সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়।যে যার সংসার নিয়ে আলাদা হয়ে যায়।
পড়ে থাকেন একা আমার শাশুড়ী!
এদিকে তুলিকে আমরা ওর ছোটবেলা থেকেই বলে এসেছি, কোনো একটা কারণে ওর দাদী বা বংশের কারো সাথেই আমাদের যোগাযোগ নেই।
তুলিও কখনো মুখ ফুটে জানতে চায়নি কি সমস্যা হয়েছিল বা কেন যোগাযোগ নেই।

কিন্তু বছর দুয়েক আগেই আমরা জানতে পারি,তুলির দাদী ভিষণ অসুস্থ।কোনো একসময়ে তিনি বউদের উপর এতো অবিচার করেছেন যে,শেষ বয়সে এখন বউরাও তার কাছে আসে না তেমন।
উনার আদরের নাতিরা যে যার মতো করে একেক দেশে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সেখানেই বসবাস করছে।
তুলিও সেই সময়ই প্রথম জানতে পারে যে তার দাদী বেঁচে আছেন আর তিনি খুব অসুস্থ।
তুলি জেদ ধরে,দাদীকে নিজেদের কাছে নিয়ে আসার।আমি আর রাশেলও তাতে সায় দেই।
আসলে কোনো একসময় আমার শাশুড়ী আমার সাথে অন্যায় করেছেন বা কর‍তে চেয়েছেন এটা ঠিক।আবার আমি যে উনার বিরুদ্ধে গিয়ে মেয়ে সন্তান জন্মদান করে তাদের পরিবারের অনেকদিনের রীতিকে ভেঙে দিয়েছি এটাও ঠিক।
কিন্তু আমি কখনোই চাইনি,শেষ বয়সে এসে উনি এরকম একা হয়ে যাক।আমি শুধু চেয়েছিলাম উনার ভুলটা শুধরে দিতে।কিন্তু আমার শাশুড়ী নিজের ভুল সময় মতো শুধরাননি বলেই শেষ বয়সে একদম একা হয়ে গিয়েছিলেন।
আমার শাশুড়ীকে আমি এখনো আগের মতোই সম্মান করি।উনার যত্নের কোনো ত্রুটি আমি রাখিনি আমার বাসায় এই দুই বছরে।

আমার মেয়ে  পর্ব ৭

আমার মেয়ে তুলিও দাদীকে খুব পছন্দ করে।
আমি কখনো চাই না,আমার মেয়ের মনে তার দাদী সম্পর্কে কোনো খারাপ ধারণার সৃষ্টি হোক।
তাই অনেক বছর ধরে এই ডায়েরীটা সযত্নে লুকিয়ে রেখেছি আমি তুলির কাছ থেকে।আজ হঠাৎ মনে হতেই ডায়েরীটা বের করে পুরোনো দিনের লেখাগুলো পড়লাম।

তুলির পরে আমার ঘরে আর কোনো সন্তান দেননি আল্লাহ।তাতে আমার বা রাশেলের কোনো আফসোসও নেই।
আমার মেয়ে গর্ভে আসার পরপরই মাস্টার্সের পরীক্ষার জন্য পড়া থেকে শুরু করে এই মেয়েকে জন্ম দেওয়ার আগ পর্যন্ত যতটা স্ট্রাগল আমি করে এসেছি সেটা আমার স্বার্থক,যখন দেখি আমার মেয়েটি মানুষের মতো মানুষ হচ্ছে।এই বয়সেই সংসার চালানোর সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে নিজের ঘাড়ে।
আমি মনে মনে গর্বিত হই, যখনই ভাবি তুলি আমার মেয়ে!হ্যাঁ #আমার_মেয়ে!
আমার শাশুড়ীকে অবশ্য এখনো মাঝেমাঝে আফসোস করতে দেখা যায়,
–“আহা,রাশেল!তোর ঘরে আল্লাহ একটা পোলাও দিলো না!”
শাশুড়ীর আফসোস শুনে আমি আপন মনেই হেসে উঠি।

সমাপ্ত

1 COMMENT

  1. অসাধারণ… বলার কোনো ভাসাই রাখে না এমন একটা স্টোরি,,,আপনার লেখাটা পড়ে সত্যি আমি এখনও খানিকটা শকের মধ্যে আছি,, সত্যি আপনাদের সমাজে আজও এরকম অনেক কু-প্রথাই প্রচলিত রয়েছে,,, আপনার লেখা গল্প হয়ত এমন আরো অনেক রাকার মনোবল বাড়িতে দেবে,,, আরো অনেক রাসেল অন্যায়ের সমর্থন ছেড়ে ন্যায় এর পথ বেছে নেবে।।

Comments are closed.