আমি পদ্মজা সিজন ২ পর্ব ৭১+৭২+৭৩+৭৪+৭৫

আমি পদ্মজা সিজন ২ পর্ব ৭১+৭২+৭৩+৭৪+৭৫
ইলমা বেহরোজ

সকালের ঘন কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে প্রকৃতি। কাঠের দুই তলা বাড়ির উঠানে শুটিং দলের সবাই বসে আছে। হিমেল হাওয়ার সঙ্গে আসা কনকনে শীত সবাইকে কাবু করে ফেলেছে। সবার মুখ থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। শাকিল নামে একটা ছেলে উঠানের মাঝে আগুন ধরালো। লিখন আগুন থেকে তাপ নেয়। তীব্র ঠান্ডার জন্য শুটিং এগোচ্ছে না। বার বার পিছিয়ে যাচ্ছে। সূর্য যখন আকাশে উদিত হয়,মৃদুলের দেখা মিলে। সে লিখনের সাথে করমর্দন করে বললো,’কেমন আছো ভাই?’
লিখন হেসে বললো,’ভালো। এই শাকিল,একটা চেয়ার দিয়ে যাও।’
শাকিল চেয়ার দিয়ে যায়। মৃদুল বসলো। দুজন বড়ই গাছের নিচে বসে আছে। সেখান থেকে অলন্দপুরের বড় সড়ক দেখা যায়। লিখন বললো,’ তারপর কেমন আছো?’
‘জি ভাই,ভালো আছি। একটা দরকারে আইছি ভাই।’
লিখন মৃদুলের দিকে মুখ করে বসলো। মৃদুল লজ্জা পাচ্ছে। লিখন বললো,’পূর্ণার ব্যাপারে কিছু?’
মৃদুলের অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সত্যি সে লজ্জা পাচ্ছে। ঘাড় ম্যাসেজ করতে করতে বললো,’পূর্ণারে কেমনে কী বলতাম বুঝতাছি না। একটু বইলা দেও।’
লিখন সশব্দে হাসলো। মৃদুলের সাথে যতবার তার দেখা হয় ততবার সে হাসতে বাধ্য! মৃদুল বললো,’আমির ভাই আর তুমি এসব অনেক ভালো বুঝো। আমির ভাইরে ডর লাগে তাই তোমার কাছে আইছি।’
লিখন বললো,’এটা কোনো ব্যাপার?’

তারপর দূরের পথে চেয়ে বললো,’আমার একটা ইচ্ছে ছিল। শীতের জ্যোৎস্নায় নৌকা নিয়ে মাঝ নদীতে যাব। নৌকায় আমি থাকব আর আমি যাকে ভালোবাসি সে থাকবে। চারিদিকে জ্যোৎস্না টুপটুপ করে পড়বে, সে সময়টাকে সাক্ষী রেখে বিয়ের প্রস্তাব দেব। মনের সব অনুভূতি জানাব। কিন্তু আমার ভাগ্যে সেই সময়টা আসেনি। তুমি চেষ্টা করতে পারো।’
লিখনের কথা মৃদুলের খুব পছন্দ হয়। সে প্রফুল্লিত হয়ে বললো,’সুন্দর বলছো ভাই।’
তারপরই মুখ গুমট করে বললো,’কিন্তু এখন তো জ্যোৎস্না নাই।’
‘শুনেছি,শুক্রবার জ্যোৎস্না রাত। আমাদের জ্যোৎস্না নিয়ে কাজ আছে।’
‘নায়িকারে ভালোবাসার কথা বলবেন নাকি?’
‘না,নায়িকা মারা যাবে।’
মৃদুল উঠানের দিকে তাকিয়ে বললো,’ভাই,নায়িকা কোনডা?’
লিখন আঙুলের ইশারায় একটা মেয়েকে দেখিয়ে বললো,’নীল শাল পরা মেয়েটা।’
মৃদুল মেয়েটাকে দেখে বললো,’এ তো আসমানের পরী।’
লিখন হাসলো। বললো,’পূর্ণার সামনে এই কথা বলিও না।’
দুজন একসাথে হাসলো। আরো অনেক কথা বললো। মৃদুল কথার ফাঁকে খেয়াল করেছে যে মেয়েটিকে লিখন নায়িকা বলেছে,সে মেয়েটি বার বার লিখনের দিকে তাকাচ্ছিল। দৃষ্টি অন্যরকম। মৃদুল লিখনকে বললো,’ ভাই,নায়িকা বোধহয় তোমারে পছন্দ করে।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

লিখন ফিরে তাকাতেই, মেয়েটি দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়। লিখন মৃদুলকে বললো,’আর ওদিকে তাকিও না। তোমার ধারণা সত্যি।’
মৃদুল উৎসুক হয়ে এগিয়ে আসে। আগ্রহ নিয়ে বলে,’উনার নাম কী?’
‘ফারহিন তৃধা।’
‘মাশল্লাহ, নামের মতোই সুন্দর। তোমার সাথে কিন্তু মানাবে।’
লিখন স্মিত হেসে বললো,’মানায় তো কতজনের সাথে আমরা কি সবাইকে পাই?’
মৃদুল ‘না’ সূচক মাথা নাড়াল। লিখন বললো,’তৃধা ছেলেমানুষ। নতুন এসেছে মিডিয়া জগতে। শুনেছি,আমার জন্য নাকি মিডিয়া জগতে এসেছে। আমি যাকে ভালোবাসি তাকে ভুলিয়ে দিয়ে নিজে জায়গা করে নিবে। এটা কি ছেলেমানুষি ভাবনা নয়?’
লিখন হাসলো। হাসলো মৃদুলও। লিখন বললো,’আমরা জীবনে অনেক কিছু চাই। সব কিন্তু পাই না। এটা সম্ভব নয়। আমার কী নেই? সব আছে। কিছুর অভাব নেই। শুধু একটা অংশই ফাঁকা। সে অংশটা কখনো পূর্ণ হবে নাকি জানি না। পূর্ণ হবে একদিন,এটা ভাবাও ঠিক নয়। কারণ যাকে চাই সে পরস্ত্রী! তবুও মন ভেবে ফেলে। যদিও এই আশা পূর্ণ হয়, আমার বর্তমানে যা কিছু আছে তা থেকে কিছু একটা হারিয়ে যাবে। এটাই দুনিয়ার নিয়ম। নিয়তি। কিছুর অভাব না থাকলে,তুমি কার পিছনে দৌড়াবে? কীসের আশায় বাঁচবে? অপূর্ণতা একধারে সৌভাগ্য আবার দূর্ভাগ্য।’
‘তুমি অনেক বুঝো ভাই।’

‘এইযে তৃধা পাগলামি করে,আমি কিন্তু মানা করি না। তালও দেই না। পাগলামি করে যদি নিজের মনকে তৃপ্ত রাখতে পারে তবে করুক না। সে তো জানে,আমার মন অন্যখানে ছুটে।’
‘কতদিন অবিবাহিত থাকবা? এইবার বিয়ে করে নেও।’
‘আম্মা,চিঠি পাঠিয়েছেন। কোন রাজনীতিবিদের মেয়ের সাথে বিয়ের কথা চলছে। এইবার ফিরে বিয়ে করতেই হবে। নয়তো নাকি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করবেন। এটা কোনো কথা?’
‘এইবার বিয়ে কইরা নেওয়া দরকার। খালাম্মারও তো ইচ্ছে করে ছেলের বউ দেখার।’
‘মৃদুল তুমি সব জানো। তুমি খুব ভালো ছেলে। ভালোবাসাও বুঝো। তাই তোমার সাথে কিছু বলি। পদ্মজা শুধু একটা নাম না। আমার মনে হয় পদ্মজা শব্দটা একটা প্রাণ! আমার বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। আমি খুব খারাপভাবে পদ্মজাতে ফেঁসে গেছি। আমার মাঝে মাঝে দম বন্ধকর কষ্ট হয়। তখন চেষ্টা করি,পদ্মজা নামক মায়াজাল থেকে বেরোতে। কিন্তু পারি না। এই যে বেঁচে আছি,প্রতি মুহূর্তে মনে হয় পদ্মজা আসবে একদিন আমার কাছে আসবে। মানুষ তো আশা নিয়েই বাঁচে। আশা পূরণ না হউক। আশা রাখতে তো দোষ নেই। বাঁচতে তো হবে। তৃধা আমাকে ভালোবাসে। আমি বুঝি। যখন শুটিং চলে,মুখস্থ ডায়লগগুলো তৃধা মন থেকে অনুভব করে আমাকে বলে। কিন্তু আমি কিছু করতে পারি না। আমার তখন খারাপ লাগে। আমি নিজে একজনের প্রেমে ব্যাকুল। তাই অন্য কারো ব্যাকুলতা আমি বুঝি। এখন আমি পদ্মজার অনুভূতিও বুঝি। পদ্মজার জায়গায় আমি দাঁড়িয়েছি। তৃধা আমাকে পদ্মজার অনুভূতি বুঝিয়ে দিয়েছে। আমি তৃধাকে যেমন মনে জায়গা দিতে পারি না,পদ্মজাও আমাকে দিতে পারে না। পদ্মজা আমির হাওলাদরকে খুব ভালোবাসে। আমি নিজের ভালোবাসার সাথে তাদের ভালোবাসাকেও সম্মান করি। তাদের ভালোবাসা অতুলনীয়। বুকে একটু জ্বালাপোড়া হয় ঠিক তবে এটাই বাস্তবতা! তৃধার জন্য আমার মায়া হয়,মেয়েটা অন্য কাউকে ভালোবেসে সুখি হতে পারতো। ঘুরেফিরে এমন কাউকে ভালোবেসেছে যে অন্য কাউকে ভালোবাসে। আমার মত হয়তো পদ্মজাও ভাবে। তৃধার ভালোবাসাকেও আমি সম্মান করি। সে সত্যি মন উজাড় করে আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু আমার পক্ষ থেকে সাড়া দেয়া সম্ভব নয়। এমনকি আমি তৃধাকে জায়নামাজে বসে কাঁদতেও দেখেছি। তবুও আমার মনে ভালোবাসা জন্মায়নি। ভালোবাসা খুব কোমল আবার খুব শক্তও। কিছু মানুষ একজনকেই ভালোবাসার জন্য জন্মায়। অন্য কারো ভালোবাসা তাকে ছুঁতে পারে না। তার মধ্যে আমি একজন। হয়তো পদ্মজাও তার মধ্যে আরেকজন। এটা ভাবতেও খারাপ লাগে। তৃধা ভালোবাসে আমাকে,আমি ভালোবাসি পদ্মজাকে,পদ্মজা ভালোবাসে আমির হাওলাদরকে! সবার ভালোবাসাই সত্য! কি কাণ্ড! এই পৃথিবীর সুখী মানুষ কারা জানো? তোমার মতো মানুষেরা।’

মৃদুল মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছে। সে অবাক হয়ে বলে,’আমার মতো?’
‘হুম,তোমার মতো। তুমি পূর্ণাকে ভালোবাসো,পূর্ণাও তোমাকে ভালোবাসে। তোমাদের তৃতীয় ব্যক্তির যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় না। এই ভালোবাসাকে কখনো হারাতে দিও না। কপাল গুণে যাকে চাও সেও তোমাকে চায়। কখনো অসম্মান করো না,ধরে রেখো। ভালোবাসা খুব দামী! যা সবাই পায় না। আমাদের জীবনে মা-বাবা,নানা-নানি,দাদা-দাদি, ভাই-বোন অনেক মানুষ আছে। যারা আমাদের ভালোবাসে। তবুও আমরা জীবনসঙ্গীর জন্য পাগল হই। তার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আকুল হয়ে থাকি। তার ভালোবাসা ছাড়া নিজেকে শূন্য মনে হয়! এই মায়া পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে হয়ে এসেছে। আমিও তেমন একজনের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আকুল হয়ে আছি। ঝাপসা ভোরে হাঁটছি। এই জায়গাটা অন্য কাউকে দেয়া সম্ভব নয়। তাই আমি বিয়ে করব না। কোনো মেয়েকে জীবন্ত হত্যা করার অধিকার নেই আমার। আমাকে যে বিয়ে করবে সে সুখি হবে না। আমি পারব না। আমি স্বামী হিসেবে ব্যর্থ হয়ে যাবো। কলঙ্ক লেগে যাবে। আমি সেটা হতে দেব না। মনে একজনকে রেখে আরেকজনকে বিয়ে করে তাকে সুখি করা একটা চ্যালেঞ্জ। আমি এই চ্যালেঞ্জটা নিতে পারবো না। কারণ,আমি শতভাগ নিশ্চিত এই চ্যালেঞ্জে আমি হেরে যাব। যে যাই ভাবুক। একাই জীবন কাটিয়ে দেব। ভালোবেসে যাওয়াতেও শান্তি আছে। নিজের স্বার্থে সেই শান্তি আমি নষ্ট করব না। বিয়ের কথা আর কখনো বলো না। আম্মাকে আমি সামলে নেব। তুমি পূর্ণাকে দ্রুত বিয়ে করে নাও। যাই হয়ে যাক। কেউ কারো হাত ছাড়বে না। একজন পিছিয়ে গেলেই কিন্তু সব শেষ।’

মৃদুল লিখনের এক হাত ধরে বললো,’ভাই,তোমারে কী বলবো আমি বুঝতাছি না। কিন্তু পূর্ণারে আমি মরে গেলেও ছাড়ব না। আমি আমার সৌভাগ্য ধরে রাখব।’
লিখন মৃদুলের কাঁধে হাত রেখে বললো,’ভালো প্রেমিক হয়ে উঠো,ভালো স্বামী হয়ে উঠো। তুমি বসো। শুটিং শুরু হবে। পরে আবার কথা হবে।’
‘যাও ভাই।’
শুটিং শুরু হয়। মৃদুল উঠে আসে। তৃধা নামক সুন্দরী মেয়েটির পরনে শাড়ি। কোমর সমান লম্বা চুল। রূপে কোনো কমতি নেই। তাও তৃধা লিখনের আকর্ষণ পাচ্ছে না। ভালোবাসা এতো অদ্ভুত কেন হয়?
মৃদুল তৃধাকে খেয়াল করে। তৃধার লিখনের দিকে তাকানোর দৃষ্টি অভিনয় নয়,একদম পূর্ণার মতো। পূর্ণা যেভাবে তার দিকে তাকায়। ঠিক সেরকম। লিখন তৃধার হাতে ধরতেই তৃধার চোখেমুখে একটা আনন্দ ছিটিয়ে পড়ে। একমাত্র শুটিংই পারে তাকে লিখনের কাছাকাছি নিয়ে আসতে। মৃদুলের শরীরটা কেমন করে উঠে। ভালোবাসার জগতে কত রূপের ভালোবাসা রয়েছে! পূর্ণার কথা খুব মনে পড়ছে। মৃদুল লিখনকে না বলেই বেরিয়ে পড়ে। বড়ই গাছের নিচে দুটো খালি চেয়ার পড়ে থাকে। চারিদিকে মিষ্টি রোদ ছড়িয়ে পড়েছে।

সকাল সকাল পূর্ণা,প্রেমা,বাসন্তি, প্রান্ত সবাই মিলে হাওলাদার বাড়িতে চলে আসে। সবাই খুব চিন্তিত। তারা নিজের চোখে পদ্মজাকে দেখতে চায়। পদ্মজার গলায় মাফলার পরেছে,যেন গলার দাগ দেখা না যায়। তার ঘরের সামনে একজন লোক সবসময় ঘুরঘুর করছে। আমির পাহারাদার রেখেছে। এছাড়া নজর রাখার জন্য লতিফা তো আছেই। পূর্ণা,প্রেমা ঘরে ঢুকেই চিৎকার করে আপা’ বলে পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরলো। পদ্মজা যেন প্রাণ ফিরে পায়। খুশিতে তার চোখে জল চলে আসে। সে দুই বোনের মাথায় চুমু দিয়ে বলে,’আমার বোনেরা।’
পদ্মজার গালের ক্ষতস্থান সবার আগে প্রেমা খেয়াল করলো। সে প্রশ্ন করলো,’আপা,তোমার গালে কী হয়েছে?’
পদ্মজা হাসার চেষ্টা করে বললো,’ব্যথা পেয়েছি।’
পূর্ণা পদ্মজার ক্ষতস্থান ছুঁয়ে বললো,’আপা,এতোটা কেমন করে হলো? কবে হলো?’
আমির ঘরে প্রবেশ করে। পূর্ণার জবাব দেয়,’ঢাকা যাওয়ার পথে দূর্ঘটনা ঘটে।’
পদ্মজা আমিরের দিকে তাকালো। রাতের পর আর তার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি। ফজরে অন্দরমহলে রিদওয়ান নিয়ে এসেছে। আমির পদ্মজার দিকে তাকালো না। সে টেবিলের উপর থেকে একটা কলম তুলে নিল। তারপর ‘আসছি’ বলে চলে যায়। পদ্মজার মুখে বসিয়ে গেছে,বানানো কথা। পূর্ণা উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করে,’আপা,দূর্ঘটনা মানে? কেমনে কী হলো?’
পদ্মজার মিথ্যে বলতে অস্বস্তি হচ্ছে। সে বললো,’যা হয়ে গেছে হয়েই গেছে। এখন তো ভালো আছি। দূর্ঘটনা মনে রাখতে নেই। এসব নিয়ে কোনো আলোচনা না।’
পূর্ণার খুব কষ্ট হচ্ছে। পদ্মজার ফর্সা গালে ক্ষতটা ভেসে আছে। ভয়ানক দেখাচ্ছে। পূর্ণা পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরে। পদ্মজা টের পায় পূর্ণা কাঁদছে। পূর্ণা এত কেন ভালোবাসে! পদ্মজা পূর্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,’কাঁদে না। এইটুকুর জন্য কেউ কাঁদে?’

পূর্ণা কান্নামাখা স্বরে বললো,’মনে হচ্ছে,আমি ব্যথা পেয়েছি।’
পদ্মজা পূর্ণাকে সামনে দাঁড় করায়। পূর্ণার দুই গালে হাত রেখে বলে,’ আমার কাঁদুনিরে।’
পূর্ণা হাসে,তার সাথে পদ্মজাও হাসে। হাসে প্রেমা,প্রান্ত,বাসন্তি। পদ্মজার পাতালঘরে থাকা মেয়েগুলার কথা মনে পড়ে যায়। সেই মেয়েগুলোরও মা-বোন-বাবাও তো অপেক্ষা করে আছে। আশায় আছে,একদিন তাদের মেয়ে,বোন ঘরে ফিরবে। পদ্মজার বুক ফুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। কিছুতেই মেয়েগুলোকে কুরবানি হতে দেওয়া যাবে না। সে তার সবকিছু ত্যাগ করে হলেও বাঁচাবে!
পূর্ণারা দুপুরে চলে যায়। আমির ঘরে আসে। দরজা থেকে পদ্মজাকে বলে,’কারো কাছে কিছু বলার চেষ্টা করবে না। বোনদেরও না। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে। কাউকে কিছু বললে তোমার বোনদের ক্ষতি হবে। বাইরে শান্টু আছে। বাড়ির গেইটেও দুজন আছে। বাইরে থেকে কেউ যেন না আসে। শুধু তোমার পরিবার ছাড়া। বেরোবার চেষ্টা করো না।’
আমির কথা শেষ করে ঘুরে দাঁড়ায়। পদ্মজা প্রশ্ন করে,’আম্মার কাছে আমাকে যেতে দেয়া হচ্ছে না কেন? আম্মা অসুস্থ। উনাকে আমি দেখতে চাই।’
‘বলে দিচ্ছি,যেতে দিবে।’
‘পূর্ণাকে বিয়ে দিতে চাই। খুব দ্রুত। প্রেমাকেও।’
আমির ঘুরে দাঁড়ায়। বললো,’প্রেমাকেও কেন?’
‘আমার ভবিষ্যৎ আমি জানি না। হয় জেল নয় মৃত্যু। কিছু একটা হবেই।’
তাৎক্ষণিক আমির কিছু বলার মতো খুঁজে পেল না। সময় নিয়ে বললো,’মৃদুল আর পূর্ণাকে গতকাল সন্ধ্যায় মেলায় দেখেছি। মৃদুলের সাথে কথা বলতে পারো।’
পদ্মজা অবাক হয়ে জানতে চাইলো,’সত্যি? কী করছিল?’
‘মেলায় কী করতে যায়?’
পদ্মজা বুঝতে পারে। সে বললো,’ছোট ভাই আপনার মতো না তার কোনো নিশ্চয়তা আছে?’
‘মৃদুল আমাদের বংশের না। তাই আমার সাথে নেই। বাইরে কিছু করে নাকি জানি না।’
পদ্মজার জবাব না শুনেই আমির চলে যায়। পদ্মজা ভাবতে বসে। মৃদুল অনেক সুন্দর একটা ছেলে। সে কি পূর্ণাকে সত্যি ভালোবাসে? নাকি এমনি ঘুরতে গিয়েছিল। একটা ছেলেমেয়ে এমনি তো মেলায় ঘুরতে যাবে না। তাদের সমাজ তো এমন নয়। পদ্মজা দৌড়ে বেরিয়ে আসে। আমিরকে ডাকলো,’শুনুন।’
আমির দাঁড়াল। পদ্মজা বললো,’আমি ছোট ভাইয়ের সাথে কথা বলতে চাই।’
‘সন্ধ্যায় কথা হবে। আমার সামনে।’

ফরিনার অবস্থা করুণ। পদ্মজা সব জেনে গেছে জানার পর অসুস্থতা কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। মৃত্যুর প্রহর গুণছেন। পদ্মজা ঘরে ঢুকে দেখে, ফরিনা চোখ বুজে শুয়ে আছেন। পদ্মজা ফরিনার শিয়রে গিয়ে দাঁড়াল। ডাকলো,’আম্মা?’
ফরিনার বুক ছ্যাৎ করে উঠলো। তিনি চট করে চোখ খুললেন। চোখ ভরে উঠে জলে। তিনি উঠতে চান,পদ্মজা ধরে। ফরিনা কেঁদে উঠলেন। কেঁদে উঠে পদ্মজাও। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদে। ফরিনা চোখের জল মুছে বললেন,’আজরাইল আমার ঘরে ঘুরতাছে। তোমারে না দেইখা আমি কেমনে মরি কওতো?’
‘এসব বলবেন না আম্মা। আমার মা নেই। আপনি আমার মা।’
ফরিনা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন,’এহন আমি শান্তিতে মরতে পারুম। তোমারে আমার অনেক কথা কওনের আছে।’
পদ্মজা ফরিনার এক হাত মুঠোয় নিয়ে ভেজাকণ্ঠে বললো,’আপনার ছেলের সম্পর্কে সব জানি আম্মা। আমার বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হয়েছে।’
ফরিনায় ঘৃণায় কপাল কুঁচকে ফেললেন। বললেন,’বাবু আমার গর্ভরে কলঙ্কিত করছে।’
‘আপনি উত্তেজিত হবেন না আম্মা।’
‘আমি তোমারে কইতে গিয়েও কইতে পারি নাই। আমারে মাফ কইরা দেও। তোমার জীবনটা আমার কুলাঙ্গার সন্তানের লাইগগা নষ্ট হইয়া গেছে। ও মা,ওরা তোমারে মারছে?’

‘না আম্মা,আমাকে কেউ মারেনি। আপনি শান্ত হোন। আমি চলে এসেছি,আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন। আপনার আর কষ্ট হবে না।’
ফরিনা চোখ বড় বড় করে তীব্র ঘৃণা আর রাগ নিয়ে বললেন,’আমি যদি মইরা যাই। তুমি বাবুর বাপের মাথাডা কাইটটা আমার কবরে রাইখা আইবা। আমার আদেশ এইডা। তাইলে আমার আত্মা শান্তি পাইবো।’
ফরিনা ছটফট করছেন। শ্বাস নিচ্ছেন অনেক কষ্টে। রাগে শরীর কাঁপছে। বিছানায় দূর্গন্ধ। চোখ মুখ শুকিয়ে একটু হয়ে গেছে। পদ্মজা দুই হাতে ফরিনাকে জড়িয়ে ধরলো শান্ত করার জন্য। বলে,’আম্মা,শান্ত হোন। আল্লাহ সব পাপের জন্য শাস্তি আগে থেকেই বরাদ্দ করে রেখেছেন। সবার শাস্তি হবে। হতেই হবে।’
‘শুয়ো** বাচ্চা আমার সাথে কী করছে আমি তোমারে কইতে চাই। তুমি হুনো আমার কথা।’
‘সব শুনবো আম্মা। সব শুনবো। লতিফা বুবু বললো,খাবার নাকি খাচ্ছেন না। এখন খাবেন। ঔষধ খাবেন,ঘুমাবেন। তারপর একটু সুস্থ হয়ে সব বলবেন। আপনার গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। কাঁপছেন আপনি। শান্ত হোন আপনি।’

ফরিনা আবোলতাবোল বলতেই থাকেন। মানুষটার মৃত্যু যেন ঘনিয়ে এসেছে। পদ্মজা বিছানা পরিষ্কার করে। ফরিনার শরীর মুছে দেয়। নতুন শাড়ি পরিয়ে খাইয়ে দিল। তারপর জোর করে ঘুম পাড়িয়ে,লম্বা করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। মানুষটার অতীত কতোটা ভয়ংকর সে জানে না। তবে শুনতে চায়। সবকিছু জেনে বড় কোনো উদ্যোগ নিতে হবে। পদ্মজার নিজের মায়ের একটা কথা মনে পড়ছে। তিনি সবসময় বলতেন “প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনো উদ্দেশ্যে জন্মগ্রহণ করে।”
যদি এই কথাটি সত্য হয়। তবে হাওলাদার বংশের শেষ পুরুষদের ধ্বংস করাই তার জন্মের উদ্দেশ্য! সে শতভাগ নিশ্চিত!
সন্ধ্যা নেমেছে কিছুক্ষণ পূর্বে। আজ আকাশ পরিষ্কার। কুয়াশা নামেনি। সন্ধ্যার নামায আদায় করে পদ্মজা নিজ ঘরে বসে আছে। অপেক্ষা করছে মৃদুলের জন্য। নিস্তব্ধতা ভেঙে পায়ের শব্দ ভেসে আসে। আমির ঘরে প্রবেশ করে। পদ্মজার থেকে দূরত্ব রেখে চেয়ারে বসে। তারপর প্রবেশ করলো মৃদুল। মৃদুলের বুক কাঁপছে। সে চিন্তিত। পদ্মজা মৃদুলকে সালাম দিল। তারপর বললো,’বসুন ছোট ভাই।’

মৃদুল বসলো। সে বুঝতে পারছে না কী হতে চলেছে। শঙ্কিত সে। গোপনে ঢোক গিলে একবার আমিরকে আরেকবার পদ্মজাকে দেখলো। পদ্মজা বললো,’কেমন আছেন?’
মৃদুলের অস্বস্তি হচ্ছে। সে দ্রুত জবাব দিল,’ভালো আছি ভাবি। কোনো সমস্যা হইছে?’
‘না,কোনো সমস্যা হয়নি। কেমন লাগছে এখানে? খাওয়া-দাওয়া ঠিকঠাক হচ্ছে?’
‘জি ভাবি,সব ঠিক আছে। ভালো লাগছে। রানি আপার কথা খুব মনে পড়ে।’
পদ্মজা আক্ষেপের স্বরে বললো,’রানি আপা কেন যে এমন করলো! যদি ফিরে আসতো।’
মৃদুল নিরুত্তর। পদ্মজা আমিরের দিকে তাকালো। আমির নিশ্চুপ। সে এই আলোচনায় যাবে না। পদ্মজা মৃদুলকে বললো,’আচ্ছা সোজাসুজিভাবেই কথা বলি। পূর্ণার সাথে আপনার সম্পর্কটা কী?’
পদ্মজার প্রশ্ন শুনে মৃদুলের দম গলায় এসে আটকে যায়। সামনে বড় ভাই আমির হাওলাদার। যাকে সে ভয় পায়। প্রশ্ন করছে,পূর্ণার বড় বোন। যে বোনকে পূর্ণা সবচেয়ে বেশি ভয় পায় আর ভালোবাসে। এমন পরিস্থিতিতে যারা পড়েছে তারাই বুঝবে তখন কেমন অনুভূতি হয়। মৃদুলকে চুপ করে থাকতে দেখে পদ্মজা বললো,’বলুন ছোট ভাই।’
মৃদুল বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে আবার ছাড়ল। তারপর বললো,’কোনো নাম নাই। আমি পূর্ণারে পছন্দ করি। আর পূর্ণা আমারে।’
পদ্মজার বুক থেকে ভারি বোঝাটা নেমে যায়। মৃদুল এক প্রশ্নে সত্য কথা বলতে পেরেছে ভেবে আনন্দ হচ্ছে। কথাবার্তা বাড়ানো সম্ভব নয়। হাতে সময় নেই। তাই সে নড়েচড়ে বসে বললো,’ আপনি বা আপনার পরিবার বিয়ের জন্য প্রস্তুত আছেন? পূর্ণাকে বিয়ে করতে চান?’

মৃদুল আবারো আমির-পদ্মজাকে দেখলো। আমির তার দিকে এক ধ্যাণে তাকিয়ে আছে। সে নীরব দর্শক। মৃদুল বুঝতে পারছে না,কীভাবে জবাব দিলে ভদ্র দেখাবে। প্রেমিকার অভিভাবকের সাথে কথা বলার জন্য আলাদা কলিজা লাগে! মৃদুল এক হাতে মাথা চুলকাল। পদ্মজার কেন যেন হাসি পায়। কিন্তু চোখেমুখে গাম্ভীর্য ধরে রাখে। এই মুহূর্তে সে পাত্রীর অভিভাবক! মৃদুল ধীরেসুস্থে বললো,’আম্মা,আব্বা অনেকদিন ধরেই বিয়ের কথা বলতাছে। আমি রাজি ছিলাম না। এখন রাজি আছি।’
পদ্মজা মৃদুলকে আগাগোড়া পরখ করে নিয়ে বললো,’বিয়ের ক্ষেত্রে গায়ের রঙ নিয়ে আপনার মতামত কী?’
প্রশ্ন শুনে মৃদুল থতমত খেয়ে গেল। মনে হচ্ছে,সে পরীক্ষা দিতে এসেছে। মেট্রিক পরীক্ষায় যা পারেনি, লিখেনি। চুপচাপ বসে সময় গুণেছে কখন ছুটি হবে। কিন্তু এখন তো জিততেই হবে। জীবন মরণের প্রশ্ন! সকালে যে কার মুখ দেখে উঠেছিল! মৃদুল মুখখানা একটুখানি করে বললো,’ জানি না ভাবি। আমার চোখে আগে কালা-সাদার ভেদাভেদ ছিল। কিন্তু এখন নাই। কেন নাই,জানি না। হুট করেই মনে হইতাছে,চামড়ায় যায় আসে না। মনের টানটা আসল। যারে ভালোবাসা যায় তার সবকিছুই ভালোবাসা যায়। সব কিছুর উপরে ভালোবাসা। ভালোবাসার সামনে সবকিছু তুচ্ছ।’
মৃদুলের কথা শুনে পদ্মজার বুকটা কেমন করে উঠে। সে আড়চোখে আমিরের দিকে তাকালো। আমিরও আড়চোখে তাকায়। দুজনের চোখাচোখি হতেই আমির উঠে চলে যায়। মৃদুল ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। বললো,’ভাবি ভুল কিছু কইছি? ভাই রাগ কইরা চলে গেল?’

পদ্মজা লুকানো যন্ত্রণা হজম করে নিয়ে বললো,’ভালো কথা বলেছেন। আমি কথা বাড়াব না। পূর্ণাকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক হলে,দ্রুত নিজের বাড়ি ফিরে যান। অভিভাবক নিয়ে আসুন। আমি আমার বোনকে বিয়ে দেব। আপনার পরিবার রাজি থাকলে আমার আপত্তি নেই। আমার বোন আমার দায়িত্বে। আমি চাই না সে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে দীর্ঘদিন থাকুক। আশা করি দ্রুত সবকিছু হবে।’
মৃদুল খুব অবাক হয়। সে ভেবেছিল,পদ্মজা রাজি হবে না। তাকে রাজি করাতে অনেক কাঠখড় পুড়াতে হবে। কিন্তু পদ্মজা তো রাজি। মৃদুলের
নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হতে থাকে। সকালে কোন সৌভাগ্যবানের মুখ দেখে উঠেছিল মনে করতে পারলে, সে তাকে একটা খাসি দিবে বলে ভাবে। মৃদুল চট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে পদ্মজাকে সালাম করতে ঝুঁকলো। পদ্মজা আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব হয়ে যায়। সে দ্রুত বিছানার উপর পা তুলে ফেললো। আর বললো,’আসতাগফিরুল্লাহ! ছোট ভাই আপনি আমার বড়।’
মৃদুল আনন্দে আত্মহারা। তার মধ্যে প্রবল উত্তেজনা কাজ করছে। কী করবে না করবে বুঝে উঠতে পারছে না। এতো দ্রুত হুট করে এমন সুন্দর প্রস্তাব পাবে,সে ভাবেনি। ঠোঁটে হাসি রেখে বললো,’আমি শনিবারেই বাড়িত যামু। রবিবারেই আম্মা,আব্বারে নিয়া আসব। আপনি চিন্তা কইরেন না।’
মৃদুলের নিঃশ্বাস শোনা যাচ্ছে। সে ভীষণ উত্তেজিত বোঝাই যাচ্ছে। পদ্মজা পানি খেতে বললো। মৃদুল পানি পান করে। তারপর বললো,’আসি ভাবি?’

‘যান। আল্লাহ আপনার ভালো করুক।’
মৃদুল তাড়াহুড়ো পায়ে বেরিয়ে যায়। পদ্মজা হাসে। মৃদুল একদম পূর্ণার মতো। ছটফটে, চঞ্চল। আমির জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। পদ্মজাকে হাসতে দেখে তার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে। ধীর পায়ে জায়গা ত্যাগ করে বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়ায়। দূর আকাশে চোখ রেখে কী যেন ভাবে। তখন রিদওয়ান আসে। আমিরকে জানায়,’শুক্রবারে সমাবেশ হচ্ছে না।’
আমির প্রশ্ন করলো,’কেন?’
‘শীতের কাপড় এখনো আসেনি। কালদিন পরই শুক্রবার।’
‘আব্বার কাজই এমন। ভাগ্য ভালো গ্রামবাসীকে আগে দাওয়াত দেয়া হয়নি। শুধু চেয়ারম্যানদের দেয়া হয়েছিল। সমাবেশ যে হচ্ছে না তাদের জানানো হয়েছে ?’
‘হয়েছে। তুই কি আমার সাথে বের হবি?’
‘আমি অন্যদিকে যাব।’
‘রাতের ঘটনা শুনলাম। আরভিদের লাশটা কী করা হয়েছে?’
‘যা করা হয় তাই করা হয়েছে। বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য সম্ভব হয়নি।’
‘আমি ঘুমে না থাকলে এমন কিছুই হতো না।’
আমিরের মেজাজ বিগড়ে যায়। বললো,’তো ঘুমালি কেন?’
‘তুই বউয়ের প্রতি দরদ দেখিয়ে আমাদের দলের একজন বিশ্বস্ত,শক্তিশালীকে হারালি।’
আমির কিছু বললো না। রিদওয়ান বললো,’পদ্মজার বুকেও ডরভয় নাই। সব তোর দোষ!’
আমির ক্রোধ নিয়ে বললো,”আমার সাথে গলা উঁচিয়ে কথা বলবি না।’
‘কী করবি? মারবি? মার।’

আমির দাঁতে দাঁত লাগিয়ে কিড়মিড় করে বললো,’রিদওয়ান! মুখ নিয়ন্ত্রণ কর। নয়তো বিছানায় না, সোজা কবরে যাবি। পুরনো প্রতিশোধ
নিয়ে নেব।’
রিদওয়ান আমিরের দিকে অগ্নি দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে চলে যায়। আমির গ্রিল খামচে ধরে। তার কপাল থেকে ঘাম ঝরতে থাকে। রেগে গেলেই তার কপাল ঘামে!
ফরিনার ঘর অন্ধকারে ডুবে আছে। মজিদ হাওলাদার আলাদা থাকেন। পদ্মজা ঘরে ঢুকে আগে হারিকেন জ্বালাল। বিছানার এক কোণে রেখে ফরিনার পাশে বসলো। ফরিনা ঘুমাচ্ছেন। নিশ্বাস নিচ্ছেন ঘন ঘন। দেখে মনে হচ্ছে,কেউ রূহর গলা চেপে ধরে রেখেছে। ফরিনা নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য ছটফট করছেন। পদ্মজার বুকটা ব্যথায় ভরে উঠে। সে ফরিনার চুলে বিলি কেটে দেয়। আরেক হাতে ফরিনার এক হাত শক্ত করে ধরে। হাত দুটো নিস্তেজ,নরম! যেন মরে গেছে। পদ্মজার কষ্ট হয়। মনে পড়ে প্রথম হাওলাদার বাড়িতে প্রবেশ করার কথা। কত মানুষ ছিল। লাবণ্য বিলেত পড়তে চলে গেল। শুনেছে,লাবণ্য বিলেতের এক ছেলেকে বিয়ে করতে চলেছে। আমির অনুমতি দিয়েছে। ফরিনা কষ্ট পেয়েছেন। রানি আপা কোথাও চলে গেল কে জানে! কষ্টের পরিমাণ কতোটা বেশি হলে একটা মানুষ এভাবে হারিয়ে যায়? মদনকে আজ সারাদিন দেখা যায়নি। কোথায় সে? ফরিনা চোখ খুললেন। পদ্মজাকে দেখে মৃদু হাসলেন। পদ্মজা বললো,’কেমন আছেন আম্মা? কোথায় কষ্ট হচ্ছে?’
ফরিনা পদ্মজার এক হাত ধরে বললো,’তুমি আইছো মা।’
‘আসছি আম্মা। কিছু লাগবে?’
ফরিনার কথা বলতে খুব কষ্ট হয়। সারা শরীরে আগুন পুড়ানো জ্বালাপোড়া। ঘরটাকে মৃত্যুপুরী মনে হয়। পৃথিবী তাকে আর রাখতে চাইছে না। ঠেলে যেন সরিয়ে দিচ্ছে অজানা জগতে। তিনি সময় নিয়ে বললেন,’কিছু লাগব না মা। তুমি আমার ধারে থাহো।’

পদ্মজা ফরিনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,’আছি আম্মা। আছি আমি।’
ফরিনা হারিকেনের নিভু আলোয় পুরো ঘরটাকে দেখলেন। পদ্মজাকে দেখলেন। আচমকা ডান পা বিরতিহীন কাঁপতে থাকে। তিনি পদ্মজার শাড়ি খামচে ধরে ভয়ার্ত স্বরে বললেন,’আমারে নিয়া যাইতাছে। আমারে ধরো পদ্মজা। আমারে ধরো। আমারে নিয়া যাইতাছে। যা,যা এখান থেকে যা।’
তিনি কাঁদতে থাকেন। পদ্মজা ভয় পেয়ে যায়। এক হাতে ফরিনার ডান পা চেপে ধরে। ধীরে ধীরে কাঁপাকাঁপি থেমে যায়। পদ্মজা দ্রুত ফরিনাকে পানি পান করালো। তারপর বললো,’কিছু হয়নি আম্মা। কেউ নেই এখানে। আপনি মিছেমিছি ভয় পাচ্ছেন।’
ফরিনা ভীত কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন,’কেউ নাই!’
‘না নেই। ঘুমানোর চেষ্টা করুন আম্মা।’
ফরিনা পদ্মজার দুই হাত আঁকড়ে ধরে চোখ বুজেন। পদ্মজা ছাড়া মানুষটার কেউ নেই। তিনি পদ্মজাকে কতোটা বিশ্বাস করেন,ভরসা করেন সেটা হাত ধরে রাখা দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
বসে থাকতে থাকতে পদ্মজার চোখ দুটি লেগে আসে। তখন ফরিনা চোখ খুলে বললেন,’আমার আম্মার নাম ফুলবানু আছিল। রামপুরার ছেড়ি।’
পদ্মজার ঘুম ছেড়ে যায়। সে নড়েচড়ে বসে। আরো একটি জীবনের গোপন অধ্যায়ের স্বাক্ষী হতে চলেছে পদ্মজা। ফরিনার চোখের দৃষ্টি ছাদে। তারা দুজন ছাড়া কোথাও কেউ নেই। বাইরে থেকে শেয়ালের হাঁক ভেসে আসছে।

ফুলবানু দেখতে সুন্দর ছিল বলে তার নাম ফুলবানু হয়। ফুলবানুর মা মারা যায়,যখন ফুলবানুর বয়স ছয়। বাবার আদরেই বড় হয়। যখন ফুলবানুর চৌদ্দ বছর বয়স তখন বনেদি এক পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে। তাদের যৌতুকের চাহিদা অনেক। তাও ফুলবানুর বাবা রাজি ছিলেন। জমিজমা,গরু-ছাগল বেঁচে মেয়ের বিয়ে দিলেন। একটাই যে মেয়ে ছিল। মেয়ের সুখই সব। ফুলবানুর সংসার দুই মাসের বেশি ভালো যায়নি। স্বামী চাপ দেয়,যৌতুকের জন্য। ফুলবানু সে খবর তার বাবার কাছে পাঠায়। ফুলবানুর বাবা শেষ সম্বল বাড়িটিও বিক্রি করে দেন। মেয়েকে সুখী করে নিজে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। বেছে নেন অনিশ্চিত জীবন। মানুষটার খবর আর পায়নি ফুলবানু। বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে সে জানে না। বিয়ের বছর খানেকের মাথায় জন্ম হয় ফরিনার। ফুলবানুর শ্বশুরবাড়ি অপেক্ষায় ছিল,ছেলের আশায়। মেয়ে দেখে তারা কপাল কুঁচকায়। এদিকে ফুলবানুর স্বামীর সম্পর্ক হয়েছে আরেক বনেদি ঘরের মেয়ের সাথে। যার বয়স ফুলবানুর স্বামীর চেয়েও বেশি। মেয়ে জন্ম দেয়ার অপরাধে ফুলবানুকে সহ ফরিনাকে রাস্তায় ফেলে দেয় তারা। ফুলবানুর স্বামী বিয়ে করে বনেদি ঘরের সেই মেয়েকে। যৌতুক দিয়ে ভরিয়ে দেয় ঘর! সেখানে এতিম ফুলবানুর জায়গা হয়নি কিছুতেই। রাস্তায় কত অমানুষ ছিঁড়ে খায় তাকে। তবুও রক্তাক্ত অবস্থায় ফুলবানু ধরে রাখে তার আদরের একমাত্র কন্যা ফরিনাকে। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে অলন্দপুরের বাজার বেছে নেয় ফুলবানু। এক পাগলির মেয়ে হিসেবে বড় হতে থাকে ফরিনা। বয়স বাড়তে বাড়তে বারোতে এসে ঠেকে। সেই সময়ে এক চন্দ্রহীন রাতে মজিদের শিকার হয় ফরিনা।

ঘোর অন্ধকারে ফরিনাকে নিয়ে আসা হয় পাতালঘরে। ছোট ফরিনা মুক্তির জন্য ছটফট করে। মজিদ তখন টগবগে যুবক। তার একেকটা থাবা ক্ষুধার্ত হিংস্র বাঘের মতো। ফরিনার ছোট্ট শরীর নির্মমভাবে কলুষিত হয়। রক্তাক্ত ফরিনা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকে পাতালঘরে। এরপরদিন চোখ খুলে মজিদের সাথে খলিলকে দেখতে পায়। আশেপাশে কয়েকজন পুরুষ ছিল। বাঁধা অবস্থায় ছিল চারটে মেয়ে। ফরিনার চোখের সামনে চারটা মেয়েকে বিভৎস ধর্ষণ করা হয়। ফরিনা ভয়ে কাঁপতে থাকে। সারা শরীরের ব্যথা ভুলে যায়। নৃশংসতার এই তাণ্ডব শেষ হওয়ার পর মজিদ ফরিনার কাছে আসে। তখন খলিল ফরিনাকে দেখে বললো,’ভাই,এই ছেড়ি তো ফুলবানুর।’
মজিদ প্রশ্ন করে,’কোন ফুলবানু?’
‘বাজারের পাগলিডা যে।’

হাওলাদার বাড়ির ছেলেরা ছেলে সন্তানের জন্য খুঁজে, খুঁজে অসহায় মেয়েদের বিয়ে করে। যাতে কখনো মুখের উপর কথা না বলতে পারে। সব জানা সত্ত্বেও চুপচাপ সব মেনে নেয়। সে মেয়ে সুন্দর হউক অথবা কুৎসিত। তাতে যায় আসে না। ছেলে সন্তানটাই আসল। গরীব,অসহায় মেয়েদের হাওলাদার বাড়ির পুরুষেরা বিয়ে করে ঘরে তুলে বলে চারপাশে তাদের অনেক নাম। অথচ,কেউ জানে না ভেতরের খবর! কেউ জানে না ভালোমানুষির পিছনের নোংরা গল্প! চতুর মজিদ তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেয়,ফরিনাকে বিয়ে করবে। এমন মেয়ে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। ফরিনার পরিবার বলতে কিছু নেই। মা আছে সেও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পথেঘাটে ঘুরে। সুন্দর অনেক মেয়ের সঙ্গ তো প্রতিদিনই পাওয়া যায়। সমাজের চোখে বউ একজন হলেই হলো। মজিদের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে। সে ফরিনাকে অন্দরমহলে নিয়ে আসে।

পূর্বে মজিদের একটা বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু সেই মেয়ে বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারেনি। মজিদের পাপের পথের বিষধর কাঁটা হওয়ার ফলে তাকে জীবন দিতে হয়েছে। খলিলের বউ আমিনা তখন গর্ভবতী। আমিনার বয়স ছিল পনেরো। মজিদ ফুলবানুকেও অন্দরমহলে নিয়ে আসে। ফুলবানু আর মজিদের বয়স কাছাকাছি ছিল। মজিদ যখন প্রস্তাব দিল,বোকা,সরল-সহজ ফুলবানু খুব খুশি হয়। তার মেয়ে এত বড় বাড়িতে রানির হালে থাকবে। তাকেও থাকতে দিবে এর চেয়ে খুশির কী হতে পারে? মজিদের মাতা নূরজাহান বিয়ের প্রস্তুতি নেন। বাড়িতে মজিদ-খলিলের অভিভাবক বলতে তিনি ছিলেন। তার স্বামী অষ্টাদশী এক তরুণীর সতীত্ব হরণ করতে গিয়ে সেই তরুণীর হাতে নিহত হয়। ঘরোয়াভাবে সম্পন্ন হয় বিয়ে। অলন্দপুর সহ আশেপাশের সব গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে মজিদ হাওলাদারের নাম। বনেদি ঘরের শিক্ষিত পাত্র হয়ে বিয়ে করেছে এক অসহায় পাগলির মেয়েকে! সবার মনপ্রাণ শ্রদ্ধায় ভরে উঠে। বিয়ের রাতে ফরিনা দ্বিতীয়বারের মতো মানুষরূপী যমদূতের দেখা পায়। শরীরে ছোপ,ছোপ দাগ বসে। বিছানায় পড়ে থাকে দীর্ঘদিন। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়,মজিদের অত্যাচারে আবার শয্যা গ্রহণ করে। ফরিনার এত দূর্বলতায় মজিদ অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। ক্রোধে ফেটে পড়ে সে। তার বিকৃত মস্তিষ্ক ফরিনাকে নগ্ন করে পিটানোর আহ্বান জানায়। মজিদ তাই করে। সে দৃশ্য চোখে পড়ে ফুলবানুর। গগণ কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠে। সেই চিৎকার ফুলবানুর জীবনের মরণ কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। মজিদের হাতে বন্দি হয় সে। ফরিনার ঘরে তাকে বেঁধে রাখা হয়। তখন বিছানায় ফরিনা রক্তাক্ত অবস্থায় ছিল। অস্পষ্ট স্বরে ‘আম্মা,আম্মা’ বলে চুপ হয়ে যায়। ফুলবানু চিৎকার করে মানুষজনকে ডাকে। কেউ শুনেনি তার চিৎকার। ফরিনাকে গলা ফাটিয়ে ডাকে,’ফরিনারে,ও মা
একটু দেখ আমারে…আম্মারে।’

নূরজাহান, আমিনা সব শুনেও নিজেদের ঘরে শুয়ে থাকে। আমিনা ভালো বংশের মেয়ে। তাকে বিয়ে করার কারণ,সে মৃগী রোগী। আর খুব ভীতু প্রকৃতির। আমিনার পিতা প্রভাবশালী। গ্রাম্য রাজনীতি সাহায্যের জন্য হাওলাদারদের প্রভাবশালী, ক্ষমতাবান আত্মীয় প্রয়োজন ছিল। আমিনার আরো বোন ছিল। সুস্থ,সুন্দর। কিন্তু মজিদ খলিলের জন্য পছন্দ করেছে রোগী,ভীতু প্রকৃতির মেয়ে আমিনাকে। ফরিনাকে সুস্থ করার জন্য ফুলবানুকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে এক ঘরে বন্দি রাখা হয়। কেটে যায় তিন-চার দিন। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। ফুলবানু ফরিনার মুখ ছুঁয়ে আদর করে আর বলে,’আমার আম্মা!’
ফরিনা ঠোঁট ভেঙে কেঁদে মায়ের কাছে অভিযোগ করে,’আমারে অনেক মারে আম্মা। আমারে লইয়া যাও। আমি এইহানে থাকুম না।’
ফুলবানুর চোখ বেয়ে জল পড়ে। দুই হাতে মাথা চুলকায়। ফরিনা তাকে নদীর পাড়ে নিয়ে গোসল করিয়ে দিতো। কেউ খাবার দিলে ফরিনা তার মাকে খাইয়ে দিতো,নিজেও খেতো। যাযাবর জীবনে ফরিনার দায়িত্বে ছিল তার মা। ফুলবানু সবকিছুতে শূন্য দেখে। শুধু বুঝতে পারে,তার মেয়েকে একজন লোক অত্যাচার করে। মনে হতেই,ফুলবানুর দৃষ্টি অস্থির হয়ে পড়ে বার বার। এলোমেলোভাবে হাত পা নাড়াতে থাকে।

দরজা খট করে শব্দ হয়। মজিদ ঘরে প্রবেশ করে। ফুলবানু তেড়ে এসে মজিদের চুল টেনে ধরে,বাহুতে দাঁত বসিয়ে দেয়। মজিদ আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব হয়ে যায়। আর্তনাদ করে উঠে। ফুলবানুর চুল শক্ত করে ধরে ধাক্কা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে। ফুলবানু মেঝেতে পড়তেই,শব্দ হয়। ফরিনা কাঁদতে শুরু করে। ফুলবানু আবার উঠে দাঁড়ায়। রাগে সে কিড়মিড় করছে। মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ বের হচ্ছে। ফুলবানু কাছে আসতেই মজিদ ফুলবানুর তলপেটে লাথি দেয়। ফুলবানু ছিটকে পড়ে। গোঙাতে থাকলো। ফরিনা ভয়ে জড়সড়! সে কাঁদতে কাঁদতে মজিদকে অনুরোধ করলো,’আমার আম্মারে মাইরেন না।আপনে আমার আম্মারে মাইরেন না। আমার আম্মায় কিচ্ছু বুঝে না।’
মজিদ পালঙ্কের নীচ থেকে দড়ি নিয়ে ফরিনার হাতপা বাঁধে। ফুলবানু নতুন উদ্যমে আবার ছুটে আসে। সে মজিদকে খুন করতে চায়। কিন্তু দূর্বল,বোকা ফুলবানু পেরে উঠেনি মজিদের সাথে। মজিদ ফুলবানুর শরীরের প্রতিটি লোমকূপকে নির্মমভাবে আঘাত করে। খামচে ধরে।
তারপর দুই হাতে ফুলবানুর চুল ধরে মেঝেতে আঘাত করে কয়েকবার। ফুলবানুর মাথা থেকে রক্ত ছিটকে পড়ে চারপাশে। ফরিনার চিৎকার বৃষ্টি ও বজ্রপাতের সাথে হারিয়ে যায়। থেমে যায় ফুলবানুর অভিশপ্ত যাযাবর জীবন। ফরিনার কণ্ঠনালি স্তব্ধ হয়ে যায়। এই জীবনে ভয়ংকর বলতে তার আর কিছু দেখার নেই। রাত শেষে দিন আসে। ফুলবানুর দেহ ভেসে যায় কোনো এক নদীর স্রোতে।

ফুলবানুর নির্মম মৃত্যু ফরিনার প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে মিশে যায়। যত বার নিঃশ্বাস নেয় ততবার মনে পড়ে মায়ের কথা। মায়ের মৃত্যুর কথা। ছোট ফরিনা বুকের ভেতর মায়ের স্মৃতি লুকিয়ে রেখে মজিদের দাসত্ব স্বীকার করে নেয়। দাসত্ব জীবনে বার বার হয়েছে অত্যাচারিত। ব্যথায় মলম লাগিয়ে দেওয়ার জন্যও কেউ ছিল না। একা কাটিয়েছে প্রতিটা মুহূর্ত। বিয়ের চার বছরের শেষদিকে কোল আলো করে আসে পুত্র সন্তান। ফরিনা জীবনে আনন্দ খুঁজে পায়। যখন তার পুত্র সন্তানের দুই বছর তখন ফরিনা ভাবে,সে তার মায়ের হত্যার প্রতিশোধ নিবে। হুট করেই বুকের ভেতর আগুন জ্বলে উঠে। সুযোগ আসে মজিদকে হত্যা করার। ফরিনা রাম দা হাতে তুলে নেয়। দূর্ভাগ্যবশত মজিদ টের পেয়ে যায়। সে ফরিনাকে খলিল, নূরজাহান, আমিনা সবার সামনে নগ্ন করে লাঠি দিয়ে আঘাত করে। ফরিনা দুই হাতে দেয়াল খামচায়। যেন দেয়াল ছুটে এসে তার কাপড় হয়। তার লজ্জা ঢেকে দেয়। কিন্তু অসম্ভব ঘটনাটা ঘটেনি।
ফরিনা হার মেনে নেয়। সহ্য করে নেয় সব। তার একমাত্র সন্তানকে নিয়ে সে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু বুকের মণিকোঠায় রক্তাক্ত তাজা অবস্থায় রয়ে যায়,তার মায়ের মৃত্যু।

ফরিনা দুই চোখ বুজে। গড়িয়ে পড়ে দুই ফোঁটা জল। ফরিনার বলা প্রতিটি কথা গুমরে, গুমরে যেন দেয়ালে বারি খাচ্ছে। সেই শব্দে পদ্মজার মাথা ভনভন করছে। তার চোখের জল বুক অবধি নেমে এসেছে। সে অনুভব করে,তার বুকের ভেতর ধিকিধিকি আগুন জ্বলছে। হাত-পা শক্ত হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে সে অন্য সত্তায় অবস্থান করছে। চোখের জল মুছে ফরিনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তারপর বললো,’কথা দিচ্ছি,মজিদ হাওলাদারের মাথা আমি আপনার নামে উৎসর্গ করব।’
ফরিনা পদ্মজার হাতে চুমু দেন। তিনি এখন ভোরের শিশিরের মতো শীতল। নিজের ভেতরের সবটুকু রাগ,ক্ষোভ,আগুন ঢেলে দিয়েছেন পদ্মজার ভেতর। এবার বোধহয় মুক্তির পালা। ফরিনা পদ্মজার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন,’তোমার মুখটারে আমার জান্নাতের সুবাসের লাহান মিষ্টি মনে অয়।’
পদ্মজা ফরিনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে বললো,’ আপনি আমার আরেক মা। আমার আরেক বেহেশত।’
ফরিনা হাসলেন। পদ্মজা বললো,’আজ থেকে আপনার সব দায়িত্ব আমার। আপনাকে সুখে রাখার দায়িত্ব আমার। আমি আপনার সব চাওয়া পূরণ করব।’
ফরিনা হাসলেন। ধীরে ধীরে বললেন,’আমি পাপী। ধর্ম নিয়া আমার শিক্ষা আছিলো না। তুমি আমারে শিখাইছো। শেষ দিনগুলা তোমার কথামত ইবাদাত(এবাদত) করছি।যদি আল্লাহ কবুল কইরা আমার নামে জান্নাত কইরা রাহে,দরজার সামনে তোমার লাইগগা খাড়ায়া থাকাম।’
ফরিনার কথাগুলো পদ্মজার বুকে তীরের মতো আঘাত হাঁনে। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। সে দুই হাতে ফরিনাকে জড়িয়ে ধরে বললো,’কেন এসব বলছেন আম্মা!’
‘আমার ধারে আমার লগে ঘুমাও মা।’

পদ্মজা ফরিনার পাশে শুয়ে পড়ে। ফরিনাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করে। মাথায় হাজারটা ভাবনা,অনেক ক্ষোভ,ঘৃণা। এতসব নিয়ে কি ঘুম আসে? দীর্ঘসময় পর তার চোখ দুটি বন্ধ হয়।
এরপরদিন সারাদিন ফরিনা কথা বলেননি। খাবারও খাননি। বাড়ির কোনো পুরুষই বাড়িতে ছিল না। রাতে পদ্মজা শুতে আসে। ফরিনা পদ্মজার দিকে তাকিয়ে একবার শুধু হাসেন। পদ্মজা দুরুদুরু বুক নিয়ে চোখ বুজে। কিছু মুহূর্ত পার হতেই দ্বিতীবারের মতো আরেক মায়ের মৃত্যুর স্বাক্ষী হয়। ধাপড়ানোর শব্দ শুনে পদ্মজা ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। ফরিনার শরীর কাঁপছে। মাথার কাছে হারিকেনের আলো নিভে যাওয়ার পথে। পদ্মজা,ফরিনা আর অদৃশ্য আজরাইল ছাড়া ঘরে কেউ নেই। পদ্মজার বুকের ধড়ফড়ানি বেড়ে যায়। সে ফরিনার এক হাত চেপে ধরে। কালিমা শাহাদাত পড়তে থাকে। পদ্মজার মুখে উচ্চারিত,”আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু” স্বরণ করিয়ে দেয় সৃষ্টিকর্তার কথা। যিনি সৃষ্টি করেছেন তার কাছেই ফিরে যেতে হচ্ছে। পদ্মজার সাথে সাথে ফরিনাও উচ্চারণ করেন। তারপর পরই দেহ ছেড়ে পাড়ি জমান দূর-দূরান্তে! পদ্মজা আম্মা ডেকে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। ফরিনার প্রাণহীন দেহটার উপর আছড়ে পড়ে বললো,’আপনিও আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন আম্মা!’
আমির সবেমাত্র বাড়িতে প্রবেশ করেছে। পানি পান করছিল। পদ্মজার কান্না কানে ভেসে আসতেই সে গ্লাস রেখে উল্কার গতিতে ছুটে আসে। মজিদের ঘুম ভেঙে যায়। পদ্মজার কান্না শুনে তিনি অবাক হলেন। আমিরতো পদ্মজাকে মারবে না। তাহলে এ মেয়ে এভাবে কাঁদে কেন? তিনি চশমা পরে ঘর থেকে বের হোন। আমিনা নিজ ঘরে চুপ করে বসে আছে। ভূমিকম্প হয়ে গেলেও তিনি বের হবেন না। খলিল,রিদওয়ান বাইরে। লতিফা,রিনু হারিকেন জ্বালিয়ে দৌড়ে আসে। বিদ্যুত নেই বিকেল থেকে। আমির ঘরে প্রবেশ করে চমকে যায়। পদ্মজা হাউমাউ করে কাঁদছে। আমির ফরিনার পাশে এসে দাঁড়ায়। আলতো করে ছুঁয়ে ডাকলো,’আম্মা?’

ফরিনার সাড়া নেই। আমিরের মস্তিষ্কে যখন বুঝতে পারে,তার মা বেঁচে নেই,সে স্তব্ধ হয়ে যায়। চারপাশ থমকে যায়। মজিদ ঘরে এসে প্রবেশ করতেই আমির তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার রক্তবর্ণ চোখ দুটি বেয়ে জল পড়ছে। সে রাগে কাঁপতে থাকে। মজিদকে এলোপাথাড়ি ঘুষি দিল। তারপর গলা চেপে ধরে বললো,’কুত্তার বাচ্চা,আম্মার উপর হাত তুলতে না করছিলাম।’
পদ্মজার উপর নজর রাখা দুজন ব্যক্তি আমিরকে জাপটে ধরে। আমিরের মুখ থেকে নির্গত হতে থাকে বিশ্রী গালিগালাজ। মজিদের চোখ ফুলে গেছে। নাক দিয়ে রক্তের স্রোত নেমেছে। তিনি বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে আছেন। আমির কখনো তার সাথে এমন করেনি!
কারো জন্য কারো জীবন থেমে থাকে না। সময় তার মতো করে সবাইকে নিয়ে ছুটে বেড়ায়। দেখতে দেখতে কেটে গেছে দুইদিন। মজিদ আলগ ঘরের বারান্দায় বসে আছেন। দুপুর অবধি বাড়িভর্তি মানুষ ছিল। মোড়ল বাড়ির সবাই ছিল। কিছুক্ষণ হলো সবাই নিজেদের বাড়ি ফিরেছে। তিনি মনে মনে ক্রুদ্ধ। আমিরের শক্ত হাতের চাপ তার গায়েও পড়েছে, তা মানতে পারছেন না। বিপদের আশঙ্কায় মাথা দপদপ করছে।
বাড়িতে আসা অনেকে প্রশ্ন করেছে,মুখে কী হয়েছে? মজিদ তখন লজ্জা নিয়ে জবাব দিয়েছে, সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিল। এছাড়া যুক্তিগত আর কোনো অজুহাত তিনি খুঁজে পাননি। অনেকে মজিদকে সন্দিহান চোখে দেখেছে। মজিদ চেয়ার এক হাতে খামচে ধরেন। রাগে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। বুকের ভেতর দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। সেখানে
খলিল উপস্থিত হয়। মজিদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য খ্যাঁক করে কাশেন। মজিদ তাকালেন না। খলিল বললেন,’ভাই,সমাবেশের কী করন?’

‘রবিবারের দাওয়াত দিবি। ফরিনার জন্য দোয়া চেয়ে নেব সবার কাছে। এখন ভালো সময়।’
‘আইচ্ছা। ভাই?’
মজিদ তাকালেন। খলিল বললেন,’ছেড়িগুলারে কবে পাডাইবা?’
‘আরো তো ছয়টা মেয়ে বাকি। কবে পাঠাবে,আমির জানে। ওর সাথে কথা বল।’
‘তোমার ছেড়ার লগে আমি কথা কইতে পারতাম না।’ খলিল ঘোর আপত্তি জানালো।
মজিদ আড়চোখে খলিলকে দেখলেন। দৃষ্টিতে অনেক রাগ। কিছুক্ষণ পর প্রশ্ন করলেন,’রিদওয়ান কোথায়?’
‘বাজারে।’
‘আচ্ছা,যা। ‘
খলিল জায়গা ত্যাগ করেন। মজিদ এক হাতে কপাল ঠেকিয়ে ভাবেন,আমিরের মনে কী চলছে? কেন তার চোখের দৃষ্টি দুইরকম! এভাবে চলতে থাকলে, হাওলাদার বংশে দূর্যোগ নেমে আসবে।

বাইরে মোলায়েম ঠান্ডা বাতাস। পড়ন্ত বিকেলের স্নিগ্ধ পরিবেশ। পদ্মজা শাল দিয়ে মাথা ঢেকে রেখেছে। সে ধীর পায়ে হেঁটে আসছে। পিছনে দুজন লোক। ফরিনার ঘরের সামনে এসে থমকে যায় পদ্মজা। পালঙ্কে পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে আছে আমির। এক হাঁটুতে এক হাত রাখা। জানালা দিয়ে আসা বাতাসে তার কপালে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো নড়ছে। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে আমির চোখ তুলে তাকাল। পদ্মজা ঘরে প্রবেশ করে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’অথচ আপনি আমার মাকে খুন করতে চেয়েছিলেন। অন্যের মা তো! তাই না?’
আমির চোখ সরিয়ে নিলো। পদ্মজা বললো,’যে মেয়েগুলোকে শিকার করেন, সে মেয়েগুলোর মায়েদের এরকমই কষ্ট হয়! আমি অবাক হচ্ছি, আপনি আম্মার জন্য কষ্ট পাচ্ছেন দেখে!’
‘কথা শোনাতে এসেছো?’
পদ্মজা হাসলো। বললো,’যখন আম্মা দিনের পর দিন কষ্ট সহ্য করে যাচ্ছিলো, তখন কোথায় ছিলেন? কেন তাকে শান্তির দেখা দেননি? ছেলে হিসেবে কী করেছেন? উল্টো কষ্ট দিয়েছেন।’
‘আম্মা আমার সম্পর্কে কিছু জানতোই না। কষ্ট পাবে কেন? ‘
‘তিনি কখন জেনেছেন সব?’
আমির নিরুত্তর। পদ্মজা উৎসুক হয়ে রইলো। আমির বেশ খানিকক্ষণ পর বললো,’যেদিন বাড়িতে এসেছি। সেদিন রাতে।’
পদ্মজার কপালে ভাঁজ পড়ে। সে প্রশ্ন করলো,’যেদিন আম্মা আমাদের ওই বাড়ি থেকে আনতে গিয়েছিল, সেদিন?’
‘হুম।’ আমির জবাব দিল ছোট করে।
‘কীভাবে জেনেছে?’

আমির বিরক্তি নিয়ে পদ্মজার দিকে তাকালো। বললো,’এত প্রশ্ন করো কেন?’
‘আমি জানতে চাই।’
‘জেনে কী হবে? আম্মা আমাকে থাপ্পড় তো কম দেয়নি! আমি চুপ করে সহ্য করেছি। আম্মাকে কিছু বলিনি। তাহলে আমি কী করে কষ্ট দিয়েছি?’
আমিরের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পদ্মজা প্রশ্ন করলো,’আপনি এই পাপের সাথে জড়িত সেটা আম্মা এতদিনেও বুঝেনি কেন? কীভাবে লুকিয়ে রেখেছেন?’
আমির চট করে উঠে দাঁড়ায়। মনের সবটুকু রাগ পালঙ্কে লাথি মেরে মিটিয়ে নেয়। তারপর বেরিয়ে যায়। পদ্মজারও রাগ হয় খুব। সে নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর আলমারি খুলে ছুরি নিলো। আমির ঘর থেকে সব ছুরি সরিয়ে দিয়েছিল। মানুষের ভীড়ে পদ্মজা মজিদের ঘর থেকে দুটো ছুরি সংগ্রহ করেছে। সতর্কতার সাথে একটা ছুরি শরীরের ভাঁজে রেখে দিলো পদ্মজা। আলমারির কপাট লাগাতে গেলেই একটা চিঠি মেঝেতে পড়ে। পদ্মজা দ্রুত চিঠিটি তুললো। পূর্ণা সকালে দিয়েছে। আলমগীর পদ্মজার নামে মোড়ল বাড়িতে এই চিঠি পাঠিয়েছে। চিঠির খামের উপর লেখা, “পদ্মজা ছাড়া অন্য কারো চিঠি পড়া নিষেধ।”
তাই পূর্ণা অথবা প্রেমা কেউ পড়েনি। পূর্ণার মনে হয়েছিল এটা গোপনীয় চিঠি। তাই সে লুকিয়ে পদ্মজাকে দিয়েছে। পদ্মজা এখনো পড়েনি। সে যত্ন করে রেখে দেয়। সময় বুঝে পড়বে।
আমির তৃতীয় তলার একটা ঘরে এসে বসলো। তার নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। এক হাত কাঁপছে। যখন সে নিজের সত্তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে তার পা অথবা হাত কাঁপে। আমির জানালার বাইরে মিনিট দুয়েক তাকিয়ে থাকে। তারপর আচমকা দেয়ালে নিজের কপাল দিয়ে আঘাত করে। তিন বারের সময় কপাল ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসে।
চোখ দুটি ছোট ছোট হয়ে যায়। তার ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ। শরীর অসাড় হয়ে পড়ে। তবুও জ্ঞান হারায়নি। দূর্বল হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় শুয়ে থাকে মেঝেতে।

মৃদুল মোড়ল বাড়ির পথে দাঁড়িয়ে আছে। তার আজ বাড়ি ফেরার কথা ছিল। অনেকদিন ধরে অলন্দপুরে সে মেহমান হয়ে আছে। ছোটবেলা একবার চার মাস হাওলাদার বাড়িতে ছিল। তারপর আর থাকা হয়নি। এইবার এক মাস হয়ে যাচ্ছে। এতদিন থাকতো না,যদি না পূর্ণার দেখা পেতো। জ্যোৎস্না রাত নিয়ে অনেক জল্পনাকল্পনা ছিল। কিন্তু ফরিনার মৃত্যুর জন্য সে রাত উপভোগ করা হয়নি। সে আগামীকাল বাড়ি ফিরবে। তাই পূর্ণার সাথে দেখা করতে এসেছে।
নূপুরধ্বনি ভেসে আসে! মানে পূর্ণা আসছে! মৃদুল সোজা হয়ে দাঁড়ালো। পূর্ণা দৃশ্যমান হয়। সে মৃদুলের সামনে এসে দাঁড়াল। মৃদুল পূর্ণার দিকে এক কদম এগিয়ে এসে বললো,’কেমন আছো?’
‘ভালো। আপনি কেমন আছেন?’
‘ভালা। প্রান্তর কী খবর?’
‘কুড়াল বানাচ্ছে।’
‘ওর কামই এমন।’
পূর্ণা হাসলো। মৃদুল বললো,’চলো নদীর দিকে হাঁটি।’
‘চলুন।’
দুজন মাদিনী নদীর পাশে এসে দাঁড়ায়। দুই দিকে গাছপালা। দুজনের মাঝে দুই হাত দূরত্ব। মৃদুল এক টুকরো পাথর নদীর পানিতে ছুঁড়ে দিল। পাথরটি পানিতে দুই,তিন বার ব্যাঙের মতো লাফ দিয়ে ডুবে যায়। পূর্ণা হাসলো। বললো,’আমিও এরকম পারি।’

মৃদুল একটা পাথর পূর্ণার হাতে দিয়ে বললো,’কইরা দেখাও।’
পূর্ণা করে দেখালো। তারপর বললো,’চাপা মারি না আমি।’
মৃদুল শুধু হাসলো। কিছু বললো না। পূর্ণা অপেক্ষা করছে,মৃদুল কী বলবে শোনার জন্য। অনেকটা সময় কেটে যায়। মৃদুল পূর্ণার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। দুই পা এগিয়ে আসে। পূর্ণা চাতক পাখির মতো তাকিয়ে রয়েছে। মৃদুল পূর্ণার দুই হাত শক্ত করে ধরলো। পূর্ণা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে। মৃদুল তার হাত ধরলে সে অন্য এক জগতে চলে যায়। যে জগতে কেউ নেই। শুধু ভালোবাসা,ভালোবাসা আর ভালোবাসা। মৃদুল বললো,”রাইতে বাড়িত যাইতাছি।’
বাড়িতে যাবে শুনে পূর্ণার চোখেমুখে আঁধার নেমে আসে। সে প্রশ্ন করলো,’রাতে কেন?’
‘রাতে হাওলাদার বাড়ির একটা ট্রলার ওদিকে যাইব। তাই রাইতেই যাব ভাবতাছি।’
পূর্ণা নতজানু হয়ে ব্যথিত স্বরে বললো,’ওহ,আচ্ছা যান।’
মৃদুল বললো,’মন খারাপ কইরো না। জলদি আইসা পড়ব।’
পূর্ণার কান্না পাচ্ছে। মৃদুল চলে যাবে শুনলেই,তার বুক ফেটে কান্না আসে। সে মৃদুলের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,’কেন আপনি এতো দূরের মানুষ?’

তার ব্যাকুল কণ্ঠের অভিযোগটি মৃদুলের হৃদয়কে কাঁপিয়ে তুলে। সে মৃদু হাসলো। পূর্ণার হাত দুটি শক্ত করে ধরে বললো,’আম্মা-আব্বারে নিয়া আসব।’
পূর্ণা চকিতে তাকায়। ঠোঁট দুটি নিজেদের শক্তি আলাদা হয়ে যায়। মৃদুল পূর্ণাকে আরো অবাক করে দিতে বললো,’তোমার আপাই বলেছে,আমার আম্মা-আব্বাকে নিয়া আসতে।’
পূর্ণার হৃৎপিণ্ড থমকে যায়। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে। সে বসে পড়লো। দুই হাতে মুখ ঢেকে লম্বা করে নিঃশ্বাস নিয়ে বললো,’কী বলছেন এসব!’
মৃদুল পূর্ণার সামনে বসলো। পূর্ণাকে নিজেকে সামলে নিতে দিল। তারপর বললো,’যা হওয়ার ছিল,তাই হইতাছে।’
পূর্ণা ঠোঁটে হাসি,চোখে জল নিয়ে মৃদুলের দিকে তাকালো। তার ইচ্ছে হচ্ছে মৃদুলকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু এটা অসম্ভব। সে চোখ বুজতেই দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। ভালোবাসার কথা বলা হয়নি,তবুও দুজন মনে মনে জানে তারা একজন, আরেকজনকে কতোটা ভালোবাসে। কতোটা চায়!
মৃদুল বললো,’সন্ধ্যা হইয়া যাইতাছে। এখন বাড়িত যাও। আমি সন্ধ্যার পরে খাওয়াদাওয়া কইরা রওনা দেব।’
পূর্ণা কী বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। এটা সে কী শুনলো! সে ধীর কণ্ঠে বললো,”সাবধানে যাবেন,সাবধানে আসবেন।’
মৃদুল পূর্ণার চোখে চোখ রেখে মাথা নাড়ালো। সন্ধ্যার পূর্ব মুহূর্তের আলোয় পূর্ণাকে তার অপ্সরী মনে হচ্ছে। চোখের ঘন পাঁপড়িগুলো চোখের জলে ভিজে আরো ঘন,কালো হয়ে উঠেছে। পূর্ণা মৃদুলের তাকানো দেখে লজ্জা পেল। বললো,’কালো মানুষকে এভাবে দেখার কী আছে?’
মৃদুল চমৎকার করে বললো,’তুমি যদি আমার চোখ দিয়া নিজেরে দেখতা বুঝতে পারতা তুমি ঠিক কতোটা সুন্দর!’
কথাটি পূর্ণার হৃদয় নাড়িয়ে দেয়।

শুটিং চলছে আসহাব নামে একজন ব্যারিস্টারের বাড়ির পুকুরঘাটে। আসহাব চৌধুরী পরিচালক আনোয়ারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আসহাব ঢাকায় থাকেন। কয়দিন হলো গ্রামে এসেছেন। বাড়িটা বানিয়েছেন বাংলো বাড়ির মতো। আসহাব ও আনোয়ার ছাদে বসে গল্প করছেন। শুটিং শেষ হয় সন্ধ্যার খানিক পর। লিখন ক্লান্ত। সে জ্যাকেট পরে বারান্দায় এসে বসে। চারিদিকে গাছপালা। সুন্দর দৃশ্য। তার সহযোগী চা দিয়ে যায়। সে চায়ে চুমুক দিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে ভাবে,পদ্মজার কথা। সোমবারে তাদের দল ঢাকা ফিরবে। তার আগে দেখা হতো যদি! তৃধা লিখনের পাশে এসে বসলো। লিখন তৃধাকে খেয়াল করে বললো,’তৃধা!’
তৃধা তার মিষ্টি কণ্ঠে বললো,’অন্য কাউকে আশা করেছিলে?’
লিখন হেসে চায়ে চুমুক দিল। বললো,’আর কার আশা করব?’
‘কেন? পদ্মজা।’
লিখন জোরে হেসে উঠলো। যেন তৃধা কোনো মজার কথা বলেছে। লিখন বললো,’তুমি অপ্রয়োজনীয় কথা বেশি বলো তৃধা। পদ্মজা এখানে আসবে কোন দুঃখে?’
‘আসতেও পারে।’ তৃধার কণ্ঠে হিংসা। সে পদ্মজা নামের না দেখা মেয়েটাকে খুব হিংসা কিরে। সব মেয়েরা তাকে হিংসা করে,আর সে করে বিবাহিত এক মেয়েকে! যে মেয়ে তার স্বপ্নের পুরুষের বুকের পুরোটা জুড়ে থাকে। যদি সে পারতো,লিখনের বুক ছিঁড়ে পদ্মজার নামটা মুছে দিত।
লিখন নির্বিকার কণ্ঠে বললো,’ঘরে যাও তৃধা।’
‘যাব না।’

‘এভাবে চলতে থাকলে,আর কখনো তোমার সাথে কাজ করার সুযোগ হলেও করতে পারব না।’
তৃধার মুখটা লাল হয়ে যায়। রাগে,হিংসায় চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে। সে কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে বললো,’আমিতো বলেছি,আমি তোমার বাসার কাজের মেয়ে হতেও রাজি।’
লিখনের মুখ ফসকে চা বেরিয়ে আসে। সে হাসতে থাকে। তৃধা প্রায় সময় এমন অদ্ভুত, অদ্ভুত কথা বলে। যা একটা সদ্য কিশোরী মেয়েকেই মানায়। তখন পরিচালক আনোয়ার হোসেন সেখানে উপস্থিত হয়। লিখনকে ওভাবে হাসতে দেখে প্রশ্ন করলেন,’ কী নিয়ে এতো হাসা হচ্ছে?’
তৃধা দ্রুত চোখের জল মুছলো। লিখন হাসি থামিয়ে বললো,’তেমন কিছু না। বসুন।’
‘না,বসব না। শুনো লিখন,হাওলাদার বাড়ির মাতব্বরকে তো চিনো?’
‘জি। দুইদিন আগে বাড়ির কর্তী মারা যায়। দেখতে গিয়েছিলাম।’
‘হুম,শুনেছি। মাতব্বর মজিদ হাওলাদার প্রতি বছর বাড়ির ছেলে-বউদের নিয়ে শীতে গরীবদের শীতবস্ত্র দান করেন। বড় সমাবেশ হয়। বড় উদার মনের মানুষ। সমাবেশ শেষে কয়েকজনকে নিয়ে ভোজন আসর জমান। মজিদ হাওলাদারের ভাই আসহাবের সাথে আমাকে দাওয়াত করে গেছেন। আমি আগামীকাল সেখানে থাকব। এদিকটা তোমাদের রেখে যাচ্ছি।’
লিখন আনোয়ারকে আশ্বাস দিয়ে বললো,’চিন্তা করবেন না। এখানে সবাই বুঝদার। কেউ বিশৃঙ্খলা করবে না।’
‘সে আমি জানি। দাওয়াত পেয়ে আমি খুব আনন্দিত। মজিদ হাওলাদারের অনেক সুনাম শুনেছি। এবার স্বচক্ষে দেখতে পারবো। খুব ভালো লাগছে।’

‘জি,তিনি খুব ভালো মনের মানুষ। আমি একবার ছিলাম উনার বাড়িতে। পরিবারের সবাই খুব ভালো।’
আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বাড়ি সম্পর্কিত আরো কিছু কথা বললেন। তারপর চলে যান। তৃধা লিখনকে প্রশ্ন করলো,’তাহলে পদ্মজাও আসবে?’
‘হু,আসবে বোধহয়।’
তৃধার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। পদ্মজা নাম উঠলেই তার খারাপ লাগে। তবুও সে এই নাম তোলে। সে অভিমানী স্বরে বললো,’তুমি যাবে?’
‘ভাবছি যাব।’
‘আমিও যাব। সেই ভাগ্যবতী মেয়েটাকে দেখতে চাই।’
লিখন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বললো,’ভাগ্যবতী মেয়ে না একটা ভাগ্যবান পুরুষকে দেখাব।’
কথা শেষ করে লিখন সামনের দিকে পা বাড়ায়। তৃধা তখন বললো,’ সে নিশ্চয়, আমির হাওলাদার। আপনার শুধু এই একটা মানুষকেই কেন ভাগ্যবান মনে হয়?’ শেষটুকু রাগে কিড়মিড় করে বললো, তৃধা।
লিখন এগিয়ে যেতে যেতেই বললো,’তুমি এতসব কোথা থেকে যে জানো!’

অন্দরমহলে মজিদ ছাড়া কোনো পুরুষ নেই। তাদের মেয়ে পাচারের সময় ঘনিয়ে এসেছে। সবাই শিকারে অথবা কোনো প্রয়োজনীয় কাজে গেছে বোধহয়। মৃদুল নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা করেছে। মগা কোথায় পদ্মজা জানে না। মদন মারা গেছে। এই খবর শুনে পদ্মজা অবাক হয়েছিল। মদনের মাথায় আঘাত ছিল,ব্যান্ডেজ ছিল। এই অবস্থায় সেদিন পাতালঘরে যাওয়ার সময় পদ্মজা মদনের মুখ না দেখে মদনকে মাথার একই জায়গায় আঘাত করেছিল। ফলে, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে মারা যায়। পদ্মজার দুঃখ হয় আলোর জন্য। আলোর মা নেই,এখন বাবাও নেই। পদ্মজা এই মুহূর্তে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করছে। অন্দরমহলের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে দুজন লোক। যারা পদ্মজাকে পাহারা দেয়। মজিদের উপর হামলা করার উপযুক্ত সময়! পাতালঘরের চাবিও নিতে হবে। পদ্মজা অনুসন্ধানী চোখে চারপাশ দেখতে দেখতে মজিদের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো।
আমির দুই হাতে মাথা চেপে ধরে উঠে বসে। মাথাটা ভন ভন করছে,রক্ত শুকিয়ে গেছে। সে দেয়ালে হাত রেখে উঠে দাঁড়ায়। তারপর এলোমেলো পায়ে বেরিয়ে আসে। তাকে পাতালঘরে যেতে হবে। সে নিচ তলায় নামার জন্য সিঁড়িতে পা রাখে। মজিদের ঘরের পাশেই সিঁড়ি। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেতেই পদ্মজা সাবধান হয়ে যায়। সে ছুরি হাতে ওৎ পেতে থাকে। আমিনা কখনো উপরে যায় না। লতিফা,রিনুকে সে নিজে নিচ তলার এক ঘরে ঘুমাতে দেখেছে। যে ব্যাক্তি নেমে আসছে,তার পায়ের শব্দ ধীর গতির। ধীর গতিতে একমাত্র খলিল সিঁড়ি ভেঙে নামে। পদ্মজার অনেক দিনের ইচ্ছে,খলিলকে জখম করার। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। পায়ের শব্দটি কাছে আসতেই পদ্মজা ছুরি দিয়ে আন্দাজে আঘাত করে। আমির ‘আহ’ করে উঠলো। আক্রমণকারীরা কখনো আমিরের থাবা থেকে বের হতে পারে না। আঘাত পাওয়ার সাথে সাথে আমির পদ্মজাকে না দেখেই,পদ্মজা কিছু বুঝে উঠার পূর্বে আন্দাজে তার এক হাত দিয়ে পদ্মজার মুখ খামচে ধরে দেয়ালে বারি মারলো। তাৎক্ষণিক আমিরের নখ ডেবে যায় পদ্মজার দুই গালে! রাতের অন্ধকার একজন আরেকজনকে ভুলক্রমে আঘাত করার মাধ্যমে ইশারা দেয়,তারা দুজন দুই পথের পথিক!

পদ্মজার মৃদু আর্তনাদ শুনে আমিরের রক্ত ছলকে উঠে। সে দ্রুত তার শার্টের বুক পকেট থেকে লাইটার বের করে,আগুন জ্বালাল। হলুদ আলোয় পদ্মজার মুখখানা ভেসে উঠে। মাথা দুই হাতে ধরে রেখেছে। ভ্রুযুগল কুঁচকানো। আমির অস্পষ্ট কণ্ঠে উচ্চারণ করলো,’পদ্মজা!’
সে পদ্মজাকে ছোঁয়ার জন্য হাত বাড়ায়। তখন পদ্মজা বললো,’দূরে সরুন।’
পদ্মজার কণ্ঠে একটু তেজের আঁচ টের পাওয়া যায়। আমির কথা বাড়ালো না। সোজা লতিফার ঘরের দিকে গেল। লতিফা,রিনুকে ডেকে নিয়ে আসে। রিনুর হাতে হারিকেন। লতিফা,রিনু পদ্মজাকে উঠতে সাহায্য করে। পদ্মজার মাথা ফুলে গেছে। ভনভন করছে। পদ্মজা লতিফাকে ধরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার চেষ্টা করে। শেষ ধাপে গিয়ে একবার পিছনে ফিরে তাকাল। হারিকেনের হলুদ আলোয় আমিরের জীর্ণশীর্ণ মুখটা দেখে পদ্মজার বুকটা হাহাকার করে উঠে। কোথায় ছুড়ির আঘাত পেয়েছে কে জানে! পদ্মজা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। আমির রিনুকে বললো,’উপরে যা। লতিফা বুবুকে সাহায্য করিস।’
রিনু নতজানু হয়ে ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো,’তোমার ঘাড় দিয়া রক্ত আইতাছে ভাই।’

আমির হাসলো। সিঁড়ি ভেঙে নামার সময় পা ফসকে যায়। আমির কুঁজো হতেই পদ্মজার আক্রমণ! এক জায়গায় বার বার আঘাত পেতে হচ্ছে! আমির রিনুকে বললো,’ঘাড়টা পঁচে যাওয়া বাকি! যা,উপরে যা।’
আমির অন্দরমহলের বাইরে পা রেখে ঠান্ডা বাতাসে কেঁপে উঠে। শীতের প্রকোপ তীব্র! মাথায়,ঘাড়ে তীব্র ব্যাথা। ঠান্ডা বাতাসে আরো ভয়াবহ যন্ত্রনা হচ্ছে! সবকিছু ছাপিয়ে হৃদয়ের ব্যথাটা দ্বিগুণ আকারে বেড়ে চলেছে। পদ্মজার ঘৃণাভরা দৃষ্টি আমির আর নিতে পারছে না। প্রথম দিকের মতো শান্ত থাকা যাচ্ছে না। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সে পঙ্গু হওয়ার পথে। শরীরের রক্ত আর হৃদয়ের যুদ্ধ আমিরের শ্বাস-প্রশ্বাসে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।
নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। আমির নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করে। দুই হাতে চুল ঠিক করে অন্দরমহলের পিছন দিকে হেঁটে আসে। তিন-চারটে কুকুর দেখতে পেল। ভাঙা প্রাচীর দিয়ে হয়তো প্রবেশ করেছে। আমির কুকুরগুলোর দিকে এক ধ্যাণে তাকিয়ে থাকে। কুকুরগুলোও তাদের হিংস্র চোখ দিয়ে আমিরকে দেখছে। আমির দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
রাতের নিস্তব্ধতায় সেই দীর্ঘশ্বাসের শব্দ দুরন্ত বাতাস ভাসিয়ে নিয়ে গেল অনেকদূর পর্যন্ত। বেওয়ারিশ কুকুরগুলো সেই শব্দ শুনে চমকে উঠল।
নড়েচড়ে দূরে সরে গেল। আমির হেসে তাদের বললো,’ বুকের যন্ত্রনার এক অংশও দীর্ঘশ্বাসের সাথে বের হয়নি! আর এতেই ভয় পেয়ে গেলি তোরা?’

একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। আমির এগিয়ে যেতেই কুকুরগুলো ছুটে পালায়। আমির অপলক চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। অকারণেই হাসলো। তারপর গভীর জঙ্গল পেরিয়ে পাতালঘরে প্রবেশ করে। রাফেদ আমিরকে দেখে আঁতকে উঠলো। বললো,’স্যার,কীভাবে হলো এসব?’
আমির চেয়ার টেনে বসে বললো,’দ্রুত পরিষ্কার করো।’
রাফেদ আমিরকে পরিষ্কার করে দিলো। আমির শার্ট পাল্টে পাঞ্জাবি পরলো। তার আর কোনো কাপড় এখানে নেই। সব অন্দরমহলে নিয়ে গিয়েছিল। সাদা পাঞ্জাবি রয়ে গেছে। পাঞ্জাবিটা পরতে গিয়ে মনে পড়ে পদ্মজার কথা। পদ্মজার সাদা রঙ পছন্দ। প্রতি শুক্রবারে আমির সাদা পাঞ্জাবি পরে জুম্মায় যেতো। জুম্মায় যাওয়ার পূর্বে পদ্মজা খুব যত্ন করে পাঞ্জাবির তিনটে বোতাম লাগিয়ে দিতো। লাগানো শেষে বলতো,’ আমার সুদর্শন স্বামী।’
পদ্মজা যতবার এ কথা বলতো,ততবার আমির প্রাণখুলে হেসেছে। সে জানে না পদ্মজার চোখে সে কতোটা সুন্দর! কিন্তু পদ্মজার দৃষ্টি ছিল মুগ্ধকর! মুগ্ধ হয়ে সে আমিরকে দেখতো। আমির পাঞ্জাবির বোতামে চুমু দেয়। তখনই কানে বেজে উঠে, “ছুঁবেন না আমায়!,দূরে সরুন!,আমি আপনাকে ঘৃণা করি!’
কথাগুলো তীরের মতো আঘাত হানে মস্তিষ্কে! আমির নিজের চুল খামচে ধরে। রাগে চিৎকার করতে করতে এওয়ানের পালঙ্কে লাথি দিতে থাকে। পালঙ্ক ভেঙে যায়। রাফেদ দৌড়ে আসে। কিন্তু আমিরকে ধরার সাহস হয় না। আমিরকে আর যে যাই ভাবুক! রাফেদ জানে,আমির পাগল। একটা সাইকো সে। যখন রেগে যায় সবকিছু তছনছ করে ফেলে। আমিরের এই রাগের স্বীকার যে মেয়ে হয়েছে,সে মেয়ে নিঃশ্বাসে,নিঃশ্বাসে নিজের মৃত্যু কামনা করেছে।

রাফেদ দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। সে মনে মনে,এই হিংস্র মানুষটার মৃত্যু কামনা করে। কত মেয়ে আমিরকে বাবা,ভাই ডেকেছে ছেড়ে দেয়ার জন্য। আমির ছাড়েনি। মুখের উপর লাথি দিয়ে ছুঁড়ে ফেলেছে মেঝেতে। রাফেদ বাধ্য হয়ে এই জগতে প্রবেশ করেছে। অর্থের অভাবে! ভাবেনি,এতোটা পাশবিক, নির্মম এরা! কিন্তু আর বের হওয়ার উপায় ছিল না। বের হতে চাইলেই,মৃত্যু অনিবার্য। তাই সে এই নৃশংসতার সাথে তাল মিলিয়েছে। পরিবারের দুর্দশা তাকে জ্ঞানহীন করে দিয়েছিল। এক কথায় গ্রহণ করে নিয়েছিল এই পথ! যখন একেকটা মেয়ের কান্না সে শুনে, মনে হয় তার বোন কাঁদছে,আকুতি করছে! প্রথম প্রথম সেও কান্না করতো। এখন মানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু মনের কোণে মুক্তির আশা এখনো আছে। তলোয়ারের আঘাতের চেয়েও ধারালো কাছের মানুষের দেয়া আঘাত! যেদিন রাফেদ বুঝতে পেরেছে আমিরের দূর্বলতা পদ্মজা,সেদিন থেকে সে দোয়া করছে, আমির যেন এই দূর্বলতার ভার সহ্য করতে না পেরে দূর্বল হয়ে পড়ে। হাঁটুগেড়ে পড়ে যায় মাটিতে। নিঃস্ব হয়ে যেন দিকদিশা হারিয়ে ফেলে। আমিরের ছটফটানি, অস্থিরতা রাফেদের মনে আনন্দের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। আমির শান্ত হয়! রাফেদকে বললো,’পানি আনো।’

রাফেদ পানি নিয়ে আসে। আমির পানি পান করে ধ রক্তে এসে প্রবেশ করে। বিথ্রিতে আমির পা রাখতেই মেয়েগুলোর চোখেমুখে স্পষ্ট ভয় জমে। রাফেদ চেয়ার নিয়ে আসে। আমির চেয়ারে বসলো না। মেয়েগুলোকে দেখে বেরিয়ে আসলো। বিওয়ানে গেল। সেখানে একটা মেয়েও নেই! শুকনো রক্ত পড়ে আছে। সবকয়টি মেয়ে কুরবান হয়ে গেছে। নদীর স্রোতে ভেসে গেছে। এই ঘরের দেয়ালে দেয়ালে শত শত মেয়ের আর্তনাদ বাজে। আমির পুরো ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখলো। বিশ বছর আগে সে এই পাতালঘরে প্রথমবার এসেছিল। তখন তার বয়স পনেরো। তার বয়সী একটা মেয়েকে সে প্রথম আঘাত করেছিল এই ঘরেই! মেয়েটা আমিরের পায়ে ধরে মুক্তি ভিক্ষা চায়। আমির মুখের উপর লাথি মারে। সঙ্গে,সঙ্গে মেয়েটার নাক,মুখ ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসে। মনে পড়তেই আমিরের শরীরটা কেমন করে উঠে। তার ভেতরে অদৃশ্য কী যেন প্রবেশ করছে! ভেতরটা খুঁড়ে, খুঁড়ে খেয়ে নিঃস্ব করে দিচ্ছে। এক কোণে সুন্দর নকশায় তৈরি করা,সিংহাসনের মতো চেয়ার রয়েছে। আমির সেখানে বসলো। এই চেয়ারে বসে কত নগ্ন মেয়ের, তীব্র যন্ত্রনার আর্তনাদ সে উপভোগ করেছে! আমির এক হাতে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বুজে। চোখের পর্দায় পদ্মজার রাজত্ব! তাদের ঢাকার বাড়িতে কোনো এক বর্ষায়,পদ্মজা তার শাড়ি দুই হাতে গোড়ালির উপর তুলে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নামছে। পিছনে ধাওয়া করেছে,আমির। পদ্মজার কলকল হাসিতে যেন পুরো বাড়ি নৃত্য করছিল। বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি! কী অপূর্ব সেই মুহূর্ত। আমির চোখ খুলে ছাদের দিকে তাকায়। তারপর রাফেদকে ডাকলো,’রাফেদ?’

রাফেদ দৌড়ে আসে। আমির রাফেদকে মিনিট তিনেক সময় নিয়ে দেখলো। তার চোখের দৃষ্টি শীতল। রাফেদের বুক দুরুদুরু করছে। আমির বললো,’কেমন আছো?’
রাফেদ চমকে যায়। সে হতভম্ব। বেশ খানিক সময় নিয়ে উত্তর দিল,’ ভালো স্যার।’
‘তোমার বোনের ছেলে হয়েছিল নাকি মেয়ে?’
রাফেদের মনে হচ্ছে,তার কলিজা এখুনি ফেটে যাবে। তার চোখ দুটি মারবেলের মতো গোল,গোল হয়ে যায়। সে কণ্ঠে বিস্ময়তা নিয়ে বললো,’ছেলে-মেয়ে দুটোই।’
‘জমজ?’
‘জি,স্যার।’
‘তুমি মুক্তি চাও?’
রাফেদ বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে। আমির বললো,’ যদি চাও,তাহলে আজ থেকে তুমি মুক্ত।’
রাফেদের মাথায় যেন আসমান ভেঙে পড়ে। সে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো। অস্থির হয়ে পড়ে। তার অনুভূতি এলোমেলো হয়ে যায়। সে আমিরের দুই পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল। বললো,’স্যার,স্যার আমি মারা যাচ্ছি।’
আমির আদেশের স্বরে বললো,’পা ছাড়ো রাফেদ। ত্রিশ মিনিটের মধ্যে জায়গা না ছাড়লে,আর যেতে পারবে না।’
রাফেদ ঝরঝর করে কাঁদতে থাকল। যেন পাহাড় ভেঙে ঝর্ণার পানি ঝরছে। আমির বললো,’উঠো তারপর দৌড়াও।’
রাফেদ দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। সে তার ব্যাগ গুছিয়ে দ্রুত এই অন্ধকার ছেড়ে হারিয়ে যায়, আলোর সন্ধানে। আমিরের বুকটা খাঁখাঁ করছে। রাফেদের চোখেমুখে মুক্তির যেই আনন্দ সে দেখেছে,সেই আনন্দের তৃষ্ণায় তার কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে। কবে এই তৃষ্ণা মিটবে? কবে?
আমিরের বুকে জ্বালাপোড়া শুরু হয়,মনে হচ্ছে কোনো ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসছে। যে ঘূর্ণিঝড় চোখের পলকে সব লণ্ডভণ্ড করে,স্তব্ধ করে দিবে।

আমি পদ্মজা সিজন ২ পর্ব ৬৬+৬৭+৬৮+৬৯+৭০

লতিফা,রিনু চলে যেতেই পদ্মজা বিছানা ছেড়ে টেবিলে বসলো। হাতে তুলে নিলো কলম-
প্রিয়তম,
আমার প্রতিটি রজনী যেন বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। আমি আপনাকে ভুলে যেতে চাই। কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না! বিছানার চাদরে আপনার শরীরের ঘ্রাণ। শরীরের প্রতিটি লোমকূপ বার বার জানান দেয়,তারা আপনাকে ভালোবাসে। আমার অস্তিত্বের পুরোটা জুড়ে আপনার বিচরণ। বুকের ভেতরটা দগ্ধ হয়ে খানখান। আপনার উন্মুক্ত বুকের সাথে চেপে ধরে বলেছিলেন, আপনার তেঁতো জীবনের মিষ্টি আমি। আপনার মুখে ছিল
হাজার,হাজার শুকরিয়া।অথচ,এই সময়ে এসে আপনি আপনার তেঁতো জীবনটা বেছে নিয়েছেন। ছুঁড়ে ফেলেছেন আমাকে! এ কোন গভীর সমুদ্রের অতলে আমাকে ছুঁড়ে দিলেন? আপনার পাপের শাস্তি কেন আমি পাচ্ছি? আবেগ-বিবেকের যুদ্ধে আমি বার বার আহত হয়ে পিছিয়ে যাচ্ছি। নিজের সবটুকু আপনার নামে দলিল করে দিয়ে,আমি ভুল করেছি। এখনো আপনার শরীরের একেকটা আঘাত আমাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়। কিন্তু আমি আপনাকে আঘাত করতে চাই। আমার ভেতরের জ্বলন্ত আগুন নেভাতে, আপনার এবং আপনার দলের প্রতিটি নরপশুর রক্তের ভীষণ প্রয়োজন!

এতটুকু লিখে পদ্মজা থামলো। তার দুই চোখ বেয়ে জল পড়ছে। আর লেখার শক্তি পাচ্ছে না। ডায়রির পৃষ্ঠাটি ছিঁড়ে, দিয়াশলাইয়ের আগুনে জ্বালিয়ে দিলো। আলমারি খুলে আমিরের দেয়া তলোয়ারটি হাতে নিল। তলোয়ারের দিকে দৃষ্টি রেখে বললো,’আপনার বুকের হৃদয়ে আমি আজীবন রানি হয়ে থাকতে চেয়েছিলাম। সেই বুকে আমি কী করে আঘাত করব?’
শেষ কথাটি বলার সময় পদ্মজার দুই চোখ বেয়ে নোনাজল নামে। সে তলোয়ার মেঝেতে রেখে,বিছানায় আছড়ে পড়ে কাঁদতে থাকলো। আমির যে পাশে সবসময় শুতো,সে জায়গাটা জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে। কিন্তু হায়! কোথায় মানুষটার উষ্ণ বুক? যে বুকে মুখ গুঁজে পদ্মজা তার সব কষ্ট ভুলে যেত!

আমি পদ্মজা সিজন ২ পর্ব ৭৬+৭৭+৭৮+৭৯+৮০