আমি পদ্মজা সিজন ২ পর্ব ৭৬+৭৭+৭৮+৭৯+৮০

আমি পদ্মজা সিজন ২ পর্ব ৭৬+৭৭+৭৮+৭৯+৮০
ইলমা বেহরোজ

রবিবার। তীব্র শীতের সকাল। সময় তখন আটটা। বাড়িজুড়ে সবার ছোটাছুটি। পদ্মজা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করছে। সে পাতালঘরের চাবি খুঁজছে। হাতে সময় নেই। আজ রাতের মধ্যে জীবন বাজি রেখে হলেও কিছু করতে হবে। আলগ ঘরের সামনে খলিল দাঁড়িয়ে রয়েছেন। মাথায় উলের টুপি। লম্বা গোঁফ। মগাকে ধমকে কাজ বুঝাচ্ছেন। চারিদিকে উৎসব উৎসব আমেজ! দুপুরের নামাযের পর স্কুলের মাঠে সমাবেশ। আলগ ঘরে এবং বাইরে শত-শত কম্বল আর শীতবস্ত্র। হাওলাদাররা হারাম টাকায় লোক দেখানো নাটক করতে চলেছে! পদ্মজা মনে মনে ব্যঙ্গ করে হাসলো। রিদওয়ান অন্দরমহল থেকে বের হয়ে খলিলের পাশে এসে দাঁড়াল। তার পরনে কালো রঙের পাঞ্জাবি। গায়ের রঙ ফর্সা। তাই কালো রঙের পাঞ্জাবিতে সুদর্শন দেখাচ্ছে। পদ্মজা লতিফার কাছে শুনেছে,কয়দিনের মধ্যে নাকি রিদওয়ানের বিয়ে! কার সাথে বিয়ে কেউ জানে না। তবে এটা নিশ্চিত, কোনো অভাগীর জীবন দুর্বিষহ হতে চলেছে! রিদওয়ান, খলিল কী বিষয়ে কথা বলছে তা পদ্মজার কানে আসার কথা নয়। তবুও সে সেদিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর সেখানে উপস্থিত হয় আমির। আমির এদিক-ওদিক দেখে খলিলকে বললো,’আমি বেরিয়ে যাচ্ছি। ফিরতে আগামীকাল ভোর হয়ে যাবে। আবারো বলে যাচ্ছি, পদ্মজার গায়ে হাত তো দূরে থাক,কারো চোখও যেন না পড়ে।’

রিদওয়ান নির্বিকার কণ্ঠে বললো,’তোর দুই চামচারে বলে যা,পদ্মজার উপর ভালো করে খেয়াল রাখতে। পাতালে তো কোনো মেয়ে নাই। তাই চিন্তাও নাই। তবে,কাউকে যেন কিছু না বলে। আর আমাদের উপর তেড়ে না আসে।’
‘তেড়ে আসলেও কিছু বলবি না। সুন্দর করে সামলাবি।’
রিদওয়ান তীব্র বিরক্তি নিয়ে বললো,’ধুর! এই মাইয়ারে কতদিন এভাবে রাখবি? হুদাই ভেজাল।’
আমির রেগে রিদওয়ানের দিকে এক পা বাড়ালো। খলিল পরিস্থিতি পাল্টাতে দ্রুত রিদওয়ানের বুকে ধাক্কা দিয়ে বললো,’যা কইতাছে হুন। বাবু তুই যা,তোর বউরে কেউ কিচ্ছু করব না।’
আমির রিদওয়ানের চোখের দিকে তাকালো। চোখের দৃষ্টি দিয়ে সে রিদওয়ানকে সাবধান করে দিল। তারপর জায়গা ছাড়ল। অন্দরমহলে ঢোকার পূর্বে চোখ পড়ে দ্বিতীয় তলার বারান্দায়। পাংশুটে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে পদ্মজা। এক মুহূর্তের জন্য হলেও ভেতরের অনুভূতিগুলো পাল্টে যায়। সে দৃষ্টি সরিয়ে দ্রুত অন্দরমহলে প্রবেশ করলো। পদ্মজা ঠায় সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। আমির ঘরে এসে শার্ট,জ্যাকেট খুলে গোসলখানায় ঢুকে। তাকে ঢাকা যেতে হবে। হাতে সময় আছে, তবুও সে আজই মেয়েগুলোকে সরিয়ে দিচ্ছে। সে নিশ্চিত, পদ্মজা চেষ্টা করবে মেয়েগুলোকে বাঁচাতে। আবার মুখোমুখি হতে হবে দুজনকে। একত্রিশটা মেয়ে যোগাড় হয়ে গেছে যখন আর রাখার মানে নেই। সে ঝুঁকি নিতে চায় না। পদ্মজা কী মনে করে দ্রুতপায়ে ঘরে আসলো। বিছানায় আমিরের শার্ট দেখে বুঝতে পারে আমির গোসলখানায় আছে। তাৎক্ষণিক পদ্মজা ভাবলো,আমিরের শার্টের পকেটে তল্লাশি চালাবে। যদি চাবি পাওয়া যায়! যেমন ভাবা তেমন কাজ।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

চাবির কথা মনে পড়তেই আমির গোসলখানার দরজা খুললো। পদ্মজা শার্টের পকেটে একটা চাবি খুঁজে পায়। তার মুখে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে। পুরোটা দৃশ্য আমিরের চোখে পড়ে। সে দরজা বন্ধ করে দেয়। পদ্মজার হাত থেকে চাবি ছিনিয়ে নেয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই তার। এই চাবি আর পদ্মজার কাজে লাগবে না! সে পাতালঘরে গিয়ে কিছু খুঁজে পাবে না। আমির নিশ্চিন্তে গোসল শেষ করলো। পদ্মজা চাবি নিয়ে রান্নাঘরে চলে আসে। সেখানে লতিফা, রিনু,আমিনা সহ আরো তিন-চারজন রান্না করছে। সমাবেশ শেষে আলগ ঘরে ভোজ আয়োজন হবে,তারই প্রস্তুতি চলছে। খলিল হাওলাদারের দুই মেয়ে শাহানা,শিরিনও আজ আসবে। পদ্মজা কাজ করার বাহানায় লতিফার কাছে গিয়ে বসলো। লতিফা পদ্মজাকে দেখে হাসলো তারপর কাজে মন দিল। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর পদ্মজা সুযোগ বুঝে লতিফাকে ফিসফিসিয়ে বললো,’উনি বেরিয়ে গেলে আমাকে বের হতে সাহায্য করো বুবু।’
লতিফা চোখ বড় বড় করে তাকায়। চাপাস্বরে প্রশ্ন করে,’কই যাইবা?’
পদ্মজা পিছনে ফিরে তাকায়। আমিনা থালাবাসন পরিষ্কার করছেন। পদ্মজা আমিনার দিকে তাকিয়ে হাসলো। তারপর লতিফাকে বললো,’ পাতালে যাবো।’
লতিফার হাত থেকে চামচ পড়ে যায়। ঝনঝন শব্দ হয়। শব্দ শুনে উপস্থিত সবাই উৎসুক হয়ে তাকায়। লতিফা দ্রুত চামচ তুলে নিলো। সবার দিকে চেয়ে হাসি বিনিময় করে পদ্মজাকে চাপাস্বরে বললো,’ চাবি কই পাইবা?’
পদ্মজা বললো,’পেয়ে গেছি। তুমি শুধু সুযোগ করে দাও।’

লতিফার চোখেমুখে ভয় বাসা বাঁধে,যা স্পষ্ট। সে ভয় পাচ্ছে,আমির জেনে গেলে তার জীবন শেষ! পদ্মজা সবাইকে আরো একবার এক নজর দেখে নিয়ে লতিফাকে বললো,’ভালো কাজের জন্য জীবন উৎসর্গ করা সম্মানের বুবু।’
লতিফা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলো। সে রাজি। পদ্মজা তার ঘরে ফিরে আসে। সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় আমির নিচে নামছিল। দুজন কেউ কারোর দিকে তাকায়নি। যেন কেউ কাউকে চিনে না। পদ্মজা ঘরে প্রবেশ করে দ্রুত দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর হাতে তুলে নিল ছুরি।
লতিফা আলগ ঘরে গিয়ে খোঁজ নেয়। আমির,মজিদ,রিদওয়ান কেউ বাড়িতে নেই। খলিল আলগ ঘরের বারান্দায় তিন জন লোকের সাথে কোনো বিষয়ে আলোচনা করছে।লতিফা দ্রুত এসে পদ্মজাকে পরিস্থিতি জানায়। পরিস্থিতি গুছানো। এবার পদ্মজার পিছনে আঠার মতো লেগে থাকা দুজন লোককে সরানোর পালা। পদ্মজা আবার রান্নাঘরে আসে। দুজন লোক সদর ঘরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাদের উপস্থিতি দেখে কেউ ভাববে না, এরা কাউকে নজরে রাখার জন্য পিছু,পিছু ঘুরে! পদ্মজা লতিফাকে ইশারা করতেই,লতিফা দুজন লোককে উদ্দেশ্য করে বললো,’আপনেরা খাইবেন না?’
তারা সত্যি অনেক ক্ষুধার্ত। আবার রান্নাঘর থেকে মাংসের ঘ্রাণ আসছে। সেই ঘ্রাণে ক্ষিধে যেন বেড়ে যাচ্ছে। দুজন সম্মতি জানায়,তারা খাবে। লতিফা চোখের ইশারায় পদ্মজাকে বেরিয়ে যেতে বলে। তারপর দুজন লোককে খেতে দিল। দুজন ক্ষুধার্ত পাহারাদার কব্জি ডুবিয়ে খেতে থাকে। পদ্মজা তাদের অগোচরে বেরিয়ে পড়ে। বাইরের চারপাশ দেখে দ্রুত জঙ্গলে ছুটে আসে। জঙ্গলের পথ তার চেনা। তাই পাতালঘরের কাছে আসতে বেশি সময় লাগেনি। আল্লাহর নাম নিয়ে সে পাতালে প্রবেশ করে। তার হাতের চাবি প্রবেশদ্বার খুলতে সক্ষম হয়।

পদ্মজা এক হাতে শক্ত করে ধরে ছুরি। ধ-রক্ত ও স্বাগতম দরজার মাঝ বরাবর এসে সে থমকে যায়। কেউ নেই! সবকিছু চুপচাপ,নির্জন। সে এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার পাশের দেয়ালে চাবুক ছিল। তাও নেই! পদ্মজা থম মেরে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। মেয়েগুলো আছে তো? প্রশ্নটা মাথায় আসতেই, পদ্মজার বুকে ধড়াস করে কিছু যেন পড়ে। সে দৌড়ে ধ-রক্তে প্রবেশ করলো। উন্মাদের মতো প্রতিটি ঘর দেখলো। কেউ নেই! তার শরীর বেয়ে ঘাম ছুটে। ধ-রক্তের কোথাও কোনো চাবুক,ছুরি,রাম দা,কুড়াল কিছু নেই! এখানে যে অনাচার-ব্যভিচার হতো তার কোনো প্রমাণই নেই। পদ্মজা স্বাগতম দরজা পেরিয়ে সবকটি ঘরে তন্নতন্ন করে অসহায় মেয়েগুলোকে খুঁজে। কিন্তু কোথাও কেউ নেই। যখন নিশ্চিত হলো,এখানে কেউ নেই,তার হাত থেকে ছুরি পড়ে যায়। দুই হাতে মাথা চেপে ধরে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে। আমির তার চোখে ধুলো দিয়ে প্রতিটি মেয়েকে সরিয়ে দিয়েছে। পদ্মজার তীব্র যন্ত্রণা হতে থাকে। সে মেয়েগুলোকে বাঁচাতে পারেনি। আফসোস আর আত্মগ্লানি তাকে চেপে ধরে। মেয়েগুলোর ছটফটানি,বাঁচার অনুরোধ কানে বাজতে থাকে। দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকে পদ্মজা। তার মনে হচ্ছে,তার মাথায় অনেক ভারি একটা বোঝা। নিজের প্রতি খুব রাগ হয়। সে কাঁদতে থাকলো। শাড়ি খামচে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,’আমি পারিনি! আমি এই ব্যর্থতা কোথায় লুকাবো আল্লাহ!’

পদ্মজার কান্না দেয়ালে দেয়ালে বারি খেয়ে পুরো পাতালপুরীতে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।
সমাবেশে বাড়ির মেয়ে-বউদের যাওয়া আবশ্যক। এটা হাওলাদার বংশের আরেক রীতি। পরিবারের সবাই সেখানে উপস্থিত থাকবে। শাহানা,শিরিন তৈরি। তারা নিচ তলায় অপেক্ষা করছে। পদ্মজা তার ঘরে স্তব্ধ হয়ে পালঙ্কে বসে আছে। লতিফা হন্তদন্ত হয়ে ঘরে প্রবেশ করলো। বললো,’ও পদ্ম,বোরকা পিন্দো নাই ক্যান? জলদি করো।’
পদ্মজা লতিফার দিকে তাকালো। তার চোখের চারপাশ লাল। চোখে ফোলা ফোলা ভাব। সে আত্মগ্লানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। বার বার মনে হচ্ছে, সে চাইলে পারতো মেয়েগুলোকে বাঁচাতে। সুযোগ ছিল। সত্যিকার অর্থে, তার সুযোগ ছিল না। পেছনের প্রতিটি নিঃশ্বাস সাক্ষী,সে প্রতি মুহূর্তে মেয়েগুলোর কথা ভেবেছে। আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। হন্ন হয়ে চাবি খুঁজেছে। ভেবেছিল,আরো দুই-তিন হাতে আছে। আমির এতো দ্রুত একত্রিশটা মেয়ে অপহরণ করে ঢাকা নিয়ে চলে যাবে সে ভাবেনি! ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। ভাবলেও কাজ হতো না! কিন্তু এসব কিছুই পদ্মজার মাথায় আসছে না। সে সমানতালে নিজেকে দোষী ভেবে যাচ্ছে। মানসিক যন্ত্রনায় হারিয়ে যাচ্ছে অন্য জগতে। রিদওয়ান ঘরে এসে উঁচু গলায় বললো,’কি হলো? পদ্মজা এখনো তৈরি হয়নি কেন? আমাদের তো বের হতে হবে।’
পদ্মজার আচমকা মনে হলো,আমির মেয়েগুলোকে আজ রাতটা গোডাউনে অথবা অফিসে রাখতে পারে। আর নয়তো বাসায়। এর মধ্যে যদি কিছু করা যায়! কিন্তু কার সাহায্য নিবে সে? এখানে ঢাকার কে আছে? সেকেন্ড তিনেক ভাবার পর তার মাথায় লিখনের নাম আসে। লিখন চাইলে আমিরকে থামাতে পারবে। অবশ্যই পারবে! এতে আমিরের সম্পর্কে সব জেনে যাবে লিখন। বলি হবে আমির! এটা ভাবতে পদ্মজার কষ্ট হয়। সে ঢোক গিলে নিজের আবেগ,অনুভূতি সামলায়। সে আমিরকে মনে মনে বলি দিল। এখন লিখনই একমাত্র আশা। শুনেছে,শুটিং এখনো চলছে। পদ্মজা সিদ্ধান্ত নেয়,সে যেভাবেই হউক লিখনের সাথে আজ যোগাযোগ করবে। রিদওনের দিকে আগুন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পদ্মজা বললো,’আসছি।’
রিদওয়ান তাড়া দিয়ে বললো,’জলদি।’
তারপর বেরিয়ে গেল। রিদওয়ান বের হতেই পদ্মজা বিড়বিড় করলো,’বেজন্মা!’
তারপর দ্রুত বোরকা,নিকাব পরে নিল।

মৃদুল তার মা-বাবাকে নিয়ে হাওলাদার বাড়িতে পা রাখে। তার বুকের গোপন কুঠুরিতে থাকা হৃদয়টা খুশিতে নৃত্য করছে। যখন সে তার মা বাবাকে বললো,সে বিয়ে করতে চায়। আর মেয়েও পছন্দ করেছে। তখনি তার মা-বাবা দুজনই খুশিতে আটখানা হয়ে যায়। মিয়া বাড়ির সবাই খুশিতে ভোজ আয়োজন করে। তাদের আদরের দুলাল মৃদুল। মৃদুল এতদিন অলন্দপুরে ছিল বলে,তার মা জুলেখা বানু অসুস্থ হয়ে পড়ে। ছয় বিঘা ভূমির উপর কাঠের বাড়ি আর নব্বই বিঘা জমির একমাত্র উত্তরাধিকারী মৃদুল! তার অনুপস্থিতিতে বাড়ির প্রতিটি মানুষ মৃতের মতো হয়ে গিয়েছিল। এমতাবস্থায়,মৃদুলের বিয়ের সিদ্ধান্ত তাদের মাঝে ঈদের আনন্দ নিয়ে এসেছে। তাই এতো দ্রুত তাদের আগমন। মৃদুলের বাবা গফুর মিয়ার মাথায় টুপি,গায়ে দামী পাঞ্জাবি। শরীর থেকে আতরের ঘ্রাণ ভেসে আসছে। জুলেখা নিকাব তুলে মৃদুলকে বললেন,’ বাড়িত কী কেউ নাই?’
মৃদুল জুলেখাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললো,’অন্দরমহলে গেলেই মানুষ পাইবেন। একটু ধৈর্য্য ধরেন আম্মা।’
জুলেখা বানু কপাল কুঁচকালেন। তিনি স্বাস্থ্যবান একজন মহিলা। বাচাল প্রকৃতির মানুষ। রূপ এবং সম্পদ নিয়ে অহংকারের শেষ নেই। তিনি সরু চোখে চারপাশ দেখতে দেখতে অন্দরমহলে আসেন। অন্দরমহলের সামনে রিনু ছিল। রিনু মৃদুলকে দেখে দাঁত বের করে হাসলো। এগিয়ে এসে বললো,’মৃদুল ভাইজান আইয়া পড়ছেন?’
‘হ আইছি,দেখা যাইতাছে না?’
রিনু বোকার মতো হাসে। জুলেখা বানু আর গফুর মিয়ার পা ছুঁয়ে সালাম করে। মৃদুল বললো,’ফুফিআম্মা ঘরে আছে?’
‘না ভাইজান। বাড়ির সবাই স্কুলঘরে গেছে।’
মৃদুলের পূর্বে জুলেখা প্রশ্ন করলেন,’কেরে? ওইহানে কী দরহার(দরকার)?’
রিনু বিস্তারিত বললো। গফুর মিয়া সন্তুষ্টির সাথে বললেন,’মনডা জুরায়া গেলো। হাওলাদার বাড়ির আত্মীয় যে হইবো হেরই সাত জন্মের কপাল।’

গফুরের প্রশংসা জুলেখা বানুর ভালো লাগেনি। অন্যের প্রশংসা তিনি সহ্য করতে পারেন না। হাতের ব্যাগটা রিনুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ঝাঁঝালো স্বরে বললেন,’এই ছেড়ি,ধরো ব্যাগডা।’
রিনু হাত বাড়িয়ে ব্যাগ নিল। জুলেখা বানু বললেন,’আমরা কোন ঘরে থাকমু? লইয়া যাও।’
‘আপনেরা আলগ ঘরে থাকবেন।’ বললো রিনু।
জুলেখা পিছনে ফিরে আলগ ঘরের দিকে ইশারা করে বললেন,’এই টিনের ঘরডাত?’
জুলেখার প্রশ্নে অবজ্ঞা। তিনি টিনের ঘরে থাকতে আগ্রহী নয় বুঝাই যাচ্ছে। রিনু কিছু বললো না। মৃদুল জুলেখাকে আদুরে স্বরে বললো,’আম্মা,কম কথা কন। আমরা মেহমান।’
রিনু জুলেখার কথাবার্তায় বুঝে গেছে,এই মহিলা কোন প্রকৃতির। সে মনে মনে ভাবে,পূর্ণার কপালে ঝাটা আছে! জুলেখা আলগ ঘরে থাকবে না,এটা নিশ্চিত। রিনু জুলেখাকে অন্দরমহলে নিয়ে আসে। রানি-লাবণ্যর খালি ঘরটা দেখিয়ে বললো,’এই ঘরে থাকবেন।’
জুলেখা ব্যাগপত্র রেখে বিছানায় টান,টান হয়ে শুয়ে পড়ে। হাত-পা ম্যাজম্যাজ করছে। একবার ভাবলেন,রিনুকে বলবেন পা টিপে দিতে। কী মনে করে যেন বললেন না। মৃদুল গফুর মিয়াকে বললো,’আব্বা,আমি গোসল কইরা,খাওয়াদাওয়া কইরা স্কুলঘরে যাইতাছি। আপনি যাইবেন?’
‘হ যামু। মহৎ কাজ নিজের চোক্ষে দেখাও ভাগ্যরে বাপ।’
মৃদুল জুলেখার উদ্দেশ্যে বললো,’আম্মা,আপনি যাইবেন?’
জুলেখা ক্লান্ত। তিনি মিনমিনিয়ে বললেন,’না আব্বা,আমি যামু না।’
মৃদুল ব্যাগ থেকে লুঙ্গি,গামছা বের করলো। জুলেখা উঠে বসেন। রিনুকে ডেকে বললেন,’এই ছেড়ি,কলডা কোনদিকে? আমারে দেহায়া দেও।’

জুলেখা আদেশ করলো নাকি হুমকি দিলো রিনু বুঝতে পারছে না। সে চুপচাপ জুলেখাকে নিয়ে কলপাড়ে গেল। লতিফা থাকলে ভালো হতো। নতুন কোনো মেহমান এসে তেড়িবেড়ি করলে লতিফা শায়েস্তা করতে পারে!
মাথার উপর সূর্য। মাঠভর্তি মানুষ। একপাশে মহিলা ও বাচ্চারা,অন্যপাশে পুরুষরা। শৃঙ্খলা বজায় রাখছে রিদওয়ান। উপর থেকে দেখলে,রিদওয়ান একজন মহৎ, ভদ্র,শান্ত ব্যাক্তি। যাকে সবমসময় দেখা যায় না। সবাই জানে,রিদওয়ান জ্ঞানী মানুষ। সারাক্ষণ বইপত্র নিয়ে থাকে। তাই তার দেখা পাওয়া যায় না। ভেতরে খবর যদি নিষ্পাপ মনের মানুষগুলো জানতো! হায় আফসোস! উপস্থিত প্রতিটি মানুষ খুব খুশি। এত এত মানুষকে শীতবস্ত্র দেয়া কম কথা নয়! সে কাজটা যখন হাওলাদার বাড়ির মানুষেরা করে,সবার কাছে তখন তারা ফেরেশতা হয়ে উঠে। ফেরেশতার সাথে তুলনা করা হয়। মজিদ হাওলাদার ও খলিল হাওলাদার শীতবস্ত্র বিতরণ করছেন। পদ্মজা একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মজার সাথে আঠার মতো লেগে আছে দুটি লোক। দুজন দুই দিকে দাঁড়ানো। তাদের চোখ সর্বক্ষণ পদ্মজার উপর। পদ্মজার চোখ দুটি লিখনকে খুঁজছে। লিখন এখানে আসবে নাকি সে জানে না। তবে প্রার্থনা করছে,সে যেন আসে। আজ তার উপস্থিতি অনেকগুলো মেয়েকে বাঁচাতে পারে। লিখন নিঃসন্দেহে একজন ভালো মানুষ। সবকিছু শোনার পর সে কোনো ব্যবস্থা অবশ্যই নিবে।
লিখন ভীড় ঠেলে প্রান্তর পাশে এসে দাঁড়ালো। প্রান্ত লিখনকে দেখে অবাক হলো। তারপর হেসে করমর্দন করলো। বললো,’কেমন আছেন ভাইয়া?’

‘ভালো,তুমি কেমন আছো?’
‘ভালো ভাইয়া।’
‘পূর্ণা,প্রেমা আসেনি?’
‘আসছে। ওদিকে আছে।’ প্রান্ত স্কুলের ডানদিকে ইশারা করে বললো।
তৃধা লিখনকে প্রশ্ন করলো,’কে ও? ‘
লিখন চাপাস্বরে বললো,’পদ্মজার ভাই।’
তৃধা তাৎক্ষণিক প্রান্তকে প্রশ্ন করলো,’তোমার পদ্মজা আপা কোথায়?’
প্রান্ত সোজা আঙুল তাক করে বললো,’ ওইযে।’
তৃধা চোখ ছোট,ছোট করে সেদিকে তাকায়। প্রান্তকে আবার প্রশ্ন করে,’সবার তো মুখ ঢাকা। পদ্মজা কে?’
প্রান্তের আগে লিখন বললো,’লম্বা মেয়েটা।’
তৃধা আড়চোখে লিখনের দিকে তাকালো। বললো,’মুখ না দেখে চিনলে কী করে?’
‘জানি না, মনে হলো। প্রান্ত ঠিক বলেছি?’
প্রান্ত হেসে সম্মতিসূচক মাথা নাড়াল। তৃধার খুব মন খারাপ হয়। প্রান্ত বললো,’ভাইয়া,আপা আপনাকে খুঁজছিল।’
‘কোন আপা?’
‘পদ্মজা আপা।’
মুহূর্তে লিখনের কী হয়ে যায়,সে নিজেও জানে না। তার বুকে অপ্রতিরোধ্য তুফান শুরু হয়! পদ্মজা তাকে খুঁজছে! এ যে অসম্ভব! লিখন চকিতে পদ্মজার দিকে তাকালো। পদ্মজার মুখ দেখা যাচ্ছে না। হাত-পা ঢাকা। তবুও মনে হচ্ছে,সে পদ্মজাকে দেখতে পাচ্ছে। ছয় বছর পূর্বে পদ্মজাকে যে রূপে প্রথম দেখেছিল। সে দৃশ্য ভেসে উঠে। তাদের প্রথম কথা! টমেটো আছে নাকি জিজ্ঞাসা করা! কত সুন্দর সেই মুহূর্ত।
লিখন পদ্মজার কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। লিখনের চোখেমুখে আনন্দ স্পষ্ট! পদ্মজা খুঁজছে শুনে এতোই আনন্দিত হয়েছে মানুষটা! ব্যাপারটা তৃধাকে কষ্ট দিচ্ছে। তার বুকে চিনচিন ব্যাথা শুরু হয়।
শাহানার অনেকক্ষণ ধরে মাথা ঘুরাচ্ছে। সে বেশি মানুষের মাঝে থাকতে পারে না। শরীর দূর্বল লাগছে। পদ্মজার এক হাত ধরে দূর্বল কণ্ঠে বললো,’পদ্ম,আমার মাথা ঘুরাইতাছে।’
পদ্মজা বিচলিত হয়ে বললো,’বেশি খারাপ লাগছে?’
শাহানার চোখ বুজে আসছে। সে অনেক কষ্টে বললো,’মাথাত পানি দেও আমার। দেও বইন,দেও!’
স্কুলের পিছনে ঝোপঝাড় আর মাদিনী নদী আছে। একটা ঘাটও আছে। পানির ব্যবস্থা আছে। পদ্মজা শাহানার এক হাত শক্ত করে ধরে ঘাটে নিয়ে আসে। দুজন লোকও সাথে সাথে যায়। শাহানা নিকাব খুলার আগে দুজন লোককে উদ্দেশ্য করে বললো,’এই তোমরা আইছো কেরে? নিকাব খুইললা পানি দিমু মাথাত। যাও তোমরা।’
দুজন লোক নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে চলে যায়। এদিকে কেউ নেই। কেউ আসতে চাইলেও তাদের সামনে দিয়ে আসতে হবে। তাই ভয় নেই।

শাহানা নিকাব খুলে মাথায় পানি দিল। শাহানা মাথা ঝুঁকে রাখে। আর পদ্মজা দুইহাতে পানি নিয়ে শাহানার মাথায় ঢালে। কিছুক্ষণ পানি দেয়ার পর শাহানা সুস্থবোধ করে। বিশ্রাম নেয়ার জন্য সে একটু দূরে একটা গাছের গোড়ায় বসলো। পদ্মজা চারপাশ দেখে নিজের নিকাব খুললো। চোখ দুটি জ্বলছে। পানি দেয়া প্রয়োজন।
পদ্মজা যেখানে ছিল সেখানে নেই! লিখন চারপাশে চোখ বুলিয়েও পদ্মজার দেখা পেলো না। এখানে আসতে আসতে কোথায় চলে গেল?
তৃধাও খুঁজলো। স্কুলে একবার শুটিং হয়েছিল। তাই লিখন জানে স্কুলঘরের পিছনে একটা ঘাট আছে। পদ্মজা সেখানে থাকতে পারে ভেবে,সেদিকে গেলো লিখন। দুজন লোক নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে তার পাশ কেটে ভীড়ের দিকে যায়। লিখন ঘাটে এসে থামে। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে শাহানা পিছনে ফিরে তাকায়। আবার চোখ সরিয়েও নেয়। পদ্মজা মুখ ধুয়ে পিছনে ফিরতেই দূরে লিখনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। পদ্মজার গলার দুটো ঘাঢ় কালো-খয়েরি দাগ,মুখের ক্ষত,চোখের-মুখের অবস্থা দিনের আলোর মতো লিখনের চোখের সামনে ভেসে উঠে। শাহানা পদ্মজার এমন অবস্থা দেখে চমকে যায়। সে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি এসেই সমাবেশে চলে এসেছে! পদ্মজার সাথে নিকাব পরা অবস্থায় কথা হয়েছে। তাই পদ্মজার এই অবস্থা সে দেখেনি। লিখনের কথা হারিয়ে যায়। বাকহারা হয়ে পড়ে সে। একেই বোধহয় বলে,পৃথিবী থমকে যাওয়া। পদ্মজা দ্রুত নিকাব পরে নিল।
পদ্মজা এক পা,এক পা করে উপরে উঠে আসে। পদ্মজার প্রতিটি কদম লিখনের হৃৎপিণ্ডে কাঁপন ধরায়। সে কথা বলার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। শাহানা পদ্মজার এক হাত ধরে বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করলো,’ও পদ্ম,তোমার এই অবস্থা কেমনে হইলো?’
পদ্মজা চাপা স্বরে বললো,’বাড়িতে গিয়ে সব বলবো আপা।’

শাহানা চোখ দুটি বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। পদ্মজার শরীরে যে দাগ সে দেখেছে,এতে নিশ্চিত কেউ পদ্মজাকে মেরেছে। গলা চেপে ধরেছে! গালে নখের আঁচড়ও রয়েছে। শাহানা স্তব্ধ হয়ে যায়। আমির পদ্মজার জন্য কতোটা পাগল সবাই জানে। আমির-পদ্মজার ভালোবাসা গল্প সবার মুখেমুখে। শাহানা,শিরিন দুজনই তাদের শ্বশুর বাড়িতে আমির-পদ্মজার ভালোবাসার গল্প করে। সেই পদ্মজার গায়ে মারের দাগ! আমিরের তো মারার কথা না,অন্য কেউও পারবে না। তাহলে কীভাবে কী হলো? শাহানার মাথায় কিছু ঢুকছে না। পদ্মজা লিখনের দিকে তাকাতেই লিখন নিঃশ্বাস ছাড়লো। নিঃশ্বাসের শব্দ উপস্থিত তৃধা,শাহানা,পদ্মজা তিন জনই শুনতে পায়। পদ্মজা তার রিনঝিনে মিষ্টি কণ্ঠে বললো,’ আপনার সাথে আমার কথা ছিল।’
লিখন ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে স্পষ্ট স্বরে বললো,’কী হয়েছে তোমার সাথে?’
লিখনের চোখের কার্নিশে জল জমে। পদ্মজা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। কেউ তার মুখ দেখলে তাকে অনেক রকম প্রশ্নের সম্মূখীন হতে হবে। তাই সে মুখ দেখাতে চায়নি কাউকে। পূর্ণা-প্রেমার সাথে যখন দেখা হয়, তখনও সে নিকাব খুলেনি। লিখন এক পা এগিয়ে এসে আবার প্রশ্ন করলো,’ কে মেরেছে?’

পদ্মজা বুক ধুকপুক করছে। তার মিথ্যে বলায় অভ্যেস নেই। আবার সত্যটাও বলা সম্ভব নয়। পরিস্থিতি সেরকম নয়। পদ্মজা লিখনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তৃধার দিকে তাকালো। পুতুলের মতো সুন্দর মেয়েটা। উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে। তৃধা পদ্মজার শরীরের দাগ নিয়ে চিন্তিত নয়। সে আগ্রহ নিয়ে পদ্মজার চোখ দেখছে। কাঁদার কারণে ফুলে থাকলেও সৌন্দর্য হারিয়ে যায়নি। অসম্ভব সুন্দর চোখ। টানা টানা চোখ বোধহয় একেই বলে! তৃধা ঈর্ষান্বিত। পদ্মজা লিখনের প্রশ্নে বললো,’মারের দাগ হতে যাবে কেন?’
লিখন রুদ্ধশ্বাসে বললো,’মুখে দাগ,গলা চেপে ধরার দাগ,চোখ ফুলে আছে। কে বলবে এটা মারের দাগ না? আমির হাওলাদার মেরেছে?’
শাহানা চমকে যায়। রাগ হয়। শাহানা-শিরিন আমিরকে অনেক ভালোবাসে। আমিরকে নিয়ে এত বড় কথা কী করে বলতে পারে লিখন? শাহানা তেড়ে এসে রাগী স্বরে বললো,’বাবু মারবো কেরে? তুমি কিতা কও?’
পদ্মজা দ্রুত লিখনকে বললো,’সব বলব। আপনার সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। আপনার সাহায্য প্রয়োজন। অনুগ্রহ করে শুনুন।’
শাহানা পদ্মজার এক হাতে ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো,’ পর পুরুষের কাছে কিতার সাহায্য তোমার পদ্ম?’
পদ্মজা বললো,’আপা,আমি আপনাকে সব বলব। একটু সময় দিন।’
পদ্মজাকে পাহারা দেয়া দুজন লোকের নাম হাবু আর জসিম। হাবু-জসিমকে একা একা দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে,রিদওয়ান পদ্মজাকে খুঁজতে থাকলো। খুঁজতে খুঁজতে ঘাটে এসে উঁকি দেয়। লিখনের সামনে পদ্মজাকে দেখে ভয়ে হয় রিদওয়ানের। লিখন দেশের একজন খ্যাতিমান অভিনেতা। সে যদি পদ্মজার মুখ থেকে সব জেনে যায়,যে কোনো মূল্যে তাদের ধ্বংস করতে উঠেপড়ে লাগবে। আর সফলও হতে পারবে। পদ্মজা পারে না,কারণ তার স্বামী এতে জড়িত। তার দুই বোনকে নিয়ে ভয় আছে। সর্বোপরি সে একজন নারী! রিদওয়ান দূর থেকে ডাকলো,’পদ্মজা।’

রিদওয়ানের কণ্ঠ শুনে পদ্মজা আশাহত হয়। লিখনের সাথে কথা যে আর দীর্ঘ হওয়া সম্ভব নয় তা স্পষ্ট। পদ্মজা তাকালো। রিদওয়ান এগিয়ে এসে বললো,’চাচা যেতে বলেছেন।’
শাহানা রিদওয়ানকে বললো,’মাথাডা ঘুরতাছিল। পদ্ম আমারে ঘাটে আইননা পানি দিছে।’
রিদওয়ান আড়চোখে লিখনকে দেখলো। লিখনের প্রতিক্রিয়া দেখলো। লিখন তাকাতেই সে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। রিদওয়ানের দৃষ্টি দেখে লিখনের বিচক্ষণ মস্তিষ্ক বুঝে যায়, এই দৃশ্যে ঘাপলা আছে। পদ্মজা ভালো নেই,তার সাথে খারাপ কিছু হচ্ছে। আর রিদওয়ান সব জানে। সে জড়িত। রিদওয়ান শাহানাকে বললো ‘এখন ঠিক আছো?’
শাহানা এক হাতে নিজের কপাল চেপে ধরে বললো,’ হ ভাই।’
রিদওয়ান হেসে লিখনের দিকে তাকালো। করমর্দন করে বললো,’ কী খবর?’
রিদওয়ানের জবাব না দিয়ে লিখন বললো,’আমি পদ্মজার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলতে চাই।’
রিদওয়ান পদ্মজার চোখের দিকে তাকায়। তারপর লিখনের দিকে। বললো, ‘কী কথা?’
‘ব্যাক্তিগত। দয়া করে সুযোগ করে দিলে খুশি হবো।’ লিখনের সোজাসুজি কথা।
রিদওয়ান দূরে সরে দাঁড়ালো। বললো,’পদ্মজা আমাদের বাড়ির বউ। সে যার তার সাথে বাইরে নির্জনে কথা বলতে পারে না।’
লিখনের হাঁসফাঁস লাগছে। সে জ্ঞানহীন হয়ে পড়ছে। নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না। মন বার বার বলছে,পদ্মজা ভালো নেই! সত্যিই তো ভালো নেই। লিখন বললো,’পদ্মজা আমাকে কিছু বলতে চায়।’

রিদওয়ান পদ্মজার দিকে তাকিয়ে আদেশের স্বরে বললো,’পদ্মজা চলো।চাচা ডাকে।’
পদ্মজা রিদওয়ানকে মোটেও ভয় পায় না। রিদওয়ানের আদেশ শোনা তো দূরের কথা। তবে এই মুহূর্তে কিছুতেই লিখনের সাথে কথা বলা সম্ভব নয়। তাই সে চলে যাওয়ার কথা ভাবে। চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই লিখন পথ আটকে দাঁড়ায়। তার গলার স্বর চড়া হয়,’ আমাকে বলে যাও তোমার গলায় কীসের দাগ? মুখে কীসের দাগ? কে মেরেছে?’
‘কে মেরেছে?’ প্রশ্নটা কানে আসতেই রিদওয়ানের গলা শুকিয়ে যায়। এতকিছু কী করে লিখন দেখলো? পদ্মজা দেখিয়েছে? এভাবে বাইরের পুরুষ মানুষকে নিজের গলা দেখিয়েছে! রিদওয়ান তার আসল রূপ,ভাষা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। পদ্মজার উদ্দেশ্যে বললো,’ তুমি না সতীসাবিত্রী! পর-পুরুষকে গলা দেখিয়ে বেড়াও আমির জানে?’
লিখনের মাথা চড়ে যায়। সে শেষ কবে নিজের ব্যক্তিত্বের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে সে জানে না। তবে আজ হারিয়েছে। তার কাছে পরিষ্কার, পদ্মজা অত্যাচারিত! তার উপর জুলুম করা হয়। লিখন রিদওয়ানের শার্টের গলা চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,’মুখ সামলিয়ে কথা বলুন।’
রিদওয়ান লিখনকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল। লিখনের ঝাঁকরা চুল কপালে ছড়িয়ে পড়ে। রিদওয়ান বললো,’ অন্যের বউয়ের উপর নজর দেয়া বন্ধ করুন। পদ্মজা চলো।’ রিদওয়ান পদ্মজার হাত চেপে ধরে। পদ্মজা এক ঝটকায় রিদওয়ানের হাত সরিয়ে দিয়ে ঝাঁঝালো স্বরে বললো,’ আমি একাই যেতে পারি।’

তারপর লিখনকে বললো,’কথা বাড়াবেন না। আমাকে যেতে দিন।’
লিখন কারো কথা শুনতে রাজি নয়। সে তার ধৈর্য্য,ব্যাক্তিত্ব থেকে সরে এসেছে। লিখন আবারও পদ্মজার পথ আটকালো। প্রশ্ন করলো,’কাকে ভয় পাচ্ছো তুমি? আমাকে বলো।’
শাহানা নিজেও অবাক পদ্মজার অবস্থা দেখে। কিন্তু লিখনের পদ্মজাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি তার ভালো লাগছে না। অন্য পুরুষ কেন তাদের বাড়ির বউয়ের জন্য এতো আকুল হবে? শাহানা কর্কশ কণ্ঠে লিখনকে বললো,’আপনে পথ ছাড়েন না ক্যান? অন্য বাড়ির বউরে এমনে আটকানি ভালা মানুষের কাম না।’
লিখনের চোখেমুখে অসহায়ত্ব স্পষ্ট! অন্য বাড়ির বউ! অন্যের বউ! এই শব্দগুলো কেন পৃথিবীতে এসেছে? সহ্য করা যায় না। রিদওয়ান লিখনকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে চাইলো। লিখন রিদওয়ানের হাতে ধরে ফেলে। রিদওয়ানের মুখের কাছে গিয়ে চাপাস্বরে বললো,’পদ্মজা আমার হৃদয়ে যত্নে রাখা জীবন্ত ফুল। তার গায়ে আঘাত করার সাহস যে করেছে তাকে আমি টুকরো টুকরো করবো।’
লিখনের হুমকি রিদওয়ানের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। সে আমিরকে সহ্য করে, কারণ আমির ঠান্ডা মাথার খুনী। চোখের পলকে যে কাউকে ধ্বংস করে দিতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা,পাতালঘর, বাড়ি,অফিস,গোডাউন সবকিছুর একমাত্র মালিক আমির। তাই রিদওয়ান রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। তাই বলে সাধারণ জগতের একজন অভিনেতার হুমকি সহ্য করবে? কিছুতেই না। রিদওয়ান লিখনের চোখে আগুন চোখে তাকিয়ে বললো,’ এসব সিনেমায় গিয়ে বলুন। নাম বাড়বে।’
লিখন রিদওয়ানকে ছেড়ে পদ্মজার দিকে মুখ করে দাঁড়াল। বললো,’ পদ্মজা তুমি তো ভীতু না। ভয় পেয়ো না। আমাকে বলো কী হয়েছে তোমার সাথে?’

পদ্মজা বললো,’আমি কাউকে ভয় পাচ্ছি না। আপনার সাথে পরে কথা বলব।’
রিদওয়ান পদ্মজার দিকে তেড়ে এসে বললো,’পরে কীসের কথা?’
রিদওয়ান পদ্মজার মুখের উপর ঝুঁকেছে বলে লিখনের রাগ বাড়ে। সে রিদওয়ানের পিঠের শার্ট খামচে ধরে। সঙ্গে,সঙ্গে রিদওয়ান লিখনের মুখ বরাবর ঘুষি মারলো। তৃধা,পদ্মজা,শাহানা চমকে যায়। তৃধা আতঙ্কে লাল হয়ে যায়। সে দৌড়ে এগিয়ে আসে। লিখন তার ঘোলা চোখ দিয়ে রিদওয়ানের উপর অগ্নি বর্ষিত করে। রিদওয়ানকে তার ঘুষি ফিরিয়ে দেয়। দুজন মারামারির পর্যায়ে চলে যায়। তৃধা,পদ্মজা কেউ থামাতে পারে না। আর কিছু সময় এভাবে চললে,কেউ একজন খুন হয়ে যাবে। শাহানা চিৎকার করতে করতে স্কুলের সামনে ছুটে যায়। তার চিৎকার শুনে উপস্থিত মানুষদের মাঝে হট্টগোল শুরু হয়। শৃঙ্খলা ভেঙে যায়। মজিদ,খলিল ছুটে আসে স্কুলের পিছনে। পরিচালক আনোয়ার হোসেন লিখনকে মারামারি করতে দেখে খুব অবাক হোন। সবাই মিলে লিখন ও রিদওয়ানকে থামালো। তারপর দুজনকে নিয়ে স্কুলের সামনে আসে। উপস্থিত মানুষরা উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে। গুরুজনরা জিজ্ঞাসা করে,তারা কেন মারামারি করছিল? মজিদ হাত তুলে সবাইকে থামালেন। তারপর রিদওয়ানের দিকে তাকালেন। রিদওয়ান চোখের ইশারায় কিছু বলছে। কিন্তু মজিদ বুঝতে পারেননি। তিনি রিদওয়ানকে জিজ্ঞাসা করলেন,’ কী সমস্যা রিদওয়ান? এমন অসভ্যতামির মানে কী?’
রিদওয়ান বাঁকা চোখে উপস্থিত মানুষদের দেখলো। সবাই তাকিয়ে আছে। আজ কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে নিশ্চিত! রিদওয়ান মাথা নীচু করে বললো,’লিখন শাহ পদ্মজার পথ আটকাচ্ছিল।’

রিদওনায়ের কথা শুনে মানুষদের মুখ থেকে লিখনের উদ্দেশ্যে ছিঃ,ছিঃ বেরিয়ে আসে। লিখন হতবাক হয়ে যায়। হতবাক হয় পূর্ণা,প্রেমা,প্রান্ত, পদ্মজা। মজিদ লিখনকে প্রশ্ন করলেন,’রিদওয়ান যা বলছে সত্য?’
লিখন পদ্মজার চোখের দিকে তাকালো। তারপর বললো,’ সত্য। কিন্তু আমি পদ্মজার গলায়,মুখে দাগ দেখেছি। গলায় যে দাগ সেই দাগ দেখে বুঝা যায় তার গলা কেউ চেপে ধরেছিল। মুখে ক্ষত,নখের আঁচড়। চোখ ফোলা। আমি শুধু জানতে চাচ্ছিলাম এসব কী করে হয়েছে? কে মেরেছে?’
লিখনের কথা শুনে মজিদের মাথা ঘুরে যায়। আমির বলেছিল,পদ্মজাকে সমাবেশে না আনতে। এতে সমস্যা হতে পারে। মজিদ আমিরের কথায় গুরুত্ব দেননি। ভেবেছেন,পদ্মজা গ্রামে আছে সবাই জানে। আর গত সমাবেশে তিনি বলেছিলেন, পরবর্তী সমাবেশে আমির বা পদ্মজা বিতরণ করবে শীতবস্ত্র। আমির তো চলে গেল। তাই পদ্মজাকে এনেছেন। আর এই সমাবেশে বাড়ির মেয়ে-বউরা অসুস্থ থাকলেও উপস্থিত থাকে। যদি কেউ প্রশ্ন করে,আমিরের বউ কোথায়? প্রশ্নটা সহজ,উত্তরও বানিয়ে দেয়া যেত। তবুও মজিদ হাওলাদার প্রশ্ন এড়াতে পদ্মজাকে নিয়ে এসেছেন। তিনি প্রশ্ন শুনতে পছন্দ করেন না।
মজিদের মুখের রঙ পাল্টে যাওয়াটাও লিখনের চোখে পড়ে। সে ভেবে নেয়,এ সম্পর্কে মজিদও জানে। সে সবার সামনে প্রশ্ন করে, ‘আপনার বাড়ির বউয়ের শরীরে মারের দাগ কী করে এলো?’

মজিদের কণ্ঠস্বর পরিবর্তন হয়। তিনি কাঠ কাঠ স্বরে বললেন,’তুমি কী করে দেখেছো?’
‘পদ্মজা ঘাটে নিকাব খুলে মুখে পানি…’
মজিদ লিখনের কথায় বাঁধা দিয়ে বললেন,’তুমি বাড়িতে এসো এ নিয়ে কথা হবে।’
মজিদ ভেতরে ভেতরে ভয়ে জমে গিয়েছেন। পদ্মজা যদি মুখ খুলে কী হবে? এখানে মজিদের প্রতিপক্ষরাও রয়েছে। তারা সুযোগ নিবে। লিখন কিছু একটা বলতে চেয়েছিল। তার পূর্বে মজিদের নতুন প্রতিপক্ষ ইয়াকুব আলী বললেন,’বাড়ির বউয়ের গায়ে মারের দাগ! এটা তো ভালো কথা না। মাতব্বর কি ছেলের বউয়ের উপর অত্যাচার করে?’
মজিদ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়েন! পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে গেছে। যে করেই হউক পরিস্থিতি হাতে আনতে হবে। মজিদ ইয়াকুব আলীকে হেসে বললেন,’ অহেতুক কথা বলবেন না। আমাদের বাড়িতে বউরা রানির মতো থাকে। গায়ে হাত তোলার প্রশ্নই আসে না। কথা বলার পূর্বে বিবেচনা করে বলবেন।’
ইয়াকুব আলী হাসলেন। বললেন,’তাহলে কী নায়ক সাহেব মিথ্যা বলছেন?’
ইয়াকুব আলীর সাথে আরো দুজন তাল মিলিয়ে বললো,’আমরা সত্যটা জানতে চাই।’
হাওলাদারদের অবস্থায় দরজার চিপায় পড়ার মতো। পদ্মজা তাদের অবস্থা দেখে মুচকি হাসে। পদ্মজার শরীরে মারের দাগ আছে! এ কথা শুনে পূর্ণা মানুষজনের মাঝখান থেকে বেরিয়ে উঁচু মাটির টিলার উপর উঠলো। পদ্মজার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো। বললো,’আপা? লিখন ভাই কী বলছে?’
পদ্মজা নিরুত্তর। খলিল উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। সব না সবাই জেনে যায়! আতঙ্কে তিনি সবার উদ্দেশ্যে বললেন,’লিখন শাহ মিছা কথা কইতাছে।’
খলিলের কথা শুনে মজিদের ইচ্ছে হয় খলিলকে জুতা দিয়ে পিটাতে। লিখন বললো,’এইটুকুও মিথ্যা না। দাগগুলো এখনো তাজা। পদ্মজা তো সামনেই আছে।’

একজন বয়স্ক মহিলা বললেন,’পদ্ম মার নিকাবডা সরাইলেই হাচামিছা জানা যাইবো।’
মজিদ জানতেন কেউ এরকম কিছুই বলবে। এখন প্রমাণিত হয়ে যাবে খলিল মিথ্যা বলেছে! মজিদের ভেতরটা থরথর করে কাঁপছে। তিনি কী করবেন? কী বলবেন? বুঝতে পারছেন না। পদ্মজা চেয়েছিল অন্যভাবে এই অধ্যায়ের সমাপ্তি করতে। যেহেতু সবার সম্মূখে সব প্রকাশ করার সুযোগ এসেছে সেহেতু উচিত সব ফাঁস করে দেয়া। এতে সব শুনে কেউ না কেউ মেয়েগুলোকে উদ্ধার করতে পদক্ষেপ নিতে পারবে। সে পুরো নিকাব না খুলে শুধু মুখটা উন্মুক্ত করলো। তার মুখের স্পষ্ট,কালসিটে দাগগুলো দেখে মানুষজনের কোলাহল বেড়ে যায়। সবাই ফিসফিসিয়ে কথা বলতে থাকে। পূর্ণা পদ্মজার গালের একটা ক্ষত দেখেছে। শুনেছিল তো দূর্ঘটনায় এমন হয়েছে। নখ ডেবে যাওয়া দুটো দাগ আর চোখের অবস্থা দেখে তার বুক ছ্যাঁত করে উঠে। সে পদ্মজার সামনে এসে দাঁড়ায়। নিকাব তুলে গলা দেখে চমকে যায়। অশ্রুসজল চোখে পদ্মজা দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে ডাকে,’আপা!’
ইয়াকুব আলী খুব অবাক হয়েছেন এরকম ভান করে বললেন,’মেয়েটার কী অবস্থা! মাতব্বর এভাবেই কী বউদের রানী করে রাখেন?’
মজিদের বুকের ব্যাথা বাড়ে। এক পা পিছিয়ে যান। কী হচ্ছে এসব! রিদওয়ান জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজায়। সে পদ্মজার ভাব দেখে ধারণা করছে,পদ্মজা এখুনি সব বলে দিবে। আর সব শোনার পর এত মানুষের সাথে তাদের পেরে উঠা সম্ভব নয়। রিদওয়ান ঢোক গিলে আচমকা বলে উঠলো,’আমির মেরেছে। এমনি এমনি মারেনি! পদ্মজার লিখন শাহর সাথে ছয় বছর আগে সম্পর্ক হয়েছিল। বিয়ের পরও লুকিয়ে ঢাকা অবৈধ মেলামেশা করে গেছে। আমির কয়দিন আগে হাতেনাতে ধরেছে। আর তাই মেরেছে।’
রিদওয়ানের কথা শুনে পদ্মজা ও লিখনের মাথায় যেন বাজ পড়ে। মজিদের চোখ দুটি জ্বলজ্বল করে উঠে। রিদওয়ান বাঁচার পথ খুঁজে দিয়েছে! মানুষজনের কোলাহল দ্বিগুণ হয়। মজিদ কখনো ভাবেননি,তার পরিবার নিয়ে আবারো এমন সভা হবে! যা হওয়ার হয়ে গেছে,পদ্মজার সম্মান উৎসর্গ করে হলেও তাদের সম্মান রক্ষা করতে হবে। লিখন ক্রোধে-আক্রোশে রিদওয়ানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। হাবু,জসিম সহ আরো কয়েকজন লিখনকে আটকায়। লিখন চেঁচিয়ে বললো,’মিথ্যাবাদী।’
কেউ একজন বললো,’মাতব্বর সাহেব,সত্যিডা খুলে বলেন।’

মজিদ হাওলাদার কেশে সবার উদ্দেশ্যে বললেন,’আমি চাইনি,আমার বউয়ের কোনো দূর্নাম হউক। হাজার হউক সে আমার একমাত্র ছেলের বউ। কিন্তু পরিস্থিতি যখন বাধ্য করছে তখন না বলে উপায় নেই। আপনারা অনেকেই জানেন,মোড়ল বাড়িতে লিখন শাহ একবার শুটিং করতে এসেছিল। তখন পদ্মজা আর লিখন শাহর মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠে। তারপর আমার ছেলে আমিরের সাথে পদ্মজার বিয়ে হয়। আমির পদ্মজাকে নিয়ে ঢাকা চলে যায়। ঢাকা লিখন শাহের সাথে পদ্মজার অবৈধ সম্পর্ক চলতে থাকে। আমার বোকা ছেলে কখনো ধরতে পারেনি। গ্রামে আসার পর লিখন শাহ দুইবার আমাদের বাড়িতে গিয়েছিল। প্রমাণ আছে কিন্তু। অনেকেই দেখেছেন। দেখেছেন তো?’
কয়েকজন বলাবলি করলো, তারা দেখেছে! মজিদ বললেন,’ লিখন শাহ কিন্তু পদ্মজার জন্য যেত। একদিন রাতেও যায়। তখন আমির হাতেনাতে ধরে দুজনকে। তাই আমির পদ্মজার গায়ের উপর হাত তুলে। রাগে একটু মার দেয়। এতে কী কোনো দোষ হয়ে গেছে আমার ছেলের?’
পদ্মজা ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মতো চিৎকার করে উঠে,’মিথ্যা কথা। আপনি বানিয়ে কুৎসা রটাচ্ছেন।’
মজিদ হাওলাদার বুকভরা নিঃশ্বাস নেন। তিনি জানেন,এই গ্রামবাসী তাকে কতোটা বিশ্বাস করে। আর লিখনকেও অনেকে বাড়িতে যেতে দেখেছে। পদ্মজার নামে একবার সালিশ বসেছিল। যদিও সেটা তার ছেলের সাথে তবে মেয়ে নির্দোষ হলেও তার একবারের বদনাম সারা জীবন রয়ে যায়! তিনি সবার সামনে দুই হাত তুলে নরম স্বরে বললেন,’আমার আর কিছু বলার নেই। বিশ্বাস, অবিশ্বাস আপনাদের উপর।’

লিখন হাবু ও জসিমকে আঘাত করলো। রিদওয়ান লিখনকে চেপে ধরে। রিদওয়ানের ইশারায় আরো কয়েকজন লিখনকে জাপটে ধরে। পরিচালক আনোয়ার হোসেন মাথা নিচু করে ফেলেন। মজিদ হাওলাদার মিথ্যা বলবেন না! তিনি মহৎ মানুষ। লিখন একটা মেয়ের জন্য পাগল সেটা তিনিও জানতেন। মজিদের কথা অবিশ্বাস করার কারণ নেই। তবে তিনি লিখনকে সৎ চরিত্রের ছেলে ভাবতেন। মুহূর্তে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। দ্বিতীয়বারের মতো পদ্মজার চরিত্রে ছিঃ,ছিঃ ধিক্কার ছুঁড়ে মারে গ্রামবাসী। কেউ যেন গায়ে হাত না দিতে পারে,আত্মরক্ষার জন্য পদ্মজা কোমরে ছুরি খুঁজলো! ছুরি নেই। সে অসহায় হয়ে পড়ে। চিৎকার করে সবার উদ্দেশ্যে বললো,’সবাই আমার কথা শুনুন।’
কেউ পদ্মজার কথা শুনলো না। সবার চেঁচামিচিতে তার গলার স্বর কারো কানেই যায় না। মজিদ হাওলাদারকে তারা অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। নিয়তি পদ্মজার সম্মানে দ্বিতীয়বারের মতো আঘাত হানে!
মজিদ হাওলাদার দুই হাত তুলে সবাইকে শান্ত হতে বললেন। তাৎক্ষণিক কোলাহল কমে আসে। তিনি সবার উদ্দেশ্যে বললেন,’আমার ঘরের বিচার আমার ঘরে হবে। আমি আর এ বিষয়ে কথা বাড়াতে চাই না। রিদওয়ান, পদ্মজাকে বাড়ি নিয়ে যাও।’
রিদওয়ান পদ্মজাকে ছুঁতে উদ্যত হতেই লিখন চেঁচিয়ে বললো,’পদ্মজা যাবে না।’
লিখন পদ্মজার জন্য ভয় পাচ্ছে। হাওলাদার বাড়ির মানুষগুলো কত বড় মিথ্যাবাদী সে আজ টের পেয়েছে। এতো বড় মিথ্যে চাপিয়ে দিলো, নিজেদের কুকর্ম লুকোতে! মজিদ হাওলাদারের মিথ্যা অভিনয় তাকে অবাক করেছে খুব। এরা পদ্মজাকে বাড়ি নিয়ে কী করে কে জানে! রিদওয়ান লিখনের কথা শুনলো না। সে পদ্মজাকে ধমকের স্বরে বললো,’বাড়ি চলো।’
তারপর হাত ধরলো। সঙ্গে সঙ্গে পদ্মজাও রিদওয়ানের হাত চেপে ধরলো। চাপাস্বরে বললো,’ছয় বছর আগের অপবাদ আবার আমার জীবনে নিয়ে আসার জন্য আপনার মতো নরপশুদের অভিশাপ! কিন্তু এবার না আমাকে না আমার বোনদের, কাউকে ছোঁয়ার সাহস কেউ দেখাতে পারবে না।’

পদ্মজা রিদওয়ানের মুখের উপর থুথু ছুঁড়ে মারে। উপস্থিত মানুষজন চমকে যায়। কোলাহল দ্বিগুণ হয়। রিদওয়ান পদ্মজার দিকে আগুন চোখে তাকায়। তার উপর হাত তোলার জন্য প্রস্তুত হয়। পদ্মজার পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল পূর্ণা। সে আর রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। রিদওয়ানের পূর্বে রিদওয়ানের গালে শরীরের সব শক্তি দিয়ে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। পূর্ণার আকস্মিক ব্যবহারে সবাই চমকে যায়। চারিদিকে চেঁচামিচি শুরু হয়ে যায়। বিশৃঙ্খলা বেড়ে যায়। রিদওয়ান রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। সে পূর্ণার গলা চেপে ধরে। শিরিন ভয়ে চিৎকার করে উঠে,’ও আল্লাহ! আল্লাহর গযব পড়ছে এইহানে! গযব পড়ছে!’
তারপর দ্রুত সরে যায়। শাহানা,খলিল রিদওয়ানকে আটকানোর চেষ্টা করে। রিদওয়ান রাগে কিড়মিড় করছে। খলিল চাপাস্বরে রিদওয়ানের কানে কানে বললেন,’রিদু পূর্ণারে ছাড়,মানুষ দেখতাছে।’
রিদওয়ান ছাড়লো না। পদ্মজা জানে,এই মুহূর্তে সে হাওলাদার বাড়ির মানুষদের আঘাত করলে গ্রামবাসী ভালো চোখে দেখবে না। তবুও রিদওয়ানকে আঘাত করার জন্য বাধ্য হতে হয়। পদ্মজা রিদওয়ানের পেট বরাবর জোরে লাথি বসায়। রিদওয়ান ছিটকে সরে যায়। দুই হাতে পেট চেপে ধরে। শাহানা ‘ও মাগো’ বলে চেঁচিয়ে উঠলো। পূর্ণা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
মৃদুল গফুর মিয়াকে নিয়ে স্কুলের দিকে আসছিল। দূর থেকে দেখতে পেল মাঠের মানুষজন অস্থির হয়ে আছে। সে গফুর মিয়াকে বললো,’

আব্বা, আপনি আসেন। আমি আগে যাইতাছি।’
তারপর দৌড়াতে থাকে। স্কুলমাঠে পৌঁছাতেই উঁচু টিলায় রিদওয়ানকে পূর্ণার গলা চেপে ধরতে দেখলো। তার রক্ত মাথায় উঠে যায়। শরীরে যেন কেউ আগুন ধরিয়ে দেয়। এদিকওদিক খুঁজে একটা মাঝারি আকারের বাঁশ পেল। সে দ্রুত বাঁশ নিয়ে দৌড়াতে থাকে। এক হাতে লুঙ্গি ধরে, যা হাঁটু অবধি উঠে আসে। মৃদুলের দৌড়ের গতিতে অনেক মানুষ ধাক্কা খেয়ে উল্টে পড়ে। মৃদুলের চোখের দৃষ্টি রিদওয়ানের দিকে। তার মস্তিষ্ক এলোমেলো। মজিদ দ্রুত পদ্মজা-রিদওয়ানের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালেন। চিৎকার করে বললেন,’কী হচ্ছে? কী হচ্ছে? থামো সবাই।’
কিন্তু কোনোকিছুই থামলো না। মৃদুলের উপস্থিতি সব লণ্ডভণ্ড করে দিল। সে বাঘের মতো লাফিয়ে উঠে টিলার উপর। বাঁশ দিয়ে রিদওয়ানকে আঘাত করতে গিয়ে শাহানা,খলিলসহ আরো দুজন লোককে আঘাত করে বসে। মজিদ দ্রুত টিলা ছেড়ে সরে যান। মৃদুল খুব রাগী! মৃদুলের এলাকার অনেকে মৃদুলকে মাথা খারাপ বলে। সে কখনো বুদ্ধি দিয়ে কিছু করে না। সবসময় ক্রোধকে মূল্য দেয়। রাগের বশে কখন কী করে নিজেও জানে না। মানুষজন ছোটাছুটি করে পালাতে থাকে। শুধু মৃদুলের হুংকার শোনা যায়। ক্রোধ থাকে উন্মাদ করে দিয়েছে। সে রিদওয়ানকে বলছে,’জার*** বাচ্চা,তুই কার গায়ে হাত দিছস! তোরে আজ আমি মাটির ভিত্রে গাঁইথা ফেলমু।’
আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা মজিদ হাওলাদারের লোকেরা মৃদুলকে ধরতে দৌড়ে আসে। তৃধা ভয়ে দূর থেকে দুই হাতে মুখ ঢেকে ফোঁপাচ্ছে। আনোয়ার হোসেন তৃধার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। তৃধার মাথায় হাত রাখলেন। আনোয়ার হোসেনের দিকে তাকিয়ে তৃধা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। বললো,’লিখনকে কেন ছাড়ছে না ওরা?’
আনোয়ার হোসেন টিলার উপর চোখ রেখে বললেন,’জানি না মা। কী হচ্ছে বুঝতে পারছি না। কেউ খুন হয়ে যাবে এখানে। লিখন যে কেন এসবে জড়িয়ে পড়লো!’

আনোয়ার হোসেনের কণ্ঠে আফসোস। তৃধা মাটিতে বসে। তার কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে। চার-পাঁচজন লোক লিখনকে জাপটে ধরে রেখেছে। লিখন ছটফট করছে ছোটার জন্য। এই দৃশ্য সে সহ্য করতে পারছে না।
পদ্মজা পূর্ণাকে বুকের সাথে চেপে ধরলো। পূর্ণা ভালো করে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। পদ্মজার বুক জ্বলছে। পূর্ণার কষ্ট তাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। মৃদুল রাগে আকাশ কাঁপিয়ে চিৎকার করছে। রিদওয়ানকে ধরতে পারলে,সে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। কিন্তু পারছে না। টিলার উপর পনেরো-বিশ জনের একটা জটলা লেগে যায়। হাতাহাতি,ধ্বস্তাধস্তি চলে বিরতিহীনভাবে। মজিদ চোখের চশমাটা ঠিক করে ঠান্ডা মাথায় ভাবলেন। এই মুহূর্তে পরিস্থিতি হাতে আনা ভীষণ জরুরি! নয়তো অনেক বিপদ ঘটে যেতে পারে। তিনি তার ডান হাত রমজানকে ডেকে ফিসফিসিয়ে কিছু বললেন। মিনিট দুয়েকের মধ্যে জটলার মাঝখান থেকে একটা আর্তচিৎকার ভেসে আসে। শব্দ তুলে লিখন শাহর দেহ লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। তার পিঠ থেকে রক্তের ধারা নামছে। মৃদুল আকস্মিক লিখনকে এভাবে পড়তে দেখে চমকে যায়। রিদওয়ান লিখনকে আহত হতে দেখে মজিদের দিকে তাকালো। তার মুখ রক্তাক্ত। মৃদুল এতজনকে উপেক্ষা করেও তাকে আঘাত করতে সক্ষম হয়েছে! মজিদ ইশারায় রিদওয়ানকে কিছু একটা বুঝালেন। রিদওয়ান তাৎক্ষণিক পদ্মজাকে খুঁজলো। দেখলো,পদ্মজা মাটিতে পড়ে আছে। তার চোখ দুটি বোজা। মজিদের একটা পদক্ষেপ পুরো পরিস্থিতি পাল্টে দিল! লিখন হয় মারা যাবে,নয়তো অনেকদিন হাসপাতালে পড়ে থাকবে। আর পদ্মজাকে একবার বাড়ি নিয়ে যেতে পারলেই হলো। আর মুক্তি পাবে না! রমজান সবার আড়ালে দ্রুত ঘাটে গেল। রক্তমাখা ছুরি আর হাতের রুমাল নদীতে ছুঁড়ে ফেললো।

এশারের আযান পড়ছে। পদ্মজা ধীরে ধীরে চোখ খুললো। নিজেকে নিজের ঘরে আবিষ্কার করলো। মাথা ব্যথা করছে খুব। সে এক হাতে কপাল চেপে ধরে। তখনই দুপুরের সব ঘটনা মনে পড়ে যায়। পূর্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল সে, তখন কে যেন পিছন থেকে মুখে কিছু একটা চেপে ধরে। তারপর আর কিছু মনে নেই! পদ্মজা দ্রুত উঠে বসে। জুতা না পরেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় লতিফার দেখা পেল। লতিফা পদ্মজাকে দেখে বললো,’কই যাইতাছো?’
‘পূর্ণা কোথায়? পূর্ণার কাছে যাব।’
‘পূর্ণা তো উপরে।’
পদ্মজা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,’উপরে মানে? তিন তলায়?’
‘হ।’
‘এখানে কে নিয়ে আসলো?’
পদ্মজা প্রশ্ন করলো ঠিকই,উত্তরের আশায় থাকলো না। দৌড়ে তিন তলায় চলে গেল। তিন তলার একটা ঘরেই পালঙ্ক আছে। রুম্পা যে ঘরে ছিল! পদ্মজা সেই ঘরে এসে মৃদুলকে দেখতে পেল। মৃদুল চেয়ারে বসে আছে। বিছানায় শুয়ে আছে পূর্ণা। পদ্মজা উল্কার গতিতে পূর্ণার মাথার কাছে গিয়ে বসলো। মৃদুল পদ্মজাকে দেখে সংকুচিত হয়। বললো,’ পূর্ণা ভালা আছে ভাবি।’
‘ও কি অজ্ঞান?’
‘না,ঘুমাইতাছে। কিছুক্ষণ আগে সজাগ ছিল।’
‘খেয়েছে? ‘
‘হুম। আপনার ধারে অনেক্ষন বইসা ছিল।’
পদ্মজা পূর্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তারপর পূর্ণার গালে,কপালে চুমু দিল। মৃদুলকে প্রশ্ন করলো,’প্রেমা,প্রান্ত কোথায়?’
‘বাড়িত গেছে।’
‘ঠিক আছে ওরা?’
‘জি ভাবি।’
‘আর লিখন শাহ?’
লিখন শাহর কথা শুনে মৃদুল চুপ হয়ে যায়। পদ্মজা উৎকণ্ঠিত হয়ে প্রশ্ন করলো,’ উনি কোথায়? কেমন আছেন?’
মৃদুল মাথা নত করে বললো,”ভাবি,ভীড়ের মাঝে কেউ একজন ভাইরে ছুরি মারছে!’
পদ্মজা এক হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে। তারপর কাঁপা স্বরে বললো,’বেঁচে আছে?’
‘জানি না ভাবি। হাসপাতালে নিয়া গেছে সবাই। পুলিশ আইছিল বিকালে।’
পদ্মজার চোখে জল টলমল করে উঠে। মানুষটা এতদিন তাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে গেছে। ধৈর্য্য ধরে থেকেছে। কঠিন ব্যক্তিত্বের আড়ালে তার জন্য ভালোবাসা যত্ন করে রেখেছে। পদ্মজা সবকিছু জানে। সব জেনেও সে কিছু করতে পারেনি। ভালো তো করতে পারলো না উল্টে তার জন্য ক্ষতি হয়ে গেল! পদ্মজার চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। দ্রুত সে জল মুছে ফেললো। আফসোস হচ্ছে! ঘাটে কথা বলা একদম ঠিক হয়নি! মেয়েগুলো হাতছাড়া হয়ে গেছে ভেবে,সে চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। আর লিখনও আজ এতো উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল!
সব ভাগ্যে লেখা ছিল। তাই হয়তো হয়েছে। কখনো হায়-হুতাশ করতে নেই। তাই পদ্মজা সিদ্ধান্ত নিল,সে লিখনের জন্য দুই রাকাত নফল নামায আদায় করবে। যেন সে সুস্থ হয়ে উঠে। লিখনের জন্য পদ্মজার প্রার্থনা করা দায়িত্ব! পদ্মজার কাছে এইটুকু অধিকার লিখনের আছে! পদ্মজা মৃদুলকে বললো,’পূর্ণা ঘুমাক তাহলে। দেখে রাখবেন। আমি আসছি।’
‘আচ্ছা ভাবি।’

পদ্মজা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। মৃদুল দরজার বাইরে তাকিয়ে রইলো। পদ্মজাকে তার অনেক প্রশ্ন করার আছে। লিখন-পদ্মজার নামে যে অপবাদ দেয়া হয়েছে সেটা যে মিথ্যা মৃদুলের চেয়ে ভালো কে জানে! সে নিজের চোখে দেখেছে লিখন শাহর কষ্ট,পদ্মজার সম্মান রক্ষার্থে নিজের অনুভূতি লুকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা,একটু কথা বলার আশায় ছটফট করা! এতো বড় মিথ্যা অপবাদ হাওলাদার বাড়ির মানুষেরা কেন দিল? আর পদ্মজার গায়ের দাগগুলো সেগুলোই কীসের? আমির হাওলাদার কোথায়? মৃদুলের ভাবনার সুতো ছিঁড়ে যায় লতিফার আগমনে। লতিফা খাবারের প্লেট টেবিলের উপর রাখলো। তারপর বললো,’পূর্ণার খাওন দিয়া গেছি। আর আপনের আম্মা কইছে নিচে যাইতে।’
মৃদুল বললো,’একটু পরে যামু। আম্মা-আব্বায় খাইছে?’
‘হ,খাইছে।’
‘অন্যরা খায় নাই?’
‘সবাই খাইছে। রিদু ভাইজানে বাড়িত নাই।’
‘কু** বাচ্চা লুকাইছে।’
লতিফা আড়চোখে মৃদুলকে দেখলো। মৃদুল রাগে ছটফট করছে। এক হাত দিয়ে আরেক হাত খামচে ধরে রেখেছে। লতিফা বললো,’আপনের আম্মার মেজাজ ভালা না।’
‘কেন? কী অইছে?’
‘কইতে পারি না। আপনের আব্বার লগে চিল্লাইতে হুনছি।’
মৃদুলকে চিন্তিত হতে দেখা গেল না। তার আম্মা একটু বদরাগী। সব সময় চেঁচামেচি করে। এতে সে অভ্যস্ত। মৃদুল লতিফাকে বললো,’ আমির ভাই কই আছে?’
‘ঢাকাত গেছে। কুনদিন আইবো জানি না।’
‘আচ্ছা,যাও এহন।’

লতিফা জায়গা ত্যাগ করলো। মৃদুল ধীরে ধীরে হেঁটে জানালার কাছে গেল। জানালার কপাট খুলে দিল। আজ চাঁদ উঠেছে। জ্যোৎস্না রাত। সে পূর্ণাকে ভালোবাসার কথা বলার জন্য এমন একটা রাতের অপেক্ষা করেছিল। জানালা খুলে দেয়াতে চাঁদের আলো পূর্ণাকে ছুঁয়ে দেয়ার সুযোগ পায়। চাঁদ তার নিজস্ব মায়াবী আলো নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে পূর্ণার সারামুখে। পূর্ণার চোখমুখ সেই আলোয় চিকচিক করে উঠে। অন্যরকম সুন্দর দেখায়। মৃদুল পূর্ণার পাশে এসে বসলো। পূর্ণার মুখের দিকে তাকাতেই, মৃদুলের চোখে ভেসে উঠে,রিদওয়ান কীভাবে পূর্ণার গলা চেপে ধরেছিল! মৃদুলের মেজাজ চড়ে যায়। রিদওয়ানকে সে যতক্ষণ ইচ্ছামত পেটাতে না পারবে শান্তি মিলবে না! মৃদুল অনেকক্ষণ রিদওয়ানকে খুঁজেছে। পেল না। মৃদুল ছটফট করতে করতে বিড়বিড় করলো,’হারামির বাচ্চা!’
পূর্ণা ঘুমের মধ্যে নড়েচড়ে উঠে। একপাশ হয়। পূর্ণার দেহ নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল। প্রান্ত পূর্ণাকে বাড়ি নিয়ে যেতে বলে। বাসন্তী বাড়িতে একা। তিনি কিছুই জানেন না। তখন মজিদ বললেন,পূর্ণাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গেলে বেশি ভালো হবে। পদ্মজা সেখানে আছে। মৃদুলও রাজি হয়ে যায়। তার কাছাকাছি থাকবে পূর্ণা এর চেয়ে আনন্দের কী হতে পারে! প্রান্ত মেনে নিল। এই মুহূর্তে মৃদুলই পূর্ণার অভিভাবক। মৃদুল বুঝতে পারেনি ,মজিদ হাওলাদার ভালো মানুষি দেখাতে এই প্রস্তাব দিয়েছেন। যাতে গফুর মিয়া বা মৃদুল অথবা গ্রামবাসী কেউই মজিদকে দোষী না ভাবে। মজিদ সবাইকে নিজের উদারতা দেখিয়েছেন। গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে বলেছেন,পদ্মজা দোষী হলেও তার বোন দোষী নয়। রিদওয়ান পূর্ণার সাথে অন্যায় করেছে। এজন্য রিদওয়ানের শাস্তি হবে। তিনি রিদওয়ানকে সবার সামনে থাপ্পড় দিয়েছেন। আর বলেছেন,পূর্ণা সুস্থ হলে পূর্ণার কাছে ক্ষমা চাইবে রিদওয়ান।
মৃদুল কল্পনা থেকে বেরিয়ে পূর্ণার এক হাত মুঠোয় নিয়ে হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে উচ্চারণ করলো,’তাড়াতাড়ি সুস্থ হইয়া যাও। আমি তোমারে নিয়া যাইতে আইছি।’

মৃদুল পূর্ণার হাতে আলতো করে স্পর্শ করতে করতে তার মায়াবী মুখখানা মুখস্থ করে নিল। মৃদুলের ইচ্ছে হচ্ছে,পদ্মজার মতো পূর্ণার কপালে চুমু এঁকে দিতে। কিন্তু সেই বৈধতা বা সাহস তার নেই। সে পূর্ণার এক হাত শক্ত করে ধরে রাখলো।
পদ্মজা ঘরে প্রবেশ করতেই মৃদুল বিজলির গতিতে পূর্ণার হাত ছুঁড়ে ফেলে। তারপর নিঃশ্বাসের গতিতে দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণার ঘুম ভেঙে যায়। মৃদুল এতো জোরে হাত ছুঁড়েছে, ঘুম তো পালানোরই কথা! পদ্মজা অবাক হয়ে মৃদুলকে দেখলো। এতো ভয় পাওয়ার কী হলো! পূর্ণা চোখ খুলে পদ্মজাকে দেখে খুব খুশি হয়। সে দ্রুত উঠে বসলো। পদ্মজা পূর্ণার পাশে গিয়ে বসে। পূর্ণা শক্ত করে পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরে বললো,’আপা।’
পদ্মজা মৃদু হেসে বললো,’বোন আমার!’
তারপর পূর্ণার দুই গালে হাত রেখে বললো,’কষ্ট হচ্ছে?’
পূর্ণা মৃদুলকে দেখলো তারপর পদ্মজাকে বললো,’ না আপা।’
মৃদুল উসখুস করতে করতে বললো,’আমি তাইলে যাই ভাবি। ওইখানে পূর্ণার খাবার আছে।’
পদ্মজা মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। মৃদুল দরজার বাইরে গিয়ে পূর্ণার দিকে তাকালো একবার। পূর্ণার বদলে সে পদ্মজাকে তাকিয়ে থাকতে দেখলো। মৃদুল জোরপূর্বক হেসে জায়গা ছাড়লো।
রাতের আঁধারে চারদিকে নেমে এসেছে নিস্তব্ধতা। শাহানা ঘুমানোর চেষ্টা করছে, পারছে না। মৃদুলের অনিচ্ছাকৃত আঘাতে ডান হাতের বাহু ফুলে গেছে। হাড়ে তীব্র ব্যাথা। হাত নাড়ানো যাচ্ছে না। শাহানা বিড়বিড় করে বিলাপ করছে,’আল্লাহগো, আল্লাহ এত্ত বেদনা ক্যারে দিছো তুমি? কমায়া দেও আল্লাহ।’
ঘুমের ঘোরে শিরিন শাহানার হাতের উপর উঠে পড়ে। শাহানা ‘আল্লাহগো’ বলে চিৎকার করে উঠলো। শিরিনের ঘুম ভেঙে যায়। সে লাফিয়ে উঠে বসে। তার চোখেমুখে ভয়। শাহানার হাত ধরতে চাইলে শাহানা চিৎকার করে বললো,’ছুঁবি না আমারে! ডাইনি,মাইরা দিছে আমারেগো।’

শিরিন অপরাধী স্বরে বললো,’আমি দেখছি না আপা।’
‘ তুই কথা কইবি না।’
শাহানার চোখমুখ কুঁচকানো। সে প্রচণ্ড রেগে আছে। ধীরে,ধীরে বিছানা থেকে নামলো। শিরিন প্রশ্ন করলো,’কই যাও?’
শাহনা পূর্বের স্বরেই বললো,’মুততে যাই।’
শাহানার ঝাড়ি খেয়ে শিরিন আর কথা বললো না। সে অন্যদিকে ফিরে শুয়ে পড়লো। শাহানা টয়লেটে যাওয়ার পথে অন্দরমহলের ফাঁকফোকর দিয়ে আসা জ্যোৎস্নার আলোয় একটা পুরুষ অবয়বকে হাঁটতে দেখলো। শাহানা ভয় পেয়ে যায়। পুরুষ অবয়বটি শাহানাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে। শাহানার দিকে এগিয়ে আসে। শাহানা ভয়ার্ত স্বরে প্রশ্ন করলো,’তুমি কেলা?’
মৃদুলের মুখটা ভেসে উঠে। সে হেসে বললো,’আপা,আমি।’
মৃদুলকে দেখেই শাহানার মেজাজ তুঙ্গে উঠে। সে চোখ রাঙিয়ে বললো,’ কুত্তার বাচ্চা,তুই আমার সামনে আইবি না। লুলা(পঙ্গু) বানায়া দিছস আমারে!’
মৃদুল কাতর স্বরে বললো,’ছুডু ভাইয়ের লগে এমন করবা? আমি তো তোমারে দেখি নাই। ইচ্ছা কইরা মারি নাই।’
‘এই তুই যা। সামনে থাইকা সর।’

শাহানা গজ গজ করতে করতে টয়লেটের দিকে চলে যায়। মৃদুল ঠোঁট উল্টে শাহানার যাওয়া দেখে। তারপর সিঁড়ির দিকে তাকালো। তার ঘুম আসছে না একটুও। পূর্ণার কথা খুব মনে পড়ছে। ইচ্ছে হচ্ছে জ্যোৎস্নার আলো সারাগায়ে মেখে অনেকক্ষণ গল্প করতে। কোনো এক অদৃশ্য যন্ত্রনা বুকে হেঁটে বেড়াচ্ছে। অন্যদিনের তুলনায় পূর্ণাকে একটু বেশিই যেন মনে পড়ছে। বুকটা ফাঁকা,ফাঁকা লাগছে। অস্থিরতায় রুহ ছটফট করছে। মৃদুল তিনবার বিসমিল্লাহ বলে,তিনবার বুকে ফুঁ দিল। তারপর আর কিছু না ভেবে তৃতীয় তলায় উঠে আসে। শেষ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকে। বুকের ভেতর কেউ বুঝি ঢোল পিটাচ্ছে! সে শুনতে পাচ্ছে। মিনিটের পর মিনিট সে এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর কবুতরের মতো ডাকলো! মৃদুল যে কবুতরের মতো ডাকতে পারে, পূর্ণা আর মৃদুলের পরিবার ছাড়া কেউ জানে না। পূর্ণা যদি জেগে থাকে তাহলে মৃদুলের নকল ডাক সে চিনতে পারবে। তারপর নিশ্চয় সাড়া দিবে! মৃদুল পূর্ণার জন্য আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। পূর্ণার দেখা নেই। মৃদুল ভাবলো,পূর্ণা ঘুমে বোধহয়। তাই সে আর অপেক্ষা করার কথা ভাবলো না। চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ালো। তখন দরজা খোলার শব্দ কানে আসে। মৃদুল পিছনে তাকাতে গিয়েও তাকালো না। যদি পদ্মজা হয়! মৃদুল দ্রুত চলে যেতে উদ্যত হয়। তখন পূর্ণা ডাকলো,’দাঁড়ান।’
মৃদুল ঘুরে দাঁড়ালো। সাদা রঙের উপর নীল সুতোর কাজের নকশিকাঁথা
গায়ে জড়িয়ে পূর্ণা হেঁটে আসছে। মৃদুল পূর্ণার সাক্ষাৎ -এর আশায় ছিল।।যখন পূর্ণার সাক্ষাৎ পাওয়া গেল,বুঝতে পারলো তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। অস্বস্তি হচ্ছে। অদ্ভুত এক যন্ত্রণা হচ্ছে! তবে সেই যন্ত্রণা প্রাপ্তির! পূর্ণা সামনে এসে দাঁড়ালো। বললো,’ছাদে চলুন। তারপর কথা বলবো।’

দুজন একসাথে ছাদে উঠে আসে। ছাদে উঠতেই রাতের পৃথিবীর সৌন্দর্যের ঐশ্বর্যময় সমারোহ চোখে পড়ে। আকাশে ইয়া বড় চাঁদ। দুজন মুগ্ধ নয়নে চাঁদের দিকে তাকালো। সৌন্দর্যের মাদকতা ছড়িয়ে পড়ে দুজন প্রেমীর মনে। মৃদুল পূর্ণার দিকে তাকালো। পূর্ণাও তাকালো। চোখাচোখি হতেই দুজন হেসে ফেললো। মৃদুল প্রশ্ন করলো,’ঘুমাও নাই?’
‘না। ঘুম আসছিল না।’
‘একটু ভালা লাগতাছে?’
‘হুম।’
‘ভাবি ঘুমে?’
‘হুম।’
‘ভাবি কিছু কইছে?’
পূর্ণা মুখ ভার করে বললো,’না। অনেকবার প্রশ্ন করেছি,ভাইয়ার সাথে কী হয়েছে? মুখে,গলায় কীসের দাগ? আপা উত্তর দেয়নি। আপার মুখের উপর কথা বলার সাহসও হয়নি।’
মৃদুল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’কিছু একটা তো হইছেই।’
আচমকা মনে পড়েছে এমনভাবে পূর্ণা বললো,’তবে আমি ঘুমের ভান ধরে ছিলাম। তখন টের পেয়েছি আপা নীরবে কাঁদছে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে আপার জন্য। আপার কীসের কষ্ট না জানা অবধি আমি শান্তি পাবো না।’
‘আমির ভাইয়ের সাথে কিছু হইছে।’
‘ভাইয়ার দেখা পেলেই হতো।’ বললো পূর্ণা। তার দৃষ্টি আকাশের দিকে। তারপর আবার বললো,’কাল লিখন ভাইয়ের খবর এনে দিতে পারবেন?’
‘পারব। চিন্তা কইরো না। লিখন ভাইয়া ঠিক হইয়া যাইব।’

পূর্ণা আর কিছু বললো না। সে চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইলো। মৃদুল বললো,’রাতের আকাশ তোমার কেমন লাগে?’
পূর্ণা খোশ মেজাজে জবাব দিল,’অনেক ভালো লাগে! আমার আম্মা,আপা,প্রেমা সবাই জ্যোৎস্না রাত পছন্দ করে। আমাদের অনেক মুহূর্ত আছে জ্যোৎস্না রাত নিয়ে। আপনার কেমন লাগে?’
মৃদুল হাসলো। তারপর বললো,’ রাতের আকাশ কুনোদিন(কোনদিন) আমার দেখার ইচ্ছা হয় নাই। এমনি রাইতে বার হইলে বার হইতাম। আকাশ দেখার লাইগগা বার হইতাম না। প্রথম তোমার সাথে দেখতে আইলাম।’
পূর্ণা মৃদুলের দিকে তাকালো। তারপর চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললো,’এত্ত সুন্দর মানুষের পাশে আমার মতো কালো মানুষকে দেখে চাঁদ কী লজ্জা পাচ্ছে না?’
মৃদুল বললো,’চান্দের কীসের এত্ত দেমাগ যে,পূর্ণার গায়ের রঙ নিয়া লজ্জা পাইবো?’
পূর্ণা ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকালো। জ্যোৎস্নার রূপ-মাধুরী নিজ চোখে অবলোকন করার সৌভাগ্য পূর্ণার বহুবার হয়েছে। কিন্তু আজকের সময়টা অন্যরকম লাগছে। মায়াবী এক অনুভূতি সর্বাঙ্গে শীতল বাতাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। মৃদুল বললো,’বইসা কথা বলি।’
‘কোথায় বসবো? ছাদ তো কুয়াশায় ভেজা।’
মৃদুল চট করে তার লুঙ্গি খুললো। পূর্ণা শুরুতে চমকে যায়। পরে দেখলো,মৃদুলের পরনে প্যান্ট আছে! মৃদুল তার লুঙ্গি ছাদের মেঝেতে বিছিয়ে বললো,’বইসা পড়ো।’
পূর্ণা মনে মনে,আসতাগফিরুল্লাহ, আসতাগফিরুল্লাহ বলে লুঙ্গির উপর বসলো। কিছুটা দূরত্ব রেখে মৃদুল বসলো। বললো,’প্যান্টের উপর লুঙ্গি পরার সুবিধা হইলো এইডা। যেকোনো দরকারে কামে লাগে। একবার টুপি ছাড়া রাইতে মাছ ধরতে গেছিলাম। ঠান্ডা বাতাসে মাথা সেকি বেদনা! এরপর করলাম কী….”
পূর্ণা বাঁধা দিয়ে বললো,’লুঙ্গি দিয়ে টুপি বানিয়েছেন তাই তো?’
মৃদুল গর্বের সাথে বললো,’হ। উপস্থিতি বুদ্ধি এইডা।’
পূর্ণা হাসলো। মৃদুল অনেক রাগী,অহংকারী। তবুও সে মুগ্ধ করার মতো একটা মানুষ। সবসময় ঠোঁটে হাসি থাকে। এই মুহূর্তে রেগে, ওই মুহূর্তে সব ভুলে যায়। পূর্ণা ছাদের মেঝেতে তাকালো। চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় ছাদের মেঝেতে থাকা শিশির চকচক করছে। স্বচ্ছ রূপালি ঝরনার মতো চাঁদের আলো যেন চারপাশ ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে! কুয়াশা ভেদ করে চাঁদ উঁকি দিচ্ছে বারংবার। দুজনের মাঝে পিনপতন নিরবতা নেমে আসে । নিরবতা ভেঙে মৃদুল ডাকলো,’পূর্ণা?’

‘হু।’
‘আমার কাঁনতে ইচ্ছা হইতাছে।’
পূর্ণা হৃদয় কেঁপে উঠলো। সে মৃদুলের দিকে মুখ করে বসলো। বললো,’কেন?’
‘জানি না। আমি যখন যেইডা চাইছি, পাইছি। এই প্রথম কিছু পাইতে গিয়া ভয় করতাছে।’
‘কী সেটা?’
মৃদুল সরাসরি পূর্ণার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,’তোমারে! তোমারে পূর্ণা।’
নিস্তব্ধ প্রহরে, জ্যোৎস্নাময় রাতে একাকী দুজনের মাঝে প্রেমিক যখন বিভ্রম নিয়ে উচ্চারণ করে ভালোবাসার কথা প্রেমিকার হৃদয়ে কী হয়? জানে না পূর্ণা। তবে তার বেলা সে দমবন্ধকর এক অনুভূতির স্বাদ পেয়েছে। সব পাখপাখালি তাদের নীড়ে ঘুমাচ্ছে শীতে। শুধু পেঁচারা জেগে আছে। থেমে থেমে তারা ডাকছে। কনকনে শীতল হাওয়া বইছে। পূর্ণা মৃদুলের এক হাত ধরে বললো,’আপা সবসময় বলে, ভাগ্যে যা আছে তাই হয়। আল্লাহ কপালে যা লিখে রাখেন তাই হয়। তাই চিন্তা করবেন না।’
‘তুমি আপনি করে আর কথা কইবা না। তুমি কইবা।’
পূর্ণা চট করে অন্যদিকে ফিরলো। বললো,’পারব না।’
‘যা কইছি হুনো। নইলে কিন্তু?’
‘কী করবেন?’
‘ছাদ থাইকা ঝাঁপ দিয়া মইরা যামু।’
পূর্ণা ভ্রু কুঁচকাল। বললো,’এসব কী কথা?’
‘দেখাইতাম ঝাঁপ দিয়া?’
মৃদুল গুরুতর ভঙ্গিতে কথা বলছে। এই ছেলে দেখানোর জন্য ঝাঁপ দিয়ে দিতেও পারে! পূর্ণা বললো,’আচ্ছা থাক,লাগবে না। আমি তুমিই বলবো।’
মৃদুল হেসে বললো,’তাইলে কও।’
‘কী বলব?’
‘তুমি।’
‘তুমি।’
মৃদুল হাসলো। হাসলো পূর্ণাও। আকাশের বিশাল উজ্জ্বল চাঁদটি আর তার সাথি তারাদের নিয়ে পূর্ণা,মৃদুলের প্রেমকথন চলে সারারাত। দুজন মুঠো,মুঠো চাঁদের আলোকে স্বাক্ষী রেখে কাটিয়ে দেয় মুহূর্তের পর মুহূর্ত। দিনে একটা অঘটন ঘটে যাওয়ার পরও প্রকৃতি তাদের মনেপ্রাণে প্রেম নিয়ে আসে গোপনে। এ যেন কোনোকিছুর ইঙ্গিত! নয়তো অসময়ে কেন এমন সু-সময় দেখা দিল?

কাকডাকা ভোরে আমির হাওলাদার বাড়িতে পা রাখলো। সে সবেমাত্রই ফিরেছে। মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। ঢাকা থেকে নিয়ে এসেছে নতুন বোঝা। যে বোঝা তাকে নুইয়ে রেখেছে। যখনি সে গোপন যুদ্ধে জয়ী হলো, দেখতে পেলো আলোর রেখা,তখনই সামনে নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকারের দেয়াল। সুখ নামক বস্তুটি নিমিষে আড়াল হয়ে গেল। এই পৃথিবী যেন তার বিরুদ্ধে চলছে। সে অনুভব করছে,এই পৃথিবী আর তার নয়। বিষের বাতাস ছড়িয়ে আছে চারদিকে। পায়ের নিচের জমিন আর তাকে চায় না। শত,শত অভিশাপের বুলি কানে বাজে। অভিশাপগুলোকে তো সে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। তাহলে তারা জীবনে ফিরে এলো কী করে? আমির জানে না। লতিফা অন্দরমহলের দরজা খুলে,আমিরকে দেখতে পেল। আমির লতিফাকে দেখে মাথা উঁচু করে। ঢোক গিলে বললো,’ভাত আছে? ঠান্ডা হলেও চলবে।’
লতিফার শরীর কেঁপে উঠে। আমিরের এরকমভাবে ভাত খোঁজাতে সে কেন যেন চমকে যায়! আমিরকে সে যমের মতো ভয় পায়। তাই কোনো প্রশ্ন করলো না। লতিফা অস্থির হয়ে পড়ল। বললো,’আনতাছি আমি। আনতাছি।’
সৌভাগ্যক্রমে আমিরের ভাগ্যে গরম ভাতই জুটে। ফজরের আযানের সাথে সাথে লতিফা রান্না বসিয়েছিল। ভাতের পাতিল নামিয়েই আমিরকে ভাত দিয়েছে। আমির প্রথম লোকমা মুখে দেয়ার পূর্বে লতিফাকে প্রশ্ন করলো,’পদ্মজা ভালো আছে?’
লতিফা গতকালের ঘটনা বলতে গিয়েও বললো না। বললো,’হ,ভালা আছে।’
আমির গাপুসগুপুস করে ভাত খেলো। সারা রাত্রি সে শীতবস্ত্র ছাড়া ছিল। ফলে শরীর মৃত মানুষের মতো ঠান্ডা হয়ে যায়। তাই সদ্য রান্না হওয়া গরম ভাত খুব উপভোগ করে খেয়েছে। খাওয়া শেষে ২য় তলায় উঠলো। পদ্মজা কোরঅান শরীফ পড়ছে। তার মধুর সুর মনপ্রাণ জুড়িয়ে দেয়ার মতো। আমির ঘরে প্রবেশ করার পূর্বে দরজার পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। তারপর ঘরে ঢুকে পদ্মজার দিকে তাকালো না। আলমারি খুলে জ্যাকেট,মোজা,টুপি বের করলো। পদ্মজা আড়চোখে আমিরকে দেখে,পড়ায় মনোযোগ দিল। আমির তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে যায়। সিঁড়ির কাছে এসে আবারও থম মেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। দৃষ্টি রয়ে যায় পদ্মজার ঘরের সামনে।

পাতালঘরের এওয়ানে রিদওয়ান শুয়ে ছিল। তার সাথে একজন সুন্দরী নারী। দুজনের অপ্রীতিকর অবস্থা। হঠাৎ আমিরের আগমনে রিদওয়ান চমকে যায়। তারপর হেসে আমিরকে বললো,’ সব ঠিক আছে?’
আমির এক হাতে কপাল চেপে ধরলো। তারপর সেই নারীর উদ্দেশ্যে বললো,’এই শালী,শরীর ঢাক।’
আমিরের কণ্ঠে তীব্র ঘৃণা। অশুভ সুন্দরী নারীটি দ্রুত চাদর গায়ে জড়িয়ে নিল। রিদওয়ান বললো,’ওরে বকতাছস কেন?’
আমির একটা খাম রিদওয়ানের মুখের উপর ছুঁড়ে দিল। তারপর এটুতে চলে গেল।
পদ্মজা রান্নাঘরে জুলেখা বানুকে দেখে অবাক হলো। অচেনা হলেও সালাম দিল,’ আসসালামু আলাইকুম।’
জুলেখা তীক্ষ্ণ চোখে পদ্মজার দিকে তাকালেন। অবহেলার স্বরে বললেন,’ওয়ালাইকুম আসসালাম।’
রিনু ছিল রান্নাঘরে। পদ্মজা রিনুর দিকে তাকিয়ে ইশারায় প্রশ্ন করলো, অচেনা মহিলাটি কে? রিনু হেসে বললো,’মৃদুল ভাইজানের আম্মা।’
পদ্মজার ঠোঁটে হাসি ফুটলো। জুলেখার দিকে এক পা এগিয়ে এসে বললো,’ দুঃখিত! চিনতে পারিনি। আপনি প্লেট ধুচ্ছেন কেন? রাখুন। আমি ধুয়ে দিচ্ছি।’
জুলেখা মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তিনি চুপচাপ প্লেট ধুয়ে, চুপচাপ বেরিয়ে গেলেন। মুখের প্রতিক্রিয়াতে পদ্মজার প্রতি ছিল অবজ্ঞা,ঘৃণা। পদ্মজা মনে মনে আহত হয়। জুলেখার দৃষ্টি ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়ার মতো ছিল। পদ্মজা জুলেখার যাওয়ার পানে চেয়ে রইলো। রিনু পদ্মজার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। ফিসফিসিয়ে বললো,’আমার মনডা কয়,এই বেডির উপর জিনের আছড় আছে!’
পদ্মজা রিনুর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালো। বললো,’উনি আমাদের বাড়ির মেহমান! মুখে লাগাম দাও রিনু। পূর্ণার জন্য খাবার নিতে পারবো?’

লতিফা শাড়ির আঁচল দিয়ে হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘরে ঢুকলো। পদ্মজার প্রশ্নের জবাবে বললো,’হ পদ্ম, নিতে পারবা। খাড়াও আমি দিতাছি। তুমি খাইবা কখন?’
‘পূর্ণা আর আমার খাবার একসাথেই দিয়ে দাও বুবু।’
‘দিতাছি। রিনু জলদি ওই বাডিডা(বাটি) দে।’
রিনুর বদলে পদ্মজা এগিয়ে দিলো। খাবার নিয়ে উপরে যাওয়ার সময় পদ্মজাকে দেখে জুলেখা হাতের গ্লাস শব্দ করে টেবিলে রাখলেন। পদ্মজা বুঝতে পারে,জুলেখার ঘৃণা ও বিরক্তির কারণ! বোধহয় গতকালের অপবাদ তিনি শুনেছেন। পদ্মজার ভয় হয়। পূর্ণার বিয়েটা হবে তো? জুলেখাকে দেখে মনে হচ্ছে,বিয়ের কথা বলার অবস্থাতেও তিনি নেই। জুলেখার কপাল আর ভ্রুযুগলে পদ্মজার চোখ আটকে যায়। যেন হেমলতার কপাল আর ভ্রু দেখছে সে। হুবহু একরকম! পদ্মজার বুকটা হুহু করে উঠে। সে দুই চোখ মেলে জুলেখার কপালের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখের দৃষ্টিতে যেন জন্ম জন্মান্তরের দুঃখ। পদ্মজাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জুলেখা উঠে চলে যান। পদ্মজার সম্বিৎ ফিরলো। সে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে তৃতীয় তলায় চলে আসে। পূর্ণা দুই হাতে একটা বালিশ জড়িয়ে ধরে পরম আবেশে ঘুমাচ্ছে। জুলেখার কপাল,ভ্রু দেখে জেগে উঠা ব্যথা পূর্ণাকে দেখে আরো বেড়ে যায়। হেমলতার যৌবনকাল পূর্ণার বর্তমান রূপের প্রতিচ্ছবি। সেই মুখ,সেই ঠোঁট,সেই গাল। নাকের পাটা মসৃণ। এতো মিল দুজনের! পদ্মজা পূর্ণার মাথায় হাত রেখে হেমলতার কথা ভাবে।পুরনো স্মৃতিগুলো চোখের পাতায় জ্বলজ্বল করছে। পদ্মজা পূর্ণার মুখের দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করলো,’আম্মা।’
তার দুই চোখ জলে ভরে উঠে। পূর্ণা কী কখনো জানবে? পদ্মজা পূর্ণার ঘুমন্ত মুখ দেখে বহুবার আম্মা বলে কেঁদেছে! সে মনকে বুঝিয়েছে, এইতো আম্মা আছে! আমার সামনেই আছে! আমি এতিম নই!

পদ্মজা হাতের উল্টোপাশ দিয়ে চোখের জল মুছলো। পূর্ণা এতো আরাম করে ঘুমাচ্ছে যে পদ্মজার ঘুম ভাঙাতে মায়া হচ্ছে। কিন্তু বেলা করে খাওয়া তার একদম পছন্দ না। খেয়ে না হয় আরো ঘুমানো যাবে। পদ্মজা পূর্ণার চোখেমুখে স্নেহের পরশ বুলিয়ে ডাকলো,’পূর্ণা? পূর্ণা? এই পূর্ণা?’
পূর্ণা ধীরে,ধীরে চোখ খুললো। পদ্মজা বললো,’সূর্য কখন উঠেছে খবর আছে? নামাযের তো নামগন্ধও নেই। যা দ্রুত হাত-মুখ ধুয়ে আয়।’
পূর্ণা অন্যদিকে ফিরে চোখ বুজলো। সে ঘুমে বিভোর। পদ্মজা আবার ডাকলো। জোর করে তুলে কলপাড়ে পাঠালো। পূর্ণা ঘুমিয়ে,ঘুমিয়ে কলপাড়ে গেল। ফিরে এলো সতেজ হয়ে। ঘরে প্রবেশ করেই সোজা লেপের ভেতর ঢুকে পড়লো। পদ্মজাকে আহ্লাদী স্বরে বললো,’খাইয়ে দাও আপা।’
পদ্মজা বিনাবাক্যে খাইয়ে দিল। পূর্ণা না বললেও খাইয়ে দিত। খাওয়ার মাঝে পূর্ণা কথা বলতে চেয়েছিল। পদ্মজা নিষেধ করে। খাওয়ার মাঝে কথা বলা ভালো না বলে চুপ করিয়ে দেয়। খাওয়া শেষে পদ্মজা বললো,’ শেষরাতে কোথা থেকে ফিরছিলি?’
পূর্ণা চোখ বড়বড় করে তাকায়। তার হেঁচকি উঠে যায়। পদ্মজা পানি এগিয়ে দিল। তাকিয়ে রইলো সরু চোখে। পূর্ণা পানি পান করে মিনমিনিয়ে বললো,’আর যাব না।’
পদ্মজা গুরুজনদের মতো বললো,’বাড়তি কথা না বলে প্রশ্নের উত্তর দেয়া বাধ্যতা।’
পূর্ণা ভয়ে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে। সে ঢোক গিলে নতজানু হয়ে বললো,’মৃদুল যে…উনার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।’
‘সে ডেকেছিল?’
‘হু।’
‘আর তুইও চলে গেলি?’
পূর্ণার মনে হচ্ছে সে ফাঁসির দঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। যেকোনো মুহূর্তে ঝুলে যাবে। পদ্মজা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ঘরের দুই দিকে জানালা আছে। পূর্ব দিকের জানালা খোলা। উত্তর দিকেরটা বন্ধ। সে উত্তর দিকের জানালা খুলতে খুলতে বললো,’ বিয়ের আগে মাঝরাতে দেখা করা কী ঠিক হলো? মৃদুল এখনো পর-পুরুষ। বিয়েও ঠিক হয়নি। যখন এসে শুয়েছিস তখন টের পেয়েছি। তার আগে টের পেলে কানে ধরে ঘরে নিয়ে আসতাম।’
পূর্ণা অপরাধী কণ্ঠে বললো,’আপা,আর যাব না। ক্ষমা করে দাও।’
পদ্মজা পূর্ণার পাশে এসে বসে। পূর্ণার হাতের উপর নিজের এক হাত রেখে বললো,’বিয়ের পর আমার বোনের জীবনে হাজার জ্যোৎস্না আসুক।’
পূর্ণা তার অন্য হাত পদ্মজার হাতের উপর রাখলো। তারপর পদ্মজার চোখের দিকে তাকিয়ে ডাকলো,’আপা।’
‘কী?’

‘তোমাকে কে মেরেছে? কেন মেরেছে? তুমি রাতে কেন কেঁদেছো?’
পদ্মজা তার হাত সরিয়ে নেয়। চোখমুখে কাঠিন্য ভাব চলে আসে। কণ্ঠে গাম্ভীর্যতা রেখে পদ্মজা বললো,’প্রশ্ন করতে নিষেধ করেছিলাম।’
পূর্ণা চোখ নামিয়ে বললো,’আপা,আমি জানতে চাই।’
পদ্মজা দাঁড়িয়ে পড়লো। বললো,’বাড়ি ফিরে যা। মৃদুলের আম্মা-আব্বা আসছে। যখন তোকে প্রয়োজন হবে ডেকে পাঠাব। তার আগে যেন এই বাড়ির আশেপাশেও না দেখি।’
পদ্মজা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়। পূর্ণা তার পায়ের উপর থেকে দ্রুত লেপ সরাল। তারপর দৌড়ে পদ্মজার সামনে এসে দাঁড়াল। অনুরোধ করে বললো,’আপা,আপা দোহাই লাগে বলো। আমি তোমার সব কথা শুনি। কিন্তু এইটা শোনা সম্ভব হচ্ছে না।’
‘পূর্ণা!’
পূর্ণা আচমকা পদ্মজার দুই পা জড়িয়ে ধরলো। কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,’আপা,পায়ে পড়ছি আমাকে সব বলো। তোমার গালের ক্ষত,গলার দাগ আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। আমি শান্তি পাচ্ছি না। কে তোমাকে এত কষ্ট দিয়েছে? কে এতোবড় দুঃসাহস দেখিয়েছে? আমি তার কলিজা ছিঁড়বো।’
পূর্ণার চোখের জল পদ্মজার পায়ে পড়ে। পদ্মজা পূর্ণাকে টেনে তুললো। পূর্ণার কাজল নয়ন দুটি জলে টুইটুম্বুর। যেন স্বচ্চ কালো জলের পুকুর।
পদ্মজা পূর্ণার চোখের জল মুছে দিয়ে বললো,’কাঁদুনি।’

পূর্ণা পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরে। পদ্মজার শরীরে সে মা,মা গন্ধ খুঁজে পায়। সেই ছোটবেলা থেকেই পদ্মজা তার জীবন,তার আনন্দ। পদ্মজার গলার কালসিটে দাগটা যেন তারই বুকের আঘাত। রক্তক্ষরণ হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। পদ্মজা পূর্ণাকে অপেক্ষা করতে বলে,নিজের ঘরে যায়। আলমগীরের দেয়া খাম নিয়ে ফিরে আসে। দরজা বন্ধ করে পূর্ণাকে নিয়ে বিছানার উপর বসলো। এরপর বললো,’আমি জানি,আমার বোন বড় হয়েছে। সেই সাথে ধৈর্য্য,জ্ঞানও বেড়েছে। আমি একটা কারণেই তোকে সব জানাব,যাতে সাবধান থাকতে পারিস। আমি চাই , সব জানার পর তুই নিজে থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নিবি না। আমি যেভাবে বলবো,সেভাবে চলবি। রাজি?’
পূর্ণা বুঝতে পারছে সে ভয়াবহ কিছু জানতে চলেছে। উত্তেজনায় তার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে পড়েছে। পূর্ণা বললো,’রাজি।’
পদ্মজা হাতের খামটা পূর্ণার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,’তিনটে চিঠি আছে। তিনটাই আলমগীর ভাইয়ার লেখা। আমি গতকাল পড়েছি। মন দিয়ে পড়বি। অনেক কিছু জানতে পারবি। আর যতটুকু বাকি আছে আমি বলব।’
পূর্ণা প্রবল আগ্রহ নিয়ে খাম খুলে তিনটে চিঠি বের করলো। পদ্মজার কথামতো প্রথম একটা চিঠির ভাঁজ খুললো।

বোন পদ্মজা,
সালাম নিও। তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই আমার। সেদিনের রাতে তোমার আগমন আমার জীবনে নিয়ে এসেছে আনন্দ। পৌঁছে দিয়েছে আলোর জগতে। যে জগতে বাঁচার জন্য পিছনের প্রতিটি মুহূর্ত অসহনীয় যন্ত্রণায় কাটিয়েছি। জানি না এতো পাপ করার পরও করুণাময় কেন আমার প্রতি এতো উদার হলেন! তিনি চেয়েছিলেন বলেই, তুমি ফেরেশতার মতো হাজির হয়েছিলে। বাঁচিয়েছিলে আমাকে আর রুম্পাকে। যখন তুমি এই চিঠি পড়ছো,তখন তোমার অবস্থা কী আমি জানি না। হয়তো সব জেনে গিয়েছো নয়তো এখনো অন্ধকারে ডুবে আছো। যদি অন্ধকারে ডুবে থাকো তাহলে আমি তোমাকে আলোর সন্ধান দেব। সব জানার পর সিদ্ধান্ত তোমার। চিঠিটা বোধহয় বড় হয়ে যাবে। এক পৃষ্ঠাতে হবে না। ধৈর্য্য ধরে সবটুকু পড়ো। আমি তোমাকে একটা তিক্ত দীর্ঘ গল্প শোনাবো। গল্পটার কেন্দ্রবিন্দু আমির হলেও জড়িয়ে আছি অনেকেই।

যখন আমিরের জন্ম হয় কাকি আম্মার পর সবচেয়ে বেশি খুশি হই আমি। কাকি আম্মা বড় দুঃখী ছিলেন। কাকা মারধর করতেন খুব। নিজ চোখে কাকি আম্মাকে বিবস্ত্র করে মারতে দেখেছি। আমার ছোট মন লজ্জায় মিইয়ে গিয়েছিল। লুকিয়ে কেঁদেছিলাম। কিন্তু কাকা বা আব্বা কাউকে একটুও মায়া দেখাতে দেখিনি,লজ্জা পেতে দেখেনি। তাদের চোখেমুখে সর্বক্ষণ হিংস্রতা ছিল। আমি খুব ভয় পেতাম আব্বাকে। ভীতু ছিলাম। আমার কাছে আমার আব্বা,কাকাই ছিল ভূত,রাক্ষস। আমার আম্মা সবসময় পাথরের মতো নিশ্চুপ। তার অনুভূতি অসাড়। কাকি আম্মা ছিলেন আমার মা। তিনি বহুবার আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে একটা ছেলের জন্য আক্ষেপ করেছেন। কাকি আম্মা বলতেন,সেই ছেলে এসে নাকি কাকি আম্মার সব দুঃখ ঘুচে দিবে। যখন সেই ছেলেটা এলো আমি অনেক খুশি হই। এবার বুঝি কাকি আম্মার কষ্ট কমবে। কাকি আম্মা বলেছিলেন, আমির হবে পুলিশ। সব অন্যায়কারীকে শাস্তি দিবে আর আমি হবো শিক্ষক। শুধু কাকি আম্মার না আমারও ইচ্ছে ছিল আমি শিক্ষক হবো। ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়াবো। সব বাচ্চাদের আদর্শ হবো। সবাই দেখে সালাম দিবে,সম্মান করবে। সারাক্ষণ হাতে একটা বই নিয়ে হাঁটবো। এই স্বপ্ন নিয়েই পড়তে থাকি স্কুলে। এর মাঝে আব্বা একটা বাচ্চাকে নিয়ে আসে। বলে, সে নাকি আমাদের আরেক ভাই। তার নাম রাখে রিদওয়ান। আমরা চার ভাই হয়ে যাই।

আমি পদ্মজা সিজন ২ পর্ব ৭১+৭২+৭৩+৭৪+৭৫

আমি,জাফর,রিদওয়ান,আমির একসাথে এক স্কুলে পড়েছি। রিদওয়ান,আমির এক শ্রেণির ছিল। ছোট থেকেই আমিরের শরীরে ছিল অবাক করার মতো শক্তি। ওর মেধা ছিল ধারালো। আমরা সবাই ধরেই নিয়েছিলাম,আমির পুলিশ হবে। অনেক বড় পুলিশ হবে। পুরো দেশ চিনবে। ঠিক তখনই আমাকে আর জাফরকে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয় অভিশপ্ত এক কালো জীবনের সামনে। যে জীবনে টাকা, নারী আর রক্তের খেলা চলে। আমাদের বুঝিয়ে দেয়া হয়,নারী হচ্ছে ভোগের বস্তু। পাতালঘরে বনেদি ঘরের দুই-তিনজন পুরুষের দেখাও মিলে। তারা দুজন নারীকে আমাদের সামনে কুৎসিত ভাবে আঘাত করে। আব্বা,কাকা উপভোগ করে সেই দৃশ্য। সেই অসহায় দুই নারীর চিৎকারে কলিজা ছিঁড়ে যায় আমার। আব্বা আর কাকার পায়ে পড়েছি যাতে তাদের ছেড়ে দেয়। কিন্তু ছাড়েনি। রক্ত দেখে জাফর জ্ঞান হারায়। ও রক্ত সহ্য করতে পারতো না। রক্তে খুব ভয় ছিল জাফরের। একটা তেরো বছরের মেয়েকে বাঁধা অবস্থায় আমার হাতে তুলে দেয়া হয়। আব্বা আমাকে বুঝায়,মেয়েটার সাথে কী করতে হবে! জানতে পারি, বাড়ির পিছনে জঙ্গলে অবস্থিত এই পাতালঘর অনেক বছরের পুরনো। আমাদের বংশের প্রতিটি পুরুষের একমাত্র পেশা পতিতাবৃত্তি ও নারী ধর্ষণ। আমাদের অঢেল সম্পদ পতিতাবৃত্তির টাকায় করা। নারী বিক্রির টাকায় করা! একরকম বাধ্য হয়েই আমাকে অভ্যস্ত করে দেওয়া হয় এই পথে। ঘৃণায় বমি করেছি অনেকবার। ধর্ষণের পর কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হতো মেয়েগুলোকে। আমার জীবন হয়ে উঠে দূর্বিষহ।
তবে ঘরে ফিরে শান্তি লাগতো। আমির ছিল সেখানে। আমিরের দুষ্টুমি আমাকে খুব হাসাতো। আমিরের একটা দোষ ছিল,ও রিদওয়ানকে খুব অত্যাচার করতো। দুজনের সম্পর্ক ছিল সাপে-নেউলে। সে যাই হোক, আমিরের সঙ্গ ছিল শান্তির! ওর চঞ্চলতা,সাহসিকতা ছিল মুগ্ধ করার মতো। আমার সেই শান্তিও একদিন নষ্ট হয়ে যায়। যেদিন নানাবাড়ি থেকে ফিরে পাতালঘরে প্রবেশ করে রিদওয়ান আর আমিরের উপস্থিতি দেখি! আমির তখন পুরোদমে পনেরো বছরের একটা মেয়েকে পেটাচ্ছিল! আমিরের চোখেমুখের হিংস্রতা আমাকে অবাক করে দেয়। আমি কিছুতেই মানতে পারছিলাম না,আমার প্রিয় ভাইয়ের এই রূপ! এই জীবন!
এর পরের কথাগুলো তোমার জন্য খুব কষ্টের হবে পদ্মজা। দয়া করে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিয়ে আবার পড়া শুরু করো।

পূর্ণা থামে। তার শরীর কাঁপছে। অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে। সে ছলছল চোখে পদ্মজার দিকে তাকায়। তার চোখে খুব ভয়,ঘৃণা। সে স্পষ্ট স্বরে উন্মাদের মতো ডাকলো,’আপা…এই আপা।’
পদ্মজা পূর্ণার এক হাত শক্ত করে ধরলো। বললো,’ভাইয়া আমাকে যা বলেছেন,তাই কর। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নে।’
পূর্ণার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। তার মাথা ভনভন করছে। শরীর যেন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে। সে পদ্মজার এক হাত শক্ত করে ধরে জোরে নিঃশ্বাস নিল। বুকে অপ্রতিরোধ্য তুফান বয়ে যাচ্ছে! আমির তার কাছে আপন বড় ভাই। সম্মানীয় বড় ভাই! এই ব্যথা সহ্য করতে পারবে না সে। পুরো শরীরে তীব্র ব্যথা অনুভূত হচ্ছে।

আমি পদ্মজা সিজন ২ পর্ব ৮১+৮২+৮৩+৮৪+৮৫