আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৫০
suraiya rafa
লস অ্যাঞ্জেলস, ক্যালিফোর্ণিয়া।
পরন্ত গোধূলি। বাকহীন, নির্জন রাস্তার দু’ধারের ম্যাপল গাছের পাতায় আধো আধো করে ঝিকোচ্ছে শেষ বিকেলের মরা রোদ।
রাস্তা ধরে সোজা মিনিট দশেক হাঁটলেই দেখা মেলে চকচকে স্বচ্ছ বালুচরের। জনমানবহীন শূন্য সেথায়। কোলাহলের অনুপস্থিতিতে দানবের ন্যায় হুংকার ছাড়ছে সমুদ্ররাজ। ফুলেফেঁপে উঠে উদভ্রান্তের ন্যায় উদ্যাম গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে আদ্র বালুকাবেলায়। প্রতি মূহুর্তে সহচারী করে হারিয়ে যাচ্ছে হাজারো অজ্ঞাত পায়ের ছাপ।
সমুদ্রতীরের পাশেই পিচ ঢালা রাস্তার মোড়ে স্থির দাঁড়িয়ে কুচকুচে কালো রঙের এক চোখ ধাঁধানো ল্যাম্বারগিনি। ছাঁদবিহীন চার চাকার গাড়িতে মূর্তির ন্যায় আসীন এক দীর্ঘদেহী সৌষ্ঠব অবয়ব। মরচে যাওয়া সূর্যের তেরছা আলোটুকু সোজা গিয়ে ঝিল দিচ্ছে তার চকচকে কালো রোদ চশমায়। ব্লেডের মতো ধারালো চিবুকের প্রতিটি বাঁকে অবিশ্বাস্য গাম্ভীর্যের ছাপ। কালচে বাদামী শুষ্ক ওষ্ঠজোড়ায় ঝুলে আছে কপটতার শ্লেষ হাসি। খানিক বাদে বাদে ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে নিসৃত হওয়া উষ্ণ ধোঁয়ার কুন্ডলিতে অশুভের ন্যায় গুমোট চারিপাশ, যেন সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে রাজত্ব শুরু করেছে এক নিস্তব্ধ মরিচীকার আস্ফালন।
সেই তখন থেকে নির্জীব দৃষ্টে সমুদ্রপৃষ্ঠের দিকে একধ্যানে চেয়ে আছে মানব। চশমার আড়ালের দৃষ্টিজোড়া শিকারীর ন্যায় তীক্ষ্ণ, অথচ ভেতরে তার অনুভূতির শূন্যতা। কেমন পৈশাচিক অভিব্যক্তি। যেন আচ্ছন্ন হয়ে নীরবে গুনে যাচ্ছে প্রতিটি ভয়াল তরঙ্গোচ্ছ্বাস ।
অদূরের হাইওয়ে সড়কে বিশাল বেরিগেড। একেরপর এক অগ্নিকাণ্ডের কবলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে সরকারি ভবন। শহরের সবচেয়ে মূল্যবান সিলমোহরটি কোনো মাফিয়া গোষ্ঠীর দ্বারা স্থানান্তরিত হয়েছে, যার ফলে পুরো লস এ্যাঞ্জেলস জুড়ে শুরু হয়েছে অগাধ নৈরাজ্য। তীক্ষ্ণ আওয়াজে ভেসে আসছে শরীর শিউরানো পুলিশের সাইরেন। জমিন কাঁপিয়ে এদিকেই ধেয়ে আসছে অপ্রসন্ন গাড়ির বহর।
মাফিয়া বস কপট হাসে। মোলায়েম হেডরেস্টের গায়ে মাথা এলিয়ে দিয়ে টানটান হয়ে বসে সিটের উপর।অতঃপর কানে আবদ্ধ এয়ারবাড সচল করে নিকোটিনের শলাকায় ওষ্ঠ দাবিয়ে বিড়বিড়ায়,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
— অলরেডি টু আওয়ার্স,থার্টি সিক্স মিনিটস,এ্যান্ড টুয়েন্টি থ্রি সেকেন্ড হ্যাভ পাসড। তোমরা আমাকে এখনো খুজে পেলেনা! ইটস টোটালি আনফেয়ার আমেরিকা। শেইম অন ইউ!
পরক্ষণেই ধ্বনিত হলো কল কেটে যাওয়ার পিক পিক আওয়াজ । সময় নষ্ট করলো না এরীশ, এয়ারবাডসসহ মোবাইল ফোনটা ভেঙে টুকরো টুকরো করে সহাস্যে ছুড়ে ফেলে দিলো গভীর সমুদ্রে। কাজ সম্পন্ন হওয়ার দরুন ফিরেই যাচ্ছিল, তন্মধ্যে অযাচিত আক্রমণে সচকিত হয়ে উঠলো মস্তিষ্ক । অতর্কিত এক ধাতব তীরের ফলা ধেয়ে এলো বিদ্যুৎ গতিতে। সরাসরি চোখ বরাবর।সুদক্ষ মাফিয়া বস সময় নিলোনা এক মূহুর্ত, ব্যঘ্র থাবায় চোখের পলকে ধরে ফেললো সেটিকে। শক্ত হাতের পেষণে ধাতব বস্তুুটিকে চূর্ণবিচূর্ণ করে ছুড়ে ফেললো রাস্তার পাশে। পরপরই সেখান থেকে ছুটে পালালো এক লম্বা বিনুনি ওয়ালা তিরন্দাজ রমণী।
চিকচিকে স্বচ্ছ বালুচর ধরে প্রাণপনে ছুটছে মেয়েটি। উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলার দরুন চেহারা অস্পষ্ট। মেয়েটাকে সুক্ষ দৃষ্টে পরখ করে নিলো মাফিয়া বস, অতঃপর অস্ফুট স্বরে আওড়ালো,
— ইট’স আ ট্র্যাপ! বাট আই ক্যান হ্যান্ডেল।
বাক্য শেষ হতে না হতেই মেয়েটাকে নিশানা করে রিভলবারের ট্রিগ্যার টানলো এরীশ। তবে অজ্ঞাত রমণীর দূরবদ্ধিতায় লক্ষ্যচ্যুত হলো পরপর দু’টো বুলেট। অবকাশ দিলোনা মাফিয়া বস,বেলাগাম চিতার গতিতে ধাওয়া করতে শুরু করলো মেয়েটাকে।
কয়েকক্রোশ বালুচর পেরিয়ে গেলো চোখের পলকে। আপোষহীন দূর্বার গতিতে ছুটছে সে বেপরোয়া রমণী,এরীশ ইউভান ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। যেচে পড়ে ঘুমন্ত হিংসকে জাগ্রত করার মূল্য তো আজ চোকাতেই হবে এই মেয়েকে।
অবশেষে টানা কয়েকঘন্টার দৌড় প্রতিযোগীতার ইতি টানলো রমণী। প্রচন্ড হাঁপিয়ে গিয়ে অকস্মাৎ হোচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়লো বালু আস্তরিত জমিনে, পরপরই থমকালো এরীশ । মাথার উপর থেকে কালো হুডির আস্তিন সরিয়ে ছুড়লো কর্কশ স্বীকারোক্তি,
— ইউ হ্যাভ টু মার্চ এনার্জি, দম আছে মানতেই হবে!
এরীশের বাক্যে গোখরা সাপের ন্যায় ফোঁস করে দৃষ্টি ঘোরালো রমণী। মেয়েটাকে দেখা মাত্রই আরেকদফা অবাক হলো এরীশ।
কৃষ্ণবর্ণের নিখাঁদ মুখশ্রী। যোদ্ধার মতো রুক্ষ দৃষ্টি। কঠোর ধারালো মুখাবয়ব, অভিব্যক্তি জুড়ে প্রবল হিং”স্রতা।এই সবকিছু ছাপিয়ে গেলো মেয়েটার অদ্ভুত দু’টো চোখের মনি। যার একটা এরীশের চোখের ন্যায় ধূসর বাদামি রঙের আর অন্যটা ঈশানীর মতোই প্রগাঢ় নীলাভ।
— হেটেরোক্রোমিয়া।
অদ্ভুত স্বরে বিড়বিড়ালো মাফিয়া বস। হেটেরোক্রোমিয়া মূলত কোনো রোগ নয়। এটা একধরনের জিনগত বৈশিষ্ট্য। সাধারণত দু’টো চোখের রঙ সম্পূর্ণ দু’রকম হয় এতে। যদিও পৃথিবীতে খুবই বিরল এই বৈশিষ্ট্য।
— হোয়াট আ মিসট্রিয়াস গার্ল!
বাক্য ধ্বনিত হতে না হতেই, আত্নরক্ষার্থে এরীশের পানে একথাবা ঝরঝরে বালু ছুড়ে মারলো মেয়েটা,অযাচিত ধোঁয়াসায় এক মূহুর্তের জন্য দৃষ্টি সরালো মাফিয়া বস। সেই সুযোগে নিমেষেই চোখের আড়াল হয়ে গেলো মেয়েটা। এরীশ বাঁকা হাসে, অতঃপর আস্তে আস্তে এগোয় সম্মুখে।
কিছুদূর যেতেই দেখা মেলে একটা অদ্ভুত ভাঙাচোরা ক্যাসেলের। নির্জন বালুকাবেলায় গাম্ভীর্যের ন্যায় মাথা উঁচিয়ে দন্ডায়মান সেই দূর্গ। ক্যাসেলটির চারিপাশ ভাসমান ফুলেট আর সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে ভেসে আসা নানান ধরনের আসবাব দিয়ে আবর্তিত। সামনে রয়েছে ঝুলন্ত কাচের বোতলের প্রাকৃতিক সুরক্ষা। সহস্তে বোতল গুলো সরিয়ে ক্যাসেলের অভ্যন্তরে পা রাখলো এরীশ। তৎক্ষণাৎ একহাতে লম্বা ধনুক আর অন্য আছে তীরের ফলা নিয়ে ধেয়ে এলো মেয়েটা। কঠোর হস্তে মেয়েটাকে প্রতিরোধ করায় ব্যস্ত হলো এরীশ। তবে দমলো না রমণী, দু’হাত মুঠিবদ্ধ করে হামলে পড়লো এরীশের উপর। চোখ খিঁচে ঘুষি হাঁকানোর পাঁয়তারা করতেই আরও একবার পরাস্ত হলো মাফিয়া বসের কাছে।
তবুও কৃষ্ণবর্ণের অদ্ভুত চোখের ভাঁজে আগুন ঝড়া ঐশ্বর্য তার । মারপিটের পারদর্শিতা ব্যাপক। এরীশ এক মূহুর্ত ভাবে, পরক্ষণেই বিভ্রম থেকে বেড়িয়ে সচকিত কণ্ঠে আওড়ায়,
— রিয়ানা! রিয়ানা ভলকভ!
সমুদ্রাগত তরঙ্গোচ্ছ্বাসের মতো ফুঁসে ওঠে রিয়ানা। অপ্রস্তুত ভঙ্গিমায় আক্রমণ করে বসে আবারও। এবার আর সুযোগ দিলো না মাফিয়া বস। একটু দূরে উল্টে পরে থাকা চেয়ারের সঙ্গে এক লহমায় বেধে ফেললো মেয়েটাকে। প্রথমে দু’হাত এরপর দু’পা সবশেষে মুখের উপর ঠেসে দিলো মোটা স্তরের কস্টেপ।
পিনপতন নৈঃশব্দ্য। এতোকিছুর পরেও অকুতোভয় রমণী। বিন্দুমাত্র টলানো যায় নি তাকে। চোখের পাতায় প্রতিহিংসার লেশ। দূর্বার বিধ্বংসী অভিব্যক্তি। যেহেতু মুখের উপর কস্টেপের আস্তরণ তাই আওয়াজ করার সুযোগ নেই রিয়ানার। ক্রোধে উন্মাদ হয়ে চেয়ার সমেত ছটফট করছে শুধু।
— রিচার্ড ইজ নো মোর!
একটুবাদে ওর মুখের টেপটা সরিয়ে , সশব্দে বাক্য ছুঁড়লো মাফিয়া বস। যা শুনে এক মূহুর্তের জন্য থমকালো রমণী। দৃষ্টিতে তার তীক্ষ্ণ বেদনার ছাপ। পর মূর্হুর্তেই দৃষ্টি নামিয়ে অস্ফুটে স্বরে আওড়ালো,
— কাপুরষ!
— ইট’স আ মিস্টেক।
রাশভারি পুরুষালি কন্ঠস্বরটা কর্ণগোচর হতেই গ্রীবা ঘোরায় রিয়ানা। ভ্রুকুটি করে বলে ওঠে,
— গর্ভনরের সিলমোহর তবে আপনিই সরিয়েছেন?
— রিচার্ড কাপুরুষ নয়। হোয়াই আর ইউ চেঞ্জ দ্যা টপিক! নিজের বয়ফ্রেন্ডের মৃ”ত্যুর খবরে বুক কাঁপলো না?
এরীশের কথায় অভিব্যক্তি কঠোর হলো রমণীর। দৃঢ় কণ্ঠে বললো,
— কাপুরষের জন্য আবার মায়া কিসের?
এরীশ প্রত্যুত্তর করেনা, বুটের ভেতর থেকে চকচকে ধাতব চাকু টা রিয়ানার চোখের সামনে তুলে ধরে। বিপরীতে ভ্রু বাঁকায় রিয়ানা। আওয়াজে সন্দেহের পারদ ঢেলে শুধায়,
— কি এটা?
— শেষ মূহুর্তে রিচার্ডের কাছে এই একটা অ”স্ত্রই অবশিষ্ট ছিল। এ্যান্ড ইট ওয়াজ মিস্ট্রিয়াস। এই চাকুটার গায়ে দু রঙের দু’টো চোখ খোদাই করা। মজার বিষয় হলো চোখ দু’টো কোনো মেয়ের। অর্থাৎ চোখ দু’টো রিচার্ডের খুব বেশিই প্রিয়।তখনই বুঝেছিলাম, এই চোখের মালিক আমার সামনে আসবেই আসবে। তবে এতো তাড়াতাড়ি সেটা আশা করিনি।
একটুখানি শান্ত হয় রিয়ানা,স্বগোতক্তি করে বিড়বিড়ায়,
— হি ওয়াজ আ কাওয়ার্ড! ও আমাকে ভালোবাসতে ভয় পেতো।
তন্মধ্যে আরেকদফা বাক্য ছোড়ে এরীশ,
— জীবনের শেষ মূহুর্তে তোমার বয়ফ্রেন্ড কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তার দূর্বলতা কি? সে তোমার নাম বলেছিল।
অদৃশ্য যন্ত্রণায় কাতরে ওঠে রমণী। কঠোর নেত্রপটে জড়ো হয় ব্যথার তুফান। প্রকম্পিত স্বরে আওড়ায়,
— অসম্ভব! রিচার্ড আমাকে ছেড়ে পায়ারেটস দলে যোগ দিয়েছিল। ও নিজের দস্যু জীবনের লোভে আমাকে ত্যাগ করেছিল। সভ্য জাতির মানুষেরা ঠিকই বলে, ভিলেইনরা কখনো মায়ার বাঁধনে আটকায় না, তাদের জন্মই হয় ধ্বংস দিয়ে।
— ভুলক্রমে যদি একবার আঁটকে যায়, তবে নিজেকে ধ্বংস করে হলেও সেই মায়া সুরক্ষিত করার ক্ষমতাটাও তারা রাখে!
এই মূহুর্তের জন্য কন্ঠ খাদে নামায় এরীশ। তার কথা শুনে রিয়ানা ভ্রু কুঁচকায়,
— কিহ!
পরক্ষণেই বর্জ্র কন্ঠ ভেসে এলো মাফিয়া বসের,
— হি গেইভ আপ হিজ লাইফ অনলি ফর ইউ বিচ! যাকে তুমি ভিলেইন বলে আখ্যায়িত করছো সে তোমার তরে আত্নহুতি দিয়েছিল।
কন্ঠে আক্রোশ ঢালে রিয়ানা,
— সে আমাকে ছেড়ে গিয়েছিল।
— তাহলে তার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এভাবে ওত পেতে কেন বসে আছো?
—- প্রতিশোধ তো আমি নেবোই,সেই গড ফাদারের, যে আমার কাছ থেকে আমার রিচার্ড কে আলাদা করে পায়ারেটস গ্রুপে পাঠিয়েছিল। আর তারপর,
খানিক নীরবতা।
— তারপর আর ফিরে আসলো না আমার রিচার্ড! চিরজীবনের মতো হারিয়ে গেলো। ওই রাক্ষুসে সমুদ্রের নীল জলের অন্তরায়।
থেমে থেমে কথাগুলো বললো রিয়ানা। কণ্ঠে তার ব্যাকুলতার প্রলাপ, অথচ দৃষ্টিতে আগুন ঝরা প্রতিশোধের লেলিহান।
এতোক্ষণে নিজের সত্তায় ফিরেছে এরীশ। ম্যানিউপুলেশন বেশ ভালোই কাজে দিয়েছে। স্বর্গবাসী প্রেমিকের তরে আপ্লুত নারীমন গলতে শুরু করেছে অবশেষে। এবারে গড ফাদারের পরিচয় জানার পালা।
তাদের কথপোকথনের মাঝেই ক্যাসেলের বাইরে খটখট করে শব্দ হলো অকস্মাৎ। শব্দ অনুসরণ দৃষ্টি ঘোরালো রিয়ানা। সদর দরজার পানে তীর্যক নজর বুলিয়ে বললো,
— এটা তোমার জন্য সেইফ জোন নয়। ইউ হ্যাভ টু গো।
এরীশ বাঁকা হাসে। ক্ষ্যাপা হিংসের ন্যায় শক্ত হাতে রিয়ানার চিবুক আঁকড়ে ধরে ছোঁড়ে কর্কষ রুক্ষধ্বনি,
— এইইই! ডোন্ট ট্রাই টু ডাইভার্ট মাই মাইন্ড। মাথায় খু”ন চেপে বসলে তোমাকে ধ্বংস করতে আমার এক সেকেন্ড ও লাগবে না।
— ইউ ব্লাডি মনস্টার!
এরীশের হাতটা এক ঝটকায় সরিয়ে দিলো মেয়েটা,মুখাবয়বে তার উপচে পড়া তেজ। চোখ দু’টোতে জ্বলজ্বল করছে বিষাদ, বিতৃষ্ণা, তার সঙ্গে কঠোর প্রতিরক্ষা।
সেদিকে দৃষ্টিপাত না করেই পাশ থেকে আরেকটা চেয়ার টেনে মেয়েটার মুখোমুখি হয়ে বসলো এরীশ। নৈঃশব্দ্যের ফায়দা লুটে একাই বলতে আরম্ভ করলো,
— গড ফাদারের পরিচয় বললেও তোমার মুক্তি নেই, না বললেও মুক্তি নেই। পার্থক্য শুধু এটাই,সত্যিটা বলে দিলে মৃত্যুটা একটু সহজ হবে।
— আমি তোমাকে ভয় পাইনা মাফিয়া বস!
ক্ষ্যাপা বাঘিনীর ন্যায় ফুঁসে উঠলো রিয়ানা।
এরীশের মানে লাগলো খুব। দৃষ্টিজুড়ে প্রস্ফুটিত হলো অশুভ এক আগ্রাসন। যেন র”ক্তের ফোয়ারা বইয়ে তবেই স্বস্তি মিলবে তার। হিং’স্র দানবের ন্যায় দাঁতে দাঁত পিষে হিসহিসিয়ে উঠলো তৎক্ষনাৎ,
— সেল্ফ কনফিডেন্স! আই হেইট ইট। আমার সামনে আত্নবিশ্বাস দেখানোর স্পর্ধায় মরবে তুমি এখন।
মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরনে নিউরনে ছড়িয়ে পড়েছে তীব্র ক্রোধ। দৃষ্টিজুড়ে দাবানলের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।যেন সামনে পেলেই ভস্ম করে দিবে সবকিছু। আচানক রিভলবার বের করে রিয়ানার কপাল বরাবর তাক করলো এরীশ। কিঞ্চিত ঘাবড়ালো রমণী। শুষ্ক কণ্ঠতালু ভেদ করলো সুক্ষ্ম ঢেউয়ের তোরন। পর মূহুর্তেই বিপরীত প্রান্ত থেকে ভেসে এলো ক্ষুব্ধস্বর,
— তোমার খেলা এখানেই শেষ।
কথা বলতে না বলতেই, হাওয়ার বেগে ছুটে গিয়ে রিয়ানার ডান বাহু বিদ্ধ করলো তীক্ষ্ণ এক ধাতব বুলেট। ঘটনার আকস্মিকতায় জোরালো ধ্বনিতে চিৎকার দিয়ে উঠে চেয়ারের হাতলে লুটিয়ে পরলো রিয়ারা।
নারীকণ্ঠের তীব্র আর্তনাদেও এইটুকু টললো না মাফিয়া বসের অন্তর। হিমালয়ের ন্যায় অটল সে মানব। দক্ষ নিশানা ধরে প্রস্তুতি নিলো আরও একটা গুলি ছোড়ার। তার আগেই পেছন থেকে ছুটে এসে ছো মে’রে তার রিভলবারটা কেড়ে নিলো অন্য কেউ।
এক লহমায় ঘুরে দাঁড়ালো মাফিয়া বস। আগন্তুকের পানে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে ধিম কন্ঠে বলে উঠলো,
— তুমি এখানে কি করছো?
— আমাকে আপনার প্রয়োজন, তাই এসেছি।
রাশভারি কণ্ঠস্বর। কালো সোয়েট শার্ট আর গ্যাভার্ডিং পরিধেয় মানুষটি রোবটের ন্যায় নিস্ফল কদমে এগিয়ে এলো সম্মুখে। এরীশও এগুলো দু’কদম। অচিরেই দৃষ্টির মিলন ঘটলো দু’জনের। ধ্বং”সের মতো উদ্যত মাফিয়া বস, দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
— ফিরে যাও তুষার জাওয়াদ। তোমাকে আমার আর প্রয়োজন নেই।
— আমাকে আপনার প্রয়োজন আছে।
একই ধ্বণিতে প্রত্যুত্তর করলো যন্ত্রমানব। যেন মোটেই ব্যতিগ্রস্ত নয় সে তেমন করেই বলতে আরম্ভ করলো,
— জানতাম, মাথা গরম হলেই গুলি ঠুকে দিবেন। সত্যিটা জানার জন্য ধৈর্য্য আর কন্ট্রোল দু’টোই প্রয়োজন। যা আপনার নেই।
—- ডোন্ট ট্রাই টু আন্ডারিস্টেমেড মি তুষার জাওয়াদ! আমি তোমার চেয়ে অনেক এগিয়ে।
অতর্কিত ব্যঘ্র হাতে তুষারের কলার চেপে ধরলো এরীশ। সেদিকে ভ্রক্ষেেপ করলো না যন্ত্রমানব । কণ্ঠ তার শীতল, সাবলীল।
— কিন্তু বয়সে আমি বড়।
— ফা’ক ইউওর ব্রোম্যান্স!
ক্ষ্যাপাটে এরীশ গর্জে উঠলো। তুষার দম ছাড়ার আগেই তার নাসারন্ধ্র বরাবর ঘুষি ছাড়লো কয়েকটা। কয়েক মূহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলো পরিবেশ। পেছন ফিরে থু থু এর সাহায্য মুখগহ্বরে জড়ো হওয়া র”ক্তের দলা অদূরে ছুড়ে ফেললো তুষার। অতঃপর কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই পাল্টা ঘুষি হাঁকালো এরীশের মুখে। সুনিপুণ অধরকোণ রঞ্জিত হলো র”ক্তের ধারায়। জিভের ডগায় উৎকট নোনতা স্বাদ অনুভূত হতেই অশুভের ন্যায় কপট হাসলো মাফিয়া বস। র’ক্তটুকু লেহন করে অতি কপট স্বরে আওড়ালো,
— এক্সুয়ালি আ’ম নট অ্যা ভ্যাম্পায়ার, বাট ইট’স টেস্ট সো গুড।
অতঃপর অতর্কিতে ঝাপিয়ে পরলো তুষারের উপর। কোনো বন্দুক নয়, কোনো মারণা”স্ত্র নয়। কেবল ধস্তাধস্তিতেই একজন অপরজনকে র”ক্তাক্ত করে ফেললো ওরা। সে কি তেজ, সে কি ক্রোধ! একজন দু’টো হাঁকালে অপরজন গুনে গুনে চারটা ফেরত দিচ্ছে। এভাবেও বুঝি র”ক্ত ঝরিয়ে অভিমান মেটানো যায়?
মাফিয়াদের র”ক্তের ফোঁটার দাম নেই। সত্যিই কোনো দাম নেই! নইলে এতো র”ক্ত ঝরানোর দ্বায়ে তুষার এরীশ দু’জনারই কারাদণ্ড প্রাপ্য।
ওদিকে তুষার আর এরীশের কান্ডে হতবুদ্ধি হয়ে যায় রিয়ানা। আহত শরীরটাকে কোনোমতে সামলে নিয়ে চেয়ারেই ঠেস দিয়ে বসে আছে সে। ঘটনার একপর্যায়ে ওরা দু’জন বেগতিক হয়ে উঠলো। র”ক্তে ভেজা চপচপে শরীর নিয়েও কেউ কাউকে একচুল সমান ছাড় দিতে নারাজ তারা, সেই সময় পেছন থেকে বাক্য ছোড়ে রিয়ানা,
— তোমরা আমাকে ধরতে এসে নিজেদের মধ্যে কেন মারামারি কেন করছো?এতোই যখন বক্সিং খেলার শখ তখন আমাকে ছেড়ে দাও, তারপর যা খুশি করো। এসব বেহুদা নাটক দেখার সময় নেই আমার।
সেই শুরু থেকে মেয়েটার সাহস দেখে দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছে এরীশ।দু’হাত মুঠিবদ্ধ করে ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছু বলবে মেয়েটাকে, তার আগেই ওপাশ থেকে বাক্য ছোড়ে তুষার,
— কথায় দেখছি প্রচন্ড ধার!
তৎক্ষনাৎ প্রত্যুত্তর করলো এরীশ ,
— এইমূহুর্তে ওর জিহ্বা কেটে দেবো আমি।
বাঁধ সাধলো তুষার। ঠান্ডা স্বরে বললো,
—ও যা জানে সেটা আগে বের করতে হবে।
— মেয়েটা মিস্ট্রিয়াস, মুখ খুলছে না কিছুতেই।
এরীশের কথায় দম নিয়ে হাসলো তুষার। কৌতুক করে বলে উঠলো,
— আপনি যেই লেভেলের হিং”স্র, ও চাইলেও কিছু বলতে পারতো না,আমি বাঁধা না দিলে এতোক্ষণে উপরে পাঠিয়ে দিতেন।
— আই হেইট আরগিউমেন্ট। মেয়েটা তর্ক করে যাচ্ছিল তখন থেকে।
—- অ্যামাজন জঙ্গলের সবচেয়ে প্রাচীনতম আধিবাসী এরা। সত্যি কারের পাইথন আর এ্যানাকন্ডার সঙ্গে দীর্ঘদিনের সহাবস্থান এদের, মিস্ট্রিয়াস তো হবেই। দেখুন গুলি খেয়েও কেমন স্ট্রং হয়ে বসে আছে। দে হ্যাভ সাম এক্সট্রা অর্ডিনারী হিউম্যান ইমিউনিটি।
— কি বলতে চাইছো?
র”ক্তাক্ত এরীশ ঘুরে তাকায় তুষারের পানে। নৈঃশব্দ্যে হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে অদৃশ্য এক ইঙ্গিত প্রদান করে তুষার।
— উই নিড টু ইউজ আওয়ার মাইন্ড।
কথা শেষ হতেই রিভলবার হাতে ধীরস্থির কদমে সামনে এগোয় দু’জন। একই গতিতে। খানিক আগের মারামারি, ধস্তাধস্তি সবটাই যেন অলীক। এখন এই মূহুর্তে তাদের লক্ষ্য এক,চিন্তা এক, কৌশল এক আর ভবিতব্য? সেটাও বোধ হয় অভিন্ন। একযোগে এগিয়ে আসা প্রতিটি জোরালো কদম জানান দিয়ে যায় তার সত্যতা। তুষার এবং এরীশ যেন দুটি পৃথক দেহের একই সত্তা।
ওদের দু’জনকে একযোগে এগিয়ে আসতে দেখে কিঞ্চিৎ ঘাবড়ায় রিয়ানা। চোয়াল শক্ত করে বিড়বিড়ায়,
— ইউ গাইস আর ইনসেইন !
কাছাকাছি আসতেই এদিক ওদিকে ঘাড় ফুটিয়ে সোজা রিয়ানার মুখোমুখি চেয়ারটায় বসে পড়লো এরীশ। অনেকটা আয়েশ করে হাঁটুর উপর আরেকপা তুলে রাজাধিরাজের মতো বসলো সে। ওদিকে পেছন থেকে রিয়ানার মস্তিষ্ক বরাবর রিভলবার ঠেসে ধরলো তুষার। মুখাবয়ব চুপসে গেলো মেয়েটার। বিপদ আসন্ন ভেবে কুণ্ঠিত স্বরে আওড়ালো,
— তোমাদের সঙ্গে আমার কোনো শত্রুতা নেই, তাহলে শুধু শুধু আমাকে কেন মারতে চাইছো?
—- হুঁশশ!আর একটা অপ্রয়োজনীয় বাক্য ছুড়লে জিহ্বা কেটে দুভাগ করে ফেলবো তোমার!
মাফিয়া বসের নীরব হুম”কিতে অন্তর প্রকম্পিত হয় রিয়ানার, কিছু বলতে গিয়েও থমকায় সে। ফের প্রশ্ন ছোড়ে তুষার ,
— রিচার্ড কে পায়ারেটস দলে কে পাঠিয়েছিল?
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রিয়ানা, আত্নসমর্পণের মতো করে নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দেয়,
— আমি বললে বিশ্বাস করবে তোমরা?
ওপাশে নৈঃশব্দ্য। গুমোট আবহ পরিলক্ষিত হলে, একাই বলতে আরম্ভ করে রিয়ানা,
— ঘটনার শুরু ব্লাড ডায়মন্ড দিয়ে। এই অভিশপ্ত বিরল পাথরকে অ্যামাজন অধিবাসীরা বলে ধ্বংসের দূত। এই পাথর যার কাছে যায় সেই কোনো না কোনো ভাবে বিপর্যস্ত হয়।
— তোমার কাছে ফেইরীটেল শুনতে আসিনি আমরা, আন্সার ইউওর কোশ্চেন বিচ! হু ইজ দ্যা গড ফাদার?
এরীশের হুংকারে আঁতকে ওঠে রিয়ানা। থমথমে স্বরে জানায়,
— আমি জানিনা।
অকস্মাৎ শক্ত থাবায় মেয়েটার কণ্ঠনালী চেপে ধরে এরীশ। পেছন থেকে তুষার জিজ্ঞেস করে,
— গড ফাদারের সঙ্গে ব্লাড ডায়মন্ডের কি সম্পর্ক?
থেমে থেমে জবাব দেয় রিয়ানা,
— পৃথিবীর সূচনা লগ্নে অ্যামাজনের গহীন থেকে এই রত্ন সংগ্রহ করে আমাদেরই এক পূর্বপুরুষ। প্রচলিত আছে এই পাথর সংগ্রহের পরপরই একের পর এক বিপর্যয়ে পুরো পরিবার ধ্বংস হয়েছে তার। তখন থেকেই আমাদের আদিবাসীদের কাছে এক অমীমাংসিত রহস্যের নাম রক্তহীরক।
এই রত্নের অদ্ভুত জ্যোতি আর বিক্ষুব্ধ কর্মকাণ্ডের ফলে তাদের বদ্ধ ধারণা রক্তহীরক পৃথিবীর কোনো অংশ নয়, বরং আকাশ থেকে খসে পড়া মহাজাগতিক কোনো নক্ষত্র এটি। সভ্য জাতিদের সঙ্গে লড়াই করার জন্য যা স্বয়ং ঈশ্বর তাদের দান করেছেন।
একটু থামলো রিয়ানা। এরীশ, তুষার দু’জনই প্রগাঢ় অভিলাষে চেয়ে আছে ওর পানে। যা দেখে সুতীব্র এক দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো মেয়েটার বুক চিঁড়ে। কোনোরূপ গড়িমসি না করেই স্পষ্ট আওয়াজে বলে উঠলো,
— অ্যামাজনের জংলী আদিবাসী আমরা, সভ্যতা থেকে অনেক পিছিয়ে। আমাদের বিশ্বাস ভক্তিতে বিজ্ঞানের ছোঁয়া অনুপস্থিত, রয়েছে ব্যাপক পরিমাণে রীতিনীতির অনুসরণ, যার ফলে পূর্বপুরুষের রীতি মোতাবেক রক্তহীরক যার হাতে থাকবে সেই আমাদের নিকট দেবতাতুল্য। হাজার বছরের এই রীতির অনুকরণ আমরা জঙ্গলেই নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছিলাম,যতদিন না সভ্যতা আমাদের ভক্তিতে হস্তক্ষেপ করে।
রক্তহীরক কি করে তার হাতে চলে গিয়েছিল সেই রহস্য জানা নেই আমার। তবে এতোটুকু জানি ওই পাথরের জন্যই আজ আমাদের গোত্রের এতো বড় বিপর্যয়। ওই গড ফাদার লোকটা রক্তহীরকের প্রলোভন দেখিয়ে গোটা সিংহলী জাতিকে নিজের করায়ত্ত করে রেখেছে। নিজেকে প্রভুর আসনে বসিয়ে আমাদের আদিবাসীদের দ্বারা একের পর এক স্বার্থ হাসিল করে যাচ্ছে লোকটা , আমার ভালোবাসা রিচার্ডও তার ভুক্তভোগী। আমি জানিনা ঠিক কতদূর গড়াবে তার এই পাষবিকতা, আর কবেই বা মুক্তি পাবো আমরা।
এ পর্যায়ে প্রশ্ন ছোড়ে তুষার,
— এখন তো ব্লাড ডায়মন্ড অন্যকারও হাতে, তাহলে তোমরা কেন শুনছো তার কথা? রীতি অনুযায়ী ব্লাড ডায়মন্ডের মালিকই হবে তোমাদের প্রভু।
— ওই যে বললাম অজ্ঞতা। গোত্রের বেশিরভাগ মানুষই অন্ধবিশ্বাসী, এতো বছর তারা ওই গড ফাদারের আনুগত্য করে এসেছে, এখনো অন্ধের মতোই বিশ্বাস তাদের, ব্লাড ডায়মন্ডের আসল মালিক একমাত্র সে-ই।কিন্তু আমি ভিন্ন, ওই পাষণ্ড গডফাদারকে না-তো আমি বিশ্বাস করি, আর না ভক্তি।
— কখনো দেখেছো তাকে?
ঠান্ডা স্রোতের মতো কন্ঠস্বরটা শ্রবনেন্দ্রিয় ভেদ করতেই তড়াক করে চোখ তুললো রিয়ানা। এরীশের পানে পূর্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করে জবাব দিলো,
— না, কখনো দেখিনি। কোনোদিন দৈহিক বর্ণনাও শুনিনি। তবে শেষবার রিচার্ডের কাছে শুনেছিলাম সে আমাদের মতো স্বাভাবিক ভাবে হাঁটেনা, ক্রাচে ভর করে এক পা টেনে টেনে হাঁটে।
— কোন পা!
তুষারের ধারালো মস্তিষ্ক ইঙ্গিত দিচ্ছে কোনো কিছুর। প্রত্যুত্তরে রিয়ানা কিছু বলবে, তার আগেই পুরো বেলাভূমি জুড়ে ঘটে গেলো অপ্রত্যাশিত এক বিপর্যয়।
অকস্মাৎ শক্তিশালী গ্রেনেড হামলে পড়লো নির্জন বালুচরে উপর । মূহুর্তেই বি”স্ফো’রণের বিকট শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠলো ধরিত্রী। কিচিরমিচির করে শঙ্কিত ধ্বনি তুলে উড়ে পালালো শঙ্খচিলের দল। দানবীয় অ”গ্নিগ্রাসে নিমেষেই হারিয়ে গেলো সমগ্র ক্যাসেল। ভুগর্ভের তীব্র প্রকম্পনে সুনামির ন্যায় ফুলেফেঁপে উঠলো সমুদ্র। ক্যাসেলের অভ্যন্তরে কীটপতঙ্গের ন্যায় ছিটকে পড়লো ওরা তিন-তিনজন মানব মানবী।
কোনো মতে নিজের অস্তিত্ব সামলে সচকিত হয়ে উঠে দাঁড়াতেই মাফিয়া বসের ইস্পাত কঠিন বক্ষ ভেদ করে বেড়িয়ে একটা চকচকে ধাতব বুলেট। ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ হয়ে গেলো তুষার, কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই মুখের উপর আবিষ্কার করলো ছিটকে আসা তাজা র”ক্তের ঘ্রাণ। এরীশের র”ক্ত!
যা দেখা মাত্রই বিদ্যুৎ চালিত পাখার ন্যায় সমগ্র দুনিয়াটা চোখের সামনে ঘুরতে লাগলো ওর। পরিস্থিতি আঁচ করার আগেই পরপর আরও দু’টো বুলেট এসে তীরের ফলার ন্যায় বুকের বাম পাঁজরে গেঁথে গেলো এরীশের। ঠিক হৃদয় বরাবর!
প্রথম গুলিটা লাগার পরে স্থির দাঁড়িয়ে থাকলেও। এবার আর সৌষ্ঠব শরীরটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না মানব । শক্তিশালী বুলেটের ধাক্কায় পিছিয়ে গেলো দু’কদম।
দৃষ্টি জুড়ে শুধু অ”গ্নিশিখার আস্ফালন। দাউদাউ করে জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে চারিপাশ। নীরবে দম ছাড়লো এরীশ। জীবনে প্রথমবারের মতো শরীরের সমগ্র ভার ছেড়ে বসে পড়লো হাঁটুভেঙে। কানের কাছে ঝিঁঝি পোকার অসহনীয় গুঞ্জন। তুষার ছুটে এলো ওর কাছে, জোরে জোরে শরীর ঝাঁকিয়ে বলতে লাগলো কিছু একটা। অধৈর্য এরীশ সেসব শোনার জন্য বসে রইলো না আর । ধীরে ধীরে শুয়ে পড়লো ধুলো জমা শক্ত জমিনে। চারিদিকের কোলাহল, বারুদের ঝাঁঝালো গন্ধ, জ্বালাময়ী অ”গ্নিদাহ সবকিছু ছাপিয়ে মাফিয়া বসের নিভু নিভু দৃষ্টিজুড়ে ভেসে উঠলো একজোড়া শান্ত, শীতল নীলাক্ষি, একফালি হৃদয় জুড়ানো স্নিগ্ধ হাসি, আর পরিশেষে একগুচ্ছ চেরিব্লোসমের মিষ্টি সুঘ্রাণ। মরিচীকার মতো আঁধারের অতলে হারিয়ে যেতে যেতে এক অতৃপ্ত বাসনায় হেসে উঠলো মাফিয়া বস। অতঃপর নৈঃশব্দ্যে বুজে গেলো তার অক্ষিপুট।
বাংলাদেশ,
সকাল থেকেই আকাশ ভার। গোধূলি পেরোতেই ম্লান হয়ে এসেছে সূর্যকীরণ। অদ্ভুত
নীরবতার ছায়ায় ঢাকা পড়েছে দিনের উচ্ছ্বাস। কেমন যেন বিষন্ন চারিপাশ। ক্লান্তিময় দিবালোকের শেষ আলো টুকু নিঃশব্দে মিলিয়ে যাচ্ছে সন্ধ্যার কোলঘেঁষে।
জানালার ধারে চেয়ার পেতে বসে নিঃশব্দে আকাশ দেখছে নিঝুম। কোলের উপর অযত্নে মেলে রাখা ক্লাসের বই। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সংস্পর্শে ধেয়ে আসা ভেজা বাতাসে এলোমেলো ভাবে উল্টে যাচ্ছে তার পাতা। বেখেয়ালি নিঝুম ডুবে আছে মায়া কাননে। আনমনে ঝিমাচ্ছে তার অন্তঃকরণ। একটুবাদেই আওয়াজ ভেসে এলো রান্নাঘর থেকে,
— কিরে নেংটি ইঁদুর চিংড়ি রেঁধেছিস কেন? তুই জানিস না চিংড়ি আমি খেতে পারিনা, আমার এলার্জী হয়!
নাকের ডগায় ভাঁজ পড়লো নিঝুমের চোখে জড়ো হলো বিরক্তির ছাঁয়া। পেছনে ঘুরে তৎক্ষনাৎ প্রত্যুত্তর করলো,
— ষাঁড়ের মতো চেঁচাবেন না তূর্য ভাই। আমি পড়ছি এখানে।
রান্নাঘর থেকে হনহনিয়ে বেড়িয়ে এলো তূর্য। নিঝুমের কাছাকাছি এসে রাগে কটমটিয়ে বললো,
— আমি ষাঁড়!
— তো কি?
নিঝুমের দৃষ্টি জানালা ছাপিয়ে বাইরে। আকাশ ফুটো হয়ে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রিমঝিম ছন্দে মুখরিত ধরণী। এই তো গত মাসেই খালামনির প্রচন্ড জোড়াজুড়িতে তূর্যের চিটাগং এর ফ্ল্যাটে শিফট করেছে ওরা দু’জন। আর তারপর থেকেই শুরু হয়েছে খালামনির আদরের ছেলের বাঁদরগিরি। এটা করে দে, সেটা এনে, ওটা দিয়ে দে ফরমায়েশ খাটতে খাটতে বিরক্ত নিঝুম। সারাদিন পতিসেবা করতে করতে পড়াশোনা লাটে উঠেছে তার।
— খিদে পেয়েছে আমার, ডিম ভেজে দে।
তূর্যের কথায় সৎবিৎ ফিরলো নিঝুমের। সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে অত্যন্ত রূঢ় স্বরে বলে উঠলো,
— নিজের কাজ নিজে করুন গিয়ে।
বাক্য শেষ হতেই একটানে ওর বইটা কেড়ে নিলো তূর্য। ছদ্ম রাগে কটমট করে বলে উঠলো,
— নিজের কাজ নিজে করলে তোকে রেখেছি কেন?
— আমি কি আপনার কাজের লোক?
— না তুই আমার বউ।
কথায় না পেরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নিঝুম। মন খারাপ করে বলে,
— সামনে আমার পরীক্ষা তূর্য ভাই, কেন এভাবে জ্বালাচ্ছেন?
মুরুব্বিদের মতো চোখ গোছালো তূর্য,ঢং করে বললো,
— সে কি কথা, স্বামীর সেবাকে তোর জ্বালাতন মনে হলো? ছিহ নিঝুম কতটা বেয়াদব তুই!
— আপনি স্বাভাবিক একটা কথাকে টেনেটুনে ঘোলাটে বানাচ্ছেন, পাড়ার ঝগরুটে মহিলাদের মতো।
— তুই আমাকে ঝগরুটে বললি? এটাওতো বেয়াদবি। পড়ালেখা করে এই শিখেছিস এতো বছর?
তূর্যের কথায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো নিঝুম। এই লোকের সঙ্গে কথা বাড়ানো মানে যেচে পড়ে নিজের মূল্যবান সময় খোয়ানো। ঝগড়া তো করবেই সাথে কথার প্যাঁচে পাগল বানিয়ে ছা্রবে। অগত্যা চেয়ার ছেড়ে উঠে রান্না ঘরে চলে গেলো নিঝুম । যেতে যেতে প্রশ্ন ছুড়লো,
— অমলেট নাকি মামলেট?
হাতে প্লেট নিয়ে নিঝুমের পেছনে ছুটতে ছুটতেই উৎসুক কন্ঠে বিড়বিড়ালো তূর্য,
— হেহেহে লক্ষী বউ আমার।
সন্ধ্যা সারে সাতটা। দিনের পাট চুকিয়ে বেশ আয়োজন করে পড়তে বসেছে নিঝুম। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে এখনো। অবিরাম বারিধারায় আদ্রতার চাঁদরে গা ভিজিয়েছে প্রকৃতি। ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধে মন্থর আবেশে বুদ হয়ে আছে হৃদয়। বৃষ্টি ফোঁটার ঝমঝম শব্দে অদ্ভুত শিথিলতায় ছেঁয়ে গেছে মস্তিষ্ক। এরূপ সময় মনোযোগ ভালো থাকে। তাই পাঠ্য বইয়ের জটিল সব অংকগুলো এখনই কষতে বসলো নিঝুম।
আঙুলের ডগায় কলম ঘোরাতে ঘোরাতেই আবিষ্কার করলো ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ। পারফিউম টা চেনা, তূর্যের উপস্থিতি টের পেয়ে ঘাড় ঘোরায় নিঝুম বিরক্তির স্বরে বলে ওঠে,
— আবার চলে এসেছেন? আমি পড়তে বসলেই আপনার যত জ্বালা তাইনা? কি চাইছেন, পরীক্ষায় ফেইল করি আমি? হ্যা তাতো চাইবেনই, ভালো চেয়েছেন কখনো আপনি আমার?
— তোর সমীকরণে ভুল আছে!
শান্ত সাবলীল স্বরে প্রত্যুত্তর করলো তূর্য। দৃষ্টি তার নিঝুমের নোটপ্যাডে আবদ্ধ। থমকালো নিঝুম। নিজ খাতার দিকে গভীর দৃষ্টিপাত করে বলে উঠলো,
— মানেহ!
তূর্য কথা বাড়ালো না। বিনা অনুমতিতে ঝুঁকলো
সম্মুখে। রমণীর গা ঘেঁষে হাত বাড়ালো নোটপ্যাডে। জটিল সমীকরণ, যেটা গত একঘন্টা ধরে মিলিয়েছে নিঝুম, সেটা একটানে কেটে দিয়ে,দক্ষ হাতে সলভ করলো অংকটা। সবশেষে উত্তর মিলিয়ে গ্রীবা ঘুরিয়ে তাকালো নিঝুমের পানে। মেয়েটার অবাক দৃষ্টিতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে, গভীর স্বরে আওড়ালো,
— তোর ভালো চাই কিংবা না চাই, তোকে কিন্তু ঠিকই চাই।
— কিহ!
আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৪৯
হতচকিত নিঝুমের কণ্ঠভেদ করে বেড়িয়ে এলো অযাচিত শব্দ। তূর্য আর প্রত্যুত্তর করলো না। গলায় তোয়ালে ঝুলিয়ে গুনগুন করতে করতে ঢুকে গেলো শাওয়ারে। নিঝুমের আর পড়া হলোনা সে রাতে। বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে বেগবান হয়ে উঠলো তার ভাবনার মায়াজাল। ঠিক সেই মূহুর্তে নিঝুমের ভাবনা ছাপিয়ে শাওয়ার থেকে ভেসে এলো তূর্যের চমৎকার গানের গলা ,
আমার মনের জোছনা,
আমি কাউকে দেবোনা….
তোমায় গাঁইথা রাখছি মনের মাঝে
নিজেও জানোনা……..