আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৫৯

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৫৯
suraiya rafa

সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। মসৃণ জানালার গরাদে চঞ্চল শিশুর মতোই হুটোপুটি খাচ্ছে শেষ বিকেলের মরা রোদ। গত কয়েকদিন ধরেই সূর্য খানিকটা তাতিয়ে আছে মস্কোতে। মন্থর উষ্ণতায় গলে গিয়েছে অধিকাংশ বরফ। সহসা প্রকৃতির গুঞ্জনে সরব হয়ে উঠেছে প্যারাডাইস সীমানার চারিপাশ, বেড়েছে জঙ্গলি প্রাণীদের আনাগোনা। পেন্টহাউজের ভেতর নিজের কক্ষের জানালায় দাঁড়িয়ে সেই তখন থেকে জঙ্গলের মাঝে একটা কুচকুচে কালো ভাল্লুকের ধীর শিকারী দৃষ্টি লক্ষ্য করছিল ঈশানী। মায়ের কোলের উষ্ণতায় ঘুমু ঘুমু চোখে হাত পা নাড়াচ্ছে ছোট্ট ইয়াশ। তার চেহারা জুড়ে অব্যক্ত চাঞ্চল্য।

দেখলেই বোঝা যায়, খুব শীঘ্রই দুষ্টুমির শীর্ষে পৌঁছাতে চলেছে এই ছোট্ট প্রাণ । আচ্ছা, বড় হলেও কি এই চঞ্চলতা,এই মিঠে হাসি, মেঘমেদুর কোমল চাহনি সবকিছু একই রকম থেকে যাবে? নাকি মাফিয়া বসের মতোই রূঢ় আর গম্ভীর হয়ে উঠবে ইয়াশ ইউভান? আশ্চর্য এই প্রশ্নটা সারাক্ষণ ঘুনোপোঁকার মতো কুটকুট করে বয়ে বেড়ায় ঈশানীর মস্তিষ্কে। মাঝেমধ্যে তো ভয় ও হয়, এরীশ আর তার ভালোবাসার টানাপোড়েন,এই অনিশ্চিত জীবনের দোলাচল, এই পাপের দুনিয়া সবকিছুর কারনে কখনো নিঃসঙ্গ হয়ে না পড়ে তার ছেলেটা!
অচিরেই চক্ষু সজল হয়ে ওঠে ভাবনায় নিমজ্জিত ঈশানীর। মাতৃত্ব নামক দ্বায়িত্বের বিষাদে ভার হয়ে ওঠে তার বুক। ঠিক তখনই রুমে প্রবেশ করে ফ্লোরা। পেছন থেকে রিনরিনে আওয়াজে ডেকে ওঠে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— আসবো?
অদ্ভুত মায়া জড়ানো কণ্ঠস্বর। বাংলা শব্দচয়ণ খুব একটা স্পষ্ট নয়। তবে আধো আধো কথা গুলো ভারী মিষ্টি শোনায়। কর্ণগুহরে ঠান্ডা হাওয়ার মতোই অদ্ভুত প্রশান্তি দেয়। ফ্লোরা এগিয়ে আসতেই হাতের পৃষ্ঠে চোখ মুছে হাসি মুখে পেছনে ঘুরলো ঈশানী।
— তোমার বোধ হয় মন খারাপ। আমি কি ভুল সময়ে চলে এলাম?
ফ্লোরার সন্দিগ্ধ বাক্যে হাসির আড়ালে দুঃখ লুকালো ঈশানী । বিগলিত হেসে বললো,
— তেমন কিছুই নয়, ছেলেটা সেই তখন থেকে জ্বালাতন করছে।
ফ্লোরা হাত বাড়িয়ে দিলো। ছোট্ট ইয়াশকে মায়ের কোল থেকে আলগোছে লুফে নিয়ে বললো,
— আমি দেখছি ওকে, তুমি যাও। এরীশ ডেকে পাঠিয়েছে।
ফ্লোরার সামনে এরীশের ব্যাপারটা সংগোপনে এরিয়ে যেতে চাইলো ঈশানী। সহসা উত্তর দিলো,

— ইয়াশ ঘুমাক তারপরে যাবো।
— আমি আছিতো।
ফ্লোরার কণ্ঠে আশ্বস্তি। ঈশানী বেজার মুখে চুপ হয়ে রইলো। ঈশানীর নির্লিপ্ততায় ভ্রুজুগল কুঁচকে এলো ফ্লোরার। কিয়ৎক্ষণ বাদে আবারও ইতস্তত গলায় প্রশ্ন ছুড়লো সে,
— তুমি কি কোনো কারণে আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছো ঈশানী? কোনো অপ্রীতিকর কারণ?
এবার সত্যিই ভীষণ অপরাধবোধ করলো ঈশানী। বিদেশবিভূইয়ের এই নরকনিবাসে সেই শুরু থেকেই ফ্লোরা তার একমাত্র বন্ধু। ঈশানী যতই অন্তর্মুখী হোকনা কেন, ভারী মিষ্টি, হাস্যোজ্জল ললিত চেহারার এই রুশকন্যাকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। সহসা উতলা ভঙ্গিতে প্রত্যুত্তর করলো রমণী,

— ছি ছি! তোমার কেন এটা মনে হলো ফ্লোরা? তোমাকে এড়িয়ে চলার মতো অতো দুঃসাহস আমার নেই ।
— তাহলে অযথা কথা কেন কাটাচ্ছো?
ক্ষণকাল অতিবাহিত হলো নৈঃশব্দ্যে , একটুবাদেই ফের নীরবতা ভেঙে জবাব দিলো ঈশানী,
— আসলে এরীশের সাথে আমার সম্পর্কটা অনেক বেশি জটিল। এখানে পরিস্থিতির চেয়েও ডেসটিনির কদর বেশি। আমি আমার ভবিতব্য মেনে নিয়েছি। কিন্তু যেই আমি তোমার সামনে বড় মুখ করে বলে গিয়েছিলাম সজ্ঞানে আর কখনো এই পাপের দুনিয়ায় পা মাড়াবো না, সেই আমি ফিরে তো এলাম, সঙ্গে নিয়ে এলাম পাপিষ্ঠ অধিপতির একমাত্র অংশকে। এটা নিঃসন্দেহে গ্লানির। আমি লজ্জিত ফ্লোরা, ভীষণ লজ্জিত।

ঈশানীর কথায় ফ্লোরার চোখেমুখে খেলে গেলো আশ্চর্য এক যাতনা। মেয়েটা নিজের পাহাড় সমান কষ্ট লুকিয়ে ঈশানীর দিকে মমতাসুলভ হাত বাড়ালো। ঢলঢলে পেলব চিবুকে আবেশিত প্রলেপ বুলিয়ে ধাতস্থ স্বরে বললো,
— আমি সবকিছু জানি ঈশু। তুমি হঠাৎ হারিয়ে যাওয়ার পরে নিজ চোখে এরীশের এতো পাগলামি এতো অস্থিরতা দেখেছি যে আমি ওই মাফিয়া বসটার দূর্বলতা বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছি। তুমি জানো এই পেন্ট হাউজে কতশত লা’শ পড়েছে শুধুমাত্র তোমার জন্য। চারিদিক ধ্বংসস্তূপ বানিয়ে ফেলেছিল এরীশ। ভাগ্যিস তুষার ছিল।
শেষ কথাটা ফ্লোরা বেশ অভয় নিয়ে বললো। সংকুচিত ঈশানীর নীলাভ চোখজুড়ে খেলে গেলো অযাচিত বিস্ময়। নিরুত্তাপ গলায় শুধালো,
— কি করেছিল এরীশ?
ফ্লোরা বললো,
— এরীশের হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট হয়েছিল জানো নিশ্চয়ই?

ঈশানী চোখের পলক ছেড়ে ফ্লোরাকে কথা এগোনোর ইশারা করলো। সহসা বলতে লাগলো মেয়েটা,
— সুস্থ হতে প্রায় দু’মাস লেগেছিল। তারপরেও কিছুমাসের বেড রেস্ট দিয়েছিল ডক্টর এরীশকে। কিন্তু তোমার বিপদের কথা শুনে এরীশ সেদিনই এমারজেন্সি ফ্লাইট ধরে। জানো, কতকিই প্ল্যান করেছিল শত্রুরা? ঘুনাক্ষরেও যদি জানতে পারতো তুমি এরীশের দূর্বলতা তাহলে তোমাকে সেখানেই মে”রে ফেলতো ওরা।
ফ্লোরার কথায় খুব একটা আশ্চর্য হলোনা ঈশানী। এরীশের সঙ্গে নিজের নাম জুড়ে যাওয়ার পর থেকেই এসব মৃত্যুঞ্জয়ী চিন্তা ধারা ওর কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়।অগত্যা নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় মাথা নাড়ালো মেয়েটা। উৎসুক কণ্ঠে শুধালো,

— তারপর কি হলো?
ফ্লোরাকে এবার উদাসীন দেখালো। অস্ফুট এক কাতরতা ভর করেছে তার চোখের পাতায়, সেভাবেই জবাব দিলো,
— তারপর তুমি চলে গেলে। আর এরীশকে আহত অবস্থায় এয়ারঅ্যাম্বুলেন্সে রাশিয়া ফিরিয়ে আনা হলো। পরপর দু’টো জটিল অপারেশন, অস্ত্রোপচার সবকিছুই কাটিয়ে উঠেছিল মাফিয়া বসটা। কিন্তু কোনোভাবেই তোমাকে ভুলতে পারেনি। সারাক্ষণ ড্রাগ নিয়ে মাতাল হয়ে পড়ে থাকতো লাউঞ্জে।ভাংচুর গো”লাগুলি এগুলো যেন ছেলেমানুষী হয়ে উঠেছিল ওর কাছে। আমি কখনো এরীশকে এতোটা এলোমেলো হতে দেখিনি ঈশানী। কিন্তু সেবার দেখেছিলাম, ড্রাগ নেওয়ার পরেও কি বাজে ভাবেই না ছটফট করেছিল তোমার জন্য, সেদিন মাফিয়া বসটার অস্থিরতা দেখে আমি নিজেই বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। সেই মূহুর্তে তোমার সব দুঃখ আমার কাছে বেমালুম লেগেছে। বন্ধুত্ব,বিবেক,বাস্তবতা সবকিছু ভুলে তোমাকে হাজারবার ভৎসনা করেছি। কেন তুমি এতো স্বার্থপর হতে গেলে ঈশানী? কেন এতোটুকু বুঝলেনা এরীশকে। যেই মাফিয়া বস কোনোদিন কারোর দিকে নির্জীব শীতল দৃষ্টি ছাড়া তাকায়নি অবধি, সে তোমার নাম নিয়ে চিৎকার করেছে। ও কতোটা উন্মাদ হয়ে গেছে তোমার জন্য, ক্যান ইউ ইমাজিন?

এই পর্যায়ে নীলাভ চোখ জোড়া ব্যথায় ভরে উঠলো রমণীর। শুষ্ক একটা ঢোক গিলে জড়ানো কণ্ঠে জবাব দিলো,
— এরীশ আমার জন্য উন্মাদ সেটা আমিও বুঝি । কিন্তু ওর এই উন্মাদনার কারণ আজও জানা নেই আমার, ফ্লোরা। এতোকিছুর পরেও আমি এরীশের কাছে একটা খোলা বই,অথচ মাফিয়া বসটা সবসময় লুকিয়ে রাখে নিজেকে। কোনোদিন কোনোভাবেই ভালোবাসি বলেনি আমায়। ওর মতে ভালোবাসা সবার জন্য নয়। তাহলে ওর কাছে আমি কিই? কাগজে কলমে স্বীকৃত একটা স্লাট?
— এটা তোমার মনে হলো?
ফ্লোরার কণ্ঠে অবিশ্বাস। ঈশানী জবাব দিলো,
— প্রেমিক হওয়ার আগে আমি ওকে মানুষ বানাতে চাই ফ্লোরা। আমি চাই আমাদের একটা সুখের সংসার হোক।
অকস্মাৎ আতঙ্কিত দেখালো ফ্লোরাকে। চোখেমুখে নিদারুণ ভয়। কিয়ৎক্ষণ নীরব থেকে শুষ্ক ওষ্ঠাধর নাড়িয়ে কিছু একটা আওড়ালো ফ্লোরা। ঈশানী ঠিকঠাক শুনতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— কি বললে?
অন্যমনস্ক ভাবটা কেটে যেতেই ধড়ফড়িয়ে উঠলো ফ্লোরা। চিন্তিত গলায় বললো,
— তোমার জন্য এরীশের পাগলামি গুলো একটু বেশিই। আমি কোনোদিন কল্পনাও করিনি এরীশের মতো একটা কোল্ড হার্ট, রুথলেস মাফিয়া বস কখনো কারোর জন্য এতোটা মরিয়া হয়ে উঠবে।ও তো দূর্বলতাকে ঘেন্না করতো। অথচ সেই ব্লাডিবিস্ট এখন বুকের মাঝে দূর্বলতার পাহাড় নিয়ে ঘুরছে। তুমি ওর দূর্বলতা ঈশানী। তুমি চাইলে ও হয়তো দুনিয়া তোলপাড় করে ফেলতেও একমুহূর্ত দ্বিধা করবে না। কিন্তু তার পরিণাম কি?
ফ্লোরার আতঙ্কিত কথাগুলো ঠিকঠাক বোধগম্য হলোনা ঈশানীর। সহসা ভ্রু কুঞ্চিত করে ফের প্রশ্ন ছুড়লো রমণী,
— তুমি ঠিক কি বলতে চাইছো ফ্লোরা?
ঈশানীর পানে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জবাব দিলো ফ্লোরা,

— এইতো সেদিন, এরীশ মাতাল হয়ে লাউঞ্জে বসে তোমার প্রিভিউ সিসিটিভি ফুটেজ গুলো হাতড়ে বেড়াচ্ছিল ল্যাপটপে। আমি তখন কিচেন কাউন্টারে খাবার বানাতে ব্যস্ত ছিলাম। ঠিক সেই মূহুর্তে হঠাৎ একটা গার্ড চলে আসাতে একটু শব্দ হয়েছিল শুধু, ব্যস এটুকুই, কথা নেই বার্তা নেই চোখের পলকে গু’লি করে মে’রে দিলো লোকটাকে । লা’শটা যখন ছটফট করতে করতে নিথর হয়ে এরীশের পায়ের কাছে ঢলে পড়লো, ও বিতৃষ্ণ হয়ে একটা জোরালো পদাঘাত করে সেটাকে কয়েকহাত দূরে সরিয়ে দিলো। র”ক্তের স্রোতে রঞ্জিত হয়ে গেলো গোটা মার্বেল পাথরের মেঝে। গো’লাগু’লির শব্দ পেয়ে তুষার ছুটে এসে দেখতে পায় এই কাহিনি। এরীশ তখনও উন্মুখ হয়ে তোমার ভিডিও দেখছে। যেন আশেপাশে সবকিছু স্বাভাবিক কোথাও কিচ্ছুটি হয়নি। তেমনই নিরুত্তাপ ছিল তার অভিব্যক্তি। তুষার আসতে না আসতেই গম্ভীর গলায় আদেশ করলো,

— লা’শটাকে সরিয়ে দাও।
তখন অবশ্য তুষার একটু চটে গিয়েছিলো। কণ্ঠে উষ্মা নিয়ে একা-একাই রাগ ঝেরেছিল কতক্ষণ।
এই পর্যায়ে ঈশানীর কণ্ঠ নমনীয় হয়ে এলো। চোখের জল ছেড়ে আহত কণ্ঠে বললো,
— আমি এরীশকে ভালোবাসি ফ্লোরা, আকাশের মতোই অধরা ভালোবাসি । ওকে কষ্ট দেওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার ছিলনা। কিন্তু ওই পরিস্থিতিতে এরীশকে আমার বিপদজনক মনে হয়েছে। ও ভুল বুঝে যদি আমার সন্তানকে মে’রে ফেলতো?
ঈশানীর এই শঙ্কা মোটেই হেয়ালির নয়। নিজের সন্তানের সুরক্ষায় একজন মা যা কিছু করতে পারে। তবুও কেন যেন অহেতুক হাসি পেলো ফ্লোরার। মেয়েটা মলিন হেসে বললো,

— তুমি ভুল ভেবেছো। একটুখানি ধৈর্য ধরে বলেই দেখতে, মাফিয়া বস ভক্তিতে ন্যুজ হয়ে যেতো তোমার তরে।
ঈশানী তৎক্ষনাৎ আর কথা খুঁজে পেলোনা কোনো। তাই প্রসঙ্গ বদলে বললো,
— তুমি আগের চেয়ে গম্ভীর আর অনেক বেশী দ্বায়িত্বশীল হয়ে গিয়েছো। আমি তোমার মাঝে এখনো সেই চঞ্চল হাসিখুশি রুশকন্যাটিকে খুঁজে বেড়াই, ফ্লোরা।
— পরিস্থিতি মানুষকে বদলে দেয় ঈশু। একবছরে কতকিই ঘটে যায়, মানুষের সাজানো জীবন বেওয়ারীশ সমুদ্রের মতোই উথাল পাথাল হয়ে যায়।সেখানে আমাদের তো প্রায় দু’বছর পরে দেখা হলো।
ফ্লোরার কণ্ঠে অব্যক্ত এক ছাইচাপা ব্যথা।তার বেদনাবিধুর গোলাপি চেহারার পানে চেয়ে কিছু একটা টের পেলো ঈশানী। হতে পারে কোনো বুকভাঙা আর্তনাদ। সহসা প্রত্যুত্তর করলো,

— ঠিক বলেছো। এরীশ তোমাদের খুব জ্বালিয়েছে তাইনা?
ফ্লোরা প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে জবাব দিলো,
— তা জ্বালিয়েছে । যতক্ষণ পেন্টহাউজে থাকতো, আতঙ্কিত করে রাখতো চারিপাশ। তবে সেসময় তোমার জন্য এরীশের উন্মাদনা, অস্থিরতা, এমনকি হৃদয় তোলপাড় করা যন্ত্রণা দেখে মনেমনে নিজের অনুভূতি গুলোকে ভীষণ তুচ্ছ মনে হতো। কেন যেন মনে হতো, এরীশের মতো ভয়ংকর ভাবে কেউ কোনোদিন ভালোবাসতে পারবে না। কেউ না!
ফ্লোরার শেষ কথাতে নিজের অজান্তেই হোটচ খেলো ঈশানী। কখন যে চোখের কোটর ছেড়ে পলব কপোলে ঈষদুষ্ণ জল গড়ালো, উদ্বেলিত হৃদয়টা জানেনা তার হদিস।

সন্ধ্যারাত। থাই জানালার কাঁচ সরানো। বিকেল থেকেই ঠান্ডা একটা হাওয়া দিচ্ছে, কনকনে ঠান্ডা নয়,আরামদায়ক। ধারে কাছে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে বোধ হয়।
সেই কখন থেকে কেঁদেকেটে ঘর মাথায় তুলেছে ছোট্ট ইয়াশ। তাকে নিয়ে সমগ্র ঘরজুড়ে পায়চারি করছে ঈশানী। কোলে নিয়ে হাটাহাটি করলেও ছেলের কান্না থামানোর বিন্দুমাত্র প্রয়াস নেই তার মাঝে। কেমন যেন অন্যমনষ্ক হয়ে আছে। মায়ের এহেন অমনোযোগে ক্রমেই ক্ষুব্ধ হচ্ছে ছোট্ট প্রাণ। থেমে থেমে বাড়ছে তার কান্নার গতিবেগ। অভিমানে উদ্বেল হয়ে হাত পা ছুড়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠতেই মোহভঙ্গ হলো ঈশানীর। ছেলেকে গভীর চুমু খেয়ে পরম স্নেহে বুকে জড়ালো সে। একটু সময় নিয়ে কান্না থামালো, ফের মানস্পটে ভেসে উঠলো ফ্লোরার বলে যাওয়া বিকেলের সেই কথাগুলো। সন্ধ্যা থেকে এসবই ভেবে চলেছে আনমনে। ভেতরের আত্নবিশ্বাসী সত্তাটা ভারী রসিকতা করে বলছে,

— রাশিয়ার প্রথম সারির মাফিয়া বস, একটা আন্ডারওয়ার্ল্ড টেরোরিস্ট, যার কোনো ভয় নেই, পরোয়া নেই একটা নির্জীব হৃদয়ের মানুষ, সে কেন তোর জন্য এতোটা উন্মাদ হবে?এটাও কি সম্ভব?
এসব কথা শুনে বিগলিত মনটা সাপের ফুঁসে উঠছে। কঠোর হয়ে প্রতিহত করছে সেই বাক্য,
— যখন ভালোবাসা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে, তখন সবচেয়ে নিকৃষ্ট, পাথর কঠিন আত্নাটাও মোমের মতো তরল হয়ে পড়ে। এরীশ আমাকে ভালোবাসে।
অন্য মনটা বিদ্রুপ করে হেসে উঠলো তৎক্ষনাৎ। কৌতুক স্বরে শুধালো,
— ভালোবাসে? বলেছে কখনো? ইউ আর নাথিং বাট হিজ ডেডলি অবসেশন।
চাবুকের আ’ঘাতের মতোই বাক্যটা এসে হৃদয়ে আঘাত হানলো ঈশানীর। অসন্তুষ্ট মনটা সাতপাঁচ ভেবে কিছু বলবে, তন্মধ্যে পেছন থেকে ভেসে এলো ধিম, রাশভারি কণ্ঠস্বর,

— ওকে আমার কোলে দাও।
সংবিৎ ফিরতেই তড়িৎ বেগে পেছনে ঘুরলো ঈশানী। আশ্চর্য্য দৃষ্টিজুগল থমকালো গিয়ে কালো সিল্ক শার্টে আবৃত ইস্পাত কঠিন চওড়া বুকে। ঘরময় একটা পুরুষালি ক্লোনের মাদকীয় সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে ইতিমধ্যে। ঈশানী দৃষ্টি তুলে মানুষটার মুখাবয়ব পরখ করার সুযোগ পেলোনা। তার আগেই ভেসে এলো নির্লিপ্ত কণ্ঠস্বর,
— তখন থেকে কাঁদছে, তোমার নিশ্চয়ই কষ্ট হচ্ছে?
কথা বলতে বলতে হাতের ব্ল্যাকবেল্ট ঘড়িটা খুলে রেখে শার্টের আস্তিন গোটালো মাফিয়া বস।
ঈশানী একটু অবাক হলো। সহসা প্রশ্ন করলো,
— ঘড়ি কেন খুললে?
এরীশ চোখের সাহায্যে নিজের অংশকে ইশারা করলো। অনুভূতিহীন গলায় বললো,
— কোলে নিলে যদি ব্যথা লাগে!

ঈশানী না চাইতেও ভেতর ভেতর সন্তুষ্ট হলো। ছেলের প্রতি একটু হলেও মায়া আছে তাহলে জানোয়ারটার। রমণীর ভাবনার মাঝেই অদক্ষ হাতে নিজের অংশকে কোলে তুলে নিলো মাফিয়া বস। এমন একটা পবিত্র অস্তিত্বকে দু’হাতে আগলে ধরে ক্রমশই বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে এলো তার। তীক্ষ্ণ চোয়ালজুড়ে ভর করলো অব্যক্ত এক কাঠিন্যতা। এই হাত দু’টো যে ভীষণ পাপী, এমন ফুলের মতো পবিত্র সত্তা তোলার দায়ে এবার ধ্বংস না হয়ে যায়। কিন্তু এই পবিত্র অস্তিত্ব কেন হুবহু তার মতো দেখতে!

এই ঝিলের মতো টলমলে চোখ, ফিনফিনে রক্তিম ঠোঁট, ঠোঁটের নিচে কুচকুচে কালো তিলক সবকিছুই কেন অবিকল এরীশের মতো। ঈশানীর মতো স্নিগ্ধ আর পবিত্র কেন নয়? নিজ অংশের দিকের তাকিয়ে এরীশ অনুভব করলো এই অস্তিত্বের মাঝে পুরোটাই তার ছায়া। কোথাও একটা দৃঢ় মেলবন্ধন। মনে হচ্ছে বুকের উপর পাহাড় তুলে দিয়েছে কেউ। অকারণ অনুভবে দমবন্ধ হয়ে আসছে যেন।
এরীশের মোহগ্রস্ত দৃষ্টি অবলোকন করে নীরবতা ভাঙলো ঈশানী। তরল গলায় বলে উঠলো,
— ইয়াশ দেখতে হুবহু তোমার মতো।
ভ্রম কেটে যেতেই দৃষ্টি ঘোরালো মাফিয়া বস। ভেতর ভেতর নৈঃশব্দ্যে খেলে গেলো অভূতপূর্ব তড়িৎ। ঈশানীও একই কথা বলছে, তারমানে ওর ধারণা মিথ্যা নয়। এরীশকে মূক হয়ে চেয়ে থাকতে দেখে প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে তাকালো ঈশানী। বললো,

— তুমি বোধ হয় ঠিক ভাবে কোলে নিতে পারোনি।
ঈশানীর কথায় একটু নড়েচড়ে উঠলো মাফিয়া বস। বিভ্রম কাটিয়ে গম্ভীর স্বরে জবাব দিলো,
— আ’ম ট্রাইং।
ঈশানী আর কথা বাড়ালো না। নিজ থেকেই ঠিকঠাক করে দিলো ইয়াশকে। এরীশের বুকের সংস্পর্শে ঠেলে দিয়ে প্রসন্ন মুখে বলে উঠলো,
— ওর কপালে একবার চুমু খেয়ে দেখো। তুমি কিছু একটা অনুভব করবে।
তপ্তশ্বাস ফেললো এরীশ। ঈশানীর পানে নির্জীব দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আহত স্বরে আওড়ালো ,
— আমার স্পর্শ মঙ্গলজনক নয়।

— তুমি ওর জন্মদাতা। একজন সন্তানের কাছে তার বাবার চেয়ে মঙ্গলজনক আর কিই হতে পারে এরীশ?
এরীশ প্রত্যুত্তর করেনা আর । শুষ্ক একটা ঢোক গিলে ঈশানীর কথা মতোই ধীরে ধীরে গ্রীবা বাড়িয়ে দেয় সম্মুখে। ক্ষণকালের নৈঃশব্দ্য ভেঙে, নিগূঢ় নির্লিপ্ত এক চুমু এঁকে দেয় নিজ অংশের ললাটদেশে। প্রথমবারের মতো পিতৃত্তের একটুখানি আদুরে আলিঙ্গনে কান্নাকাটি থামিয়ে শান্ত হয়ে যায় অংশ তার। এরপর ধীরে ধীরে বর্ষণ শেষে ঠান্ডা হাওয়ার মতোই গভীর ঘুম নেমে আসে ছোট্ট সোনার অশ্রুবিজরিত চোখের পাতায়। এরীশ তখনও ধ্যানমগ্ন হয়ে ছেলেকে দেখছিল। তখনই পাশ থেকে নিচু গলায় ডেকে ওঠে ঈশানী,

— কিছু অনুভব হলো?
এরীশ নিজের চেহারার গম্ভীর ভাবটা ধরে রেখেই আওড়ালো,
— সফ্ট এ্যান্ড ইনোসেন্ট, জাস্ট লাইক ইউ।
ঈশানী বিগলিত হাসলো। জবাব দিলো,
— এই দৃশ্য দেখা যে আমার অসম্ভব কল্পনার অভূতপূর্ব অধ্যায়, রীশ।
— তোমার জন্য আমি সব করতে পারি।
মাফিয়া বসের স্পষ্ট স্বীকারোক্তি। অতঃপর ইয়াশকে সন্তোর্পনে দোলনায় শুয়িয়ে দিয়ে এগিয়ে এসে মুখোমুখি হলো ঈশানীর। স্ব-পকেটে দু’হাত গুঁজে দৃষ্টির মিলন ঘটালো সে। এরীশের হিমশীতল দৃষ্টিতে মুগ্ধ চিত্ত বিহ্বল হয়ে পড়লো রমণীর । বিস্ময়ভাব কেটে যেতেই হতচকিত কণ্ঠে শুধালো,

— ক…কি হয়েছে?
মূহুর্তেই অভিব্যক্তি বদলে নিজের চিড়াচড়িত কাঠিন্যতায় ফিরে এলো মাফিয়া বস। চোয়ালের পেশী শক্ত করে শূন্য দৃষ্টিতে তাকালো সে মেয়েটার পানে,
— তখন ডেকে পাঠিয়েছিলাম। আসলে না কেন?
— মাথা থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিল।
রমণীর নির্বিকার প্রত্যুত্তরে আধার নামলো এরীশের কৃষ্ণগহ্বরে। দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
— এই মূহুর্তে তোমাকে শাস্তি দিতে ইচ্ছে করছে।
থমকে গেলো রমণী। তড়াক করে চোখ তুলে অবুঝ বালিকার মতোই দৃষ্টিপাত করলো অনুভূতিহীন শূন্য চোখে। এরীশ তখনও নির্বিকার। সহসা শুষ্ক একটা ঢোক গিলে ভয়ার্ত গলায় প্রশ্ন ছুড়লো ঈশানী,
—ক… কি শাস্তি?
— দু’মিনিটে লাউঞ্জে এসো, তারপর বলছি।
নিরুত্তাপ কণ্ঠে কথাগুলো আওড়ে হনহনিয়ে বেড়িয়ে গেলো এরীশ।

ঈশানী লাউঞ্জে এলো টানা দশমিনিট লাগিয়ে। এরীশ কাউচে বসে ম্যাকবুকে কিছু একটা করছিল তখন , হঠাৎ সে অনুভব করলো আশেপাশে ভ্যানিলার সুঘ্রাণটা তীব্র হয়ে উঠেছে,সহসা চোখ বুজে গভীর শ্বাস টানলো। অতঃপর ধীরে ধীরে চোখ খুলতেই দেখলো স্বয়ং সাকুরা তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে। রমণীর মোমঢালা কোমল চেহারাখানি পরখ করতেই ভেতরের কঠিন সত্তাটা ক্রমশ দ্রবীভূত হতে লাগলো মাফিয়া বসের। কি অদ্ভুত এই রমণী! নিষ্ঠুর মাফিয়া বসের চোখে একমাত্র পবিত্রতার প্রতীক, যার উপস্থিতিতে সাকুরার মতো স্নিগ্ধতা ছড়ায়, আর শরীর থেকে ভ্যানিলার মতো সুমিষ্ট সুঘ্রাণ।
কিছু একটা বলতে গিয়েও হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে পড়লো এরীশ। মনে পড়ে গেলো মাতভেইয়ের জুড়ে দেওয়া কঠোর সতর্কবাণী,

— ওকে একটু ভালো ফিল করাও। শী ইজ ইন দ্যা লাস্ট স্টেজ অব ডিপ্রেশন।
তপ্তশ্বাস ফেললো এরীশ। তৎক্ষনাৎ সিদ্ধান্ত বদলে নিজেকে যথাসম্ভব সংযত করে ইতিবাচক একটা অভিব্যক্তি ধরে রাখলো চেহারায়। ঈশানী প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে তাকাতেই ওর হাতটা খপ করে টেনে ধরে লম্বা পা ফেলে সদর দরকার দিকে এগুতে লাগলো বিনাবাক্যে। আকস্মিক কাণ্ডে হকচকিয়ে উঠলো রমণী,তড়িঘড়ি করে প্রশ্ন ছুড়লো,
— কোথায় নিয়ে যাচ্ছো এতো রাতে?
কোনোরূপ জবাবদিহি না করে উল্টো প্রশ্ন করলো এরীশ,
— এই পেন্টহাউজের রুফটপে যে একটা হেলিপ্যাড রয়েছে সেটাকি তুমি জানো?
— তোমার এই রহস্যেঘেরা অদ্ভুত পেন্টহাউজে কোনোকিছুই অস্বাভাবিক নয়।
নির্লিপ্ত কণ্ঠে কথাটা বলে ঠোঁট উল্টালো রমণী। এরীশ প্রত্যুত্তর করলো,

— চলো তাহলে।
— কোথায়?
এ পর্যায়ে নব ঘুরিয়ে রুফটপের দরজাটা খুলে ফেললো এরীশ। অন্যহাতে হ্যাঁচকা টান মে’রে ঈশানীকে কোলে তুলে অন্ধকারের মাঝে এগিয়ে যেতে যেতে জবাব দিলো,
— হেলিকপ্টার রাইডে!

মেঘাচ্ছন্ন থমথমে আকাশ। বিজলির নীলাভ রশ্মিতে ক্ষণে ক্ষণে চমকে উঠছে প্রকৃতি। ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দু’হাজার মিটার উপরে বসে প্রবল বিস্ময় নিয়ে সমগ্র মস্কো শহর পরখ করছে ঈশানী। দুচোখের তারায় স্পষ্ট উল্লাস। ওষ্ঠাধর ফাঁক হয়ে আছে সবিনয়ে। রাতবাতির ঝিকিমিকি আলোয় পুরো শহরটিকে জাদুর মতো লাগছে। ওর পাশেই পাইলটের রিভলভিং চেয়ারে বসে কলেক্টিভ নিয়ন্ত্রণ করছে এরীশ ইউভান। রাতের আকাশ অথচ কালোরঙা বিশালাকার রোদচশমায় চোখ দু’টো আবদ্ধ তার। মাখনের মতো উজ্জ্বলাভ চেহারার মাঝে তীক্ষ্ণ নাসারন্ধ্রে পদ্মাসন হয়ে গেড়ে বসে থাকা সানগ্লাসে ভীষণ আকর্ষনীয় দেখাচ্ছে তাকে। আন্ডার কাট স্টাইলিস চুলগুলো অবাধে জায়গা করে নিয়েছে বিস্তৃত কপালে। গতিপথে নিগূঢ় পর্যবেক্ষনের দরুন দাঁতের ডগায় অধর কামড়ে ধরেছে সে বেখেয়ালে।

চারিদিক ঘুরে হেলিকপ্টারটা যখন লোকালয় ছাড়িয়ে সমুদ্রের অভিমুখে এগুতে লাগলো, তখন ধীরে ধীরে আধার হয়ে এলো চারিপাশ। বাইরে টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, বেড়েছে বাতাসের গতিবেগ । হঠাৎ শহর ছেড়ে এহেন নির্জন গতিপথে এগুতে দেখে দৃষ্টি ঘোরালো ঈশানী। অকস্মাৎ কিছু প্রশ্ন করবে তার আগেই মাফিয়া বসের এলোমেলো উদাসীন মুখাবয়ব লক্ষ্য করে দুনিয়া ভুলে গেলো মেয়েটা ।

বুকের ভেতর টের পেলো আশ্চর্য এক তড়িৎ কম্পন। লোকটা যখনই চোখে রোদচশমা চড়ায়, বারবারই সেই প্রথম আকর্ষনের কথা মনে পড়ে যায় ঈশানীর। শূন্য দৃষ্টি,তীক্ষ্ণ চোয়াল, কালচে বাদামি ওষ্ঠ, আর তার নিচে ঠিক চিবুক বরাবর কুচকুচে সেই কালো তিলক। এখন এই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে মাফিয়া বসের নিম্নাধরের তিলকটা চৌম্বকের মতো টানছে ওকে। হেলিকপ্টারের ককপিটে বসা দক্ষ পাইলটটিকে কি ভীষণ মোহনীয় লাগছে। নিস্প্রভ দৃষ্টে চেয়ে আছে ঈশানী,থমকে আছে তার শ্বাসপ্রশ্বাস। অসময়ের বর্ষার মতোই বুকের ভেতর টিপটিপ করে ঝরে পড়ছে অনুভূতির বৃষ্টি। মনে হচ্ছে প্রেমে পড়ার এক অপার্থিক লগ্নে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষটিকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে ঈশানীর। এবার যদি ওই চশমা আবৃত চোখ দু’টো ওর দিকেই ঘুরে তাকায় তখন! তখন কি হবে? ঈশানীতো ম’রেই যাবে!

কল্পনা বিলাসী রমণীর রঙধনুর মতো রঙিন কল্পনা স্থায়ী হলোনা বেশিক্ষণ। বিভ্রম ভাঙিয়ে বাস্তবের চিরাচরিত রুক্ষতা নিয়ে ভেসে এলো গম্ভীর কণ্ঠস্বর,
— তখন থেকে কি দেখছো? আই ক্যান্ট ইভেন ফোকাস।
ঈশানী মতিভ্রমে বিড়বিড়ালো,
— একহাতে ড্রাইভ করলে সব পুরুষকেই কি এমন আকর্ষনীয় দেখায়?
এরীশের কানে মস্ত হেডফোন। তবুও বাতাসের ঘূর্ণনের কারণে কোনোকিছুই স্পষ্ট শুনতে পেলোনা সে। অগত্যা দ্বিতীয়বার জানতে চাইলো,
— কি বললে?
হেলিকপ্টারের গতিজড়তায় মোহভঙ্গ হতেই ধড়ফড়িয়ে উঠলো ঈশানী। উত্তর দেওয়ার ফুরসত পেলোনা, তার আগেই এরীশ বললো,

—- আই থিংক উই নিড টু ল্যান্ড, প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে এদিকে।
কথা বলতে বলতেই ঈশানী লক্ষ্য করলো ওরা একটা সমুদ্রবেষ্টিত বালুচরে এসে নেমেছে। অবিরাম বর্ষনে ধূসর হয়ে আছে চারিদিক,হেডলাইডের তীর্যক আলোয় সামনে পেছনে খানিক পর্যবেক্ষণ করে কৌতুহলি স্বরে প্রশ্ন ছুড়লো ঈশানী,
— এটা কোথায় এরীশ?
কানের হেডফোন খুলতে খুলতে এরীশ জবাব দিলো,
— এটা একটা দ্বীপ, আর আমাদের ওয়েডিং ভেন্যু।
— ওয়েডিং!
ঈশানীর কণ্ঠে বিস্ময়। এরীশ প্রত্যুত্তর করলো,
— হু, কেন বিয়ে করবে না আমায়?
এরীশ হেয়ালি করছে সেই ভেবে প্রসঙ্গটিকে বেমালুম অগ্রাহ্য করলো ঈশানী। উল্টো বহমান বারিধারার পানে মুগ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আওড়ালো,

— রাশিয়াতে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার এমন ঝুম বৃষ্টি দেখলাম আমি।
পরক্ষনেই আবদারের স্বরে বলে উঠলো,
— আমি ভিজতে চাই এরীশ, প্লিইইজ!
এরীশের অভিব্যক্তি কঠিন। রক্ষণশীল গলায় বললো,
— বাইরে অনেক বেশি ঠান্ডা।
— হোক ঠান্ডা তুমি তো আছো।
অতি সাবলীল ভাবে কথাটা বলেই দরজা খুলে চড়ুইয়ের মতো চঞ্চল পদচারণায় হেলিকপ্টার থেকে টুপ করে নেমে গেলো ঈশানী। এরীশ সেদিকে বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে। মনেমনে ভাবছে,
— মেয়েটা সেই শুরু থেকে এরীশ ইউভানের মতো একটা মনস্টারকে ভরসা করে আসছে, কি আশ্চর্য!

রিভলভিং চেয়ারে দুলতে দুলতে প্রায় দশমিনিট ধরে হেটলাইটের সুবিস্তীর্ণ আলোয় রমণীর বৃষ্টিবিলাশ অবলোকন করছে এরীশ। চারিপাশে নাইটওয়াচার আর demon Knight দের বিশেষ সুরক্ষা রয়েছে তাই খানিকটা নিশ্চিন্ত সে।
চোখের সামনে বৃষ্টিস্নাত লতানো শরীরের নারীটিকে গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে এক ধ্যানে। তর্জণী আর মধ্যমা দুটো একত্রে কপালের উপর বোলাতে বোলাতে মোহাবিষ্ট নয়নে দেখে চলেছে সিক্ত রমণীর প্রতিটি আবেদনময়ী পদক্ষেপ। কখনো তার আনমনা স্নিগ্ধ হাসি কখনো বা ছোট্ট ছোট্ট হাতের এলোমেলো জলকেলি। দেখতে দেখতেই অভিব্যক্তি পাল্টে গেলো এরীশের। গম্ভীরতা ছাপিয়ে দু’চোখে জড়ো হলো অপার মুগ্ধতা। জীবনে প্রথমবার বৃষ্টিকে বৃষ্টি বলে মনে হচ্ছে তার। অমানিশার বুক চিড়ে নেমে আসা শীতল বারিধারার রিমিঝিম আওয়াজ তীরের ফলার মতোই বুকে এসে লাগছে যেন । সেই সঙ্গে একীভূত হয়েছে এক প্রবিত্র সরলতার কমনীয় লালিত্য।

এক জীবনে বৃষ্টিকে কোনোদিন নিছক পানির বর্ষন ব্যাতীত অন্যকিছু মনে হয়নি এরীশের। ভেজা তো দূরে থাক, কোনোদিন খেয়াল করে তাকায়নি অবধি। কিন্তু আজ কিছু আশ্চর্য ব্যতিক্রম ঘটছে। আজ মনে হচ্ছে বৃষ্টির আলাদা সুবাস আছে। বৃষ্টি কেবল নিছকই জলধারা নয়, এ যেন প্রেয়সীর প্রথম প্রেমের উষ্ণ আলিঙ্গন।
বহুক্ষণের বৃষ্টিবিলাসে শরীরটা বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে ঈশানীর। তিরতির করে কাঁপছে তার সর্বাঙ্গ। বৃষ্টিস্নাত বরফ শীতল শরীরে অকস্মাৎ মন্থর উষ্ণতা অনুভব হতেই জমে গেলো সে। হেলিকপ্টারের হেডলাইনের ব্যাতীত আশপাশ নিকোশ আধারে নিমজ্জিত, তাই একটু ভয়ও হলো। ভ্রুকুটি করে কয়েক মূহুর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়াতেই ফের ঘাড়ের উপর আঁচড়ে পড়লো গাঢ় তপ্তশ্বাস। সঙ্গে সঙ্গে ধড়ফড়িয়ে উঠে পেছনে ঘুরলো ঈশানী। সময় ক্ষেপণ করলো না মাফিয়া বস, তটস্থ রমণীকে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে একটানে নিয়ে এলো বুকের কাছে। দীর্ঘদেহী ইস্পাত কঠিন বুকের ভাজে পাখির পালকের মতো লেপ্টে গিয়ে দম নিলো ঈশানী। ক্ষীণ আওয়াজ তুলে আওড়ালো,

— এরীশ তুমি!
— হুম আমি, তোমার এই আনন্দ উল্লাসের কারণ খুঁজতে এলাম।
বিস্ময়ভাব কেটে যেতেই এরীশের থেকে দূরত্ব বাড়ালো ঈশানী। অতঃপর চোখে চোখ রেখে তরল কণ্ঠে শুধালো,
— খুঁজে পেলে কিছু?
— উহু এখনো না।
এরীশের মুখে মাস্ক লাগানো নেই। তার বর্ষণসিক্ত চেহারাজুড়ে পৌরষীয় আসক্তি। মেদহীন সৌষ্ঠব শরীরে লেপ্টে আছে কালো রঙের সিল্ক শার্ট।আস্তিন গোটানো, ফর্সা হাতের কব্জিজুড়ে আবদ্ধ ব্ল্যাকবেল্ট ঘড়িটাও আশ্চর্য মোহনীয়তায় কেড়ে নিচ্ছে আকর্ষন। বৃষ্টিস্নিগ্ধ গোটা মানুষটিকে একপল পর্যবেক্ষণ করে তাড়াহুড়ো চোখ ফিরিয়ে নিলো রমণী। বরফ শীতল ঠান্ডার মাঝেও ক্রমশ উষ্ণ হয়ে উঠছে তার সমগ্র মুখমণ্ডল। জাফরানি রঙ ধারণ করেছে পেলব ঠান্ডা গাল। এরীশ কিছু বললো না আর, নির্লিপ্ত হাতে একটা কালো হুডি চড়িয়ে দিলো ঈশানীর ভেজা শরীরে।
শুকনো আবরণে কিঞ্চিৎ নড়েচড়ে উঠলো ঈশানী, নিরুত্তাপ কণ্ঠে জানালো,

— আমার ততোটাও ঠান্ডা লাগছে না।
— জানি।
— তাহলে এটা কেন দিলে?
— মন বললো তাই।
মাফিয়া বসের সংক্ষিপ্ত প্রতুত্তর। ঈশানী একটু অবাক হয়ে শুধালো,
— মনের কথা আবার কবে থেকে শোনা শুরু করলে তুমি?
— যবে থেকে তুমি এলে!

নিজের কথাতে এরীশ নিজেও কিঞ্চিৎ অবাক হলো বোধ হয়। তার মনের উপর যে মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ নেই তা আরও একটা প্রমান হয়ে গেলো ঈশানীর সামনে। ফলস্বরূপ নিশ্চুপ হয়ে রইলো কিছু না বলে। ওদিকে এরীশের শেষ কথাটা টেনিস বলের মতোই ক্রমাগত ঢপ খেতে লাগলো ঈশানীর মস্তিষ্কে। উৎসুক পুলকিত চিত্ত হঠাৎই ছেয়ে গেলো অতর্কিত বিষণ্ণতায়। মনে পরে গেলো বিকেলে ফ্লোরার বলে যাওয়া প্রতিটি বাক্য। সেসব ভেবে ধীরে ধীরে গভীর নীল চোখ দু’টো অথৈজলে থৈথৈ করে উঠলো রমণীর।

ঝাপসা চোখে ভয়-জড়তা, দ্বিধাদ্বন্ধ সবকিছু ভুলে জীবন্ত পুতুলের মতো কয়েক মূহুর্ত নৈঃশব্দ্যে চেয়ে রইলো ওই বৃষ্টিভেজা সুদর্শন মুখটির দিকে। পরপরই স্রোত তরঙ্গের মতো অকস্মাৎ ঝাপিয়ে পড়লো স্বামী নামক ব্যক্তিটির উপর। তার শরীরের সঙ্গে মোমের পুতুলের মতো মিশে গিয়ে দু’হাতের আঁজলায় তুলে নিলো খড়খড়ে চিবুকখানি। এরীশ তখনও বিহ্বল নয়নে তাকিয়ে। জীবনে এতোটা আশ্চর্য বোধ হয় আর কখনো হয়নি সে । সেই আশ্চর্যের মাত্রা দিগুণ করে দিয়ে আচানক বুকভেঙে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো রমণী। কাঁদতে কাঁদতে অজস্র চুম্বন আঁকলো এরীশের তীক্ষ্ণ চোয়ালে। আতর্নাদের মতো করে বলতে লাগলো,

— খুব কষ্ট হয়েছে তোমার? খুব কষ্ট হয়েছে তাইনা?
এতোগুলো এক্সিডেন্ট, একের পর এক অপারেশন, খুব কষ্ট হয়েছে জান? এতোকিছুর পরেও কেন আমার জন্য এতো পাগলামি তোমার? আমার মতো একটা তুচ্ছ মেয়ের জন্য কেন নিজেকে এভাবে ভাঙছো? তুমি ভেঙে গেলে আমি সইতে পারবো না রীশ। কেন বুঝতে পারোনা?
— আমি শুধু তোমাকে চাই।
ঈশানীর হাজারটা বুকভাঙা বিলাপের বিপরীতে এরীশের নির্লিপ্ত স্বীকারোক্তি। তা শুনে মেয়েটা ফুঁপিয়ে উঠলো নতুন উদ্যমে। অস্থির হয়ে বললো,

— আমিতো তোমারই এরীশ। আমিতো তোমারই।
এতোকিছুর মাঝেও এরীশ খেয়াল করলো তার গ্রীবা ছুঁতে পায়ের আঙুলের উপর ভর করে দাঁড়াতে হয়েছে ঈশানীর। ফলস্বরূপ দু’হাত বাড়িয়ে ওকে শূন্যে তুলে নিলো এরীশ। অতঃপর কপালে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে হিসহিসালো,

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৫৮

— গিভ মি মোর।
ঈশানী একটু অবাক হলো, নাক টেনে শুধালো,
— কি?
অন্ধকারের মাঝে ফের ধ্বনিত হলো পুরুষালি হাস্কি কণ্ঠস্বর,
— কিস!

আমি শুধু চেয়েছি তোমায় পর্ব ৬০