আযদাহা সিজন ২ পর্ব ২৩
সাবিলা সাবি
“আমাকে ছাড়ুন,” ফিওনা মৃদু স্বরে বললো,একটু কাঁপা কাঁপা গলায়।
জ্যাসপার চমকে তাকাল, কথাটা ঠিক বুঝতে পারছে না। “মানে, কি ছাড়বো?”
“এই যে…আমাকে ধরে রেখেছেন।” ফিওনার কণ্ঠে হালকা ভর্ৎসনার আভাস ছিল,তবে দৃষ্টি অন্যদিকে নিবদ্ধ।
তখনই জ্যাসপারের মনে হলো, সে কীভাবে ফিওনার পেট জড়িয়ে ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে রেখেছে।ফিওনার দেহ তার দেহের এতটাই কাছে মিশে আছে যে এক অপরের অংশ হয়ে গেছে।অবচেতনে তার হাতটা পেটের আশেপাশে জড়িয়ে ছিল,আর এই সামান্য ছোঁয়া ফিওনাকে একটু থমকে দিয়েছে।
জ্যাসপার ছাড়লো না,বরং ধীর গলায় বললো,“নামো দোলনা থেকে।”
ফিওনা ধীরে ধীরে দোলনা থেকে নেমে এলো।ঠিক সেই মুহূর্তে,জ্যাসপারের হাতটা নিজের অজান্তেই সরে গেল তার পেটের অংশ থেকে। কিন্তু সরে যাওয়ার সময় পেটের চারপাশে একটা মৃদু স্পর্শ রেখে গেল—অদ্ভুত, অথচ নিঃশব্দে বিদ্যুতে আছন্ন করা মতো। সেই হালকা স্পর্শ ফিওনার মনে উত্তেজনার ঢেউ তুলল,আর জ্যাসপারও সেই অজানা অনুভূতিতে আবৃত হলো।
নতুন,আবিষ্কারের মতো এই অনুভূতির কাছে দুজনেই খানিকটা থমকে গেল—ভুলে গেলো সবকিছু, এই ক্ষণিক স্পর্শে শুধু থেকে গেল কিছু না-বলা অনুভূতি।
ফিওনা ধীরে দোলনা থেকে নামতেই জ্যাসপার হনহন করে হাউজের ভেতরে চলে গেলো। ততক্ষণে পাহাড়ের আকাশে সন্ধ্যার আভা ছড়িয়ে পড়েছে,চারপাশে ম্লান আলো,দিন-রাতের সীমানায় দাঁড়িয়ে আছে।
ঠিক তখনই অ্যাকুয়ারা ছোট্ট গোলাপী খরগোশটি হাতে নিয়ে ছুটে এলো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“একি, ফিওনা! তুমি একা একা নামলে কিভাবে?” অ্যাকুয়ারার চোখে বিস্ময়।
ফিওনা মৃদু হেসে বললো, “এভাবেই ব্যালেন্স রেখে।”
অ্যাকুয়ারা ভ্রু কুঁচকে বলে,“সর্বনাশ!যদি পড়ে যেতে?”
তারপর খরগোশটি দেখিয়ে বললো,“এইটা কি তোমার হাতে?”
ফিওনা বিস্ময়ে তাকালো খরগোশটির দিকে।
অ্যাকুয়ারা আনন্দিত ভঙ্গিতে “দেখো তো,কি সুন্দর খরগোশ।
ফিওনা অবাক হয়ে “ওমা,গোলাপী রঙে খরগোশ!আগে তো কখনও এমন খরগোশ দেখিনি!”
অ্যাকুয়ারা মাথা নাড়িয়ে বললো,“এটা এই পাহাড়ের খরগোশ।ওরা বেশ বিরল।”
ফিওনা খুশি হয়ে বললো,“ভালোই করেছো,অ্যাকু।এটাকে নিয়ে একটু সময় কাটানো যাবে।”
খরগোশের গোলাপী পশমে স্নিগ্ধ সন্ধ্যার আলো মিশে যেতেই,পাহাড়ের পরিবেশ আরো মোহনীয় হয়ে উঠল।
অ্যাকুয়ারা মৃদু হেসে বলল, “পরের বার তোমাকে পাহাড়ের ফুলের বাগানটা ঘুরিয়ে দেখাবো।আর কালকে তোমাকে গ্লাস হাউজের ছাদে নিয়ে যাবো।সেখানে আরও অনেক ধরনের ফুল আছে।”
ফিওনার চোখে উচ্ছ্বাসের ঝিলিক ফুটে উঠল।
“সত্যি বলছো?”
“হ্যাঁ,সত্যি,” অ্যাকুয়ারা ফিওনাকে আশ্বস্ত করে বললো। “প্রিন্সের অনুমতি নিয়ে কাল আমরা ছাদে উঠব।”
ফিওনা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল,”আচ্ছা,তাহলে ছাদের ফুলগাছগুলোর যত্ন কে নেয়?”
অ্যাকুয়ারা হেসে বলল “আরেহ!ওগুলো যত্ন করতে হয় না।তারা এমনিতেই সবসময় তাজা আর সুন্দর থাকে।প্রকৃতিই তাদের যত্ন নিচ্ছে।”
অবাক হয়ে ফিওনা ভাবল,এই পাহাড়ের ফুলগুলোও কি তবে কোনো জাদুকরী শক্তির অধিকারী? তাদের নিরবচ্ছিন্ন সৌন্দর্যের রহস্যে মোহিত হয়ে পড়ল সে।
অবশেষে আজকের মতো ঘোরাঘুরি শেষে তারা গ্লাস হাউজে ফিরে এল। সেখানে ঢুকতেই হঠাৎ অ্যাকুয়ারা কিছু উপন্যাসের বই ফিওনার দিকে বাড়িয়ে দিলো।ফিওনা অবাক হয়ে বইগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, “এগুলো কিভাবে আনলে,অ্যাকু?”
অ্যাকুয়ারা মৃদু হেসে জবাব দিলো, “আরেহ, থারিনিয়াসকে দিয়ে আনিয়েছি আমার কথা বলে।”
ফিওনার মুখে উজ্জ্বল হাসি ফুটে উঠল।সে অভিভূত হয়ে বলল, “তুমি সত্যিই অনেক ভালো,অ্যাকু।ইচ্ছে করছে তোমাকে জড়িয়ে ধরি।”
অ্যাকুয়ারার সেই বন্ধুত্বপূর্ণ সান্নিধ্যে ফিওনার মনটা আনন্দে ভরে উঠল,অ্যকুয়ারা তার কাছে লিন আর লিয়ার মতোই হয়ে উঠলো।
রাতের রান্না শেষে খাবার একে একে পরিবেশন করতে লাগলো ফিওনা।টেবিলের চারপাশে নীরবতা জমে আছে, শুধুমাত্র থালায় খাবারের মৃদু শব্দ শোনা যাচ্ছে। জ্যাসপার চেয়ারে বসে ধীরে ধীরে খাবার খাচ্ছে,তবে তার দৃষ্টি বারবার আড়চোখে ফিওনার দিকে চলে যাচ্ছে। আজ ফিওনার মুখে এক অন্যরকম আভা—স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল, আনন্দে ভরপুর। এই উজ্জ্বলতা দেখে জ্যাসপারের মনের কোণে অদ্ভুত অনুভূতি জেগে উঠছে।
এতদিন সে দেখেছে,ফিওনা সাধারণত খাবার বাড়ার সময় ম্রিয়মান থাকে, মুখে ফ্যাকাশে এক আবরণ। কিন্তু আজ তার চোখে এক নতুন দ্যুতি খেলা করছে।মনে হচ্ছে বাইরের দোলনায় সময় কাটিয়ে,হাওয়ার স্পর্শে একটু প্রশান্তি খুঁজে পেয়েছে। জ্যাসপার ভাবছে,কেনো আমি এই মানবী মেয়েটার সব বিষয়ে এতো ভাবছি?
রাতের নিস্তব্ধতায় ল্যাবের মৃদু আলোর নিচে জ্যাসপার প্রবেশ করলো,গ্লাসের গাঢ় প্রান্ত ঘিরে চারপাশে ছড়িয়ে থাকা যন্ত্রপাতির দিকে এক এক করে তাকাল।আজকের রাতটি ছিলো অন্যরকম।ল্যাবে সে এসেছে নিজেকে বোঝার জন্য, নিজের মনে জমে ওঠা একটি অদ্ভুত অনুভূতির সঠিক পরিচয় জানার জন্য।ফিওনার প্রতি তার আকর্ষণটা কি কেবল কৌতূহল,নাকি এর গভীরে লুকিয়ে আছে আরও কিছু?
প্রথমে সে অক্সিটোসিন পরীক্ষা শুরু করলো।এই হরমোনটি,যাকে “প্রেমের হরমোন” বলে—তার ভেতর কি সত্যিই ভালোবাসার কোনো বীজ বপিত হয়েছে?নিজের শরীর থেকে নমুনা নিয়ে সে ল্যাবের স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে রাখলো। কিছু মুহূর্তের মধ্যে যন্ত্রটি জ্বলে উঠলো, স্ক্রিনে ফুটে উঠলো “অক্সিটোসিনের মাত্রা হাই,” যা কোনো শারীরিক টান বা গভীর আকর্ষণের প্রথম চিহ্ন।জ্যাসপারের চোয়াল শক্ত হলো।নিজের অবচেতন মনে ফিওনার প্রতিচ্ছবি তার শরীরের সাড়া ফেলছে।
এরপর জ্যাসপার তার ফিজিওলজিক্যাল রেসপন্স পরীক্ষা করলো। এই পরীক্ষাটি তার শ্বাসের গতি, হৃদস্পন্দন,আর রক্তচাপের পরিবর্তন পরীক্ষা করছে।যন্ত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য স্ক্রিনে ফুটে উঠলো: “শরীরে সামান্য উত্তেজনা, এবংহার্টবিট বেড়ে গেছে।” ফিওনার কাছে যাওয়ার মুহূর্তগুলো তার শরীরের প্রতিটি ভাঁজে লুকিয়ে রয়েছে।মনে হলো,অজান্তেই সে হৃদয়ে কোনো এক দুর্বলতার বীজ রোপণ করেছে।
পরের পরীক্ষা ছিল গ্লুকোজ লেভেল।সাধারণত রোমাঞ্চ বা উদ্বেগের মুহূর্তে এই স্তর পরিবর্তিত হয়, যা অনেক সময় প্রেমের আবেগের কারণে হতে পারে। সে টেস্টটি শুরু করতেই স্ক্রিনে দেখা দিলো,”গ্লুকোজের মাত্রা কিছুটা বেড়ে গেছে,” যা ইঙ্গিত করছে তার মনের উত্তেজনা। সে ভাবল,তবে কি ফিওনার প্রতি অনুভূতিটা সত্যিই প্রেমের প্রথম ধাপ?
এরপর এল অফলাইন স্ট্যাটাস টেস্ট।এখানে সে চাচ্ছিলো দেখতে,ফিওনার চিন্তা বা সঙ্গ ছাড়া এই অনুভূতি কতটা গভীরে পৌঁছায়।স্ক্রিনে ফুটে উঠলো: “প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও মানসিক সংযোগ।” মনে হলো,ফিওনা তার কাছে অনুপস্থিত থাকলেও তার মনের প্রান্তে এক ধরনের অদৃশ্য বন্ধনের সৃষ্টি হয়েছে।
শেষ পরীক্ষা ছিল সাংস্কৃতিক সংযোগ।ল্যাবের স্ক্রিনে ফুটে উঠলো, “মনের মধ্যে সংযোগ প্রতিষ্ঠিত,” যার ফলে তার মনে আরো দৃঢ় হলো যে, ফিওনার প্রতি এই অনুভূতি কেবল দৃষ্টি বা উপস্থিতি নয়,বরং তার জীবনে এক গভীর ভালোবাসার প্রকাশ।
এই সমস্ত পরীক্ষার শেষে, স্ক্রিনে এক সংক্ষিপ্ত শব্দ ফুটে উঠলো:”ইউ ফল ইন লাভ।”
জ্যাসপার এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল,মনে হলো,সমস্ত পরীক্ষার ফলাফল তার মনের গোপন অংশগুলো উন্মোচিত করলো।
ল্যাবের স্ক্রিনে টেস্টের ফলাফলগুলো দেখার সাথে সাথেই জ্যাসপারের মুখটা কঠিন হয়ে উঠলো। তার চোখেমুখে ফুটে উঠলো বিস্ময় আর ক্রোধের ছাপ,সে বিশ্বাসই করতে পারছে না। সে চিৎকার করে বললো,
“নো! দিস ইজ ইম্পসিবল! আমি কিভাবে ওই ফুলিশ হিউম্যান গার্লটার প্রেমে পড়তে পারি?”
এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে নিজের ভেতরে তোলপাড় হওয়া অনুভূতিগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করছিল সে। কিন্তু তার মনের সমস্ত যুক্তি অদৃশ্য হয়ে গেলো। টেস্ট মেশিনগুলোর দিকে রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে বললো, “এই ডিভাইসগুলো আসলে কোনো কাজেরই না!”
তারপর ক্রোধে জ্বলে উঠে একে একে টেস্ট যন্ত্রগুলোকে আঘাত করে মাটিতে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলো। তার দৃষ্টিতে ছিল অভিমান আর অস্বীকারের এক কঠিন মিশ্রণ,নিজের অনুভূতিকে মুছে ফেলতে চাইছে কিন্তু পারছে না।
সব ভেঙে চুরমার করে,অবশেষে জ্যাসপার এক্সিকিউটিভ চেয়ারে এসে বসল।মাথা পেছনে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল এক মুহূর্তের জন্য, নিজের ভিতরে জমে থাকা রাগের আগুনটাকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়।
কিন্তু,চোখ বন্ধ করতেই তার মনে ভেসে উঠলো ফিওনার উজ্জ্বল হাসি,যত্ন নিয়ে তার হাতে মলম লাগানো দৃশ্য, আর সেই কোমল স্পর্শ—যা তাকে ছুঁয়ে যায়।মনে পড়লো সেই মিষ্টি চুম্বন,যে চুম্বন তার হৃদয়ের গভীরে এক কোমল স্পন্দন সৃষ্টি করেছিল।
জ্যাসপারের মনের তীব্র রাগ ধীরে ধীরে গলে যেতে লাগলো। অনুভব করল এক অজানা শীতলতা, ফিওনার স্মৃতিগুলো তাকে শান্ত করতে চাইছে।এক গভীর নিঃশ্বাস ফেলে নিজের সত্তাকে তিরস্কার করে বিড়বিড় করে বলল,“জ্যাসপার,অরিজিন ড্রাগন প্রিন্স!!নিজের ধ্বং*স নিজেই ডেকে আনলে…”
এই মুহূর্তে তার ভেতরে দ্বন্দ্বের স্রোত বয়ে গেলো—একদিকে তার অহংকার,অন্যদিকে ফিওনার প্রতি গোপন সেই আবেগ,যা তাকে ধীরে ধীরে আবদ্ধ করছে,তার সমস্ত শক্তি শিথিল করে দিয়ে নিঃশব্দে তার মনের গভীরে প্রবেশ করেছে।
সারারাত ল্যাবেই কাটানোর পর,সকালে জ্যাসপার বাড়ি ফিরে আসল। তার সারা শরীর ক্লান্ত, মন ভারাক্রান্ত। কিন্তু যখন সে হাউজে প্রবেশ করলো, তাঁর চোখে পড়লো এক অদ্ভুত দৃশ্য। কিচেনে, সবার আগে ফিওনা আর অ্যকুয়ারা ব্যস্ত ছিল,কিন্তু হঠাৎ এক গোলাপী খরগোশ ছুটে এসে দাঁড়াল জ্যাসপারের পায়ের কাছে।
এটা কোনো অদৃশ্য শক্তি ছিল, যা ফিওনার দিকে তাকে টেনে আনছে। ফিওনা দ্রুত কিচেন থেকে বেরিয়ে এসে, খরগোশটা ধরতে চাইল। সে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে, জ্যাসপারের পায়ের কাছ থেকে খরগোশটা তুলে নিলো। কিন্তু, এই সময়ই তার চোখগুলো অদ্ভুতভাবে জ্যাসপারের দিকে উঠে গেলো। চোখে এক গভীর চুপচাপ ভাব,এক অপ্রকাশিত ভাব ছিল,যা দেখে জ্যাসপার বুঝতে পারলো কিছু একটা ঘটছে।
ফিওনা খরগোশটা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো, চোখে চোখ রাখলো।তার প্রশান্ত মুখের ওপর কিছু অব্যক্ত কথা ছিল,সে নিজে বুঝতে পারছে,এই মুহূর্তে তাদের মধ্যে কিছু পরিবর্তন হচ্ছে,যা তাদের সম্পর্ককে এক নতুন দিশা দেখাতে চলেছে।
ফিওনা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল,তার চোখে ধরা পড়ে জ্যাসপারের মুখের গম্ভীরতা। জ্যাসপার কিছু না বলে,তীক্ষ্ণ চোখে একবার তাকিয়ে হনহন করে সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে চলে গেলো।
ফিওনা ধীরে ধীরে খরগোশটাকে নিজের কোলে নিলো,তার কোমল হাত দিয়ে তাকে সামলে,কিচেনের দিকে হাঁটা দিলো।চোখের কোণে এক মৃদু হাসি ফুটে উঠলো, খরগোশটাকে আদর করে বলল,
“পিংকি,তুমি আর কাউকে পেলেনা? ওই দানবটার পায়ের কাছেই যেতে হলো?আমি না থাকলে এতক্ষণে তোমাকে হা করে আগুন ছুড়ে ভস্ম করে দিতো।” খরগোশটা তার কথার অর্থ না বুঝলেও,ফিওনার কোলের উষ্ণতায় এক রকম নিশ্চিন্ত হয়ে ওর দিকে বড় বড় চোখে চেয়ে থাকল।
আজকের সারাটা দিন ফিওনা নিজেকে বইয়ের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছিল,একটি নতুন উপন্যাসের আকর্ষণে ভেসে চলছিলো।খরগোশটি তার পাশে ছিল সারাক্ষণ,নীরব আর আদরপ্রিয়,সব সময় তার সঙ্গী হয়ে থাকলো। তবে হঠাৎ করেই দরজায় খোলার মৃদু শব্দ শুনতে পায় ফিওনা। অ্যকুয়ারা ফিওনার কক্ষে আসে,খরগোশটার অবস্থা দেখতে। খরগোশটি দরজার পাশেই ঘুরঘুর করছিল,তার চোখে কিছুটা আতঙ্ক ছিল,কিছু ঘটতে চলেছে।
স্লাইডিং হয়ে দরজা খুলতেই খরগোশটি দ্রুত দৌড়ে বেরিয়ে যায়, অ্যকুয়ারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই,খরগোশটি তীব্র গতিতে করিডোরে চলে যায়।
“ফিওনা! ওকে আটকাও,আলবিরা আর থারিনিয়াস দেখলে, সর্বনাশ হয়ে যাবে!” অ্যকুয়ারা চিৎকার করে বললো, তার গলা তীক্ষ্ণ আতঙ্কে ভরা।
ফিওনা তড়িঘড়ি বিছানা থেকে উঠে,পা ফাঁক করে খরগোশটিকে ধরার জন্য দৌড়ে চলে গেলো।কিন্তু খরগোশটির গতিও ছিল অপ্রতিরোধ্য,সে অজানা এক শক্তি নিয়ে করিডোরে দৌড়াচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত,সে করিডোরের শেষ প্রান্তে চলে যায়,একদম জ্যাসপারের কক্ষের সামনে এসে থেমে দাঁড়ায়। চুপচাপ বসে পড়ে, মনে হলো তার গন্তব্য শেষ হয়ে গেছে।
ফিওনা তার পিছনে এসে দাঁড়ালো, একটু বিরক্ত,আবার একটু উদ্বিগ্ন।
ফিওনা খরগোশটাকে ধরতে ছুটে এসে দাঁড়ালো জ্যাসপারের কক্ষের সামনে। তার হয়তো ধারণাই ছিল না যে, জ্যাসপারের ঘরের দরজা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কয়েকজনের জন্যই স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যায়। তাই সে সেখানে দাঁড়াতেই দরজা স্লাইডিং হয়ে নিঃশব্দে খুলে গেলো।
খরগোশটি সেই সুযোগে ফাঁক গলে দ্রুত জ্যাসপারের ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়লো। ফিওনা একটু ইতস্তত করলেও দরজার সামনে দাঁড়ানোতেই দরজাটি বন্ধ হচ্ছিল না,তাই বাধ্য হয়েই সে আরও কিছুটা এগিয়ে গেল।ভেতরে ঢুকতেই তার দৃষ্টি থমকে গেল।
জ্যাসপার খালি গায়ে,একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে উবুড় হয়ে শুয়ে আছে। তার শক্তিশালী কাঁধ আর পেশিগুলো আবছা আলোয় স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছে। ফিওনার মন কিছুটা অস্থির হলো, কিন্তু সে দ্রুতই নিজেকে সামলে নিল।
ফিওনা আস্তে আস্তে জ্যাসপারের ঘরে ঢুকলো। তবে এই পন্ডিত খরগোশটা আরেক কাণ্ড করলো। সে হঠাৎই লাফিয়ে পড়লো জ্যাসপারের পিঠের ওপর, আর সাথে সাথেই জ্যাসপার চমকে লাফিয়ে উঠলো। ধীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো সামনেই ফিওনা, আর তার পিঠের ওপর সেই উচ্ছৃঙ্খল খরগোশ।
জ্যাসপার ক্ষুব্ধ হয়ে দ্রুত বিছানা থেকে নামতেই খরগোশটা সারা বিছানাজুড়ে এদিক-ওদিক দৌড়াতে শুরু করলো, সাথে সাথে বিছানাটাকেই উলটপালট করে দিয়ে গেলো। জ্যাসপার কড়া গলায় বললো, “এটাকে এই হাউজে এনেছে কে? সবকিছু নষ্ট করে দিচ্ছে! ফিওনা, এক্ষুণি এটা সড়াও এখান থেকে!”
ফিওনা জ্যাসপারের রাগ দেখে চুপচাপ না থেকে দ্রুত খরগোশটাকে ধরার চেষ্টা করলো। সে বিছানায় উঠেই খরগোশের পেছনে পেছনে ছোটাছুটি শুরু করলো, একবার এদিকে তো আরেকবার ওদিকে। বিছানার ওপর দু’জনের সেই ছোটাছুটির মাঝে এক অদ্ভুত বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হলো।
জ্যাসপার এখন পুরোপুরি রেগে গিয়ে ফিওনাকে বিছানার সাথে চেপে ধরলো। তার শক্তিশালী হাতগুলো ফিওনার হাতের আঙুলের ভাঁজে গভীরভাবে চেপে ধরলো। আরও এক পা এগিয়ে তাকে আটকানোর চেষ্টা করছে। ফিওনার শরীরটা বিছানায় রীতিমতো চেপে গেলো,সে স্নায়ুর উপর চাপ অনুভব করলো—একদিকে শ্বাস রুদ্ধ,আরেকদিকে জ্যাসপারের উপস্থিতি তাকে ঘিরে নিয়ে আসে।
জ্যাসপারের নিঃশ্বাস সোজা ফিওনার নাকে ঠোঁটের ওপর পড়তে লাগলো,মুহূর্তের মধ্যে তার সত্তা তাকে পুরোপুরি ঘিরে ফেললো। ফিওনার বুক উঠানামা করছে,গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি শ্বাস নিতে তার জন্য কঠিন হয়ে উঠছে। সে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে,সারা দেহে এক অজানা শিহরণ ছড়িয়ে পড়ছিল।
“কি করছিলে টা কি? ফিওনা,ওই খরগোশটা আমার গ্লাস হাউজে প্রবেশ করার সাহস কিভাবে পেলো?”—জ্যাসপারের গর্জন আরও তীব্র হলো।
ফিওনার শরীরে কোনো শব্দের শক্তি ছিল না,শুধু তাঁর মধ্যে কষ্টকর শিহরণ ছড়িয়ে পড়ছিল।তার পেটের ভেতর উত্তাল একটি সমুদ্র বয়ে যাচ্ছিল। এক মুহূর্তে,তার মাথায় এক দমকা ভাবনা এল,”আপনার মতো এমন আস্ত বড় একটা ড্রাগন মনস্টার এই হাউজে থাকতে পারলে, এই ছোট কিউট প্রাণীটা কেনো পারবেনা?”
তবে সে কথাগুলো কেবল মনে মনে বললো,মুখে কিছু উচ্চারণ করতে পারল না।জ্যাসপারের উপস্থিতি,তার শক্তি, সব কিছু মিলিয়ে এক অদ্ভুত নিষ্ঠুরতা ফিওনার মনের মধ্যে থমকে দাঁড়িয়েছিল।
জ্যাসপারের সবুজ চোখজোড়ায় ফিওনা এক টানে হারিয়ে যাচ্ছিল।চোখ দুটি ছিলো গভীর কোনো সাগর, যেখানে ডুব দিলে আর কখনো ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতো না। তার কণ্ঠস্বর মৃদু কাঁপছিল—”সরি,আর হবেনা…আমি পিংকিকে খাঁচায় আটকে রাখবো, ও আর আপনাকে বিরক্ত করবে না।”
ফিওনার ঠোঁটের কোণগুলো অল্প একটু কাঁপছিল, কথাগুলো বলার সময় তার ভিতর থেকে কোনো এক অচেনা অনুভূতি উঠে আসছিল।সেই কোমল কম্পন,তার গলার স্বরের মিষ্টি টান,সব কিছু মিলিয়ে জ্যাসপারের ভেতরে এক অজানা শিহরণ জাগিয়ে তুলল।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে তার ঠোঁট ফিওনার আরো কাছে নিয়ে এল।আজকে আর কোনো বায়োক্যামিকেলের প্রয়োজনে না আজকে তার চোখে এক ধরনের আকর্ষণ ছিল,আরো একবার ফিওনাকে চুম্বন করার তীব্র ইচ্ছা।তবে কিছু একটা তাকে থামিয়ে দিয়েছিল—আজ তার অনুভূতিতে কিছুটা অস্থিরতা ছিল,কিছুটা বাধা ছিল।ফিওনার অবস্থা যে এতটা দুর্বল হয়ে গেছে,তা সে বুঝতে পারছিল।
তার ঠোঁট প্রায় ফিওনার ঠোঁটের সাথে ছুঁই ছুঁই করছিল,ফিওনার চোখ দুটো আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল,তার শ্বাস কিছুটা ভারী হয়ে উঠেছিল।
সে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সেই মুহূর্তের ভেতর হারিয়ে ফেলতে চাচ্ছিল।
হঠাৎ করে,জ্যাসপার তার ঠোঁট ফিওনার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে থেমে গেল।এক মুহূর্তের জন্য, পুরো পৃথিবী থেমে গিয়েছিল।তারপর,তার গম্ভীর কণ্ঠে সেই শব্দগুলো ছুঁড়ে দিল—”আমার কাছে তুমি আর আসবে না, আমার থেকে দূরে দূরে থাকবে, সেটাই তোমার জন্য মঙ্গল।”
ফিওনার হৃদয়ে সেই শব্দগুলি আছড়ে পড়ল,হঠাৎ করে কোন অদৃশ্য ভারী জিনিস তার বুকে চেপে বসে। সে চুপচাপ চোখ খুলে তাকালো।তার দৃষ্টি ফিসফিস করে,কিন্তু জ্যাসপারের চোখের মধ্যে যা দেখল,তা তাকে অবাক করে দিল।জ্যাসপারের কথা বলার মাঝে কোনো ক্রোধ বা রাগের ছোঁয়া ছিল না। বরং, জ্যাসপারের চোখে ছিল এক অদ্ভুত শীতলতা, সেই সব অনুভূতি,যা সে চেপে রেখেছে, সেগুলোই প্রতিফলিত হচ্ছিল।
ফিওনা নিজেও বুঝতে পারলো না,জ্যাসপার যখন তাকে দূরে থাকতে বললো,তখন তার ভেতর এক অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করছিল।তার মনে ছিল এক ধরণের প্রশান্তি আসার কথা—যেহেতু সে এতদিন ধরে এক অনির্দিষ্ট আকর্ষণের মাঝে বন্দি ছিল,যা কখনো একদম স্পষ্ট ছিল না।কিন্তু আজ,যখন জ্যাসপার তাকে দূরে থাকতে বললো,তার অনুভূতিতে কোনো স্বস্তি ছিল না। বরং,এক অজানা শূন্যতা তার ভেতরে কুন্ঠা তৈরি করছিল।
তার মন একটি অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় ডুবে যাচ্ছিল—এমন এক যন্ত্রণা,যা সে শুধু অনুভব করছিল,কিন্তু প্রকাশ করতে পারছিল না।
জ্যাসপার ফিওনার হাতের ভাঁজ থেকে নিজের হাতের বাঁধন সড়ালো।ধীরে ধীরে,সে ফিওনার ওপর থেকে উঠে পড়লো। ফিওনার শরীর ক্ষণেই অবশ হয়ে গিয়েছিল,মাথা ঘুরছিল,গা কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছিল।তার শক্তি,তার অস্থিরতা—সবকিছু এক মুহূর্তে স্থির হয়ে গিয়েছিল।কিন্তু তারপর,একটু একটু করে,সে নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ালো।
জ্যাসপার এখনো তার দিকে না তাকিয়ে অন্য দিকে ফিরে ছিল।ফিওনা তার দিকে না তাকিয়ে,চুপচাপ সোফায় বসে থাকা খরগোশটিকে কোলে তুলে নিয়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে গেলো।তার পায়ের আওয়াজ মিলিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই, ঘরটা নিঃশব্দ হয়ে গেলো।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে তার দৃষ্টি দরজার দিকে ফেরালো। ফিওনার অনুপস্থিতিতে,কক্ষের বাতাসে এখনও সেই মিষ্টি ঘ্রানটা ছিল—হরমোনাল,আকর্ষণীয়,যা ফিওনার শরীর থেকে অল্প বিস্তর ছড়িয়ে পড়েছিল।সেই ঘ্রান,যা একসাথে তাকে টানছিল আর আবার দূরে সরিয়ে নিচ্ছিল।
এখন,তার বুকের ভেতর একটা অস্থিরতা অনুভূত হচ্ছিল। এক টুকরো কিছু—তার অন্তরের গভীরতা থেকে—কেউ ছিঁড়ে নিয়ে চলে গেছে। সে কী চেয়েছিল?কী বলেছিল?কেন এই শূন্যতা তাকে এতটা আঘাত করেছে?এক অজানা অনুভূতির মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছিল জ্যাসপার,যা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল।
জ্যাসপার এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে, তার মনের গভীরে গুমোট এক অনুভূতি ঘুরপাক খাচ্ছিল।সে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছিল,কিন্তু তারপরও এক অদৃশ্য চাপ তার বুকের ভেতর জমে উঠছিল।তার চোখ দুটি কিছু খুঁজছিল,তবে সে জানতো, সে যা খুঁজছে,তা সম্ভব নয়।
মনে মনে বিড়বিড় করল, “আমাকে ফিওনার কাছ থেকে দূরে থাকতেই হবে।” কথাগুলো নিজের ওপর এক কঠোর নিয়ম চাপানোর মতো,তবে তার প্রতিটি অক্ষরে ছিল এক অজানা দ্বন্দ্ব। “আমার ভেতরের লাভ হরমোন তৈরি হওয়ার উৎস একমাত্র এই মেয়ে। ওর থেকে দূরে থাকলেই সব আগের মতো হয়ে যাবে।” এ কথা বলার সময় তার চোখে এক অদ্ভুত তীব্রতা ছিল,সে নিজের অন্তর্দ্বন্দ্বকে চিরকাল চুপচাপ লুকিয়ে রাখতে চাচ্ছে।
আযদাহা সিজন ২ পর্ব ২২
জ্যাসপার মাথা তুলে,ধীরে ধীরে তার চারপাশে তাকালো,নিজের ভেতরের গহীনতাগুলিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। এই পৃথিবীতে তার আসার লক্ষ ছিল অতি বিশেষ—এথিরিয়ন আর একটি গোপন মিশন। প্রেম, ভালোবাসা—এগুলো তার জন্য ছিল একেবারে নিষিদ্ধ, এক অনিশ্চিত রাস্তা। “কোনো প্রেম ভালোবাসা না,” সে মনে মনে কথাগুলো আওড়ালো, নিজের সঙ্গেই সমঝোতা করতে চাইছে।
কিন্তু মনের গভীরে,তার শরীরের প্রতিটি কোণে কিছু একটা টের পাচ্ছিল।এক ধ্বংসাত্মক অস্থিরতা, যে অস্থিরতা সে বহু বছর ধরে চাপিয়ে রেখেছিল,এখন আর সইতে পারছিল না।