আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৫৩

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৫৩
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

কয়েকদিন থেকে ফোনের প্রতি ভীষণ এডিক্টেড পাখি।সারাক্ষনই ছোট বাচ্চাদের ফানি ভিডিও দেখে সময় কাটাচ্ছে।অবশ্য শান এতে তেমন বাড়ন করছে না।কারণ যতোক্ষন পাখি ফোনে থাকে ততোক্ষণ ঐ ঘটনাগুলো একটু হলেও ভুলতে পারে।ইউটিউবে ভিডিও দেখার এক পর্যায়ে একটা ভিডিওতে চোখ আটকে যায় ইউটেরাস ট্রান্সপ্লান্টের মাধ্যমে জন্ম নেয়া প্রথম শিশু।চোখ বড় বড় করে তাকায় পাখি।মনে মনে ভাবতে থাকে, “এ ও সম্ভব!”

এরপর পুরো ভিডিওটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখলেও ভালোভাবে বুঝতে পারে না পাখি।কিন্তু এতোটুকু তো ঠিকই বুঝেছে যে এ পদ্ধতিতে নিজের সন্তানকে নিজের পেটেই ধারণ করতে পারা যায়।গুগলে সার্স করে মোটামুটি একটা ধারনা পায়।লোভ সামলাতে পারে না সে।খুশিতে গদগদ হয়ে সন্ধ্যাবেলায় শানের আগমনের অপেক্ষা করে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আজ সুন্দর করে শাড়ি পড়েছে পাখি।লম্বা চুলের হাতখোপাটা ঘাড়ের উপর ঢিলে করে ঝুলছে।কানে ছোট ছোট দুটো দুল পরে চোখে মোটা করে কাজল দিয়ে নেয়।গেইটে শানের গাড়ির হর্ণে নিজেকে আরেকটি বার আয়নায় সেট করে নেয়।অপেক্ষা করে কাঙ্খিত মানুষটার।

শান ক্লান্ত শরীর টা নিয়ে হেলেদুলে চলে আসে উপরে নিজের ঘরে।দরজাটা ঠেলার আগেই খুলে যায় সেটা।বেশ অবাক হয় শান।ভিতরে পা রাখতেই নাকে ভেসে আসে চিরচিনা সেই লেডিস পারফিউমের কড়া সুগন্ধ।ঠোঁটের কোণে আপনাআপনি হাসি ফুটে ওঠে।চারপাশে তাকিয়েও পাখিকে পায় না।পাখি দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে মিটমিটিয়ে হাসছে।এরপর দরজার শিটকিনি লাগানোর শব্দে শান পিছন ফিরে তাকায়।থ হয়ে যায় পাখিকে এতোদিন পর এভাবে দেখে।যেন কতো বছর তাকে দেখছে।পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।নতুন করে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যায় পাখি।কাচুমাচু করে এগিয়ে আসে শানের দিকে।

শান নিঃশব্দ হেসে পাখিকে আরেকটু টেনে আনে নিজের কাছে।ডান কানের দুলটায় হালকা টোকা মেরে গাঢ় মোটাস্বরে বলে,”লুকিং গর্জিয়াস।দ্যা মোস্ট বিউটিফুল লেডি ইন দ্যা ওয়ার্লড”
শানের ঘোরলাগা কন্ঠের স্বর সারা শরীর কাঁপিয়ে তোলে।
পাখি মাথাটা একটু তুলে শানের দিকে তাকাতেই শান কপালে শব্দ করে লম্বা একটা চুমু এঁকে দেয়।
পাখি আজ নিজে থেকেই শানের শার্টের বোতাম খুলে দেয়,হাতের ঘড়ি খুলে রাখে,পকেট থেকে ওয়ালেটটা বের করে রাখে।

শান ভ্রু কুচকে পাখির দুই কাঁধে হাত রেখে বলে, “পরিবেশটা কেমন যেন ভিন্ন লাগছে না?”
“তুমিই তো বলো, আমি যেন আগের মতো হই। আর এখন এভাবে বলছো”,ঠোঁট উল্টিয়ে থমথমে মুখে জবাব দেয় পাখি।
“তা ঠিকাছে, কিন্তু কেন মনে হচ্ছে কিছু একটা খিচুড়ি পাকাচ্ছো ভিতরে ভিতরে”,চোখ ছোট ছোট করে সন্দিহান হয়ে প্রশ্ন করে শান।
পাখি ঝটকা মেরে কাঁধ থেকে হাত দুটো নামিয়ে দেয়।নেতিয়ে যাওয়া আঁচল টা কোমড়ে গুঁজে বলে, “এবার খুশি?”

অট্টোহাসিতে ফেটে পরে শান।মনে মনে ভাবতে থাকে,”এই পাখিটাকে বড্ডো মিস করছিলাম”
“হুমম এই যে ড্রেস, ঐ যে ওয়াশরুম যান গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসেন”,শানের ভাবনার মাঝেই কাবার্ড থেকে পাখি শানের ড্রেস বের করে এনে বিছানায় ছুড়ে দেয়।শান মিটমিটি হেসে পাখির দিকে তাকায়।এরপর কোন কথা ছাড়াই ওয়াশরুমে চলে যায়।

কিছুক্ষন পর মাথাটা মুছতে মুছতে বের হয়ে দেখতে পায় পাখি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খোপাটা খুলে চুল আচড়াচ্ছে।হাতের তোয়ালে টা বিছানায় ছুড়ে শান দ্রুত এগিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে চুলের ভাঁজে মুখ ডুবিয়ে দেয়।এমন অতোর্কিত আক্রমনে বেশ হকচকিয়ে ওঠে পাখি।মূহূর্তে পেটের উপর শক্ত করে চেপে রাখা শানের হাত দুটো ছাড়াতে ব্যস্ত হয়।
আয়না ভেদ করে শানের দিকে তাকায় পাখি।কিছুক্ষন পর শানও মাথা তুলে তাকায়।কাঁধে থুতনিটা রেখে বলে,”সরি”

পাখি মুক বাঁকিয়ে নেয়।শান বাঁকানো গালটা আলতো টেনে বলে,”এভাবেই চাই প্রতিটাদিন, প্রতিটা মূহূর্ত”
মুচকি হেসে মাথা নিচু করে পাখি।লজ্জামাখা মুখটা শানের কাছে আরো কিছু পাওয়ার জানান দিচ্ছে।
চোখ মুখ বন্ধ করে পাখির কাঁধে মাথা এলিয়ে চুপ করে থাকে শান।
“শুনো না, একটা কথা ছিলো”
“জানি…”,বন্ধ চোখে কাঁধে মাথা রেখেই বলে শান।
“জানতে মানে!”

“তোমার সাজ পোশাকেই বলে দেয় তুমি আজ নিশ্চই কোন অন্যায় আবদারের ডালি সাজিয়ে বসেছো”
থমকে যায় পাখির কথা।মুখ দিয়ে কোন শব্দই আর বের হয় না যেন।
“বলো”,শানের ঘোরলাগা কন্ঠে ধ্যান ভাঙ্গে পাখির।
“বলছি যে আমি মা হতে চাই”,মুখটা করূন করে বলে পাখি।
ঢিলে হয় শানের হাতের বাঁধন।ঠোঁট উঠিয়ে নেয় কাঁধের উপর থেকে।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সরে আসে শান।বিছানায় বসে গা এলিয়ে দেয় শটান হয়ে। পাখি তড়িঘড়ি করে পাশে এসে বসে।
“কি হলো, কিছু বলছো না যে!”

শান মাথার পিছনে দুই হাত দিয়ে পাখির দিকে দৃষ্টি রাখে। অনুভূতিহীন চাহনীতে বলে,”এটা তোমার কেমন আবদার জান।কিভাবে সম্ভব এটা?হ্যা উপায় আছে তুমি কি সেগুলোতে যেতে চাচ্ছো?”
পাখির মনে লাড্ডু ফুটে যায় মূহূর্তেই।কারণ সে এরকমই কিছু অপশনের অপেক্ষায় ছিলো।
নিজের খুশিকে দাবিয়ে রেখে বলে,”কি কি সেগুলো, বলো না একটু শুনি?”
“টেস্টটিউব আছে, সারোগেসি আছে,আরো নতুন অনেক পদ্ধতি চালু হয়েছে”

“টেস্টটিউব মোটামুটি জানা, সারোগেসি টাও জানি আর কি আছে সেটা বলো না প্লিজ”
শান কিছুক্ষন পাখির দিকে সরুচোখে তাকিয়ে কি যেন ভেবে বলে,”এডপ্টেশন”
পাখি কাঙ্খিত উত্তর না পেয়ে মুখটা মলিন করে অন্যদিকে নজর রাখে।
“আমি টেস্টটিউবে যাবো না, সারোগেসি তে অন্যের গর্ভে আমার সন্তান থাকবে আমি সেটাতেও যাবো না,আর এডপ্টেশনে মন ভরবে না আমার।আমি কি চাই জানো! আমি চাই আমাদের বেবি আমার গর্ভে বেড়ে উঠবে।ওর বেড়ে ওঠার প্রতিটা মূহূর্ত আমি উপভোগ করতে চাই গো “,শেষের কথাটা বেশ অসহায় হয়ে বলে পাখি।

শান চট করে উঠে বিছানায়।চোখে মুখে রাগের ছটা।
“তোমায় এই বাচ্চার ভুত মাথায় কে ঢোকালো বলো তো?”
“কেউ ঢুকায় নি।আমি তোমায় বাবা বানাতে চাই ব্যাস।সাথে আমিও মা হতে চাই,এতোটুকুই”
“আমি কি তোমায় একবারও বলেছি আমি বাবা হতে চাই?কি পাগলামি করছো আবারও তুমি “,রাগে হতাশায় বলে ওঠে শান।

স্বগতোক্তি করে বলে,”তুমি যেটা আমায় বোঝাতে চাইছো সেটা আমি আদৌ করতে দেবে না, আর না তোমার ডিসিশনে সায় দেবো।তাই এতো ভনিতা করো না।খাবার দাও, ক্ষিদে লাগছে”
শানের কথায় পাখি ছলছলে চোখে তাকিয়ে থাকে।মুখটা বিকৃত করে একটানে শাড়িটা খুলে ছুড়ে মারে কাবার্ডের কাছে।চুল গুলো টেনে তুলে উপরে বেঁধে রাখে।রাগে গজ গজ জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।শান বিছানায় বসে কপাল স্লাইড করতে করতে ভাবে,”এই ভাবনার উদয় হলো কি করে ওর মাথায়”

এরপর চট করে পাখির ফোন হাতে নেয়।গুগলে তখনও লেখাটা জ্বলজ্বল করে,”ইউটেরাস ট্রান্সপ্লান্ট”
শানের আর বুঝতে অসুবিধা হয় না পাখি ব্যপার টা নিয়ে গুগল করেছে।

সেদিন রাত থেকে একটিবারের জন্যেও পাখি কথা বলে নি শানের সাথে।তবে দৈনন্দিনকার সমস্ত কাজ করে দিচ্ছে। শান কয়েকবার এগিয়ে গেলেও লাভ হয় না।পাখি সিটকে সরে গেছে অন্যপাশে।
পাখি যে ইন্টারনাল জেদি মেয়ে এটা এতোদিনের শানের বুঝতে বাকি থাকে না।
সকালবেলা ঘর গুছাতে ব্যস্ত পাখি।শান আয়নায় নিজেকে সেট করে নিচ্ছে আর আড়চোখে পাখিকে দেখছে।এরমাঝে দৌঁড়ে ঘোরে ঢোকে ইনায়াহ্।
পাখিকে জড়িয়ে ধরে।পাখি কপালে চুমু দিয়ে কোলে তুলে নেয়।
“আজ আমায় স্কুলে রেখে আসো না মুন সাইন।কতোদিন ধরে তোমার সাথে যাইই না!”,অনুরোধের স্বরে বলে ইনায়াহ্।

পাখি কিছু বলতে যাবে তার আগেই শান বাঁধা দিয়ে বলে,”না মাম্মাম তোমার মুন সাইন তো এখনো অসুস্থ্য। একটু সুস্থ হোক তখন তোমায়…..”
“তুমি গিয়ে নাস্তা টা সেড়ে নাও মা, আমি রেডি নিচে নামছি কেমন!”,শানের দিকে না তাকিয়েই জবাব দেয় পাখি।
ইনায়াহ্ খুশি খুশি নিচে চলে যায়।

“এটা কি বললে তুমি?কোথাও যাওয়া হবে না তোমার”,পাখির হাত টেনে ধরে বলে শান।
শানের দিকে না তাকিয়েই পাখি হাতটা ছাড়ার জন্যে মুচরামুচরি করে।শান আলতো টানে পাখিকে কাছে নিয়ে আসে।অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে পাখি।
কপালের উপরে নেমে আসা অবাধ্য চুলগুলো সরিয়ে শান বলে,”আমার কোন বাচ্চা কাচ্চা কিচ্ছু চাই না।আমার তোমাকে চাই জাস্ট তোমাকে।”
তবুও পাখি কিছু বলে না।শান মুচকি হেসে বলে,”কেন এমন ছেলেমানুষি করছো জান।আমাদের ইনায়াহ্…… ”

“তুমি হাজার বার বললেও তুমি ইনায়াহ্’র বাবা হতে পারবে না।তুমি তো মামা।আমিও হাজার বার বললেও ইনায়াহ্’র মা হতে পারবো না। আখেরে আমি কিন্তু মামিই।আমাদের ইনায়াহ্ থাকুক। কোন সমস্যা নেই।কিন্তু আমার মা হওয়ার ইচ্ছেটা একটি বার ফিল করোতো?”
বলতে বলতে কেঁদে ফেলে পাখি।দুইহাতে শানের কলার চেপে বলে,”এই দাও না একবার মা হওয়ার সুযোগ।আমার এই পেটে আমি আমার সন্তানকে নিতে চাই। জাস্ট একটি বাচ্চা চাই আমার”
পাখির চোখ মুছিয়ে শান বলে,”তুমি যে ইউটেরাস ট্রান্সপ্লান্টের কথা বলছো এটার ব্যাড ইফেক্ট সম্পর্কে জেনেছো?তুমি জানো কতোটা ঝুঁকি এটা?”

“আমি জানি না, আমি হবো আর তোমাকে বাবা হওয়াবো এটা ছাড়া আর কিচ্ছু জানি না আমি, ব্যাস”,একরোখা জবাব দিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে পাখি।
শান কিছু একটা ভেবে বলে,”রেডি হও”
“কোথায় ”
“ডক্টরের কাছে ”
“সত্যি”,খুশিতে ঝলমলিয়ে ওঠে পাখির চোখমুখ।

ইনায়াহ্’কে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে শান পাখিকে নিয়ে চলে যায় পাপড়ির কাছে।পাখির খুশি চোখ মুখ উপচে পড়ছে যেন।শান সেদিকে বার বার তাকাচ্ছে আর ড্রাইভ করে চলছে।কিছুক্ষন পর গাড়ি এসে থামে গন্তব্যে।গাড়িটা পার্ক করে শান পাখির হাত ধরে মেডিকেলের ভিতরে চলে যায়।কল আসে ফোনে।ফোন কানে নিয়েই পাখির হাত ধরে সামনে এগিয়ে চলছে শান।

পাখি হাতের দিকে তাকিয়ে আনমনে বলে,”তুমি তোমারর কথা রেখেছো। বলেছিলে, আমার জীবনের শেষ নিঃশ্বাসের শেষ বিন্দু পর্যন্ত আমার পাশে থাকবে।আমার এতোবড় ক্ষতির পরেও একটিবার আমার দিকে নেতিবাচক দৃষ্টি রাখো নি।তাহলে আমারও তো কথা রাখার কথা তাই না।বলেছিলাম, নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও তোমাকে বাবা ডাক শোনাব।কথা রাখার সুযোগ যখন পেয়েছি তখন কেন বসে থাকব!
ভাবনার মাঝে কখন তারা পাপড়ির কেবিনের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে পাখি টেরও পায় নি।
মাথা উচিয়ে নেইমপ্লেট দেখে ভ্রু কুচকে পাখি বলে,”এখানে কেন?”
শান কিছু না বলেই টেনে নিয়ে যায় ভিতরে।

“আয়, আয় বস। তোর জন্যেই বসে আছি নয়ত একখানে যাওয়ার আছে আমার”,বলতে বলতে পাপড়ি চোখ রাখে পাখির পেটের দিকে।
অবাক হয়ে বলে,”কি ব্যপার এতো দিনে তো…… ”
শান পাংশুটে মুখে পাখিকে এনে বসায় এরপর মিসক্যারেজের কথাটা জানায়।তারপর ইউটেরাসের ব্যপারটাও জানায়।
পাখি শুধু মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় চেয়ে চেয়ে দেখে শানের দিকে।অবাক হয় পাখি, “শান সেদিন রাতের আসল কারণগুলো চেপে গেলো!”

“এখন এই মহাশয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে তিনি মা হবেন।তাও আবার কিভাবে জানিস, ট্রান্সপ্লান্টেশনের মাধ্যমে”,পাপড়ির দিকে তাকিয়ে বলে শান।
পাখির মিসক্যারেজে আহত পাপড়ি।তারপর এতোবড় একটা দূর্ঘটনা!
শানের কথায় ভাবনার সুতো ছেড়ে পাখির।একবার শানের দিকে তো আর আরেকবার পাপড়ির দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে নেয়।

শান পাপড়িকে চোখের ইশারায় কিছু বলে।পাপড়ি মাথা দুলিয়ে পাখির দিকে ফিরে বলে,”আচ্ছা ভালো কথা, তা তুমি কি জানো এতে কিন্তু ঝুঁকিও আছে?”
মাথা তুলে পাখি বলে,”সব কিছুরই তো ঝুঁকি আছে, ভালো দিকও আছে।আমি ওভাবেই বেবি নিতে চাই বাকিটা আল্লাহ্ ভরসা ”

“শোন আমি তোমায় কিছু জানাই”,বলেই পাপড়ি ল্যাপটপের স্ক্রিনে কতোগুলো জিনিস ওপেন করে।
“ইউটেরাস ট্রান্সপ্লান্ট মূলত জরায়ু প্রতিস্থাপন। অর্থাৎ কোন সুস্থ-সবল, রোগমুক্ত ইউটেরাস তোমার শরীরে স্থাপন করা হবে দীর্ঘ সময়ের জটিল একটা অস্ত্রপচারের মাধ্যমে।

আরো ভালো করে বুঝাই,প্রথমে হাজব্যান্ড ওয়াইফের ডিম্বানু ও শুক্রাণু একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে হিমায়িত রাখা হয় নিষিক্ত করণের জন্যে।তারপর একটি চল্লিশোর্ধ্ব কোন মহিলার সুস্থ, সবল একটি ইউটেরাস কঠিন জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি একটি অপারেশনের মাধ্যমে তোমার শরীরে সেই ইউটেরাস স্থাপন করানো হবে।এরপর ঐ নিষিক্ত ভ্রুনটি আবার ছয় থেকে সাত মাস পর তোমার প্রতিস্থাপিত নতুন ইউটেরাসে প্রবেশ করানো হবে।এরপর অপেক্ষা চলবে একটি বছরের।তারপর কপাল ভালো হলে একটি ফুটফিটে শিশু।আর তারপর ঐ প্রতিস্থাপিত নতুন ইউটেরাস টি আবারও জটিল একটি অপারেশনের মাধ্যমে তোমার শরীর থেকে বের করানো হবে।

এটা পুরোটাই চিকিৎসাবিদ্যার নতুন আবিষ্কার।তবে এক্ষেত্রে সফলতার পরিমানও বেশি।ঝুঁকিও কিন্তু সমানুপাতিক।প্রথমত দেখো, তোমাদের একটি সুস্থ, রোগমুক্ত ইউটেরাস প্রয়োজন তাও আবার হতে হবে চল্লিশ পেরিয়ে যাওয়া কোন মায়ের।মনে করো পেয়েও গেলে, কারণ ডোনার থাকে এসব কাজের জন্যে।তারপর যদি ঐ ইউটেরাস তোমার শরীর ধারণ করার ক্ষমতা না রাখে তখন?

ধরে নিলাম ওটাও হলো।তারপর নিবির পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে তোমায়।একটু এদিক সেদিক হলেই ভ্রুনটা নষ্ট হয়ে যাবে।তার সাথে তোমার আরো বড় ক্ষতির সম্ভাবনা থাকবে।ধরে নিলাম সেটাও পারলে, বাচ্চা পেটে বেড়ে উঠলো।জন্মও নিলো তারপর আরো একটা জটিল অপারেশন আছে সেটার মাধ্যমে ইউটেরাস বের করে আনা হবে।ক্যান ইউ ইমাজিন, কতোটা জটিল প্রক্রিয়া এটা?একটা ঝুঁকি সারাজীবনের জন্যে থেকেই যাবে।”

পাপড়ির কথাগুলো পাখি কতোটা বুঝলো বা মানলো শান বুঝতে পারলো না।চশমা টা খুলে মাথাটা দুদিকে চেপে পাখিকে উদ্দেশ্য করে বলে,”এসবের কোন দরকার নাই।খুব যদি মা হওয়ার স্বাধ জাগে তবে আমরা সারোগেসি বা টেস্টটিউব বা এডপ্টেশনের সহায়তা নিবো।আমি কোনমতেই ট্রান্সপ্লান্টেশনে যাবো না”
শানের রাগের কথায় শানের দিকে একটি বার করূন দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথা নিচু করে পাখি। দুই ফোটা জল টুপ করে পরে যায় গাল বেয়ে।যেটা শানের নজর এড়ায় না।তীরের মতো বিঁধে যায় বুকের বাঁ পাশে।পাখি আর একটি কথাও না বলে উঠে বাহিরে চলে যায়।

“ওর চাওয়া বড্ডো ছেলে মানুষি।ও তো জানে না এটা কতো জটিল একটা প্রক্রিয়া!”,নিজে নিজেই বলে শান।
পাপড়ি শানের হাতে হাত রেখে বলে,”এতে কিন্তু সফলতার পরিমানও বেশি।আমি বলি কি, তুই একবার ইউএসএ তে মেইল কর।ডোনার খুঁজুক তারা।একটা মেয়ের মা হওয়ার ইচ্ছে টা যে কতোটা সেটা অন্য কেউ বুঝতে পারে না রে।যে ভুক্তভোগী সেইই কেবল বোঝে।ও যখন চাইছে তখন একটা চেষ্টা করেই দেখ না ”
“কি বলছিস এসব?আমি কোন কিছুর বিনিময়ে ওকে হারাতে চাই না পাপড়ি।আমি জানি সে ওর কথা রাখতেই এতো বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে”

“কিসের কথা?”
“প্রেগন্যান্সিতে বলেছিলো, যেভাবই হোক আমাকে বাবা ডাক শোনাবে।সেই জিদ থেকেই ও এটা করতে চাইছে।আমায় খুব ভালোবাসে তো”
“আর তুইও তো কম না।জানিসই পাখি মা হতে পারবে না তবুও এতোটা ভালোবাসিস”
“কি আর বলি তোকে, ও যে আমার কাছে কি তা শুধু আমিই জানি”

সকালের নাস্তার টেবিলে বসেছে সবাই।আজ আবারও বাড়িটা গমগম করছে।পাখি থম মেরে বসে চামচ নাড়াচাড়া করছে।হঠাৎ সকাল বেলাতেই চলে আসে শর্মিলা ;রানুকে সাথে করে।সবার সাথে কুশল বিনিময় করে বসে পড়েন তিনিও। আগের মতোই মুখোরিত সবাই।আনন্দ নেই শুধু পাখির মনে।তবুও সবার সাথে যথেষ্ঠ হেসে হেসে কথা বলার চেষ্টা করছে।

“রনি কবে যাওয়ার ডিসিশন নিলি ?”,কাটা চামচে শসার টুকরোটা মুখে দিতে দিতে বলে শান।
সবাই খাওয়া রেখে শানের দিকে তাকায়।
খেতে খেতেই রনি জবাব দেয়,”এইত আগামি ৩ তারিখ ভাইয়া ”

“আজ তো ১ তারিখ। আর মাত্র দুইটা দিন মাঝে।ডেট পিছায়া দে।৪ বা ৫ তারিখ নির্দিষ্ট কর”
নির্বিকার চিত্তে সবাই তাকায় শানের দিকে।পাখি তখনো মাথা নিচু করে চামচ নাড়ছে।শান যে ওর পাশে বসেই এতো কথা বলছে এতে যেন ওর ভ্রুক্ষেপ নেই।
“কি বলছো ভাইয়া!পিছাব?কিন্তু কেন?”
“আমিও যাবো।তিনটা টেকেট এক্সট্রা কাটবি।”
“তাহলে সেদিনই যাই প্রবলেম কই ভাই?”
“দুইটা দিন পর গেলে তোর কি খুব সমস্যা?”

“সেরকম টা না ভাইয়া, কবে জানি আমার শ্বাশুরি মত পাল্টায় যে মেয়েকে নিয়ে যেতে দিবে না।তাই আর…..”,বলতে বলতে রাখির দিকে তাকায় রনি।
কটমটে দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রাখি।
শান সেদিকে চেয়ে বলে,”এককালিন তো যাচ্ছিস না।এককালিন এখানে আসবি বলেই যাচ্ছিস।তো রাখির মায়ের প্রবলেম হওয়ার কথা নয়।আর আমার হাতে একটা কাজ আছে বর্তমানে। ওটা শেষ হবে ৪ বা ৫ তারিখের দিকে।”

এতোক্ষনে মাথা তুলে তাকায় পাখি। হার্টের বিট বেড়ে গেছে।হাস্যোজ্বল মুখে শানের দিকে তাকায়।শান আড়চোখে একবার দেখে টিস্যুতে মুখটা মুছে বলে,”আমি, পাখি আর ইনায়াহ্’র জন্যে।”
“বলিস কি?মেয়েটা তো সবে মাত্র সুস্থ হলো?আর ক’টা দিন পর যা ”
“না আম্মা,ওর একটু পরিবেশ চেঞ্জ করাতে হবে।একটু রিফ্রেশমেন্টের দরকার “,দাঁড়িয়ে পাখির দিকে তীর্যকদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে শান।

পাখির আর বোঝার বাকি নেই শান কেন আমেরিকা যেতে চাচ্ছে।খুশিতে এখনি তার যেন নাচতে মন চাচ্ছে।
শান চলে যাওয়ার পথেই চেয়ে আছে পাখি।নতুন করে বার বার বাঁচতে ইচ্ছে করে তার এই মানুষটার জন্যে।বার বার প্রেমে পরে যায় পাখি তার এই ডাক্তার সাহেবের প্রতি।

“আমায় মৃত্যু দাও, তবু এতো শাস্তি দিও না।তোমাদের দুইটা পায়ে পরি আমার মরন দাও।এই দেখো ঘা পঁচে গেছে আমার”,বলতে বলতেই হুহুস্বরে কেঁদে ওঠে রায়ান।গত দুই মাসে হাজারও বার নিজের মৃত্যু কামনা করেছে রায়ান।মারের চোটে, কষ্টের চোটে প্রান ওষ্ঠাগত হয়;কিন্তু রুহ্ টা বের হয় না।

বিছানার সাথে বাঁধা পড়ে আছে মরার মতো।পাশে দাঁড়ানো দানবীয় শরীরের অধিকারী লোকদুটোকে বার বার বলেছে তার মৃত্যু দিতে কিন্তু তারা বসের হুকুম ছাড়া রায়ানের ধারের কাছেও যেতে পারে না।বস প্রতিদিন একটা নির্দষ্ট সময় দেন, ঐ সময়ের মাঝে রায়ানের শরীর মারে ক্ষত বিক্ষত করা হয়।কখনো কখনো রায়ানের চোখ মুখ বেঁধে শয্যাশায়ী রায়ানকে এলোপাথাড়ি মেরে চলেন বস নিজেই।

“হেই গেট আপ, বস ইস কামিং”
দুজনের একজন চাপাস্বরে ধমক দেয় রায়ানকে।বন্ধ চোখ দুটো পিটপিট করে খোলে রায়ান।ধরে ধরে তোলা হয় রায়ানকে।গা দিয়ে ঘায়ের পঁচা গন্ধে নাক মুখ কুচকে নেয় উপস্থিত সবাই।ভনভনে মাছির আনাগোনা বেড়েছে পঁচনে।

দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকে তাদের বস।দুজনের একজন খুব দ্রুত হাতে রুম ফ্রেশনার দিয়ে পুরো ঘরে সুগন্ধি ছড়িয়ে দেয়। যাতে তাদের বসের কোন অসুবিধা না হয়।
আগত বস সমন্ধীয় লোকটা তবুও নাকে রুমাল চেপে ঘরে ঢোকে।চাপানো রুমালের আড়ালেও মানুষটাকে চিনতে অসুবিধা হয় না রায়ানের।গলার স্বর ভেঙ্গে গেছে।গেই স্বরেই ক্ষীন চিৎকার করতে করতে পিছাতে থাকে।বিছানায় চাদর নেই।চাটাই বিছানো শুধু। একটু নড়াচাড়া করলেই ঘায়ের সাথে লেগে কলিজা ছিড়ে যাবার উপক্রম হয় রায়ানের।

মুখ থেকে রুমাল সরিয়ে নেয় লোকটা।হাতে গ্লোবস পড়ে পায়ের শিকল ধরে একটা হেঁচকা টানে রায়ানকে নিয়ে আসে নিজের সামনে।এ ব্যথা যেন মৃত্যু বেদনাকে হার মানিয়ে দিচ্ছে।ঘায়ের ছালবাকল সব উঠে গেলো চাটাইয়ের সাথে লেগে।প্রাণপনে চিৎকার করছে রায়ান।আর আগত লোকটার পৈশাচিক হাসিতে মেতে উঠছে পুরো ঘর।

কাঁদতে কাঁদতে ঘা জমেছে রায়ানের চোখের কোণে।জীর্ণশীর্ণ রায়ান ভয়ার্ত চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে পাগলের মতো বলে,”মেরে ফেলো, মেরে ফেলো আমায়।আমায় মেরে মাও একবারেই”
এরপর করূন সুরে কান্নার রেশ তুলে বলে,”আমি ভুল করেছি, আমায় মৃত্যু দাও। এ কষ্টের থেকে একেবারেই মৃত্যু দাও আমার”

“হা হা হা…মৃত্যু? তোর?এতো সহজ!বলেছিলাম না প্রতি মূহূর্ত মৃত্যু কামনা করাব কিন্তু মরবি না।”,বলেই আবারো ঘর কাঁপিয়ে হেসে ওঠে লোকটা।
আর কান্না করতে করতে দম ভারী হয়ে আসে রায়ানের।
ভ্রু কুচকে লোকটা এক পা তুলে দেয় একটু আগে মারে ক্ষতবিক্ষত হওয়া রায়ানের পায়ের পাতার উপর।ব্যথার চোটে চোখ মুখ লাল হয়ে আসে রায়ানের।
একটা পৈশাচিক হাসি দিয়ে লোকটা বলে,”মরবি?মরতে চাস?”
রায়ান একবাক্য হ্যা বলে দেয়।

লোকটা পা দিয়ে পাতা টা পিষে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদুটোকে বলে, “এটাকে নীলাদ্রি লেকের পাশে কোথাও ছুড়ে ফেলো। দাঁড়িয়ে থেকে দেখবে যদি এক ঘন্টার মাঝে না মরে তবে এমন মৃত্যু দেবে যেন পৃথিবীতে আর কোন রায়ানের জন্ম না হয়।”
বলেই লোকটা পিছন ফিরে চলে যায়।
“না না না,এমন করো না। দয়া করো আমায়। আমায় মৃত্যু ভিক্ষা দাও এখানেই “,অনুনয় করছে রায়ান।
কিন্তু লোকটা পিছনে ফিরে তাকায় না।
পকেট হাতরিয়ে অবশিষ্ট একটা সিগারেট ঠোঁটে ধরিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে চলে যায়।

আজ ৪ তারিখ।আগামিকাল শানদের ইউএসএ যাওয়ার ডেট।
“ভাইয়া এই যে তোদের টিকেট।আগামিকাল সকালেই ফ্লাইট।রেডি হয়ে নে তাড়াতাড়ি”,হন্তদন্ত হয়ে টিকেট টা ধরিয়ে রনি বেড়িয়ে যায়।
শান তখন কাপড় ভাঁজ করতে পাখিকে সাহায্য করছে।আর দুষ্টু মিষ্টি খুঁনসুটিতে মাতিয়ে রাখছে পাখিকে।
“কে কোথায় আছো দেখে যাও”

নিচ থেকে রাহেলার চিৎকারে সবাই যে যার ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে।পাখি হন্তদন্ত হয়ে বের হতেই শান হাত আটকে বরে,”এতো তাড়াহুড়োর কিছু নেই।সাবধানে জান”
পাখি আতঙ্কিত চোখে মুখে নিচে নেমে আসে।দেখতে পায় বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে টিভির স্ক্রিনের দিকে।

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৫২

নিউজ পড়ছে সংবাদ পাঠিকা,”আনুমানিক ২ মাস আগে গুম হওয়া সিলেট মৌলভীবাজারের স্বনামধন্য ব্যবসায়ী আজাদ মাহমুদের ছোট ছেলে রায়ান মাহমুদের অর্ধ্বগলিত লাশ উদ্ধার।লাশ দেখতে লাখো মানুষের ঢল। তদন্ত চলছে পুলিশ বাহিনীর”

গায়ের প্রতিটা লোম জানান দিয়ে দাঁড়িয়েছে সবার।লাশের ঝাপসা ছবিটা স্ক্রীনে ভাসতেই পাখি মুখ ঘুরিয়ে নেয়।বুঝতে পারে শান পাশে দাঁড়ানো।একহাত শান পাখিকে আগলে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলে।
“কেমন লাগছে তোমার?”
“এতো নৃশংস ভাবে কে মারলো?”,চোখভরা জল নিয়ে প্রশ্ন পাখির।
“তোমার সাথে তো এর থেকে নৃসংস হয়েছে জান।এবার বলো মনে শান্তি ফিরেছে?নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে করছে তো?”

পাখি হুহুস্বরে কেঁদে ওঠে সেই রাতটার কথা মনে করে।পা উচিয়ে শানের গলা জড়িয়ে কেঁদে ওঠে শব্দ করে।অস্পষ্ট স্বরে বলে,”আমি ভীষন খুশি আজ”
উপস্থিত সবাই অবাক যেন।শান পাখিকে সাবধানে নিজের ঘরে নিয়ে যায়।

আসক্তি সিজন ২ শেষ পর্ব