আসক্তি সিজন ২ শেষ পর্ব

আসক্তি সিজন ২ শেষ পর্ব
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

দীর্ঘ সময়ের প্লেন জার্নির পর সবাই এসে পৌঁছায় সাভানাহ,জর্জিয়া।জানা যায় আমেরিকার অন্যতম সুন্দরতম শহরগুলোর মাঝে এটি একটি।নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষের আনাগোনা চারদিকে।যে পরিবেশের সাথে দেশের পরিবেশের কোনই মিল নেই।প্রথমত শান পাখি সহ রনিদের বাসায় ওঠে।সেখানে সৌজন্যতার খাতিরে কিছুদিন অবস্থান করতে হয় তাদের।এরপর রনির সহযোগীতায় আলাদা বাসার খোঁজ করে শান; পেয়েও যায়।

নতুন বাড়িতে চলে আসে ইনায়াহ্ সহ। বেশ ছিমছাম পরিপাটি একটা বাড়ি।কোথাও কোন ময়লার স্তুপ নেই, না আছে খুব বেশী মানুষের ভীড়।বলতেই হয় এ স্থানীয় মানুষ বেশ পরিচ্ছন্ন।এক কথায় একদম মনোরোম যাকে বলে।ইনায়াহ্ বেশ খুশি।ট্রান্সপ্লান্ট মেডিকেলের পাশেই হওয়ায় এই বাড়িটাকে বেছে নেয় শান।তিন রুমের মাঝারি একটা বাড়ি।পাশেই রান্নাঘর, মাঝে ড্রয়িংরুম।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আগে থেকেই ডোনারের খোঁজ করতে অনুরোধ করেছিলো শান।রনিকে সাথে করে ছুটে যায় মেডিকেলে।৫০+ একজন ভদ্র মহিলার সাথে সাক্ষাত করান বিভাগীয় প্রধান।তার সাথে বিভিন্ন ব্যপারে কুশলাদির এক পর্যায়ে শান জানতে পারে তিনি সদিচ্ছায় ইউটেরাস ডোনেট করতে প্রস্তুত।তার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড সাথে বড় কোন রোগ আছে কিনা, রক্তের গ্রুপ সবকিছু একে একে জেনে নেয় শান।সাথে থাকে বিভাগীয় আরো একজন ডাক্তার।

কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর সিদ্ধান্তে উপনীত হয় এই ভদ্র মহিলার থেকেই সাহায্য নিতে হবে।ভাবনা অনুযায়ী কাজ।পাখিকে নিয়ে আসা হয় ইনায়াহ্ সহ।সেখানে পৌঁছে ভয়ে গলা যেন শুকিয়ে আসে পাখির।
“ভয় করছে?”, পাখির হাতে হাত রেখে বলে শান।
পাখি কিছু না বলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে।শান আবারও বলে,” এসবের দরকার নাই জান।চলো আমরা বাড়ি ফিরে যাই ;কয়দিন ঘুরে।আমার এসবে একদমই ইচ্ছে নেই।শুধু তোমার জন্যেই….”

“ইনায়াহ্’কে স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করো”, সোজা সামনে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলে পাখি।
শান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অপেক্ষা করে ভিতরের ডাকের।কিছুক্ষন পর ডাক পরে।
দুজনেই ভিতরে ঢোকে।ট্রান্সপ্লান্টের প্রাথমিক কাজ সম্পাদন করা হয়।
কিছুদিন পর শান আবারও মেডিকেলে চলে যায় পাখিকে নিয়ে।আজই চূড়ান্তভাবে ট্রান্সপ্লান্ট কার্যক্রম সম্পাদন করার দিন।অটির সামনে দাঁড়িয়ে পাখির গা কাঁপছে ভীষণ বাজে রকম ভাবে।শক্ত করে চেপে রেখেছে শানের হাত।দূর থেকে রনির চোখে পড়ে সবটা।একমাত্র রনি ছাড়া পরিবারের কেউই জানে না এখানে আসার কারণ।

একসময় ভয়ের চোটে কখন যেন শানের হাতে খামচি দিয়ে নখের আঁচড় বসিয়ে দেয়, পাখি তা নিজেও টের পায় না।শান পাখিকে কপোট রাগ করে বলে,” এতো ভয় কেন পাচ্ছো? খুব তো সাহস করে এলে?কোথায় গেলো সে সাহস? ”
কাঁদো কাঁদো মুখে পাখি শানের দিকে তাকায়।মাথাটা বুকের সাথে চেপে শান বলে,”চলো বাড়ি যাই।এতো ভয় পেতে হবে না তাহলে”

“না আমি যাবো না।এর শেষ দেখে তবেই বাড়ি ফিরব”, বুক থেকে চট করে মাথা তুলে বলে পাখি।
সময় আসে কাঙ্খিত সেই অস্ত্রোপচারের। পাখি শানকে ভিতরে আসার জন্যে অনুনয় করে। ডাক্তার হওয়ার সুবাধে বিভাগীয় ডাক্তারের অনুমতিতে অটি রুমে প্রবেশের সুযোগ পায় শান।সে কি পাখিকে সামলাবে,তার নিজেরই কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে।তবুও পাখির কথা ভেবে ভিতরে ঢোকে। বাহিরে রনি ইনায়াহ্’কে কোলে করে বসে থাকে।

এক ঘন্টা, দুই ঘন্টা, তিন ঘন্টা এভাবেই চলে যায় দীর্ঘ নয়টা ঘন্টা। উত্তেজনার শেষ থাকে না বাহিরে অপেক্ষারত রনির।ভয়ে কলিজা বার বার শুকিয়ে আসে শানের।তবুও একের পর এক সাহস যুগিয়ে যায় পাখিকে।

অটির লাইট বন্ধ হয়ে যায়।বেড়িয়ে আসে ডাক্তাররা।শান বেড়িয়ে আসে পাখিকে সাথে নিয়ে।নতুন ইউটেরাস প্রতিস্থাপন সফলভাবে সম্পন্ন হয়ে যায়।কেবিনে সিফট করা হয় পাখিকে।এরপর একদম বেড রেস্টে থাকতে বলা হয় ।ইনায়াহ্’কে স্কুলে ভর্তি করানো হয়। কারণ গর্ভধারনের এ প্রক্রিয়া দীর্ঘসময়ের।
কেটে যায় পুরো আটটি মাস। এরই মাঝে শরীরের সাথে এটাচ হয় নতুন এ অঙ্গটি।এবার অপেক্ষা সেই আকাঙ্খিত মূহূর্তের।দেখতে দেখতে সেই সময়টিও চলে আসে।

বেশ সফলতার সাথে প্রবেশ করানো হয় নিষিক্ত সেই ভ্রুন।একটা নতুন অভিজ্ঞতা, মা মা একটা অনুভূতি চলে আসে পাখির মাঝে।প্রথম সন্তান ধারনের সময়কার স্মৃতিগুলো ভেসে ওঠে মানসপটে।এ যেন অন্যরকম এক সুখানুভূতি।অথচ পাখি জানে সবে মাত্র প্রক্রিয়া শুরু।

কেটে যায় ২ টি মাস।দেখতে দেখতে মিস হয়ে যায় দুইটা মাসের পিরিয়ড। পরিক্ষার পর জানা যায় ৯ সপ্তাহের আঙ্গুরের ন্যায় একটি শরীর বিরাজমান সেখানে।এ খুশি কোথাও রাখার মতো ভাষা নেই।মেডিকেলেই কেঁদে ফেলে পাখি।এ কান্নার গভীরত্বই বুঝিয়ে দেয় একজন নারীর কাছে মাতৃত্ব কতোখানি সুমিষ্ট, কতোখানি আকাঙ্খিত।শান নিজেকে কোনমতে সামলিয়ে বুকে জড়িয়ে নেয় পাখিকে।সে কিভাবে এ খুশি উপভোগ করবে তা জানা নেই।

খুব সাবধানতার সহিত বাড়িতে নিয়ে আসে পাখিকে।বসিয়ে দিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফায়।ইনায়াহ্ বাড়িতে নেই ;স্কুলে।
পাখির কোলে মাথাটা দিয়ে ছোট বাচ্চাদের মতো কেঁদে ওঠে শান।নিজেকে আর কোনমতেই সংবরন করা সম্ভব না তার।প্রথমের থেকেও এবারের খুশিটা যেন যুদ্ধ জয়ের মতো।পাখির পেটে অজস্র চুমু এঁকে দেয়।এরপর কপালে কপাল ঠিকেয়ে কেঁদে ফেলে দুজনেই।খুশির কান্নায় ছেঁয়ে যায় পুরো বাড়ি।তারা কেউই ভাবতে পারে নি নতুন করে বাবা মা হওয়ার মতো দূর্লভ সংবাদ তারা কখনো পাবে।
এমন সময় ইনায়াহ্ বাড়ি চলে আসে।

“তোমরা কাঁদছো কেন মুন সাইন?”, ঠোঁট উল্টিয়ে বলে ইনায়াহ্।
পাখি নাক টেনে মাথা তুলে দুই হাত বাড়িয়ে দেয় ইনায়াহ্’র দিকে।ইনায়াহ্ দৌঁড়ে চলে যায় পাখির কাছে।ইনায়াহ্’কে জড়িয়ে ধরে বুকে আলাদা এক প্রশান্তির বাতাস বয়ে যায় যেন।কপালে চুমু দিয়ে পাখি বলে,” তোমার একটা বোনু আসবে আবারও”

মুখটা ভার হয়ে যায় ইনায়াহ্’র।শান পাখি একে অপরের দিকে গভীর চাহনীতে চেয়ে ইনায়াহ্’র মনোভাব বোঝার চেষ্টা করে।শান ইনায়াহ্’কে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে, “তুমি খুশি হও নি মাম্মাম?”
“সে বার তো বোনু আসলো বলেই মুন সাইন অসুস্থ হয়ে পরলো।আমার খুব কষ্ট হয়েছিলো তখন।আল্লাহ্’র কাছে খুব প্রে করেছি যেন মুন সাইনকে সুস্থ করে দেয়।আবারও বোনু আসলো আবারও যদি……”, ঠোঁট উল্টিয়ে বলে ইনায়াহ্।

শান মুচকি হেসে ইনায়াহ্’র গালে চুমু দিয়ে বলে,” ইন শা আল্লাহ্ এবার কিচ্ছু হবে না তোমার মুন সাইনের।সবটাই ভালোভাবে হবে”
বলতে বলতেই পাখির দিকে তাকায় শান।
ইনায়াহ্ খুশি হয়ে গলা জড়িয়ে ধরে দুজনের।উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে,”আমরা আবারও চারজন হবো ইয়েএএ”
দেশে সকলকে খবরটা জানায় শান।কারো মাঝেই যেন খুশির অন্ত নেই আজ।নতুন করে বাবা মা হতে চলেছে শান পাখি।

এরপর শুরু হয় সেই বাচ্চাকে বাঁচনোর আরেকটা যুদ্ধ।শান এখানকারই একজন মহিলাকে রেখে দেয় পাখির সার্বক্ষণিক সেবার জন্যে।পাখির ঘরের মধ্যেই সবটার ব্যবস্থা করে দেয় শান।দিনের প্রায় বেশীরভাগ সময় পাখির কাছে থাকে।এখানে বসেই দেশের সমস্ত কাজ কর্মের হিসাব রাখে শান।তবে কাজ টা বর্তমানে অপশনাল হিসেবে রেখে দেয়।কারণ গতবার তারই গাফিলতির ফল ভোগ করতে হয়েছে পাখিকে।যেটার জন্যে আদৌ নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না সে।

পাখির হাঁটাচলা,খাওয়াদাওয়া সবকিছুর হিসেব যেন শানের নখ দর্পনে।
গর্ভের সন্তানের বয়স এখন ৪ মাস।
একটি জোৎস্নাত রাত। ইনায়াহ্ ঘুমিয়েছে অনেকক্ষন হলো।ঘুম নেই পাখির চোখে।সেই রাতের ভয়ানক দৃশ্য গুলো ভেসে উঠছে চোখের সামনে।কোমড়ে জড়িয়ে রাখা শানের হাতটা সন্তোর্পনে সরিয়ে উঠে যায় জানলা ভেদ করে ঘরে ঢোকা জোসনার আলোর কাছে।বেলকোনির রেলিং এ হাত রেখে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে ভাবছে পাখি,”জীবনটা এতোটাও নাটকীয় না হলে কি চলত না?আমি জানি ডাক্তার সাহেব কখনোই আমায় কিছু বলবে না তবুও নিজের ভিতরের একটা প্রশান্তির প্রয়োজন।বার বার নিজেকে ধর্ষিতা মনে হয় কেন?কেন ঐ রাত টাই ভুলতে পারছি না?আমার এতো এতো সুখ কি ঐ রাতকেই ভোলাতে পারছে না”

“জীবনকে কোনকিছুতেই থামাতে নেই।সকল বাঁধা, প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছানোই জয়ীর কাজ”, বলতে বলতে পাখির পিছনে এসে দাঁড়ায় শান।
শানের কন্ঠে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় পাখি।
শান এসে আলতো হাতে জড়িয়ে বলে,” আমি সারাজীবন তোমার কাছে নত হয়ে থাকব শুধুমাত্র আমার সেইদিনের ভুলের জন্যে।তবু নিজেকে এভাবে কষ্ট দিও না”
পাখি কোন কথা বলতে পারে না।নীরবে কয়েকফোটা অশ্রু বিসর্জন দেয়।শান নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয় পাখিকে।চোখের পানি মুছে বলে,”এরপর থেকে যা যা হবে সবটাই ভালো হবে।আমরা ভালোভাবে বাঁচব জান”

চলে যায় আরো একটি মাস।বাড়তে থাকে পাখির পেটের পরিধি।যেটা যে কারোরই নজরে পরার মতো।ঢিলেঢালা পোশাকের নির্দেশ দেয় শান।বাড়তে থাকা পেটে হাত বুলিয়ে অজানা ভালো লাগায় মন ভরিয়ে তোলে পাখির।ইনায়াহ্ এসে জড়িয়ে ধরে আলতো করে।তার খুশির যেন অন্ত নেই।এসবের মাঝেই চলে আসে ইনায়াহ্’র জন্ম তারিখ।যেটার কথা বেমালুম ভুলে যায় শান।

“শুনছো?”
“হুমম বলো, কিছু লাগবে?”, ল্যাপটপ থেকে মাথা উঠিয়ে বলে শান।
” ভুলে গেছো ইনায়াহ্’র জন্মদিন আগামি পরশু।কিছু করবে না?”
শান চট করে ল্যাপটপের পার্ট নামিয়ে অবাক বিষ্ময়ে পাখির দিকে তাকায়।
“এতোকিছুর মাঝে তো ভুলেই গেছিলাম এটা”, চোখে মুখে অপরাধবোধ ফুটে ওঠে শানের।
পাখি এগিয়ে এসে বলে,” প্রতিবছরই তো বড় করেই আয়োজন করো, এবারও করো না।আর এখানে তো নতুন নতুন অনেক ফ্রেন্ডস হয়েছে ওর”

পাখির কথাকে অগ্রাহ্য করার অবকাশ পায় না শান।
এখানেও খুব জাঁকজমক ভাবে জন্মদিন পালনের আয়োজন করে ।রনিদের পরিবারের সবাই উপস্থিত হয়।সাথে উপস্থিত হয় ইনায়াহ্’র নতুন নতুন বন্ধুরা আর তাদের ফ্যামিলি।গত দিনগুলোতে আশপাশের সবার সাথেই বেশ সখ্যতা গড়েছে শানের।সবাইকে আমন্ত্রন করা হয় সেদিন।

কেটে যায় আরো পাঁচটি মাস।দিন ধার্য করা হয় অপারেশনের। বুকের মাঝে ধুকপুকানি বেড়ে গেছে পাখির।বাড়তে থাকা শিশুর একেকটা মূহূর্ত যেন হৃদয় দিয়ে শুষে নিয়েছে পাখি। তবুও ভয়ে আজ গলা শুকিয়ে আসছে।অটিতে ঢোকানো হয় পাখিকে।আজও তার শানকেই লাগবে।উপায়ন্তর না পেয়ে শান ঢুকে পরে অটিতে।মাথার কাছে একটা টুলে বসে সাহস যুগিয়ে যাচ্ছে পাখির।বাহিরে অপেক্ষা করছো কয়েক জোড়া উৎসুক চোখ।

কিছুক্ষন পর ভেসে আসে সদ্য জন্মানো নবজাতক কান্নার সুর।একজন নার্স খুব সাবধানতার সাথে শানের হাতে দেয় বাচ্চাকে।কাঁপা কাঁপা হাতে হাত বাড়াতে গিয়ে থেমে যায় শান।কেমন যেন জটিল অনুভূতি কাজ করছে মনের মাঝে।উপস্থিত সকলে মৃদ্যু হেসে পাখিকে কেবিনে সিফট করে।এদিকে নিজের সন্তানকে দু হাতের তালুতে নিয়ে অঝোরে কেঁদে ফেলে শান।তার নিজের একটা ফুটফুটে ছেলে সন্তান এলো পৃথিবীতে।এ খুশি কোথায় রাখবে সে।

পাখি দূর্বল দৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে চোখের পাতা বুজে ফেলে।কোণা বেয়ে গড়িয়ে পরে প্রশান্তির অশ্রু।বন্ধ চোখে মনে মনে বলে,”এবার যদি আমার মৃত্যুও হয় তবুও আমি একরাশ পূর্ণতা নিয়ে চলে যেতে পারব।তুমি বাবা হয়েছো।এর থেকে বড় পূর্ণতা আর কি হতে পারে!”
পাখির চোখ খুলে যায় কারো ঠোঁঠের উষ্ণ স্পর্শে।এ স্পর্শ যে বড্ডো চেনা, বড্ডো আপন।
চোখ খুলে নেয়।কোলের শিশুকে দেখিয়ে শান জড়িয়ে আসা কন্ঠে বলে,” তোতোমার, আআমার!আআমাদের ছেলে”

কেঁদে ফেলে পাখি।বুকে জড়িয়ে নেয় নিজের নাড়িছেঁড়া ধনকে।কান্না করার মতো শক্তি শরীরে নেই তবুও আজ সে কাঁদছে। ভীষণ মন দিয়ে কাঁদছে।সদ্য জন্মানো শিশুটা টুকটুক করে চেয়ে আছে কান্নারত তার মায়ের দিকে।গালে, চোখে, মুখে, ঠোঁটে অগনিত চুমুতে ভরিয়ে দেয় পাখি।বুকের সাথে ঠেকিয়ে রাখে নিজের সন্তানকে।

এরপর একে একে সবাই এসে দেখে যায়।ভিডিও কলে সবাইকেই নিজের সন্তান দেখায় শান।ছেলের উচ্ছাসে শর্মিলা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে নেয়।
“আম্মা আমি বাবা হয়েছি, আম্মা।দেখো আমার ছেলে”
বলতেই আর কথা বের হয় না শানের গলা দিয়ে।কান্নয় বুক ভেসে যায় যেন।
ইনায়াহ্ এসে দেখেছে। কিন্তু মন ভালো নেই তার।শান ইনায়াহ্’কে কোলে বসিয়ে মন খারাপের কারণ জিজ্ঞেসা করে।

গমগমে স্বরে ইনায়াহ্ বলে,”তোমরা তো বলেছিলে বোনু হবে ভাই হলো কেন?”
“আল্লাহ্ খুশি হয়ে যা দেয় তাই নিতে হয় মা।আর আমাদের তুমি তো আছোই এখন তোমার একটা ভাই হলো।বোনু হলে তোমার জামা কাপড়, খেলনা সব কিছুতে সে ভাগ বসাতো। সেটা ভালো লাগত তোমার?বলো?”,
মাথা দুদিকে নাড়িয়ে ইনায়াহ্ বলে, ” না”
“ভাই হয়েছে মানে, ও তোমার কোন কিছুতে ভাগ বসাবে না।এবার হ্যাপি?”
“অনননেক”, শানের গলা জড়িয়ে বলে ইনায়াহ্।

কেটে যায় দীর্ঘ ছয়টা মাস।এরই মাঝে আবারও অপারেশনের মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত নতুন ইউটেরাসটি বের করে আনা হয়। পাখি নাকোচ করলেও শান কোন কথা শোনে নি। কারণ এর ফলে সারজীবন ঔষধ খেয়েই সুস্থ থাকতে হতো পাখিকে।

” কি করছো কি, ছাড়ো”,চাপা রাগ দেখিয়ে বলে পাখি।
কিন্তু শান কিছুতেই ছাড়ে না।পিছন থেকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
“তোমার মেয়ে কতো বড় হয়ে গেছে, ছেলের বয়স ছয় মাস চলছে আর তোমার দুষ্টুমি গেলো না।এখনো বাচ্চাদের মতো করো”, এটা সেটা বলেও শানকে ছাড়াতে পারে না পাখি।
কাঁধে মুখ রেখে বলে,” তোমার প্রতি এ দুষ্টুমি আমার বুড়া বয়সেও থেকে যাবে।”

“উফফফ!আম্মু তোমার ছেলেকে আমি সামলাতে পারব না।এতো ভারী আর দুষ্টু!”, বলতে বলতে ইছাদ(ইছাদ নামের অর্থ;সুখীকরন) কে নিয়ে ঘরে ঢোকে ইনায়াহ্।
চট করে পাখিকে ছেড়ে দেয় শান।নিজেকে ঠিকঠাক করে ইনায়াহ্’র দিকে এগিয়ে যায় পাখি।
ইনায়াহ্’র কথায় হেসে ফেলে।

ইছাদকে কোলে নিতে নিতে বলে,” আপু কে বিরক্ত করেছো বুঝি!হুমম”
সদ্য জন্মানো দাঁত দুটো বের করে ফোকলা হেসে ওঠে ইছাদ।বেশ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী সে।ইনায়াহ্ বেশিক্ষন কোলে নিয়ে থাকতেই পারে না।হাফিয়ে ওঠে।ছেড়ে দেয় মেঝেতে।আর হামাগুড়ি দিয়ে পুরো বাড়ি ঘুরে বেড়ায় ইছাদ।দুষ্টুও হয়েছে প্রচুর।

“তোমার ছেলে তোমার মতো হয়েছে বুঝেছো?না জানি ছোটকালে কতো দুষ্টু ছিলে তুমি।সেই গুন পাইছে এ “,শানকে উদ্দেশ্য করে বলে পাখি।
শান প্রশান্তির হাসি ঠোঁটে এলিয়ে বলে,” হ্যা ভালো গুন গুলো তোমার থেকে পাইছে আর খারাপ গুলো আমার থেকে তাই না?”
“তাই তো”,মুচকি হেসে দাম্ভিকতার স্বরে বলে পাখি
ইছাদকে ঘিরেই সবার যতো আয়োজন।বদলে গেছে অনেক কিছুই। বদলেছে ইনায়াহ্ও । মুখাবয়ব, শারিরীক গঠন পাল্টে গেছে।লম্বা হয়েছে বেশ খানিকটা।এখন মুন সাইন ডাকে না পাখিকে। আম্মু বলেই ডাকে।শানকেও আব্বু বলেই ডাকতে অভ্যস্ত হয়েছে সে।চারজনে মিলে যেন ভরা সংসার। সুখের সীমানা নেই কোথাও।

ছেলেকে বুকের উপর বসিয়ে নানান খুঁনসুটিতে ব্যস্ত শান।ইনায়াহ্ এসে যোগ দেয় তাদের সাথে।আজই ইনায়াহ্’র স্কুলের শেষ দিন ছিলো।কারণ আগামিকালই দেশে ফিরে আসার দিন ধার্য করা হয়েছে।শর্মিলা সহ বাড়ির সবাই অধীর আগ্রহে বসে আছে ইছাদ কে সামনা সামনি দেখবে বলে।
পাখি সমস্ত কিছু গুছিয়ে নিচ্ছে।গত দু বছরেরও বেশি সময় ধরে এ বাড়িতে থাকছে তারা।কেমন যেন অজানা মায়ায় আটকা পরেছে পাখি।নিজের হাতে গড়ানো একার সংসার তার। ছেড়ে যেতে কেমন যেন লাগছে।রান্নাঘরে নিজে হাতে সাজানো জিনিস গুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে। হঠাৎ শানের ডাকে দৌঁড়ে ছুটে যায়।

” কি হয়েছে, এভাবে ডাকলে কেন?”,হন্তদন্ত হয়ে বলে পাখি।
ভয়ে কলিজা কাপঁতে থাকে যেন।শান তখনোও ছেলের দিকে একধ্যানে তাকিয়ে আছে।চোখে জল ছলছল।
পাখি দ্রুত ইছাদকে কোলে নিয়ে বলে,”কি হয়েছে ইছাদের?”
ইনায়াহ্ হেসে বলে,”আম্মু ভাইয়া বাবা ডেকেছে”
ইনায়াহ্’র কথায় পাখি শানের দিকে তাকায়।বুঝতে পারে কিছু একটা লুকাচ্ছে সে। হয়ত চোখের কোণে জমানো জলটাই লুকাচ্ছে।দ্রুত ইছাদকে নামিয়ে শানের কোলে দিয়ে পাশে বসে পাখি।শানকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলে,”তোমার কি হয়?”

ছোট্ট ইছাদ আধো আধো বুলিতে জবাব দেয়,”বাব্বাপ”
চট করে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নেয় শান।অগনিত চুমু খেয়ে বলে,”পাখি ও আমায় বাবা ডেকেছে আজ প্রথম বার!আমি বাবা হলাম তবে!”
মুখে এক আকাশ সম প্রশান্তি আর চোখে টইটম্বুর জল নিয়ে পাখি মাথা উপর নিচ করে সায় দেয়।
শান একহাতে ইনায়াহ্ অপরহাতে ইছাদকে বুকে জড়িয়ে নেয়।দুই ছেলে মেয়েকে অসংখ্য আদরে ভরিয়ে তোলে।
পাখি ভ্রু নাচিয়ে চোখে ইশারা করে চাপাস্বরে বলে,”আমি কোথায় থাকবো”
“কলিজায়”

শান আর পাখির সাথে চিরকালের জন্যে চলে আসে রনির পরিবার।একটা ভরা সংসার যেন এবার।নিজের বেষ্ট ফ্রেন্ডের সাথে জা হিসেবে সংসার করা,রনির মতো হেল্পফুল একটা দেবর,নিজের মায়ের মতো তিনজন শাশুড়ী, চাচা শ্বশুর, বাবার মতো খান সাহেব আর আবদুল্লাহ, ফেরেশতার মতো একজন স্বামী,আদরের মেয়ে-ছেলেকে নিয়ে যেন কানায় কানায় পূর্ণ পাখির সংসার।সাথে রাফি আর রানু তো আছেই।

দেশে ফিরে শান জানতে পারে রানু আর রাফির মাঝে দীর্ঘ ৩ বছরের ভালোবাসার সম্পর্ক।শান নিজ দায়িত্বে তাদের বিয়েরও সমস্ত ব্যবস্থা করে দেয়।
ড্রয়িংরুমে সবাই মিলে ইছাদকে নিয়ে আনন্দে ব্যস্ত।হঠাৎ উপর থেকে ডাকে শান।
“পাখি”
মাথা তুলে তাকিয়ে পাখি ইশারা করে, “কী?”

“একটু ঘরে আসো তো”
শানের ডাকে উপরে চলে যায় পাখি।ঘরে ঢুকেই বুঝতে পারে শান দরজা লাগিয়ে দিয়েছে।পিছন ফিরে পাখি হেসে ফেলে।লজ্জামিশ্রিত চাহনীতে বলে,”দরজা আটকালে কেন?”
“এদিকে আসো”
টেনে নিয়ে যায় পাখিকে বিছানার কাছে।ড্রয়ার খুলে একটা নীল বক্স বের করে হাতে দেয় পাখির।
“খোল”
“কি এতে?”
“খুলোই তো ”
পাখি ভ্রুকুচকে বক্স খুলতেই বুঝতে পারে একটা ডায়মন্ডের নেকলেস সেখানে।সাথে সাথেই মুখের হাসিটা মিলিয়ে যায় পাখির।
“এসব কি করেছো তুমি?এটা তো হীরের?তুমি কি পাগল হয়ে গেছো?”,হড়বড় করে একের পর এক বলেই যাচ্ছে পাখি।

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৫৩

” শেষ??”,মুখে বিরক্তির ছাপ এনে বলে শান।
“শেষ মানে!এটা তো অনেক টাকার?এতোসবের কোন মানে হয়?আমি অলঙ্কারই পরি না। কতো গুলো পরে আছে ড্রয়ারে। তোমার সামনেই যা একটু টুকটাক…..”, বলতে বলতে মুখ নামিয়ে নেয় পাখি।
শান থুতনিটা তুলে ধরে বলে,” হুমম, সেই আমার সামনেই এটা পরে সাজবা।গট ইট?”
“কিন্তু এতো টাকা! ”

“তোমায় টাকার হিসেব করতে বলে নি কেউ।আমার ইছাদকে আমার হাতে তুলে দিয়েছো ভাবতেও পারবে না আমি কতোটা সুখী”
“ও এটা তাহলে তারই পুরষ্কার বুঝি!”, থমথমে মুখে বলে পাখি।
শান নিঃশব্দ হেসে পাখির মুখটা তুলে ধরে বলে,”
কোনো এক রূপকথার জগতে,
তুমি তো এসেছো আমারই হতে।
কোনো এক রূপকথার জগতে,
তুমি চিরসাথী আমার জীবনের এই পথে।”
ঠোঁট প্রসস্থ করে হেসে ওঠে পাখি ।হাত টেনে বুকে জড়িয়ে নেয় শান। কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিসিয়ে বলে,”ভালোবাসি”
“খুব ভালোবাসি”

(লেখাঃ আফিয়া আজাদ নিঝুম ) এই লেখিকার আরও লেখা গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন এবং এই গল্পের সিজন ১ পড়তে চাইলেও এখানে ক্লিক করুন

3 COMMENTS

  1. Golpota suru theke shesh porjonto prottekta episode e onk sundor hoyeche. Last episode gulo akdom emotional chilo. Season 1 thekeo ei season 2 besi valo hoyeche. E golpota amr pora e website er sobcheye sundor golpo.

  2. Season 1 theke season 2 ta onek onek onek onek onek…………… valo hoyeche onnnnneeeekkkkkkk sundor hoyeche Season 2 ta seiiiiiiiiiiiiiii sundor hoyeche just osm

  3. Ei golpo ta eto sundor hoyce bole bujate parbo na…..যখন ইউটেরাসের মাধ্যমে বাচ্চা নেওয়ার কথা শুনলাম বার বার মনে হচ্ছে আল্লাহ প্লিজ শেষ যেনো সুন্দর হয়…পাখি শান একটু সুখী হোক….এতো ইমোশনাল ছিলো..আমি কালকে রাত আটটা শেষ রাত ৪ টা পর্যন্ত ৩৬ পর্ব পর্যন্ত পড়েছি আর এরপর ১২ টা থেকে এখন শেষ করে আলাদা একটা শান্তি লাগছে…শেষ টা তো সুন্দর হয়ছে…এই এতক্ষণ ওদের নিয়ে ভাবনার জগৎ থেকে বাহির হয়ে ওদের খুব মিস করছি….এমন স্বামী যেনো আল্লাহ প্রত্যেকটা মেয়ের ভাগ্যে রাখেন….

Comments are closed.