আহনাফ চৌধুরী পর্ব ১৭

আহনাফ চৌধুরী পর্ব ১৭
মুন্নি আক্তার প্রিয়া

আহনাফ হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেও সরল না। অর্ষা ততক্ষণে ব’মি করে ক্লান্ত। সাজেদা বেগম রুমে ঢুকে এই অবস্থা দেখে কী বলবেন বা করবেন হুট করেই বুঝে উঠতে পারলেন না। মাকে দেখে আহনাফ শান্তকণ্ঠে বলল,
“মা, অর্ষাকে ওয়াশরুমে নিয়ে যাও।”

সাজেদা বেগমও তাই করলেন। আহনাফ রুম পরিষ্কার করতে করতে অর্ষাকে ফ্রেশ করে নিয়ে এলেন সাজেদা বেগম। এরপর আহনাফ গেল ফ্রেশ হতে। মাত্র ব’মি করেছে বিধায় সাথে সাথেই খাবার খেতে দিলেন না সাজেদা বেগম। তিনি রান্নাঘরে গিয়ে চট করে কাঁচামরিচ দিয়ে তেঁতুল মেখে আনলেন। জ্বরের তেতো মুখে তেঁতুলই ভালো লাগবে এখন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“অর্ষা, এটা খাও।”
খাটের সাথে হেলান দিয়ে শুয়ে ছিল অর্ষা। সাজেদা বেগমের হাত থেকে বাটি হাতে নিয়ে শুধাল,
“তেঁতুল?”
“হ্যাঁ, খাও। ভালো লাগবে। রুচিও হবে। ভাত এখন খাওয়ার দরকার নেই। আমি মাল্টার জুস দিয়ে যাচ্ছি। আর কমলা দিয়ে যাচ্ছি।”

“এখন কোনো কিছু লাগবে না, মা।”
“তুমি বেশি কথা বলবে না। আমি যা বলব সব শুনবে।”
তিনি চলে যাওয়ার পর অর্ষা তেঁতুল খাওয়া শুরু করে। একমাত্র এই খাবারটাই এখন তার ভালো লাগছে। আহনাফ আবারও গোসল করে এলো। অর্ষার খারাপই লাগল ওকে দেখে। ভারী দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ক্ষীণস্বরে বলল,

“সরি।”
আহনাফ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কিছু বললে?”
“সরি।”
“সরি? সরি কেন?”
“ব’মি করে দিলাম যে!”
“এখানে সরি বলার কী হলো? তুমি নিজের খেয়াল রাখছ না একদম। এরজন্য অবশ্যই সরি বলা উচিত তোমার। কী খাচ্ছ এখন?”

“তেঁতুল। খাবেন?”
“না। তুমি খাও।”
“আমার কিছুই ভালো লাগছে না। জ্বরে এত কাবু এর আগে কবে হয়েছিলাম ঠিক মনে পড়ছে না।”
“মনে পড়লে কি ভালো হয়ে যাবে? ঠিকমতো খেতে হবে। নিজের যত্ন নিতে হবে। সময়মতো মেডিসিন নিতে হবে।”
“আমার জন্য আপনাকে আর মাকে এখন কষ্ট করতে হচ্ছে।”

“এত ফর্মালিটিস কেন দেখাচ্ছ? আমি আর মা কি তোমার পর?”
“তবুও!”
“তবুও কী আবার? বেশি কথা না বলে খাও। না খেয়ে খেয়ে শরীরের যা হাল করেছ!”
আহনাফ বারান্দায় যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছিল। পেছন থেকে অর্ষা শুধাল,
“আপনি আমার এত যত্ন নেন কেন?”
আহনাফ দাঁড়িয়ে পড়ল। পিছু ফিরে শান্তকণ্ঠে বলল,
“কারণ তুমি আমার বউ।”

সময় চিরপ্রবাহমান। সময় বদলায়। সেই সাথে বদলায় মনের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও অনুভূতি। হয়তো অনুভূতি প্রখর হবে নয়তো হবে ভোঁতা। কোনো কিছুই এক রকম থাকবে না সব সময়। কখনো বাড়বে, কখনো কমবে। কখনো প্রিয় হবে, কখনো হবে অপ্রিয়। অর্ষার মাঝেও এমন পরিবর্তনই লক্ষ্য করছে সবাই। এমনকি অর্ষা নিজেও। এখন আর আগের মতো করে রিহানের কথা মনে আসে না। সেই সময়টুকু দখল করে নিয়েছে আহনাফের চিন্তা-ভাবনা।

আহনাফের এত ভালোবাসা-যত্ন উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না অর্ষার। বোধ করি, অন্য কোনো মেয়ে থাকলেও তারও সাধ্য হতো না উপেক্ষা করার। তাছাড়া মেয়েরা স্বভাববতই একটু ভালোবাসার কাঙাল হয়। কেউ একটু ভালোবাসলে, যত্ন করলে মেয়েরা গলে যায়। দুর্বল হয়ে যায়। খুশি হয়ে যায়। প্রিয়জনের জন্য মেয়েদের খুশি করা খুবই সহজ। শুধু একটু বিশুদ্ধ ভালোবাসা দিলেই হয়। এর বিনিময়ে তারা গোটা বিশ্বের সকল ভালোবাসা প্রিয় মানুষটির পদতলে উপস্থাপন করতে প্রস্তুত। সেখানে অর্ষা না চাইতেও আহনাফের ভালোবাসা এত বেশি পরিমাণ পেয়ে আসছে যেটা উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

এইযে অর্ষা যখন অসুস্থ ছিল আহনাফ ওকে ছোটো বাচ্চার মতো আগলে রেখেছে। যত্ন নিয়েছে। মানুষটা অফিসে থাকলেও যেন মন পড়ে থাকত বাড়িতেই অর্ষার কাছে। মাঝে মাঝে অর্ষা ভেবে পায় না যে মানুষ এত নিঁখুত হয় কী করে? কেন তার কোনো দোষত্রুটি অর্ষা খুঁজে পায় না! তাছাড়া যেই ছেলের মা একজন আদর্শ নারী হয় তার সন্তানও যে আদর্শবান হবে এতে তো সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না।

আহনাফের বাবাও খুবই যত্নবান। সকালে অফিসে যাওয়ার পূর্বে বারবার করে স্ত্রীকে বলে যেতেন অর্ষার যেন ভালো করে খেয়াল রাখেন। রাতে বাড়িতে ফিরেও তিনি সবার আগে অর্ষার খোঁজ-খবর নেবেন। এইযে এত সুখ, আনন্দ সমস্তকিছু তার স্বপ্ন মনে হয়। মাঝে মাঝে ভাবে সে হয়তো কোনো দিবাস্বপ্ন দেখছে। কিন্তু পরক্ষণেই তার ভাবনা ভাঙে। কোনো কিছুই স্বপ্ন নয়। সব সত্যি। তবে স্বপ্নের মতোই সত্যি।

রিহানকে হারানোর পর তার মনে হয়েছিল পৃথিবীতে তার মতো অভাগী, অসুখী হয়তো দ্বিতীয় আর কেউ নেই। তার ভাগ্যে হয়তো আল্লাহ্ সুখ লিখে রাখেননি। নিজের পরাজয়, দুঃখ-কষ্টকে যখন মেনে নেবে বলেই সিদ্ধান্ত নিল তখন আল্লাহ্ তাকে দু’হাত ভরে দিতে শুরু করেছেন। নতুবা এমন শ্বশুরবাড়ি কিংবা স্বামী পাওয়া এতটাও সহজ ছিল না। খারাপ সময়টায় আল্লাহর ওপর রাগ করত, অভিমান করত বলে এখন তার নিজেকে ভীষণ লজ্জিত লাগে। অনুতপ্ত হয়।

এজন্য সে আল্লাহর কাছে ক্ষমাও চায়। এত সুন্দর জীবন দেওয়ার জন্য শুকরিয়াও আদায় করে সে প্রতিনিয়ত।
রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে যখন জীবনের সুখ-দুঃখের হিসাব-নিকাশ করছিল অর্ষা তখন ঘাড়ে কারো উষ্ণ নিঃশ্বাস এসে লাগল। চকিতে ফিরে তাকাল পেছনে। আহনাফ হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ তার চোখে-মুখে ক্লান্তির প্রতিচ্ছবি। ঘামে মুখ ও কপালের কিছু চুল ভিজে আছে। গায়ের শার্টও ঘামে ভেজা। তবুও তাকে কতটা খুশি ও প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে। আহনাফকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হলো না। সে নিজে থেকেই বলল,

“বিশ্বাস করো অফিস করে ভীষণ ক্লান্ত লাগে। কিন্তু লাঞ্চের পর ভালো লাগে। সময়টা কখন যাবে কখন পাঁচটা বাজবে আর কখন অফিস শেষ হবে সেই মুহূর্ত গুনতে থাকি। বাড়িতে ফিরলেই আমার মিষ্টি বউটাকে দেখতে পারব। এই অপেক্ষাটুকু আমাকে এতটা স্বস্তি দেয়! এই দেখো, তোমাকে দেখার পর আমার সব ক্লান্তি কেটে গেছে। মনে হচ্ছে, এই মুখটা দেখার অপেক্ষাটুকু পার করার জন্য আমি শত বছর ক্লান্ত থাকতে প্রস্তুত।”
অর্ষা হেসে ফেলল। বলল,

“সবসময় শুধু ঢং!”
“ঢং? আমার অনুভূতিকে তোমার ঢং মনে হলো?”
“হয়েছে। তর্ক-বিতর্ক পরে করা যাবে। আগে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন।”
“তুমিও চলো।”
“কোথায়?”
“ওয়াশরুমে। দুজনে একসাথে গোসল করলাম না হয়!”
অর্ষা চোখ পাকিয়ে আহনাফের বাহুতে কিল বসিয়ে বলল,
“অসভ্য লোক!”!

অর্ষা চলে যাওয়ার পর আহনাফ গা দুলিয়ে হাসতে লাগল। পরক্ষণে কাপড় বদলে সে গোসল করে এলো। সবাই মিলে রাতের খাবার খেয়ে আহনাফ আগে রুমে এলো। অর্ষা এবং সাজেদা বেগম খাবার, টেবিল সব ভালোমতো রেখে, গুছিয়ে তারপর গেল ঘুমাতে। অর্ষা রুমে গিয়ে দেখল আহনাফ চোখের ওপর হাত রেখে শুয়ে আছে। লাইট নিভিয়ে অর্ষাও গিয়ে পাশে শুয়ে পড়ল। আহনাফ চোখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখে অর্ষা অন্যদিক ফিরে শুয়ে আছে। সে ক্ষীণস্বরে ডাকল,

“অর্ষা?”
অর্ষা পাশ ফিরে বলল,
“হু?”
অন্ধকারে দুজনের চোখ সয়ে এসেছে ততক্ষণে। আহনাফ নিজের বুকের বামপাশে হাত রেখে বলল,
“এখানে ব্যথা করছে।”
অর্ষা বুঝতে পারল আহনাফ কী চাচ্ছে। তবুও না বোঝার ভান ধরে বলল,
“কেন?”

“এটা যার জায়গা সে নিচ্ছে না। তাই ফাঁকা পড়ে আছে তো! যার জায়গা সে নেবে নাকি অন্য কাউকে দেবো বুঝতে পারছি না।”
অর্ষা তড়িৎ গতিতে আহনাফের বুকে মাথা রাখল। আহনাফ শব্দ করে হেসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল অর্ষাকে। অর্ষা চাপা রাগ দেখিয়ে বলল,
“এটা আমার জায়গা। দলিল করে নিয়েছি। আপনি অন্য কাউকে দেওয়ার সাহস দেখান কীভাবে?”
“তাহলে তোমার জায়গা রেখে তুমি দূরে থাকো কেন? আমার কষ্ট হয় না?”
“আর কষ্ট পেতে হবে না।”

“অর্ষা?”
“হু?”
“আদর করব!”
অর্ষার শরীর শিউরে উঠল মুহূর্তেই। কণ্ঠস্বর রোধ হয়ে এলো। মৃদুস্বরে বলল,
“এখন না।”
“তাহলে কখন?”
“অন্য কোনো সময়।”
“এখন কী সমস্যা?”
“এমনি।”
আহনাফ কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বলল,
“আচ্ছা।”

এরপর আর একটা কথাও বলল না আহনাফ। চুপ করে শুয়ে রইল। আহনাফের নিরবতা অর্ষাকে পীড়া দিচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পর সে ডাকল,
“শুনছেন?”
“হু।”
“ঘুমিয়ে পড়েছেন?”
“না।”
“একটা কথা বলব।”
“বলো।”
“একটা চুমু দেবেন?”

আহনাফ অবাক হয়ে বলল,
“কী?”
“একটা চুমু দেবেন? কপালে।”
বিস্ময়ে ভাঁটা পড়ল আহনাফের। কণ্ঠস্বর নিচু হয়ে এলো। বলল,
“ওহ।”
এরপর সে অর্ষার কপালে একটা চুমু খেল। অর্ষা ডানগালে হাতে রেখে বলল,
“এখানে একটা।”
পূণরায় আহনাফকে অবাক হতে হলো। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। ডানগালে চুমু খেল সে। অর্ষা বামগালে হাত রেখে বলল,

“এখানে একটা।”
আহনাফ বামগালে চুমু খেল। অর্ষা চোখের পাতায় হাত রেখে বলল,
“দুই চোখে।”
আহনাফ দুই চোখের পাতায় চুমু খেল। ক্রমান্বয়ে তার ভেতরের চঞ্চলতা বেড়ে যাচ্ছে। বিশ্বাসই হচ্ছে না এটা অর্ষা! এবার অর্ষা নাকে আঙুল রেখে বলল,
“এখানে একটা।”

আহনাফ এবার অর্ষাকে বুক থেকে নামিয়ে বালিশে শুইয়ে দিল। নিজে কিছুটা অর্ষার ওপর ঝুঁকে নাকে চুমু খেল। অর্ষার লজ্জা লাগলেও মুচকি হাসল সে। নিঃশ্বাস আটকে বলল,
“ঠোঁটে একটা।”

এবার সবচেয়ে গভীর চুমুটা খেল আহনাফ। অর্ষা কোনো প্রকার বাঁধা প্রদান করল না। কোনো চুমুও আর তাকে নিজে থেকে চাইতে হলো না। ঠোঁট থেকে গলায়, ঘাড়ে, বুকে অজস্র চুমু খেতে লাগল আহনাফ। অর্ষার শরীর অসাড় হয়ে আসছিল।

আহনাফ চৌধুরী পর্ব ১৬

অদ্ভুত রকম ভীতি ও আনন্দ উভয় অনুভূতিই অনুভব হচ্ছিল তার। অচেনা, অজানা অনুভূতি সম্পর্কে এতদিন শুধু জানলেও আজ সে নিজেই পরিচিত হচ্ছে। শরীর ছোঁয়াটা তখনই আনন্দের ও সুখের হয় যখন সেখানে ভালোবাসা থাকে, সম্মান থাকে। এবং অর্ষাও যে অতীতের সকল পিছুটান ভুলে আহনাফকে ভালোবাসতে শুরু করেছে তাতে বোধ করি কারো কোনো সন্দেহ নেই। সঠিক নারীর ভালোবাসার যত্ন নিলে কমে না কখনো; বরং বাড়ে।

আহনাফ চৌধুরী পর্ব ১৮