দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ২৯

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ২৯
তাসফিয়া হাসান তুরফা

দোলা দরজা খুলতেই মামিকে দেখে অবাক হয়। তার পেছনে দাড়ানো রাকিবকে দেখে বিরক্তও হয় মনে মনে। এদিকে, দোলাকে দেখে শায়লা বেগমের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়। মেয়েটা প্রশ্ন করে,
—মামি, আপনি?

—হ্যাঁ, আমি। তা ভেতরে ঢুকতে দিবি নাকি দরজার সামনেই এমন মূ’র্তি হয়ে দাঁড়ায় থাকবি? সর সামনে থেকে!
মামির কথায় তিক্ততা স্পষ্ট। দোলা কিছু না বলে চুপচাপ জায়গা করে দেয়৷ মনে মনে ভাবে, মামি আবার কোন কান্ড ঘটাতে এসেছে এ সময়? রাকিব উল্টাপাল্টা কিছু বলে দেয়নি তো?
শায়লা ভেতরে ঢুকতেই তার পিছু পিছু চোরের মতো রাকিব ঢুকে যায় বাসায়। তখনই রান্নাঘর থেকে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসছিলেন পারভীন বেগম। কে এসেছে না দেখেই দোলার উদ্দেশ্যে বললেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—কে এলো রে, দোলন?
—মেয়েকে জিজ্ঞেস না করে চোখটা তুলে দেখলেও তো পারো, পারভীন। তবেই না উত্তর পাবে!
শায়লার আওয়াজে পারভীন বেগম বিস্মিত সুরে চাইলেন। খানিকটা ইতস্তত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,
—আরে ভাবি, আপনি হঠাৎ এ সময়? দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন না!
পারভীনের কণ্ঠে স্পষ্ট অপ্রস্তুত ভাব। কেননা এ সময় এখানে মোটেও আশা করেননি ভাবীকে। তার মধ্যে বাসায় নিশীথ আছে, মেহমানের সামনে আবার কোনো বিবাদ ঘটাবেন না তো! উনার ভাবনার মাঝেই শায়লা তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,

—বসার জন্য আসিনি। তোমরা মা-মেয়ে যা করেছো এরপর তোমাদের বাসায় বসতে আসার ইচ্ছেটাও আমার শেষ হয়ে গেছে!
—ভাবি, ধীরে বলুন। বাসায় মেহমান আছে! আর আপনি এমন করে বলেছেন কেন?
পারভীন বেগমের কথায় শায়লা হিস’হিসিয়ে বললেন,

—কেন বলছি তা কি তোমরা জানোনা? নাকি নতুন করে শুরু থেকে বলতে হবে আমার, হ্যাঁ? তোমার মেয়ে আমার ছেলের সাথে কি করেছে তা আবার আমাকেই বলতে হবে?
—আমার জানামতে আপনি উল্টোকথা বলছেন, ভাবি। দোলা রাকিবের সাথে কিছু করেনি বরং রাকিবই ওকে ডেকে নিয়ে গিয়ে ফেরার পথে…আমার তো বলতেও লজ্জা লাগছে ছিঃ!
—পারভীন! মেয়ের দেখাদেখি এখন তুমিও মিথ্যা বলছো? আমার ছেলেকে অপবাদ দিচ্ছো? তোমার সাহস তো কম নয়!

—দোলা ঠিক করেছেটা কি যদি বলতেন খুব উপকার হতো। আপনার কথার সারমর্ম আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা। আপনিই ফোন করে দোলাকে জোরপূর্বক রাজি করিয়েছিলেন শেষবার রাকিবের সাথে দেখা করতে যেতে, না হয় আমার মেয়ে কোনদিন আপনার ছেলের পাশ ঘেঁষতোনা। অথচ এখন আপনিই কিনা ওর উপর দোষ দিচ্ছেন! যেখানে অপ’রাধী আপনার ছেলে!

নিজের সত্যটা প্রায় ফাস হতে ধরায় রাকিব নড়ে উঠলো। আরেকটু হলেই পারভীন বেগম ওর মাকে সবটা সত্যি বলে দিতে পারেন। তাই ও নিজেই নিজের সাফাই গেয়ে নির্লজ্জের ন্যায় বললো,
—ফুপি, এই যে তুমি আমার উপর এত দোষ দিচ্ছো। তুমি কি জানো তোমার মেয়ে কি করেছে? ওখানে আমার সাথে কি হয়েছে তোমার কোনো আইডিয়া আছে?

—রাকিব, আমি জানি ওখানে কি হয়েছে। দোলা সবটাই আমাকে বলেছে..
—দোলা বলছে তো কি হয়েছে? রাকিব কি বলতে চাইছে সেটাও একবার শুনো। নয়তো কে জানে তোমার মেয়ে আবার কোনো ভুল তথ্য দিয়ে তোমায় বিভ্রান্ত করেনি তো!
শায়লার কথায় পারভীন বেগমের চোখমুখ শক্ত হয়। দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দেন,

—ভাবি, আপনার যেমন রাকিবের উপর বিশ্বাস আছে তেমনি আমার দোলনের উপর বিশ্বাস আছে। তবু আপনি যেহেতু বলছেন তাই আমি রাকিবের কথাটাও শুনবো। রাকিব, তুমি কি বলতে চাও বলো। আমি শুনছি!
পারভীন বেগম অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাকিবের কথা শুনতে চান। নয়তো কখনোই এ ভুল-বোঝাবুঝি ও মনমালিন্য মিটানো সম্ভব নয়! এদিকে, উনার জবাব শুনে রাকিব জঘন্যভাবে হাসে। বাকা চোখে দোলার দিকে তাকিয়ে মিথ্যা বলার জন্য প্রস্তুতি নেয়। দোলা ভ্রু কুচকে ওকে সবটা পর্যবেক্ষণ করে। বুঝে নেয় ছেলেটার মনে নিশ্চয়ই কোনো কুবুদ্ধি চলছে, যার দরুন ও এত কনফিডেন্সের সাথে এখানে এসে এমন করে কথা বলছে। তখনই রাকিব বলে উঠে,

—তোমার মেয়ে বাহিরে থেকে যতটা ভোলাভালা সেজে থাকে, বাস্তবে ও অতটা সহজ-সরল নয়, ফুপি। দোলা যে তোমায়, আমায়, আমাদের সকলকে ফাঁকি দিয়ে প্রেম করছে তা কি তোমার জানা আছে? শুধু প্রে’ম করা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলেও হতো, সোজা প্রেমিককে দিয়ে আমায় পি’টিয়েছে! এই দেখো গলায় আংগুলের ছাপ…
রাকিব শায়লার মতো পারভীন বেগমকেও নিজের পক্ষে নেওয়ার উদ্দেশ্যে আবারো গলার কাছে শার্টের খুলে দেখায় নিশীথের হাতের ছাপ। এরই মাঝে দোলা ওকে বাধা দিয়ে কথা বলে। বিরক্তিতে চেচিয়ে উঠে ও বলে,

—রাকিব! কিসব ফালতু কথা বলছো? মিথ্যা কথা বলারও একটা সীমা থাকে! তোমার কি বিন্দুমাত্রও লজ্জা হবেনা কখনো?
রাকিব কুটিল হাসে। ভাবে, মেয়েটা বাসায় এসে কিছু জানায়নি। ফলে ওর কথা শুনে ভয় পেয়েছে। ও পুনরায় বলে,
—লজ্জা আমার না তোমার হওয়া উচিত, দোলা। অনেকদিন ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে ঘুরেছো। তাছাড়াও সত্যি কথা শুনতে তেতোই লাগে। দেখলে, ফুপি? যেই না সত্যিটা বললাম ওমনি তোমার মেয়ের গায়ে লেগে গেলো! আসলে ওর ভেতরে ভেতরে সাংঘাতিক বুদ্ধি কিনা! বিয়ে ভাঙার জন্য একেবারে রেডি। তাছাড়া কেউ এভাবে সরাসরি প্রেমিককে নিয়ে যায়?

এক দমে কথাগুলো বলে রাকিব থামে৷ ওর কথায় পারভীন বেগমের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই বুঝেও না বুঝার ভান করে। নিজের ইগোকে প্রশ্রয় দিতে মেকি দম্ভের সাথে বলে,
—আরেহ যদি আগেই বলতো ওর অন্য ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে তবে কি আমি ওকে বিয়ে করতে চাইতাম! কত মেয়ে আমায় বিয়ে করতে বসে আছে তোমাদের আইডিয়া আছে? অথচ, তোমার এই বেয়া’দব মেয়ের পেছনে অযথাই আমাদের এত সময় নষ্ট হলো! আর প্রেম করছেও বা কেমন ছেলেকে! আস্ত একটা মা’স্তান। নামটা কি বলেছিলো যেন…

কথার মাঝে থেমে রাকিব নাম মনে করার চেষ্টা করে। আর তখনই পেছন থেকে গম্ভীর পুরুষালি আওয়াজ ভেসে আসে।
—নিশীথ!
নাম শুনে রাকিব ঝোকের বসে মাথা নাড়ে! পারভীন বেগমের উদ্দেশ্যে বলে,
—হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশীথ। আরে ফুপি, তুমি তো জানোইনা ওই ছেলে কিরকম! একদম গু’ন্ডার মতো আচরণ আর মা’রা’মারি করে। তাই আমরা তোমায় পরামর্শ দিতে এসেছি, সময় থাকতে দোলার উপর নজর রাখো। নয়তো কখন কি কু’কাণ্ড করে বংশের সম্মান ডুবাবে কে জানে!

—তাই নাকি?
পেছন থেকে আবারো সেই পুরুষালি কণ্ঠ প্রশ্ন করে। রাকিব কিছুটা বিরক্ত হয়েই বলে,
—অবশ্যই। আমরা কি মজা করতে এসেছি এখা…
এবার কথা বলার মাঝে হঠাৎ রাকিবের মনে পড়ে এ বাসায় তো শিমুল বাদে কোনো ছেলেমানুষ নেই। আর শিমুল ছোট মানুষ, ওর গলায় এত গাম্ভীর্য, পুরুষালি ভাব আসেনি এখনো। তবে? এই কণ্ঠের মালিক কে? তখন কে বললো নিশীথের নাম? ভাবনা অনুযায়ী কিছু একটা অনুমান করে রাকিব তড়িৎ গতিতে পেছন ফিরে।

ওর থেকে কদম পাঁচেক দূরে দাঁড়ানো নিশীথকে দেখে প্রায় সাথে সাথেই রাকিবের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়! ছেলের ভয়ার্ত দৃষ্টি অনুসরণ করে শায়লা বেগমও পেছন ফিরেন। নিশীথকে দেখে চিনতে না পারায় ওকে তেমন পাত্তা না দিয়ে ছেলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন,

—কি হলো, বাবা? তুই থেমে গেলি কেন? পারভীনকে ওই নিশীথের ব্যাপারে সবটা সত্যি বল! ওরাও জানুক ওদের মেয়ে কোন গু’ন্ডার সাথে প্রেম করছে!
—মা…
ছেলের হাবভাবে শায়লা বেগম বিরক্ত হন। চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন,
—কি হয়েছে? এখন কথা বলা বাদ দিয়ে ম্যা ম্যা করছিস কেন? তুই কি ভুলে গেলি আমরা কিজন্যে এখানে এসেছি?

—হ্যাঁ, আন্টি। আরেকটু বলুন না! আমরাও শুনতে চাই গু’ন্ডা নিশীথ কি কি করেছে!
নিশীথ বিদ্রুপের সহিত প্রশ্ন করে। ওর কথায় বিরক্ত হয়ে শায়লা বেগম বলেন,
—তুমি শুনে কি করবে? তোমাকে তো চিনলামই না! পারভীন, এটাই তোমার মেহমান নাকি যার কথা বলছিলে?
পারভীন বেগম নিঃশব্দে মাথা নাড়তেই শায়লা নিশীথের উদ্দেশ্যে বললেন,
—শুনো ছেলে, তুমি মেহমান হয়ে এসেছো মেহমানের মতোই থাকো। এটা আমাদের ফ্যামিলি ম্যাটার, এখানে তোমার নাক গলাতে হবেনা!

—আমি নাক গলাতে চাইনি। ইনফ্যাক্ট, আমার কোনো ইন্টেরেস্টও নেই আপনাদের সো-কল্ড ফ্যামিলি ম্যাটারে৷ কিন্তু আপনার ছেলেই তো স্বেচ্ছায় আমায় জড়ালো। তাই এখন আমার কাছে দ্বিতীয় কোনো অপশন নেই! আই এম ফো’র্সড!
নিশীথের কথা বুঝার চেস্টায় শায়লা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলেন ওর দিকে। কিছু একটা মাথায় আসতেই চোখ বড় বড় করে রাকিবের দিক তাকাতেই ও মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে ভীত গলায় বিড়বিড়িয়ে বললো,

—এটাই নিশীথ, মা!
ছেলের কথায় ব্যাপকভাবে চমকে গেলেন শায়লা বেগম। বস্তুত, তিনি এখানে এসেছিলেন পারভীনের সামনে দোলার প্রেমের ঘটনা খুলে ওদের অপমান করতে, ওদের চমকে দিতে! কিন্তু, নিয়তির খেলা যে ভিন্ন! উলটো এখানে এসে যে তিনি নিজেই সবচেয়ে বড় চমক পাবেন তা কস্মিনকালেও মাথায় আনেননি!

ওদের মা-ছেলের চেহারা দেখে নিশীথ রহস্যময় হাসি দেয়। সে তো শিমুলের রুমে বসে ওর সাথে গল্প করছিলো। এমন সময় বাইরে থেকে চেচামেচির আওয়াজ আসে। শিমুলকে জিজ্ঞেস করতেই, ও কণ্ঠ শুনে বলেছিলো, “এটা তো মামির আওয়াজ মনে হচ্ছে, নিশীথ ভাইয়া!”

ব্যস! মামির কথা শুনে নিশীথের চতুর মস্তিষ্ক নিজ হতেই অনুমান করে নেয় মামি কেন এসেছে এখানে। নিশ্চয়ই রাকিব বাসায় যেয়ে সবকিছু বলে দিয়েছে। সেদিন দোলার জন্য পরিপূর্ণভাবে ধোলাই দিতে পারেনি বলেই ছেলেটার সাহস এত বেড়েছে, এসব ভেবে ধীরেসুস্থে নিশীথ বেরিয়ে আসে শিমুলের রুম থেকে। তখন রাকিব ও মামি উল্টোদিক ঘুরে কথা বলায় ব্যস্ত থাকায় তারা ওর উপস্থিতি লক্ষ্য করতে ব্যর্থ হন৷ এদিকে ওকে দেখে দোলা কথা বলতে নিলে নিশীথ ইশারায় চুপ করায় মেয়েটাকে। তা লক্ষ্য করে কামিনি, পারভীন বেগম-ও আর কথা বলেন না। নিশীথের উপস্থিতি পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে রাকিবের দিকে মনোযোগ দেন যাতে ওদের বানোয়াট কথার মাঝে কোন বিঘ্ন না ঘটে!

অবশেষে, সব জল্পনা কল্পনা এড়িয়ে নিশীথ দু কদম এগিয়ে আসে। প্যান্টের পকেটে দু’হাত গলিয়ে আয়েশ করে রাকিবের সামনে দাঁড়ায়।
অতঃপর ওর দিকে কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টি ছুড়ে প্রশ্ন করে,
—তো কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেলে কেন, রাকিব? বলো কি বলছিলে! আমিও নিজের গুনগান একটু ভালোমতো শুনি। কন্টিনিউ প্লিজ!

নিশীথের কথার ধরনে দোলার হাসি পায়। সবার আড়ালে ও ঠোঁট টিপে হাসলেও নিশীথের নজর এড়ায়না ঠিকি। নিশীথ প্রশ্নসূচক চাহনিতে তাকাতেই দোলার হাসি হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। দৃষ্টি ফিরিয়ে মেয়েটা অন্যদিকে তাকায়। তা দেখে নিশীথ পুনরায় রাকিবের দিক চোখ ফেরায়।

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ২৮

চোখমুখ শক্ত করে ওর দিকে তাকাতেই রাকিব ঢোক গিলে! আচমকা নিশীথের হা’তে তখনকার মা’ই’র খাওয়ার কথা মনে হতেই ওর গলা শুকিয়ে আসে। রাকিব জানে, নিশীথ থাকতে ওর প্ল্যান পুরোপুরি সফল হবেনা। চিন্তিত সে মায়ের দিক তাকায় বুদ্ধির আশায়! মনে মনে ভাবতে থাকে, এবার ওর কি হবে?

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ২৯ (২)