দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৪৩

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৪৩
তাসফিয়া হাসান তুরফা

দোলা ভার্সিটি শেষে বাসায় ফেরার পর থেকেই লক্ষ্য করছে পারভীন বেগম বেশ খুশি খুশি আছেন। মা-কে খুশি দেখে আপনাআপনিই দোলার মনটাও প্রফুল্লিত হলো! ফ্রেশ হয়ে খেতে বসে মায়ের সাথে গল্প করার এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করলো,

—কি হয়েছে, মা? তোমাকে আজ বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছে! ব্যাপার কি বলো তো।
মেয়ের কথায় পারভীন বেগম এক গাল হেসে বললেন,
—খুশির ব্যাপার আছে বলেই তো খুশি আছি!
—তাই নাকি? কি এমন খুশির ব্যাপার আছে আমাকেও বলো শুনি!
—তোর বিয়ে ঠিক করেছি, দোলন! আল্লাহ চাইলে কাল বাদে পরশুদিন ছেলেপক্ষ এসে তোকে দেখে আংটি পড়িয়ে দিয়ে যাবে!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দোলা মাত্রই এক নলা ভাত মুখে নিচ্ছিলো এমন সময় মায়ের কথা শুনে সে হাত হাওয়ায় ঝুলে রইলো। হাতের মুঠো থেকে খপ করে পড়ে গেলো ভাত। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে মায়ের দিকে চেয়ে বললো,
—আমার ব,,বিয়ে ঠিক করেছো মানে? কার সাথে? কবে? তুমি আমাকে কিছু জানাওনি কেন?
পারভীন বেগম বেশ স্বাভাবিকভাবে বললেন,

—ছেলে আমার পরিচিত, আজ ওরা বাসায় এসেছিলো কথাবার্তা বলতে। সবমিলিয়ে আমার ভালো লেগেছে তাই হ্যাঁ বলে দিয়েছি। তুই বাসায় ছিলিনা তাই তোকে জানানো হয়নি। থাকলে তুইও জানতে পারতি!
—কিন্তু মা, তুমি তো আমার সবই জানো। তবু্ও এভাবে হুট করে বিয়ে ঠিক করলে কেন? আমার বিশ্বাসই হচ্ছেনা।
দোলা উদাসমুখে বললো। পারভীন বেগম মনে মনে হাসলেন মেয়ের মুখের অবস্থা দেখে। কিন্তু চেহারায় গাম্ভীর্য ধরে রেখে বললেন,

—দেখ দোলন, তুই আমার মেয়ে। নিশ্চয়ই তোর খারাপ হবে এমন কিছু আমি করবোনা। নিজের মায়ের উপর তোর এটুকু ভরসা নেই?
—আমি তেমনটা বলিনি, মা। অবশ্যই তুমি যা করবে আমার ভালোর জন্যই করবে কিন্তু সেদিন তুমিই না আমায় নিশীথকে নিয়ে ওসব বললে। এখন আবার অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক করেছো, তাই কিছু বুঝতে পারছিনা।

পারভীন বেগম ভাবলেন এবার কি বলবেন। তার মন চাইছে মেয়েকে এক্ষুণি সবটা সত্যি সত্যি বলে দিতে, দোলাকে আশ্বাস দিতে যে, তখন যেই নিশীথকে বিয়ে করার পরামর্শ উনি দিয়েছিলেন এখনও সেই নিশীথের সাথেই দোলার বিয়ে ঠিক করেছেন তিনি। কিন্তু হবু জামাই এর অদ্ভুত নিষেধাজ্ঞার কারণে দোলাকে চেয়েও তিনি সত্যটা বলতে পারছেন না, নিশীথের কথার সম্মান রক্ষার্থে।

কেননা বিয়ের কথা পাকা করে বাসা থেকে বের হওয়ার আগে নিশীথ তাকে বলেছে, বিয়ের ব্যাপারে আগেই দোলাকে কোনোকিছু না জানাতে। পারভীন বেগম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলেন “কেন”? কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে ভাবলেন, থাক না! এসব ছেলেমেয়েদের ব্যাপার। নিশীথ হয়তো নিজেই ওকে জানিয়ে সারপ্রাইজ দিতে চাইছে। তাই পারভীন বেগমও কথা না বাড়িয়ে নিশীথের কথায় রাজি হয়ে যান, ওকে কথা দেন উনি দোলাকে কিছু জানাবেন না। নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে পারভীন বেগম মেয়েকে বললেন,

—এতকিছুর কৈফিয়ত তো আমি দিতে পারবোনা, দোলা। এই যে তুই নিশীথের কথা ভেবে এতদিন নিজের অবস্থা খারাপ করলি, ও কি একবারো তোর খোজ নিয়েছে? একবারো তোর সাথে দেখা করা বা তোকে ফোন দিয়ে তোর হালচাল জিজ্ঞেস করেছে?

দোলা নিশ্চুপ রয়। মায়ের এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থায় ও নেই। ও হিসাব করে দেখলো, আসলেই তো নিশীথের সাথে সেই কবে ওর শেষ কথা হয়েছিলো। এরপর থেকে দোলা কত ফোন দিয়েছে, কিন্তু নিশীথ ধরেনি। হয় ফোন কেটে দিয়েছে নয়তো বন্ধ করে রেখেছে। এদিকে মা যে ওর বিয়ে অন্য কোথাও ঠিক করে রাখলেন, এ খবর কি নিশীথ জানে?
দোলাকে এমন বিষন্ন চুপচাপ দেখে পারভীন বেগম বললেন,

—হয়েছে। এত মন খারাপ করতে হবেনা। ভালোমতো খা এখন। আর শোন, আমার বিশ্বাস আমার পছন্দ করা ছেলেকে তোরও পছন্দ হবে। মিলিয়ে নিস মায়ের কথাটা!
রুমে চলে যেতে যেতে পারভীন বেগম বললেন। দোলা শুনেও চুপ করে রইলো৷ মনে মনে ভাবলো, এই যে নিশীথ ওর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে রেখেছে, ও কি জানতে পারবে ওর অগোচরে দোলার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে? জানলে কি হবে নিশীথের রিয়েকশন? ও কি আবারো আগেকার ন্যায় পাগলামি করবে দোলার জন্য? করবে হয়তো। তখন নিশ্চয়ই দোলার সাথে আবারো আগেকার ন্যায় যোগাযোগ করবে? দোলার মনে আশা জাগে। ইচ্ছে হয় নিশীথের সাথে দেখা করার, ওকে সবকিছু খুলে বলার! একিসাথে ওর প্রতি নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করার ইচ্ছে।

পরদিন দোলা নিশীথের সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করলো। অবশ্য নিজে থেকে ব্যবস্থা করেছে বললে ভুল হবে। বুদ্ধি খাটিয়ে তূর্যকে দিয়ে নিশীথকে ডেকে আনার ব্যবস্থা করেছে। লোকেশন এলাকা পার হয়ে মেইনরোডের পাশের পার্ক। যেখানে রোজ সকালে আশেপাশের ছেলে-মেয়ে প্রৌঢ়া থেকে শুরু করে সবাই হাটতে আসে। কিন্তু তূর্য এসে জানায় নিশীথের দেখা করার সময় হবে বিকেল ৫টায়। অফিস থেকে ফিরে দোলার সাথে পার্কে দেখা করার জন্য ও রাজি হয়েছে। দোলার অবশ্য এতে অসুবিধে নেই, নিশীথ যে এভাবে হুট করে ডাকায় দেখা করতে রাজি হয়েছে এতেই ও আপাতত খুশি! তূর্যকে ধন্যবাদ দিয়ে দোলা অপেক্ষা করতে থাকে বিকেল হওয়ার।

গোধুলির আলোয় ছেয়ে আছে আকাশ। প্রকৃতিতে বইছে মৃদু মৃদু বাতাস। ঘড়ির কাটায় বিকেল তখন পৌনে পাঁচটা। দোলা রেডি হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। মা-কে বললো সন্ধ্যের মধ্যে ফিরে আসবে। পারভীন বেগমও কিছু বললেন না। পায়ে হেটে পার্কে পৌঁছাতে দোলার মিনিট দশেক সময় লাগলো। পার্কে এখন বেশ মানুষ। কোনো যুগল একত্রে হাটতে এসেছে তো কেউ ছোটবাচ্চাকে খেলতে নিয়ে এসেছে। গাছের উপর পাখিদের কিচিরমিচির আর পার্কের ভেতর মানুষের কলধ্বনিতে মুখরিত পরিবেশ।

কিছুদূর পরপর ছোট ছোট কয়েকটা বেঞ্চ বসানো আছে। ওখানে মানুষ বসে আছে। দোলা ফাকা দেখে একটি বেঞ্চে বসলো। নিশীথ হয়তো কিছুক্ষণের মাঝেই চলে আসবে। ততক্ষণ বসে বসে অপেক্ষা করবে। এমন মুখরিত পরিবেশে বসে থাকতেও ভালো লাগে। দোলার ক্ষেত্রেও তাই হলো। কিছুক্ষণের মাঝেই ওর মন ভালো হয়ে গেলো। চোখ বুজে বেঞ্চে হেলান দিতেই ক্রিং ক্রিং করে ফোন বেজে উঠলো। ভ্রু কুচকে চোখ খুলে স্ক্রিনে তাকাতেই নিশীথের নাম দেখে ভ্রুকুটি মিলিয়ে সমান হয়ে গেলো। দোলার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো হাসি। ফোন ধরতেই নিশীথ জিজ্ঞেস করলো ও পার্কের কোথায় আছে। দোলা জায়গা বলে দিতেই নিশীথ মিনিট দুয়েকের মাথায় সেখানে চলে এলো।

ক্লান্ত শরীরে ফরমাল গেটাপে হেটে আসা নিশীথের দিকে তাকাতেই দোলার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মুগ্ধতা খেলে গেলো। গোধুলির আলো আবছা পড়ছে ওর চোখমুখে। ফলে চোখমুখ কিছুটা কুচকে রেখেছে নিশীথ। ধূসর প্যান্টের সাথে কনুই অব্দি গোটানো কালো শার্ট বেশ মানিয়েছে ছেলেটার শুভ্র আবরণে।

দোলা কোথায় যেন পড়েছিলো, পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ ক্লান্ত শরীরে অফিস থেকে কাজ করে বাসায় ফেরা পুরুষ। আজ নিশীথকে দেখে দোলার সেই কথাকে সত্যি বলেই মনে হলো। দোলার নিকট আসতেই ওর চাহনি নিশীথের দৃষ্টিগোচর হলো। এ প্রথম নিজের প্রতি দোলার এমন মুগ্ধকর চাহনি নিশীথের অন্তরে অদ্ভুত প্রশান্তি জাগালো। তবে এটা ওর চোখেমুখে প্রকাশ পেলোনা। দোলাকে পরপর দু’বার ডাকতেও ওর চোখ সরছেনা দেখে নিশীথ ওর হাত ঝাকিয়ে ডাকলো,

—দোলনচাঁপা? শুনছো?
নিশীথের ডাকে দোলা ধ্যান থেকে বেরিয়ে আসে। এতক্ষণ নিশীথের দিকে হা করে তাকিয়ে ছিলো ধ্যানে আসতেই লজ্জায় মিইয়ে যায়। ইতস্তততা সামলে বলে,
—দাঁড়িয়ে আছেন কেন? টায়ার্ড নিশ্চয়ই? বসুন না!
—তুমি যেভাবে তাকিয়ে ছিলে বসার সময় আর পেলাম কই?

নিশীথ ফিরতি জবাব দেয়। দোলা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। ইশ, এভাবে না বললে কি হতোনা? কেন যে নিশীথ এরকম করে! দোলা লজ্জা ঢাকতে তড়িঘড়ি করে বেঞ্চে গিয়ে বসলো। নিশীথও চুপচাপ ওর দেখাদেখি বেঞ্চে চলে গেলো। পিঠ সটান হেলান দিয়ে চোখ বুজে দোলাকে বললো,
—কি বলার জন্য ডেকেছো জলদি বলো। অনেক টায়ার্ড আমি। বেশিক্ষণ থাকতে পারবোনা!
যদিও দোলা বুঝে নিশীথ সত্য বলছে তবুও বেশিক্ষণ থাকবেনা শুনে ওর খারাপ লাগলো। সে আর দেরি না করে মিনমিনিয়ে বললো,

—আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, নিশীথ। মা নিজে ছেলেকে পছন্দ করে বিয়ে পাকা করেছেন এবার।
দোলা মনে মনে আশা করলো, নিশীথ রেগে যাবে আগেকার মতো। এক্ষুনি হয়তো বলবে, কে ওই ছেলে? দেখাও আমাকে। ওকে আমি দেখে নিবো।
কিন্তু দোলাকে এক আকাশ সমান অবাক করে দিয়ে নিশীথ বললো

—তো? আমি কি করবো?
দোলার এবার মনে হলো, আজকের দিনের মতো বিস্মিত ও কোনোদিনই হয়নি। প্রথমে মা এত সহজেই কোনো আগামবার্তা ছাড়া ওর বিয়ে ঠিক করে নিলেন, এখন নিশীথ ওর বিয়ের কথা শুনেও এমন গা-ছাড়া রিয়েকশন দিচ্ছে! আজকে কি হচ্ছে ওর সাথে? দোলা বিস্ময় চেপে বলে,
—এভাবে বলছেন কেন?
নিশীথ চোখমুখ কুচকে বললো,
—কিভাবে বলছি, দোলনচাঁপা? আমি তো নরমাল কথা বললাম। তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে এটা তো ভালো কথা। তুমি আমায় কি করতে বলছো?

নিশীথের তরফ থেকে এমন ভাবলেশহীন জবাব শুনে এবার অপমানবোধে দোলার চোখে পানি আসা শুরু হলো। একই সাথে প্রবল হলো আক্ষেপ।অন্যদিক তাকিয়ে চোখ মুছে মুখ স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বললো,
—কিছু না। আপনি আসবেন আমার বিয়েতে। কেমন?
দোলার পরিস্থিতি বুঝে নিশীথ মনে মনে ভাবলো,
এই না হলো আমার দোলনচাঁপা! ভাঙবে তবু মচকাবে না? মেয়েটা সত্যিই অন্যরকম।
নিশীথ মুখে বললো,

—সরি, আমি ভীষণ বিজি আছি। প্লাস আমার পরিবার মেয়ে দেখছে আমার জন্য। কে জানে তোমার পাশাপাশি আমারও বিয়ে হয়ে যেতে পারে।
এবার দোলা নিশীথের চোখের দিক তাকালো। ওর বিয়ের কথা শুনে মাথায় এলো নিজের স্বপ্নের কথা। তবে কি ওর স্বপ্নটাই সত্যি হতে যাচ্ছে শেষমেশ? ওর নিশীথ কি সত্যিই অন্য কারও হবে? দোলার চোখে আবারও অশ্রুর ফোয়ারা নামে। তা লুকোতে বেঞ্চ থেকে উঠে পেছন ফিরে বলে,

—ওহ। যে মেয়েকে আংকেল পছন্দ করেছিলেন ওই মেয়ে বুঝি?
—হ্যাঁ। লিরার কথা বলেছিলাম কি তোমায়? ও খুব সুন্দর, জানো? ভাবছি রাজি হয়ে যাবো। এত সুন্দর মেয়ে প্লাস আমাদের ব্যাকগ্রাউন্ড এর। সবমিলিয়ে পারফেক্ট আমার জন্য! বাই দ্যা ওয়ে, তুমি কিভাবে বুঝলে?
নিশীথও কথা বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায়। উকি দিয়ে দোলার মুখ দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু মেয়েটা আরেকটু আড়াল হয়ে চোখের পানি মুছে যায় দ্রুত। ঘন ঘন পলক ফেলে বলে,

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৪২

—আপনি কেন এত বিজি ছিলেন কয়েকদিন এখন বেশ বুঝছি। যাই হোক, বিয়ের জন্য শুভকামনা রইলো। আসছি তবে?
শেষের কথাগুলো বলে দোলা আর নিশীথের জন্য অপেক্ষা করেনা। বরং, যত দ্রুত সম্ভব পার্ক ত্যাগ করে একপ্রকার দৌড়ে। নিজের ছুটে চলার তাড়ায় মেয়েটা একবারও পেছন ফিরে দেখেনা নিশীথের দিকে। যদি পেছন ফিরতো তবে দেখতো নিশীথের ঠোঁটের কোণে জ্বলজ্বল করতে থাকা প্রশস্ত হাসির রেখা!

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৪৪