দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৪১(২)

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৪১(২)
তাসফিয়া হাসান তুরফা

নিশীথ বিয়েতে রাজি হয়ে গেছে। দোলার বারবার প্রত্যাখ্যানের ফলে রাগ ও জি’দের বশে ও এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পুরো পরিবার নিশীথের সিদ্ধান্তে অবাক হলেও এ মুহুর্তে সবচেয়ে খুশি একটাই মানুষ- আয়মান তালুকদার। উনার বহু আকাংক্ষিত ইচ্ছা যে অবশেষে পূরণ হতে চলেছে! তাই এ শুভকাজে আর দেরি করা উচিত নয় বলে তিনি মনে করছেন। যদি পরে নিশীথের মন পাল্টে যায় তবে?

এজন্যই ঘরোয়া আয়োজনে কাল দুপুরে বাদ জুমা নিশীথ লিরার বিয়ে পড়ানো হবে! শুধুমাত্র দুই পরিবারের লোকজনদের নিয়ে হতে চলা ঘরোয়া এ অনুষ্ঠানের ব্যাপারে জানলোনা তেমন কেউ। তবু খবর পেয়ে গেলো নিশীথের বন্ধুমহল। ওরা যেমন অবাক হলো, একিসাথে নিশীথের জি’দ এর কাছে হেরে ওকে কোনোকিছু বুঝাতে ব্যর্থ হলো। সবচেয়ে চমকে গেলো তূর্য, কেননা নিশীথ ও দোলার প্রণয়ের অনেকটাই সে নিজ চোখে দেখেছে। কতো সময় তো ও নিজেই হেল্প করেছে ওদের প্রেমে! অথচ এখন কিনা শেষ মুহুর্তে এসে এরকম হবে? নিশীথকে বুঝাতে না পেরে তূর্য অন্য ফন্দি আটলো। ও চলে গেলো দোলার কাছে। দরজা খুলে তূর্যকে দেখে দোলা অবাক হলো। তূর্য বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—একটু বাইরে আসবেন প্লিজ? অনেক জরুরি কথা আছে আপনার সাথে।
দোলনচাঁপা অবাক হলো। তূর্য কখনো আসেনি এভাবে ওর সাথে কথা বলতে। আজ এসেছে যখন তার মানে নিশ্চয়ই জরুরি কিছু বলতেই এসেছে! নিশীথের কিছু হয়নি তো? দোলা মা-কে বলে তূর্যর সাথে বাইরে গেলো। বাসার বাইরে আসতেই তূর্য দোলাকে সব বলে দিলো। নিশীথ কিভাবে রাগের বশে লিরার সাথে বিয়েতে রাজি হয়েছে, কারও কথা শুনছেনা সবটাই ওকে বলে দিলো। সব শুনে দোলনচাঁপা আকাশ থেকে পড়লো! এ কোন নিশীথের কথা শুনছে সে? নিশীথ এমনটাও করতে পারে? অতি শোকে দোলা কথা বলতে ভুলে গেলো। চুপচাপ হতবিহ্বলের ন্যায় চেয়ে থাকার মাঝেই তূর্য আবারো বললো,

—ভাবি, এখন আপনিই কিছু করেন। আমরা ভাইয়ের বউ হিসেবে আপনাকেই মেনে নিয়েছি। আপনি ছাড়া আমরা আর কাউকেই ভাবি হিসেবে মানতে পারবোনা। প্লিজ ভাইয়ের সাথে বিয়েতে রাজি হয়ে যান! আমরা সবাই আপনাদের বিয়েতে সাক্ষী হবো। আয়মান আংকেলও জলদিই মেনে নিবে। তবু প্লিজ এ অঘটন ঘটতে দেবেন না!
দোলা পাথরের ন্যায় চেয়ে রইলো। ও কি করবে না করবে কিছুই বুঝতে পারলোনা। শুধু বুঝলো, নিশীথ ওর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে।

এতটাই দূরে যে এখন আর চাইলেও ও আগের নিশীথকে ফিরে পাবেনা! স্তব্ধপায়ে হেটে বাসার বাইরে বেরোতেই দোলা নিশীথকে দেখলো। তবে নিশীথের ওর দিকে ধ্যান নেই আজ! সে তো ব্যস্ত হাসিমুখে ফোনে অন্য কারও সাথে কথা বলতে। দোলার মনে প্রশ্ন এলো, আচ্ছা! ও কি ওই মেয়েটার সাথে কথা বলছে? নাম কি যেন মেয়েটার? ওই লিরার সাথে!

কষ্টে, হিংসায় দোলার রন্ধ্রে আ’গুন লাগলো। তনুমন জ্ব’লে গেলো! বারবার শুধু মনে হলো, এতদিন যে নিশীথ শুধু ওর ছিলো, যে ওকে এক পলক দেখার জন্য এতটা পাগলামি করতো, কাল থেকে সেই নিশীথ অন্য কারও হয়ে যাবে! জীবন এত স্বার্থপর কেন? যদি ক্ষণিকের মোহ হয়েই আসার ছিলো তবে কেন সবকিছু এত করে ওকে টানতো? দুঃখে, ক্রোধে দোলার চিৎকার করতে কান্না পেলো। মাথার মধ্যে ভীষণভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে সবকিছু। চোখে ঘোলা দেখছে ও। আর কিছু বুঝবার আগেই দোলা মাথা ঘুরে পড়ে গেলো!

মুখমণ্ডল ঘেমে-নেয়ে একাকার দোলার। কপালের রগগুলোও ইষত ব্যাথায় দপদপ করছে যেন! বিছানা থেকে উঠে বসে আশেপাশে তাকাতেই সে উপলব্ধি করলো যে, এতক্ষণ ও যা দেখলো তার সবটুকুই একটা স্বপ্ন ছিলো! মায়ের সাথে কথা শেষে আরও কিছুক্ষণ ঘুমানোর উদ্দেশ্যে একটু শুয়েছিলো মেয়েটা অথচ এই চোখ লাগার বিনিময়ে ও কি দেখলো? সাধারণ ভাষায় বলতে গেলে যেটা শুধুমাত্র একটি দুঃস্বপ্ন! কিন্তু দোলার কাছে যেন এ দুঃস্বপ্নই ছিলো ওর জীবনের সবচেয়ে তিক্ত অনুভূতি।

সবকিছু এতটা বাস্তব, এতটা কল্পনাতীত লেগেছে যে দোলা এখনো একপ্রকার ঘোরে আছে যে কি থেকে কি হয়ে গেলো একটু আগেই! ভাগ্যিস ঘুমটা ভেঙেছিলো। নয়তো নিশীথের বিয়ে হওয়াটা কিভাবে সহ্য করতো ও? হোক স্বপ্ন৷ তবুও আর দশটা প্রেয়সীর মতোন অন্য কারও সাথে প্রিয়তমের বিয়ের কথা দোলা কখনোই ভাবতে চায়না, এমনকি সেটা ওর দুঃস্বপ্নেও না!

একিসাথে মেয়েটা উপলব্ধি করলো, এই স্বল্পক্ষণেই নিশীথের প্রতি ওর অনুভূতিগুলো কতটা গাঢ় হয়ে গেছে! ফলে দোলার মন গললো। ও নিশীথের সাথে কথা বলতে চাইলো। হাত বাড়িয়ে বিছানার পাশ থেকে ফোন হাতে নিয়ে নিশীথের নাম্বারে ডায়াল করলো। দোলার মনে এখন একটাই ভয়, নিশীথ যদি আসলেই রাগ ও জিদের বশে লিরাকে বিয়ে করতে রাজি হয়?

নিশীথ ফোন ধরলোনা। উল্টো কিছুক্ষণ রিং হতেই কেটে দিলো কল। দোলা বিস্মিত হলোনা, ও বুঝে নিশীথ রেগে আছে। কিন্তু ও যে রাগ ভাঙানোর জন্যই নিশীথকে ফোন দিয়েছিলো এ কথা ওকে বুঝাবে কে? দোলা মনে মনে হতাশ হয়! আরও কিছুক্ষণ কল দেওয়ার চেষ্টা করতেই এক পর্যায়ে নিশীথ ফোন অফ করে দেয়। দোলার মন খারাপ হয়। এবার কিভাবে যোগাযোগ করবে নিশীথের সাথে বসে বসে ভাবতে থাকে। ও যে নিশীথকে বিয়ে করতে রাজি তা ছেলেটাকে কিভাবে বুঝাবে?

পরদিন তালুকদার বাড়িতে গোল টেবিল বৈঠক বসেছে। নিশীথ সকালে নাস্তা করে বেরিয়েছে, বাসায় আসেনি এখনো। ডাইনিং টেবিলে বসা সদস্যদের মাঝে আজকের আলোচনার বিষয় নিশীথের বিয়ে। বাড়ির প্রৌঢ় ব্যক্তি হিসেবে ইউনুস সাহেব নিজের মত প্রকাশ করলেন ছেলেদের সামনে। সোজাসাপটা কণ্ঠে বললেন,
—এ বাড়ির বউ ও আমার নাতবৌ হিসেবে দোলনচাঁপাকে আমার পছন্দ হয়েছে। আমার মনে হয় আয়মান বাদে বাকি সবারও একি মতামত, কি বলিস তোরা?
আরেফিন সাহেব মাথা নাড়লেন। সায় দিয়ে বললেন,

—হ্যাঁ আব্বা। ঠিক বলেছেন আপনি। আমারও মেয়েটাকে এক দেখাতেই ভালো লেগেছে। নিশীথের পছন্দের তারিফ করতে হয়!
ছোটছেলের কথায় ইউনুস সাহেব হাসলেন। আসমা বেগমের দিকে চেয়ে বল্লেন,
—বৌমা, নিশীথের মা হিসেবে তোমার মতামতও অতি প্রয়োজন। তোমার কি মনে হয় নিশীথের বউ হিসেবে দোলনচাঁপা কেমন? তোমার ভালো লেগেছে মেয়েটাকে?
হঠাৎ নিজের নাম শুনে আসমা বেগম চারদিকে তাকিয়ে মাথা নোয়ান। নিচু গলায় বললেন,

—আমার মতামত শুনে আর কি হবে, আব্বা? ছেলে আমার তার জন্য পছন্দ করে রেখেছে। শেষ মুহুর্তে এসে আমাদের জানালো। এবার আমাদের পছন্দ-অপছন্দ দিয়ে কি করবো? নিশীথকে আপনি চেনেন না? ওর পছন্দ হয়েছে মানে এখন দুনিয়া উল্টে গেলেও ওর যায় আসবেনা।
আসমা বেগমের ঘুরানো প্যাচানো উত্তরে ইউনুস সাহেব অসন্তোষ প্রকাশ করলেন। ভ্রু কুচকে বললেন,
—কি বলতে চাইছো তুমি? দোলনচাঁপাকে তোমার পছন্দ হয়নি?
আসমা বেগম মাথা নেড়ে বললেন,

—মেয়েটার মাঝে অপছন্দ হওয়ার মতো কিছুই নেই। অন্তত প্রথম দেখায় তো যেকারোই ভালো লাগবে ওকে। আমারও ভালো লেগেছে। তবে ছেলে আগে থেকে কোনোকিছু না জানিয়ে হুট করে এভাবে বিয়ের কথা বলে মেয়ে দেখালো তাই একটু কষ্ট পেয়েছি, এই আর কি! অন্য কিছু না!
এবার ইউনুস সাহেব বুঝলেন তার মনোভাব। এজন্য নিশীথের মুখে দোলনচাঁপার কথা শুনার পর থেকে এমন চুপচাপ আছেন! মায়ের এ মনোভাবের ব্যাপারে নিশীথকে জানাতে হবে, উনি মনে মনে ভাবলেন। এর মাঝে আয়মান সাহেব মুখ খুললেন। তাচ্ছিল্য করে বললেন,

—মেয়েটার বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখেই গলে হেছে নিশীথ। এই ছেলেটা আমার সারাজীবন এমন বোকামি করে গেলো। ভেবেছিলাম অন্তত বিজনেসে জয়েন দেওয়ার পর থেকে একটু লাভ-লসের ব্যাপারে চিন্তা করতে শিখবে অথচ এখনো আগের মতোই রয়ে গেলো!
—বিয়ে কোনো ছেলেখেলার বিষয় নয়, আয়মান। না এটা কোনো বিজনেস ডিল যে এখানে মানুষ লাভ-লস দেখবে। সারাজীবন ব্যবসা করতে করতে তুই যান্ত্রিক হয়ে গেছিস। তোর অনুভূতি মরে গেছে। এজন্যই তুই নিশীথের দিকটা বুঝতে পারছিস না! একে-অপরের প্রতি ভালোবাসা ছাড়া আর যাই হোক, বিয়ের মতো সম্পর্ক টিকেনা। এ দিকটা তোর ভাবার দরকার আছে!

এতক্ষণ গম্ভীর মুখে থাকলেও বাবার কথা শুনে এবার আয়মান সাহেবের মুখে ফুটে উঠলো রহস্যময় হাসি। চোখেমুখে ছেয়ে গেলো অদ্ভুত তিক্ততা। যেন অতীতের কিছু মনে করছেন সেভাবে মাথা নেড়ে তাচ্ছিল্য করলেন! কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বললেন,

—তুমি এ কথা বলছো, আব্বা? আজ নাতির প্রতি ভালোবাসায় তুমি অন্ধ হয়ে গেছো বলে নিজের…
—অনেক বলেছিস তুই। চুপ কর এখন। সব জায়গায় সবকিছু বলতে হয়না তোর মাথায় রাখা উচিত ব্যাপারটা!
ছেলেকে থামিয়ে দিয়ে কঠোরভাবে বলে উঠলেন ইউনুস সাহেব। আয়মান সাহেব ফোস করে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে আশেপাশে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেলেন। বড় এক শ্বাস ছাড়লেন ইউনুস সাহেব নিজেও। অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে সবার উদ্দেশ্যে বললেন,

—যেহেতু আয়মান বাদে আমাদের সবারই দোলনচাঁপাকে এ বাড়ির বউ হিসেবে পছন্দ, সুতরাং আমাদের এ ব্যাপারে অগ্রসর হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। কারণ, নিশীথকে আমরা সবাই চিনি। ও নিজের ইচ্ছার বাইরে কোনোকিছু করেনা এটা জানা কথা। ও যখন বলেছে ও শুধু দোলনচাঁপাকেই বিয়ে করবে, তার মানে যেভাবেই হোক না কেন নিশীথ ওকেই বিয়ে করবে!

ছেলেমেয়ে দুজনই এডাল্ট, এখন মাঝখান থেকে আমরা রাজি না হলে ওরা যদি আলাদা ভাবে নিজেরা বিয়ে করে নেয় তবে খামোখাই দু’পরিবারের বদনাম হবে! তাই আমার মনে হয় কাল-বিলম্ব না করে আমাদের দোলনচাঁপার মায়ের সাথে এ বিষয়ে বসে কথা বলা উচিত! যত দ্রুত ওদের বিয়ে দেওয়া যায় তত ভালো হবে! আয়মান, আমার মনে হয় এ ব্যাপারে তোর কোনো আপত্তি নেই। কি বলিস?

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৪১

উনার কথায় ডাইনিং এ বসা সকলেই মাথা নেড়ে সায় দিলো। আয়মান সাহেব সব দেখে টেবিল থেকে উঠে দাড়ালেন। চেয়ার ছেড়ে যেতে যেতে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন,
—যা মন চায় করো!
ইউনুস সাহেব তৃপ্তির হাসি হাসলেন। যাক, এবার বেপরোয়া তার নাতিকে ঘরে টেনে আনার ব্যবস্থা করা যাবে!

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৪২