দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৪১

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৪১
তাসফিয়া হাসান তুরফা

বাসায় ফিরে নিজের রুমে ঢুকে সারারাত দোলা কেটে কাটিয়েছে৷ ফলস্বরূপ নিদ্রাহীন ফোলা ফাপা চোখের নিচে কালি জমেছে বেশ। ঘড়ির কাটায় বাজে ১১টা। অথচ এখনো দোলা বের হলোনা রুম থেকে। ব্যাপারটা পারভীন বেগমকে চিন্তায় ফেলে দিলো। তার মেয়ে সকাল সকাল উঠে পড়ার মানুষ। “আর্লি টু বেড, আর্লি টু রাইজ” প্রবাদটাকে ছোট থেকেই অনুসরণ করে মেয়েটা। ফলে, শিমুল ও কামিনির মতো অলস নয় ও। ঘুমোবে যেমন তাড়াতাড়ি আবার উঠবেও সকাল সকাল। সেই মেয়ের এমন বেলা করে উঠায় মায়ের মনে খটকা লাগলো! তার দোলনের শরীর খারাপ হয়নি তো?

চিন্তাগ্রস্ত পায়ে হেটে দোলাত রুমের দরজা খুলতে যেয়ে পারভীন বেগম দেখেন দরজা ভেতর থেকে লক করা। এবার তার আরেকটু খটকা লাগলো। দোলা সাধারণত কখনোই দরজা এভাবে লক করে ঘুমায়না। তবে আজকে এসব অদ্ভুত আচরণের মানে কি? হয়েছেটা কি ওর? একরাশ চিন্তা নিয়ে মেয়ের দরজায় জোরে জোরে ধাক্কিয়ে নক করলেন তিনি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দোলা মাটিতে বসে খাটে মাথা দিয়ে ঘুমোচ্ছিলো। মূলত ভোরের আলো ফোটার পর কাদতে কাদতে কখন যে ওভাবে ওখানে ঘুমিয়ে গেছে ও নিজেও বুঝেনি। আর ঘুমোতে সকাল হয়ে যাওয়ায় এখনো ও ঘুমে মগ্ন। এদিকে পারভীন বেগম একনাগাড়ে দরজা ধাক্কিয়েই যাচ্ছেন, ফলে কিছুক্ষণের মাঝেই দোলার কানে আওয়াজ এলো।
দোলা স্তম্ভিত ফিরে পেতেই নিজের অবস্থান দেখে চমকে উঠলো। কিছুক্ষণের মাঝেই মনে পড়লো সমস্ত ঘটনা। এক ঝটকায় মাটি থেকে উঠে দাড়াতেই শরীর ঝিমঝিম করে উঠলো। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই আঁতকে উঠলো। কিন্তু এখন কিছু করার নেই, মা সমানে ডেকেই চলছেন। দোলা ঘুম ভাংগা কণ্ঠে জবাব দিলো,

—দুই মিনিট দাও, মা। দরজা খুলছি!
এতক্ষণে মেয়ের আওয়াজ পেয়ে পারভীন বেগম কিছুটা শান্ত হলেন। ডাকাডাকি বন্ধ করে অপেক্ষা করলেন ওর জন্য। দোলা চটপট ফ্রেশ হতে চলে গেলো। মুখে একনাগাড়ে পানি দিয়ে চোখমুখের বেহাল দশা কমানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো।

খানিকবাদে বেরিয়ে দরজা খুলে মা-কে দেখে ইতস্তত হেসে রুমে ঢোকার জায়গা করে দিলো। পারভীন বেগম একবার মেয়ের দিকে তো একবার রুমের আশেপাশে নজর বুলিয়ে দেখলেন। দোলার বিমুঢ় প্রাণহীন চেহারা দেখেই তার কলিজা শুকিয়ে এলো! অর্থাৎ, তার মনে এমনি এমনি কু ডাকেনি। কিছু একটা দুঃসংবাদ নিশ্চয়ই আছে। তাই তিনি আর দেরি না করে মেয়েকে নিয়ে খাটে বসলেন। দোলা মায়ের চোখের দিকে তাকাতে পারছেনা। বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে নিচু হয়ে আছে শুধু। এরই মাঝে পারভীন বেগমের যা অনুমান করার তিনি করে নিলেন। মেয়ের গালে হাত রেখে কণ্ঠ কোমল করে বললেন,

—কি হয়েছে আমার সোনা মেয়েটার? চোখমুখের এই অবস্থা কেন, মা?
ব্যস! মায়ের মধুর ডাকে এবার দোলনচাঁপার সংযমে ভাটা পড়লো। এতক্ষণ বুকের মাঝে চাপিয়ে রাখা কষ্ট বাধভাঙ্গা নদীর মতো কলকল করে বেরিয়ে এলো। হু হু করে কেদে মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে নীড়হাড়া পাখির মতোন আশ্রয় খুজলো মায়ের বুকে। পারভীন বেগম পরম মমতায় মেয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে নিরব সান্ত্বনা দিলেন। কেদে মন হালকা করার সুযোগ দিলেন। খানিকবাদে দোলা সামান্য থামতেই উনি সুযোগ বুঝে প্রশ্ন করলেন,

—নিশীথের পরিবার রাজি হয়নি, তাই না?
দোলা মায়ের বুকেই মাথা নেড়ে জানালো “না”। পারভীন বেগম নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। উনি মনে মনে যে ভয়টা পাচ্ছিলেন দেখা গেলো শেষমেশ সেটাই হলো! তার ফুলের মতো মেয়েটার মন ভেঙে গেলো! তবু মায়ের মন, কি করে মেয়ের কষ্ট দেখেন? দোলার মন ভোলাতে জিজ্ঞেস করলেন,

—নিশীথ আর কিছু বলেছে? যে ওর কোনো চিন্তাভাবনা আছে কিনা। নাকি সে-ও পরিবারের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে?
দোলা এবার মাথা তুললো। সোজা হয়ে বসে হাত দিয়ে চোখ মুছে নাক টানতে টানতে বললো,
—উনি তো পাগল। বলছিলেন পালিয়ে বিয়ে করতে! যেন সবকিছু এতই সোজা?
কথাটা বলে দোলার একটু হাসি পেলো নিশীথের তখনকার অবস্থা মনে পড়ে! কিন্তু মায়ের সামনে ও নিজেকে হাসা থেকে বিরত লাগলো। এরই মাঝে পারভীন বেগম একটু হাসলেন। হেসে বললেন,

—ভালোই বলেছে তো। ভালোবাসার মানুষের সাথে পরিবার বিয়ে না দিলে সে বেচারাও আর কি-ই বা বলবে? তা কবে বিয়ে করছিস তোরা?
মায়ের কথায় দোলা প্রচন্ড অবাক হয়ে গেলো। এতটাই যে কিছুক্ষণ হা করে চেয়ে রইলো মায়ের মুখপানে। বিস্ময়ের সাথে বললো,

—কিহ! ভালো বলেছে মানে? তুমি এ কথা বলছো, মা? আমি জাস্ট ভাবতে পারছিনা!
খানিকটা থেমে বললো,
—আর আমরা যদি পালিয়ে বিয়ে করি তবে কতকিছু হবে তুমি ভাবতে পারছো?
—কি হবে?

পারভীন বেগমের ভাবলেশহীন জবাব। দোলা ভড়কে যায়। থতমত খেয়ে মা-কে ওসব কথাই বলে যা ও নিশীথকে বলে এসেছে কাল রাতে। পারভীন বেগম মনোযোগ দিয়ে সব শুনেন। শুনে গম্ভীর হয়ে মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
—তোর কি নিশীথকে ভালো লাগে?
দোলা তাকাতেই উনি জোর গলায় বললেন,
—হ্যাঁ নাকি না? স্পষ্ট জবাব দিবি এবার আমাকে!

দোলা চুপচাপ হ্যাঁ-বোধক মাথা নাড়ে। পারভীন বেগম প্রসন্ন হোন। কিছুক্ষণ কিসব ভেবে মেয়েকে বললেন,
—তোর একটা বিয়ে ভেঙে গেছে। সমাজে এমনিতেই মানুষ তোকে নিয়ে কম কথা বলছেনা। সেটা তুই নিজেও জানিস। রাকিবের দোষ থাকা সত্ত্বেও একটাবার তুই দেখেছিস কেউ ওকে দোষারোপ করেছে? উল্টো আমাদের আত্মীয়দের মাঝেই মানুষ তোকে নিয়ে খারাপ কথা বলছে। তাহলে নিশীথ যখন সাহস করে তোকে বিয়ে করে তোর দায়িত্ব নিতেই চাইছে তখন তুই এভাবে পিছপা হচ্ছিস কেন এ সম্পর্ক থেকে?

দোলা থমথমে মুখে শূন্যে চেয়ে রয়। মা যে নেহাৎ মিথ্যে কথা বলছেন তা-ও নয়। বরং নিশীথের সাথে পারিবারিক ভাবে বিয়ে হলেও যাদের ওকে নিয়ে বাজে কথা বলার ওরা ঠিকি বলে যাবে। ওদের তো থামাতে পারবেনা। তবে কেন ওদের জন্য শুধু শুধু নিজের সুখ-শান্তি নষ্ট করবে ও? এরই মাঝে পারভীন বেগম আবারও বললেন,

—আমি তোকে পালিয়ে বিয়ে করতে উৎসাহ দিচ্ছি এমনটা ভাবিস না। আমি নিজেও কোনোদিন চাইনি আমার কোনো মেয়ে পালিয়ে বিয়ে করুক। কিন্তু তোর পরিস্থিতি ভিন্ন৷ নিশীথ তোকে প্রচণ্ড ভালোবাসে আর আমি জানি মনে মনে তুই নিজেও নিশীথকে ভালোবেসে ফেলেছিস। তাই তোদের পরিস্থিতিতে যদি একেবারেই কিছু সম্ভব না হয় তবে পালিয়ে বিয়ে করা ছাড়া উপায় নেই।

—উনার পুরো পরিবার রাজি, মা। শুধু তার বাবা ছাড়া। কিন্তু নিশীথ বললেন উনি আংকেলকে রাজি করাতে পারবেন না, তিনি নাকি সুবিধার না। তিনি অন্য মেয়ের সাথে নিশীথের বিয়ে ঠিক করতে চাইছেন। এজন্যই আমায় নিয়ে রাজি হচ্ছেন না!

—তাহলে দেখ কিছুদিন কি হয়। আমি তাড়াহুড়োর কথা বলছিনা। তবে এক্ষেত্রে আমি নিশীথের পক্ষে। আর আমার এসব বলার পেছনে যথাযথ কারণও আছে৷ শোন দোলা, নিশীথ যতই তোকে ভালোবাসুক না কেন দিনশেষে ও কিন্তু একটা ছেলেমানুষ। তুই যদি এখন পাত্তা না দিস বা সম্পর্ক ভেঙে দিস তবে তুই হয়তো সহজে ওকে ভুলতে পারবিনা। কিন্তু নিশীথ যদি একবার বাপের কথায় বিয়ে করে নেয় তবে ওর মুভ অন করতে সময় লাগবেনা। তোর কি সেটা ভালো লাগবে? ভেবে বল তো!

এবার দোলার টনক নড়লো। মনে মনে নিশীথের সাথে অন্য মেয়েকে কল্পনা করতেই ওর প্রেমিকা মনে মেয়েলি হিংসা জাগ্রত হলো তীব্রভাবে। কল্পনা থেকে বেরিয়ে আসতেই দোলার চোখমুখ শক্ত হলো, ফর্সা নাকের ডগা লাল হলো। সে তো এভাবে ভাবেইনি? নিশীথ অন্য কারও হলে কি ও সইতে পারবে? একদম পারবেনা। এবার মন ও মস্তিষ্কের লড়াইয়ে দোলা বিভ্রান্ত হয়ে গেলো।

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৪০

মস্তিষ্ক বলছে, এভাবে বিয়েটা করা উচিত হবেনা। পাছে লোকে কি বলবে?
অন্যদিকে মন বলছে, নিজের মানুষকে কাছে পেয়ে যদি একটু কটু কথা শুনতেই হয় তবে ক্ষতি কোথায়?

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৪১(২)