দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৪০

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৪০
তাসফিয়া হাসান তুরফা

দোলার দুঃখ ভারাক্রান্ত চেহারা দেখে নিশীথ মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ও জানতো দোলা এমনই রিয়েক্ট করবে। এটা নিতান্তই স্বাভাবিক, ওর জায়গায় অন্য কেউ হলেও এভাবেই রিয়েক্ট করতো। নিশীথ ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কিছু বলতে যাবে এমন সময় দোলা বেশ শান্ত কণ্ঠে বললো,

—মানা করেছে এটা সরাসরি বললেই পারতেন। ফোনে অযথা নাটক করলেন কেন?
নিশীথ চুপ রইলোনা। স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
—নাটক কই করলাম? মিথ্যে কথা তো বলিনি তোমায়। বাবা মানেনি তো কি হয়েছে? আমাদের বিয়ে তো হবেই। তাই বিয়ের শপিং করতে বলেছি। এখানে নাটকের কি দেখলে?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দোলা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে হাওয়ায় মাথা নাড়লো। এ লোকটা এখনো এসব বলছে? বাবার থেকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান পাওয়ার পরেও? কিভাবে সম্ভব এতটা আত্মবিশ্বাস! দোলা নিশীথকে বুঝতে পারেনা! এই ছেলেটা একেবারেই অন্যরকম। কিন্তু দোলা বাস্তববাদী মেয়ে, ও বুঝে শুরুতেই এমন প্রত্যাখ্যান মানে ওদের বিয়েটা আর দশটা বিয়ের মতো স্বাভাবিকভাবে হবেনা। কোনোমতে বিয়ে হলেও তাতে ঝামেলা হবেই। তাই ও বরফের ন্যায় শীতল কণ্ঠে বললো,

—বাবা-মা রাজি না হলে বিয়ে কিভাবে হয়, নিশীথ?
—কেন? মানুষ কি পালিয়ে বিয়ে করেনা? আমরাও করবো!
দোলা অসন্তুষ্টিতে ভ্রু কুচকায়। মাথা দু’পাশে নাড়িয়ে বলে,
—এটা ঠিক নয়। প্রত্যেকটা বাবা-মায়েরই নিজের সন্তানদের বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন-আকাংক্ষা থাকে! আপনার বাবা-মায়েরও নিশ্চয়ই আছে? সেখানে উনাদের না জানিয়ে পালিয়ে বিয়ে করলে তারা অনেক কষ্ট পাবেন।
নিশীথ বিরক্ত হয়। এ মেয়ে চাইছে কি? তবে কি ও বিয়ে করতে চায়না? নিশীথ মনের প্রশ্ন ভেতরে চেপে রাখেনা। শক্ত কণ্ঠে সরাসরি দোলাকে শুধায়,

—তবে কি বলতে চাইছো? আমরা এখানেই থেমে যাবো? আমাদের সম্পর্ক কোনো পরিণতি পাবেনা?
দোলা মাথা নামায়। সে নিজেও এমনটা চায়না। ও মন থেকে চায় ওদের দুজনের সম্পর্কটা পরিণতি পাক এবং সেটা দুই পরিবারের সম্মতি নিয়েই। কিন্তু এখন পরিস্থিতি এমন হওয়ায় কি বলা উচিত দোলা নিজেও জানেনা। তাই ও তর্কে না গিয়ে নিশীথকে বুঝানোর জন্য সুন্দরমতোন বললো,

—আমি তো সেটা বলিনি। কিন্তু এর মানে এই নয় যে আমাদের পালিয়ে বিয়ে করা উচিত। বিষয়টা আপনার-আমার কারও পরিবারই ভালো চোখে দেখবেনা। উল্টো দেখা যাবে সম্পর্কগুলো আরও তিক্ত হয়ে যাচ্ছে! একটা নতুন সম্পর্ক সবার দোয়া ও ভালোবাসা দিয়ে শুরু করা উচিত, নিশীথ। কারও অভিশাপ ও অনিচ্ছায় নয়!

নিশীথের প্রচন্ড রাগ হলো। তবে তা দোলার উপর নয়। রাগটা হলো পরিস্থিতির উপর! কেন তাদের সম্পর্কে এত বাধা? যেখানে ছেলেমেয়ে রাজি সেখানে একটা নিছক পারিবারিক সম্মতির জন্য কেন ওরা এক হতে পারবেনা? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো! কিন্তু উত্তর পেলোনা। সমাজে যুগ যুগ ধরে এমনটাই হয়ে আসছে। সকলের বিয়ে এভাবেই হয়। তাই না চাইতেও সে দোলার কথা অস্বীকার করতে পারছেনা। রাগে-বিরক্তে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে নিশীথ গাড়ির সিটে ঘু’ষি মারে সজোরে। দোলা চমকে উঠে। নিজেকে ধাতস্থ করে নিশীথের হাত টেনে এনে বলে,

—আশ্চর্য! আপনি এমন করছেন কেন? নিজের উপর রাগ ঝেড়ে কি কিছু হবে?
—তো কার উপর রাগ ঝাড়বো? তোমার উপর?
নিশীথ রাগের সহিত বলে উঠে। পরক্ষণেই আহত কণ্ঠে নিজে নিজেই বলে,
—কিন্তু সে অধিকারটাও তো আমার নেই!

দোলার কষ্ট হয় নিশীথের কথা শুনে। কিন্তু ও কি বলবে? কোন ভাষায় সান্ত্বনা দিবে ওকে? ওর হাতেও যে কোনোকিছু নেই। নিশীথের কথার বিপরীতে দোলা কোনো জবাব দেয়না। কিছুক্ষণ নিজের মতোন চিন্তাভাবনা করে। অতঃপর নিশীথকে ডাকতেই ও সাড়া দেয়। দোলা ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করে,

—আপনি কি জানেন আমি কেন পালিয়ে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছিনা?
নিশীথ মাথা নাড়ে। অর্থাৎ, সে জানেনা। যদি দোলার ওকে বিয়ে করতে কোনো অসুবিধাই না থাকে তবে কেন এত আপত্তি? নিশীথ জানতে চায়। ও দোলার হাত ধরে বলে,
—আমায় জানাও, দোলনচাঁপা। তোমার রাজি না হওয়ার পেছনের প্রত্যেকটা কারণ আমাকে জানাও!
নিশীথের আগ্রহে দোলা ভরসা পায়। নিজেকে গুছিয়ে বলতে শুরু করে,

—এ সমাজে মেয়েদের দোষ বেশি। কথাটা তিক্ত শুনালেও এটাই সত্যি। আমি অনাথ মেয়ে। আল্লাহ আমাদের যেটুকুই দিয়েছেন আমরা তাতে চলতে পারলেও আপনাদের তুলনায় আমাদের নিতান্তই কিছু নেই। আপনার সাথে আমার যায়ন…

দোলা কথা শেষ করার আগেই নিশীথ ওর চোয়াল চেপে ধরে এক হাতে। বিস্ময়ে দোলা তাজ্জব বনে যায়। গোলগোল চোখে তাকিয়ে রয় নিশীথের পানে। কিন্তু নিশীথ সেদিকে পাত্তা দেয়না। ওর দু’চোখে ক্রো’ধ। ওকে দেখে মনে হচ্ছে যেন দোলা বড়সড় কোনো অপরাধ করে ফেলেছে এবং সে তা মেনে নিতে পারছেনা। দোলার গাল চেপে ধরা অবস্থাতেই নিশীথ হিংস্র কণ্ঠে বলে,

—তোমার সাহস হলো কিভাবে এসব কথা বলার? আমাকে তুমি এমন ভাবো? কোনোদিন আমার কোনো কথায় বা আচরণে তোমার মনে হয়েছে আমি তোমাকে ওই চোখে দেখি?
দোলা না-বোধক মাথা নাড়ে। তবু নিশীথ শুনেনা। ও আবারো বলে,
—এ কথাটা মানুষ আমায় বললেও যতটা কষ্ট পেতাম আজ তোমার থেকে শুনে তার চেয়েও হাজারগুণ বেশি কষ্ট পেয়েছি, দোলনচাঁপা।

নিশীথ দোলার মুখ থেকে হাত ছেড়ে দেয়। দোলা হা করে শ্বাস নেয় কিছুক্ষণ। নিজের গাল ডলতে ডলতে বলে,
—পুরো কথা না শুনেই রিয়েক্ট করেন কেন?
—যেটুকু বলেছো তাতেই মাথায় আগু’ন লেগেছে। পুরোটা শুনলে যে কি হতো আল্লাহ মালুম!
দোলা হতাশ হয়। এ লোকের সাথে কথায় পারা যাবেনা! গমগমে কণ্ঠে বলে,
—আমি যে কথাগুলো বলছিলাম ওগুলো আমার কথা নয়। তথাকথিত সমাজের মানুষের কথা। আপনি নিজেই চিন্তা করুন? মানুষ তো এসবই বলে। এমন অবস্থায় যদি আমরা দুজন পালিয়ে বিয়ে করি তবে সবাই কাকে দোষ দিবে বলুন তো?
নিশীথ নিরবে চেয়ে রয়। কোনো জবাব দেয়না। দোলা আবারো বলে,

—তখন সব দোষ হবে আমার। মানুষ বলবে আমিই আপনাকে ফাসিয়েছি। এ কারণেই পরিবারের অমতে আমাদের পালিয়ে বিয়ে করতে হয়েছে। একই এলাকায় থাকায় আমাদের এখানে থাকাও কঠিন হয়ে যাবে। আর..
—তোমার কি মনে হয় আমি মানুষের কথার পরোয়া করি?
—আমি জানি আপনি করেন না। কিন্তু আপনার পরিবার করে, আমার পরিবার করে।
—আমার পুরো পরিবার আমাদের সম্পর্কে রাজি, শুধু বাবা বাদে। উনাকে অনেক বুঝানোর ট্রাই করেছি তবুও তিনি নিজ জিদে অটল। কারণ ছেলের খুশির চেয়ে বিজনেসের লাভ তার কাছে বড়!
নিশীথ তাচ্ছিল্যের সাথে বলে। দোলা খামখেয়ালি ভাবে উত্তর দেয়,

—উনি কেন রাজি নয় আমি জানিনা। তবে আমি এতটুকু জানি যে, নিজেদের স্বার্থের জন্য আমরা মা-বাবাকে কষ্ট দিতে পারিনা। অন্য কারও কথা না ভাবলেও অন্তত তাদের সন্তুষ্টির কথা আমাদের ভাবা উচিত, নিশীথ।
—আর আমরা নিজেরা যে কষ্ট পাচ্ছি সেটার কি, দোলনচাঁপা? আমাদের খুশির কোনো মূল্য নেই?
এবার দোলা চুপ হয়ে যায়। জবাব দিতে পারেনা। তবে অন্ধকারে ওর চোখের কোণ ছলছলে হয়। যা ও নিশীথকে দেখাতে চায়না। উঠে যাবার বাহানা দিয়ে বলে,

—ভীষণ রাত হয়ে গেছে, নিশীথ। আমার এখন যেতে হবে। মা উঠে গেলে সমস্যা হবে।
আজ নিশীথও জোর করলোনা। দোলা নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো। দরজা লাগিয়ে দিয়ে সামনে অগ্রসর হতেই ওড়নায় টান পড়লো। পেছন ফিরতেই দেখলো, গাড়ির দরজায় ওড়না আটকে আছে। দোলা তাকাতেই নিশীথ দরজা খুলে দিলো। যেন ও আগেই দেখেছিলো, শুধু দোলার পেছন ফিরার অপেক্ষা করছিলো।

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৩৯

নিশীথ ওড়না এগিয়ে দিতেই দোলা দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলো। ওড়নার আঁচলে চোখের জল মুছে নিজের দুঃখ ভোলার ব্যর্থ চেষ্টা করলো। অপরদিকে, নিশীথ দোলার যাওয়ার পানে একধ্যানে চেয়ে রইলো। পকেট থেকে সি’গা’রেট বের করে ধরালো। জানালার বাইরে ধোয়া উড়িয়ে আকাশের পানে চেয়ে বললো,
বুক ফাটে তবু মুখ ফুটেনা। কেন তুমি এমন?
আর কতদিন চলবে এভাবে? জানতে চায় এ মন!

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৪১