আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৩৪

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৩৪
লেখনীতে সালমা চৌধুরী

আবির রাশভারি কন্ঠে আবার বলে উঠল,
“সবাই জানে খান বংশের বড় ছেলে আমি। চাচাতো ভাই বোনদের মধ্যে আমি বড় হলেও, সত্যিকার অর্থে আসিফ ভাইয়া আমাদের মধ্যে সবার বড় আর আমি দ্বিতীয়। পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে বা আমি সফল হতে পারবো কি না জানি না, তবে আমি আমার জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব ফুপ্পির সাথে আমাদের বাসার সম্পর্ক ঠিকঠাক করার।”
একটু থেমে আবির আবার বলল,

“জানিস মেঘ, এই দুজন মানুষের জন্য আমাদের বাড়ির প্রতিটা মানুষ ভেতর থেকে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে গেছে। তাদের রা*গ, আর অনাদেয় কর্মকান্ডের ফলাফল ভোগ করতে হয় বাকি সদস্যদের। ফুপ্পির মতো কাকামনির জীবনের সুখ শান্তিও কেড়ে নিয়েছে এই মানুষগুলো। কাকামনি ঠান্ডা মেজাজের মানুষ হওয়ায় আর শুধুমাত্র ভাই বলে হয়তো এখনও সম্পর্ক ঠিক আছে। নাহয় ফুপ্পির মতো অবস্থা কাকামনিরও হতো। কাকামনি সবার সামনে প্রাণোচ্ছল থাকে ঠিকই কিন্তু ওনার ভেতরটায় সবচেয়ে বেশি বিধ্বস্ত। ফুপ্পিতো তো তবুও ভালোবাসার মানুষকে পেয়েছেন, কাকামনি তো তাও পেলেন না। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মেঘের মস্তিষ্ক জোড়ে বিচরণ করছে লক্ষাধিক প্রশ্ন কিন্তু সেসব প্রশ্নের উত্তরে শুধু বাবা-চাচার নাম ই উঠে আসবে। কাকামনির জীবনের ইতিহাস শুনারও ইচ্ছে নেই, তাই এই বিষয়ে প্রশ্ন করল না। নিজের আব্বু আর বড় আব্বু এতটা পা*ষাণ এটা ভাবতেই মেঘের কষ্ট হচ্ছে। মেঘ বিভোর হয়ে স্মৃতি মনে করায় ব্যস্ত। আবির ভাই ফেরার পর থেকে যা যা ঘটেছে সব মনে করার চেষ্টা করছে। হঠাৎ মাথায় আসলো, আবির ভাই যে বার বার বাবা-চাচার মুখের উপর কথা বলেন৷ ওনারা যদি আবির ভাইকে…এটুকু ভেবেই মেঘ থেমে গেল। চিন্তিত স্বরে বলল,

” আপনি আব্বু বা বড় আব্বুর মুখের উপর আর কথা বলবেন না প্লিজ।”
নিজের প্রতি প্রেয়সীর দুশ্চিন্তা দেখে আবির আনমনে হেসে উঠল, স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“আমি যদি কথা না বলি তাহলে ওনারা ওনাদের মর্জি মতো সবকিছু করবেন। ওনাদের সকল ইচ্ছে পূরণ করা আমার পক্ষে সম্ভব না৷ আমি কারো প্রিয় হয়ে থাকতে চাই না। আমি তাই করব যা আমার করতে ইচ্ছে করবে। ”
মেঘের শীতল চাউনি দেখে আবির ভারী কন্ঠে বলে উঠল,

“তোকে আগেও বলেছি এখন আবার বলছি, কখনো কারো মন রাখার চেষ্টা করবি না। ঠিক সেই কাজ টায় করবি যেটা তোর মন করতে চাইবে। বিষয় ছোট হোক বা বড় আগে নিজের মনকে প্রায়োরিটি দিবি। আর ফুপ্পির বিষয়টা ভুলেও কাউকে বলবি না, বাড়িতে কাউকে এই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করবি না। তোকে জানানো দরকার ছিল তাই জানিয়েছি। আজকের পর থেকে বুঝে শুনে পা*গলামি করবি। কারণ আমি চাই না তোর পা*গলা*মিকে সিরিয়াসলি নিয়ে কেউ তোর মনে আ*ঘাত করুক৷ ”

কথা শেষ করে মেঘকে নিয়ে বাড়ি ফিরছে আবির। মেঘের মনে আজ কোনো অনুভূতি নেই। এইযে এতদিন জান্নাত আপুকে নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করল৷ সেই জান্নাত আপু সম্পর্কে তার ভাবি হয়ে গেছে। বাড়ির রহস্য না জানলে, আজ মেঘ আবিরকে নিজের মনের কথা বলেই দিত। কিন্তু তার বাড়ির মানুষ যে ভালোবাসার জা*তশ*ত্রু। তারা তো কোনোদিন মানবে না। আবির ভাইয়ের প্রতি যে সে অসম্ভব দূর্বল। আবির ভাইকে এই জীবনে কি আদোঃ পাবে?
আবির বাইক চালাচ্ছে আর মনে মনে ভাবছে,

“আমার জীবনটা কেন এমন হলো! তোর প্রবল অভিমান আমায় দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিল। ৬ বছর যাবৎ আমি নিজের উপলব্ধি জমিয়েছি। সেই সুদীর্ঘ অভিসন্ধি বাস্তবায়নের সুযোগ টাও পেলাম না আমি। ভেবেছিলাম দেশে ফিরে তোর কাছে আমার চিত্তের অব্যক্ত প্রণয় প্রকাশ করব। এত বছরে তোকে ঘিরে কত লক্ষাধিক স্বপ্ন দেখেছি, সেই সব স্বপ্নের কথা জাহির করব। গত ৬ বছর শুধু একটায় পরিকল্পনা করেছি, কিভাবে তোকে আমাতে আসক্ত করব। তিনমাসের মধ্যে তোকে আমার বউ করে নিবো এই দৃঢ় সংকল্পে নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম । কিন্তু একটা ঘটনা, আমায় চূ*র্ণবি*চূর্ণ করে দিয়েছে। গত ১ বছর যাবৎ আমি নিজের সঙ্গে ল*ড়াই করছি। তোকে উপেক্ষা করার বিন্দুমাত্র শক্তি যে আমার ছিল না৷

দেশে ফিরে প্রথমবার তোর লালিত মুখমণ্ডল আর মায়াবী আঁখি দেখে এক মুহুর্তের জন্য নিজেকে উ*ন্মাদ মনে হয়েছিল। ইচ্ছে হয়েছিল, খান বাড়ির সব নিয়মনীতির বি*নাশ করে হলেও তোকে আমার করে নেই।
কিন্তু আমি পারি নি। আজও আমি তোকে ভালোবাসি বলতে পারছি না। তুই পরিবার ছাড়তে পারবি না আর আমি তোকে! নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা ছাড়া আমি আর কোনো পথ খোঁজে পাচ্ছি না।

তোকে পাওয়ায় জন্য যতটুকু যোগ্যতা অর্জন করা দরকার আমি ঠিক ততটুকুই যোগ্য হবো। তারপরও আমার তোকেই লাগবে। আমার তোকে পাওয়ার ইচ্ছে যতটা প্রবল, তোর মনেও আমাকে পাওয়ার সেই শাণিত ইচ্ছে জাগতে হবে। পরিস্থিতি যতই কঠিন হোক, তোর আমার প্রতি প্রগাঢ় আস্থা থাকতে হবে। তুই আমার হলে, আমি পুরো দুনিয়ার সঙ্গে লড়তে পারব। কিন্তু তোকে না পেলে আমার প্রণয়ের পরিণতি হবে মৃ*ত্যু।”
বাসার সেই মোড়ে মেঘকে নামিয়ে আবির ঠান্ডা কন্ঠে বলল,

“যা বলেছি তা মাথায় রাখিস৷ সামনে তানভির আছে,ওর সঙ্গে বাসায় যাবি। বাসায় কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে তোর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। যা বলার তানভির বলবে। জান্নাতের বিয়ের কথা কাউকে বলিস না। আর অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করে নিজের শরীর খারাপ করিস না। ফুপ্পির সাথে সম্পর্কটা আমি ঠিকঠাক করার চেষ্টা করবো, তুই সাবধানে থাকিস। ”

তানভির বাসার কাছেই মেঘের জন্য অপেক্ষা করছিল। মেঘকে নিয়ে বাসায় ঢুকেছে ।ড্রয়িং রুমে দুই ভাই বসে আছেন। মেঘ আর তানভির কে দেখেই মোজাম্মেল খান প্রশ্ন করলেন,
“কোথায় গেছিলা?”
মেঘ তানভিরের মুখের দিকে তাকাতেই,
তানভির বলল,

“তুই রুমে যা।”
ভাইয়ের কথামতো মেঘ রুমে চলে গেছে। ওরা দুই ভাই মেঘকে এমনভাবে আগলে রাখে যেন বাড়ির কেউ কিছু বলতে না পারে। বড় রা কিছু বললে কষ্ট বেশি পাবে কিন্তু তানভির যেহেতু ছোট থেকেই শাসন করে তাই ভাইয়ের শাসন মেঘের এখন সয়ে গেছে। তানভির যা যা কথা বলার, তা বলে রুমে চলে গেছে। মেঘ ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পরছে। বিকেল থেকে এত এত ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়ছে যেগুলো মাথায় স্থির হতেও একটু সময় লাগবে। মেঘের আবেগ, অনূভুতি সব বিলীন হয়ে গেছে। আবির ভাইয়ের বলা প্রতিটা কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে । একটা কথা বার বার মনে হচ্ছে,

“এই বাড়ির প্রতিটা মানুষ ভেতর থেকে দুমড়েমুচড়ে ভেঙে গেছে। ”
ফুপ্পির বিষয় জানার পর মেঘের হৃদয়টা ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। চারমাসের প্রেমানুভূতি প্রকাশ করার আগেই সব শেষ হয়ে গেল। আবির ভাইয়ের প্রতি যে আকাশ সম প্রলয়লীলা , সবই ফিকে হয়ে গেছে। ফুপ্পি আর কাকামনির মনে কত ই না কষ্ট। এসব ভেবে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছে নিজেও জানে না। আবিরের জন্য অপেক্ষা করার শক্তিটুকুও আজ ছিল না।

আবির মেঘকে নামিয়ে দিয়ে আবার বিয়ের প্রোগ্রামে গেছে৷ রাকিবের বেস্ট ফ্রেন্ড হিসেবে এসময় আবিরকে রাকিবের পাশে থাকা খুব বেশি প্রয়োজন। রাকিবের একমাত্র বোন জান্নাত৷ রাকিবের আর একটা ছোট ভাইও আছে। তবে বোনের প্রতি ভাইদের ভালোবাসা একটু বেশিই তীব্র হয়৷

সপ্তাহখানেক হয়ে গেছে। কিন্তু মেঘের মাথা থেকে ফুপ্পির ঘটনা কোনোভাবেই যাচ্ছে না। যতবার আব্বুকে আর বড় আব্বুকে দেখে ততবারই মনে হয় ওনারা হি*টলা*রের থেকেও নিকৃষ্ট। এতদিন আবির ভাইকে হি*টলা*র বলায় নিজেই অনুতপ্ত হচ্ছে। এখন আর মেঘ আগের মতো আবিরকে জ্বালায় না, আবিরের রুমে যায় না, অনুভূতি প্রকাশের চেষ্টাও করে না। আব্বু আর বড় আব্বুকে দেখলে যতটা রা*গ হয়, আবির ভাইকে দেখলে ঠিক ততটায় কষ্ট হয়।
আজ তানভির প্রোগ্রামে ব্যস্ত। হঠাৎ ফোনে কল বাজতেছে। ফোন বের করে অবাক চোখে তাকায়। বন্যা কল দিচ্ছে। প্রোগ্রাম থেকে বের হয়ে এক পাশে গিয়ে ফোন রিসিভ করল।

বন্যা- আসসালামু আলাইকুম।
তানভির- ওয়ালাইকুম আসসালাম।
বন্যা- ভাইয়া, আপনি কি বাসায়?
তানভির- ভাইয়া ডাকতে কতবার না করেছি তোমায়!
বন্যা-সরি, আর ভাইয়া বলবো না। মেঘের কি কিছু হয়েছে? আমি কল দিলে রিসিভ করে না। হঠাৎ রিসিভ করলেও ঠিকমতো কথা বলে না।
তানভির- বনু একটু মানসিক চাপে আছে। কিছুদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।
বন্যা- কি হয়েছে?
বন্যা মনে মনে ভাবছে, আল্লাহ জানে আবির ভাইকে নিয়ে কোনো ঝামেলা ই হলো কি না!
তানভির – তেমন কিছু না। তোমার কি খুব দরকার? কিছু বলার থাকলে আমায় বলতে পারো আমি বনুকে জানিয়ে দিব নে।

বন্যা আমতা আমতা করে বলল,
“ঐরকম কিছু না। কথা হইতেছে না তাই চিন্তা হচ্ছিল। এজন্য আপনাকে কল দিলাম।”
তানভির ঠান্ডা কন্ঠে শুধালো,
“আর কোনো কারণ নেই?”
বন্যা আস্তে করে বলল,
” না মানে, আছে!”
তানভির ধীর কন্ঠে বলল,
“বলো”

বন্যা ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করল,
“আজকে কি আপনার একটু সময় হবে? ”
তানভির ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,
“কেনো?”
বন্যা একটু থেমে বলল,
“আপনার সাথে কি দেখা করা যাবে? আপনি মেঘকে নিয়ে আসলে ভালো হতো। যদি আপনার সময় হয় আর কি!”
তানভির জানাল,

“বনুর মনের অবস্থা খুব একটা ভালো না। তারপরও আমি জিজ্ঞেস করব নে। বনু না আসলে কি আমি আসতে পারবো? নাকি দেখা করতে হলে বনুকে নিয়ে আসতেই হবে?”
বন্যা কিছু বলছে না দেখে তানভির আবার বলল,
“আমি বিকেলে কল দিব তোমায়। রাখছি এখন। ”

তানভির ফোন রেখে আবিরকে কল দিল। আবিরের কড়া নিষেধ মেঘকে এখন কোথাও নেয়া যাবে না। মেঘের মন মেঘকেই ঠিক করতে হবে৷ সব বিষয়ে আবির বা তানভির মেঘকে সাহায্য করতে পারবে না। তানভির কি করবে বুঝতে পারছে না। মেঘকে জিজ্ঞেস না করলে বা মেঘের মতামত না নিলে, পরবর্তীতে বন্যা বিষয়টা জানলে তানভিরকে ভুল বুঝবে। আবার মেঘ যদি ঘুরতে যেতে রাজি হয়ে যায় তাহলে আবির তো তানভিরকে মে*রেই ফেলবে।

দু-টানা কাটিয়ে শেষমেশ মেঘকে কল করল তানভির, মেঘ তখন উপন্যাস পড়ায় ব্যস্ত। বাসায় শুয়ে বসে থেকে আর ভালো লাগছিল না৷ ফোন চাপতে গেলে আবির ভাইয়ের আইডি আসে সামনে।আবির ভাইকে দেখলেই বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠে৷ পড়াশোনার চাপ নেই৷ বাড়ির কারো সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না। চুপচাপ শুয়ে বসে থাকলে বার বার শুধু ফুপ্পির কথা মনে পরে। এসবকিছু কাটাতে আবির ভাইয়ের দেয়া উপন্যাসের বই গুলো পড়া শুরু করেছে। বেশির ভাগ সময় উপন্যাস ই পড়ে৷ উপন্যাস পড়ার আরেকটা অন্যতম কারণ হলো নিজেকে সবার থেকে আড়াল করে রাখা।
তানভির ২-৩ বার জিজ্ঞেস করেছে ঘুরতে যাবে কি না! কিন্তু মেঘের ঘুরতে যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই। বোন রাজি না হওয়াতে তানভিরের জন্য ভালোই হয়েছে। আবিরের কাছে ব*কা খেতে হয় নি। কিন্তু বন্যা দেখা করবে কি না কে জানে!

বিকেলের দিকে প্রোগ্রাম শেষ করে তানভির বন্যাদের বাসার গলি পর্যন্ত গিয়ে বন্যাকে কল দিল।
বন্যা কিছুক্ষণের মধ্যে রেডি হয়ে একটা শপিং ব্যাগ হাতে নিয়ে আসলো৷ তানভিরের সাথে একা ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না বলেই মেঘকে আনতে বলছিল। কিন্তু মেঘ এলো না অথচ তানভির এসে দাঁড়িয়ে আছে। তাই বাধ্য হয়ে বন্যা বেরিয়েছে৷ ঘন্টাখানেক তানভিরের সাথে বাইকে ঘুরেছে, কিন্তু একবারের জন্যও তানভিরকে স্পর্শ করেনি। সন্ধ্যার দিকে রেস্টুরেন্টে বসে আছে বন্যা আর তানভির। বন্যা আশেপাশে একবার তাকিয়ে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করল, তারপর হাতের শপিং ব্যাগটা তানভিরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

“এগুলো আপনার জন্য। ”
তানভির বিস্ময় সমেত তাকিয়ে বলল,
“আমার জন্য! ”
বন্যা উপর নিচ মাথা নাড়লো।
“কিন্তু কেন?”
“আপনি দুবার আমায় ট্রিট দিয়েছেন, গিফটও দিয়েছেন। আমারও তো উচিত চান্স পাওয়ার খুশিতে আপনাকে কিছু দেয়া।”

তানভির শপিং ব্যাগ টা নিজের কাছে এগিয়ে নিল। রেপিং এ মোড়ানো একটা বক্স খুলতেই চোখে পরলো একটা কালো চেইনের ঘড়ি। অনেক সুন্দর ডিজাইনের, মোটামুটি দামিও। তানভির ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঘড়িটা দেখে বলল,
“ঘড়িটা অনেক সুন্দর কিন্তু আমি তো ঘড়ি পড়ি না!”
বন্যা আস্তে করে বলল,

“ছেলেদের হাতে ঘড়ি থাকলে ভালো লাগে, তাই নিয়েছি। আপনি ঘড়ি পড়েন কি না তা তো আমি জানতাম না!”
“ব্যাপার না। পছন্দ করে এনেছো তার জন্য ধন্যবাদ। ”
এই বলে তানভির ঘড়িটা হাতে দিল। শপিং ব্যাগে আরেকটা সুন্দর ওয়ালেট। ওয়ালেট আর ঘড়ির বক্স শপিং ব্যাগে রেখে খাওয়াদাওয়া করে বন্যাকে বাসার কাছে পৌঁছে দিয়ে তানভির বাসায় আসছে৷ আবির ড্রয়িংরুমে বসে কফি খাইতেছিল।
তানভিরের হাতে ঘড়ি দেখে কপাল কুঁচকে ঠাট্টা স্বরে বলল,

” কারো জন্য কেউ একজন তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কত কাজ ই না করছে! অবশ্য এসব দেখতে ভালোই লাগছে। ”
তানভির ঘড়ি পরা হাতটা নিজের পিছনে লুকিয়ে, মন খারাপ করে বলল,
“মজা করছো !”
আবির স্ব শব্দে হেসে উঠল৷ তানভির গাল ফুলিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে৷ আবির সোফায় বসে সেদিকে তাকিয়ে হেসেই যাচ্ছে।

বেশকিছুদিন কেটে গেলো। খাবার টেবিলে দেখা হয় মেঘ আবিরের। মেঘ দু একবার আবির ভাইয়ের দিকে তাকায়, চোখাচোখি হলেই চোখ নামিয়ে নেয় মেঘ।
আবির সকালে খেয়ে অফিসে চলে যায়, মীম আর আদিও স্কুলে চলে যায়, মেঘ বাসায় একা একা থাকে। প্রতিদিন বিকেলে ছাদে যায়, গাছগুলোর দেখাশোনা করে। বাকি সারাদিন আবির ভাইয়ের দেয়া উপন্যাসের বই পড়ে। ২ টা উপন্যাস শেষ করে ফেলেছে।

তৃতীয় উপন্যাসটা যত পড়ছে মেঘের মনের ভেতর প্রেমানুভূতি তত সক্রিয় হতে শুরু করেছে। ফিকে হয়ে যাওয়া অনুভূতিরা আবারও জাগ্রত হচ্ছে। আবির ভাইয়ের প্রতি ধারালো ভালোবাসার টানে ২৮ বছরের গত হয়ে যাওয়া ইতিহাসকে পেছনে ফেলে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে।
“”হয়তো আবির ভাইকে পাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে, নয়তো সারাজীবন আবির ভাইকে এক তরফা ভালোবেসে যাবে। তবুও মুখ লুকিয়ে, আবির ভাইকে এড়িয়ে চলবে না। “”

রাত ১১ টার দিকে মেঘের ৩য় উপন্যাস পড়া শেষ হয়েছে৷ সেই থেকে আবির ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছে। গত কিছুদিন যাবৎ আবির ভাইয়ের বাড়িতে আসা যাওয়াতে মেঘের বিশেষ কোনো নজর ছিল না৷ বাইকের শব্দ শুনেও বেলকনিতে যেতে ইচ্ছে হয় নি তার৷ আজ এতদিন পর মেঘ আবির ভাইয়ের জন্য বেলকনিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। অথচ আবির ভাই ফিরছে না। আবির ইদানীং অফিস থেকে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে ঘন্টাখানেক পর আবার বের হয়৷ ফিরতে ফিরতে রাত ১২ টা বেজে যায়। যেহেতু মেঘ আবিরের সাথে কথা বলে না, আবিরের জন্য অপেক্ষা করে না তাই আবিরও নিজের মতোই চলাচল করে।

১২ টার দিকে আবির বাসায় ফিরেছে। আবিরকে দেখেই মেঘ বেলকনি থেকে মিষ্টি করে হাসলো। এতদিন পর আজ মেঘের মুখে একটু হাসি ফুটেছে। আবির বাইক থেকে সেই দৃশ্য দেখল কি না কে জানে!আবির নিজের রুমে ফ্রেশ হতে চলে গেছে।
মেঘ চুপিচুপি ড্রয়িং রুমে আসছে। এত রাতে কেউ ই সজাগ নেই৷ টেবিলের উপর আবিরের জন্য খাবার ঢেকে রাখা হয়েছে৷ মেঘ খাবারগুলো দেখছে। এরমধ্যে আবির নিচে নামলো। মেঘের থেকে কয়েক পা পিছনে দাঁড়িয়ে ডাকল,
” কি করছিস এখানে ”

আবিরের কন্ঠ শুনে, আতঙ্কে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো মেঘ।
মেঘ আবিরের চোখাচোখি হতেই আবির একটানা দুবার ভ্রু নাচালো। মেঘ নিঃশব্দে হেঁসে উঠলো। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর প্রেয়সীর মুখে হাসি দেখে আবিরের মন এক মুহুর্তেই শান্ত হয়ে গেছে। আবির চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেকে সুস্থির করার চেষ্টা করল।
মেঘ মাথা নিচু করে বলল,

“আপনি এগুলো দিয়ে কিভাবে খাবেন। আপনাকে একটা ডিম ভেজে দেয়?”
মেঘের এমন কথায় আবির চোখ মেলে তাকালো, ভারী কন্ঠে জবাব দিল,
“কোনো প্রয়োজন নেই। আমি খেতে পারবো।”
আবির ভারী কন্ঠে বললেও মেঘের সেসবে মাথা ব্যথা নেই। কারণ তার মাথায় উপন্যাসের প্রেমালাপ ঘুরপাক খাচ্ছে। সে আবার বলল,

” আপনি তো বলেছিলেন পরীক্ষার পর রান্নাঘরে যেতে পারবো। পরীক্ষা তো শেষ। এখনও কি যেতে পারবো না?”
আবির স্বাভাবিক কন্ঠে প্রশ্ন করল,
“তোর কি ডিমভাজা খেতে ইচ্ছে করছে? আমি করে নিয়ে আসবো?”
মেঘ ডানে-বামে মাথা নেড়ে বলল,

“আমি ভাজবো।”
আবির গম্ভীর কন্ঠে শুধালো,
“তুই ডিম ভাজতে পারিস?”
মেঘ দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“আম্মুরা ডিম ভাজার সময় আমি দেখেছি।”
আবির পুনরায় বলল,
” তোর ভাজতে হবে না। তুই বস আমি ডিম ভেজে নিয়ে আসছি৷ ”
মেঘ শক্ত কন্ঠে বলল,
“না, আমি আনবো।”

আবির ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেল। মেয়েটা এতদিন পর আবিরের সঙ্গে কথা বলতে আসছে। ধম*ক দিলে মনে কষ্ট পারে। তাই ধমক দিতে পারছে না৷ আবার ডিম ভাজতে পাঠাতেও সাহস পাচ্ছে না৷
আবির দু পা এগিয়ে থমকে দাঁড়ালো। সেখান থেকে ঘুরে এসে চেয়ার টেনে বসল। পকেট থেকে ফোন বের করে কিছু একটা চেক করছিল। একবার রান্নাঘরে তাকাচ্ছে একবার ফোনে৷
দুবার ডেকে বলেছে,

“তুই কি পারবি নাকি আমি আসবো!”
মেঘ দুবার ই উচ্চস্বরে বলেছে,
“পারব”

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৩৩

কিন্তু আবিরের কলিজা কাঁপছে। প্রথমবার মেঘ রান্না করতে গেছে। পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে যদি হাত কে*টে ফেলে! কয়েকবার রান্নাঘরে দেখে যেই না ফোনের দিকে মনোযোগ দিয়েছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মেঘ চিৎকার দিয়ে উঠেছে।

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৩৫