আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ১৯

আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ১৯
জেনিফা চৌধুরী

“আমার মায়ের সংসার ফেলে রেখে তুমি বাইরে গিয়ে ডিঙিপনা করে বেড়াবে? পড়ালেখার এত শখ হলে বিয়ে করেছো কেনো?”
তানহার এমন এলোমেলো বাক্য শুনে তারিনসহ তামজিদও অবাকের শেষ সীমানায়। এর মধ্যেই কেটে গেছে সপ্তাহ খানেক। তারিন কলেজে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু ক্লাস শুরু হবে আরো দুইদিন পর। তারিনের কলেজে ভর্তি হওয়ার কথা শুনেই৷ আজ সকালেই তানহা এই বাসায় এসেছে।

এসেই সেই বিষয়ে ঘোর আপত্তি জানিয়ে উপরোক্ত কথাগুলো বলে উঠল। তারিন আগেই কিছু বললো না। চুপচাপ তানহার মেয়েকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ সংগোপনে একবার শান্ত চোখে তামজিদের দিকে তাকালো। তামজিদের দৃষ্টিতে বিস্ময় স্পষ্ট। তানহা পুনরায় তামজিদকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“ভাই, তুই কি দুইদিনেই বউ পাগল হয়ে গেলি নাকি? বউ যা বলছে তাই শুনছিস। তারিন না হয় অল্পবয়সী মেয়ে, ওর মনে এখন সেই বয়সী মেয়েদের মতো শখ, আহ্লাদ জাগবে কিন্তু তাই বল তুই তো আর অল্পবয়সী না। যা করছিস ভেবে চিন্তে করছি তো? তারিন যদি এখন সারাদিন কলেজ, পড়ালেখার পেছনে ছুটে তাহলে আমার বাবাকে কে দেখবে? এই সংসার কে দেখবে?”

তারিন এবার মুখ খোলার জন্য প্রস্তুত হলো। তার আগেই তামজিদ বলে উঠল,
“আপা, তোমার কি তারিনের পড়ালেখা করা নিয়ে আপত্তি আছে?”
তানহা ঝটপট উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ, আছে।”
তামজিদ পাল্টা প্রশ্ন করলো,
“কেনো?”
তানহা চোখ গরম করে তামজিদের দিকে তাকালো। বললো,
“কেনো বুঝতে পারছিস না?”
তামজিদ বেশ শান্ত স্বরে উত্তর দিলো,

“না! বুঝতে পারছি না। তুমিও একটা মেয়ে, তারিনও একটা মেয়ে। তুমিও এক বাড়ির বউ, তারিনও সেম। তুমি নিজে বিয়ের পর পড়ালেখা, চাকরি সব করতে পেরেছো, অথচ দেখো আমার বউয়ের বেলায় তোমার ভিন্ন মতামত। কেনো, আপা?”
তানহা আগের ন্যায় গরম চোখে তাকালো তামজিদের দিকে। উচ্চবাক্যে বলে উঠল,

“তুই আমাকে প্রশ্ন করছিস? আমার সাথে নিজের বউয়ের তুলনা করছিস? হ্যাঁ, আমি বিয়ের পর পড়ালেখা, চাকরি দুটোই করেছি। ঘরে এবং বাইরে দুই জায়াগায় মানিয়ে নিতে পেরেছিলাম, কারণ আমার সংসারে আমার শাশুড়ী মা আছেন। কিন্তু এই সংসারে আমার মা নেই৷ তারিনের শাশুড়ী নেই। আমার বয়সের সাথেও তারিনের বয়সের গ্যাপটা অনেক বেশি। কি করে পারবে ও?”

তামজিদ কিছু বলে উঠার আগেই এবার তারিন মুখ খুলল। বেশ দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“আমার বয়স কম, আমার শাশুড়ী নেই এইসব এক্সকিউজ কে আমি আমার স্বপ্নের পথে বাঁধা মনে করি না, আপু। আমি সংসার সামলে পড়ালেখা কন্টিনিউ করতে পারবো।”
তানহা উচ্চস্বরে বলল,
“মুখে যা বলা সহজ, কাজে করে দেখানো বেশ কঠিন।”
তারিন পাল্টা উত্তর দিলো,

“আমি মুখে বলছি না। সময় দিন কাজেও করে দেখাবো, ইন শা আল্লাহ।”
তানহা এবার বেশ কঠিন স্বরে বলল,
“বেয়াদবের মতো বড়দের মুখে মুখে কথা বলছো কেনো? বড়দের কি করে সম্মান করতে হয় জানো না?”
তারিনও বেশ শান্ত হয়ে, গুছিয়ে বলল,

“শুধু বড়দের না। আমি ছোট৷ বড় নির্বেশেষে সব মানুষকেই সম্মান করতে জানি, আপু। সম্মানটা বয়স দেখে নয়, আচরণ দেখে করতে হয়। যে সম্মানের যোগ্য তাকেই সম্মান করা উচিত।”
তানহার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। উত্তেজিত স্বরে তামজিদের উদ্দেশ্যে বলল,
“তোর বউকে বল চুপ থাকতে। আমার সাথে কোন সাহসে ও এভাবে কথা বলছে?”
তামজিদ ও শান্ত স্বরেই বলল,

“আপা, ও তো ভুল কিছু বলে নি৷ তুমি একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে কিভাবে এমন অশিক্ষিতের মতো আপত্তি করছো? তুমি তো আমার বড় আপা। তার মানে তারিনের ও আপা। তুমি বললে না, তারিন তোমার থেকে বয়সে বেশ ছোট৷ তাহলে তো তোমার উচিত তারিনকে বোনের মতো আগলে রাখা, ওর পাশে থাকা, সাহস দেওয়া____তা না করে তুমি এইটুকু মেয়েকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় মত্ত হয়ে উঠেছো?”

তানহা এবার চুপ করে গেলো। একবার আড় চোখে তারিনের দিকে তাকালো। মেয়েটার চোখে, মুখে আলাদা একটা মায়া আছে৷ সেই প্রথম দিন থেকে মেয়েটার সাথে ওর ভালো সম্পর্ক গড়েছে। আজকেই প্রথম মতের অমিল হলো। তারিনের মুখের দিকে তাকিয়ে তানহার ভেতরে খারাপ লাগা শুরু হলো। ঠিকি তো, মেয়েটার বয়সেই বা কতটুকু?

এই বয়সী একটা মেয়ে এত গুছিয়ে সংসার করছে এটাই তো অনেক বড় কিছু। মেয়েটার মনের জোর আর আত্মবিশ্বাস প্রবল। ওর পাশে থাকলে, ভরসা দিলে ও অনেক কিছু করতে পারবে। তামজিদ খানিক চুপ থেকে বলল,
“আপা, মা তো আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। এখন তুমি আছো। আমার আরেক মা যাকে মনে করি আমি। সেই তুমি আমাদের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছো___ এটা মানতে পারছিনা আমি। আপা, তুমি তো আমাকে সবসময় বুঝতে৷ আমার পাশে থাকতে। তাহলে এখন কেনো বুঝছো না? আপা, একটু বুঝো প্লিজ, তুমি আছো, আমি আছি, বাবা আছে।

আমরা সবাই মিলে তারিনের পাশে থাকলে তারিন ঠিক মানিয়ে নিবে। ওর মধ্যে মানিয়ে নেওয়ার সেই ক্ষমতা, জেদ, আত্মবিশ্বাস আছে। ও ঠিক পারবে। আমি বলছি। আমাদের থেকে এভাবে দূরে সরে যেওনা, আপা। আমাদের তোমাকে বড্ড প্রয়োজন, আপা।”

তানহা চুপ করে আছে। তারিন বাচ্চাটাকে তামজিদের কোলে দিয়ে, তানিহার দিকে এগিয়ে গেলো। তানহার হাত জোড়া নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
“আপু, আপনি ছাড়া এখন আমাদের পাশে কেউ নেই। প্লিজ, আমার স্বপ্নে পূরণে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবেন না।”
তানহা তারিনের থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। তামজিদের কোলের থেকে নিজের মেয়েকে কোলে তুলে নিলো। শান্ত হয়ে তামজিদের দিকে তাকিয়ে কঠিন স্বরে বলল,

“আমার বাবা, আর আমার মায়ের সংসারের কোনো অযত্ন হলে, আমি ভুলে যাবো তুই আমার ভাই, আর ও আমার ভাইয়ের বউ।”
বলেই দরজার দিকে পা বাড়াতেই তামজিদ পথ আটকে দাঁড়ালো। অনুরোধ বাক্যে বলে উঠল,
“আপা! আপা, এভাবে চলে যেও না৷ বাবা শুনলে কষ্ট পাবে। এক সংসারে থাকতে গেলে অনেক তর্ক, বির্তক হয় তাই বলে এভাবে রাগ করে চলে যেও না। প্লিজ, আপা।”
তানহা শুনলো না। কোনো শব্দ না করে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই তারিন এসে তানহার হাত ধরে ফেলল। শান্ত স্বরেই বলল,

“আজকে যদি মা বেঁচে থাকতো, তাহলে এভাবে রাগ করে বেরিয়ে যেতে পারতেন, আপু?”
তানহা নিঃশব্দে তাকালো তারিনের দিকে। তারিন পুনরায় বলে উঠল,
“মায়ের সংসার আগলে রাখবো। বাবাকে যত্নে রাখবো। নিজের পায়ে দাঁড়াবো। সে জন্য আমার তো আপনাদের সাপোর্ট প্রয়োজন। আপনারা যদি এভাবে মুখ ঘুরিয়ে নেন, তাহলে আমি দূর্বল হয়ে পড়বো। একটা মেয়ের শক্ত মনোবল, স্বপ্ন এভাবে ভেঙে দিবেন না। সব থেকে বড় কথা আপনি একজন শিক্ষিত স্বাবলম্বী নারী হয়ে অন্য একজন নারীকে এভাবে স্বপ্ন পূরণের পথে বাঁধা দিবেন না, প্লিজ আপু।”

তানহা চুপ করে অন্য দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে আছে। তারিন অসহায় চোখে তামজিদের দিকে তাকালো। তামদিন আলতো স্বরে ‘আপা’ বলে ডেকে উঠতেই তানহা কাঠকাঠ গলায় বলে উঠল,
“যেদিন তোর বউ ঘরে, বাইরে দুটো সমান তালে সামলে দেখাতে পারবে, নিজেকে সঠিক প্রমাণ করতে পারবে, সেদিন আমি এ বাড়িতে আবার ফিরে আসবো।”

তানহার কথা শেষ হতেই তানহা কয়েকপা এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে তামজিদ বলে উঠল,
“তোমাদের কাছে কেনো আমার বউ নিজেকে প্রমাণ করতে যাবে, আপা? বউটা তো আমার। যদি কখনো কোনো কিছুর জন্য নিজেকে প্রমাণ করতে হয়, তাহলে সেটা শুধু আর শুধুমাত্র আমার কাছে করবে। মা তো এই সংসারের দায়িত্ব আমার বউকে দিয়ে গেছে। তোমাকে না। তোমার তো আলাদা একটা সংসার আছে, তুমি সেদিকটা ঠিক করে সামলাও, আপা। মায়ের অবর্তমানে এই সংসারটা আমার বউয়ের। তো, আমার বউ নিজের সংসার কি করে সামলাবে এটা একান্তই ওর ব্যাপার। কেনো তুমি শুধু শুধু ঝামেলা করে সম্পর্কে তিক্ততা বাড়াচ্ছো, আপা?”

তারিন এক নজরে তামজিদের দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষটা ওর জন্য নিজের বড় বোনের সাথে এভাবে কাঠকাঠ গলায় কথা বলছে! একজন মেয়ে তখনেই শশুড়বাড়ি সুখী, যখন মেয়েটার স্বামী তার হয়ে পুরো পৃথিবীর সাথে লড়াই করে। তারিনের নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে ভাগ্যবতী নারী মনে হচ্ছে। তামজিদের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে তানহা বড় বড় পা ফেলে চলে গেলো।

তানহা চলে যেতেই তামজিদ দরজাটা আটকে বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। দুই হাতে মুখটা কিছুক্ষণ চেপে ধরে রাখলো। তারিনের দিকে চোখ পড়তেই তারিনের অসহায় মুখটা চোখে পড়লো। তামজিদ ঠোঁটে কোনে হাসি ফুটিয়ে তারিনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। এক হাতে তারিনকে নিজের সাথে খানিকটা জড়িয়ে ধরে, ভরসা দিয়ে বলে উঠল,

আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ১৮

“আমি আছি তো, বোকা। চিন্তা করছো কেনো? আপা, মায়ের শোকটা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাই, মেনে নিতে পারছে না। দেখবে খুব শিঘ্রই আপা নিজেই তোমাকে বুঝবে। তোমার পাশে থাকবে।”
এত কথার মাঝে তারিনের মাথায় একটাই কথা ঘুরছে ‘আমি আছি তো’। ব্যাস! আর শান্তিতে থাকতে কি লাগে? এই কথাটাই তো যথেষ্ট।

আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ২০