আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ১৮

আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ১৮
জেনিফা চৌধুরী

আযানের শব্দে যখন তারিনের ঘুম ভাঙে, তখন নিজেকে স্বামীর বক্ষস্থলে আবিষ্কার করল। রাতে
কখন চোখ লেগে গেছে কে জানে? তামজিদ খুব যত্নে তারিনকে নিজের বুকের মাঝে আগলে রেখেছে। তামজিদের মুখের দিকে তাঁকিয়ে তারিনের বড্ড মায়া হলো। একদিনেই মানুষটার মুখ শুকিয়ে গেছে। চোখ দুটো ফুলে আছে৷ চেহারাতেও ফোলা ফোলা ভাব। মাকে হারিয়ে মানুষটা খুব বেশি ভেঙে পড়েছে। মা হারানোর যন্ত্রণা এতোটা বেদনাদায়ক কেনো? তারিন মনে মনে প্রার্থনা করলো,

“কোনো সন্তানের চোখে সামনে যেনো তার বাবা মায়ের মৃত্যু না হয়।”
নামাজের সময় হয়ে গেছে। তামজিদের ঘুমটা ভাঙাতে ইচ্ছে হলো না। ছেলেটা রাতে মাকে হারানোর যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল। তারিন খুব সাবধানে তামজিদকে ডাকলো,
“শুনছেন…?”
তামজিদ বোধহয় টের পেলো না। তারিন পুনরায় ডাকলো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“শুনছেন? উঠুন। নামাজ পড়বেন না? উঠে নামাজ পড়ে নিন। তারর চলেন মায়ের কবর যিয়ারত করে আসি।”
তামজিদের কানে ‘মায়ের কবর’ শব্দটা মারাত্নক ভাবে আঘাত হানলো। লাফিয়ে উঠে বিছানার উপর বসে পড়লো। তারিনের দিকে অসহায় চোখে তাকালো। তারিন বুঝলো তামজিদ কথাটায় কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু কি আর করার? বাস্তবতা মেনে নিতেই হবে। সব মেনে নিয়ে রবের ফয়সালার উপর শুকরিয়া জানাতে হবে। তারিন আর কিছু না বলে ওয়াশরুমে চলে গেলো। ওযু করে এসে দুটো জায়নামাজ হাতে নিয়ে তামজিদের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,

“বসে থাকবেন না।”
তামজিদ ওযু করার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। ওযু করে এসে দেখলো তারিন জায়নামায় বিছিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তামজিদ এসে নামাজ শুরু করলো। দুজনে একসাথে নামাজ পড়া শেষ করলো। মোনাজাত ধরতেই তামজিদ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তারিন চুপচাপ শুনছে। কিছু বলছে না৷ থামাচ্ছে না। স্বান্তনা দিচ্ছে না। কান্না করুক। রবের নিকট কাঁদলে মন হালকা হয়৷ দুনিয়াতে কেউ কারোর কষ্ট, দুঃখ বুঝে না।

তাই দুনিয়ার মানুষদের নিজের খারাল লাগা, ভালো লাগা প্রকাশ না করে, সংগোপনে উপরওয়ালার কাছে প্রকাশ করাই শ্রেয়। নামাজ শেষ করে দুজনে বর্ষা বেগমের কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়লো। কবরস্থানে আসতেই তারিনের বুকটা ভারী হয়ে উঠল। কালকে যে মানুষটা এসময় দুনিয়াতে ছিলো। বেঁচে ছিলো। দিব্যি নিঃশ্বাস নিচ্ছিলো। হাসি খুশি ছিলো। সে মানুষটা একদিনের ব্যবধানে আজ মাটিতে শুয়ে আছে। দুনিয়ার নিয়ম বড্ড মর্মান্তিক! তারিন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না৷ হুঁ হুঁ করে কান্না করে উঠল। তামজিদ একহাতে তারিনকে বুকের সাথে আকঁড়ে ধরল। বলে উঠল,

“আমরা দুজনে মায়ের সংসার আগলে রাখবো। আমার মায়ের সংসারটা সাজিয়ে, গুছিয়ে রাখতে পারবে না?”
“আপনি আমার পাশে থাকবেন, মাস্টার মশাই?”
“অবশ্যই! থাকবো ”
“তাহলে আমি সব পারবো। মায়ের সংসারকেও আগলে রাখবো, নিজের স্বপ্নও পূরণ করবো। নিজের পায়ে দাঁড়াবো। আপনার যোগ্য হয়ে উঠবো। আপনার ভালোবাসা ও অর্জন করে নিবো। পরিশেষে আমাদের একটা ছোট্ট সংসার হবে।”
তামজিদের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটলো।

সময় কারোর জন্য থেমে থাকেনা। যে চলে যায় সে একাই চলে যায়। দুনিয়া যেমনটা তেমনি রেখে যায়।
মাঝে কেটে গেছে প্রায় এক মাস। তারিন, তামজিদ, আমজাদ সাহেব এক সপ্তাহ পরেই ঢাকায় ফিরে এসেছিলেন। তানহার মেয়ে হয়েছে সেজন্য। তারিন অবশ্য ঢাকায় এসে কয়েকদিন মন মরা হয়ে ছিলো। এই সাজানো, গুছানো সংসারের সব জিনিস যার যার জায়গায় ঠিকভাবে আছে। শুধু নেই সাজিয়ে রাখা মানুষটা।

দুনিয়ার নিয়মে পা বাড়িয়ে মন পাথর করে নিতে হয়। শোক কাটাতে হয়। নিজেদের জীবনের ছন্দে ফিরে আসতে হয়। দুনিয়াবী জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়। এই এক মাসে তারিন আর তামজিদের সম্পর্কটাও আগের থেকে অনেক বেশি সুন্দর হয়েছে। স্বাভাবিক স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক আস্তে আস্তে গড়ে উঠছে। বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সম্পর্কের ন্যায় দুজনে আচরণ করে। তামজিদ খুব যত্নে তারিনকে আগলে রাখে। তারিন বুঝতে পারছে তামজিদ আস্তে আস্তে তারিনের উপর দূর্বল হওয়া শুরু করেছে। সব আধার কাটিয়ে আলোর মুখ দেখা শুরু করেছে তারিন। জীবন যেনো এই সুখেই কেটে যায়।

তারিন দুপুরের রান্না শেষ করেছে মাত্রই। এর মধ্যেই কলিং বেল বেজে উঠলো। জাহেলাকে বলল,
“তুমি একটু বাবাকে গোসল করে, নামাজ শেষ করতে বলো। তারপর আমি খাবার দিচ্ছি। আমি দেখি কে এসেছে?”
জাহেলা প্রতিউত্তরে হাসি দিয়ে আমজাদের সাহেবের রুমের দিকে রওনা দিলো। আর তারিনের হাত থাকা খুন্তিটা আনমনে না রেখেই ব্যস্ত ভঙ্গিতে গিয়ে দরজা খুলে দিলো।দরজা খুলতেই তামজিদের হাস্যজ্বল মুখটা চোখে পড়লো। তারিনও সৌজন্যমূলক হাসি উপহার দিলো। জিজ্ঞেস করল,

“বাবাহ! মাস্টার মশাই, আজকে এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসলেন যে?”
তামজিদ তারিনের নাক টেনে দিয়ে হাসি দিয়ে বলে উঠল,
“আমার বাচ্চা বউটাকে না দেখে থাকতে পারছিলাম না।”

বলেই তারিনকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে চলে গেলো। আর তারিন কপাল কুঁচকে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। অতঃপর যখন বুঝলো তামজিদ ওর সাথে মজা নিয়েছে। তখন দরজাটা আটকে রাগী ফেস করে তামজিদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কোমরে হাত রেখে, চোখ, মুখ কুঁচকে প্রশ্ন করে বসলো,

“আমি বাচ্চা?”
তামজিদ জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বললো,
“অবশ্যই! কোনো সন্দেহ আছে?”
বলেই পানি খাওয়া শুরু করলো। তারিন এবার দ্বিগুণ রেগে গেলো। কোমরে শাড়ির আঁচলটা গুঁজে নিয়ে নিলো পোক্ত করে। খুন্তিটা তামজিদের দিকে তাঁক করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“এটা চিনেন?”

তামজিদ হকচকিয়ে গেলো। কি মেয়েরে বাবা! খুন্তিটা সোজা মুখের দিকে ধরলো। তারিনের অগ্নী দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করতে লাগলো। মাথায় দুষ্টু বুদ্ধিরা এসে হানা দিলো। সাহস সঞ্চয় করে উত্তর দিলো,
“আরে চিনবো না কেনো? এটা ‘খুন্তি’ যা দিয়ে রান্না করে। বুঝেছো, পিচ্চি?”
বলেই মুখ টিপে হাসলো। তামজিদের হাসি দেখে তারিনের শরীর রাগে রি রি করে উঠল। কি আজব? বার বার বাচ্চা, পিচ্চি বলে সম্মোধন করছে কেনো? ও কি পিচ্চি নাকি? গোটা একটা সংসার সামলে চলেছে। আর সেই মেয়েটাকে বলে পিচ্চি! তারিন রেগেমেগে বলল,

“মাস্টার মশাই, দেখুন।”
তামজিদ মুখ টিপে হেসে বলল,
“আচ্ছা দেখাও।”
তারিন দমে গেলো। চোখ দুটো নামিয়ে ফেললো। আমতা আমতা করে বলল,
“কি দেখাবো?”
“যা দেখাতে চাও।”

তামজিদের কথা শুনে তারিনের মুখটা একদম চুপসে গেলো। তারিনের চুপসে যাওয়া মুখটা দেখে তামজিদ ফিক করে হেসে দিলো। তামজিদের হাসি দেখে তারিন খন্তিটা তুলে বলে উঠল,
“দাঁড়ান। আজকে আপনার খবর আছে।”
তারিন বলতে দেরি কিন্তু তামজিদের দৌড় দিতে দেরি হলো না। এক দৌড়ে সোজা রুমে গিয়ে তোয়ালে নিয়েই ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। তারিন ওয়াশরুমের দরজায় জোরে থা’প্পড় মে’রে বলে উঠল,

“দরজাটা খুলুন বলছি। এক্ষুনি খুলুন। নয়তো আপনার খবর আছে আজ।”
তামজিদ ওপাশ থেকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“দরজা কেনো খুলবো? আমার সাথে গোসল করার শখ হয়েছে বুঝি?”
তারিন আর কিছু বলার সাহস পেলো না৷ এপাশ থেকে ছিটকিনিটা আটকে দিয়ে দুষ্টু কন্ঠে বলে উঠল,
“এবার সারাদিন ওয়াশরুমেই বসে থাকুন।”

বলেই তারিন বিছানার উপর এসে বসে পড়লো। তামজিদের সাথে দৌড়ে হাঁপিয়ে গেছে। কিছু একটা ভেবে আনমনেই হেসে উঠল। বিয়ের পর মানুষটাকে এই প্রথম এত চঞ্চল রুপে দেখে এক ভালো লাগা হৃদয় ছেয়ে গেলো। এই মুহূর্তে চোখ গেলো বিছানার পাশে থাকা ট্রি-টেবিলটার উপর। সেখানে তামজিদের একটা হাসিওয়ালা ফটোফ্রেম রয়েছে। তারিন ফটোফ্রেমটা হাতে নিয়ে নিজে নিজে বলে উঠল,

“এই যে, আপনি হাসেন না কেন সবসময়? আপনাকে হাসলে যে খুব সুন্দর লাগে, মাস্টার মশাই।”
এর মধ্যেই তামজিদ ওয়াশরুমের ভেতর থেকে চিল্লানো শুরু করতেই তারিন ভয় পেয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠল।তাড়াতাড়ি ছবিটা রেখে দৌড় গেলো সেদিকে। দরজার সামনে গিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠল,
“এভাবে হাম্বার মতো চেঁচামেচি করছেন কেন? এই হচ্ছে মাস্টার মানুষের এক দোষ। বাইরে চিল্লাবে বেচারা ছাত্র-ছাত্রীর উপর। আর ঘরে চিল্লাবে বউয়ের উপর। খুলবো না আমি দরজা। এভাবে চিল্লাপাল্লা করলেন কেন? আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম।”

তামজিদ ওপাশ থেকে বেশ কাকুতির স্বরে বলে উঠল,
“আমার ভুল হয়েছে। আমাকে ক্ষমা করে দিয়ে দরজাটা খুলে দিন, প্লিজ।”
তারিন মুখ টিপে হাসলো। একটু ভাব নিয়ে বলে উঠল,
“খুলতে পারি একটা শর্তে।”
“কি শর্ত?”

দুষ্টুমির স্বরে গ্রামের ভাষায় আগের মতো করে বলে উঠল,
“আমারে আর পিচ্চি কইয়া ডাকবেন না, কন রাজি?”
তামজিদ হো হো করে হেসে উঠল। তামজিদের হাসির শব্দ তারিন এপাশ থেকে বেশ ভালো ভাবে শুনতে পাচ্ছে । অবাক স্বরে বলে উঠল,

“একি! এমন পাগলের মতোন হাসতাছেন ক্যান? মাথার সবকয়ডা তার কি ছিইড়া গেছে?”
বলে একটু থামলো। কি যেনো ভেবে পুনরায় চেঁচিয়ে বলল,
“আয় হায়! আপনেরে কি ভূতে ধরলো নাকি, মাস্টার মশাই?”
তামজিদ থামলো। তারিনকে নকল করে গ্রামের ভাষায়, শান্ত স্বরে বলল,

“আমার দাদি, দয়া কইরা দরজাটা খুইলা দেন। আমি আপনেরে আর পিচ্চি কইয়া ডাকমু না।”
তামজিদের মুখে এহেন কথা শুনে তারিন যেনো আকাশ থেকে ঠাস করে পড়ল। ছিটকিনিটা খুলে দিতেই তামজিদের হাস্যজ্বল মুখটা চোখে পড়ল। তারিনের বিস্মিত চেহারা পানে তাকিয়ে তামজিদ মুখ টিপে হাসলো। তারিনের নাক টেনে দিয়ে বলে উঠল,

“এভাবে আকাশ কুসুম চিন্তা ভাবনা করে এই ছোট্ট মাথায় প্রেশার দিবেন না। কাল আমার সাথে কলেজে যাবে।”
তারিন অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“কেনো?”
“নাচ দেখতে।”
তারিন মনোক্ষুণ্ণ হলো। মুখ গুমরা করে বলল,
“মজা করবেন না।”
তামজিদ মাথা মুছতে মুছতে বলল,

আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ১৭ (২)

“বোকা। কাল তোমাকে ভর্তি করাবো। আমাদের কলেজেই পড়বে তুমি। কাল থেকে তোমার স্বপ্ন পূরনের এক ধাপ শুরু হলো।”
কথাটা শুনে তারিনের মুখে হাসি ফুটলো৷ অবশেষে স্বপ্ন সত্যি হবে তাহলে? কিন্তু এই স্বপ্ন পূরনের পথ কি এত সোজা হবে?

আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ১৯