আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ১৭ (২)

আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ১৭ (২)
জেনিফা চৌধুরী

নিজের স্বামীকে তার প্রাক্তন জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে স্বান্তনা দিচ্ছে___দৃশ্যটা ঠিক সহ্য হলো না, তারিনের। তামজিদ বার বার দিশাকে সরিয়ে দিচ্ছে দুই হাতে৷ তারিন অনেকক্ষণ ধরে দৃশ্যটা চুপচাপ দেখছিলো। বর্ষা বেগমকে দাফন করার জন্য গ্রামে নিয়ে আসা হয়েছে। সবাই এসেছে শুধু তামজিদের বোনকে তানহাকে আনা হয় নি। তানহার ডেলিভারি ডেট মাত্র সপ্তাহ খানেক পর।

এই অবস্থাতে এতটা প্রেশার নিতে পারবে না, সে। তাই তাকে ঢাকা থেকেই একবার শেষ দেখা দেখিয়ে আনা হয়েছে। তারিন গ্রামে আসার পর থেকে নিজের মাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলো। এক মুহূর্তের জন্যেও ছাড়ে নি। দিশা কোথা থেকে খবর পেয়ে এখানে এসেছে কে জানে? এসে থেকেই তামজিদের পাশের থেকে উঠে নি৷ ভদ্রতার খাতিরে শোকের বাড়িতে কোনো ধরনের ঝামেলা করতে চাচ্ছিলো না, তারিন। তাই এতক্ষণ কিছু বলেনি। কিন্তু এবার আর সহ্য করতে পারলো না। উঠে গিয়ে তামজিদের কাঁধে হাত রাখলো। তামজিদ তারিনকে দেখেই শান্ত স্বরে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“আমার পাশে বসো। কোথাও যেও না।”
তারিন এবার যেনো মনে শক্তি পেলো। দিশার উদ্দেশ্যে শান্ত স্বরে বলল,
“দিশা আপু, আপনার না আজকে ইন্ডিয়া চলে যাওয়ার কথা?”
দিশা শান্ত বাক্যে উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ। চলে যাবো। আমার একটু সমস্যা ছিলো তাই যাওয়ার ডেট একদিন পিছিয়ে দিয়েছি।”
তারিন সে বিষয় আর কথা বাড়ালো না। সরাসরি বলে উঠল,

“দেখুন দিশা আপু, আমাদের শোকের মাঝে আজকে কোনোরকম সিনক্রিয়েট করবেন না, প্লিজ। কালকে থেকে আমি আপনাকে যথেষ্ট সুন্দর ব্যক্তিত্বের মানুষ হিসেবে জেনে আসছি। তাই এমন কোনো কাজ করবেন না যেটা আপনার ব্যক্তিত্বকে খারাপ বানিয়ে দিবে। আপনি আমাদের এই শোকের দিনে আমাদের পাশে থাকতে এসেছেন আমি খুশি হয়েছি। কিন্তু বার বার আমার স্বামীকে এভাবে স্পর্শ করবেন না। আমার সেটা ভালো লাগেনা।”
দিশা প্রতিউত্তরে বেশ শান্ত গলায় জবাব দিয়ে উঠল,

“তাজ, আমার বেস্টফ্রেন্ড। তাই আমি ওর সাথে ফ্রেন্ডলি বিহেভিয়ার করছি।”
তারিনও বেশ শক্তপোক্ত স্বরে বলল,
“আপনি, আমি এই ব্যবহারকে বন্ধুত্বপূর্ণ মনে করলেও, গ্রামের সবাই সেটা করবে না। বিষয়টা দৃষ্টিকটু লাগে বেশ! দয়া করে একটু সরে বসুন।”
দিশা কোনো কথা না বলে চুপচাপ সরে বসলো। কিন্তু তামজিদ আর সেখানে বসতে চাইলো না৷ তারিনের উদ্দেশ্যে বলল,

“বাবা কোথায়?”
তারিন ছোট্ট করে উত্তর দিলো,
“বাবা রুমে আছেন। বাবার প্রেশার লো হয়ে গেছে।”
“বাবার, কাছে চলো।”
বলেই তারিনের হাত ধরে নিয়ে ঘরে চলে গেলো। দিশা তৎক্ষনাৎ আর বসে থাকলো না। নিজেও নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। তামজিদ ঘরে আসতেই আমজাদ সাহেবকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে কেঁপে উঠল। আমজাদ সাহেবের পাশে গিয়ে বসলো। ছেলেকে দেখেই তিনি কঠিন শোকে মুষড়ে পড়লেন। ছেলের হাত দুটো জড়িয়ে ধরে হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলেন। তামজিদ অশ্রুসিক্ত স্বরে বাবাকে স্বান্তনা দিতে বলে উঠল ,

“তুমি এতোটা ভেঙে পড়ো না, বাবা। তুমি অসুস্থ হয়ে গেলে আমাদের কি হবে? এখন তুমিই আমাদের মাথার উপর ছাদ, বাবা৷ তোমার কিছু হয়ে গেলে আমরা কি নিয়ে বাঁচবো?”
এবার তারিনও আমজাদ সাহেবের পাশে বসল। আমজাদ সাহেবের হাত ধরে বলল,

“সেই বিয়ের দিন থেকে আপনি আর মা আমাকে আগলে রেখেছেন। নিজের পরিবারের অভাব, বাবা মায়ের অভাব বোধ করতে দেন নি। মা, তো আমাকে সংসার বুঝিয়ে না দিয়েই চলে গেলো। এখন আপনিই আমাদের সম্বল, বাবা৷ আপনি না থাকলে আমরা কি নিয়ে থাকবো? আপনাকে নিয়েই মায়ের সব থেকে বেশি চিন্তা ছিলো। আপনাকে আমি দেখে রাখবো, বাবা। আপনার কোনো অযত্ন হতে দিবো না। আমি আছি তো। আপনি, আমি, আমরা সবাই মিলে মায়ের সংসার খুব যত্নে আগলে রাখবো।”

আমজাদ সাহেবের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটলো। মানুষ বেঁচে থাকতেই কত আদর যত্ন। ম’রে গেলে কতক্ষণে মাটিতে রাখবে সেই আয়োজন ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দেখতে দেখতে সময় গড়িয়ে গেলো। তামজিদেও এবার মাকে শেষ বিদায় দেওয়ার সময় এসে পড়ল। লাশটাকে কবরে নামানোর জন্য ধরতেই ওর হাত কাঁপছিলো। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরছে।

কি নির্মম এ দৃশ্য! সন্তান নিজের হাতে মাকে কবরে রাখছে। নিয়তি বড্ড নিষ্ঠুর! মাটি দেওয়ার পালা শেষ হতেই একে একে সবাই বিদায় নিলো। আমজাদ সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়লেন সবাই ধরাধরি করে বাড়ি নিয়ে গেলো। দাঁড়িয়ে রইলো তামজিদ একা। সবাই চলে যেতেই ধপ করে বসে পড়লো কবরের পাশে। কবরটাকে জড়িয়ে ধরল দুই হাতে৷ এবার গলা ফাটিয়ে ‘মা’ বলে চিৎকার করে উঠল। শব্দ করে কাঁদতে লাগলো। কান্নারত স্বরেই বলতে লাগলো,

“মা, কেনো আমাকে একা রেখে গেলে? আমাকে এতিম করে কেনো গেলে? আর কয়েকটা বছর আমার সাথে কি এমন ক্ষতি হতো? তোমাকে আমি একটুও সুখ দিতে পারলাম না, মা। তোমার সুখের জন্যই তো নিজের ভালোবাসাকে বির্সজন দিয়েছিলাম। তোমার পছন্দের মেয়েকে বউ করে এনেছিলাম। তোমার সাজানো গুছানো সংসার ফেলে কোথায় চলে গেলা, মা?”

তামজিদ কাঁদছে। নিজের মাকে হারিয়ে ফেলার শোক সহ্য করতে পারছে না। তানহার জন্য বুকটা ফেটে যাচ্ছে। এই অবস্থায় নিজের বোনের পাশেও থাকতে পারছে না। সবদিকের শোক সহ্য করে কি করে মানুষ? তামজিদ ও আর পারছে না। হাঁপিয়ে গেছে। এশারের আযান হচ্ছে চারদিকে৷ তারিন আর তারিনের মা এসেছে তামজিদের কাছে। তারিন আসতেই তামজিদ তারিনকে ঝাপটে ধরল।তারিনকে বুকের মধ্যে আগলে নিয়ে কাঁদতে লাগলো।

তারিনও কাঁদছে। ছেলেটাকে স্বান্তনা দেওয়ার ভাষা ওর জানা নেই। সুস্থ হয়ে উঠা মানুষটা আজ মাটির নিচে। ভাবতেই বুকটা ফেটে যাচ্ছে তারিনের। কি ভেবেছিলো? আর কি হয়ে গেলো! এই দুনিয়াতে আজকে থাকতে কালকের আশা নেই। কালকে ভোর আমাদের জীবনে আসবে নাকি তার কোনো গ্যারান্টি নেই। অথচ আমরা এই মিছে দুনিয়ার কতশত স্বপ্নে বিভোর থাকি সারাক্ষণ। তামজিদ অনেকক্ষণ যাবৎ কাঁদছে। এবার তারিনের মা সালেহা খাতুন এগিয়ে আসলেন। তামজিদের মাথায় হাত রাখলেন। আলতো হাতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

“বাজান, কান্দো ক্যান? আমি আছি না? তোমার আরেক মা। তোমার মায়ের মতোন অতো আদর, যত্ন করতে পারুম কিনা জানি না। কিন্তু আমার পোলা, মাইয়া যেমন আদর যত্নে থাকবো। তুমিও থাকবা। আমারে মা কইবা। আমার আরেক পোলা তুমি। আমার বড় পোলা। কান্দে না, বাজান। লও ঘরে লও। কানলে আফার কবরে আযাব হইবো, বাজান। আহো, আমার লগে লও। নামাজ পড়ো গিয়া। দুইডা হাত তুইলা আল্লাহ রে কও, আফারে যেনো আল্লাহ বেহেশত নসিব করে।”

তামজিদ একটু শান্ত হলো। অন্তত কেউ একজন মায়ের মতো আগলে তো নিচ্ছে। স্বান্তনা তো দিচ্ছে। তারিন আর তামজিদকে নিয়ে রুমে চলে আসলো। তামজিদ ফ্রেশ হয়ে সোজা মসজিদে চলে গেলো নামাজ পড়ে। নামাজ পড়ে এসে মায়ের কবরটা একবার ঘুরে আসলো। রাত বাড়লো। বাড়ি আস্তে আস্তে নিস্তব্ধ হতে শুরু করলো৷ তামজিদ মায়ের ঘরে একবার ঘুরে আসলো। কই মা নেই তো! ঘর ভর্তি মানুষ৷ কিন্থ মা নামক মানুষটা নেই তো! কষ্টে আবারো বুক ভারী হয়ে উঠল। নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়৷ চোখের উপর হাত রেখে সটান হয়ে আছে। কিছুসময় পর রুমে তারিনের উপস্থিত টের পেতেই, তামজিদ শান্ত বাক্যে বলল,

“লাইটটা একটু অফ করে দাও, তারিন। মাথা যন্ত্রণা করছে।”
তারিন শুনলো না। তামজিদের পাশে গিয়ে বসলো। তামজিদের হাতটা সরালো। শান্ত স্বরে বলে উঠল,
“উঠুন। একটু কিছু খেয়ে নিন। সেই সকাল থেকে না খাওয়া। এবার না খেলে শরীর খারাপ করবে।”
“খাবো না।”

“দেখুন, আপনি তো মায়ের বড় ছেলে। মায়ের ভরসার জায়গা। আপনার উপরেই এখন বাবার দায়িত্ব। আপনি এভাবে ভেঙে পড়লে, বাবাকে সামলাবে কে? একটু নিজেকে শক্ত করুন। আমি আছি তো আপনার পাশে। আপনার এত চিন্তা কিসের? আপনাকে আমি কথা দিচ্ছি, মায়ের সাজানো সংসার আমি এলোমেলো হতে দিবো না। মায়ের মতো করে পারবো কিনা জানিনা, তবে দুইহাতে মায়ের সংসার সাজিয়ে রাখবো। বাবার খেয়াল রাখবো। নিজের স্বপ্নও পূরণ করবো।”

তামজিদ অবাক চোখে তারিনের দিকে তাকিয়ে আছে। এইটুকু একটা মেয়ে কি সুন্দর করে সবাইকে সামলে রাখছে? কে বলবে মেয়েটা সবে স্কুলের গন্ডি পেরিয়েছে? কথা শুনে কারো সে কথা বোঝার সাধ্য নেই ? তারিন তামজিদকে টেনে উঠে বসালো। ভাত মেখে তামজিদের মুখে তুলে ধরে বলল,

“হা করুন।”
তামজিদ চেয়ে আছে তারিনের দিকে। মেয়েটাকে যত দেখছে তত অবাক হচ্ছে। তারিন খুব যত্ন করে তামজিদকে খাইয়ে দিলো। সাথে একটা পেইনকিলার খাইয়ে দিলো। তারপর বলে উঠল,
“এবার একটু ঘুমান। আমি আছি এখানেই।”

তামজিদও কোনো প্রতিক্রিয়া না করে শুয়ে পড়লো। তারিন লাইটটা বন্ধ করে এসে তামজিদের মাথার পাশে বসলো। আলতো হাতে তামজিদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
“বয়সের সাথে ম্যাচুরিটি আসে___কথাটা সম্পূর্ণ ভুল। শুধু বয়স না। সময় ও পরিস্থিতির সাথে মোকাবিলা করতে করতে একটা মানুষের মধ্যে ম্যাচুরিটি আসে।”
তারিন মনে মনে ভাবতে লাগলো,

আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ১৭ 

“কাল থেকে এক নতুন সংগ্রাম শুরু হবে৷ সংসার নামক শক্ত সুঁতোয় বাধা পড়ে যাবে সারাজীবনের জন্য। এই ভেঙে পড়া সংসার ও মানুষগুলোকে সাজিয়ে তুলতে হবে নিজের হাতে। নিজের স্বপ্নও পূরণ করতে হবে। সবটা একা হাতে সামলাতে পারবো তো?”

আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ১৮