আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ১৭ 

আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ১৭ 
জেনিফা চৌধুরী

হসপিটালের করিডোরে দেয়াল ঘেঁষে বসে আছে তারিন। হাটুতে মুখ গুজে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বিয়ের পর থেকে শাশুড়ী নামক মানুষটা মায়ের মতো আগলে রেখেছিলো। মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি। শাশুড়ীও মায়ের মতো ভালোবাসতে পারে__কথাটা তারিন প্রতি ক্ষণে ক্ষণে প্রমাণ পেয়েছে। আজ সেই শাশুড়ী নামক মা মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছেন।

তাকে বাঁচানোর জন্য কত দৌঁড় ঝাপ। আজকে তারিন কাঁদছে। শব্দ করেই কাঁদছে। এই অল্প কয়েকদিনে মানুষটা কে ও বড্ড ভালোবেসে ফেলেছিলো। এই তো কালকে রাগে, ক্ষোভে বর্ষা বেগমের সাথে কঠিন স্বরে কথা বলেছিলো। তখন বর্ষা বেগম হাসছিলেন। আর তারিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছিলেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“আমার ছোট্ট মনির আজ মাথা গরম কেনো? আমার ছেলেটা আবার কি অকাজ করেছে? বাইরে ঘুরতে নিয়ে আমার মেয়েটার মন ভালো করার বদলে আরো খারাপ করে দিয়েছে। আসুক আজকে ও বাড়িতে ওকে ইচ্ছে মতো বকে দিবো। সাথে দুই একটা থা’প্পড় ও বসিয়ে দিবো৷ তুই কাঁদিস না। তুই কাঁদলে আমার ভালো লাগেনা৷ কাঁদিস না।”
যত্ন করে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়েছিলো।

আর সেই মানুষটা এক রাতের ব্যবধানে এখন মৃত্যু সজ্জায়। নাহ! মানতে পারছেনা তারিন। কষ্টে দম বন্ধ হয়ে আসছে। মানুষটা কি শেষ বার ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ দিবে না? তার ভুল ধারণা ভাঙানোর সুযোগ দিবে না৷ তিনটা মানুষের অভিযোগ মাথায় নিয়ে চলে যাবে? তারিন আকাশ কুসুম ভেবে মুখ হাতে চেপে শব্দ করে কান্না করে উঠল। এর মধ্যেই তামজিদ হন্তদন্ত হয়ে হসপিটালে প্রবেশ করলো। তামজিদকে দেখেই তারিন উঠে দাঁড়ালো। তারিনের সামনে এসে তামজিদ ভাঙা ভাঙা স্বরে থেমে থেমে জিজ্ঞেস করল,

“মা! মা! মা, কেমন আছে?”
তারিন কাঁদছে। তারিনকে কাঁদতে দেখে তামজিদ আরো ঘাবড়ে গেলো। এই তো কয়েক ঘন্টা আগেই তো মাকে ভালো রেখে গেলো। হঠাৎ কি হয়ে গেলো? তামজিদ আবারো প্রশ্ন করলো,
“বলো? মা, কোথায়? বাবা! বাবা, কোথায়?”
এর মধ্যেই আমজাদ সাহেব সেখানে উপস্থিত হলেন। হসপিটালেই ভর্তি সংক্রান্ত কিছু কাজ ছিলো। আমজাদ সাহেবকে দেখেই তামজিদ উত্তেজিত স্বরে জিজ্ঞেস করল,

“মা! মা, কোথায় বাবা? হঠাৎ কি হয়ে গেলো?”
তিনি নিশ্চুপ। তারিন মুখ খুলল। কান্নারত স্বরে ব্যাখা করতে লাগল,
“আপনি চলে যাওয়ার পর, মা আর আমি মিলে টুকটাক কাজ করছিলাম। হুট করেই বলল, ‘শরীরটা ভালো লাগছে না’। তাই আমি রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিতে বললাম। আমি এদিকেই কাজ করছিলাম।

প্রায় আধ ঘন্টা পর কিছু পরে যাওয়ার শব্দ শুনে আমি আর জাহেলা আপা দৌড়ে মায়ের রুমে গিয়ে দেখি, মা ওয়াশরুমের দরজায় পড়ে আছেন। নাক, মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিলো। রক্তে সারা ওয়াশরুম একাকার অবস্থা। আর মা নিচে পড়ে ছটফট করছিলেন।”
বলেই তারিন আবার কান্নায় ভেঙে পড়লো। তামজিদ দুই পা পিছিয়ে গেলো। চোখের বাঁধ ভেঙে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। অসহায় স্বরে ‘বাবা’ বলে ডেকে উঠল। প্রশ্ন করল,

“মা! এখন কি অবস্থা মায়ের?”
আমজাদ সাহেব শান্ত স্বরেই বললেন,
“জানিনা। ডাক্তার দেখছেন।”

তামজিদ দুই হাতে মুখ চেপে ধপ করে পেছনের চেয়ারটায় বসে পড়লো। তারিন ঠিক বুঝতে পারলো তামজিদ কাঁদছে। আমজাদ সাহেব তামজিদের পাশে বসতেই তামজিদ দুই হাতে তাকে জড়িয়ে ধরলো। তারিন ও আজ কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতেই বললো,
“আপা কে খবর দেওয়া হয় নি।”

আমজাদ সাহেবের হুঁশ ফিরে আসলো। মেয়েটার এই অবস্থায় মেয়েটাকে এমন খবর দিবে কি করে? তবুও মনকে শান্ত করল। মেয়েকে ফোন দেওয়াএ জন্য অন্য পাশে চলে গেলো। কিছু মুহূর্ত পর ডাক্তার বেরিয়ে বর্ষা বেগমের বাড়ির লোকের খোঁজ করতেই তারিন আর তামজিদ এগিয়ে গেলো। আমজাদ সাহেব ও ডাক্তারকে লক্ষ্যে করে এগিয়ে আসলেন। আমজাদ সাহেব মন শক্ত করে নিলেন। শান্ত স্বরেই প্রশ্ন করে বসলেন,
“আমার স্ত্রী, কেমন আছেন?”
ডাক্তার খুবই ব্যথিত স্বরে জবাব দিলেন,
“স্যরি! সে আর বেঁচে নেই।”
বলেই তিনি পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন।

তার আর কিছু বলার সাহস হলো না। এই পরিবারের মানুষদের সামনে দাঁড়ানোর মতো শক্তি নেই তার। ডাক্তারের উচ্চারিত বাক্যটি তারিন, তামজিদ আর আমজাদ সাহেবের কানে পৌঁছাতেই তারা তিনজনে যেন পাথর রুপে পরিনত হলো। তারিন মুখে হাত চেপেই উচ্চ স্বরে কান্না করে উঠল। আমজাদ সাহেব পা ভেঙে পড়ে যেতে নিলেই তারিন তাকে দুই হাতে ধরে চেয়ারে বসে দিলো।

তামজিদ ধীর পায়ে কেবিনে প্রবেশ করলো। বর্ষা বেগমের দেহটা কাপড় দিয়ে ঢাকা আছে। নার্স দুটো তামজিদকে দেখেই সাইডে সরে গেলো। তামজিদ ধীর পায়ে বেডের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। কাঁপা-কাঁপি হাতে মায়ের মুখ থেকে কাপড়টা সরাতেই ওর বুকটা ধক করে উঠল। সন্তানের সামনে মায়ের লাশ___পৃথিবীর সবথেকে জঘন্য দৃশ্য বোধহয় এটাই। তামজিদ আলতো করে বর্ষা বেগমের মাথায় হাত রাখলো। নাহ! কাঁদছে না তামজিদ। শুধু চোখের অবাধ্য নোনাজল গুলো গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। তামজিদ পাশে থাকা টুলে বসলো। বর্ষা বেগমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে করুন স্বরে ডেকে উঠল,

“মা! ও মা! মা! মা গো!”
কণ্ঠস্বর রোধ পাচ্ছে ওর। শব্দ বের হচ্ছে না। ভেতরটা ভেঙে চূড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই তারিন এসে দাঁড়ালো দরজায়। তামজিদকে এভাবে ভেঙে যেতে দেখে দ্বিগুণ কষ্ট হচ্ছে ওর। নিঃশব্দে তামজিদের পাশে এসে দাঁড়ালো। তামজিদ পুনরায় করুন স্বরে বলে উঠল,

“মা! ও মা! শুনো, আজ থেকে আমি কাকে মা ডাকবো? আমি বাসায় ফিরে আসতে দেরি হলে কে আমাকে বার বার ফোন দিবে? আমার বাড়ি ফেরার পথ চেয়ে কে বসে থাকবে? কে বলবে? বাবা, আমার এই ঢাকা শহরে ভালো লাগে না৷ চল গ্রামে চলে যাই। মা, ও মা! আমি অসুস্থ হলে কে আমার পাশে এসে বসে থাকবে? আমার মাথায় কে হাত বুলিয়ে দিবে? মা! তোমার জন্য আমি আমার ভালোবাসার মানুষটাকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। আর এখন সেই তুমিই আমাকে ছেড়ে চলে গেলে! কেনো মা? এত স্বার্থপর কেনো হলে তুমি? একজন কে হারিয়ে তো আমি নিজেকে শক্ত করে তুলছিলাম। এখন তুমি আমাকে দ্বিতীয় বার ভেঙে দিয়ে চলে গেলে, মা? মা, ও মা! একবার তাজ বলে ডাকবে, মা?”

তারিনের বুকটা ফেটে যাচ্ছে৷ মাকে হারানোর যন্ত্রণা বোধহয় দুনিয়ার সবথেকে বেশি কষ্টের। মায়ের মতো দ্বিতীয় কেউ হয় না। মা হারিয়ে গেলে কখনোই দ্বিতীয় কাউকে মায়ের রুপে পাওয়া যায় না। তারিন ভাবছে শাশুড়ী নামক মাকে হারানো কষ্ট যদি এতটা হয়, তাহলে নিজের মাকে হারানোর কষ্ট কিভাবে সইবে? ভেবেই বুকটা কেঁপে উঠল তারিনের। নিজেকে অসহায় লাগছে খুব৷ আজকে তারিন কাঁদছে, কই শাশুড়ী নামক মানুষটা তো মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে না? বুকে জড়িয়ে নিচ্ছে না। তামজিদ চুপ করে আছে। কিছুক্ষণ থেমে পুনরায় বলতে লাগলো,

“মা! মা! মা! একবার উত্তর দাও না। আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে, মা। তোমার তাজের বুক ফেটে যাচ্ছে, মা। তোমার শক্ত ছেলেটা ভেঙে গেছে, মা। তুমি এভাবে কেনো চলে গেলে, মা? আমি তো কয়েকঘন্টা আগেও তোমাকে ভালো দেখে গেলাম, মা। হঠাৎ কি হয়ে গেলো, মা? আমাকে শেষ বার কিছু বলে যেতে পারতে, মা? একবার তাজ বলে ডাকতে পারতে মা? আমি নিজেকে কিভাবে বুঝাবো, মা?

আমার মাকে আমি শেষ বারের মতো একটু দেখতে পারলাম না,মা। এই যন্ত্রণা কিভাবে সহ্য করবো, মা? তুমি তো আমাকে একা করে দিয়ে গেলে, মা।”

আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ১৬

তারিন আর সহ্য করতে পারলো না। তামজিদের কাঁধে হাত রাখলো আলতো করে। তামজিদ এবার চোখ তুলে তাকালো তারিনের দিকে। তামজিদ মুখে হাসি টানলো। বলল,
“তারিন, তোমাকে আমার মা ভুল ভাঙানোর সুযোগ দিলো না। অভিযোগ কাঁধে নিয়েই চলে গেলো।”

আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ১৭ (২)