আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ২৫

আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ২৫
জেনিফা চৌধুরী

রক্তমাখা হাতটা শক্ত করে ধরে তামজিদ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল। তারিন জ্ঞান হারিয়েছে অনেক আগেই৷ তামজিদ নাকে হাত দিয়ে দেখলো নিশ্বাস পড়ছে কিনা। হ্যাঁ, পড়ছে! তারমানে বেঁচে আছে___কথাটা মনে উঠতেই তামজিদের টনক নড়লো। বিধ্বস্ত স্বরে পাশে একজনকে বলল,

“আমাকে একটু সাহায্য করবেন, প্লিজ। একটা গাড়ি ডেকে আনুন।”
তামজিদ তারিনের আঁচল দিয়ে তারিনের মাথাটা প্যাঁচিয়ে রেখে, তারিনকে কোলে তুলে নিলো। সবাই গাড়ি নিয়ে আসতেই তামজিদ গাড়িতে উঠে পড়লো। ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাওয়া হলো। সারাটা রাস্তা তামজিদ তারিনকে বুকে চেপে হাউমাউ করে কান্না করেছে। তারিনকে তড়িঘড়ি করে ডাক্তার, নার্সরা মিলে নিয়ে গেলো। আর তামজিদ বাইরের চেয়ারে বসে কাঁদছে। কি করবে ভেবে না পেয়ে তানহাকে কল দিয়ে আসতে বলে রেখে দিলো। তারপর রাহিমকে কল দিলো। রাহিম হলো তামজিদের বন্ধু।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“ভাই! এ কি অবস্থা তোর?”
হঠাৎ তানহার গলার স্বর পেয়ে তামজিদ হকচকিয়ে উঠলো। তামজিদের পাঞ্জাবীতে, হাত, মুখে রক্ত লেগে আছে। রাস্তায় পড়ে গিয়ে তামজিদের গুরুতর কিছু না হলেও অনেক জায়গায় কেটে, ছিলে গেছে। পায়েও প্রচন্ড ব্যাথা পেয়েছে। তামজিদকে এমন রক্তমাখা অবস্থায় দেখে তানহার আত্মা কেঁপে উঠল। তামজিদের সামনে গিয়ে তামজিদকে জড়িয়ে ধরল। কান্না করে দিলো মুহূর্তেই। কান্নারত স্বরে বলে উঠল,

“কি হয়েছে, ভাই? এই অবস্থা হলো কি করে? বল, কি হয়েছে? তুই এখানে কেন?”
একাধারে প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। তামজিদ ও কান্না করছে। মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না৷ কি বলবে? ওর বুকটা যে ফেটে যাচ্ছে। চোখের সামনে বার বার তারিনের রক্তমাখা মুখটা ভেসে উঠছে। তারিনের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো বুকের ভেতর যন্ত্রণা দিচ্ছে। তানহাও কাঁদছে। কি হয়েছে বুঝতে পারছে না৷ বুকের ভেতর অজানা ভয়ে তানহা কাবু হয়ে আছে। মস্তিষ্কে হাজারটা প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। তানহা এবার তামজিদকে শান্ত করলো৷ তামজিদের গালে হাত রেখে শান্ত স্বরে বলল,

“ভাই, আমার কাঁদিস না। আগে বল কি হয়েছে? তোর এই অবস্থা কেন? তারিন কোথায়? বাবা কোথায়? কোনো দূর্ঘটনা ঘটেছে? চুপ করে থাকিস না৷ বল আমাকে?”
তামজিদ নিজেকে অনেক কষ্টে সামলালো। সবটা খুলে বলল। সবটা শুনে তানহার বুকের ভেতর মুচড়ে উঠল। তারিনের সাথে সেই প্রথমদিন থেকে তানহার আদর, যত্নের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। সেদিন তানহা রাগ করেছে ঠিকই। কিন্তু সবটা পরে মেনেও নিয়েছিলো। তানহা কাঁপা কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করল,

“এখন কি অবস্থা? ডাক্তার কি বললো?”
তামজিদ কোনোরকমে উত্তর দিলো,
“এখনো কিছু বলেনি।”
এর মধ্যেই সেখানে রাহিম এসে উপস্থিত হয়৷ রাহিমকে সবটা তানহা খুলে বলে। তামজিদের এই অবস্থা দেখে রাহিম কিছু বলে উঠার সাহস পাচ্ছে। তবুও তামজিদের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“সব ঠিক হয়ে যাবে। আল্লাহ ভরসা। চিন্তা করিস না।”

প্রায় ঘন্টা খানেকের মাথায় একজন নার্স ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতেই তামজিদ সেদিকে ছুটে গেলো। হাঁসফাঁস করতে করতে প্রশ্ন করল,
“আমার বউ! আমার বউ কেমন আছে, নার্স? ও ঠিক আছে তো? সুস্থ হয়ে যাবে তো? বলুন না? ঠিক আছে?”
রাহিম তামজিদকে শান্ত করে বলল,

“তুই একটু শান্ত হয়ে দাঁড়া এখানে। আমরা কথা বলছি।”
তারপর নার্সের উদ্দেশ্য তানহা বলে উঠল,
“তারিন কেমন আছে এখন?”
নার্স এবার শান্ত হলো। বলল,

“রোগীর অনেক ব্লাড লস হয়েছে। ইমার্জেন্সি ২ব্যাগ ‘ও পজিটিভ’ রক্ত লাগবে। এখনো জ্ঞান ফিরেনি। তাই এখন কিছু বলা যাচ্ছে না৷ আপনারা যত দ্রুত সম্ভব রক্ত জোগাড় করার চেষ্টা করুন।”
অন্য কেউ কিছু বলার আগেই তানহা বলে উঠল,
“আমার ‘ও পজিটিভ’ রক্ত। আমি রক্ত দিবো।”
রাহিমও বলে উঠল,

“আমারো রক্ত ‘ও পজিটিভ’। আমিও রক্ত দিবো।”
নার্স ওদের দুজনকেই নিজের সাথে নিয়ে গেলো। তানহার থেকে রক্ত নেওয়া হলো না৷ রাহিমের থেকেই দুই ব্যাগ রক্ত নেওয়া হলো। রক্ত দেওয়া শেষ হতে হতে অনেকটা সময় কেটে গেলো। ওরা তিনজনেই হসপিটালের করিডোরে পায়চারি করছে। তারিনের এখনো জ্ঞান ফিরেনি। যত সময় যাচ্ছে তত তামজিদের বুকের ভেতরের ভয়, অস্থিরতা বাড়ছে। মনে মনে উপরওয়ালাকে ডাকছে৷

ঘড়ির কাটায় রাত ১২টা ছুঁইছুঁই। তানহা কিছুক্ষণ আগে বাসায় চলে গেছে। ওর বাচ্চা কাঁদছে বলে। তামজিদ আর রাহিম রয়ে গেছে হাসপাতালে। রাহিম বাহিরের থেকে নতুন শার্ট, প্যান্ট এনে দিয়েছে। সেগুলো চেঞ্জ করে তামজিদ আর রাহিম দুজনেই পাশের মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে এসেছে। এসে থেকে তামজিদ প্রায় একশো বার ডাক্তারকে একশো প্রশ্ন করেছে। কিন্তু প্রতিবারেই হতাশ হয়ে ফিরেছে। ‘আই.সি.ইউ’ শিফট করা হয়েছে মিনিট দশেক আগে। তামজিদ আর অপেক্ষা করতে পারলো না। ডাক্তারের কাছে গিয়ে অসহায় স্বরে বলল,

“আমি কি একবার আমার বউয়ের সাথে দেখা করতে পারি, ডাঃ? প্লিজ না করবেন না৷ আমি কোনোরকম সমস্যা করবো না, প্রমিস। প্লিজ, একবার দেখা করে আসি?”

ডাক্তার প্রথমে বারণ করতে চাইলেও তামজিদের মুষড়ে পড়া মুখের দিকে তাকিয়ে বারণ করলো না। পারমিশন দিতেই তামজিদ ‘আই.সি.ইউ’ রুমে ঢুকে পড়লো। তারিনের মুখে অক্সিজেন মাক্স। মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ প্যাঁচানো। ঠোঁটের এক কোনে রক্ত জমাট বেঁধে আছে৷ ডান পাশের গাল লম্বালম্বিভাবে কেটে আছে হালকা। ফর্সা মুখটা লাল হয়ে আছে। হাতে স্যালাইন চলছে। কী এক বিদঘুটে দৃশ্য!

তামজিদের সহ্য হলো না। যে মেয়েটা সারাদিন ছটফট করে। এক হাতে সব সামলে চলে সেই মেয়েটা এভাবে শান্ত হয়ে আছে! নাহ, মানতে পারছে না! তারিনের সামনে এগিয়ে গিয়ে আলতো করে, খুব সাবধানে তারিনের কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। একটা চেয়ার টেনে তারিনের পাশে বসলো। হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে ঠোঁট ছোঁয়াতেই ফুঁপিয়ে কান্না চলে আসলো। শক্তপোক্ত ছেলেটা মাকে হারানোর এই প্রথম এভাবে অসহায়ভাবে কাঁদছে। তামজিদ কান্নারত স্বরেই বলতে শুরু করলো,

“এই আমার চাঁদ! চাঁদ! শুনছো? এই আমার মনোহরিণী! শুনছো? বলো না, শুনছো? একবার শুনছো? মাস্টার মশাই, বলে একবার ডাকো। একবার আমার দিকে তাকাও। এভাবে চুপ করে থেকো না, আমার চাঁদ। আমার কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে। তুমি এতটা নির্মম হইও না। এই চাঁদ! দেখো আজ তোমার মাস্টার মশাই কাঁদছে। দেখো আমার পাশে কেউ নেই। আমাকে স্বান্তনা দেওয়ার কেউ নেই। কেউ নেই, চাঁদ। তুমি ছাড়া আমার পাশে কেউ নেই। আর সেই তুমি চুপ করে আছো। চোখ বন্ধ করে আছো। মানতে পারছিনা আমি। কিছুতেই মানতে পারছিনা।”
তামজিদের গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না৷ বারবার চোখের পানিতে সবটা ঝাপসা হয়ে আসছে। পুনরায় কান্নারত স্বরে বলা শুরু করল,

“এই মেয়ে! এই! এভাবে শুয়ে থাকলে চলবে বলো? তুমি না আমার ডাক্তার রানী হবে? তাহলে শুয়ে আছো যে? কলেজে যাবেনা? পড়বে না? এই দেখো, আমার মায়ের সংসার ভেসে যাচ্ছে৷ সামলানোর কেউ নেই। ও চাঁদ! উঠো না একবার। তুমি ছাড়া আমার সব এলোমেলো হয়ে যাবে। একবার উঠো আমি তোমাকে অনেক যত্নে আগলে রাখবো৷ সত্যি বলছি। উঠো একবার।”
তামজিদ তারিনের হাতে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলো। হাতটা বুকে জড়িয়ে কাঁদছে। কি থেকে কি হয়ে গেলো কে জানে? সময় শেষ হতেই তামজিদকে বের করে দেওয়া হলো। অনেক রিকুয়েষ্ট করেও থাকা গেলো না।

সারারাত গলা কা’টা মুরগীর মতো ছটফট করেছে তামজিদ। একসেকেন্ডের জন্যও চোখ বন্ধ করেনি। তাহাজ্জুদ ও পড়েছে। বার বার রুমের বাইরে গিয়ে কাচের দরজা ভেদ করে তাকিয়ে ছিলো ভেতরের দিকে। ভোরের আজান দিতেই তামজিদ মসজিদে চলে গেলো। নামাজ পড়ে এসে সেই দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে রইলো৷ এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড, এক মিনিট, দুই মিনিট এভাবে করে প্রায় ৩/৪ ঘন্টা কেটে গেছে। এখনো তারিনের জ্ঞান ফিরে আসেনি৷ সকাল ১০টার দিকে ডাক্তার এসে চেক-আপ করে বাইরে বেরিয়ে আসতেই, তামজিদ আর রাহিম তাকে ঘিরে ধরলো। একে একে দুজনেই প্রশ্ন ছুড়ে মা’রলো,

“তারিন, কেমন আছে?”
ডাক্তার অতি দুঃখের সাথে জানালো যে,
“২৪ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান না ফিরলে উনি হয় কোমায় চলে যাবেন। অথবা জ্ঞান ফিরলেও সে পাগল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ৯০%। আর কিছু বলা এখন সম্ভব না।”
বলেই তিনি চলে গেলো। তামজিদের কর্ণদ্বয়ে পৌঁছাতেই তামজিদ কয়েক পা পিছিয়ে পড়ে যেতেই নিকেই রাহিম দুই হাতে তামজিদকে ধরে ফেলল। কোনোরকমে বলল,

আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ২৪

“এভাবে ভেঙে পড়িস না, দোস্ত। আল্লাহ আছেন তো। সব ঠিক হয়ে যাবে?”
তামজিদকে ধরে নিয়ে চেয়ারে বসাতেই তামজিদ অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠল,
“আল্লাহ আমার থেকে আমার মাকে কেড়ে নিয়েছে। এখন আমার বেঁচে থাকার শেষ সম্বলটুকু কেড়ে নিবে, দোস্ত?”

আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ২৫ শেষ অংশ 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here