আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ২৪

আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ২৪
জেনিফা চৌধুরী

“আমাকে ভালোবাসেন, মাস্টার মশাই?”
তামজিদ রান্না করছিলো, আর তারিন পাশেই চেয়ারে বসে ছিলো চুপটি করে। হুট করে এহেতুক প্রশ্ন করতেই তামজিদ ভড়কে তাকালো। অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
তারিন বিস্তর হাসলো। হাসিমুখে বলল,
“বলুন না, ভালোবাসেন?”
তামজিদ কিছু বললো না। হাতের কাজটুকু শেষ করে এসে তারিনের কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। তারপর আবার কাজে মনোযোগ দিলো। তারিন থেমে থাকার মেয়ে না। পুনরায় আগের ন্যায় প্রশ্ন করল,
“ভালোবাসেন?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তামজিদ চুপ। দেখে মনে হচ্ছে উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছে না। তারিনের এবার রাগ ধরছে শরীরে। কি আশ্চর্য! এত প্রয়োজনীয় একটা প্রশ্ন মানুষটা ঠান্ডা মাথায় এড়িয়ে যাচ্ছে! তারিন এবার উঠে দাঁড়ালো। সাথে সাথে পেট ধরে ‘আহঃ’ বলে শব্দ করে বসে পড়লো। তামজিদ তড়িঘড়ি করে তারিনকে ধরে রাগী স্বরে বলে উঠল,
“তোমাকে উঠতে বলেছে কে? বেশি পাকনামি করো তুমি।”

তারিন চেয়ারে বসে পড়ে। তামজিদের কোমর জড়িয়ে ধরে। তারপর বলে উঠে,
“আমার আপনি আছেন তো। ভয় কিসের?”
তামজিদ স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে পরম যত্নে তারিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“ভালোবাসা যদি এত সহজ হতো, তাহলে আমরা প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিকে ভালোবাসতাম। তখন পৃথিবীতে ‘ভালোবাসা’ শব্দটাকে ঘিরে এত আহাজারি, সুখ, দুঃখ থাকতো না, আমার চাঁদ। বুঝলে?”
তারিন নিশ্চুপ। তামজিদ পুনরায় বললো,

“তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী! আমার দুনিয়া ও পরকালের সাথী। আমার হালাল সঙ্গিনী। আমার বৃদ্ধকালের একাকিত্বের বন্ধু৷ তোমাকে ভালো না বাসলে যে উপরওয়ালা নারাজ হবেন।”
তারিন তামজিদকে ছেড়ে দিলো। শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো তামজিদের দিকে। তামজিদ তারিনের দুই গালে হাত রেখে শান্ত বানীতে বলে উঠল,

“এইযে তুমি আমার ব্যক্তিগত চাঁদ৷ আমার ব্যক্তিগত সুখ। আমার বুকের বাম রাজ্যের রানী।”
তামজিদ এবার আলতো স্বরে ‘চাঁদ’ বলে ডেকে উঠতেই তারিন ছোট্ট করে জবাব দিলো,
“হুঁ”
“আমার চাঁদ, শুনবে?”
“বলুন। শোনার জন্যই তো তৃষ্ণার্ত হয়ে আছি, মাস্টার মশাই।”
“তাহলে শোনো?”
“শুনছি।”
“ভালোবাসি, আমার চাঁদ।”

শব্দটা শুনেই তারিন হুঁ হুঁ করে কান্না করে উঠল। আজ এতদিন পর মনের ভেতরে শান্তির বাতাস বইছে। এই একটা শব্দ শুনার জন্য কতদিন তারিন তৃষ্ণার্ত কাকের ন্যায় চেয়ে ছিলো। অবশেষে আজ তৃষ্ণা মিটলো তবে৷ তারিনের কান্না দেখে তামজিদ প্রথমে ঘাবড়ে গেকেও পরক্ষণেই হেসে দিলো৷ তামজিদকে হাসতে দেখে তারিন ভ্রু যুগল কুঁচকে তাকালো সেদিকে। কান্নারত স্বরে প্রশ্ন করলো,

“এভাবে পাগলের মতো হাসছেন কেনো?”
তামজিদ হাসি থামিয়ে উত্তর দিলো,
“এই যে আমার ছোট্ট চাঁদ কেমন বাচ্চাদের মতো কাঁদছে। অবশ্য সে তো বাচ্চাই।”
তারিন গর্জে উঠে বলে উঠল,

“একদম বাচ্চা বলবেন না।”
তামজিদ এবার তারিনের কানে ফিসফিস করে বলে উঠল,
“যে আমার আদরের ডোজ সহ্য করতে পারে না, সে বাচ্চা নয় তো কি?”
তারিন এবার লজ্জা পেলো। দুজনের খুনশুটি চলতেই থাকলো। তামজিদ আজ এক হাতেই সব রান্নাবান্না করেছে। ঘর গুছানো থেকে শুরু করে সব তামজিদ নিজেই করেছে৷ তারপর দুজনে মিলে গোসল শেষ করে নামাজ আদায় করে নিলো। সবাই মিলে খাবার টেবিলে বসে গল্প সল্প করে খাওয়া শেষ করলো।

বিকেলের চারদিকে পরিবেশে ঠান্ডা বাতাস বইছে। তারিন আর তামজিদ বেলকনিতে বসে আছে। বসে আছে বললে ভুল হবে। তামজিদ খুব যত্নসহকারে তারিনের মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে। আর তারিনকে বকছে,
“কি করেছো তুমি এতদিনে? চুল গুলো একটুও যত্ন নেও নাই৷ নষ্ট করেছো। আমি থাকতে, আমার বউয়ের এত সুন্দর চুলগুলো অযত্নে নষ্ট হতে দিবো না। আজ থেকে প্রতি সপ্তাহে আমি তোমার চুলে তেল দিয়ে দিবো, শ্যাম্পু করে দিবো। একদম অযত্ন করবে না। বুঝেছো?”

তারিন মাথা নাড়লো। কিছুসময় পর বলে উঠল,
“একটা কথা বলবো?”
“দশটা বলো।”
তারিন হাসল। বলল,

“আমার না ফুচকা খেতে ইচ্ছে করছে খুব। বাইরে নিয়ে যাবেন?”
তামজিদ সংগোপনে জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার শরীর ঠিক আছে?”
তারিন আগের ন্যায় বলে উঠল,
“একদম পারফেক্ট আছে। চলুন না, একটু ঘুরে আসি। বিয়ের পর তো আমরা একদিনও বাইরে কোথাও ঘুরতে যাইনি।”

তামজিদ জিজ্ঞেস করলো,
“কোথায় যাবে বলো?”
তারিন বলল,
“কোথায় যাবো জানিনা। আপনি আর অজানা উদ্দেশ্য হাঁটবো, ঘুরবো, খাবো।”

অতঃপর দুজনেই রেডি হয়ে নিলো। তারিন কালো রঙের একটা শাড়ি পড়েছে। খোঁপায় গোলাপ ফুলের দিয়েছে। চোখে হালকা কাজল ও ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়েছে। দেখতে কী সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে! তামজিদ কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেই মায়াবী মুখপানে। পেছন থেকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ ডুবালো। নেশালো স্বরে বলে উঠল,

“আমাকে সম্পূর্ণ পাগল করে ফেলবে নাকি?”
তারিন হাসলো। খানিকটা লজ্জাও পেলো। লজ্জা মিশ্রিত স্বরে বলল,
“যে এমনিতেই পাগল হয়ে আছে, তাকে আর নতুন করে কিভাবে পাগল করবো?”
তামজিদ হাসলো। ঠোঁট ছোঁয়ালো তারিনের কাঁধে। বলল,
“বেশি পাকা পাকা কথা শিখে গেছো।”
তারিন সে বলল,
“সে আমি ছোট থেকেই বড্ড পাকা।”
দুজনে একসাথে হেসে উঠলো। আমজাদ সাহেব বাহিরে আছেন। হয়তো কোনো চায়ের দোকানে আড্ডা জমাতে গিয়েছেন। জাহেলা ঘুমাচ্ছে। তারিন জাহেলাকে ডেকে দরজা লাগিয়ে দিতে বলে বেরিয়ে গেলো।

দুজনে বেরিয়ে ফুটপাতের রাস্তা ধরে কিছুক্ষণ এগিয়ে যেতেই একটা ফুলের দোকান চোখে পড়তেই তামজিদ তারিনের হাত ধরে সেদিকে গেলো। দোকান থেকে দুটো বেলী ফুলের মালা কিনে একটা মালা তারিনের খোঁপায় খুব যত্ন করে পড়িয়ে দিলো। অন্যটি তারিনের হাতে পড়ালো। তারপর একটা রিকশা নিয়ে দুজনে রমনার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।

খোলা আকাশের নিচে, দুজন কপোত-কপোতী রিকশায় চড়ে বসেছে। তামজিদের বাহু জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে মাথা রেখে আছে তারিন। আধা ঘন্টার মাথায় ওরা এসে পৌঁছালো সেখানে। দুজনেই ভাড়া মিটিয়ে নেমে গেলো। তারিনের হাতটা শক্ত করে ধরে হাঁটা শুরু করলো দুজন মনের আনন্দে। তামজিদও আজ কালো পাঞ্জাবী পড়েছে। দুজন হাজারটা গল্প সল্প করতে করতে হাঁটছে৷ তামজিদ বেশ কিছু ফটোও তুলে দিয়েছে তারিনকে। তারিনের কাছে সময়টা কিছুটা কল্পনার মতো কাটলো।

সন্ধ্যা নেমে এসেছে চারদিকে। দুজনে রাস্তার পাশে ছোট্ট একটা ফুচকার দোকানে বসেছে। তামজিদ হাঁক ছেড়ে ফুচকা ওয়ালার উদ্দেশ্যে বলল,
“মামা, দুই প্লেট ফুচকা দিবেন। ঝাল কম দিবেন।”
ব্যস! এখানেই বাঁধলো বিপদ। তারিন কিছুতেই ঝাল কম দিয়ে খাবে না। গর্জে উঠে বলে উঠল,
“একদম না, মামা। আমারটায় বেশি ঝাল দিবা।”
তামজিদ ও কম কিসে। সেও গর্জে উঠে বলল,
“না, একদম ঝাল দিবেন না।”

ফুচকাওয়ালা মামা পড়েছে এবার বিপদে। সে কোন দিকে যাবে আসলে বুঝতে পারছে না। কিন্তু শেষমেশ তারিনের রাগের কাছে তামজিদ হার মানলো। ঝাল করেই ফুচকা বানিয়ে দেওয়া হলো। তারিন একেক করে তিন বার টক নিয়েছে। তৃতীয় বারেরটা শেষ করে ঝালে হু হু করতে করতে বলে উঠল,
“মামা, আর একটা টক দাও।”

তামজিদ খাবার রেখে হা করে তাকিয়ে আছে তারিনের দিকে। রাগী স্বরে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। মাথায় দুষ্টু বুদ্ধিরা ধরা দিলো। তারিনের দিকে ঝুঁকে বলে উঠল,
“এত টক খাচ্ছো যে, ব্যাপার কি?”
ঝালে তারিনের চোখে পানি জমেছে। মুখ লাল হয়ে আছে। তবুও নাকি আরো ঝাল লাগবে। তারিনের ঝাল খাওয়া দেখে তামজিদের ঝাল লেগে গেছে। তামজিদ পুনরায় বলে উঠল,
“এক রাতেই প্রেগন্যান্ট হয়ে গেছো নাকি, জান?”

কথাটা শোনা মাত্রই তারিনের সব ঝাল মাথায় উঠে গেলো। তৎক্ষনাৎ তড়িৎ বেগে কাশি শুরু হলো। তারিনের কাশি দেখে তামজিদ মুচকি হাসছে৷ আর তারিন একাধারে কাশতে কাশতে ভাবছে,
“লোকটা আজকাল বড্ড ঠোঁট কাটা স্বভাবের হয়ে গেছে।”
তামজিদ তারিনের মাথায় ফুঁ দিতে দিতে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

“থাক জান, এত তাড়াতাড়ি প্রেগন্যান্ট হয়ে যেও না। তাহলে আমার আদরে আরেকজন ভাগ বসাতে চলে আসবে। তখন আমার কি হবে, জান? আর…।”
তামজিদ আর কিছু বলার আগেই তারিন মুখ চেপে ধরলো। এক গ্লাস ঢকঢক করে গিলে ফেলে, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

“একদম চুপ। হয়ে গেছে আমার খাওয়া। এবার চলুন। রাত হয়ে গেছে। বাসায় ফিরতে হবে৷ বাবা একা আছেন।”
তামজিদও আর কথা বাড়ালো না। বিল মিটিয়ে দুজনেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। রাস্তায় আসতেই তারিন খেয়াল করলো আজকের চাঁদটা একদম গোল। খুশিতে লাফিয়ে উঠে বলে উঠল,
“দেখুন, আজ চাঁদকে এত সুন্দর লাগছে! মাশ-আল্লাহ!”

তামজিদ আকাশ পানে তাকিয়ে তারিনকে এক হাতে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
“আকাশের চাঁদের থেকেও আমার ব্যক্তিগত চাঁদ আরো বেশি সুন্দর! মাশ-আল্লাহ!”
তারিন হাসলো। তারিনের মনে হঠাৎ করেই ইচ্ছা জাগলো চাঁদকে সাক্ষী রেখে একটা সুন্দর মুহূর্তে ফোনে ক্যাপচার করার। কিন্তু কে করবে? তামজিদকে ইচ্ছার কথা বলতেই তামজিদের পাশ দিয়ে কয়েকটা ছেলে হেঁটে যাচ্ছিলো৷ ওদের রিকুয়েষ্ট করে বলল, ছবি তুলে দেওয়ার জন্য। চাঁদকে সাক্ষী রেখে দুজনে কয়েকটা ছবি তুলে নিলো। সাথে একটা সুন্দর ভিডিও করে দিলো ছেলেগুলো। যাওয়ার সময় ছেলেগুলোর মধ্যে একজন বলে উঠল,

“আপনাদের দুজনকে একসাথে এত সুন্দর লাগছে। একদম পারফেক্ট। এভাবেই হাসিখুশি থাকুন সারাজীবন।”
প্রতি উত্তরে তামজিদ হেসে ধন্যবাদ জানালো। তারপর দুজনে রিকশায় চড়ে বসলো। কিছু দূর যেতেই হঠাৎ পেছন থেকে একটা দ্রুতগামী সি.এন.জি এসে রিকশায় ধাক্কা লাগালো। তারিন আর তামজিদ কিছু বুঝে উঠার আগেই দুজনেই রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়লো।

আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ২৩

সাথে সাথে তারিনের মাথা ফেটে র’ক্ত পড়া শুরু করলো। তামজিদের চোখ সেদিকে যেতেই ‘তারিন’ বলে জোরে চিৎকার করে উঠলো। তারিন জ্ঞান হারানোর আগে শুধু খেয়াল করলো চারদিক থেকে মানুষজন ছুটে আসছে। বেশিক্ষণ চোখ খুলে রাখার শক্তি পেলো না। তারিনের মনে হচ্ছে এই বুঝি তারিন দুনিয়ার সব মোহ মায়া ত্যাগ করে বিদায় নিচ্ছে৷ জ্ঞান হারানোর আগে একবার অস্পষ্ট স্বরে থেমে থেনে বলতে লাগলো,
“ভালোবাসি, মাস্টার মশাই।”

আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ২৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here