আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ২৫ শেষ অংশ 

আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ২৫ শেষ অংশ 
জেনিফা চৌধুরী

“আমার বউ এখন কেমন আছে, ডাঃ?”
সম্পূর্ণ একদিন মাঝে কেটে গেছে। দিনের আলো ফুরিয়ে রাতের অন্ধকারে সবটা ঢেকে গেছে। তারিনের জ্ঞান ফিরেছে দুপুরের পরে। একবার শুধু চোখ মেলে তাকিয়ে তামজিদকে ডেকেছিলো। তারপর আবার চুপ হয়ে যায়। ডাক্তার অবশ্য বলেছে আর চিন্তার কোনো কারণ নেই। তবুও তামজিদের চিন্তা, ভয় দূর হচ্ছে না। সন্ধ্যা হয়ে আসতেই হসপিটালে বাইরে তামজিদ ডাক্তার আসার জন্য অপেক্ষা করছিলো। ডাক্তারকে আসতে দেখেই উপরোক্ত প্রশ্নটি করে বসলো। তামজিদের অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে ডাক্তার হেসে ফেললো। তামজিদের কাঁধে হাত রেখে শান্ত বানীতে বলল,

“তোমার বউ একদম ঠিক আছে। ওষুধের ডোজে ঘুমাচ্ছে এখন। কোনো চিন্তা করো না৷ সব ঠিক হয়ে যাবে, মাই বয়।”
তামজিদের ঠোঁটের কোনেও স্বস্তির হাসি ফুটলো। একদিনেই ছেলেটা একদম মুষড়ে পড়েছে। চোখ, মুখের সে কি অবস্থা! তানহা সারাদিন হসপিটালে ছিলো। রান্নাবান্না করে নিয়ে এসেছিলো। কিছুক্ষণ আগে রাহিম গিয়ে তানহাকে বাসায় দিয়ে এসেছে। তামজিদকে হাসতে দেখে রাহিমের মুখেও হাসি ফুটেছে। তামজিদ ডাক্তারের হাত দুটো জড়িয়ে ধরে হেসে উত্তেজিত স্বরে প্রশ্ন করল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“সত্যি? আর কোনো চিন্তা নই?”
ডাক্তার ও হেসে জবাব দিলো,
“হ্যাঁ! সত্যি। ”
তামজিদ এবার হাসতে হাসতে উচ্চস্বরে বলে উঠল,
“আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ!”
তারপর ডাক্তারের উদ্দেশ্যে বলল,
“আমি একটু আমার বউয়ের সাথে দেখা করতে পারি, ডাঃ?”
ডাক্তার বললেন,

“তোমার ওয়াইফকে বেডে শিফট করা হচ্ছে। তারপর সারাক্ষণ বসে বসে দেখো।”
বলেই সে হেসে চলে গেলো। রাহিম তামজিদকে জড়িয়ে ধরল। খুশি মনে বলে উঠল,
“বলেছিলাম না ভাবি একদম ঠিক হয়ে যাবে? এখন ভাবি সুস্থ হলে আমাগো ঘুরতে নিয়ে যাইতে হবে, দোস্ত।”
তামজিদ হেসে বলল,
“আগে আমার বউ সুস্থ হোক৷ তারপর নিয়ে যাবো।”
তামজিদ তানহাকে ফোন দিয়ে খবরটা জানিয়ে দিলো। তারিনের বাসায় ও জানালো। তারা আসতে চেয়েছিলো, কিন্তু তামজিদ বারন করেছে। বলেছে তারিনকে বাসায় নেওয়া হলে তখন আসতে।

তারিনকে বেডে শিফট করা হয়েছে৷ তামজিদ ডাবের পানি ভর্তি বোতলটা হাতে নিয়ে কেবিনে ঢুকলো। তারিন তখন চোখ বন্ধ করে ছিলো। তামজিদ নিশ্চুপে রুমে ঢুকে বসার টুল টেনে পাশে বসলো। তারিনের হাতের উপর আলতো করে হাত রাখতেই তারিন চোখ মেলে তাকালো। তামজিদকে দেখে অসুস্থ চেহারা পানে হাসি ফুটলো। চোখের কোনে মুহূর্তেই জল জমে গেলো। তামজিদের হাতটা শক্ত করে ধরার মতো শক্তি পাচ্ছে না। তবুও কোনোরকমে তামজিদের হাতটা ধরলো। তারিনকে কাঁদতে দেখে তামজিদের বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। উত্তেজিত স্বরে জিজ্ঞেস করল,

“ব্যাথা পেয়েছো? কাঁদছো কেন? কি হয়েছে? কষ্ট হচ্ছে?”
তারিন কোনোরকমে চোখের ইশারায় বুঝালো যে, কষ্ট হচ্ছে না। তামজিদ ইশারা বুঝতে পেরে শান্ত হলো। বলল,
“কিছু খাবে?”
তারিন তাও না করলো। অস্পষ্ট স্বরে বলল,
“আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিবেন, মাস্টার মশাই?”
ওইটুকু বাক্য বলতেই ওর দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। তামজিদ নিজেকে সামলে আলতো হাতে তারিনের মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। কাঁপা-কাঁপি স্বরে বলা শুরু করল,

“আমার শক্ত বউটা আজ এমন দূর্বল হয়ে পড়েছে কেন? তুমি না ডাক্তার হবে? আমার মায়ের সংসার সামলে রাখবে? তাহলে এভাবে ভেঙে পড়ছো কেন, আমার চাঁদ? তুমি ভেঙে পড়লে আমাকে কে সামলাবে?”
তারিনের চোখ থেকে দুই ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল। আগের ন্যায় থেমে থেমে বলল,
“আমি আছি তো।”

তামজিদের মনে হলো এই বাক্যটা সোজা ওর বুকে গিয়ে লাগলো। মেয়েটা এই অল্প সময়ে বিশাল মায়ায় বেঁধে ফেলেছে তামজিদকে। তামজিদ কখনো ভাবতেও পারেনি তারিনের মায়ায় এত শক্তপোক্ত ভাবে আটকে যাবে। তামজিদের এই মুহূর্তে খুব ইচ্ছে করছে তারিনকে বুকে জড়িয়ে রাখতে। কিন্তু সম্ভব হলো না৷ বেশ অনেকক্ষণ তারিনের সাথে বকবক করে সময় পার করলো। বকবক করতে করতে তারিন কখন যে ঘুমিয়ে গেছে তামজিদ টের পায়নি। তারিন ঘুমিয়ে গেছে___এটা খেয়াল করে একটু স্বস্তি পেলো। কিছুক্ষণ তারিনের পাশে ওভাবেই বসে বসে তারিনকে দেখতে দেখতে সময় কাটালো।

সেদিন রাতটাও এভাবেই কেটে গেলো। পরের দিন সকাল থেকেই তারিন বেশ সুস্থ হয়ে উঠলো। আগের থেকে শরীর ভালো লাগছে৷ সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখলো তামজিদ ওর বেডের পাশে মাথা রেখে, তারিনের হাত শক্ত করে ধরে ঘুমিয়ে আছে। তারিনের হাতের ক্যানোলা লাগানো। স্যালাইন কাল রাতেই শেষ হয়েছে। মুখে ওষুধ দেওয়া হয়েছে এখন। মাথার অবশ্য ব্যাথা রয়েছে বেশ। তবুও উঠে বসার মতো ক্ষমতা হয়েছে। তামজিদের ঘুমন্ত মুখপানে তাকিয়ে তারিনের বেশ স্বস্তি অনুভব হলো। শারীরিক অসুস্থতা এক নিমিশেই হাওয়া হয়ে গেলো, মানসিক শান্তির কাছে।

তারিন কোনোরকমে উঠে বসলো। উঠে বসে তামজিদের মাথায় আলতো করে হাত রাখতেই তামজিদের ঘুম ভেঙে গেলো। ঘুম ঘুম চোখে উপরে তাকাতেই চোখের ঘুম উড়ে গেলো। তারিনকে উঠে বসতে দেখে চ্যাঁচিয়ে বলে উঠল,
“এ কি! তুমি উঠেছো কেন? কি হয়েছে?”
তারিন হাসলো। তামজিদের এলোমেলো চুলে হাত ডুবিয়ে হেসে উত্তর দিলো,
“আমি ঠিক আছি, জনাব। এত চিন্তা করবেন না। এই দুইদিনে চেহারার অবস্থা কি করেছেন?”
তামজিদ মলিন হাসলো। মলিন স্বরেই জবাবে বলে উঠল,

“আমার বউ ছাড়া আমি ঠিক কতটা অসহায় এই দুইদিনে তা খুব ভালো ভাবেই বুঝে গেছি।”
তামজিদের কণ্ঠের অসহায়ত্ব টের পেলো তারিন৷ তামজিদকে টেনে বেডে বসালো। তামজিদের কাঁধে মাথাটা আলতো করে রাখলো। বলল,

“আপনি আমার ব্যক্তিগত সুখ মাস্টার মশাই। উপরওয়ালা আমাকে এত সুখ দিয়েছেন, আলহামদুলিল্লাহ। এই সুখ ছেড়ে আমি কোথাও যেতে চাইনা, মাস্টার মশাই। আমি আপনার সাথে বাঁচতে চাই। সারাজীবন এই সুন্দর পৃথিবীতে আপনার সঙ্গী হয়ে কাটাতে চাই।”

তামজিদ তারিনকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরতেই তারিন খানিকটা ব্যাথা পেলো মাথায়। কিন্তু তবুও শব্দ করলো না। চারদিকে একবার নজর বুলিয়ে নিলো। এই কেবিনে আরো ২/৩জন আছেন। তারা সবাই ওদের দিকে চেয়ে আছে। তারিন নিশ্চুপে তামজিদকে বলে উঠল,

“কি করছেন? ছাড়ুন আমাকে। লোকে দেখছে তো?”
তামজিদ ছাড়লো না। বরং আর একটু গভীর ভাবে বুকে আগলে রাখলো। খামখেয়ালি স্বরে জবাব দিলো,
“দেখুক। আমার কি? আমার বউ আমি জড়িয়ে ধরেছি। লোকের চোখ আছে লোক দেখবে। তাতে আমার কিছু যায় আসে না বুঝেছো, আমার চাঁদ?”
তারিন লজ্জা পেয়ে হেসে মুখ লুকালো শার্টের ভাঁজে। দুইদিন পর তারিন নিজের সুখ খুঁজে পেয়েছে।

মাঝে কেটে গেছে দুইদিন। তারিনকে আজ বাসায় আনা হয়েছে। বাসায় আসতেই তানহা এসে দরজা খুলে দিলো। তানহাকে দেখে তারিন অবাক চোখে তাকালো। হসপিটালে সেদিন দেখতে গিয়েছিলো। তানহাকে দেখে তারিনের সবটা স্বাভাবিক মনে হয়েছিলো। কিন্ত তবুও তারিনের মনে ভয় ছিলো তানহা হয়তো সবটা মেনে নেয়নি৷ তানহা তারিনকে দেখেই হেসে তারিনকে ধরে ভেতরে নিয়ে আসতে আসতে জিজ্ঞেস করলো,

“ঠিক আছো, তারু?”
তারিন হাসলো। ফুরফুরে স্বরে জবাব দিলো,
“একদম ঠিক আছি, আপু? আমাদের মাইশা মামনি কোথায়?”
তানহা তারিনকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে, হেসে বলে উঠল,
“মাইশা ঘুমিয়েছে। বাবা আছেন ওর কাছে। তুমি এখানে বসো। আমি একটু তোমার জন্য শরবত বানিয়ে নিয়ে আসি।”

তারিন তানহাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে পাশে বসালো। বলল,
“কিছু লাগবে না, আপু। আপনি একটু এখানে বসুন। জাহেলা আপা, কোথায়? তাকে একটু বলুন আপনার ভাইকে শরবত দিতে। ”
তানহা বলল,
“জাহেলার মা অসুস্থ। ও একটু বাড়ি গেছে। তুমি একটু বসো। আমিই দিচ্ছি।”
তারিনার এবার তানহার হাত জড়িয়ে ধরল। নিচু স্বরে বলল,

“আপু, আমার উপর রাগ করে থাকবেন না। আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি সবটা গুছিয়ে রাখতে পারছি না।”
তানহা হাসলো। তারিনের গালে হাত রেখে হাস্যজ্বল স্বরে বলল,
“ধুর, বোকা মেয়ে। সেদিন এই বাসায় এসে মাকে না পেয়ে আমার মাথা ঠিক ছিলো না। মায়ের অভাব প্রতিটা সেকেন্ডে ফিল করছিলাম। তাই রেগে গেছিলাম। তোমাদের কথা বোঝার চেষ্টা করেনি৷ তোমাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি। আমাকে ক্ষমা করো, বোন। আমি প্রথম দিন থেকে যেমন তোমার বোন ছিলো আর সারাজীবন থাকবো। আমি আছি তো। আমি, তুমি, তাজ আমরা সবাই মায়ের সংসার সামলে রাখবো। তোমার স্বপ্ন তুমি পূরণ করবে। আমি, ভাই দুজনেই তোমার পাশে আছি। তোমার কোনো চিন্তা নেই।”

তারিনের চোখের কোনে জল জমলো। কান্না চলে আসলো মুহূর্তেই। তানহা তারিনের চোখে জল দেখে তারিনকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো। তারিনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“আজ থেকে একদম কাঁদবে না। আর কোনো চিন্তা করবে না। যতদিন সুস্থ না হবে ততদিন একটুও নড়াচড়া করবে না। আমি আছি, সব সামলে নিবো। তোমার কাজ শুধু রেস্ট করা। বুঝেছো?”
তারিন মাথা নাড়ালো। মনে মনে ভাবছে,

আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ২৫

“আমি এত ভাগ্যবতী কেন? আমার ভাগ্যে এত সুখ ছিলো কখনো ভাবতেই পারেনি৷ এত সুখে থেকে দিন দিন বাঁচার ইচ্ছাটা তীব্র বেড়ে যাচ্ছে৷ এখন তো মৃ’ত্যুকে ভয় হয়। মৃ’ত্যু নামক কঠিন সত্য যদি এসে সামনে দাঁড়ায়। তখন আমি এই মানুষগুলোকে ছেড়ে যাবো কি করে?”

আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ২৬