আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ২৮

আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ২৮
জেনিফা চৌধুরী

তানহা আর তারিন মিলে গুছিয়ে, পরিপাটি করে সংসার সামলে চলেছে প্রতিদিন। তারিন পড়ালেখা, সংসার দুটোই ভালো করে সামলাচ্ছে। আমজাদের সাহেবের খেয়ালও রাখছে। তানহা আছে বলেই তারিন হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে পারছে। একটু নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারছে। তানহার স্বামীও এখানে এসে থাকে রাতে। সবাই মিলে একসাথে হৈ-হুল্লোড়ের তারিনের সংসার ও পড়ালেখা জীবন খুব ভালো ভাবেই কেটে যাচ্ছে। দিন যায়, মাস যায়, বছরও যায়। দেখতে দেখতে সময় গড়িয়ে যায়। সময় ও স্রোত কারোর জন্য অপেক্ষা করে না।

“এখন আর পড়তে হবে না। এসে শুয়ে পড়ো।”
তামজিদের কণ্ঠস্বর শুনে তারিন ধড়ফড়িয়ে উঠে। আড়মোড়া হয়ে বসে চিন্তিত স্বরে বলে উঠল,
“আপনি শুয়ে পড়ুন। আমি পড়বো।”
তারিন কথাটা বলে পড়ায় মনোযোগ দিলো। ভেতরে ভেতরে চিন্তায় কেমন হাঁসফাঁস লাগছে। মাথাও ঘুরছে বেশ। চিন্তায় গলা দিয়ে খাবারও নামে নি আজকে। বাড়ির সবাই অবশ্য তারিনকে সারাদিন ধরে সাহস দিয়েছে, ভরসা দিয়েছে। তবুও তারিনের ভয় কাটছে না। মনে হচ্ছে সব পড়া ভুলে গেছে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে বার বার। মস্তিষ্কে বারবার কিছু প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“ কাল সব প্রশ্নের এন্সার করতে পারবো তো? প্রশ্ন কেমন হবে? ঠিকঠাক সব কিছু সামলাতে পারবো তো?”
এমন নানা রকম ভাবনা মাথায় আসছে। তানহা বার বার করে বলে দিয়েছে,
“একদম সংসার আর বাবাকে নিয়ে ভাববে না। আমি সব সামলে নিবো। তুমি শুধু মন দিয়ে পড়ালেখা করবে, আর পরিক্ষা দিবে। ভালো রেজাল্ট করে আমার ভাইয়ের মুখ উজ্জ্বল করবে। নিজের স্বপ্ন পূরণ করবে।”

তাই আপাতত সংসারের ভূতটা তারিনের মাথা থেকে নেমেছে। তারিন ভাবনার মাঝে পাশে তামজিদের উপস্থিতি টের পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো তামজিদ দাঁড়িয়ে আছে। মুখে রয়েছে প্রতিবারের মতো তৃপ্তির হাসি। এই হাসিতেই তারিন গলে যায় যায় বারবার। সময়ের সাথে সাথে আগের তামজিদ পরিবর্তন হয়েছে। আগের মতো গম্ভীর্য নেই, কষ্ট নেই, আফসোস নেই। এখন তামজিদ মন খুলে হাসতে পারে। তারিনকে বুকে জড়িয়ে নিশ্চিন্তে রাত পার করতে পারে। তামজিদ এখন হয়েছে চঞ্চল, হাসিখুশি, প্রাণবন্ত একটা মানুষ৷ তারিন তামজিদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে তামজিদ হাস্যজ্বল স্বরে বলে উঠল,

“কি দেখো, বউ?”
“আপনাকে?”
“আমার কি দেখো?”
“হাসি।”
তামজিদ এবার দুষ্টুমির ছলে বলল,
“শুধু হাসি দেখবে আর কিছু দেখবে না?”
তারিন কথাটার মানে বুঝতে পেরে তামজিদের বাহুতে কিল মে’রে বলল,
“অ’সভ্য।”

তামজিদ তারিনের দিকে ঝুঁকে তারিনের ঠোঁটে হালকা করে চুমু খেলো৷ তারপর তারিনের নাকে নাক ঘষে বলল,
“তোমার জন্য।”
তারিন তামজিদের দুই গালে হাত রেখে হাস্যজ্বল স্বরে বলল,
“হ্যাঁ, আমার অ’সভ্য বর।”
তামজিদ তারিনকে আর কিছু বলতে না দিয়ে পাজ কোলে তুলে নিলো। তারপর বলে উঠল,
“তাহলে চলো এবার একটু অস’ভ্যতামি দেখাই।”
তারিনকে এনে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তামজিদ নিজেও পাশে শুয়ে পড়লো। তারপর তারিনকে বুকে টেনে নিয়ে তারিনের মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে বলতে লাগলো

“আমার চাঁদ, জীবন ভালো, মন্দের সমন্বয়ে গঠিত৷ একদিন ভালো যাবে তো দুই দিন খারাপ যাবে___এটাই প্রকৃতির নিয়ম। খারাপ দিন আসবে বলেই যে ভালো দিনগুল ভুলে গিয়ে, খারাপ দিনগুলো নিয়ে হতাশা, আফসোস করতে হবে এমন না। আল্লাহ কষ্টের পরেই সুখ নিশ্চিত করেছেন। জানো না?”
তারিন চুপচাপ শুনছে। এই মানুষটার কণ্ঠস্বরের থেকে বের হওয়া প্রতিটা কথা ওকে আত্মবিশ্বাস জোগায়। তামজিদ পুনরায় বলল,

“পরিক্ষার আগের রাতে এর পড়তে হয় না, চাঁদ। পরিক্ষার আগে রাতে শুধু জামাইয়ের বুকে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে হয়। আর সকালে উঠে রিফ্রেশ মাইন্ডে পরিক্ষা দিতে যেতে হয়। বুঝছো?”
তারিন হাসলো। উঠে বসে তামজিদের নাক টেনে বলল,
“বুঝলাম, মশাই। কিন্তু যাদের জামাই নেই তাদের মাইন্ড কিভাবে রিফ্রেশ হবে, শুনি?”
তামজিদ মেঁকি হাসলো। প্রসঙ্গ পালটে বলল,
“তাড়াতাড়ি বুকে আসো। বাহিরে বৃষ্টি নামছে। বউ বুকে নিয়ে ঘুমানোর মতো ওয়েদার। এমন রোমান্টিক ওয়েদারে তুমি আমার থেকে দূরে থেকো না, জান।”
তামজিদের এমন অভিনয় সুলভ কথা শুনে তারিন হাসলো। তামজিদের বুকে কয়েকটা কি’ল, ঘু’ষি মে’রে হাসতে হাসতে বলল,

“দিন দিন একদম বাচ্চা হয়ে যাচ্ছেন।”
তামজিদ আফসোসের ছলে বলে উঠল,
“আমি কেনো বাচ্চা হবো, জান। এখন তো আমরা বাচ্চার বাবা-মা হবো। যদি তুমি পিচ্চি না হতে তাহলে এতদিনের এক পিচ্চির মা বানিয়ে দিতাম। কিন্তু আমার ফুটা কপাল, আমার বউ নিজেই একটা পিচ্চি।”
তারিন লজ্জা পেলো। মিশে গেলো তামজিদের উদাম বুকে। তামজিদ তারিনের কপালে আলতো ঠোঁট ছুঁয়ে বলল,
“কালকের জন্য অগ্রীম ‘বেস্ট অফ লাক ফর ইউর এক্সাম’। ভালোবাসি।”

তারিন প্রতি উত্তরে ‘ভালোবাসি’ বলে নিশ্চুপ হয়ে রইলো। ভাবতে লাগলো সময় কত দ্রুত চলে যায়। কাল থেকে তারিনের এইচ.এস.সি পরিক্ষা শুরু। এতক্ষণ সেই পরিক্ষার প্রস্তুতি নিয়েই তোড়জোড় চলছিলো। দেখতে দেখতে এর মাঝে দুটো বছর কেটে গেছে। কিভাবে বছর কেটে গেলো তারিন নিজেও বুঝতে পারেনি। সংসার, পড়ালেখা দুটো একসাথে তারিন হয়তো ব্যালেন্স করতে পারতো না, যদি তানহা না থাকতো। তানহা শুরু থেকে যথেষ্ট করেছে তারিনের জন্য। মাঝে যখন তানহা শশুড় বাড়ি যেতো তখন তারিনের মা এসে ছায়া দিয়েছে তারিনকে। এভাবেই দিন পেরিয়ে গেছে। এখন তারিনের একটাই স্বপ্ন। এতগুলো মানুষের বিশ্বাস, ভরসা সে রাখবে। নিজের স্বপ্ন পূরণ করবে। তামজিদের এত এত আত্মত্যাগ ও বৃথা যেতে দিবে না।

সকালে উঠেই তারিন নামাজ আদায় করে পড়তে বসে। তামজিদ নামাজ শেষ করে তারিনের জন্য চা বানাতে রান্নাঘরে গিয়েছে৷ তারিন অবশ্য বার বার বারণ করেছে, কিন্তু তামজিদ কি আর শোনার পাত্র? তারিন বইয়ের একটার পর একটা পৃষ্ঠা উলটে যাচ্ছে আর রিভিশন দিয়ে যাচ্ছে৷ কিন্তু যত পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে তত মনে হচ্ছে আগের সব পড়া ভুলে যাচ্ছে। ছোট থেকে এই এক সমস্যা ওর। নার্ভাসনেসের কারণে অনেক জানা প্রশ্নের উত্তরও ভুলে যায়। তারিনের মুখটা ভয় আর নার্ভাসনেসে একদম চুপসে আছে। তামজিদ দুই হাতে দুটো চায়ের কাপ নিয়ে ভেতরে ঢুকে তারিনের চুপসে যাওয়া মুখ দেখে প্রশ্ন করল,

“আমার বউটা এমন পেঁচার মতো মুখ করে আছে কেন? কি হয়েছে? সব ভুলে গেছো?”
তারিন অসহায় চাহনী নিক্ষেপ করলো তামজিদের দিকে। বাচ্চাদের মতো মাথা উপর নিচ করে ‘হ্যাঁ’ বুঝালো। তা দেখে তামজিদ হেসে চায়ের কাপটা তারিনের হাতে দিয়ে, অন্য হাতে বইটা বন্ধ করলো। তারপর এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

“উঠো।”
“কোথায় যাবো?”
“চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে একটা সুন্দর সকাল উপভোগ করতে যাবো।”
তারিন না করতে যেয়েও করলো না। তামজিদের হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো। দুজনে মিলে বেলকনিতে থাকা পাশাপাশি দুটো বেতের চেয়ারে বসলো। তারিন চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তামজিদের কাঁধে মাথা হেলিয়ে দিলো। তামজিদ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,

“দোয়া পড়ে হলে ঢুকবে, আর প্রশ্ন ধরবে৷ তারপর ঠান্ডা মাথায় প্রশ্ন আগে পুরোটা বুঝবে। যেগুলো ভালো পারো সেগুলো আগে শুরু করবে। তারপর যেগুলো মনে হবে, হালকা ট্রাই করলে পারবে সেগুলো আস্তে আস্তে বুঝে, শুনে দিবে। কোনো তাড়াহুড়ো করবে না। একদম হাইপার হবে না, নার্ভাসও হবে না। ডানে, বামে তাকিয়ে সময় নষ্ট করবে না। কেউ জিজ্ঞেস করলে পারলে বলবে না পারলে নাই। আর এর মাঝে আমি একবার গিয়ে দেখে আসবো হলে। প্রবলেম নাই। বুঝেছো আমার জান?”

তারিন মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। তারপর আর তারিন কে পড়তে বসতে দিলো না। তামজিদ নিজেই কিছু বেসিক প্রশ্ন মুখে। জিজ্ঞেস করেছে। দুজনে মিলে পুরো সকালটা এভাবেই কাটালো। মূলত তামজিদ তারিনকে একটু রিফ্রেশমেন্ট দেওয়ার চেষ্টায় ছিলো। মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করছিলো।

তামজিদ রেডি হয়ে বসে আছে অথচ তারিন এখনো রেডি হতে পারছে না। তামজিদও তাড়া দিচ্ছে না৷ এখন তাড়া দিলে মেয়েটা সব এলোমেলো করে ফেলবে। তাই তামজিদ বসে না থেকে তারিনের কাগজপত্র সব গুছিয়ে দিচ্ছে। সব ঠিক আছে কিনা চেক করছে। এর মাঝেই তানহা ভাতের প্লেট হাতে রুমে ঢুকল। বলল

“খেয়ে নাও এবার।”
তারিন সাথে সাথে বলল,
“এখন আর খাওয়ার সময় নেই, আপু। প্লিজ জোর করো না।”
তামজিদ কিছু বলার আগেই তানহা গর্জে উঠে বলে উঠল,
“একদম না। এসব কথা একদম শুনবো না। আচ্ছা তুমি রেডি হও, আমি তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছি।”

তারিনের বারন করা উপেক্ষা করা, তানহা তারিনকে খাইয়ে দিচ্ছে৷ তারিন রেডি হওয়ার জন্য ছোটাছুটি করছে আর তানহা তারিনের পিছু পিছু হেঁটে খাইয়ে দিচ্ছে। তামজিদ গালে হাত দিয়ে খাটের উপর বসে বসে সামনের দৃশ্যটা দেখছে। তারিন এক লোকমা মুখে দিতেই আবার বলছে ‘খাবে না’ আর তানহা সাথে সাথে চোখ রাঙিয়ে খাইয়ে দিচ্ছে৷ মায়েরা যেমন স্নেহ, মমতা একসাথে মাখিয়ে খাইয়ে দেয়। তানহাও ঠিক এমনটাই করছে৷ এমন একটা সুন্দর, প্রানবন্তর দৃশ্য দেখে তামজিদের হৃদয়ে তৃপ্তির বাতাস বইছে। পৃথিবীর সব সংসারের ননদ-ভাবীর সম্পর্ক যদি এমন হতো, তাহলে হয়তো প্রতিটা সংসারে শান্তি বিরাজমান থাকতো৷ তামজিদ ভাবনার মাঝে খেয়াল করলো মাইশা গুটিগুটি পায়ে ডিম খেতে খেতে নিশ্চুপে রুমে ঢুকছে। তামজিদ মাইশা দেখে গিয়ে কোলে তুলে নিয়েই বলে উঠল,

“দেখেছো, তোমার মাম্মা তোমার মামনিকে কত আদর করে খাইয়ে দিচ্ছে৷ আমার মাও নেই আমাকে কেউ এভাবে খাইয়েও দেয়না।”
তামজিদ কথা শেষ হতে না হতেই মাইশার হাতে থাকা ডিমটা তামজিদের মুখে ডুকিয়ে দিতে দিতে আধো আধো স্বরে বলল,
“খাও, মামা। আমি তোমাল মা লা?”

এইটুকু বাচ্চার বোধশক্তি দেখে তামজিদের চোখের কোনে জল জমে গেলো। সত্যি! আল্লাহ কখনো শূন্যস্থান রাখে না। এইতো তামজিদ মা পেয়েছে। এক মা হারিয়ে আরেক মা পেয়েছে। তামজিদ নিজে একটু খানি ডিম কামড় দিয়ে নিয়ে, বাকি টুকু মাইশাকে খাইয়ে দিতে দিতে বলল,
“হ্যাঁ, মা। তুমিই আমার মা।”

আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ২৭

বলেই মাইশার গালে চুমু খেয়ে মাইশাকে বুকে জড়িয়ে রাখলো। মাইশাও একদম নিশ্চুপ হয়ে তামজিদের বুকে মিশে রইলো। মামা, ভাগনির একটা সুন্দর মুহূর্ত দেখে তারিন আর তানহার চোখেও পানি জমেছে। তারিন এই সুন্দর মুহূর্তটা ক্যাপচার করতে একদম ভুললো না। মনে মনে প্রার্থনা করলো,
“এই সংসারটা যেনো এভাবেই হাসি, আনন্দে থাকে সারাজীবন।”

আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ২৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here