আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ২৭

আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ২৭
জেনিফা চৌধুরী

কলেজের স্যারের গাড়ি থেকে তারিনকে নামতে দেখে মাঠে উপস্থিত কয়েকজন বেশ অবাক হয়। কানাঘুষা শুরু হয় মুহূর্তেই। মাঝে কেটে গেছে প্রায় ১মাস। এই ১ মাস তারিন সম্পূর্ণ রেস্টে ছিলো। তানহা, তামজিদ, জাহেলা কেউ তারিনকে একটা কাজে হাত লাগাতে দেয়নি। তামজিদের যত্ন, ভালোবাসার ছায়াতলে তারিন সবচেয়ে নিরাপদ ছিলো। তানহা একা হাতে সম্পূর্ণ সংসারটাকে সামলেছে। বোন ও হয়তো বোনের জন্য এত কিছু করেনা তানহা যতটা তারিনের জন্য করেছে। হাসি, আনন্দে এক মাস যে কিভাবে কেটে গেছে তারিনের খেয়ালেই আসে না। আজ এক মাস পর তারিন কলেজে পা রাখছে। তারিনকে হাত ধরে সাবধানে নামিয়ে দিয়ে তামজিদ বললো,

“এখানে দাঁড়াও। আমি গাড়ি পার্কিং করে আসছি। নড়বে না একদম।”
তারিনও মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। তামজিদ গাড়ি নিয়ে পার্কিং করতে চলে যেতেই, প্রথম দিনের সেই ছেলেগুলো এসে হাজির হলো তারিনের সামনে। হঠাৎ করে ওদের সবাইকে একসাথে দেখে ঘাবড়ে গেলো তারিন। কিন্তু সেটা প্রকাশ করলো না৷ ছেলেগুলোর মুখে বিশ্রি হাসি দেখে তারিন মুখ বাঁকিয়ে প্রশ্ন করলো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“এমন খাটাশের মতো হাসছেন কেন?”
তারিনের থেকে এমন বাক্য শুনে ছেলেগুলোর হাসি থেমে গেলো। অন্ধকার মুখে বলে উঠল,
“আমরা তোমার সিনিয়র সম্মান করতে জানো না?”
তারিন মুখ চেপে হাসলো। হেসে বলল,

“সিনিয়রদের সম্মান করতে জানি। কিন্তু আপনাদের মতো লাফাঙ্গা /বাদর পোলাপাইনদের সম্মান করতে জানিনা। এক মিনিট, সেদিনের থা’প্পড়ের কথা এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন কি করে বলুন তো?”
ছেলেগুলোর মধ্যে একজন গরম কণ্ঠে চোখ রাঙিয়ে বলে উঠল,
“দেখো, নিজের লিমিট একদম ক্রোস করবে না বলে দিলাম। আমার খারাপ রুপটা তুমি জানো না। তোমার মতো মেয়েকে এক মিনিটে আমি আমার পায়ের তলায় এনে ফেলতে পারি। আ…।”

কথাটা সম্পূর্ণ শেষ করার আগেই তছেলেটার গালে সজোরে থা’প্পড় বসলো। আচমকা এমন আঘাতে তারিনসহ, ছেলেগুলো বসে অবাক। তারিন অবাক নয়নে পাশ ফিরে দেখলো তামজিদ দাঁড়িয়ে আছে। তামজিদকে দেখেই তারিনের মুখে হাসি ফুটলো। তামজিদকে দেখে বাকি ছেলেগুলো বেশ ভয় পেলেও থা’প্পড় খাওয়া ছেলেটা শুধু অগ্নী দৃষ্টিতে তামজিদের দিকে তাকিয়ে আছে৷ তামজিদ কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে ছেলেটার কলার চেপে ধরে চেঁচিয়ে বলে উঠে,

“সেদিন তোদের খালি মুখে বিদায় দিয়ে খুব ভুল করেছি। আজ তোদের শেষ দেখে ছাড়বো। তোর এত বড় সাহস হয় কি করে যে তুই আমার বউকে পায়ের তলায় ফেলার কথা উচ্চারণ করিস? বল? এত বড় সাহস তোকে কে দিয়েছে?”

বলেই সজোরে আরেকটা থা’প্পড় মে’রে বসলো। তামজিদের মুখে ‘আমার বউ’ শব্দটা শুনেই ছেলেগুলোর দম বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। ছেলেগুলো ভেবেছিলো সেদিন হয়তো স্যার হিসেবে তারিনকে তামজিদ গার্ড দিয়েছিলো। তাই আজকে আবার তারিনকে একা পেয়ে এসেছিলো সুযোগ নিতে। কিন্তু এখন তামজিদের মুখের কথা ও অগ্নীঝড়া দৃষ্টি দেখে খুব ভালো করে বুঝতে পারছে যে, ওরা ভুল জায়গায় হাত বাড়িয়েছে। থা’প্পড় খাওয়া ছেলেটা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“বউ! কে আপনার বউ স্যার? এই মেয়েটা?”
‘এই মেয়েটা’ বলার কারণে তামজিদ আরেকটা থা’প্পড় বসালো ছেলেটার গালে। সর্তক করে দিয়ে বলে উঠল,
“আমার বউ মানে তোদের ম্যাম। ম্যাম ডাক। এই মেয়ে, এই মেয়ে বলে কাকে সম্মোধন করছিস?”
ছেলেটা থতমত খেয়ে নিচু স্বরে বলল,

“স্যরি, স্যার। আমাদের ভুল হয়ে গেছে। আমাদের ক্ষমা করে দিন। ”
একে একে সবাই স্যরি বললো। কিন্তু তামজিদ থামার পাত্র নয়। গর্জন করে বললো,
“তোদের কোনো ক্ষমা হবে না আজ। তোদের সব কয়েকটা কে আমি জেলে ভরবো। জাস্ট ওয়েট।”
বলেই কাউকে একটা ফোন করলো। কয়েক বার রিং হতেই ওপাশ থেকে ছেলে কণ্ঠে একজন বেশ হাস্যজ্বল স্বরে বলে উঠল,

“আরে জানু, এতদিন পর তোমার আমাকে মনে পড়লো। ভাবীকে পেয়ে আমাদের ভুলে গেলা। ভুলে যেও না এক সময় আমরাই তোমার জান, পরান ছিলাম। আ…।”
ওপর পাশের ব্যক্তির কথা সম্পূর্ণ শেষ হতে না হতেই তামজিদ গম্ভীর স্বরে ঝাড়ি মে’রে বলল,
“শালা লেডিস, চুপ। তোর সাথে আমি কি প্রেম করতে ফোন দিয়েছি? তোকে পুলিশের মতো এমন বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে কোন শালা নিয়োগ দিছিলো সেটাই ভাবছি।”
ফোনের ওপাশ থেকে রিহাব চুপসে যাওয়া স্বরে বলে উঠল,

“দেখ, মামা। তুই আমাকে অপমান করস ঠিক আছে, কিন্তু আমার গায়ের পোষাককে অপমান করবি না বলে দিলাম। তাহলে একদম ৩০২ধারার কেসে ফাঁসিয়ে দিবো।”
এতক্ষণে তারিন ওদের কথোপকথন শুনে হাসলেও এখন বুঝতে পারলো তামজিদ কেনো রিহাবকে ফোন দিয়েছে। তামজিদ পুনরায় ঝাড়ি মে’রে বলে উঠল,
“তোর নানাও সেই ক্ষমতা নেই। এখন তোর ফাল’তু বকবক বাদ দিয়ে আমার কথা শোন।”
রিহাব বলল,

“জানি তো কোনো দরকার ছাড়া আমাকে তোর মনে পড়ে না। এখন বল কি দরকার?”
তামজিদ ছেলেগুলোর দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল,
“ইভটিজার দের কি শাস্তি হতে পারে?”
রিহাব বেশ ভাবুক স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“তোরে আবার ইভটিজিং করলো কে, মামা?”
তামজিদ ধমকে বলল,
“শালার ব্যাটা, তোকে যা জিজ্ঞেস করছি তা আগে বল।”
রিহাব ধমক খেয়ে থতমত হয়ে বলল,

“বেশি কিছু না, মামা। ২৯৪ ধারায় না বড়োজোর তিন মাস জেল হতে পারে। এটা খুব কম শাস্তি হয়ে যাবে। তুই খালি ওই শালাদের একবার আমার হাতে তুলে দে। পাছার মধ্যে ৯৯ ধারার ডান্ডার বাড়ি পড়লে দেখবি এমনেই দাদী/নানীর নাম ভুলে যাবে। এমন মা’র মা”রবো যে নিজেদের চেহারা দেখে নিজেরাই ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবে।”
রিহাব আর তামজিদ স্পিকারে দিয়ে কথা বলছিলো। রিহাবের কথা শুনে এবার ছেলেগুলো ভয়ে একেকজন কাবু হয়ে আছে। তামজিদ পুনরায় ছেলেগুলোর দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল,

“আচ্ছা, তোকে একটু পর কল দিচ্ছি।”
বলেই রেখে দিলো। এরপর ছেলেগুলোর কাছে যেয়ে বলল,
“শুনলি তো? এবার তোরা বল তোরা কোনটায় রাজি। ২৯৪ ধারা ৯৯ ধারা?”
তামজিদ কথাটা বলার সাথে সাথে ওরা সবাই এক জোট হয়ে তামজিদের পা প্যাঁচিয়ে ধরে, বলতে লাগলো,
“আমাদের ভুল হয়ে গেছে, স্যার। আর কখনো এমন ভুল হবে না। আমাদের শেষ বারের জন্য একটা সুযোগ দিন, প্লিজ স্যার। আপনার পায়ে পড়ি।”
তামজিদ একবার তারিনের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো। তারিন ইশারায় কিছু বুঝাতেই তামজিদ ওদের সবার উদ্দেশ্যে বলল,

“মাফ করতে পারি একটা শর্তে…।”
সবাই একসাথে বলল,
“আমরা রাজি।”
তামজিদ হাসলো। বলল,
“বাবাহ, শর্ত না শুনেই রাজি।”
ছেলেগুলো পুনরায় বলল,
“হ্যাঁ, স্যার।”
তামজিদ গম্ভীর স্বরে বলল,
“আজ থেকে ঠিক করে পড়াশোনা করবি। প্রত্যেকটা বিষয় ভালো নাম্বার নিয়ে পাশ করবি। আর কোনো মেয়ে অসম্মান করবি না। সবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ বজায় রাখবি।”

সবাই একসাথে বলে উঠল,
“আমরা রাজি, স্যার।”
তামজিদ পুমরায় বলল,
“শুধু মুখে বললে হবে না। কাজে করে দেখাতে হবে। ভেবে নিস না, আমি কিছু জানবো না। আমার নজর আজ থেকে তোদের উপর থাকবে। কথাটা মনে রাখিস। সাথে এইযে আমার বউয়ের মুখ ভালো করে চিনে রাখ। যদি নেক্সট একদিন চোখ তুলেও তাকিয়েছিস তাহলে চোখ দুটো খুলে হাতে ধরিয়ে দিবো, মাইন্ড ইট।”

বলেই তামজিদ তারিনের হাত ধরে সেখান থেকে নিয়ে চলে আসলো। তারিন আজ শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামজিদের অগ্নীশ্বর রুপ দেখলো। আজ নতুন করে তামজিদের উপর এক দফা ক্রাশ খেয়ে বসে আছে। তারিন ক্লাসে আসতেই নিহা দৌড়ে এসে তারিনকে জড়িয়ে ধরলো। মন খারাপ করে বলল,
“তুই অনেক খারাপ। সেই যে প্রথমদিন আসলি তারপর হারিয়ে গেলি৷ মায়া লাগিয়ে দূরে সরে গেলি৷ এটাকে বুঝি বন্ধুত্ব বলে? আ…।”
কথার মাঝখানে নিহা খেয়াল করলো তারিনের গালে, মুখে বেশ কয়েক জায়গায় কা’টা দাগ। তা দেখে নিহা আঁতকে উঠে। প্রশ্ন করে,

“এমন হয়েছে কি করে?”
তারিন নিহাকে নিয়ে একটা বেঞ্চে বসলো৷ সবটা খুলে বললো। সেই সাথে তামজিদ আর তারিনের পরিচয়টাও বললো। সব শুনে নিহা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। অবাক স্বরে বলে উঠে,
“তার মানে তুই যাকে ‘বুইড়া’ বলে সম্মোধন করেছিলে সে আর কেউ না আমাদের স্যার ছিলো?”
তারিন হাসে। উত্তর দেয়না৷ নিহা এবার গর্জে উঠে বলে,

“বে’দ্দব, ওমন হ্যান্ডসাম ছেলেকে কেউ বুইড়া বলে? তোর চোখে কি ছানি পড়েছে? স্যারকে দেখলে কেউ কি বলবে তার বয়স ৩০এর কোঠায়? এখনো দেখতে কি হ্যান্ডসাম, স্টাইলিশ। যে কেউ এক দেখায় মুগ্ধ হবে।”
তারিন এবার চোখ দুটো ছোট ছোট করে, ভ্রু কুঁচকে নিহার দিকে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“এই যে, আপনাকে কেউ আমার স্বামীর উপর মুগ্ধ হতে বলেনি। আমার স্বামী মানে তোর জিজু৷ সো, ভাইয়ের নজরে দেখবি তাকে। উল্টা পাল্টা নজর দিবি না। সে আমার। শুধু আমার। শুধু আর শুধুমাত্র আমার। তার ০০% ভাগ ও আমি কাউকে দিবো না কখনো। কোনোদিন না। বুঝছোস?”
তারিনের কথা শুনে নিহা হেসে ফেলে৷ হাসতে হাসতে বলে,

আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ২৬

“হিংসুটে, মহিলা।”
তারিন হেসে বলে,
“শুধু আমার সোয়ামির লেইগ্যা। জানোস না, মাইয়া মাইনসে সব কিছুর ভাগ দিতে পারলেও নিজের সোয়ামির ভাগ্য কাউরে দিতে পারে না?”

আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ২৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here