স্রোতস্বিনী পর্ব ২৩

স্রোতস্বিনী পর্ব ২৩
মুগ্ধতা রাহমান মেধা

রাত যত গভীর হচ্ছে প্রকৃতিলোকে অভাবনীয় পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে।চারিদিকে এলোমেলো বাতাস বইছে।বাতাসের তীব্র গতিবেগসহ ঘনকৃষ্ণ পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দ্রুতগতিতে ছুটে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে শুনা যাচ্ছে ঝড়ো হাওয়ার একটানা শোঁ শোঁ শব্দ ও ক্ষুব্ধ ঝটিকার উত্তাল গর্জন।

প্রচণ্ড বর্ষণ শুরু হয়ে গেল। মুহুর্মুহু বিদ্যুৎত্বহ্নি ঝলসিত হয়ে গোটা আকাশটাকে বিদীর্ণ করে দিতে চাইল। চারদিকে জমাটবাঁধা নিশ্ছিদ্র অন্ধকার।স্রোতের মনে হলো আকাশ আজ তার সাথে পাল্লা দিয়ে মন খারাপ করছে।স্রোতের কেনো জানি আজ খুব মন খারাপ হচ্ছে।মনটা কু গাইছে।কোনো বিপদ হবে কি!মেহরাদ ঠিক আছে তো!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রাতের খাবার খেয়ে সবাই যার যার রুমে চলে যায়।মাহিরা-তাঈফ ক্লান্ত হওয়ায় আর কথা বলে নি কেউ। তারপর থেকেই স্রোত তার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ঝড়ের তান্ডবলীলা দেখছে।বৃষ্টির প্রতিটি কণা তাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে।একটা সময় পর পুরোপুরি ভিজে গেছে সে।কিন্তু তাতে স্রোতের খেয়াল নেই।কেনো যে মন বলছে মেহরাদের কিছু হয়েছে।মেহরাদের কথা বড্ড বেশিই মনে পড়ছে।রাত একটা-দুটো হবে হয়তো!কে জানে!মন খারাপের সাথে সাথে ঝড়ের পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে।স্রোত ঠিক করলো কাল সকালেই বনলতা বেগমকে দিয়ে মেহরাদের ডিপার্টমেন্টে যোগাযোগ করাবে।মেহরাদের কোনো খোঁজ আছে কিনা জানার চেষ্টা করবে।সে বেলকনিতেই ভেজা কাপড়ে বসে রইলো।ঘরে গিয়ে কাপড় পরিবর্তন করতে ইচ্ছে করছে না।

কোনো কারণ ছাড়াই মন খারাপ হওয়ার ব্যাপারটা অদ্ভুত। শুধু শুধুই কান্না করতে ইচ্ছে করে,চিৎকার করতে ইচ্ছে করে,নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছে করে।স্রোতেরও এমনই হচ্ছে।শূন্যতা অনুভব হচ্ছে।কখন যে এই ঝড়ের মাঝেই ভেজা কাপড়ে স্রোত ঘুমিয়ে পড়েছে কে জানে!

সকাল দশটা কি এগারোটা বাজে।সূর্যের প্রখর আলোয় স্রোতের ঘুম মাত্র ভেঙ্গেছে।পিট পিট করে চোখ মেলে নিজেকে বেলকনিতেই আবিষ্কার করলো।নিজেকে বেলকনিতে ঘুমোতে দেখে নিজেরই বিরক্ত লাগলো।মাথাটা কেমন ভার ভার লাগছে।সারারাত বৃষ্টিতে ভেজায় গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে।এর মধ্যে বাড়ির লোক অনেকবার তাকে ডেকেছে,কিন্তু সে শুনতে পায়নি।বেঘোরে ঘুমোচ্ছিলো কিনা।স্রোত আস্তে আস্তে উঠে ফ্রেশ হতে চলে যায়।গোসল করায় তার শরীরটা এখন ভালো লাগছে।তবে মাথাটা কেমন ভারী হয়ে আছে।

কয়টা বাজে দেখার জন্য নিজের মোবাইলটা হাতে নিলে দেখতে পায় মোবাইলটা বন্ধ হয়ে আছে।কাল চার্জ দিতে ভুলে গিয়েছিল সে।দেয়াল ঘড়িতে দেখলো ঠিক এগারোটা বাজে।যারপরনাই বিরক্ত হলো সে।এতোক্ষণ কেউ ঘুমায়!আম্মু জানি কত টেনশন করছে।অনেক্ষণ হয়তো ডেকেছেও।জ্বরের ঘোরে শুনতে পায়নি।সে তাড়াতাড়ি করে মোবাইলটা চার্জে দিয়ে বাহিরে যাওয়ার জন্য দরজা খুলতেই দেখলো মাহিরা সামনে দাড়ানো।তার চোখগুলো কেমন ফোলা ফোলা।আচ্ছা, মেয়েটা কি কান্না করেছে?কিন্তু কেনো?স্রোতের ভাবনার মাঝেই মাহিরা তাকে জাপটে ধরে বললো,

“তুমি ঠিক আছো? জানো কতবার ডেকেছি তোমায়?কত আজেবাজে চিন্তা হচ্ছিলো।এখন দরজা না খুললে সত্যি সত্যি দরজা ভেঙ্গে ফেলতাম।”
স্রোত একটু অবাকই হলো।মাহিরাকে ছাড়িয়ে স্মিত হেঁসে বললো,
“এতো চিন্তার কিছু নেই।কাল রাতে বৃষ্টিতে ভেজায় অনেক জ্বর এসেছিলো।তারজন্যেই এতোক্ষণ ঘুম।স্যরি।কিন্তু তোমার চোখ মুখের অবস্থা এমন কেনো?কান্না করেছো?”

মাহিরা অবাক হলো।স্রোতকে এতো স্বাভাবিক লাগছে কেনো?সে কি কিছু জানে না?শোনে নি?মাহিরা কিছু বলার আগেই স্রোত ড্রয়িংরুমে চলে যায়।মাহিরা কিছু বলতে গিয়েও বলে না।সেও স্রোতের পেছন পেছন যায়।ড্রয়িংরুমে এসে বাড়ির সবাইকে দেখে স্রোত অবাক হয়।নোলক সাহেব,তার স্ত্রী,সন্তান,রায়হান,তার মা জাহানারা বেগম সবাই এখানে।তাদের দেখে প্রথমে অবাক হলেও পরে ধারণা করে নেয় মাহিরা দেশে ফিরেছে বলে হয়তো,সবাই দেখা করতে এসেছে।কিন্তু সবার মন খারাপ কেনো?

সবাই তার দিকে কেমন করে যেনো তাকিয়ে আছে।সে কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।খেয়াল করলো বনলতা বেগম নেই এখানে।স্রোত কিছু জিজ্ঞাসা করতে নিবে এর আগেই কোথা থেকে যেনো আচমকা মান্ধবী এসে তাকে জাপটে ধরে কাঁদতে থাকে।টাল সামলাতে না পেরে স্রোত পিছিয়ে যায়।স্রোত দেখলো সদর দরজা দিয়ে তার বাবা-মামাও তাড়াহুড়ো করে ঢুকছে।স্রোত যেনো কিছু বুঝে উঠতে পারছে না।তাহলে কি আম্মুর কিছু হয়েছে!স্রোত মান্ধবীকে ছাড়িয়ে প্রশ্ন করলো,

“কিরে কি হয়েছে?তোরা এই অসময়ে এখানে কেনো?কাঁদছিস কেনো?কি হয়েছে?”
তারপর সবার উদ্দেশ্যে বলে,
“আম্মু কোথায়?আপনাদের সবার মন খারাপ কেনো?কেউ কিছু বলুন প্লিজ!”
সবাই বুঝলো স্রোত এখনো কিছু জানে না। মেয়েটাকে কিভাবে এই কথা বলবে কেউ বুঝে উঠতে পারছে না।এর মাঝে মান্ধবী প্রশ্ন করলো,

“তুই কিছু জানিস না?”
“কি জানার কথা বলছিস?”
মান্ধবী তখন বাড়ির অন্যদের দিকে তাকায়।তারা ইশারা করে বোঝায় স্রোত এখনো কিছু জানে না।মান্ধবী নিজেকে সামলিয়ে বোনকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“তোর ফোন কোথায়?”
“চার্জে।কাল চার্জ দিতে ভুলে যাওয়ায় এখন উঠে দেখি ফোন অফ হয়ে আছে।কিন্তু কেনো?”

সবাই এতোক্ষণে সবটা বুঝলো।মান্ধবী তখন নিজের ফোনে একটা নিউজ চালু করে ফোনটা স্রোতের দিকে এগিয়ে দেয়।
স্রোত ফোনটা নিয়ে স্ক্রিনে জ্বল জ্বল করে লেখা “ব্রেকিং নিউজ ” শব্দটি দেখলো।এক অতীব সুন্দরী নারীকে বলতে দেখা গেলো,

স্রোতস্বিনী পর্ব ২২

“মধ্যরাতে পাহাড়ি দ স্যুদের সাথে মুখোমুখি সং ঘর্ষ হয় বাংলাদেশ সেনাসদস্যের।একপর্যায়ে সেনাসদস্যরা দস্যুদের চারিদিক থেকে ঘেরাও করতে নিলে তারা বো মা হামলা করে।ফলে ঘটনাস্থলেই মা রা যায় অনেক দস্যু এবং সেনাসদস্য।নিহতদের চেহারা শনাক্ত করা যায় নি।মৃতদেহ ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।তবে ঘটনাস্থল থেকে মেজর মেহরাদ সাদাফের ইউনিফর্মের ব্যাডজ্ পাওয়া গিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে,মেজর মেহরাদ সাদাফ ঘটনাস্থলেই মা রা গিয়েছেন……”

স্রোতস্বিনী পর্ব ২৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here