আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৩১

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৩১
লেখনীতে সালমা চৌধুরী

কিছুক্ষণ হলো পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এত এত পরীক্ষার্থীর ভিড়ে আবিরের দৃষ্টি খোঁজছে সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে ৷ অবশেষে চোখ পরে তার অষ্টাদশীর পানে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে, মুখে তার তৃপ্তির হাসি, খুশিতে জ্বলজ্বল করছে দুই আঁখি৷ এক নিমিষেই আবিরের দুশ্চিন্তা উধাও হয়ে গেছে৷
মেঘ কাছাকাছি এসে খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,

“আলহামদুলিল্লাহ, পরীক্ষা ভালো হয়েছে৷ ”
সঙ্গে সঙ্গে প্রশস্ত হলো আবিরের দুই ওষ্ঠ। ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
“আলহামদুলিল্লাহ। ”
বাসায় কল দিয়ে সবার সাথে কথা বলেছে। আবির মেঘের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
” এখন কি বাসায় যাবি?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বাসায় যাওয়ার কথা শুনেই মেঘের মনটা খারাপ হয়ে গেছে৷ ২৪ ঘন্টা বাসায় থাকতে থাকতে বির*ক্ত হয়ে গেছে। কোচিং এ যাওয়া ব*ন্ধ হওয়ার পর শুধু একদিন ভাই বোনদের সাথে ঘুরতে বের হয়েছিলো। সেই থেকে বলতে গেলে ঘরবন্দী। মেঘের মন খারাপ দেখে আবির পুনরায় প্রশ্ন করল,
“ঘুরতে যাবি?”

সহসা মেঘ হাসিমুখে আবিরের দিকে তাকিয়েছে। কিন্তু হাসিটা কয়েক সেকেন্ডেই গায়েব হয়ে গেছে। মনে পরে গেল কিছুদিন আগের খাতা পুড়ানোর ঘটনা। যার মনে মেঘের জন্য বিন্দু মাত্র জায়গা নেই, তার সাথে কথা বলায় বেমানান ৷ ওনার নাম লেখাতে যেই মানুষটা কয়েকমিনিটের মধ্যে সম্পূর্ণ খাতা পু*ড়িয়ে ফেলেছেন, সেই মানুষটার থেকে দূরে থাকায় শ্রেয়। মেঘ মাথা নিচু করে উত্তর দিল,
“না বাসায় চলে যাব।”
আবির কপাল কুঁচকে কেমন করে চেয়ে আছে। আবির খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে, তার অষ্টাদশী অভিমান করে আছে ।
আবির গম্ভীর কন্ঠে বলল,

“আগে চল খেতে যায়। তোর জন্য তাড়াহুড়োতে সকালে না খেয়ে বের হয়ছি। খুব খুদা লাগছে। ”
আজ শহর জুড়েই জ্যাম। পরীক্ষার্থীদের ভিড়ে গাড়ি এক জায়গাতেই ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে আছে। মেঘকে নিয়ে নাস্তা করে বেড়িয়েছে। ১ ঘন্টায় বিশাল জ্যাম পেরিয়ে বাইক ছুটছে নিরুদ্দেশের পথে। মেঘ দুবার জিজ্ঞেস করেছে, ” কোথায় যাচ্ছি? ”

কিন্তু আবির কোনো উত্তর দেয় নি। ঘন্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে গেছে এক অপরূপ সুন্দর জায়গায়। উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরের সুপরিচিত সেই জায়গার নাম দিয়াবাড়ি। দিয়াবাড়ি সবসময় ই বেশ জনপ্রিয়। তবে শরৎকালে কাশফুলের শুভ্রতায় এই স্থানের মাধুর্যতা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। আকাশে যেমন সাদা মেঘেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে তেমনি প্রকৃতি জু্ড়েও সাদার মেলা।

মুগ্ধ আঁখিতে কাশফুল দেখছে মেঘ। কাশফুলের শুভ্রতায় মেঘের মন ফুরফুরে হয়ে গেছে। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে, আলতো হাতে কাশফুল ছুঁয়ে দিচ্ছে। এদিকে আবির বাইকে হেলান দিয়ে দুর্বোধ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে সেই দৃশ্য দেখছে। মুহুর্তেই আবিরের ঠোঁটের কোণে হাসির ঝলক দেখা গেল। আনমনে বলে উঠল ,
“মানুষ শুধু শরতে কাশফুলের মায়ায় পড়ে, অথচ আমি প্রতিদিন,প্রতিক্ষণ শুধু তোর মায়ায় পড়ে থাকি।”
মেঘের মনে আনন্দের সীমা নেই। আনন্দ হবে নাই বা কেনো। ঢাকা শহরে থেকেও এত বছরে কোনোদিন এই জায়গায় আসতে পারে নি। শুধু দুএকবার নাম ই শুনেছে। বাবা-কাকারা ব্যবসার কাজে এতই ব্যস্ত থাকেন যে,

সবাইকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার সময় ই নেই কারো৷ কাকামনি মাঝে মাঝে মেঘ, মীম আর আদি কে নিয়ে বের হলেও সেটা ৩ মাসে একবার। অথচ আবির দেশে ফিরেছে সবেমাত্র ৪ মাস হবে। এই অল্প সময়েই আবির মেঘকে নিয়ে ঢাকার আশেপাশে সব জায়গা ঘুরে ফেলেছে। অবশেষে আজ কাশফুলের রাজ্যেও নিয়ে আসছে, ভাবতেই পারছে না মেঘ। আবির মেঘকে বুঝতে না দিয়ে, মেঘের বেশকিছু ছবি তুলেছে।ফোন পকেটে রেখে, কতগুলো কাশফুল একসাথে এনে মেঘের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

“তোর কিছু ছবি তুলে দিব?”
মেঘ আবিরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো। সেও মনে মনে ভাবছিল, মোবাইল টা নিয়ে আসলে ছবি তুলতে পারতো৷ কিন্তু আবির ভাইকে এই কথা বলার সাহস পাচ্ছিলো না। আবির মেঘের মনের কথা বলে ফেলেছে, তাই না চাইতেও মেঘ হেসে ফেলেছে । আবির কয়েকটা ছবি তুলে দিয়েছে, ছবিগুলো দেখে মেঘ স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“ধন্যবাদ, আমরা কি এখন চলে যাব?”
আবির ভ্রু কুঁচকে বলে উঠল,

“এত স্বা*র্থপর কেন তুই?”
মেঘ চোখ বড় করে তাকিয়ে শুধালো,
“মানে?”
আবির বিরক্তির স্বরে বলল,
“এইযে এত কষ্ট করে এতদূর নিয়ে আসলাম তোকে,ছবিও তুলে দিলাম। একটা বার বলতে তো পারতি,দেন আপনাকে দুটা ছবি তুলে দেয় বা একটা সেলফি অন্তত তুলি। যেই নিজের ছবি তুলা শেষ ওমনি বাসায় যায় গা, স্বা*র্থপর একটা৷ ”

“আমি স্বা*র্থপ*র হলে আপনি হি*টলা*র। ” মুখের উপর মেঘ জবাব দিয়ে ফেলছে।
আবির কপালে কয়েক ভাঁজ ফেলে, ভারী কন্ঠে বলল,
“আমি হি*টলা*র হলে তুই হি*টলা*রের নানী । ”
এ যেনো বিতর্ক প্রতিযোগিতা চলছে।
মেঘ ভেঙচি কেটে বলল,
“জীবনেও না। আমি আপনার মতো এত পা*ষাণ না। ”

এ কথা শুনে আবির হেসে ফেললো। আচমকা হাসাতে মেঘ বিস্ময় সমেত তাকিয়েছে। মেঘ ভেবেছিল আবির ভাই হয়তো রে*গে যাবেন৷ কিন্তু ওনি হাসছে দেখে বেশ অবাক হয়েছে।
আবির গলা খাঁকারি দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলা শুরু করল,

“সামান্য একটা কারণে গত ৯ বছর তুই আমার সাথে কথা বলিস নি। তুই ভুল করলে, বড় ভাই হিসেবে কি তোকে শা*স্তি দেয়ার অধিকার ছিল না আমার ? এইযে এতগুলো বছরে একটা বার কথা বলিস নি আমার সাথে, তখন একবারের জন্যও কি নিজেকে পা*ষাণ মনে হয় নি তোর? হয়তো দেশে না ফিরলে এখনও কথা বলতি না। একবারও মনে হয়নি, এই মানুষটার সাথে কথা বলা উচিত? তোর এই অসীম দূরত্বে সেই মানুষটারও খারাপ লাগতে পারে, ভেবেছিস কখনো? ভাবিস নি!”

মেঘ শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে। ওষ্ঠদ্বয় কাঁপছে তিরতির করে। আবির ভাইয়ের সাথে এতবছরে একবারের জন্য ও কথা বলতে ইচ্ছে হয় নি তার। অথচ ওনাকে দেখার পর, ওনার ভারী কন্ঠে বলা একেকটা কথা, অনুভূতিহীন আচরণ, ক্রো*ধিত আঁখি, তাকানোর স্টাইল, ঘন কালো চুল আর গাল ভর্তি ছোট ছোট দাঁড়ি দেখে ধীরে ধীরে প্রেমে পড়তে বাধ্য হয়েছে। আবির ভাই তো দেশে ফিরে আবারও থা*প্পড় দিয়েছে তাকে ।

কই এবার তো সে কথা বন্ধ করে নি। রা*গ, অভি*মান শেষে ঠিকই বার বার কথা বলেছে। এইযে সেদিন খাতা পুড়ালো তারপরও আজ সেই মানুষটার সাথেই ঘুরতে এসেছে। তাহলে এত বছর কেনো কথা বলতে ইচ্ছে হয় নি তার?
মেঘ কিছু বলছে না দেখে আবির বাইকের দিকে চলে যাচ্ছিলো৷ মেঘ আচমকা বলে উঠল,
“আপনার সাথে একটা ছবি তুলা যাবে?”
আবির মুচকি হেসে উত্তর দিল,
“Why not ”

ঘুরাঘুরি শেষে বাসায় ফিরছে। মেঘের হাতে অনেকগুলো কাশফুল। তার খুব ইচ্ছে করছে এগুলো বাসায় নিয়ে মীম আর আদিকে দেখাবে। কিন্তু আবিরের ক*ড়া নি*ষেধ বাসায় নেয়া যাবে না।বাধ্য হয়ে মানতে হলো আবির ভাইয়ের কথা। রাস্তায় ২ টা পিচ্চি মেয়েকে ফুলগুলো দিয়ে বাসায় চলে আসছে৷

সময় চলছে নিজস্ব গতিতে। মেঘের পড়াশোনার অন্ত নেই। সবেমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা শেষ হলো৷ সামনে মেডিকেল পরীক্ষা। পড়ার চাপ যতটা মেঘের, ঠিক ততটায় জান্নাতের। প্রতিদিন ৩-৪ ঘন্টা সময় নিয়ে পড়ানো। নিজে প্রশ্ন করে মেঘের পরীক্ষা নেয়া, সেগুলোর সমাধান করা। ১৫ দিনের মাথায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। যতদিন না মেঘ চান্স পাচ্ছে ততদিন চলবে এই লড়াই।

সপ্তাহ খানেক পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক ইউনিটের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। মেঘের সিরিয়াল আসছে। সেই খুশিতে খান বাড়িতে উৎসব চলছে৷ প্রতিটা মানুষ ই মহাখুশি, তবে মোজাম্মেল খান তেমন খুশি না। কারণ ওনার ইচ্ছে মেঘ মেডিকেলে পড়বে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি ওনার আগ্রহ নেই বললেই চলে। বাড়ির সবাই হৈ চৈ করছে দেখে এক সময় ধ*মক দিয়েই বসলেন,

“মেডিকেল পরীক্ষা এখনও হয় নি। এত খুশি হওয়ার কিছু নেই। সামনে পরীক্ষা৷ পড়তে বসো গিয়ে। ”
আবির রুমের বাহিরে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে নিচে সবার হৈ-হুল্লোড় দেখছিল। তবে মোজাম্মেল খানের ধ*মকে আজ আবিরের রা*গ হচ্ছে না। বরং মেঘের চান্স পাওয়ার খুশিতে এসব সামান্য বিষয়কে সে পাত্তায় দিচ্ছে না। কিন্তু মোজাম্মেল খানের ধম*কে মেঘের মন খারাপ হতে সময় লাগলো না। সিঁড়ি দিয়ে উঠে নিজের রুমে যেতে গিয়ে আবিরকে দেখেই থ*মকে দাঁড়ালো। শীতল চোখে তাকালো একবার। হয়তো বুঝতে চেয়েছিলো রেজাল্ট এর কথা শুনে আবির ভাই খুশি হয়েছেন কি না! কিন্তু আবিরের অভিব্যক্তি বুঝা গেল না। তাই মাথা নিচু করে মেঘ রুমে চলে গেছে।

মেঘের পড়া যেমন থেমে নেই তেমনি জান্নাত আপুর ও ছুটি নেই। কিছুদিন পর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা দিলো। এবার আর আবির নিয়ে যায় নি। মোজাম্মেল খান নিজে গাড়ি করে মেয়েকে নিয়ে গেছেন। পরীক্ষা যেমন ই হয়েছে,রেজাল্টের অপেক্ষায় আছে সবাই। কিছুদিন পর একদিন আবির আর রাকিব অফিসে কাজ করছিলো। হঠাৎ রাসেল ছুটে এসে উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

“কিরে আবির মেঘ কি চান্স পাইছে?”
আবির ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থেকেই উত্তর দিল,
“DU তে হয়ছে, জগন্নাথে ওয়েটিং৷ কেন?”
রাসেল পুনরায় বলল,
“আরে ভার্সিটি না। মেডিকেলে চান্স পাইছে কি না জিজ্ঞেস করছি৷ ”
আবির অবাক চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
“রেজাল্ট দিয়ে দিছে নাকি?”
রাসেল সহসা উত্তর দিল,

“হ্যাঁ, মাত্র দেখলাম। এজন্যই তো তোকে জিজ্ঞেস করতে আসছি।”
আবির তাড়াতাড়ি ফোন বের করে নেটে রেজাল্ট দেখল, অকস্মাৎ আবিরের মুখটা মলিন হয়ে গেলো।
রাকিব জিজ্ঞেস করল,
” কি হলো, চান্স পায় নি?”
আবির ভারী কন্ঠে উত্তর দিল,
“সরকারি তে আসে নি, প্রাইভেটে পড়তে পারবে।”

আবির সঙ্গে সঙ্গে তানভির কে কল দিয়েছে। তানভির বাসায় নেই। আবির বসা থেকে উঠে রুমের মধ্যে পায়চারি শুরু করেছে। কি করবে বুঝতে পারছে না। বাসায় কি চলছে কে জানে! হঠাৎ ই মীমের কথা মনে পড়লো । তাড়াতাড়ি আকলিমা খানের নাম্বারে কল দিয়েছে। প্রথম কলটায় রিসিভ করলো মীম। মায়ের ফোন বেশিরভাগ সময় মীমের কাছেই থাকে৷ মীম আর আদি মিলে গেম খেলে। মীম কল রিসিভ করেই সালাম দিলো।
আবির সালামের উত্তর দিয়ে ভারী কন্ঠে বলল,

“বাসার কি অবস্থা? ”
মীম চিন্তিত স্বরে বলল,
“চাচ্চু আপুকে ব*কতেছে। আম্মু আর মামনি মিলেও থামাতে পারছে না। আব্বু, বড় আব্বু, বড় আম্মু কেউ বাসায় নেই। আমাকে আর ভাইকেও ধ*মকে রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে। ”

আবির আর কিছু না বলেই কল কেটে দিয়েছে। তৎক্ষনাৎ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। আবির সেদিনই চাচ্চুর মনের কথা বুঝেছিল। এই ঝামেলা টা হওয়ার ই ছিল, কিন্তু আজ রেজাল্ট দিবে এটা আবিরের জানা ছিল না।৷ জানলে হইতো আজ বাসা থেকে বের ই হতো না। বাইকের গতিই বুঝিয়ে দিচ্ছে ভেতরে ভেতরে আবির কতটা ক্ষি*প্ত। বাসার গেইট টা কোনোরকমে পেরিয়ে বাইক রেখে ছুটে গেছে অন্দরমহলে। ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে আছেন মোজাম্মেল খান, ওনার পাশে হালিমা খান স্বামীকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। সিঁড়ির পাশে ভীত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেঘ৷ চিবুক নেমে গলার সঙ্গে মিশে আছে৷ কান্নার তোপে সামনেরদিকের চুলগুলো ভেজা গালে লেপ্টে আছে, দৃষ্টি তার ফ্লোরের দিকে।

আকলিমা খান রান্নাঘরে। ভাসুর কে থামানোর সাধ্য নেই বলেই সরে পরেছেন। আলী আহমদ খান মালিহা খানকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলেন৷ এখনও ফেরে নি। ইকবাল খান হয়তো কোনো কাজে বেড়িয়েছেন।
মোজাম্মেল খান তখনও রা*গান্বিত কন্ঠে বলেই যাচ্ছেন,

“তোকে এত আদর ভালোবাসা দিয়ে কি হলো। সরকারি মেডিকেলে চান্স টায় পাস নি। কত গর্ভ করে সবাইকে বলেছিলাম আমার মেয়ে মেডিকেলে পড়বে। এখন আমি কোন মুখে বলবো যে আমার মেয়ে চান্স পায় নি। তোকে….”
এতটুকু বলতেই আবির উচ্চস্বরে বলে উঠল,
“এই মেঘ রুমে যা। ”

আচমকা আবিরের কন্ঠ শুনে মেঘ কিছুটা কেঁপে উঠল। মোজাম্মেল খানও থেমে গেলেন। মেঘ মুখ তুলে আবিরের দিকে তাকিয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে চোখ লাল করে ফেলেছে। মোজাম্মেল খান বাসায় ফেরার পর থেকে মেঘকে ব*কেই যাচ্ছেন। ঘুরে ফিরে এক কথায় বার বার বলছেন,
“এত আদরে থেকে, এত সুযোগ সুবিধা পেয়েও মেডিকেলে চান্স পাস নি। ছেলে যেমন ভ*ন্ড, মেয়েটাও এরকম ই হচ্ছে। সামান্য একটা ভর্তি পরীক্ষাতে চান্স পেতে পারে নি। এই থেকে শুরু করে আর যা যা বলার ছিল সবই বলেছেন।”

অতিরিক্ত রা*গে মানুষের বুদ্ধি লোপ পায়৷ তখন যা বলে তার বেশিরভাগ ই অহেতুক আর বিবেকহীন কথা।
মেঘ সিক্ত আঁখিতে আবিরের দিকে তাকিয়েই আছে। আবির নিরেট কন্ঠে পুনরায় বলল,
“রুমে যেতে বলেছি তোকে।”

মেঘ মাথা নিচু করে ফেলেছে। বাবার দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। এতক্ষণ বাবার ধম*ক খেয়েছে এখন আবির ভাইয়ের ধ*মক খাওয়ার আর ইচ্ছে নেই। তাই ধীর পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলো। আবির কয়েক কদম এগিয়ে সোফার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে মোজাম্মেল খানের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলা শুরু করলো,
” যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। এমন তো নয় যে, মেঘ চেষ্টা করে নি। আর এমনটাও নয় যে, সে পাশ করে নি। আপনার যদি পড়ানোর ইচ্ছে থাকে তাহলে এত এত প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ আছে। ঐখানের কোনোটাতে পড়াতে পারেন৷”

মেঘ রুমে যেতে যেতে আবিরের কথাগুলো শুনেছে।আবির ভাই যে বাপের ব*কার হাত থেকে মেঘকে বাঁচাতে এসেছে৷ এটা ভেবেই মেঘ অবাক হয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে ওনিই বলেছিলেন DU তে চান্স না পেলে পা ভে*ঙে ঘরে বসিয়ে রাখবেন। অথচ আজ সেই মানুষটার ভিন্ন রূপ।
“একটা মানুষের কত রূপ ই না হতে পারে!”
মোজাম্মেল খান রে*গে বললেন,

“প্রাইভেটে পড়ানোর ইচ্ছে থাকলে মাস শেষে এত এত টাকা মেয়ের পড়াশোনার জন্য খরচ করতাম না। বাসা থেকে বের হলেই আশেপাশের মানুষ আমায় প্রশ্ন করবে, কেন চান্স পায় নি, কি বলবো আমি তখন?”
আবির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“আপনি কি চাইছেন এখন? ঘন্টার পর ঘন্টা মেয়েটার উপর রা*গ ঝাড়লেই কি রেজাল্টে পরিবর্তন আনতে পারবেন? এডমিশন টেস্টের সময় একটা মানুষ এমনিতেই ডিপ্রেশনের মধ্যে দিয়ে সময় পার করে, সেখানে তাকে এভাবে কথা শুনাচ্ছেন! আজ আপনার যতটা কষ্ট হচ্ছে। তার থেকেও হাজার গুণ বেশি কষ্ট হচ্ছে মেঘের । দিনরাত এক করে চান্স পাওয়ার জন্য পড়াশোনা সে করেছিলো। বাবা মা হিসেবে ওকে সাপোর্ট করাটা আপনাদের দায়িত্ব ছিল। কিন্তু কি বলবো, আপনারা তো সন্তানের থেকেও সমাজ কে বেশি প্রাধান্য দেন। ”

কথাগুলো বলে আবির সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাচ্ছে। মোজাম্মেল খান নিশ্চুপ বসে আছেন। ভেতরে ভেতরে এখনও রা*গে ফুঁসছেন। কিন্তু আবিরের বলা কথাগুলোর প্রতিত্তোর ছিল না বলেই চুপ করে গেছেন। হালিমা খানও শান্ত স্বরে স্বামীকে বুঝাচ্ছেন। মেঘ বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আসে। আবির একটু শব্দ করেই দরজা ধাক্কা দিল। কিন্তু মেঘের কোনো সাড়াশব্দ নেই। অবিরত কেঁদেই যাচ্ছে , এই কান্নার কোনো অন্ত নেই।
আবির বিছানার পাশে বসে আস্তে করে ডাকলো,

“মেঘ ”
সঙ্গে সঙ্গে মেঘ একটু থামলো। তারপর আবার কান্না শুরু করলো। আবির আলতোভাবে মাথায় হাত রেখেছে। এলোমেলো চুল গুলো কিছুটা গুছিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“তোর সাথে কথা আছে,উঠ। ”
মেঘ কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিল,
“আমার সাথে কথা বলতে হবে না। আপনি চলে যান৷ ”
আবির গম্ভীর কন্ঠে বলল,

“তোর সাথে কথা না বলে আমি যাব না। আমি ১০ পর্যন্ত গুনবো, এরমধ্যে মুখ ধৌয়ে আমার সামনে এসে বসবি। ”
মেঘ তবুও নড়ছে না। আবির ভারী কন্ঠে বলা শুরু করল,
“এক…….”
“দুই…….”
মেঘ তড়িঘড়ি করে উঠে ওয়াশরুমে চলে গেছে। মেঘের এই তড়িঘড়ি দেখে আবির মৃদু হাসলো।
মেঘ ফ্রেশ হয়ে আবির মুখোমুখি বসেছে। আবির মোলায়েম কন্ঠে শুধালো,

“তুই কাঁদছিলি কেনো? চান্স পাস নি বলে নাকি চাচ্চু ব*কেছে তাই?”
মেঘকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে আবির আবার শুধালো,
“তুই কি মেডিকেলে পড়তে চাস? পড়তে চাইলে বল। প্রাইভেটেই পড়াবো তোকে। কেউ রাজি না হলে, আমি তোকে পড়াবো। শুধু বল পড়তে চাস কি না। ”
মেঘ মাথা নিচু করে উত্তর দিল,
“জানি না। ”

এই প্রশ্নের উত্তর নেই মেঘের কাছে। কারণ ছোটবেলা থেকে ভালো স্টুডেন্ট হওয়ায় JSC এর পর সবার মতো পরিবারের কথায় তাকেও সাইন্স নিতে হয়েছিল। আর সাইন্স নেয়া মানেই বাড়ির মানুষ ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন দেখা শুরু করে। সবার স্বপ্ন কে বাস্তবায়ন করতেই এতদিন সে চেষ্টা করে এসেছে।
আবির শ্বাস ছেড়ে ভারী কন্ঠে বলা শুরু করলো,

“দেখ, যদি এমন হয় ডাক্তার হওয়ায় তোর একমাত্র লক্ষ্য । তুই মন প্রাণ দিয়ে চাস ডাক্তার হতে। তাহলে তুই প্রাইভেটে পড়তে পারিস। প্রাইভেট থেকে পড়েও প্রতিবছর হাজার হাজার ভালো ডাক্তার বের হচ্ছেন। কিন্তু যদি মনে হয়,ডাক্তার হওয়া তোর একমাত্র স্বপ্ন নয়। তুই সাইন্স নিয়েছিস, আর আশেপাশের মানুষ চাইছে তুই ডাক্তার হ। শুধুমাত্র তাদের ইচ্ছে পূরণ করতে মনের বিরুদ্ধে তুই ডাক্তার হতে চাচ্ছিস,তাহলে আমি বলবো কোনো দরকার নেই। কারো কথায় বা কারো চাপে নিজের ইচ্ছে কে কখনোই মাটি চাপা দিবি না। তোর যেখানে পড়তে ইচ্ছে করে তুই সেখানেই পড়তে পারিস। কে কি বলবে সেটা আমি বুঝবো!”

মেঘ নির্বাক চোখে চেয়ে আছে আবির ভাইয়ের মুখের পানে। আবিরের বলা কথাগুলো শুনে মেঘের চোখ আবারও টলমল করছে। তার আব্বুও তো কথাগুলো এভাবে বলতে পারতো । আবির তপ্ত স্বরে পুনরায় বলল,
“পৃথিবীর মানুষ কি ভাবছে তাতে আমার কিছু যায় আসে না। তোর ইচ্ছেটায় আমার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান । দিনশেষে আমি তোর মুখে মিষ্টি হাসি দেখতে চাই। কারো কথায় নয়, নিজে সিদ্ধান্ত নিবি তুই কি চাস। আবারও বলছি, তুই যা চাস তাই হবে। ”

আবির চলে গেছে। আবিরের দেয়া সান্ত্বনা তে আর কিছু হলো কি না জানা নেই তবে মেঘের কা*ন্না থেমে গেছে। দীর্ঘসময়ের অশান্ত মন শান্ত হয়ে গেছে। তবে এখন নিচে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে তার নেই। লাইট অফ করে শুয়ে শুয়ে ফোন চাপছিলো। বন্যার সাথে কথা হয় নি৷ বন্যাকে ২ বার কল দিয়েছে। কিন্তু কোনো খবর নেই৷ ফে*সবুকে ঘুরতে ঘুরতে আবির ভাইয়ের একটা ছবি সামনে আসছে। এতদিন পড়াশোনার চাপে আবির ভাইয়ের আইডিটাও ঘুরে দেখা হয় না। তাই আজ সময় নিয়ে আইডিতে ঘুরতেছে। হঠাৎ ই চোখে পরলো সামনে আবির ভাইয়ের জন্মদিন।

মেঘ দিন গুনছে, আর মাত্র তিনদিন বাকি। কিভাবে কি করবে এসব ভাবতে ভাবতে রেজাল্টের চিন্তা মাথা থেকে চলে গেছে। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পরেছে কে জানে!
কিছুক্ষণের মধ্যে মালিহা খান আর আলী আহমদ খান বাসায় ফিরেছেন। মেঘের মন খারাপ শুনে দেখতেও গিয়েছিলেন। কিন্তু মেঘ ঘুমাচ্ছে দেখে ডাকেন নি৷ ছোট বেলা থেকেই মেঘের ঘুম অনেক গভীর আর ঘুমের মধ্যে মেঘকে ডাকলে মাথা ব্যথা করে। তাই সচরাচর কেউ ই ডাকে না।

কিছুক্ষণ পর আবির মায়ের রুমে গেছে। কিছুদিন যাবৎ ই মালিহা খানের প্রেশার বাড়তি, মাথা ভার হয়ে থাকে, চোখে ঝাপসা দেখছিলেন। আবির মায়ের কাছে কিছুক্ষণ বসে, খাবার খাইয়ে তারপর ঔষধ খাইয়ে নিজের রুমে আসছে। এটুকু সময়ের মধ্যে আলী আহমদ খান রুমে আসেন নি। হয়তো বা দুই ভাই অন্য রুমে কথা বলছেন।

ঘন্টাখানেক পর তানভির বাসায় ফিরেছে। আবিরের কাছ থেকে সবই শুনেছে। মেঘকে দেখতেও গিয়েছিল কিন্তু লাইট অফ দেখে সেও ডাকে নি। রুমে বসে কি করবে বুঝতে পারছে না।
তখনই বন্যার নাম্বার থেকে কল আসছে৷ তানভির অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে কলটা রিসিভ করল,
বন্যা বলল,

“আসসালামু আলাইকুম। ”
তানভির উত্তর দিল,
“ওয়ালাইকুম আসসালাম৷”
বন্যা চিন্তিত কন্ঠে শুধালো,
“আপনি কি বাসায়? মেঘ কোথায় বলতে পারবেন? এতগুলো কল দিচ্ছি রিসিভ করছে না তো তাই বাধ্য হয়ে আপনাকে কল দিলাম । ”
তানভির স্বাভাবিক কন্ঠে জবাব দিল,

“আমি বাসায়। বনু তো ঘুমাচ্ছে, মনে হয় ফোন সাইলেন্ট করা।”
বন্যা আবার প্রশ্ন করলো,
“মেঘের কি সরকারিতে চান্স হয়ছে?”
তানভির ভারী কন্ঠে উত্তর দিল,
“না, প্রাইভেটে। তোমার?”
বন্যা মন খারাপ করে বলল,
“আমারও । ”
তানভির ধীর কন্ঠে বলল,

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৩০

” চিন্তা করো না। যা হবে ভালোই হবে। DU তে তো তোমার ও চান্স হয়েছে শুনলাম। বনুরে বুঝাইয়া দুজনেই ভর্তি হয়ে পরো। হয়তো আল্লাহ চাচ্ছেন দুই বান্ধবী একসাথে থাকো।”
বন্যা মৃদু হেসে উত্তর দিল,
“হয়তো বা৷ দোয়া করবেন। আল্লাহ হাফেজ। ”
তানভির ও আল্লাহ হাফেজ বলে ফোন রেখে দিয়েছে।

আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব ৩২