আহনাফ চৌধুরী পর্ব ৩

আহনাফ চৌধুরী পর্ব ৩
মুন্নি আক্তার প্রিয়া

তামিমের বিস্ময় কাটছিল না তখনো। আহনাফ বসে আছে ভাবলেশহীনভাবে। তামিম গাল চুলকে বলল,
“তুই যদি এই চিরকুট সুপ্তিকে দিয়ে থাকিস তাহলে এটা অর্ষার কাছে যাবে কীভাবে?”
“আমি জানিনা।”
“অর্ষা আর সুপ্তি ফ্রেন্ড না তো আবার?”
“তোর মাথা গেছে? অর্ষার বয়স আর সুপ্তির বয়স এক?”
“তাহলে পরিচিত?”

“জানিনা রে বাপ! এই টপিক এখন বাদ দে। তোর কথা বল। মেয়ে পছন্দ হয়েছে?”
“হ্যাঁ। আমার কাছে বেশ ভালো লেগেছে। আলাদা কথাও বলেছি। বেশ নম্র-ভদ্র আর শান্ত মনে হলো কথা বলে।”
“তাহলে তো ভালোই। বাড়িতে গিয়ে বলে দিবি যে মেয়ে পছন্দ হয়েছে তোর।”
“আমি না হয় বললাম! কিন্তু মেয়ের আমাকে পছন্দ হয়েছে কিনা তা কে জানে?”
“না হওয়ার মতো তো কোনো কারণ দেখছি না।”
“সেটা তো বাসায় গেলেই জানা যাবে। চল উঠি তাহলে এখন?”
আহনাফ মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। চায়ের বিল মিটিয়ে দুজনে বেরিয়ে গেল চায়ের দোকান থেকে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নীল রঙের বারো হাত শাড়িটা ঝেড়ে ভাঁজ করছে ঐশি। পাত্রপক্ষের সামনে আজ সে এই শাড়িটা পরেই গিয়েছিল। তামিমের সাথে কথা বলার সময়ে এক প্রসঙ্গে জানতে পেরেছিল নীল তার ভীষণ পছন্দের। অবশ্য অধিকাংশ মানুষেরই দেখা যায় যে নীল রং প্রিয়। কমন একটা কালার। নিজের মাঝে যখন বিভিন্ন রকম চিন্তা-ভাবনার প্রসার ঘটে চলছিল সেই মুহূর্তে অর্ষা এলো ঐশির রুমে। মূলত আমেনা বেগমই ওকে পাঠিয়েছে তামিমের ব্যাপারে কথা বলতে। পছন্দের কথা মাকে বললেও অপছন্দের অনেক কিছুই হয়তো দ্বিধায় সে মাকে বলতে পারবে না। এজন্যই তিনি অর্ষাকে পাঠিয়েছেন। ঐশি চাপা স্বভাবের এবং শান্ত। সবার সাথে তার ভাব তেমন না থাকলেও অর্ষার সাথে আছে। অর্ষাকে সে ভালো-মন্দ সমস্ত কিছুই শেয়ার করে।

“আপু!”
অর্ষাকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঐশি মুচকি হাসল। বলল,
“ভেতরে আয়।”
অর্ষা বিছানায় পা উঠিয়ে বসল। ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“ব্যাপার কী তোর?”
“কীসের ব্যাপার?”
“মনে মনে হাসছিস কেন?”

“কই মনে মনে হাসি? চোখে বেশি দেখিস!”
“আচ্ছা! তারপর বল ছেলেকে কেমন লাগল?”
“ভালো।”
“শুধু ভালো?”
“আর কী?”
“অনেক ভালোও হতে পারে। আবার বিয়ে করার মতোও ভালো হতে পারে। তোর কোনটা? বিয়ে করার মতো ভালো লেগেছে?”

ঐশি চুপ করে আছে। বয়সে সে অর্ষার চেয়ে চার বছরের বড়ো। পড়াশোনার গণ্ডি পেরিয়ে এখন একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করছে সে। বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা শূন্যের কোটায়। স্কুলে থাকতে বেস্টফ্রেন্ড ছিল এক মেয়ে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় বন্ধুত্বে দূরত্ব বেড়েছে। এখন আর কোনো যোগাযোগও নেই। এরপর থেকে সবার সাথে শুধু ওর ভালো সম্পর্ক। নিজের খুব কাছের বলতে কোনো ফ্রেন্ড নেই।

অফিসেও তাই। কয়েকজনের সাথে ভালো সম্পর্কই শুধু। প্রেম-ভালোবাসা জীবনে অবশ্য এসেছিল। তবে ঐশি ইন্ট্রোভার্ট হওয়ায় সেই ডাকে সাড়া দেয়নি। সে তার পড়াশোনা এবং পরিবার নিয়েই ভালো ছিল। এখন আর বিয়ে না করে উপায় নেই। পরিবারের পছন্দেই বিয়ে করবে ভেবে রেখেছিল সবসময়। তামিমের আগেও কয়েকজন পাত্রপক্ষ দেখে গেছে ঐশিকে। ওদের কারও সাথেই কথা বলে ওর ভালো লাগেনি। কিন্তু তামিমের বেলায় মনে হলো ভিন্ন কিছু ঘটেছে। যদিও তামিমকে দেখে মনে হয়েছে যে, সে চঞ্চল স্বভাবের। একদম তার বিপরীত। কিন্তু ব্যবহার, কথাবার্তা মার্জিত। এটাই বোধ হয় তাকে মুগ্ধ করেছে।

ঐশি অর্ষার পাশে বসে চুপচাপ অনেকক্ষণ ভাবল কিছু। তারপর বলল,
“হ্যাঁ, বিয়ে করার মতো।”
অর্ষা খুশিতে লাফিয়ে উঠে বলল,
“সত্যিই?”
ঐশি মুচকি হেসে বলল,
“হ্যাঁ।”
“ইয়ে! ফাইনালি তাহলে তোর বিয়েটা হচ্ছে।”
“খুব খুশি না? জানি তো কেন এত খুশি। নিজের রাস্তা ক্লিয়ার হবে তাই না?”
“আহ্ আপু! সবসময় সত্যি কথা বলতে হয় না।”
দু’বোনই একযোগে হেসে উঠল তখন।

দুই বাড়ি থেকেই খবর আদান-প্রদান হলো। তাদের সবারই তামিম এবং ঐশিকে পছন্দ হয়েছে। আরেক দফায় দুই পরিবার এক সাথে বসে এঙ্গেজমেন্টটা সেরে ফেলতে চায়। এবার কথাবার্তা হবে তামিমদের বাসায়। সেই সাথে বাড়ি-ঘরও ঘুরে দেখা হবে। ঐশির পরিবারও এতে রাজি হয়েছে।

একদিকে বোনের বিয়ে হবে এই খুশিতে দিন কাটছিল অর্ষার। অন্যদিকে আগামীকাল রিহানের জন্মদিন। সে ভেবে রেখেছে কাল সরাসরি স্টুডিওতে গিয়ে রিহানকে সারপ্রাইজ দেবে। এজন্য সে রাতেই রিহানকে কল দিয়ে জেনে নিয়েছিল যে সকালে সে কোথায় থাকবে। রাতে ঘুমের বাহানা দিয়ে বারোটার আগেই কথা বলা শেষ করেছে অর্ষা। যাতে করে বারোটায় উইশ না করতে হয়। একেবারে সারপ্রাইজ দিয়েই উইশ করবে। এজন্য রাতে সে জলদি ঘুমিয়েও পড়ে। পরের দিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়ে নেয়। ক্লাস আছে আজ, এটা বলে সে বাড়ি থেকে বের হলো। রিহানের সাথে দেখা করে তামিমের সাথে দেখা করতে হবে। গতকাল কল করেছিল সে অর্ষাকে। দরকারি কথা নাকি আছে ওর সাথে।

অর্ষা সবার আগে গেল গিফ্ট কিনতে। একটা ঘড়ি কিনে সে লাভ শেপের একটা পেস্ট্রি কিনে নিল। এরপর দুটো চকোলেট আর দুটো গোলাপ কিনে স্টুডিওর সামনে গিয়ে কল দিল রিহানকে। দু’বার কল দেওয়ার পরও রিহান রিসিভ করেনি। তিনবারের বেলায় কল কেটে দিয়েছে। হয়তো ব্যস্ত আছে। এখন আবার ফোন করাটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারল না অর্ষা। দোনামনা করে প্রায় দশ মিনিট চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। দশ মিনিট পর আবার দ্বিধা করেই কল করল। এবার কল রিসিভ করল রিহান। ব্যস্ততার স্বরে বলল,

“অর্ষা, আমি এখন বিজি আছি। বারবার কল করছ কেন? কী বলবে, তাড়াতাড়ি বলো।”
“একটু বাইরে আসতে পারবে?” ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল অর্ষা।
“বাইরে আসব মানে? তুমি এখন কোথায়?”
“তোমার স্টুডিওর সামনে।”

এরপর আর কিছু না বলেই রিহান কল কেটে দিল। কিছুক্ষণ পরই দেখা গেল, রিহান স্টুডিও থেকে বের হচ্ছে। অর্ষা খুশি হয়ে এগিয়ে গেল কিছুটা। রিহান কাছাকাছি আসতেই অর্ষা ফুলগুলো এগিয়ে দিয়ে বলল,
“হ্যাপি বার্থডে টু ইউ।”
রিহান ফুলগুলো নিল। বিরক্ত হয়ে বলল,
“আর ইউ ক্রেজি অর্ষা?”

অর্ষা হতবিহ্বল হয়ে তাকাল রিহানের দিকে। রিহান সেই বিরক্তস্বরেই বলল,
“এটা আমার কাজের জায়গা। এখানে আসা ঠিক হয়নি তোমার। আমার প্রফেশন তো জানো তুমি!”
অর্ষার চোখ ছলছল করছে। গলাও কেমন যেন ধরে আসছে তার। মাথা নিচু করে গিফ্টগুলো এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এগুলো তোমার। আসছি এখন।”

অর্ষা আর ফিরে তাকাল না। পিছু ঘুরে হাঁটার সময় দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল তার চোখ বেয়ে। হাতের উলটোপিঠে চোখ মুছেও নিল তৎক্ষণাৎ। এরপর হাঁটতে হাঁটতেই তামিমকে কল করে বলল রেস্টুরেন্টে আসতে। সে রেস্টুরেন্টে আসার মিনিট দশেক পরেই তামিমও চলে আসলো। তামিমের সামনে অর্ষা যথাসম্ভব চেষ্টা করল নিজেকে স্বাভাবিক রাখার।

“কখন এসেছ?” জিজ্ঞেস করল তামিম।
“এইতো ভাইয়া একটু আগেই।”
“কিছু অর্ডার করেছ?”
“না।”
“খালি মুখে বসে আছো কেন পাগলি? কী খাবে বলো?”
“কফি।”

“শুধুই কফি?”
“হ্যাঁ। আমি সকালে নাস্তা করেই বের হয়েছি।”
“ঠিক আছে।”
তামিম দুটো কফি অর্ডার দিয়ে বলল,
“আসলে গতকাল তোমায় কল দিয়ে দেখা করতে বলেছি ঐশির বিষয়েই কথা বলতে। ওর সাথে তোমার সম্পর্কটা কেমন?”

“সম্পর্ক কেমন বলতে?”
“না মানে কেমন ক্লোজ তোমরা আরকি!”
“বুঝতে পেরেছি। আমাদের সম্পর্ক খুবই ভালো। কিছু জানতে চাচ্ছেন আপুর ব্যাপারে?”
“কিছু জানতে চাই বলতে, ঐশি কি চুপচাপ স্বভাবের নাকি কথা বলতে চায় না আমার সাথে বুঝতেছি না। ও কি তোমাকে কিছু বলেছে? অথবা ওর কি অন্য কাউকে পছন্দ?”
অর্ষা কিছুটা হেসে বলল,

“এমন কিছু না। ও এরকমই চুপচাপ। আর আপুর আপনাকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে।”
তামিম আহ্লাদিত হয়ে বলল,
“সত্যি?”
“হ্যাঁ।”
“যাক শান্তি!”

অর্ষা হাসল। হাসির মাঝেও তার রিহানের কথা মনে পড়ে গেল তখন। বুকের ভেতরটা তৎক্ষণাৎ মোচর দিয়ে উঠল ওর। কফি খাওয়া শেষে তামিম বলল,
“চলো তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেই।”
“আমি যেতে পারব একা।”

“সমস্যা নেই। আমিও পৌঁছে দিতে পারব।”
“অবশ্য আপু আজ বাসাতেই আছে। গেলে দেখা করতে পারবেন।”
অর্ষার দুষ্টুমিতে লজ্জা পেয়ে গেল তামিম।
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে তামিম বলল,
“তার আগে একটু আহনাফের বাসায় যাই চলো। এইতো সামনেই ওর বাসা। অফিসের একটা ফাইল আছে ওর কাছে।”

অর্ষা মাথা দুলিয়ে বলল,
“আচ্ছা।”
আহনাফের বাসায় ওরা হেঁটেই গেল। লিফ্ট দিয়ে পাঁচ তলায় উঠে কলিংবেল বাজানোর পর দরজা খুলে দিল বাড়ির মেইড। তার চোখে-মুখে ভীতি। ভেতর থেকে ভাঙচুরের শব্দ আসছে। তামিম দৌঁড়ে গেল ভেতরে। পিছু পিছু গেল অর্ষা। ঠিক তখনই একটা কাচের গ্লাস সামনের দিক থেকে ছুঁড়ে মেরেছে আহনাফ। যেটা এসে লেগেছে অর্ষার ডানপাশের চোখের কিনারে।

আহনাফ চৌধুরী পর্ব ২

ঘটনাটি এত দ্রুত ঘটে গেছে যে কেউই কিছু বুঝতে পারেনি। আহনাফ তখনো বাকি জিনিসগুলো উন্মাদের মতো ভাঙচুর করছিল। অর্ষার চিৎকারে সে পিছু ফিরে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। অর্ষা ব্যথায় চোখের ওপর হাত রেখে চেপে ধরেছে। সাজেদা বেগম, তামিম এবং বাড়ির মেইড এসে অর্ষাকে দ্রুত সরিয়ে নিল সেখান থেকে। আহনাফ তখনো বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আঘাতপ্রাপ্ত অর্ষার দিকে।

আহনাফ চৌধুরী পর্ব ৪