এই শহরের পাখিগুলো ডানা মেলে উড়তে জানেনা পর্ব ২

এই শহরের পাখিগুলো ডানা মেলে উড়তে জানেনা পর্ব ২
লেখিকাঃ তামান্না

মেহরিন দৌড়ে তার রুমে চলেগেল। ঠাস করে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। অসহ‍্য লাগছে তার, মনে হচ্ছে বিষ! বিষ খেয়ে নিজেকে শেষ করে দেয়, আরেকবার মনে হয় শরীর টাকে আগুনে ঝলসে পুড়িয়ে দিলে মনে হয় জ্বালাটা কিছুটা কমতো। কেন এত কষ্ট? স্বামীর সঙ্গে পরনারী দেখায় কেন এত কষ্ট? এত কষ্ট করে নিজের স্বপ্ন দিয়ে গড়া সংসার অন‍্য আরেকজন কেড়ে নিচ্ছে। সেখানে তো সে জোড় গলায় অনেক কথাই শুনিয়ে এলো। কিন্তু কিভাবে সে এসব সহ‍্য করবে?কিভাবে সে সহ‍্য করবে?মাথা যেন তারা চরম ভাবে খারাপ হয়েগেছে। হাতের কাছে কিছু খুজতে খুজতে নজর পরলো টেবিলে রাখা ছুড়ি!..

বাহির থেকে দরজা যেন একদম ভেঙ্গে ফেলবে।মার সাথে তাল মিলিয়ে ভাই, বাবা, ভাবী ও যেন ডেকে সারা হয়েগেলেন। আচ্ছা এরা এমন করছে কেন? শান্তিতে কি মরতেও দিবে না এরা? ছুড়িটা হাতে নিয়ে দেখলো খুব ধারালো, এই ছুড়ির একটা দাগ টেনে দিলে হাতের শিরা উপশিরা থেকে রক্ত গুলো টগবগিয়ে পরবে হয়তো, মেহরিন ছুড়িটা নিয়ে চোখ বন্ধ করে একটা টান দিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে গলগলিয়ে তাজা রক্ত গুলো বেরিয়ে পরলো। মুখে তার অজস্র যন্ত্রণাময় হাসি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

হৃদয়ে তার শত ক্ষতবিক্ষত গ্লানি। আচ্ছা মেয়েরা বুঝি এমনি হয়?জীবনের সবকিছু সহ‍্য করলেও স্বামীর প্রতরণা সহ‍্য করা যায় না। এই যন্ত্রণা বিষের থেকেও বেশি বিষক্রিয়ায় শরীরে ছড়িয়ে পরে।এই যন্ত্রণার থেকেও তার কাছে এখন সন্তান হারানো কষ্টটাই বেশি। হাজার হোক সেতো মা! দুটো শিশু যেন তাকে কাছে ডাকছে। তাকে মা বলে ডেকে তার পাশে বসে আছে।
মেহরিন তার সবকষ্ট সব স্মৃতি যেন চোখের সামনে পুনরাবৃত্তি দেখছে। স্মৃতিগুলো ও না যেন সময় বুঝেই
আসে চোখ বেয়ে প্রচন্ড আক্রোশে পানি পরে যাচ্ছে।

রক্ত গুলোর দিকে নজর পরতেই শরীর শিরশির করে উঠলো তার, দাড়ানো অবস্থায় দপ করে পরে গেল সে।
বাহির থেকে মেহরিনের বড় ভাই চেচামেচি শুরু করে দিয়েছেন। মেহরিনকে অনেকবার ডেকেও যখন কিছুই করতে পারেননি তখন দরজা ভেঙ্গে রুমের ভিতর ডুকে পরলেন। হুড়মুড়িয়ে রুমের ভিতর ডুকে পরলো সবাই।
মেয়েকে নিথর ভাবে পরে থাকতে দেখে মেহরিনের মা চিৎকার করে উঠলেন। বড় আদরের মেয়ে তার, দুই ছেলের পর এই ছোট মেয়েই আদরের মণি। সেই মেয়েকে এভাবে নিথর হয়ে পরে থাকতে দেখে তার যেন আত্মা কেপে উঠলো। মেহরিনের বাবা মেয়ের কাছে গিয়ে বসে পরলেন। স্তব্ধ হয়েগেল সবাই, এটা কি হলো! হাসিখুশি মেয়েটা এমন একটা কান্ড গঠিয়ে ফেলবে কেউ ভাবতেই পারেনি।

মেহরিনকে স্ট্রেচারে করে এম্বুল‍্যান্সে ডুকানো হচ্ছে। অজ্ঞান মেহরিনের হয়তো জানা নেই তার আশেপাশে কি হচ্ছে। কিন্তু পরিবারের সব সদ‍্যসের তো ঠিকই মাথা খারাপ হয়েগেছে। প্রত‍্যেকের চোখে পানি, সবাই যেন একটা ঘোরের মধ‍্যে আছে। হসপিটালে আনার পর এটেম্প টু সুসাইড কেসের জন‍্য ডাক্তার রা নিতে চাইলেও। মেহরিনের চাচাতো ভাই ওসি, তার সুপারিশের জন‍্য ডাক্তাররা বাধ‍্য হলো।

কেবিনে শুয়ে আছে মেহরিন খুব শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে।
বাহিরে হট্টগোল চলছে মেহরিনকে নিয়ে, তার শশুর বাড়ির একাংশ চলে এসেছে। মেহরিনের স্বামী আকাশ এখনো আসেনি। মেহরিনের শাশুড়ি কেবিনের বাইরে কেদেকেটেঁ একাকার করে ফেলছেন। তিনি যে করেই হোক এই বউকে নিয়ে যাবেন।আকাশের কুকির্তী জানলেও তিনি মেহরিনের পরিবারের সামনে বললেন তিনি কিছুই জানেন না। কেন কি হয়েছে সব এরিয়ে গেছেন তিনি। মেহরিনের বাবা- মা তাকে প্রশ্ন করেও কোন উত্তর যখন পাননি তখন বুঝলেন মেহরিনের স্বামীই কিছু করেছে। মেহরিনকে হাতছাড়া করা যাবেনা। মেহরিনই তার সংসারটাকে চালিয়েছে, তার কুলাঙ্গার ছেলে তো বাহিরে ঘুরে ঘুরে সব শেষ করে দিয়েছে।ছেলেকে তাই কাল রাতে ইচ্ছে মত শাসিয়ে এসেছেন।

এদিকে… আকাশ পরেগেছে মহা চিন্তায়, একদিকে তার সম্পত্তি আরেকদিকে শীলা! শীলাকে পেলে সম্পত্তি পাবে না,আবার সম্পত্তি পেলে শীলাকে পাবেনা।মা তাকে রাতে বলে দিয়েছে সে যদি মেহরিনকে হাতছাড়া করে শীলাকে ঘরে তুলে তাহলে তার সবকিছু তার ছোটমেয়ের নামে উইল করে দিবে।এটা কোনকালেও সে হতে দিবে না। বাধ‍্য হয়ে সবকিছু মাটিচাপা দিয়ে মেহরিনকে বেছে নিতে হবে তাকে। যতকিছুই হোক শীলাকে সে ছাড়বে না।মায়ের কথা ভেবে নাহয় মেহরিনকে আবার ঘরে তুলবে।সুযোগ বুঝে সব হাসিল করে সময়মতো সব ছেড়ে দিবে।

কিছুক্ষণ আগেই আকাশ এসেছে। আকাশের মা জোড় করে পাঠিয়েছে মেহরিনের কাছে।
আকাশ দাড়িয়ে আছে সিটের পাশে আর মেহরিন চেয়ে আছে ছাদের দিকে।
আকাশ- “মেহরিন আমি যা করেছি ভুল করেছি। আমাকে ক্ষমা করা যায় না?”
মেহরিন তার দিকে এবার তাকালো। আকাশ যেন এটারই অপেক্ষা করছিলো। মেহরিনকে যদি একটু গলানো যায় একটু থামানো যায়। মেহরিনের চোখে অশ্রু অসহায়ের মত চেয়ে আছে সে আকাশের দিকে।আকাশের মনে হলো মেহরিন তাকে ক্ষমা করে দিবে।আকাশ আরেকটু পাশে বসে মেহরিনের হাতজোড়া নিজের হাতের ভাজে নিয়ে নিলো। মেহরিন কেমন করে উঠলো, নড়েচড়ে হাত সরিয়ে দিতে চাইলো।আকাশ আরো জোর করে চেপে ধরতেই। মেহরিন অসুস্থ শরীর নিয়ে উঠতে চাইলো। উঠতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার, শরীর টা প্রচন্ড ম‍্যাজম‍্যাজ করছে। মাথা ঘুরে উঠছে, তবুও সবকিছু তোয়াক্কা না করে অনেক কষ্ট করে উঠে বসল।

আকাশ – আরে কি করছো, অসুস্থ শরীর, এমন করো না!
মেহরিন তার দিকে চেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো।
আকাশ আবার কাছে এসে হাত ধরতে চাইলে মেহরিন কিছু খুজতে লাগল। খুজতে খুজতে নজর পরলো বেড সাইড টেবিলের উপর বেন্ডেজ আর বেন্ডেজ সিজার।কোন কিছু না ভেবে বেড সাইড টেবিলে থাকা বেন্ডেজ সিজার টা হাতের কাছে পেয়ে আকালের গলায় আঘাত করতে চাইলো। আকাশ সরে যেতেই আকাশের হাতে আঘাত করলো।

আকাশের হাত থেকে রক্ত পরছে। তা দেখে মেহরিন অট্টহাসিতে মেতে উঠলো। চিৎকার করে বলল-
“আমার সন্তাকে মেরেছিস তুই! খুনি তুই! তোকে খুন করবো নইলে আমি আমার নিজেকে শেষ করবো।”
আকাশ ডেকে উঠলো সবাইকে। খুব ভয় পেয়েছে সে, হাত-পা কাপছে তার কেচিঁটা সামান‍্য হাতে লাগাতে যেভাবে কেটে রক্ত পরছে। গলায় লাগলে তো সর্বনাশ হয়েযেত। মেহরিন গলায় ছুড়ি বসানোর আগেই সে হাত দিয়ে ধরে ফেলেছে।ডাক্তার এসে দেখলেন, মেহরিন আকাশকে আঘাত করতে চাইছে। আকাশকে না পেরে তারপর মেহরিন নিজের শরীরে আচড় কাটতে লাগল। নার্সরা কেউ ধরে রাখতে পারছে না। অবশেষে ডাক্তার গিয়ে একটা ঘুমের ইন্জেকশন দিয়ে দিলো মেহরিনকে।মেহরিন কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর নিস্তেজ হয়ে বেডে শুয়ে পরল।কিছুক্ষণ আগের রুদ্রময়ী মেহরিন ইন্জেকশনের কারনে শান্ত হয়েগেল। মেহরিনের মা এসব দেখে কান্া করতে লাগলেন। ভালো শান্ত শিষ্ট মেয়েটাও তার কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে।

এই শহরের পাখিগুলো ডানা মেলে উড়তে জানেনা পর্ব ১

মেহরিনের বাবা আর ভাইকে ডেকে নিয়েগেলেন ডাক্তার তার কেবিনে।
ডাক্তার ইভা- “আন্কেল আমার মনে হয় আপনাদের কিছু কথা জানানো উচিৎ । এই মুহূর্তে অবশ‍্য আপনারা তা সহ‍্য করতে পারবেন বলে মনে হয়না। তবুও আমাকে বলতে হবে।”
মেহরিনের বাবা-” কি কথা? ”

ডাক্তার ইভা – “আসলে আন্কেল মেহরিন মানসিক ভাবে অনেক আঘাত পেয়েছে। অনেক টর্চার ওকে করা হয়েছে। আর আমি যতটুকু বুঝলাম মেহরিন প্রেগন‍্যান্ট ছিল। একবার নয় পরপর দুবার। একটা সন্তান সম্ভাবা নারীর থেকে যদি তার সন্তানকে অকালে শেষ করে দেওয়া হয় তাহলে তার কি হবে বুঝতে পারছেন?”
মেহরিনের বাবা আর ভাই যেন আকাশ থেকে পরলেন। মেহরিনের সঙ্গে এতকিছু ঘটে গেল।
ডাক্তার ইভা- “আন্কেল মেহরিনের কন্ডিশন এখন অনেক খারাপ। ও এখনো পুরোপুরি মানসিক ভাবে আঘাত পেয়েছে। ওর অবস্থা এমন যে যেকোন সময় ও কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে। মেহরিন নিজেকে নিজে শেষ করতে দুবার ও ভাববে না। ”

মেহরিনের বাবা – কি হয়েছে ওর?
ডাক্তার ইভা- “আন্কেল আপনি বুঝতে পারছেন না?
ওর মস্তিষ্কে এই গঠনার এতই প্রভাব পরেছে যে এখন ও মানসিক রুগী হয়েগেছে। ওকে একজন ভালো সাইক্রিয়াক্টিকের কাছে কাউন্সিলিং করান আপনারা।

ইমেডিয়েটলি যা করার করুন। এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে আপনারা মেহরিনকে কোনভাবেই সুস্থ করতে পারবেন না। ও এমনিতেই দূর্বল, দুবার অপারেশন, অফিসের কাজের চাপ! সাংসারিক চাপ, তারপর আবার স্বামীর দিনের পর দিন অত‍্যাচার মেয়েটাকে ভিতরে ভিতরে শেষ করে দিয়েছে।”
মেহরিনের ভাইয়ের বুকের উপর দিয়ে যেন বিরাট বড় রকমের পাথর কেউ চাপিয়ে দিয়েছে। কি ভাবে এত কিছু হয়েগেল মেয়েটার সাথে। এত অমানুষ ও আজকাল আছে?

এই শহরের পাখিগুলো ডানা মেলে উড়তে জানেনা পর্ব ৩