এই শহরের পাখিগুলো ডানা মেলে উড়তে জানেনা পর্ব ৪

এই শহরের পাখিগুলো ডানা মেলে উড়তে জানেনা পর্ব ৪
লেখিকাঃ তামান্না

মেহরিন চিৎকার করে কাদছে আর বলছে -” তোমরা আমাকে বাধা দিও না! আমাকে যেতে দাও, ও আমার সন্তান! ও আমার, ও কাদছে! ”
মাহিন- “ও তোর বাচ্চা না!”
মেহরিন রুমের সবকিছু ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে,-” আমি মানি না! ওকে তোমরা নিয়ে আসো।”
মেহরিন সারাটাদিন কেদেছে, একটু ও থামেনি।

মাহিন রাতের বেলায় মেহরিনের রুমের দরজা খুলে ঢুকে দেখলো মেহরিন ফ্লোরে পরে আছে। মেহরিনের পাশে বসে ডাকতে লাগলো মাহিন।মেহরিনের ভিজে যাওয়া চোখ দুটো দেখে মাহিনের বুক কেমন কেপেঁ উঠলো। মেহরিন ভাইকে দেখে আবার ডুকরে কেদেঁ উঠলো।
” কাদতে কাদতে ক্লান্ত মেহরিন মাহিনের পা চেপে ধরলো। চেপে ধরে বলতে লাগল –
” আমার বাবুটাকে এনে দেয় না ভাই!”
” আমার কলিজাটাকে এনে দেয়!”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বিড়বিড় করে কিসব বলতে বলতে মাহিনের পায়ের কাছেই পরে গেল সে। মাহিন ও আজ যেন পুরোপুরি নির্বাক। মেহরিনকে বুকে জড়িয়ে ধরলো সে। মেহরিন ভাইয়ের পা জড়িয়ে বসে আছে। আর মাহিন তার মাথা বুকে জড়িয়ে আছে। দরজার পাশেই দাড়িয়ে আছে মাহিনের বছর পাচেঁক বয়সের মেয়ে মৃদুলা। ফুফুকে দেখে সে যেন ভয় পেয়েছে, সামনে আসতে চাইছে না।
গতকাল তার মা তাকে বলে দিয়েছে ফুফু অসুস্থ তাকে যেন বিরক্ত না করা হয়। সেই কথা ভেবেই দূরে দূরে রয়েছে সে। মৃদুলা রুমে ডুকে পরলো, বাবার সামনে দাড়াতেই মাহিন কাছে ডেকে তাকে পাশে বসিয়ে দিলো।

মাহিন- মেহরিন!
মেহরিন- হুম,
মাহিন- ও তোর মেয়ে, এই তোর মেয়ে! মৃদুলা মা ফুফির কাছে যাও! মৃদুলা একটু ভয়ে ভয়ে মেহরিনের পাশে দাড়ালো। মেহরিন ওকে কাছে পেয়ে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো কিছুক্ষণ। পরম মমতায় মৃদুলাকে আদর করতে লাগল। কপালে চুমু খেয়ে বুকে জড়িয়ে রইল। সে এখন অন‍্য ঘোরে রয়েছে যখন যা মনে আসে তা করে বেড়াচ্ছে। কোথায় কি হচ্ছে তা যেন তার মাথায় ডুকছে না। নরম তুলতুলে হাত দুটো ধরে বসে আছে যেন কেউ তার কাছ থেকে কেড়ে নিবে।

সারা গর যেন একদম হট্টগোল শুরু হয়েগেছে। কিছুক্ষণ আগেই বাড়িতে পা দিয়েছে শাফায়েত। নানার বাড়ি সচরাচর তেমন একটা ঘুরতে আসে না শাফায়েত। বড় কেন ছোটবেলায় শাফায়েত কোথাও সহজে ঘুরতে যেত না। কারন হইহুল্লড় নাকি তার কাছে বিরক্তিকর। নানুমা অসুস্থ বিধায় এসেছে। তাও মায়ের অনুরোধের জেড়ে এসেছে । মা আর তার মেয়ে শিমুকে রাখার জন‍্য ময়না পাঠিয়ে দিয়েছে আগেই । শিমু খুবই ছোট প্রায় এক হবে বাচ্চা মেয়েটার বয়স । এতটুকু মেয়েকে ছেড়ে থাকতে তার ভালো লাগেনা। তাই অফিস দেরী করে এসে রাতে এখানে থাকার প্রস্তুতি নিয়েছে।

শিমু সারাটাদিন চিৎকার করে কাদলেও বাবাকে পেয়ে যেন একদম চুপ হয়েগেছে। এতটুকু মেয়ে কিভাবে যে এতকিছু বুঝে শেয়ানা হয়েগেছে সে। শাফায়েত মেয়েক‍ে কোলে করে নিয়ে রুমের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে হাটতে লাগল। পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে আর আদর দিতে দিতে মেয়েটিকে ঘুম পারিয়ে দিল। মাঝে মাঝে শিমুর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকালে তার প্রক্তন স্ত্রীর কথা মনে পরে কতটা মিল মা আর মেয়ের! হয়তো মায়ের সত্বাগুলো মেয়ে তার মধ্যে আপন করে ধারণ করেছে।

ঘুমলে শিমুর মা ও শিমুর মায়ের মত দুচোখের উপর হাত রেখে ঘুমাতো। কারন তার চোখে আলো লাগলে নাকি ঘুম হয় না, ঘুমতে কষ্ট হয়। শিমুর কপালে আরেকটা চুমু দিয়ে সে ও পাশে শুয়ে পরলো। মেয়েকে বুকে টেনে পাড়ি দিলো ঘুমের দেশে।

রুমের এককোণে পরে আছে মেহরিন। কারো সাথে সে কথা বলে না। চুপচাপ এক কোণে বসে থাকে, ইচ্ছে হলে দু একটা কথা বলে, তবে তা একদমই খাপছাড়া! যা বলে বেশির ভাগই আবোলতাবোল, মৃদুলাকে পেলে তাকে ছাড়তে চায় না। এ নিয়ে কেউ কিছু বলে ও না।
ও তো আর কোন ক্ষতি করছে না। ও মাতৃত্বের স্বাদটুকু মৃদুলাকে কাছে টেনে আদর করে পায়। এইটুকুতে যদি সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে পায় সমস‍্যা কি?
অফিস থেকে ফোন আসলে মেহরিনের বাবা তাদের জানিয়ে দে মেহরিন অসুস্থ, সুস্থ হলে সে চাকরিতে জয়েন দিবে। অফিস কর্তিপক্ষ অবশ‍্য এ নিয়ে কোন মতামত দেননি , তবে বেশীদিনের ছুটিও দেয়া সম্ভব যে নয় তা তারা জানিয়ে দিয়েছেন।

নিয়ম করে সময় মত আবারো যেন কেদেঁ উঠেছে শিমু। শিমুর কান্না থামাতে ময়না ছাদের ধারে এসে দাড়িয়েছে।
মেহরিন ময়নাকে দেখে ডাকদিল। ময়না মেহরিনের সামনে এসে দাড়িয়ে বলল-
” আফা কেমন আছেন?” শরীল ডা ভালো নি?”
– “খুব ভালো, ভালো আছি!” তোমার বাবুটা কি বেশী কাদেঁ?”
– “হ আফা, কান্দে বেশী!” জ্বালায় বেশী!”
– “আমার কাছে দেও, দেখবে আর কাদবে না!”
– ‘ভাইজান হের মাইয়ারে কারোর কাছে দিতে মানা করছে!” ময়নার কথার মধ‍্যেই শাফায়েতের মা ছাদে প্রবেশ করলেন।

শাফায়তের মা সুলতানা বেগম-” এই ময়না কার সাথে কথা বলছিস? আর ওকে নিয়ে ছাদে এত ঘোরাফেরা করার কি দরকার? ঘুমিয়ে গেলে রুমে নিয়ে খাটে শুইয়ে দিস যা।
ময়না -” ঐ যে আফার লগে!” সুলতানা বেগম ময়নার দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলেন মেহরিন দাড়িয়ে আছে।
শুকনো মুখ, সেই মুখে লেগে আছে হাসি।
“আরে মেহরিন যে! কি খবর তোমার?”
ময়না- “খালা হের কিন্তু মনে হয় তারছিড়া আছে!”

সুলতানাবেগম – হোয়াট রাবিশ! ময়না তোমাকে না কত করে বলেছি কথাবার্তার পরিবর্তন কিছু করো। এভাবে সরাসরি একজন মানুষের সামনে আজেবাজে কথা বলবে না। না বুঝলে চুপ করে থাকবে। তুমি ওর সমন্ধে এভাবে বলছো, তুমি কি জানো ও কেমন? যাও বাসায় যাও!”
ময়না- “ভয় পেয়ে দৌড়ে বাসায় চলেগেল।”

এই শহরের পাখিগুলো ডানা মেলে উড়তে জানেনা পর্ব ৩

সুলতানা বেগম মেহরিনের কাছে এসে দাড়িয়ে বললেন – ” ওর কথায় কিছু মনে করো না মেহরিন!”
খুব ছোট ও শাফায়েতের মেয়ে হয়েছে। মা নেই মেয়েটার!” এত ছোট্ট মেয়েকে কে দেখবে! আমি এখনো চাকরি ছাড়িনি। তুমি তো জানো আমি কাজ পাগল মানুষ! কাজ ছাড়া আমার চলেই না। বলেই হেসে দিলেন তিনি। বিকালে তোমাদের বাসায় আসবো অনেক কথা জমে আছে ঠিক আছে।”
মেহরিন কি বুঝলো কে জানে মাথা নাড়িয়ে চলেগেল ভিতরে।

সুলতানা বেগম নাতনিকে নিয়ে এসেছেন মেহরিনদের বাসায়। নিজের গল্প আর সুখ দুখের কথা বলতে এসে যেন নিজেই স্তব্ধ হয়েগেলেন। তার পাশেই শিমুর হাত ধরে বসে আছে মেহরিন। মেহরিন শিমুর হাতদুটো নেড়েচেড়ে সুলতানা বেগমের কোলে থাকা অবস্থায় আদর করে দিচ্ছে। সুলতানা বেগম অবশ‍্য কিছু বলেননি তবে শিমুকে তিনি কোল থেকে নামিয়ে দেননি।
মেহরিন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত , এখনো পুরোপুরি সুস্থ নয় শিমুকে তার হাতে ছেড়ে দেওয়া মানে চরম প্রকারের বোকামি করা। আবার এ ও ভাবছেন মেয়েটারই বা দোষ কি? এই মেয়েটার তো কোন দোষ নেই! মেয়েটি পাগল ও নয়! মেয়েটির দরকার –

“ভালোবাসা, ভরসা, আশ্রয়,আর বুকভরা নিশ্বাস! ভালোবাসা, ভরসা, আশ্রয় এই তিন মিলেই তো মানুষের মধ‍্যে তৃপ্ততা আসে। আর এই তৃপ্তিতেই বুক ভরে একজন মানুষ নিশ্বাস নিতে পারে। ”
যে মানুষটির ভাগ‍্যে এই তিন জিনিস নেই সে মানুষটির জীবনে কতটুকুই বা পূর্ণতা পাবে?”

সুলতানা বেগমের পাশে বসে কাদছেন মেহরিনের মা।
মেয়ের জীবনের সুখের গল্প যেখানে হেসে বলার কথা।
সেখানে তিনি কেদে বলছেন তার মেয়ের আত্মজীবনী।
সুলতানা বেগম মেহরিনের মুখের দিকে চেয়ে আছেন। আশর্চয‍্য হয়ে যাচ্ছেন, মিষ্টি আর সুন্দর মুখশ্রীর মেয়েটির মুখে আগের মতই হাসি লেগে আছে। তবে বদলে গেছে তার চেহারা আর শরীর।

এই শহরের পাখিগুলো ডানা মেলে উড়তে জানেনা পর্ব ৫