এই শহরের পাখিগুলো ডানা মেলে উড়তে জানেনা পর্ব ৫

এই শহরের পাখিগুলো ডানা মেলে উড়তে জানেনা পর্ব ৫
লেখিকাঃ তামান্না

“ভালোবাসা, ভরসা, আশ্রয়,আর বুকভরা নিশ্বাস! ভালোবাসা, ভরসা, আশ্রয় এই তিন মিলেই তো মানুষের মধ‍্যে তৃপ্ততা আসে। আর এই তৃপ্তিতেই বুক ভরে একজন মানুষ নিশ্বাস নিতে পারে। ”
যে মানুষটির ভাগ‍্যে এই তিন জিনিস নেই সে মানুষটির জীবনে কতটুকুই বা পূর্ণতা পাবে?”

সুলতানা বেগমের পাশে বসে কাদছেন মেহরিনের মা।
মেয়ের জীবনের সুখের গল্প যেখানে হেসে বলার কথা।
সেখানে তিনি কেদে বলছেন তার মেয়ের আত্মজীবনী।
সুলতানা বেগম মেহরিনের মুখের দিকে চেয়ে আছেন। আশর্চয‍্য হয়ে যাচ্ছেন, মিষ্টি আর সুন্দর মুখশ্রীর মেয়েটির মুখে আগের মতই হাসি লেগে আছে। তবে বদলে গেছে তার চেহারা আর শরীর। বদলেগেছে তার সত্বা ও! মেহরিন শিমুকে আদর করতে করতে সুলতানা বেগমকে বলে উঠলো –

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আন্টি – “ওকে একটু কোলে দেও না! ”
সুলতানা বেগম মেহরিনের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলেন মুখে তার আকুল আবেদন। এই মিষ্টিমুখের মেয়েটাকে কি করে না করা যায়! তিনি মেহরিনের কোলে শিমুকে দিয়েদিলেন। শিমুকে মেহরিনের কোলে দিয়ে দেওয়ায় মেহরিনের মুখে একরাশ হাসি উপচে পরেছে। শিমু টুক্কর টুক্কর করে চেয়ে আছে, মেহরিন মুখের কাছে নিয়ে শিমুর কপালে চুমু দিতেই, শিমু চোখ বুজে হেসে দিল। তারপর তার ছোট ছোট নরম দুটো হাত দিয়ে মেহরিনের পুরো মুখ ছুইয়ে দিল।

সুলতানা বেগম চেয়ে আছেন, তার কাছে এ দৃশ‍্য মনে হচ্ছে কোন পূর্ণ মা তার সন্তানকে নিঃস্বার্থ ভাবে আদর করছে। আর সেই আদরগুলোকে মেখে নিচ্ছে মা হারা এক সন্তান!
সুলতানা বেগম শিমুকে মেহরিনের কাছথেকে নিয়ে নিলেন। মেহরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন –
“ভালো থেকো মা, তারাতারি সুস্থ হও,সবকিছু ওপরওয়ালার হাতে। এমন হতে পারে আজ যারা তোমার জীবনে তছনছ করে দিয়েছে কাল তারাই তোমার পায়ে এসে পরবে। তোমার জন‍্য আমার পূর্ণ আশির্বাদ আছে, দোয়া করি জীবন তোমার পূর্ণ হোক! সম্পূর্ণ রুপে আবার নিজেকে তৈরী করো। ”

মেহরিনের মাকে উদ্দেশ্য করে -” ভাবী গেলাম আমি, শাফায়েতকে তো চিনেন ও আমাকে কালকে দয়াকরে এখানে থাকতে দিলেও আজ দিবেনা। হয়তো এখন চলেও এসেছে বাসায়, যাই আমি ভালো থাকবেন। আর মেহরিন মায়ের চিকিৎসা করান যত তারাতারি পারেন।
মেয়েটার সাথে এত কিছু হয়েগেল। এতটুকু বয়সে কত নির্যাতন সহ‍্য করেছে ও। মেহরিনকে দেখে শিমুকে কোলে করে নিয়ে গেলেন তিনি। মেহরিন শিমুর দিকে চেয়ে আছে। চোখ দুটো ছলছল করছে। মেহরিন তার রুমে দৌড়ে চলেগেল।

সাইকোলজিস্ট ফজলে এনামুল হক চৌধুরী! বিরাট বড় এবং কঠিন নামের হলেও মানুষটা একদমই সরল প্রকৃতির। হেসে হেসে কথার ছলে যেন মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারেন খুব সহজে। মেহরিন আজ একমাস তার কাছে আশে, তার পরামর্শ মতে চলে। এই একমাসে মেহরিনের কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে যেমন আগে কিছুই মনে করতে পারতো না। এখন সে স্পষ্ট সব মনে করতে পারে এবং বলতে পারে। তবে আগের মত এখনো কারো সঙ্গে স্বাভাবিক হতে পারেনি সে। এখন এককোণে চুপচাপ বসে থাকে।

এনামুল সাহেব বসে বসে চা খাচ্ছেন। তার পাশে একটা ডিভানে আধশোয়া হয়ে আছে মেহরিন। এনামুল সাহেব প্রশ্ন করলেন –
” তোমার এখন কাকে বেশী আপন মনে হয়?”
– “কেউ না!”
“কেন কেউ নয়? এত বড় পৃথিবীতে কেন কেউ তোমার আপন নয়?”
– “সবই পর!”
– কেন পর? তোমার কি কোন ভালোবাসার মানুষ নেই?”
-নেই, নেই আমার কেউ নেই! আমার বাচ্চা নেই, আমার স্বামী নেই!”
– তোমার স্বামী যদি তোমার কাছে ফিরে আসে তাকে কি তুমি গ্রহণ করবে?”

– “মেহরিন চোখ বন্ধ অবস্থায় ছটফট করতে করতে চিৎকার করে উঠে বসল। আমার কেউ নেই! আমার স্বামী নেই,সে আমার স্বামী না! সে আমার শত্রু! ”
– “রিল‍্যাক্স! রিল‍্যাক্স! শান্ত হও মেহরিন!” সে তোমার শত্রু আমি মেনে নিয়েছি। শান্ত হও, আমি ও চাই না তার কাছে তুমি যাও!” মেহরিনের তীব্র উত্তেজনা ক্রমশ কমতে লাগল। ” শুয়ে পরো, আর চোখ বন্ধ করো আমি যা বলছি তা শুনো। মেহরিন চোখ বন্ধ করে শুয়ে পরলো।

এনামুল সাহেব- ” তোমার বিয়ের পর থেকে কি হয়েছে তা আমাকে বলো! ”
মেহরিন- চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করছে। আমার বিয়ের প্রথমদিকে আকাশ আমার সাথে ভালো আচরণ করলেও শেষে এসে আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করে আমার।
এনামুল – “কখন? ”
মেহরিন- “প্রথম কনন্সিভের সময় আমি তাকে এ ব‍্যাপারে বললে সে আমার শাশুড়িকে এটা বলতে নিষেধ করে দেয়। তার মতে আমার আর তার কেরিয়ার নাকি বাচ্চাই শেষ করে দিবে। কেরিয়ারে আমরা এগুতে পারবো না। বাচ্চা হলে অফিস সামলাবো কিভাবে?”

” এগুলো সে বলতো সব সময়। সেদিনের পর থেকে সে আমাকে পুরোপুরি সময় কম দিয়ে , অফিস নিয়ে পরে থাকতো। দিন হলে অফিস, রাত হলে বাসায় এসে আমাকে নানা ভাবে কথা শুনাতো, আর টাকা নেওয়া তো নিত‍্যদিনের কথা!এর মাঝে আমি বুঝেগেলাম তার সাথে কারো সম্পর্ক চলছে। গভীর সেই সম্পর্ক! কিন্তু কার সাথে তা আমি প্রমাণ সহ বের করতে পারছিনা। প্রতিবার কলের পর কল কেটে দেওয়া, মোবাইলে তেমন ইনফরমেশন ও ছিল না। ”

“আর তাছাড়া স্বামীর পিছনে গোয়েন্দা গিরী করার সময় ও আমার ছিল না। সংসার নামক বন্দনায় যে একবার জড়ায় সে অন‍্যকিছু করার সময়ই বা কোথায় পায়? তারপর আমি আবার দ্বিতীয়বারের মত কনন্সিভ করি। এই সন্তানের বেলায় আমি মানসিকভাবে আরো ভেঙ্গে পরি। তাকে জানালে কি বলবে সেই ভয়ে আমি বলতে চাইনি।”
মেহরিন উঠে বসে পরলো মুখে হাত চেপে ডুকরে কেদে উঠে বলতে লাগল –

-” সে কিভাবে যেন এই বাচ্চার কথা জেনে গিয়েছে এবং সেইদিন আমাকে ঘুমের ইন্জেকশন দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে এবোর্শন করিয়ে আনে। আমার সব শেষ করে সে। তারপর কেটে যায় একটা মাস আমি ভিতরে ভিতরে শেষ হলেও, আশাবাদী ছিলাম আমি তাকে যে করেই হোক শাস্তিই দিবো। আর এরমধ‍্যেই আমার কলিগ সেইদিনের গঠনার কথা আমায় বলে। তার ফুফাতো বোন শীলার সাথে সম্পর্ক এই বিষয়টা কখনো আমার জানা হতো না যদি না আমি সেদিন হোটেলে যেতাম। আর সেই ঘটনায় আমি প্রমাণ যোগাড় করতে সক্ষম হই।”

এই শহরের পাখিগুলো ডানা মেলে উড়তে জানেনা পর্ব ৪

মেহরিন কাদতে লাগল। মাহিনের স্ত্রী এসে পাশে বসে পরলো। তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগল।
এনামুল সাহেব – “মিসেস মাহিন ওকে কাদতে দিন। আপনি চলুন আমার চেম্বারে ।”
মাহিনের স্ত্রী-” স‍্যার কি বুঝলেন ওর অবস্থা?”
এনামুল সাহেব-” আপনাদের মত পরিবার, থাকলে কেউই অসুস্থ হয়ে পরে থাকবে না। যাইহোক আমি মেহরিনকে নিয়ে আগেই আশাবাদী ছিলাম। তবে আমার মনে হয় ওকে আরো কিছু সময় দেওয়া উচিৎ। ওর এই একমাসের কোর্সে বুঝলাম ওর যথেষ্ট পরিবর্তন এসেছে।

মাহিনের স্ত্রী – “ধন‍্যবাদ স‍্যার! ”
মেহরিনকে টানা একমাস এনামুল সাহেবের কাছে নিয়ে আসা হয় আগের মত উগ্রতা তার কিছুটা কমেছে। তবে পুরোপুরি নয়। মাঝেমাঝে অবশ‍্য এখনো কেদেঁ উঠে সে।
তবে বাবা- মা, আর ভাই- ভাবীর জন‍্য সে দিক থেকে সে পূর্ণ হয়েছে।

ডিবোর্স লেটারে সাইন করছে মেহরিন। আজ এক ফোটা ও জল তার চোখ থেকে পরছে না। শক্ত হাতে কলম ধরেছে সে। এক সময় স্বামীকে চোখের আড়াল হতে দেখলেই খুজতে খুজতে ক্লান্ত হয়েযেত এখন তা সম্পূর্ণ রুপে বন্ধ। আকাশকে আর এ বাড়িতে আসতে দেননি মেহরিনের বাবা। মাহিন চেয়েছিল আকাশকে পুলিশে দেওয়ার জন‍্য যেন কঠিন শাস্তি পায়। কিন্তু বাদ সাধলেন মেহরিনের বাবা। তারমতে সব বিচার কাধে নিতে নেই প্রকৃতির শাস্তি বলেও কিছু আছে। মেয়ে আস্তে আস্তে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে এতেই অনেক।

এই শহরের পাখিগুলো ডানা মেলে উড়তে জানেনা পর্ব ৬