একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব ১৫

একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব ১৫
writer Mousumi Akter

কিছু অনুভূতি ভয়ানক ভাবেই মনের মধ্যে তুফানের সৃষ্টি করে,মন তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।হৃদয়ে শুরু হয় ভয়ংকর প্রলয়।যা মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যায়।হৃদস্পন্দন এর কম্পন ভয়ানক গতিতে বাড়তে থাকে।পাশে বসে থাকা মানুষটির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আমি।তার ঘনকালো ভ্রু, প্রশস্ত কপালে পড়ে থাকা চুল, চোখে খয়েরি ফ্রেমের চশমা, শ্যামসুন্দর মুখশ্রীতে কি দারুণ এক অবয়ব ফুটে উঠেছে!

মানুষ টা বুকে হাত বেঁধে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে।গাড়ির জানালা খোলা; মাথার সামনের চুল গুলো মৃদু বাতাসে উড়ছে।পরনের খয়েরি পাঞ্জাবী টা যেনো এই মানুষটার জন্যই মানানসই।তার হাসির থেকে গম্ভীরতায় আমি মুগ্ধ হয়েছি বহুবার।গম্ভীর মুখশ্রীতে কিছু একটা আছে। বিশেষ কিছু যা আমার হৃদয়কে তছনছ করেছে বহুবার।কেনো যেনো কয়েক সেকেন্ডের বেশি দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখতেই পারছিনা। অবাধ্য দৃষ্টি বারবার উনার দিকেই চলে যাচ্ছে।উনি আচমকা তাকালেন আমার দিকে।নিমিষেই বুকের মধ্যে হাতুড়ির পেটানোর মত বাড়ি মেরে উঠল।কি ভয়ানক সে চাহনি!আমি লজ্জায় উনার চোখে চোখ রাখতে পারলাম না,চোখের দৃষ্টি নামিয়ে ফেললাম।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সাদা গাড়ি টা দ্বিপ্রহর এর আগেই এসে পৌঁছালো আমিন ভিলার সামনে।আমিন ভিলা আমার দাদুর নিজ হাতে করা।খুবই সাধারণ একতলাবিশিষ্ট একটা বাড়ি।বাড়ির গেটেই রয়েছে সাদা আর গোলাপি রঙের কাগজ ফুল এর বিশাল বড় দুইটা গাছ।হঠাৎ অনুভূত হলো আমার শরীরে চিরচেনা সেই বাতাস লাগছে।যে বাতাসের শীতল হাওয়ায় আমাকে একুশ টা বছর আগলে রেখেছিলো এই শহর।

এই শহর আমার শহর। মূহুর্তেই আনন্দে চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আমার। প্রাণভরে যেনো অক্সিজেন গ্রহন করতে পারছি।এই শহরের আকাশ,বাতাস,পাখি,গাছপালা,সবুজ অরণ্য সবই আমার।অস্থিরতায় মনের মাঝে ছটফটানি বিরাজ করছে। শুধু মনে হচ্ছে কখন গাড়ি থেকে নেমে ছুটে গিয়ে আম্মু আর বাবা কে জড়িয়ে ধরব ।মাত্র দুটো দিন ছিলাম না এ বাড়িতে।মনে হচ্ছে আমি কয়েকজন্ম পার করে এসেছি ও বাড়ি থেকে।গাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে আম্মু -বাবা, আপু,দুলাভাই,আপুর ছেলে অন্তু ও পাড়া প্রতিবেশী কয়েকজন।

গাড়ি থেকে নেমে রোশান স্যার আম্মু-বাবাসহ বাকিদের সবাইকে সালাম দিলেন।তরী আর রোশান স্যারের দাদুও সবাই কে সালাম দিলেন।সবাই কুশল বিনিময় করছে।আমি থম মেরে দাঁড়িয়ে আছি।আশে -পাশের প্রতিবেশীরা আমাকে জিজ্ঞেস করছে কেমন আছিস।এটা আমি যেনো কেমন সহ্য করতে পারছি না।আমি এ বাড়ির আত্মীয় হয়ে গিয়েছি যে সবাই জিজ্ঞেস করছে আমি কেমন আছি!আম্মু-বাবা রোশান স্যার কে নিয়েই যেনো ব্যাস্ত।আমার দিকে তেমন খেয়ালই নেই।আমি কি এতই পর হয়ে গিয়েছি!দুটো দিন বাড়িতে ছিলাম না তার জন্য কি একটু খারাপ লাগে নি কারো!মনে মনে অভিমানের পাল্লা ভারী হওয়ার আগেই

বাবা আমার কাছে এগিয়ে এসে টুপ করে গড়িয়ে পড়া চোখের পানি মুছে দিয়ে আমাকে তার বুকের সাথে আগলে ধরল।কপালে চুমু দিয়ে বলল,
‘বাবাকে ছাড়া কেমন ছিলে মা?খুব কষ্ট হয়েছে তাইনা?’
সমস্ত আবেগ যেনো বাবার এই একটি কথায় এক জায়গা জড়ো হয়ে গেলো।এক্ষুনি ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে দিবো এমন একটা অবস্থা।

এরই মাঝে আম্মুও এগিয়ে এসে বলল,
‘তুমি ওভাবে বলোনা তাহলে আমার মেয়ের বেশি কষ্ট হবে।আমাকেও তো বিয়ে করে নিয়ে এসেছিলে। তোমার মাকেও বাবা নিয়ে এসেছিলো।এভাবেই প্রতিটা মেয়ের জীবন কাটবে।মেয়েকে সাহস দাও।’
আম্মু আমাকে অনেক ভালবাসে তবে আম্মু বাবার থেকে বেশি স্ট্রং।কখনো দূর্বলতা বুঝতে দিতে চায়না।
আম্মু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর বলছে,

‘কিসের কষ্ট মা?কোনো কষ্ট নেই!এটাই নিয়ম মা মেয়েদের।
দম বন্ধ হয়ে থাকা কাঁন্না এবার হাউমাউ করে বেরিয়ে এলো।খুব জোরে কেঁদে দিয়ে বললাম, ‘আমার ভীষন কষ্ট হচ্ছে বাবা!মনে হচ্ছে কতদিন দেখিনি তোমাদের!আমি আর যাবোনা বাবা।’

বাবা রোশান স্যারের দিকে তাকালো।রোশান স্যার আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।বাবা ভাবছে তার জামাই তার মেয়ের এমন কথায় হয়তো মাইন্ড করছে।বাবা স্বভাব সুলভ হেসে রোশান স্যারের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘মেয়েটা আগে কোথাও থাকেনিতো!এইজন্য কষ্ট পাচ্ছে বাবা।তুমি কিছু মনে করোনা।’
আমি বাবার সাথে সব সময় বন্ধুসুলভ আচরণ করি।ছোট মেয়ে বলে বাবার অনেক আদুরে আমি সংকোচ ছাড়া বাবাকে যেকোনো কিছুই বলতে পারি।

কাঁন্নাভেজা কন্ঠে নাক টেনে বললাম, ‘উনি কেনো কিছু মনে করবে বাবা?উনাকে বলো এ বাড়িতে সারাজীবনের মত থেকে যেতে তাহলেই বুঝবে।
বাবা হেসে বললেন, ‘পা*গ*লি আমার।’
আম্মু বাবা আমাকে তাদের বুকের সাথে আগলে ধরে রেখেছে।রোশান স্যার অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।আমাকে উনি ও বাড়িতে থাকতে কখনো ভেঙে পড়তে দেখেন নি।এটা উনার কাছে অবাক হওয়ার মতোই ব্যাপার।
আমার আপু এগিয়ে এসে বলল,’কি মহারানি আগে তো আমাকে খুব বলতে, এখন কাঁদো কেনো?’

আপুকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘তোমার কি একটুও কষ্ট হয়নি আমার জন্য?
পাশ থেকে দুলাভাই বললেন, ‘তোমার আপু কি দু’রাত ঘুমিয়েছে,মনে হচ্ছে যেনো তার বোনকে বেচে দেওয়া হয়েছে।যেমন শ্যালিকা তেমন বউ। ‘
পাশ থেকে প্রতিবেশীরা ফিসফিস করে বলছে,

“মনে হয় সারাহ’র বরের সারাহ কে দেখে পছন্দ হয়নি।দেখো কেমন থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে ওর বর।আর সারাহ ই বা এত কাঁন্নাকাটি করছে কেনো?বিয়ের আগে মুখ দেখে নি, মুখ দেখার পর মনে হয় আর পছন্দ হয়নি।বেশি খাইতে গেলে যা হয় আরকি।মেয়ে পড়ে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে।বিয়ে দিয়েছে বিসিএস ক্যাডার এর সাথে।আমরা জানতাম এমন কিছুই হবে।’

অন্য একজন বলছে, ‘আরে মনে হয় সারাহ’র ই ওর বরকে পছন্দ হয়নি।সারাহ হচ্ছে মডার্ণ মেয়ে।বরের বয়স একটু বেশি দেখে ওর আর ভাল লাগছেনা।এইজন্য কাঁন্নাকাটি করছে।’
অন্য একজন বলছে, ‘সারাহ’র জা কে দেখে মনে হচ্ছে খুব সাদাসিধা। সারাহ যে ডে*ঞ্জা*রা*স আর মডার্ণ মেয়ে, এই সাদাসিধা জা কে পায়ের নিচে রাখবে।এইবার দেখা যাবে সারাক্ষণ জিন্স পরে ঘোরা মেয়ে কিভাবে শাড়ির আঁচলে যায়।আগে তো বলত আমি জীবনে শাড়ি পরবো না।’

কথাগুলো কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলাম আমি।মানুষ পারে কিভাবে এরকম মনগড়া কথা বলতে!কিছু বলতে যাবো তখন ই দেখি তরীর মুখ টা গুমট মেঘের মত কালো হয়ে আছে।ওর বোধহয় কষ্ট হচ্ছে আমার পরিবারের ভালবাসা দেখে।ওর কি হৃদয় জ্বলছে,পুড়ছে,ভীষণ কষ্ট হচ্ছে!হবে না কেনো?আজ ওর জীবন টাও এমন হতে পারতো।
আম্মু-বাবাকে বললাম, ‘আম্মু -বাবা আমার সাথে যে মেয়েটা এসছে সে আমার জা।ওর নাম তরী।ওর মা-বাবা কেউ নেই।ওর মনে হয় খুব কষ্ট হচ্ছে।একটু দেখোনা প্লিজ।আমার খেয়াল রাখতে হবেনা।ওকে যত্ন করো তোমরা।

আমার মা-বাবা কে কোনো জিনিস বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দেওয়া লাগেনা।তাদের সামান্য বললেই বুঝে যায়।আমার আম্মু গিয়ে তরীর দুই গালে হাত রেখে বলল, ‘মামনি মুখটা এমন শুকনো লাগছে কেনো?’
তরী লুকায়িত কাঁন্না সামলানোর চেষ্টা করে বলল, ‘না আন্টি কিছুই না।’
‘আজ থেকে তুমিও আমার মেয়ে বুঝলে?একটুও মায়ের অভাব বোধ করবা না।’
বলেই আম্মু পরম আদরে তরীকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরল।

বাবা বললেন, ‘মা তরী আমরা আছি,কিসের কষ্ট মা? যাও ভেতরে যাও অনেক ক্লান্ত তোমরা।’
আম্মু আর বাবার তরীর প্রতি এমন সহনশীলতা আমার খুব ভাল লাগলো।রোশান স্যার কে দুলাভাই কখন ভেতরে নিয়ে গিয়েছেন জানিনা।শাড়িতে দু’দিন যেনো দম বন্ধ হয়ে আসছিলো।শাড়ি থ্রি পিছ পরার অভ্যাস আমার নেই।জিন্স এর টি-শার্ট পরি বাসায়।কলেজে জিন্স এর উপর টপ্স বা কামিজ। নিজের রুমে এসে ধপ্পাস করে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম।প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছি।আহা! কি শান্তি!রুমের দরজা লাগিয়ে দিলাম।এখনি এই শাড়ি নামক অশান্তি থেকে বিদায় নেবো।

আলমারি থেকে ব্লু জিন্স, আর একটা লং টপ্স বের করলাম।শাড়ি খুলে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে আগে টপ্স পরে নিলাম।জিন্স পরতে পরতে পেটিকোট খুলে ছুঁড়ে মারতেই আতঙ্কে শিউরে উঠলাম।ওয়াশ রুমের দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন রোশান স্যার।ওনার মুখের উপর গিয়ে পড়েছে পেটিকোট। উনি কই ছিলেন আসলেন কোন জায়গা থেকে!আমি তো দরজা লাগিয়ে দিয়েছি।ওহ মাই গড!

উনি কি দেখে ফেললেন আমার চেঞ্জ করা।হতবিহব্বলের মত তাকিয়ে আছি উনার দিকে।উনি পেটিকোট টা মুখ থেকে সরিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।কি আশ্চর্য রকম সে চাহনি!আমার চক্ষুদ্বয় কপাল অতিক্রম করেছে।হাত পায়ের আঙুল নাড়াচাড়া করছি শুধু।উনাকে ভাল ভাবে পর্যবেক্ষণ করে যা বুঝলাম উনি ওয়াশ রুমে ছিলেন।ভেজা চুল, ভেজা শরীর, গোসল করেছেন।পেটিকোট টা হাতে করে ধীর গতিতে আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার সামনে স্ট্রং হয়ে দাঁড়ালেন।কপালের চামড়ায় ভাজ পড়েছে কয়েকটা।আমি অনামিকা আঙুল কামড়ে ধরে তাকিয়ে আছি উনার দিকে।উনিও অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।আমি এবার একটু সরে দাঁড়িয়ে বললাম,

‘আ-আপনি ভেতরেই ছিলেন?
‘হুম’
‘এ ঘর চিনলেন কিভাবে?’
‘দুলাভাই চিনিয়ে দিলেন।’
‘ভেতরে কী করছিলেন?’
‘ভুলে গিয়েছোগাড়ির ঘটনা?এখন গোসল না করলে হতো?
‘আমি কখন রুমে এসেছি জানেন?
‘হুম।’
আপনি তখন কোথায় ছিলেন।?
‘ভেতরে।’

বেরোলেন কখন?
যখন চেঞ্জ করছিলে।
‘কিহ!এত বিশ্রী আপনি?একজন শিক্ষক হয়ে এসব অশ্লীলতা করেন কিভাবে?লজ্জা করলো না আপনার?
‘আমার লজ্জা করে বলেই ওয়াশ রুমে যায়।তোমার মত খোলা ময়দানে চেঞ্জ করিনা।’
‘লিসেন, ইট’স মাই রুম।আমি দরজা লাগিয়েই চেঞ্জ করছিলাম।কে জানতো ভেতরে আপনি?আপনি কী দেখেছেন সত্যি করে বলুন?

‘বললে শুনতে পারবে?ওকে ফাইন। আই সে….
নাহ! নাহ! বলতে হবেনা।এ আমি কিছুতেই শুনতে পারব না।এখন আমার কী হবে?
‘স্টুপিড! আমি কিছুই দেখিনি।এভাবে চেঞ্জ করার সময় জিনিসপত্র ছুঁড়তে হয়? পেটিকোট পড়েছিলো মুখে ভাগ্যিস আর কিছু পড়ে নি।

একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব ১৪

আপনি মিথ্যা বলছেন, নিশ্চয় দেখে নিয়েছেন সব।আপনি আমার এত বড় সর্বনাশ করতে পারলেন স্যার?
‘সর্বনাশ আর তোমার কোথায় হলো?যা হওয়ার তাতো আমার ই হয়েছে!ভয়ানক সর্বনাশ সারাহ সিদ্দিকী!
আল্লাহ! আমি আবার কী করলাম উনাকে?

একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব ১৬+১৭