অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫৩ শেষ অংশ

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫৩ শেষ অংশ
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল 

সকাল থেকে উজ্জ্বল রোদ ছড়িয়েছে আজ। কিন্তু আবহওয়া ঠান্ডা। আমের ভিলার সকলেই বসার ঘরে উপস্থিত। সিঙ্গেল সোফায় বসে আছেন রাশেদ। কিছুক্ষণ আগে নাস্তা করেছেন। এখন চায়ের জন্যে অপেক্ষা করছেন। দ্বিতীয় সিঙ্গেল সোফাটায় জাফর বসেছেন। রুদ্র আর উচ্ছ্বাস পাশেই বড় বসে কফি খাচ্ছে। উচ্ছ্বাসের ব্যবহার একদম স্বাভাবিক। যেন কিছুই ঘটেনি। ওর এই স্বাভাবিক ব্যবহার আরও বেশি অস্বস্তিতে ফেলছে রুদ্রকে। রুদ্র চাইছে উচ্ছ্বাস ওকে কিছু বলুক। অভিমান করুন। অভিযোগ করুক। রেগে গাল ফুলিয়ে বসে থাকুক। কিন্তু কিছুই করছেনা ছেলেটা। বুকে এতো কষ্ট চেপে রেখে এভাবেও হেসেখেলে বেড়ানো যায়!

কুহু ভার্সিটি যাওয়ার জন্যে রেডি হয়ে বসে আছে। ও নিজেও চায়ের জন্যে অপেক্ষা করছে। রাশেদ বেশ মনোযোগ দিয়ে পেপার পড়ছেন। ওনার পাশে টি-টেবিলে কিছু রাখার আওয়াজ পেয়ে ভাবলেন চা দেওয়া হয়েছে। সেদিকে না তাকিয়েই হাত বাড়ালেন। কিন্তু কোন কাপ পেলেন না। পেলেন একটা বাক্স। পেপার থেকে চোখ সরিয়ে তাকালেন সেদিকে। দেখলেন ওনার ঔষধের বাক্স। তার পাশে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রাশেদ একটু হাসলেন। পেপারটা সাইডে ভাঁজ করে রেখে চশমাটা খুললেন। তারপর প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ভুলেই গিয়েছিলাম। ভালো করেছো মনে করেছো।’
প্রিয়তা চোখ ছোট ছোট করে দেখছে রাশেদকে। কিছু বলছে না। রাশেদ কোনমতে দ্রুত হাতে সকালের ঔষধগুলো বের করে খেলেন। প্রিয়তা পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল, ‘এভাবে অনিয়ম করেছেন বলেই শরীরের ভেতরে এতো রোগ। বাইরে দিয়ে ফিটফাট থাকলে কী হবে? ভেতরে ভেতরে কতোটা সুস্থ আছেন সেটাতো যারা কাছ থেকে দেখি তারা জানি তাইনা?’

রাশেদ কিছু বললেন না। চুপচাপ মেনে নিলেন প্রিয়তার শাসন। এরমধ্যেই রাশেদ আর কুহুর জন্যে চা নিয়ে এলো জ্যোতি। রাশেদের জন্যে রাখা চা-টা তাকে দেওয়া হলো। চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই মুখ কুঁচকে গেল রাশেদের। চিনি সল্পতা। কিছু বলতে গিয়েও প্রিয়তার মুখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বললেন না। সেই চা-টাই খেয়ে নিলেন। প্রিয়তা হেসে বলল, ‘নাক কোঁচকাতে হবেনা। সুগার ফ্রি শেষ হয়ে গেছে। এ বেলা চালিয়ে নিন। আজকেই আনিয়ে নেব। সন্ধ্যায় মিষ্টি চা-ই পাবেন।’
রাশেদ কিছু বললেন না। চুপচাপ চায়ে চুমুক দিলেন। বাকি সবাই মিটমিটিয়ে হাসছে। বাড়ির সবাইযে যে দমিয়ে রাখে, তাকে এভাবে দমে যেতে দেখতে ভালোই লাগছে ওদের।

চা খেয়ে কয়েকসেকেন্ড বসে রইলেন রাশেদ। তারপর গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘রুদ্র?’
রুদ্র চট করে তাকাল রাশেদের দিকে। সঙ্গেসঙ্গেঈ বলল, ‘জ্বি বাবা?’
‘বিয়ের পর তোমার আর প্রিয়তার সেভাবে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তাইনা?’
‘হ্যাঁ আসলে_’

এইটুকু বলে থেমে গেল রুদ্র। কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। প্রিয়তাসহ বাকি সবাই কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে। রাশেদ হালকা গলা ঝেড়ে বললেন, ‘বিয়ের তো দু বছর হতে চলল। কোথাও যাওয়াও হয়নি। এক কাজ করো, প্রিয়তাকে নিয়ে কক্সবাজার থেকে ঘুরে এসো।’

হঠাৎ রাশেদ আমেরের এমন প্রস্তাবে সকলেই বেশ অবাক হলো। রাশেদ হঠাৎ এমন কিছু বলে বসবেন সেটা কেউই আসা করেনি। প্রিয়তা বোকার মতো তাকিয়ে আছে। জাফর বললেন, ‘কিন্তু এই সময়?’
বলে চারপাশে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন। আবার বললেন, ‘মানে এই সিজনে কক্সবাজার গিয়ে কী করবে? বর্ষাকালে গেলে ভালো হতোনা?’

রাশেদ নিজের কন্ঠে গম্ভীরতা বজায় রেখেই বললেন, ‘সে যখন বর্ষা আসবে তখন দেখা যাবে। আপাতত গিয়ে ঘুরে আসুক।’
রুদ্রকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘তোমাদের দু সপ্তাহ ওখানে থাকার ব্যবস্থা করে রেখেছি। কালই বেরিয়ে পড়ো।’
সকলের চোখ চড়াক গাছ। দুই সপ্তাহ! রুদ্র আমের ঘুরতে যাবে তাও দুই সপ্তাহের জন্যে? ব্যপারটা কেউই ঠিকভাবে হজম করতে পারছেনা। কুহু বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। কিন্তু রুদ্র স্বাভাবিক। এবং স্বাভাবিকভাবেই বলল, ‘কিন্তু বাবা, এতগুলো দিন থাকার কী দরকার?’

রাশেদ বললেন, ‘দরকার আছে। মেয়েটা বিয়ের পর থেকেই বাড়িতেই আছে। যাও ওকে নিয়ে একটু আলাদা সময় কাটিয়ে এসো। দুজনের মন ফ্রেশ হবে।’
রুদ্র আর কিছু বলল না। প্রিয়তা মাথা নিচু করে মুচকি হেসে চলে গেল রান্নাঘরে। জ্যোতি ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। স্বাভাবিক হতে চায় ও। সবটা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে চায়। কিন্তু মন কী মস্তিষ্কের কথা মানে? সে যে বড্ড বেহায়া। তাইতো আজও জ্যোতির হৃদয় পোড়ে। দম আটকে আসে। মন খুলে কাঁদতে ইচ্ছে করে। তীব্র অভিমানী মন বারবার একই প্রশ্ন করে, আমায় কেন ভালোবাসলে না রুদ্র?

রাশেদ আর জাফর বেরিয়ে যেতে উচ্ছ্বাস রুদ্রর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘হানিমুন মোবারক বস।’
কুহু শব্দ করে হাতে তালি দিয়ে উঠল। রুদ্র গম্ভীর এক চাহনী দিয়ে দুজনকেই চুপ করিয়ে দিলো। ঘন্টাখানেকের মধ্যে আমের ভিলার সকলেই যে যার যার কাজে বেরিয়ে পড়ল।

রাতে আমের ফাউন্ডেশন থেকে একসঙ্গেই বের হলো রুদ্র আর উচ্ছ্বাস। হঠাৎই বেশ ঠান্ডা পড়ে গেছে। বারবার হাতের তালু ঘষছে দুজন। রুদ্র জিপে উঠতে নিয়ে দেখল উচ্ছ্বাস অন্যদিকে যাচ্ছে। রুদ্র ‘উচ্ছ্বাস’ বলে ডাকতেই উচ্ছ্বাস দাঁড়িয়ে গেল। পেছন ঘুরে রুদ্রর দিকে এগোতে এগোতে বলল, ‘কিছু বলবি?’
রুদ্রও দু কদম এগিয়ে এসে বলল, ‘যাচ্ছিস কোথায়?’
‘জানিসই তো।’

‘আজ এমনিতেই ভীষণ ঠান্ডা পড়েছে। বারে যেতে হবেনা। বাড়ি চল।’
উচ্ছ্বাস হাসল। রুদ্রর চোখে চোখ রেখে বলল, ‘ভয় পাস না। বারেই যাচ্ছি। ইনফরমেশন লিক করতে না।’
রুদ্র রেগে গেল। ভ্রু কুঁচকে তাকাল উচ্ছ্বাসের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘একটা থাপ্পড় মেরে দেব কিন্তু। বাড়াবাড়ি হচ্ছে এবার। তুই আমার সিচুয়েশন টা বুঝছিস না।’

উচ্ছ্বাস এখনো হাসছে। হাসি মুখেই বলল, ‘বুঝেছিতো। কিন্তু কী বলতো? লজিক ব্যপারটা মস্তিষ্কের জন্যে তৈরী। মনের জন্যে নয়। লজিক মস্তিষ্ক নিজ দায়িত্বে বুঝে নেয়। কিন্তু মনতো শুধু আবেগটাই বোঝে। মন লজিক বুঝতে চায়না, জোর করে মানাতে হয়। তোর সিচুয়েশনটা মগজকে বুঝিয়ে দিয়েছি। সে বুঝেছেও। কিন্তু মনকে মানাতে একটু সময় লাগছে। ভাবিস না। একটু সময় দে। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

কথাটা বলে রুদ্রর কাঁধে হাত রাখল উচ্ছ্বাস। ওর ঠোঁটে হাসি থাকলেও চোখের বিষণ্নতা রুদ্রর নজর এড়ালোনা। মনে অদ্ভুত এক ব্যথা অনুভব করল রুদ্র। উচ্ছ্বাস আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেল নিজের গন্তব্যে। রুদ্র ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল। এরপর জিপে উঠে নিজেও বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল।

রুদ্র রুমে এসে দেখল প্রিয়তা ব্যাগ গোছাচ্ছে। ভালোভাবে খেয়াল করে বুঝল কালকে বের হওয়ারই প্রস্তুতি নিচ্ছে। রুদ্র মৃদু হেসে এগিয়ে গেল। পেছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরল প্রিয়তাকে। রুদ্রর ঠান্ডা হাতের স্পর্শে প্রিয়তা মৃদু কেঁপে উঠল। কিন্তু মুখে কৃত্রিম বিরক্তিভাব ফুটিয়ে বলল, ‘এসেই শুরু করেছেন? দেখছেন না কাজ করছি?’
রুদ্র ছাড়লো না। আরও আয়েশ করে প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে থুতনি রেখে বলল, ‘আমাকে কাজ দেখাচ্ছো? সেইতো আমার সঙ্গে প্রাইভেট সময় কাটানোর জন্যেই প্রস্তুতি নিচ্ছো। একান্তে।’

শেষের শব্দটা রুদ্র খানিকটা ইঙ্গিতপূর্ণভাবেই বলল। কিন্তু প্রিয়তা বিন্দুমাত্র লজ্জা পেলোনা। বরং রুদ্রকে ছাড়িয়ে চলে গেল কাবার্ডের কাছে। আর পোশাক বের করতে করতে বলল, ‘তাও ভালো। বাবাতো একটু একান্তে সময় কাটাতে পাঠাচ্ছেন আমাদের। কিন্তু আপনি? বাবা না বললেতো এ জীবনে আর এসব কিছু ভাবতেন না। আনরোম্যান্টিক গোমড়ামুখো একটা!’
কথাগুলো বলে আবার লাগেজে কাপড় রাখায় মনোযোগ দিল প্রিয়তা। রুদ্র কোমরে হাত দিয়ে, ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল প্রিয়তার দিকে। ওর দিকে তাকিয়ে থেকেই বিছানায় বসে বলল, ‘আমি আনরোম্যান্টিক।’

প্রিয়তা থেমে গেল। বিরক্তিমাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘কোন সন্দেহ আছে আপনার?’
রুদ্র বিছানায় হেলান দিয়ে বসে বলল, ‘কাজগুলো শেষ করে কাছে এসো। তারপর বোঝাচ্ছি রোম্যান্টিকতা কাকে বলে।’
প্রিয়তা রুদ্র হুমকিকে বিন্দুমাত্র পাত্তা দিলোনা। নিজের কাজ করতে করতেই বলল, ‘হ্যাঁ। ঐ অবধিই দৌড় আপনার। সবজায়গাতে গুন্ডামিটাই করতে জানেন। সেটা রাস্তা হোক বা বেডরুম।’

‘আমি গুন্ডামি করি?’ অবাক হয়ে বলল রুদ্র।
প্রিয়তা হেসে ফেলল। লাগেজটা বন্ধ করে বলল, ‘এই কথাটা জিজ্ঞেস করে আর হাসাবেন না। শুনে মনে হচ্ছে বাদর বলছে, “কী! আমি গাছে গাছে লাফাই?”।’
রুদ্র উঠে দাঁড়িয়ে প্রিয়তাকে ধরতে নিল। কিন্তু পারল না। তার আগেই এক ছুটে ওয়াশরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো প্রিয়তা। রুদ্র হেসে ফেলল। বিছানায় বসে চেঁচিয়ে বলল, ‘বের হও একবার। তারপর দেখাচ্ছি।’

পরেরদিন বেশ ভোরবেলায় রান্নাবান্নার তোড়জোড় চলছে। রুদ্র আর প্রিয়তা তাড়াতাড়ি বের হবে। ওদেরকে সময়মতো খাবার দেওয়ার জন্যেই এতো তাড়াহুড়ো। রান্না জ্যোতি করছে। হাতে হাতে সাহায্য করছেন নার্গিস বেগম। একটা সাদা টিশার্ট আর নীল শর্টস্ পরে হাই তুলতে তুলতে কিচেনে এলো উচ্ছ্বাস। জ্যোতির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বউমনি ওঠেনি?’
‘উঠেছে। বের হবেতো। তাই তৈরী হচ্ছে।’
‘অহ! তাহলে কফিটা তুই করে দেনা প্লিজ।’

‘দুধ-পানি গরম করাই আছে। শুধু কফি আর চিনিটা মেশাতে হবে। আমি দিয়ে দিচ্ছি। নিজে একটু করে নাও প্লিজ।’
‘দে।’
জ্যোতি দ্রুত হাতে সবকিছু এগিয়ে দিল। উচ্ছ্বাস কফি বানাচ্ছে। নার্গিস বেগম বললেন, ‘সাধে কী আর বলেছি। বাদশা আর গোলাম এক পেরেসাদে থাকলে কী হবে? বাদশা বাদশাই থাকে। আর গোলাম সারাজীবন গোলামি-ই করে। নিজের ছেলের বিয়ে দিল। এখন আবার ঘুরতেও পাঠাচ্ছে।

কদিন পর আবার বাচ্চাকাচ্চাও হবে। কিন্তু এইযে এই ছেলেটার বয়স হচ্ছে। ওরও একটা ভবিষ্যি আছে। সেটা ভেবে দেখেছে? কিছু করেছে ছেলেটার জন্যে? করেনি। র’ক্ত, র’ক্তই হয়।’
কথাটা বলে বাসন হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন নার্গিস। বিরক্তিতে জ্যোতির কপাল কুঁচকে এলো। এই মহিলা যখনই কথা বলে বিষাক্ত কথাই বলে। একটা ভালো শব্দ যদি এর মুখ দিয়ে বের হতো। কিন্তু অবাক করা বিষয় আগের বারগুলোর মতো আজ উচ্ছ্বাস কোন দাঁতভাঙা জবাব দিলোনা। চুপচাপ শুনে গেল কেবল। জ্যোতি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, ‘তুমি ঠিক আছো?’

‘হুম? হুম ঠিকই আছি।’ চামচ দিয়ে কফি মেশাতে মেশাতে হেসে বলল উচ্ছ্বাস।
‘কাল নাজিফাকে দেখলাম।’
‘ওহ। ‘
‘ তুমিও দেখেছো। দু মাস আগে শপিং করতে গিয়েছিলাম তখন। তাইনা?’

উচ্ছ্বাস কিছু বলল না। ঠোঁটে মুচকি হাসি। তবে কফি মেশানোর গতি বেরে গেছে। দুমাস আগে শপিং মলে দেখেছিল উচ্ছ্বাস নাজিফাকে। ওর ভাবীর সঙ্গে ছিল। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল সে গর্ভবতী। নাজিফার দেখা পেয়ে চোখের শান্তি যেমন পেয়েছে। ওকে গর্ভবতী অবস্থায় দেখে বুকের মধ্যকার চিনচিনে ব্যথাটাও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। ঐ সন্তানের বাবা তো ওর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হায় নিষ্ঠুর নিয়তি! ভাবে এক হয় আরেক। উচ্ছ্বাস কয়েক সেকেন্ডের বেশি তাকায়ই নি নাজিফার দিকে। তবে নাজিফা যে সুখে আছে সেটাই কম কী?

জ্যোতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘কয়েক সেকেন্ডের জন্যেই দেখতে পেলাম। রিকশায় ছিল। একা। দেখেতো মনে হলো সাত-আট মাসের গর্ভবতী। এই সময়ে একা একা কেন বের হয়েছে বুঝতে পারলাম না।’
উচ্ছ্বাস কোন জবাব দিলোনা। ওর কফি করা শেষ। মগটা নিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে গেল রান্নাঘর থেকে। সেদিকে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলল জ্যোতি। উচ্ছ্বাসের যন্ত্রণাটা বুঝতে পারে ও। দুজনেই তো প্রেমে ব্যর্থ হওয়া অভাগা মানব-মানবী।

একঘন্টার মধ্যেই খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বের হওয়ার জন্যে তৈরী হলো রুদ্র-প্রিয়তা। ওদের ঘুরতে যাওয়া নিয়ে কুহুর উত্তেজনা সবচেয়ে বেশি। সকাল থেকেই আনন্দে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। রুদ্র-প্রিয়তা রাশেদ আর জাফরকে সালাম দিল। উচ্ছ্বাস আর জ্যোতির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এলো কুহুর কাছে। কুহু হাসিমুখে রুদ্রকে ইশারা করে বলল, ‘ভাইয়া তোরা ফিরে আসতে আসতে আমার জন্মদিন চলে যাবে। আমার গিফট চাই কিন্তু।’

‘কী চাই বল।’
‘কক্সবাজার যাচ্ছিস তো। আমার জন্যে সুন্দর সুন্দর ঝিনুকের গহনা কিনে আনবি। অনেকগুলো করে।’
রুদ্র মুচকি হেসে কুহুকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আচ্ছা। আর কিছু?’
কুহু মাথা নেড়ে না করল। প্রিয়তা কুহুকে বলল, ‘শুধু ভাইয়ার কাছেই সব আবদার? আমার কাছে চাইবেনা?’
কুহু প্রিয়তার হাত ধরে একটান দিয়ে সাইডে নিয়ে এলো। প্রিয়তা ভ্রু নাচিয়ে বোঝালো, কী? কুহু ইশারায় বলল, ‘এবার ফিরে এসে একটা ছোট্ট বাবু গিফট করো। তাহলেই হবে।’

প্রিয়তা চোখ বড়বড় করে তাকালো কুহুর দিকে। একহাতে কান মুলে দিয়ে বলল, ‘পাঁজি মেয়ে!’
কুহু হাসল। নিঃশব্দ কিন্তু প্রাণখোলা হাসি। সে হাসি দেখে রুদ্র আর প্রিয়তা দুজনেই শান্তি পেলো।
সকলের কাছ থেকে আরও একবার বিদায় নিয়ে আমের ভিলা থেকে বেরিয়ে পড়ল রুদ্র-প্রিয়তা।

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫৩

কিন্তু রুদ্র জানলো না ওদের এই যাত্রার সঙ্গেসঙ্গেই আমের ভিলা আর সোলার সিস্টেমের ধ্বংসের যাত্রা শুরু হলো। এরপর যা হবে, শুধুই বিনাশ। সেই মর্মান্তিক বিনাশের একবিন্দুও যদি টের পেতো, তাহলে রুদ্র ভুল করেও যেতোনা। কখনও না।

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫৪