অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫৩

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫৩
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল 

সময় যেন স্রোতের চেয়েও তীব্র গতিতে ছুটল। দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল আরও দুটো মাস। নভেম্বর প্রায় শেষের দিকে। ডিসেম্বর আসতে চলেছে। ইতিমধ্যে শীতের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। দিন ছোট হয়ে আসছে। সন্ধ্যা তাড়াতাড়ি হচ্ছে। বেলা তখন পাঁচটা বাজে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা নামবে। নিজের কেবিনে বসে কাজ করছিলেন রাশেদ। একা। দরজার কাছে রুদ্র এসে দাঁড়াল। কয়েক সেকেন্ড দেখে নিয়ে বলল, ‘বাবা আসব?’

‘এসো।’ নিজেকে কাছে ব্যস্ত রেখে অন্যমনস্ক হয়ে বললেন রাশেদ।
রুদ্র ভেতরে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে বলল, ‘ডেকেছিলেন?’
‘হুঁ।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নিজের কাজে মনোযোগ ধরে রেখেই বললেন রাশেদ। এখনো রুদ্রর দিকে তাকায়নি। রুদ্রও চুপচাপ বসে অপেক্ষা করল। প্রায় তিন মিনিট পর ফাইল বন্ধ করলেন রাশেদ। চশমা খুলে টেবিলের ওপর রেখে তাকালেন রুদ্রর দিকে। রুদ্র শিরদাঁড়া সোজা করে বসল। রাশেদ একটা শ্বাস ফেলে বললেন, ‘ইকবাল এখনো নিখোঁজ, তাইতো?’
‘জ্বি। পালিয়েছে, নয়তো অপরপক্ষ ওনাকে মেরে ফেলেছে। যদি দ্বিতীয় ব্যপারটা ঘটে থাকে তাহলে বেঁচে গেল। কিন্তু যদি বেঁচে থাকে তাহলে সেটা ওনার দুর্ভাগ্য।’

শেষের কথাটা বলতে গিয়ে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো রুদ্রর। রাশেদ বললেন, ‘খারাপ লাগবেনা তোমার?’
‘বিশ্বাসঘাতককে নিজের হাতে মারতে খারাপ লাগেনা আমার। সে যে-ই হোক। বরং ওদের সহজ মৃত্যুটাই আমার সহ্য হয়না। আমার-ই পিঠে ছু’রি মেরে কয়েক সেকেন্ডের কষ্টেই মুক্তি পেয়ে যাবে সেটা মানতে পারিনা আমি।’
কথাগুলো আক্রোশ নিয়ে বললেও রাশেদের উপস্থিতি মনে পড়তেই একটু ইতস্তত করে চুপ হয়ে গেল রুদ্র। রাশেদ লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলল, ‘এই সপ্তাহের মধ্যে ডেলিভারী আসছে। সমুদ্রপথে। মনে আছে?’

‘আছে।’
‘কী ভাবলে?’
‘এবারের মাল আনা আর ডেলিভারী দেওয়াটা ব্যবসার জন্যে হবেনা। আসল গন্ডোগোলটা ঠিক কোথায় হচ্ছে সেটা জানার জন্যেই হবে। প্রতিটা চেকপোস্টের আগে এবং যেখানে যেখানে মাল নামানো হয় সেখানে আমাদের লোক লুকিয়ে থাকবে। তাদের কাজ হবে এটা দেখা যে আসল সমস্যাটা ঠিক কোথায় হচ্ছে।’
রাশেদ কিছুক্ষণ ভাবলেন। ভেবে বললেন, ‘ইকবাল নেই। সুতরাং ওদের কোন ইনফরমারও নেই। তবুও কী এসবের দরকার আছে?’

‘আছে। আর কোন ইনফরমার যে সত্যিই নেই। সেটাই দেখতে হবে আমাকে।’
রাশেদ মাথা ঝাঁকালেন। রুদ্র এবার একটা বড় কাগজ মেলে রাখল টেবিলে। যেখানে কক্সবাজারের ম্যাপ আছে। রুদ্র কোথা থেকে মাল তোলা হবে। কোথায় কোথায় নামানো হবে। ওদের লোক কোথায় বসে নজর রাখবে। এবং কোনরকম গন্ডগোল কীভাবে একশন নেওয়া হবে সবটাই খুটিয়ে খুটিয়ে বুঝিয়ে বলল রাশেদকে।

পরিকল্পনা পছন্দ হয়েছে রাশেদের। কিন্তু তার মুখভঙ্গি দেখে সেটা বোঝা গেলোনা। সবটা ব্যাখা করার পর রুদ্র বলল, ‘আর এই ব্যপারটা আপনি আর আমি ছাড়া দলের আর কেউ জানবেনা। এটাই আমাদের প্রথম একশন যেখানে দলের অন্যকাউকে আমরা কিছুই টের পেতে দিচ্ছি না।’
রাশেদ কিছু বললেন না। আবার চশমা পড়ে একটা ফাইল হাতে নিয়ে বললেন, ‘আমার ভরসা আছে তোমার ওপর। তুমি সব ঠিকঠাক করবে। আমার কথা শেষ। তোমার কিছু বলার আছে?’

‘না বাবা।’
‘তাহলে যাও। আমার বাড়ি ফিরতে ঘন্টা দুই লাগবে।’
রুদ্র চলে যেতে নিলেই রাশেদ বলে উঠল, ‘তোমার প্রতিপক্ষ এবার শওকত মীর্জা। কথাটা ভুলে যেওনা রুদ্র।’
রুদ্র দাঁড়িয়ে গেল। মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল ওর। শক্ত কন্ঠে বলল, ‘আমি আপনার ছেলে। যদি ম’রি, সবাইকে মে’রেই মরব।’
কথাটা বলে রাশেদের কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল রুদ্র। রাশেদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন। কিন্তু মনোযোগ দিতে পারলেন না বোধ হয়।

ঘটনাটা পাঁচবছর আগের। তখনও ব্লাক হোলের সঙ্গে সোলার সিস্টেমের ব্যবসায়ীক সম্পর্ক আছে। পার্টনারশিপ থাকলেও অভ্যন্তরীণ কিছু ছোটখাটো ঝামেলা লাগতে শুরু করেছিল। তখন সবে আন্ডারওয়ার্ল্ডে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করছে রুদ্র। অপরদিকে শওকত মীর্জার ডার্ক নাইট দলটা তখন তুলনামূলক যথেষ্ট দুর্বল ছিল।

একবার সোলার সিস্টেমের জন্যে আসা প্রায় কয়েক লাখ টাকার মাল চুরি করে নিয়ে যায় ডার্ক নাইট। এক্ষেত্রে তারা একটা ট্রিক ব্যবহার করে। বাইরোডে মাল নিয়ে পালানো মুশকিল হবে। সেটা তারা জানতো। তাই ট্রাকে সামান্য কিছু মালই বাই রোডে পাঠায়। আসল মালগুলো নিয়ে ট্রেনে করে পালানোর চিন্তা করে শওকত। একটা গোটা কম্পার্টমেন্ট বুক করে পালিয়ে যাচ্ছিল শওকত। সাথে ছিল মাত্র দুজন।

শওকত মীর্জা স্বয়ং মাল নিয়ে যাবে, তাও একা। এটা চিন্তা করাও বেশ কঠিন ছিল। কিন্তু কীভাবে যেন ওদের পরিকল্পনা আন্দাজ করে ফেলে রুদ্র। তাই বাকিলোকগুলোকে ট্রাকের পেছনে পাঠালেও নিজে একা যায় সেই ট্রেনে। তখন মধ্যরাতে মাঝের কোন একটা স্টেশন থেকে উঠে পড়ে ট্রেনে। সুযোগ বুঝে ঢুকে পড়ে সেই কম্পার্টমেন্টে। সাইলেন্সার লাগানো বন্দুক থাকায় বাকি দুজনকে ঘায়েল করতে সময় লাগেনি রুদ্রর।

শওকতের সঙ্গেও সেদিন ভয়ানক এক সংঘর্ষ হয় ওর। মারমারির একপর্যায়ে ট্রেন থেকে পড়ে যেতে নেয় শওকত। রুদ্র হাত ধরে ফেলে। শওকতের সেই অবস্থা দেখে বাঁকা হেসে বলে, ‘আপনার জীবন মৃত্যু এখন আমার বাঁ হাতের ওপর নির্ভর করছে মীর্জা। কী বলেন? কোনটা দেব আপনাকে? জীবন নাকি মৃত্যু?’

মৃত্যুকে এতো কাছে দেখে ভয় পেয়ে যান শওকত। রুদ্রর কাছে প্রাণ ভিক্ষা চায়। আকুতি ভরা কন্ঠে বলে, ‘আমাকে মেরোনা রুদ্র। আমি আর কখনও তোমাদের দলের বিষয়ে নাক গলাবো না। এবারের মতো ক্ষমা করে দাও। প্রাণ ভিক্ষা চাইছি আমি।’

কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তখনই রুদ্রর হাত স্লিপ করে যায়। আর চলন্ত ট্রেন থেকে পড়ে যান শওকত মীর্জা। এবং সেই দুর্ভাগ্যকে আরেক ধাপ বাড়িয়ে দিয়ে ওপর পাশ থেকেও আরেকটা ট্রেন ছুটে আসে। ব্যপারটায় হতভম্ব হয়ে যায় রুদ্র। ও চায়নি শওকতের হাত ছেড়ে দিতে। কিন্তু কীভাবে স্লিপ করে গেল ও বুঝতে পারেনি। পরের স্টেশনে নিজেদের মাল নিয়ে নেমে যেতে পারলেও মনে খচখচানি রয়েই গিয়েছিল ওর। পরে খবর নিয়ে জেনেছিল প্রাণে বেঁচে গেছেন শওকত। কিন্তু নিজের একটা পা হারিয়েছেন। ট্রেনের নিচে কা’টা পরেছে তার বাঁ পা। ব্যপারটায় কিছুটা হলেও খারাপ লাগে রুদ্রর। আজও ঐ ঘটনার জন্যে আফসোস হয় ওর। কিঞ্চিৎ কুলসিত বোধ করে।

অপরদিকে নিজের এই পরিণতির জন্যে রুদ্রকে মনে প্রাণে দায়ী করেন শওকত। আজও রুদ্রর প্রতি তীব্র ঘৃণা পুষে রেখেছে নিজের মনে। এতো বছর যাবত শুধু অপেক্ষা করে যাচ্ছে। প্রতিশোধের অপেক্ষা!

সন্ধ্যা সন্ধ্যাই বাড়ি ফিরে এলো রুদ্র। বাইরে বিশেষ কোন কাজ নেই। তারওপর প্রিয়তাও কল রিসিভ করছেনা। বাড়ি ফিরে বসার ঘরে প্রিয়তাকে না পেয়ে অবাক হল রুদ্র। এইসময় প্রিয়তা নিচেই থাকে। রান্নাঘরের দিকে উঁকি দিয়েও প্রিয়তার কোন সন্ধান না পেয়ে জ্যোতিকে জিজ্ঞেস করল, ‘প্রিয়তা কই?’
জ্যোতি একবার ওপরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আর বলোনা। বিকেল থেকেই শরীরটা খারাপ ওর। বলল ভালো লাগছেনা। একটু আগে দেখে এলাম ঘুমোচ্ছে।’

রুদ্র ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘সিরিয়াস কিছু?’
‘দেখেতো মনে হলোনা। সবসময় কী আর শরীর ঠিক থাকে?’
‘কাউকে দিয়ে ঘরে দু কাপ কফি পাঠিয়ে দে।’
বলে রুদ্র উপরে চলে এলো। রুমে এসে দেখে প্রিয়তা ঘুমোচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে প্রিয়তার মাথায় হাত রাখল রুদ্র। প্রিয়তা হালকা নড়ে। শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক। রুদ্র ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এলো। দশ মিনিট পর বেরিয়ে এসে দেখল কফি দিয়ে গেছে কেউ। রুদ্র প্রিয়তার কাছে গিয়ে বসল। মৃদু গলায় ডাকল, ‘প্রিয়?’

দ্বিতীয়বার ডাকতে হলোনা। প্রথমে ভ্রু কুঁচকে হালকা নড়ে উঠল। এরপর আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকাল প্রিয়তা। রুদ্রকে দেখে চমৎকার করে হাসল। প্রেয়সীর হাসি দেখে রুদ্রও হাসল। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে নরম কন্ঠে বলল, ‘এই অসময়ে ঘুমোচ্ছো যে? খারাপ লাগছে?’
প্রিয়তা ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল, ‘কখন এলেন?’
‘মাত্রই।’

প্রিয়তা বিছানায় ভর দিয়ে উঠে বসল। রুদ্রও সাহায্য করল। হাত বাড়িয়ে টি-টেবিল থেকে চুলের ক্লিপটা নিয়ে চুল বাঁধল। একটা হাই তুলে বলল, ‘আপনি বসুন। আমি কফি নিয়ে আসছি।’
‘কফি আনিয়েছি আমি। তোমার কী শরীর খারাপ লাগছে?’
‘না, তেমন কিছু না। ক্লান্ত লাগছিল খুব। খেয়ে শুয়েছিলাম কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা। কেউ ডাকেও নি।’
‘আচ্ছা যাও। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে এসো। কফি ঠান্ডা হয়ে যাবে।’
প্রিয়তা বিছানা থেকে নামল। ওয়াশরুমে যেতে নিয়েও থেমে গেল। রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘শুনুন না। আপনি ফ্রি আছেন কবে?’

রুদ্র ফোন দেখছিল। ফোনে চোখ রেখেই বলল, ‘কেনো বলোতো?’
‘একটু ডাক্তারের কাছে যেতাম।’
রুদ্র ফোন রেখে ভ্রু কুঁচকে তাকাল প্রিয়তার দিকে। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কী হয়েছে প্রিয়? আর ইউ ওকে? কিছু বলছোও না। সমস্যা কী?’
প্রিয়তা হেসে বলল, ‘আরে আপনি এতো টেনশন করছেন কেন? এমনিতে একদম ফিট আছি আমি। একটা রুটিন চেকআপ করিয়ে নেব। এই আরকি।’

‘শিওর?’
‘ইয়া।’
‘আচ্ছা আমি তাড়াতাড়ি একদিন ম্যানেজ করে নিচ্ছি। তুমি তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে আসো।’
প্রিয়তা ওয়াশরুমে চলে গেল। রুদ্র কয়েক সেকেন্ড ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে আবার ফোন দেখতে লাগল। অপেক্ষা করল প্রিয়তার বেরিয়ে আসার।

দুদিন পর। গোধূলি লগ্ন। ঠান্ডা ফুরফুরে হাওয়া আসছে উত্তর দিক থেকে। কিছুক্ষণ পরপরই একেকটা পাখির ঝাক একেকদিকে উড়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। রুদ্র আর উচ্ছ্বাস দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। দুজনের দৃষ্টি রক্তিম আকাশের দিকে আটকে আছে। পকেট থেকে সিগারেটের একটা প্যাকেট বের করল উচ্ছ্বাস। দুটো সিগারেট বের করে একটা বাড়িয়ে দিল রুদ্রর দিকে। রুদ্র হাত বাড়িয়ে সিগারেটটা নিয়ে ঠোঁটের মাঝে চেপে ধরল। পকেট থেকে লাইটার বের করে ধরালো সিগারেটটা। উচ্ছ্বাসও ততক্ষণে নিজের সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছে। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে রুদ্র বলল, ‘হঠাৎ ছাঁদে ডাকলি যে? কিছু বলবি?’

উচ্ছ্বাসের দৃষ্টি এখনো আকাশের দিকে স্হির। ও ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে রেখে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, ‘কিছু দেওয়ার ছিল তোকে।’
‘কী?’
উচ্ছ্বাস আবার নিজের পকেটে হাত দিলো। হাতটা বের করার পর রুদ্র তাকাল। তাকিয়ে চমকে উঠল। কারণ উচ্ছ্বাসের হাতে ছোট্ট একটা মাইক্রোফোন। উচ্ছ্বাস এতক্ষণে তাকাল রুদ্রর দিকে। মুচকি হাসি দিয়ে বলল, ‘এটা।’

রুদ্র কী বলবে বুঝতে পারল না। ইকবালের ঘটনার পর দলের বাকি প্রধান দুজন অর্থাৎ উচ্ছ্বাস আর জাফরের হোলস্টারেও মাইক্রোফোন লাগিয়ে রেখেছিল উচ্ছ্বাস। এমন নয় যে ওদেরকে ও অবিশ্বাস করে। কিন্তু তবুও ভেতরের ইনফরমেশগুলো আরও কেউ লিক করছে কি-না তা না জানা অবধি শান্তিতে শ্বাসও নিতে পারছেনা ও। আর পুরো ঘটনাটা পুরোপুরি ক্লিয়ার হওয়ার জন্যেই এরকম একটা পদক্ষেপ নিতে হয়েছে ওকে।

ও ভেবেছিল ঝামেলাটা মিটে গেলেই আবার সরিয়ে নেবে ওগুলো। কিন্তু উচ্ছ্বাস যে টের পেয়ে যাবে সেটা বুঝে উঠতে পারেনি। বলার মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে চুপ হয়ে গেল রুদ্র। প্রথমবার উচ্ছ্বাসের চোখে চোখ মেলাতে পারল না। জড়তা জাপটে ধরল সর্বাঙ্গকে। উচ্ছ্বাসের ঠোঁটে এখনো হাসি লেগে আছে। ও হাত উঁচু করে নিজের সামনে এনে দেখল মাইক্রোফোনটা। রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এটার কাজ শেষ বস? নাকি আরও কিছুদিন রাখব সাথে?’

রুদ্র লম্বা শ্বাস ফেলে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকাল। অনেক কষ্টে নিজের ইতস্তত ভাব দূর করে বলল, ‘দেখ ভাই, এটা দরকার ছিল। আমি কাকার হোলস্টারেও রেখেছি। বিশ্বাস কর।তোকে আমি অবিশ্বাস করছিনা। কিন্তু..’
উচ্ছ্বাস রুদ্রর কথার মাঝেই হেসে ফেলল। সকৌতুকে বলল, ‘আরে ভাই তুই আমাকে এক্সপ্লেইন করছিস কেন? তুই দলের লীডার। তুই উল্টে আমাদের কাছে এক্ষপ্লেনেশন চাইবি। আর আমরা সেটা দিতে বাধ্য। তা-না, নিজেই জবাবদিহি করছে। পাগল ছেলে।’

উচ্ছ্বাস কথাটা যতটা স্বাভাবিকভাবে বলল ঠিক ততটাই অস্বাভাবিক লাগল রুদ্রর কাছে। এই চারপাঁচটা লাইনে যে তীব্র অভিমান মেশানো ছিল সেটা বুঝতে রুদ্রকে বেগ পেতে হয়নি। রুদ্রর খারাপ লাগল। উচ্ছ্বাস আবারও তাকিয়ে রইল খোলা আকাশের দিকে। ঘনঘন টান দিচ্ছে সিগারেটে। রুদ্র কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে দেখল ওকে। রুদ্র কখনই নিজেকে ব্যখ্যা করতে পারেনা। গুছিয়ে কথা বলতে পারেনা। তবুও মনে মনে যথাসম্ভব নিজের কথাগুলো গোছানোর চেষ্টা করে বলল, ‘উচ্ছ্বাস, তুই আমাকে ভুল বুঝছিস। আমি সত্যিই সেরকম কিছু ভেবে কাজটা করিনি। আমি তোকে বোঝাতে পারবনা ব্যপারটা।’

‘তাহলে কী ভেবে করেছিলি?’ নির্লিপ্ত কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ল উচ্ছ্বাস।
জবাব দিতে পারল না রুদ্র। কীভাবে ব্যপারটা উচ্ছ্বাসকে বোঝাবে নিজেই বুঝতে পারল না। মনে মনে অস্হির হলো। না সেই অস্হিরতা চেহারায় প্রকাশ পেল, না মুখে কিছু বলতে পারল। উত্তর না পেয়ে আবার হাসল উচ্ছ্বাস। সিগারেটে লম্বা এক টান দিয়ে বলল, ‘ছাড় না! আমি কিছু মনে করিনি। মনে করার কথাও না। আজকালতো নিজের মায়ের পেটের ভাইকেও বিশ্বাস করা যায়না। সেখানে রাস্তায় ‘টোকাই’ বলে পরিচিত এক ছেলেকে বাড়িতে তুলে এনে উচ্ছ্বাস বানালেই কী আর সে ঘরের ছেলে হয়? বিশ্বাসে খুত থাকা জায়েজ।’

‘উচ্ছ্বাস আমি_’
‘তুই আবার এক্সপ্লেইন করছিস! বললাম তো ঠিকই আছে। আর আমি কিছু মনে করার বা রাগ করার কে? বরং তোর স্ট্রাটেজির প্রশংসা করতে হয়। এই না হলে রুদ্র আমের। এতো বড় একটা দল সামলাস। আবেগে ভেসে বেরালে চলবে কেন? ঠিকই আছে।’

তারপর সেই মাইক্রোফোনটা আবার নিজের পকেটে রেখে বলল, ‘এইযে এটা আমার কাছে থাকল। যতদিন তোর দরকার মনে হবে এটা আমার কাছেই থাকবে। আর যখন যখন চেঞ্জ করার দরকার হবে কষ্ট করে, প্লান করে লুকিয়ে চেঞ্জ করার দরকার নেই। আমাকে বললেই হবে। এইটুকু বিশ্বাস করতেই পারিস। যদিও সেটা তোর ওপর ডিপেন্ড করছে। তোর ইচ্ছে হলে বিশ্বাস করিস নয়তো করিস না।’

রুদ্র নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল। উচ্ছ্বাস একবারও তাকিয়ে দেখছে না রুদ্রকে। হাত অস্বাভাবিকভাবে চলছে ওর। কখনও নাক চুলকোচ্ছে, চুল ঠিক করছে, হাতের তালু ঘষছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে উচ্ছ্বাস। আঘাতটা মনে লেগেছে হয়তো। লাগারই কথা। সিগারেটটা নিচে ফেলে পা দিয়ে পিষে উচ্ছ্বাস ব্যস্ত কন্ঠে বলল, ‘আমি নিচে গেলাম বুঝলি। কফি খেতে ইচ্ছে করছে।

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫২

বউমনির হাতের কফি খেলেই শরীর চাঙা হয়ে যাবে। আসি বস।’
কথাটা বলে একসেকেন্ডও দাঁড়াল না উচ্ছ্বাস। রুদ্রও ওর যাওয়ার দিকে তাকাল না। তাকিয়ে রইল মুক্ত আকাশের দিকে। আরেকটা সিগারেট জ্বালালো। মনটা খারাপ হয়ে গেছে রুদ্রর। ইচ্ছে করছিল উচ্ছ্বাসকে শক্ত করে একবার জড়িয়ে ধরতে। আজ ছেলেটাকে যে আঘাত ও করেছে, স্নেহের স্পর্শে সেই আঘাত একটু হলেও লাঘব করতে। কিন্তু অজানা কারণেই পারল না। নিজের ওপরই হঠাৎ ভীষণ রাগ হলো রুদ্রর। ওদের জন্যে যেই ছেলেটা নিজের ভালোবাসা বিসর্জন দিল, তার সঙ্গে এতোবড় অবিচার করা ওর উচিত হয়নি। যেখানে ও নিজেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারছেনা, সেখানে উচ্ছ্বাস কীকরে ক্ষমা করবে?

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৫৪